Search

Wednesday, July 11, 2018

ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক বিশিষ্টজনদের


বর্তমানে দেশে এক ধরনের বিচারহীন ও জবাবদিহিতা শূন্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে রেখেছে। জনগণের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামকে পুলিশি নির্যাতন ও দলীয় পেটোয়া বাহিনী (গুন্ডাবাহিনী) দিয়ে দমন করে রাজনৈতিক মতামতকে সংকুচিত করে রেখেছে। এর জন্য নাগরিকদের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধের সংগ্রাম করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বি‌শিষ্টজনেরা। 

বুধবার, ১১ জুলাই, দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটি আয়োজিত ‘ফ্যাসিবাদ ও জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।

সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগের বর্বর হামলা, নির্যাতন, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, আহতদের চিকিৎসায় সরকারি কর্তৃপক্ষের বাধা দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আলোচকগণ ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা এবং নির্যাতনকারীদের রক্ষা করে তাদের সহায়তা করার তীব্র নিন্দা জানান। 

বৈঠকে বক্তারা বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে র‌্যাব-পুলিশ বাহিনী দিয়ে সারা দেশে এ পর্যন্ত ১৬৩ জনকে বিনা বিচারে ও পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এখনও সেটি চলমান রয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের লাগামহীন দুঃশাসন ও লুটপাটের অপরাধকে আড়াল করতে এক ধরনের ত্রাস সঞ্চারের জন্য বিনা বিচারে মানুষ খুন করার এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’ 

বামপন্থি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বদরুদ্দীন ‍উমর বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্বরোচিত যেসব কাজ হচ্ছে সেগুলো বিশ্বের অন্য কোনও দেশে হচ্ছে না। আজকে যারা ব্যবসায়ী শ্রেণি, যারা লুটপাট করছে তারাই দেশের শাসক শ্রেণি। তারা নিজেদের চুরির টাকা দিয়ে নমিনেশন নিয়ে ভোট লুট করে ক্ষমতায় বসছেন।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটা গুন্ডাবাহিনী। তারা নানা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো তাদের পেছনে শেখ হাসিনা রয়েছে।’ 

সরকার নির্বাচন কমিশনকে শেষ করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের সরকার পরিবর্তনের কোনও অবস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনকে অকার্যকর করে শেষ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। জনগণের ভোটে নয়, আগামী নির্বাচনে জিততে হলে অন্য কিছু করতে হবে। তা না হলে এই সরকার আবার ক্ষমতায় আসবে। বর্তমানে দেশের মানুষ একটি আগ্নেয়গিরির উপরে আছে, জনগণ এখন শুকনো পাতার মত হয়ে গেছে। তাই সরকারের এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় শয়তান হচ্ছে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সংগীতশিল্পীরা। জনগণ কোনও প্রতিরোধ গড়লে র‌্যাব-পুলিশ পেটায়, ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক শ্রেণির মানুষেরা প্রতিরোধ যেন গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। তারা প্রতিরোধের গোড়া মেরে দিচ্ছে। এরা পাকিস্তান আমলেও খেয়েছে, এখনও খাচ্ছে। এরাই আবার আজীবন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যুর পরে কী হবে তাদের? এরাই দেশের বড় ক্ষতি করছে।’ 

বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘অপরাধের প্রতি জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়ে চিহ্নিত ও প্রমাণিত অপরাধীর সাজা রাষ্ট্রীয়ভাবে মাফ করে তাকে নিরাপদে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটকারীদের বিচার না করে এবং মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে সরকার। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এই ভণ্ডামিই সরকার জনগণের সামনে তুলে ধরে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।’

দেশের নাগরিকদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করারও দাবি জানান তিনি।

বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘যে নেক্কারজনক ঘটনা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, তার জন্য শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পচন ধরেছে, আমরা একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করি। শিক্ষার্থীরা বলছে- হলে থাকতে হলে বড় ভাইদের পা ধরতে হয়। বড় ভাইদের প্রটোকল মেনে চললেও উঠতে-বসতে চড়-থাপ্পড় খেতে হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ছাত্র নেতাদের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার নজিরও রয়েছে। এতে ছাত্র নেতারা মাথায় চড়ে বসছে। কোটার দাবি শুধু চাকরি পাওয়ার দাবি নয়, এটি সংবিধান স্বীকৃতির দাবি। তরুণ সমাজ আজ জেগে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘নীরব একটা ষড়যন্ত্র চলছে, আমরা সবাই এর সাথী, মিডিয়াও এর সাথী। যে রাষ্ট্র যত বেশি লাঠিপেটা করবে সেটাই ওই রাষ্ট্রের জনবিচ্ছিন্নতার তত প্রমাণ।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম. নূরুন্নবী বলেন, ‘আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। তবে দেশে সত্যিকার অর্থে কোনও গণতন্ত্র নেই আজ। একটা দল সংবিধানের কথা বলে বলে অন্য দলকে ঠেকাচ্ছে। অথচ তারা নিজেরাই সংবিধান বিরোধী কাজ করছে। বর্তমান সরকার নিজেই সংবিধান বিরোধী। এখন এলাকার গলির সন্ত্রাসী কর্যাক্রম সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে চলে গেছে। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এটা লোভ দেখানো, এটা সার্থক হবে না। কারণ যারা মাদকের মূলহোতা সরকার তাদের আইনের আওতায় আনছে না।’ 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানের নামে শত শত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। অন্তত ৩৫ হাজার মানুষকে জেলে ভরে রাখা হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলন এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। কিন্তু এটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এটাকে ধরে রাখতে পারছি না। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে চলছে, তারা এটি হতে দিচ্ছে না।’ 

আয়োজক সংগঠনের সভাপতি বদরুদ্দীন উমরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকরাম হোসেন, মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ নেতা বিনায়ন চাকমা প্রমুখ।
  • কার্টসিঃ ব্রেকিং নিউজ বিডি/ জুলাই ১১,২০১৮  

‘আমার মণিকে তোমরা বাঁচতে দাও, মুক্তি দাও’

রাশেদের মায়ের আর্তনাদ

ছেলের মুক্তির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন রাশেদের মা সালেহা খাতুন। গতকাল শাহবাগে। 

ঝিনাইদহের সালেহা বেগম এর আগে কখনো ঢাকায় আসেননি। এবারই প্রথম। ছেলের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার সুযোগ তাঁর হলো না। এর আগেই চিনতে হলো ডিবি অফিস, ডিএমপি, শাহবাগ থানা, সিএমএম কোর্ট। তিনি এখন ভিক্ষা চান ১০ দিনের জন্য পুলিশি রিমান্ডে থাকা একমাত্র ছেলে রাশেদ খানকে। ছেলেহীন এই শূন্যতার হাহাকার থেকে তিনি মুক্তি চান।

সালেহা বেগমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল গতকাল মঙ্গলবার, শাহবাগের একটি খাবারের দোকানে বসে। শুরুতেই হাত জোড় করে বললেন, ‘আমার মণিকে তোমরা মাফ করে দাও। ভিক্ষা দাও। আমার মণিকে আমি ঢাকায় আর রাখব না গো। গ্রামে নিয়ে চলে যাব। শুধু মুক্তি দাও। সেও বাঁচুক। আমিও বাঁচি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদ খানকে সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয় থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এক ঝলক দেখার জন্য সকাল থেকে সালেহা বেগম দাঁড়িয়ে ছিলেন ডিবি অফিসের ফটকে। দেখে মনে হয়েছে, ছেলে ভালো নেই। সর্বস্ব দিয়ে যে ছেলেকে মানুষ করেছেন, তাঁর যে এমন হাল হবে স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। তিন-তিনটি মামলার আসামি এখন রাশেদ খান। তিনি কি মুক্তি পাবেন? কখনো কি তাঁর কায়ক্লেশে চলা সংসারের দায়িত্ব একমাত্র এই ছেলেটি বুঝে নেবেন? এমন হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘোরে সালেহার। কূলকিনারা পান না। শুধু চান, ছেলে ফিরে আসুক।


সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে তৈরি ছাত্রদের মঞ্চ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান। বাবা নবাই বিশ্বাস রাজমিস্ত্রি, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। রাশেদের দুটি বোন। একজন তাঁর বড়, অন্যটি ছোট। শ্রমজীবী দম্পতি দাঁতে দাঁত চেপে সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করে গেছেন। রাশেদ খান এতকাল তাঁদের বিমুখ করেননি।

সালেহা বেগম বলছিলেন, ছেলে পঞ্চম, অষ্টম, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে সরকারি ও ব্যাংকের বৃত্তির টাকা পেয়েছেন। আর বাকিটা তাঁরা জুগিয়েছেন ঘাম ঝরিয়ে। ‘এমনও দিন গেছে, রাশেদের আব্বা হয়তো বাজার থেকে পাঁচ কেজি চাল কিনে এনেছে। পরে ছেলে ফোন করে বইখাতা কিনতে টাকা চেয়েছে। চাল ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ছেলেকে টাকা পাঠিয়েছেন। শুধু পানি খেয়ে আমরা রাত পার করেছি। এমবিএ ভর্তির সময় ছাগল বিক্রি করেছি। ভেবেছিলাম, পড়াশোনা শেষ। কষ্টের দিনও শেষ। হলো না।’

এখন এই যে তিনি ঢাকায় এলেন, ছেলের জন্য ছোটাছুটির খরচ কী করে চলছে? সালেহা বেগম জানান, ছেলের বাবার কিডনিতে সমস্যা। অস্ত্রোপচারের জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা ভেঙে ভেঙেই এখন চলছে।

রাশেদ খানের নামে জটিল সব মামলা। মায়ের মাথায় ধরে না। কথার ফাঁকে সালেহা বেগম মামলার কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলা একটি। এর বাইরে পুলিশের অভিযোগ, রাশেদের প্রত্যক্ষ মদদে, পরিকল্পনায় ও নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টা থেকে ২টার মধ্যে হাতে লোহার রড, পাইপ, হ্যামার, লাঠি নিয়ে বেআইনি ‘জনতাবদ্ধে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অনধিকার প্রবেশ করে ভাঙচুর ও মালামাল চুরি করে নিয়ে যান। তাঁর নির্দেশেই ভিসির বাসভবনের আসবাব ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দেন, সিসি ক্যামেরার রেকর্ড সংরক্ষণের যন্ত্র (ডিভিবার) নষ্ট করে ফেলেন। কোনো স্বার্থান্বেষী মহলকে বিশেষ সুবিধা করে দিতে রাশেদ এসব অপকর্ম করেছেন।

সালেহা বেগম গতকাল বলেন, ‘আমার মণি তো কোনো অন্যায় করেনি। সে শুধু একটা চাকরি করতে চেয়েছিল। সে তো সরকারি চাকরিই করতে চেয়েছিল। সরকারকে ফেলতে যাবে কেন?’
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ১১,২০১৮ 

Tuesday, July 10, 2018

চাপে পড়ে ছেলের হত্যা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন মা


থানায় হত্যার পর এক কিশোরকে ক্রসফায়ারে নিহত দেখানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ওয়ারী থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে পুলিশের দাবি, গত ৬ এপ্রিল রাতে ওয়ারীর টয়েনবি সার্কুলার রোডের একটি গলিতে ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশ ও ডাকাতদের পাল্টাপাল্টি গুলির মধ্যে ডাকাতদের একজন মারা যায়। 

পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তির নাম ‘ছোট’ রাকিব। বয়স ২২ বছর। খুনসহ একাধিক ছিনতাইয়ের মামলায় তাঁর নাম আছে। কিন্তু নিহত রাকিবের পরিবারের দাবি, তার বয়স ১৫ বছর এবং নাম রাকিব হাওলাদার।

এ ঘটনায় নিহত রাকিবের মা রীতা হাওলাদার গত ১১ এপ্রিল পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা করেছিলেন। আসামি ছিলেন ওয়ারী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম, থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সেলিম, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জ্যোতিষ চন্দ্র রায় ও পুলিশের সোর্স মোশাররফ হোসেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছিল। পরে পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং ওপর মহলের প্রচণ্ড চাপের মুখে মা-ই কিশোর সন্তানের হত্যা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। যদিও আদালতে তিনি বলেছেন, তাঁর ছেলেকে খুন করা হয়েছে। তাঁর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। তিনি আল্লাহর কাছে বিচার চান। আদালত ইতিমধ্যে মামলার সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছেন। 

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘যদি ধরে নিতে হয় রাকিবের মা ভয়ে পিছিয়ে গেছেন, আর মামলা চালাতে চাননি, তাহলে এটাও আমাদের জন্য অশনিসংকেত।’ অন্যদিকে, চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম বলেন, ‘পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয়ভীতি দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে যদি মামলা প্রত্যাহার হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব ছিল বিষয়টি তদন্ত করার।’ 

ঘটনা যেভাবে ঘটে 

নিহত রাকিবের পরিবার ও প্রতিবেশীরা বলছেন, দুটি সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছে রাকিব। তার বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় একটি ছিনতাইয়ের মামলা আছে। কোনো হত্যা মামলা নেই। রাকিবের পরিবার বলছে, ওয়ারী থানার এএসআই জ্যোতিষ চন্দ্র রায় গত ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাপ্তানবাজার মুরগিপট্টির মোড় থেকে তাকে ধরে নিয়ে যান। খবর পেয়ে রাকিবের মা রীতা হাওলাদার পরদিন থানায় যান এবং ছেলেকে সেখানে দেখতে পান। তিনি জ্যোতিষ চন্দ্র রায়ের কাছে ছেলেকে ধরে আনার কারণ জানতে চান। জ্যোতিষ রায় তাঁকে বলেন, রাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেবেন। রাকিবের বাবা মহসিন হাওলাদারও মোবাইলে কথা বলেন এএসআই জ্যোতিষের সঙ্গে। থানায় আরেক পরিচিত এসআই শাহ আলমকে ঘটনা জানিয়ে সহায়তা চান রাকিবের মা।

আদালতে দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল, বাদী রীতা হাওলাদার থানায় যখন এএসআই জ্যোতিষের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন ওসির কক্ষ থেকে রাকিবের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। রাকিবের মা থানায় আছেন—এমন তথ্য গিয়ে ওসিকে জানান জ্যোতিষ। রীতা হাওলাদার ওসি রফিকুলের কক্ষে গিয়ে দেখতে পান, রাকিবের মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। পরনে প্যান্ট নেই। শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন। ওসি রফিকুল এবং ওসি (তদন্ত) সেলিম তাঁর ছেলে রাকিবকে লাথি মারছেন। পরে এএসআই জ্যোতিষ, ওসি (তদন্ত) সেলিম ও সোর্স মোশাররফ থানা থেকে রাকিবের মাকে চলে যেতে বলেন। পরদিন রীতা হাওলাদার থানার কনস্টেবল মো. আলীর কাছে রাকিবের জন্য এক প্যাকেট খাবার দেন। কিন্তু ওসি সেই খাবার ফেরত দেন এবং জানাতে বলেন, থানায় রাকিব নামের কেউ নেই।

রাকিবের মা রীতা প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেকে কিছু খাওয়াতে চান বলে তিনি জ্যোতিষকে জানান। জ্যোতিষ তুইতোকারি করে তাঁকে থানা থেকে চলে যেতে বলেন। রাকিবকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে জ্যোতিষ বলেন, ‘তোর ছেলের কাছে অনেক তথ্য আছে। তথ্য নেওয়ার পর ছেড়ে দেব।’ থানা থেকে চলে না গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দেন ওসি (তদন্ত) সেলিম। এরপর ভয়ে তিনি চলে আসেন। সেদিন সন্ধ্যা সাতটার পরে আর থানায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে এএসআই জ্যোতিষ বলেন, ‘আমি কোনো কথা বলব না। এ ব্যাপারে যা বলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবে।’

পরদিন ৬ এপ্রিল শুক্রবার সকালে রীতা হাওলাদার আবার থানায় যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানার গেটে পৌঁছে শুনি, লোকজন বলাবলি করছে, আহা রে, ছেলেটারে মাইরা ফেলাইছে। থানা এখন ধুইতাছে। মরাটারে জয়কালী মন্দিরের কাছে নিয়ে আবার ক্রসফায়ার দিছে।’ রীতা হাওলাদার বলেন, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের লাশ গ্রহণের সময় দেখতে পান, ছেলের ডান হাত ভাঙা, মাথা ফাটা, পেটে আঘাতের চিহ্ন ও দুটি পায়ের জোড়াগুলো থেঁতলানো।

বাদী জানান, যেদিন মামলা করা হয়, সেদিনই তাঁকে আদালত এলাকা থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশ মারধর করে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়েছে বলে আদালতে অভিযোগ করেন রাকিবের মা। আদালতকে লিখিতভাবে তিনি জানান, ১৯ এপ্রিল বিকেলে এসআই জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জন তাঁর বাসায় এসে কাগজে ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বলেন। রাজি না হলে বাদী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে বাদীর চোখে আঘাত লাগে। জোর করে সই নিয়ে যায়। আদালতের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে বাদী সেদিন বলেন, আসামিরা থানার দায়িত্বে থাকলে তাঁর পক্ষে আর মামলা চালানো কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা সম্ভব নয়।

পুলিশের দাবি, ওয়ারী থানার টিপু সুলতান রোডের কাছে টয়েনবী সার্কুলার রোডে ডাকাতদের গুলিতে নিহত হয় রাকিব। ছবি: আবদুস সালাম

এরপর ১০ মে বাদী মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। অবশ্য এর আগে গত ৩০ এপ্রিল বিচারকের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বাদী রীতা বলেছেন, রাকিবকে হত্যা করা হয়েছে। আবার এটাও বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তাঁর। মামলা তোলা প্রসঙ্গে রীতা প্রথম আলোকে বলেছেন, মামলা করার পর পুলিশ যে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছিল, তা লিখিতভাবেই তিনি জানিয়েছিলেন। বড় বড় জায়গা থেকে চাপ এসেছে। মামলা না তুললে এলাকায় থাকতে পারবেন না বলে হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে আদালতের কাছে তিনি বলেন, রাকিবকে হত্যা করা হলেও আর মামলা চালাতে চান না। আল্লাহর কাছেই তিনি বিচার চান।

মামলার পর গত ১৪ মে ওয়ারী থানার ভিডিও ফুটেজ (৪ এপ্রিল দিবাগত রাত ১০টা থেকে ৬ এপ্রিল সকাল ৮টা) সিডি আকারে আদালতে জমা দেওয়ার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী জোনের উপকমিশনারকে (ডিসি) নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে থানার সব পুলিশের নাম ও ছবি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা। উল্লিখিত সময়ে কোন পুলিশ সদস্য কী গাড়িতে কী পোশাকে দায়িত্বরত ছিলেন, সেই তালিকাও চান আদালত। পাশাপাশি নিহত রাকিবের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাগজ চান আদালত।

এ ব্যাপারে ওয়ারী জোনের ডিসি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত যা চেয়েছিলেন, সবই দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাঠানো রাকিবের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, তার বিরুদ্ধে (রাকিব) থাকা মামলার কাগজপত্র, সহযোগী আসামিদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি মহানগর দায়রা আদালতে পাঠানো হয়।

যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে ওয়ারী থানার কোনো ভিডিও ফুটেজ আদালতে দেওয়া হয়েছিল কি না, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।

৫ জুলাই রীতা হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করার পর পুলিশ হত্যার হুমকি দিয়েছিল মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও চাপ দিয়েছিলেন মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য, না ওঠালে এলাকাছাড়া করবেন। বাধ্য হয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আদালতে বলে এসেছি, আমার ছেলে রাকিবকে থানাতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। আমি বিচার চাই। আবার আমি মামলা চালাতে চাই।’

রীতার আইনজীবী মোশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর থেকে পুলিশ বাদীকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছে। বিষয়টি আদালতকেও জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আপস করার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হয়।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর বাদী রীতা হাওলাদার এবং রীতার বাবা আবদুল লতিফ সরকারের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। গত ২৩ মে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অভিযোগকারীর মামলা প্রত্যাহারের দরখাস্ত হতে প্রতীয়মান হয় যে অভিযোগকারী মামলা চালাতে আগ্রহী নন।’

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জুন আদালত বলেছেন, বিচার বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলা প্রত্যাহারে বাদীর দরখাস্ত থেকে প্রতীয়মান যে বাদী মামলা চালাতে আগ্রহী নন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলাটি অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, অগ্রসর হলেও মামলার কোনো ফলাফল হবে না। মামলাটি নথিজাত করে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন আদালত।


রাকিবের মায়ের দাবি, ওয়ারী থানায় রাকিবকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ছবি: আবদুস সালাম

মামলা প্রত্যাহারে চাপ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কাউকে কোনো চাপ দেওয়া হয়নি।’ বর্তমানে রাজধানীর বাড্ডা থানায় ওসির দায়িত্বে আছেন। 

রাকিব হাওলাদারের নানা আবদুল লতিফ সরকার ওয়ারীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ল্ডের কাপ্তানবাজার ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০ বছর ধরে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। লতিফ সরকার বলেন, ‘আমাদের নেতা মহিউদ্দিন মহী ভাইয়ের ভাগনে তালহা খুনে জড়িত ছিল রাকিব নামের এক ছিনতাইকারী। কিন্তু পুলিশ আমার নিরীহ নাতি রাকিবকে থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলে। পরে ক্রসফায়ার দেখিয়েছে। বাস্তবে সে তালহা খুনে জড়িত ছিল না। মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন আপস করতে। পুলিশও কথা বলেছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, নানা চাপ ছিল।’

আসামি মোশাররফ ও কিছু প্রশ্ন

রাকিবের বাবা মহসিন হাওলাদার ডিজিটাল ব্যানার তৈরি করেন। তিনি দুটি সিনেমায় অর্থ লগ্নি করেন। কিন্তু দুটিতেই বড় লোকসান হওয়ায় একেবারে পথে বসে যান। বছর তিনেক আগে জয়কালী মন্দিরের সামনের রাস্তায় একটি টং দোকান তুলে ছেলে রাকিবকে বসিয়ে দেন। সে দোকানে চা, কলা, বিস্কুট বিক্রি করত। একই জায়গায় পুলিশের সোর্স মোশাররফেরও দুটি অবৈধ দোকান আছে। জয়কালী মন্দিরসংলগ্ন এলাকায় হানিফ উড়ালসড়কের নিচ ও আশপাশে এমন ৩০-৩৫টি টং দোকান আছে। দোকানগুলো থেকে থানা-পুলিশের হয়ে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলেন মোশাররফ।

রাকিবের মা দাবি করছেন, বছর দেড়েক আগে সোর্স মোশাররফ তাঁর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নেন। কিন্তু টাকা শোধ করতে গড়িমসি করায় বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে তিনি মোশাররফকে অপমান করেন। এরপর থেকে মোশাররফ তাঁদের পেছনে লাগেন। রাকিবের বাবা মহসিনের দাবি, প্রতিদিন চাঁদা দিলেও মোশাররফের সঙ্গে সমস্যা হওয়ার পর থেকে ওয়ারী থানা-পুলিশ একাধিকবার তাঁর টং দোকানের বিরুদ্ধে নন-প্রসিকিউশন (অধর্তব্য) মামলা করেছে। এসব মামলায় আদালত ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা জরিমানা করতে পারেন। আর আসামি হাজির না হলে পরোয়ানা জারি করেন। রাকিবের বাবার নামে এমন একটি পরোয়ানাও ছিল।


রাকিবের পরিবার বলছে, শিশু শিল্পী হিসেবে রাকিব দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছে। ছবি: সংগৃহীত


সরেজমিনে দেখা যায়, রাকিবের মৃত্যুর পর থেকে হানিফ উড়ালসড়কের নিচে থাকা সোর্স মোশাররফের দোকান বন্ধ রয়েছে। এক মাস ধরে তাঁকে এলাকায় দেখাও যাচ্ছে না। সেখানে অন্য একাধিক টং দোকানের মালিক প্রথম আলোকে জানান, সোর্স মোশাররফ তাঁদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৩০ টাকা করে চাঁদা নেন। দোকান থেকে চাঁদা তোলার কথা স্বীকার করেন মোশাররফ হোসেন। চাঁদার টাকা কাকে দিতেন, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশকে।’

রাকিবকে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন মোশাররফ। তবে দোকানের বিরুদ্ধে মামলা করা নিয়ে রাকিবের বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয় স্বীকার করে মোশাররফ বলেন, ‘পুলিশের সামনেই রাকিবের মা আমাকে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। তবে আমি তাঁর কাছ থেকে কোনো টাকা ধার নিইনি।’ রাকিব কীভাবে মারা গেছে, তা জানেন না দাবি করে মোশাররফ বলেন, ‘শুনেছি ক্রসফায়ারে মারা গেছে।’ রাকিবের মৃত্যুর পর পুলিশের করা মামলায় তাঁর ছেলে রাজীবের সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে মোশাররফ বলেন, সেই রাতে সে দোকানে ছিল। পুলিশ ডেকে নিয়ে সাক্ষী করেছে। কয়েক দিন আগে ছেলেকে ওমানে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান মোশাররফ।

আপনার দোকান বন্ধ, এলাকায়ও থাকছেন না; কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা ক্যাচাল লাগছে, তাই দূরে আছি।’


মামলার বাদী রাকিবের মা রীতা অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁর চোখের নিচে আঘাত করে। 


পুলিশের সঙ্গে রাকিবের মায়ের কথোপকথন

রাকিব হাওলাদারকে থানায় ধরে এনেছিলেন ওয়ারী থানার এএসআই জ্যোতিষ চন্দ্র রায়। থানায় রাকিবের মা একাধিকবার তাঁর কাছে ধরনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জ্যোতিষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলব না। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবেন।’

তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলামের কক্ষে রাকিবকে মারধর করতে দেখেছেন মা রীতা হাওলাদার। কিন্তু ওসি প্রথম আলোকে বলেন, রাকিব নামের কাউকে তাঁরা ধরেননি। রাকিবের মায়ের থানায় আসার তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।

তবে রাকিবের কথিত ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনার পর করা মামলার বাদী এসআই শাহ আলম সেদিন রাকিবের খোঁজে তার মা রীতা হাওলাদারের থানায় যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

এসআই শাহ আলম রাকিবের পরিবারের দীর্ঘদিনের পরিচিত। রাকিবের মা রীতা হাওলাদার তাঁকে কাকা ডাকেন। পরিচিত এএসআই জ্যোতিষও। সাবেক ওসি রফিকুল ইসলামও প্রথম আলোকে বলেছেন, রাকিবের বাবা-মা এবং নানাকে (আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ মৃধা) এসআই শাহ আলম অনেক দিন থেকে চেনেন। অথচ পুলিশ ‘ক্রসফায়ারের’ পরে মামলায় রাকিবকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে দেখায়। 

এই মামলার পর রাকিবের মা রীতা হাওলাদার এসআই শাহ আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলেন। তাতে দেখা যায়, এসআই শাহ আলম রীতাকে বলছেন, ‘তোমাকে সেদিন থানায় দেখছি, আমি অস্বীকার করছি না। তুমি ছেলেকে খুঁজতেছ। তুমি দেখছ না, আমি সেদিন কী কাজে যেন ব্যস্ত ছিলাম।’

রাকিবের মা বলছেন, ‘আমি কাকা আপনাকে থানায় বলেছিলাম, আমার ছেলেকে ওরা মারতেছে। কিন্তু আপনি গুরুত্ব দিলেন না। কম্পিউটার রুমে চলে গেলেন।’ শাহ আলম বলেন, ‘শোনো, আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার যদি কোনো কাজ করেন, তখন ওই ব্যাপারে আমি না, কারও নাক গলানোর অধিকার নাই।’

রীতা হাওলাদার বলেন, ‘...আর মরা মানুষটারে কেমনে ক্রসফায়ার করে, কন? আমার কি কোনো শত্রু আছে কাকা?’ শাহ আলম বলেন, ‘তুমি এখন যে প্রশ্ন করো, বাবা রে, তোমার সঙ্গে কথা বললে আমাগো পাপ হয়ে যাবে।’

রীতা হাওলাদার বলতে থাকেন, ‘মরা মানুষরে কেউ ক্রসফায়ার দেয়। আমার বাচ্চার বয়স মাত্র ১৫ বছর। আল্লাহ এ খুনের বিচার করবে।’

শাহ আলম তখন বলেন, ‘হ, তুমি আল্লার কাছেই কও। যে লোকে তোমার ছেলেকে মারছে, তারও ছেলেমেয়ে আছে। তার ছেলেমেয়েরও যেন এমন হয়। তুমি না কইলেও মার্ডার কেস কোনো দিন চাপা থাকে না। এই যে নারায়ণগঞ্জে সাতটা লোক খুন হলো। কীভাবে বস্তামস্তা বান্দে লাশ ডুবাই দিছিল। লাশ কিন্তু ভেসে উঠছে।’

আরও একবার এসআই শাহ আলমকে ফোন করেছেন রীতা হাওলাদার। রীতা বলছেন, ‘কাকা, জ্যোতিষকে (এএসআই) আমার ছেলের মোবাইল ফোনটা দিতে কন। স্মৃতিটা রাখি। টাচ মোবাইলটা। সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছি। ওটার ভেতর পোলার ছবি আছে।’ শাহ আলম বলেন, ‘রাকিবরে কে ধরে আনছিল; জ্যোতিষ? আচ্ছা, আমি জ্যোতিষের সঙ্গে কথা বলব।’

ছেলের মোবাইল ফোন ফিরে পেতে পরিচিত এসআই শাহ আলমকে আরেক দিন ফোন করেন রীতা হাওলাদার। শাহ আলম বলেন, ‘জ্যোতিষের সঙ্গে দেখা হয়নি। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে লই। আর যদি না হয়, তাহলে আমি একটা মোবাইল কিনে দিব।’ রীতা হাওলাদার বলেন, ‘কাকা, ওটা আমার পোলার স্মৃতি!’

আরেক কথোপকথনে শাহ আলম রীতা হাওলাদারকে বলছেন, ‘আমার চোখের পানি কয়বার মুছছি, দেখছ। আমার বিশ্বাস হয় না রীতার পোলা মারা গেছে। আমার এখনো সত্যি বিশ্বাস হয় না। আমি তো লতিফ ভাইকে (রাকিবের নানা) কইছি, আপনার নাতি তো ছোট মানুষ। অনেকবার বাসায় গেছি। ও তো আমারে নানা ডাকে।’

তালহা থেকে শুরু 

২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা ওয়ারীর গোপীবাগে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন। নয় দিন পর তালহাকে খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন আবদুর রহমান ওরফে মিলন ও বেলাল হোসেন ওরফে সবুজ নামের দুজন। তাঁরা আদালতে বলেছেন, তালহা খুনে তাঁদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ‘টোকাই রাকিব’ নামের একজন। তবে তার বিস্তারিত পরিচয়, ঠিকানা জবানবন্দিতে নেই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, তালহা খুনের দুদিন পর ওয়ারী থানায় ২০০ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে একটি মামলা হয়। সেখানে এক আসামির নাম ছিল মো. রাকিব। ওই মামলায় পুলিশ রীতা হাওলাদারের ছেলে রাকিব হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় তিন মাস সে কারাগারে থাকে। কিন্তু তালহা হত্যার নয় দিন পর গ্রেপ্তার দুজনের জবানবন্দিতে আসা ‘টোকাই রাকিব’, তালহা হত্যার দুদিন পর এক ব্যক্তির করা ছিনতাই মামলার আসামি ‘মো. রাকিব’ আর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত ‘ছোট রাকিব’ কি একই জন?

তালহা খুনের মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ারী থানার এসআই হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জবানবন্দিতে রাকিবের পুরো ঠিকানা বলেনি তারা। ওয়ারী এলাকায় তো অনেক রাকিব আছে।’

পুলিশ বলছে, ডাকাতদের গুলিতে রাকিব ওয়ারীর টয়েনবি সার্কুলার রোডের এই দোকানের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন। 


৩৫ নম্বর বনগ্রাম লেন, ওয়ারীর বাসিন্দা মহসিন হাওলাদার ও রীতা হাওলাদারের ছেলের নাম রাকিব হাওলাদার। ছিনতাইয়ের মামলায় নাম মো. রাকিব হলেও আটক হয়ে জেল খেটেছে কিশোর রাকিব হাওলাদার। ওই ছিনতাই মামলার বাদীর নাম ওমর ফারুক। তিনি ২৪ নম্বর ফোল্ডার স্ট্রিটের সিটি টেলিকমের কর্মচারী ছিলেন। তিনি এখন আর সেখানে কাজ করেন না। এজাহারে থাকা ফোন নম্বরটি এই অফিসের ছিল।

এই রাকিবই যে তালহা খুনে জড়িত, তা কি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে? জানতে চাইলে ওয়ারী থানার তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এই রাকিবই।’ তাহলে যখন ছিনতাই মামলায় রাকিব হাওলাদার আটক ছিল, তখন তাকে তালহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখাননি কেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘এই রাকিব তো তখন আমার মাধ্যমেই জেলে গেছে। সে-ই যে তালহাকে মেরেছে, তা তো তখন আমি জানতাম না। ১৬ দিন পর (আসলে ৯ দিন পর) যখন তালহা খুনে জড়িত সবুজ ও মিলন ধরা খায়, তখন জানতে পারি রাকিবের নাম।’ এরপর ছয় মাস পার হয়ে গেল, রাকিব হাওলাদার জামিন পেয়ে চায়ের দোকান চালাচ্ছে, বাসা থাকছে, এত দিন তাকে তালহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘এখানে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। রাকিবকে তালহা খুনের মামলায় কীভাবে গ্রেপ্তার দেখাব? রাকিবের কি শেষ আছে? এক ছিনতাইকারী আরেক ছিনতাইকারীকে চেনে না। একজনের ফোন নম্বর আরেকজন জানে না। কেবল চেহারার বর্ণনা দিতে পারে।’ আবার রফিকুল ইসলাম এ-ও বলেন, তালহা খুনে জড়িত থাকার পাশাপাশি এই ‘ছোট’ রাকিব মুক্তার নামের আরেকজন খুনেও জড়িত ছিল। ২ এপ্রিল জয়কালী মন্দির এলাকায় ছিনতাইয়ের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে মুক্তার খুন হয়। এ মামলায় গ্রেপ্তার আসামি জিসান ও শামীম আদালতে বলেছেন, মুক্তারের গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে এই রাকিব। ওয়ারী জোনের ডিসি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, তালহাকে খুন করেছিল রাকিব। সে ছিনতাইকারী। 

তালহা খুনের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহ আলম। তিনি ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত রাকিব খুনের মামলারও বাদী। আবার তিনি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনায় ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে করা মামলাও বাদীও তিনি। সেই মামলায়ও ক্রসফায়ারে নিহত রাকিব আসামি। এই শাহ আলমকেই রাকিব নানা ও রাকিবের মা কাকা বলে ডাকেন।

তালহা হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে শাহ আলম বলেন, ‘এখনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাইনি। পেলে অভিযোগপত্র দেব।’ দুজন তো ধরা পড়েছে আর কে আছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাঁদের সঙ্গে “ছোট” রাকিবও ছিল।’ এই রাকিব কি গ্রেপ্তার হয়েছেন? শাহ আলম বলেন, ‘রাকিবকে তো অ্যারেস্ট করা যায়নি। পরবর্তীকালে জানতে পেরেছি, বঙ্গভবন রোডে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। এই রাকিবই ১০০ ভাগ তালহা খুনে জড়িত ছিল।’ কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে সে-ই তালহা হত্যায় জড়িত ছিল? জবাবে শাহ আলম বলেন, ‘মামলার আগের তদন্ত কর্মকর্তা হারুন–অর–রশিদ গুলিবিদ্ধ ওই ডাকাতকে দেখে বলে ওঠেন, এই রাকিবকেই তিনি খুঁজছিলেন।’ আপনি এই রাকিবকে চিনতেন? শাহ আলম বলেন, ‘রাকিবের বাবা-মাকে চিনি। জয়কালী মন্দিরের ওখানে রাকিবদের দোকান ছিল। সেখানে তার বাবা-মাকে দেখেছি। কিন্তু রাকিবকে বাস্তবে দেখেননি।’ তার বয়স কত হবে? শাহ আলম বললেন, ‘১৯-২০ বছর হবে।’ কিন্তু তিনি মামলায় রাকিবের বয়স দেখিয়েছেন ২২ বছর। রাকিবের মৃত্যুর পর রাকিবের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, ‘না।’

আইনজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা যা বলছেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও আইনজীবী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার হওয়া উচিত। এই যে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, এটাও আমাদের বিবেচনায় আনা উচিত কোন পরিস্থিতিতে আমরা বাস করি।’ 

চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশু রাকিবের মৃত্যুর ঘটনাটা লোমহর্ষক। আইন অনুযায়ী রাকিবের মায়ের বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয়ভীতি দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে যদি মামলা প্রত্যাহার হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল বিষয়টি তদন্ত করার। বাদীর মামলার প্রত্যাহারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত অসম্পূর্ণ রাখা উচিত নয়। ভুক্তভোগী যে মামলা করেছেন, তা পুনরুজ্জীবিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একজন শিশুকে মেরে ফেলার মতো এমন গুরুতর অভিযোগের মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ আইনে নেই।’

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ১০,২০১৮ 

Monday, July 9, 2018

তরিকুলের ওপর হামলাকারী কারা


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তরিকুলের ওপর হামলার যেসব ভিডিও ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের লাঠি, রাম দা ও হাতুড়ি নিয়ে আঘাত করতে দেখা গেছে। গত ২ জুলাইয়ের ওই হামলায় তরিকুলের ডান পায়ের দুটি হাড় ভেঙে যায়।

তরিকুলের ওপর হামলাকারীদের মধ্যে ১১ জনকে চিহ্নিত করেছে দ্য ডেইলি স্টার। এদের মধ্যে ১০ জনই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

হামলার পর থেকে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের সবাইকেই ক্যাম্পাসে দেখা গেছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে তারা এখন প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুল ইসলামের ওপর হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন। তরিকুলের পায়ে ও কোমরে লোহার হাতুড়ি দিয়ে সে আঘাত করে। তার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকায়। সে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক।

হামলা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে গতকাল বলেন, ‘ওই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।’

তরিকুল যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল, মামুনের সঙ্গে রমিজুল ইসলাম রিমু ও লতিফুল কবির মানিক তার ঘাড়ে ও পিঠে লাথি মারছিল। রমিজুল ইসলাম রিমু ছাত্রলীগের রাবি শাখার সহসভাপতি। আর লতিফুল কবির মানিক মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের কর্মী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে ফেলে পেটানোর সময় তরিকুল হাত দিয়ে তার মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। এসময় ছাত্রলীগের কর্মী জন স্মিথ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু ও রিমু এগিয়ে গিয়ে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। মানিক ব্যাডমিন্টন কভার থেকে একটি রামদা বের করে রাম দা’টির ভোঁতা দিক দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করেন। তখনও হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত অব্যাহত ছিল।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, তরিকুলকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলেন রাবি শাখা ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান ও পরিকল্পনা বিষয়ক সহসম্পাদক সৌমিত্র কুমার রানা। অন্যান্য ছবিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন ও চার জন সহসভাপতি—আহমেদ সজীব, গুফরান গাজী, শোভন কায়সার ও মিজানুর রহমান সিনহাকে লাঠি নিয়ে পেটাতে দেখা যায়।

এ ব্যাপারে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে সহিংসতার চেষ্টা করছিল কিছু ছাত্র। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির লোকজন ছাত্রদের উষ্কানি দিচ্ছিল। ‘তাদেরকে প্রতিহত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা সেটাই করেছি।’

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাতুড়ি নিয়ে হামলাকারী মামুন দাবি করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাই তাদের ওপর হামলা চালাতে গিয়েছিল। ‘ওরা হামলা করতে এলে আমরা তাদের ধাওয়া করি। তাদের মধ্যে একজন পড়ে গেলে আমরা সবাই মিলে মারধর করি… ঘটনা এটাই।’ হাতুড়িসহ হামলার অস্ত্র তাদের কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছিল বলে তার দাবি।

নিজের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ভালো আছি।

হাসিমুখে গর্বভরে বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, আমি ক্যাম্পাস থেকে পালিয়েছি কিনা। আমি পালাইনি। আমি ক্যাম্পাসেই আছি এবং আমার ওপর কোনো মানসিক চাপ নেই।’

হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশান বা ছাত্রলীগের কেউ যোগাযোগ করেছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, না…না কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’

যোগাযোগ করা হলে রাবি প্রক্টর লুতফর রহমান বলেন, ঘটনাটি ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটায় তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দেখবে।

হামলাকারী ও হামকার শিকার সবাই রাবির ছাত্র ছিল জানানোর পর তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সেখানে ছিলেন। তারাই আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ বিষয়টি দেখবে।

ছবি ও ভিডিওতে যাদেরকে হামলা চালাতে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তারা বিষয়টি দেখবেন।

  • The Daily Star/ jul 9, 2018 

চলে যা ভাই…


ইসরাফিল খসরু


গত বেশ কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেদম প্রহার, নিষ্ঠুর নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচেছ আমাদের তরুণ ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’ এর নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। এদের অধিকাংশই দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থী ছেলেমেয়ে। বলা হচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। যদি ধরেও নিই এতে ছাত্রলীগের কোন ভূমিকা নেই, তাহলে প্রকাশ্য দিবালোকে জনস্মুখে সংবাদকর্মীদের সামনে এমন সন্ত্রাসী কাজ করার সাহস কোথা থেকে পেল তারা? সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এই ঘটনাগুলোতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর দৃশ্যমান অনুপস্থিতি। 

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে।    এক — তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, আইনশৃংখলার দায়িত্ব পুলিশ কতিপয় যুবকদের হাতে তুলে দিয়েছে? যদি তা হয় তাহলে জনগণের কাছে কি বার্তা পৌঁছায়? দুই —  সরকার কি আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে না ন্যায্য অধিকারের অবস্থান থেকে দেখছে। তিন — দেশের সাধারণ জনগণের ভাবনা কি? তারা কি এটিকে শুধুমাত্র ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবে দেখছে? 

এই প্রশ্নমালার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের কাছে কিছু জিনিস পরিস্কার হয়। 

প্রথমে —   আইনশৃংখলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা যা একটি অশনি বার্তাই দেয়। বার্তাটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক আন্দোলনেও জনগণের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। এই ছাত্ররা বাংলাদেশেরই জনগণ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া তাদের অধিকার। প্রথমে মানুষ বুঝে নিচ্ছে সরকারের নির্দেশেই তারা নিস্ক্রিয় থাকছে। কাজেই, ধরে নেয়া যায়, এই আইন-শৃংখলা বাহিনী সরকারের সেবার জন্য, জনগণের নয়।

সরকারের আচরণ থেকে এটি পরিস্কার, সরকার এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। এটি যে অধিকারের আন্দোলন সেটিকে সরকার মেনে নিচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার এই আন্দোলনে  জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা ও পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। অথচ সরকার যদি এই আন্দোলনকে অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত, তাহলে এর সমাধান দেখতে পেতাম। 

যেখানে এপ্রিল ১১, ২০১৮, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন সাধারন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা-সংস্কার’ দাবি তিনি মেনে নিয়েছেন এবং আন্দোলনকারীরা সেই আশ্বাসের বিশ্বাসের নিরিখে আন্দোলন স্থগিত রাখে, সেইখানে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিলম্বিত হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। ইতোমধ্যে কোটা পদ্ধতিতে ৩৭তম বিসিএসের ফলাফলও দিয়ে দেয়া হয়েছে, যদিও ৩৭তম থেকেই কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি ছিল।  তার উপর আন্দোলনকে বিতর্কিত করে ভিন্নাখাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। এসবকে সরকারের সদিচ্ছার অভাবের আলামত হিসেবেই দেখা স্বাভাবিক। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, এই বিষয়ে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করা। 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের ভূমিকা কি হতে পারে? তারা যদি এই আন্দোলনকে শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হিসেবে দেখে, তাহলে এই আন্দোলন খুব বেশি গতি পাবে না। এইক্ষেত্রে এই বার্তাটিও সর্বমহলে পৌঁছাবে যে দেশে কোন যৌক্তিক আন্দোলন হলে তাতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে না, সেইখানে শুধু যে শ্রেণির আন্দোলন তারাই শুধু অংশ নেবে। অথচ চলমান  ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’  যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মেধাভিত্তিক উজ্জ্বল এক বাংলাদেশ গড়ার, সেই আন্দোলনে যদি জনগণ সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে আন্দোলনকারীদের আমরা এখনি বলে দিতে পারি —    "চলে যা ভাই, এই দেশে তোদের কোন ভবিষ্যত নাই।" মেধার মূল্যায়ন ও বিকাশের জন্য আমাদের ছেলেরা রাস্তায় মার খাবে কিন্তু আমরা তাদের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে একটি উজ্জ্বল বাংলাদেশের আশা করব, সেই ধারণাটিই ভুল। সেইক্ষেত্রে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। 

  • লেখক বাংলাদেশের একজন হতভাগা নাগরিক। 

রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে এগিয়েছে চীন

সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রক্রিয়া শেষ মুহূর্তে আটকে যায়। এর পর থেকে ফাইলবন্দি প্রকল্পটি। সোনাদিয়ায় না হলেও মিয়ানমারের রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পথে অনেকটাই এগিয়েছে চীন। সোনাদিয়া থেকে ২৮৯ কিলোমিটার দূরে রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই এ বিষয়ে চুক্তি হবে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সিনহুয়া।

কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের (সিআইটিআইসি) নেতৃত্বে চীনের ছয়টি গ্রুপ অব কোম্পানির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা করছে মিয়ানমার। কিয়াকপিউয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে আহ্বান করা দরপত্র প্রক্রিয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে যোগ্য বিবেচিত হয় সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম। প্রকল্প দুটির মধ্যে রয়েছে একটি শিল্পপার্ক। অন্যটি গভীর সমুদ্রবন্দর। মূলত কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিআইটিআইসি এ বিষয়ে শিগগিরই চুক্তিতে পৌঁছবে বলে আশা করছে উভয়পক্ষ।

মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী থান মিয়েন্ট সিনহুয়াকে বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে কিয়াকপিউয়ের গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। দুই দেশের জন্যই এটি সমান লাভজনক হবে। এছাড়া সমুদ্রবন্দরটির কল্যাণে উন্নয়ন হবে রাখাইন রাজ্যেরও। স্থানীয়দের জন্য বিপুল কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।

গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় রয়েছে মাদেই আইল্যান্ড টার্মিনাল ও ইয়ানবাই আইল্যান্ড টার্মিনাল। এতে জাহাজ নোঙরের সুবিধাসম্পন্ন মোট ১০টি বার্থ থাকবে। শিল্পপার্ক ও গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রাস্তা ও সেতু নির্মাণের কাজও রয়েছে প্রকল্পটির আওতায়। ২০ বছরে মোট চারটি ধাপে গভীর সমুদ্রবন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ হবে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে বার্ষিক ৭৮ লাখ টন বাল্ক কার্গো ও ৪৯ লাখ টিইইউএস কনটেইনার ধারণ সক্ষমতা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।

কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বাংলাদেশও অনেকটা এগিয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। জাপানের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সে সময় এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও পরিচালনা করে। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১১-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এরপর প্রকল্পটিকে ফাস্টট্র্যাক মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়। প্রকল্পটির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় একটি কমিটিও।

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা হয়নি। এর পর থেকে এক প্রকার ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে প্রকল্পটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজে গতি আসেনি। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রভাব আমাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সামনে এগোতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সবাইকে নিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই আমরা। বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরার দরকার ছিল। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেটি তুলে ধরতে পারিনি আমরা।

মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ বরাবরই ছিল বলে জানান সাবেক এ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়, সে সময়ও মিয়ানমারের কাছে চীনের প্রস্তাবটি ছিল। অল্প দূরত্বে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলে তার অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই হয়তো সোনাদিয়া গুরুত্ব পাচ্ছে না।

রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের অন্য অংশীদারগুলো হলো— চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, চায়না মার্চেন্টস হোল্ডিংস (ইন্টারন্যাশনাল), টিইডিএ ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং, ইউনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ও থাইল্যান্ডের চারোয়েন পোকফান্ড গ্রুপ অব কোম্পানিজ। মিয়ানমারের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকল্প দুটি নির্মাণ ও পরিচালনাকাজ সম্পন্ন করবে সিআইটিআইসি কনসোর্টিয়াম। ২০১৪ সালে মিয়ানমার সরকারের ঘোষিত মিয়ানমার স্পেশাল ইকোনমিক জোন ল’ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। 

বিশ্লেষকদের মতে, চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মূলেও আছে রাখাইনের কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরেই নির্মাণ করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দরটি। 

ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে যে অস্থিরতা তার অন্তর্নিহিত কারণ এ অঞ্চলের সম্পদ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও এর শিকার।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে থাকে। সেই সময় থেকে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা।

  • Courtesy: BanikBarta /Jul 09, 2o18

আগামী সপ্তাহে মজুরি প্রস্তাব দেবে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের দ্বিতীয় সভা রোববার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে মালিক ও শ্রমিক কোনো পক্ষই মজুরি প্রস্তাব দেয়নি। উভয় পক্ষই ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রস্তাব জমা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

রাজধানীর তোপখানা রোডে রোববার বিকেলে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের দ্বিতীয় সভা শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। সভায় মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজী সাইফুদ্দিন আহমদ, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি ফজলুল হক, পোশাকশিল্পের মালিক প্রতিনিধি তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, পোশাকশিল্পের শ্রমিক প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। তবে বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. কামাল উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন না।

বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মজুরি নির্ধারণে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেসব বিষয়ে নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে গত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা ছিল। উভয় পক্ষই জানিয়েছে, তাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তারা আমাদের কাছে কিছু সময় চেয়েছে। সে জন্য আমরা সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছে। মজুরি বোর্ডের তৃতীয় সভা ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যেই মালিক ও শ্রমিকপক্ষ প্রস্তাব দেবে।’ 

মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পোশাক খাত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ইন। যাতে কোনো রকম আঘাত না আসে এবং শ্রমিকেরা যাতে ভালোভাবে চলতে পারেন এবং পোশাক খাত যাতে ভালো থাকে, সে জন্য মালিকের সক্ষমতা ও শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আমরা একটি হিসাব দাঁড় করতে চাই। সেটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সে জন্য আমরা ১০ দিন সময় চেয়েছিলাম। তবে আট দিন পেয়েছি।’ আগামী সভার আগেই মজুরি প্রস্তাব জমা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 

মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করা হচ্ছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, আগস্ট মাসে মজুরি বোর্ডের ছয় মাস শেষ হবে। তারপর আরও তিন মাস নেওয়ার সুযোগ আছে। আশা করছি, এর মধ্যেই কাজ শেষ হবে। আর সময় নিতে হবে না। 

শ্রমিক প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের মজুরি প্রস্তাব মোটামুটি তৈরি। তবে গ্রেডের সংখ্যা সাতটি থেকে কমিয়ে পাঁচটি করায় মজুরি হার নির্ধারণে একটু ঝামেলা হয়েছে। মালিকপক্ষ যেহেতু দেয়নি, তাই আমরাও কিছুটা সময় পেলাম। কারণ এক পক্ষের প্রস্তাবে তো আলোচনা হবে না।’ 

অপর প্রশ্নের জবাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, উভয় পক্ষ মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানা পরিদর্শন করবে মজুরি বোর্ডের সদস্যরা। এরপরই আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ এবং মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের ‘টালবাহানা’ বন্ধের দাবিতে মজুরি বোর্ডের সামনে প্রতীকী অনশন করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। 

এ ছাড়া নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ের সামনে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা-কর্মীরা পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা এবং গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীরা নিম্নতম মজুরি ১৮ হাজার নির্ধারণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।


উল্লেখ্য, গত ১৯ মার্চ মজুরি বোর্ডের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে সেটি স্থগিত করা হয়। 

পোশাকশিল্পের জন্য ১৯৮৪ সালে প্রথম নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। তখন পোশাকশ্রমিকদের জন্য ৬২৭ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে বোর্ড। পরে ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা এবং ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরির মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা এবং চিকিৎসা, যাতায়াত ও খাদ্যভাতা ১ হাজার ১০০ টাকা। একেকটি মজুরি কাঠামো পাঁচ বছরের জন্য গঠন করা হয়।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৯, ২০১৮ 

পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি আরও সফলভাবে কার্যকর করতে হলে সেবাগ্রহীতাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ। দম্পতিদের কাছে মানসম্পন্ন সেবা সহজলভ্য করে তুলতে হবে। সেবার ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।

গত শনিবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিবার পরিকল্পনা: সুরক্ষিত মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা এসব মতামত দেন। প্রথম আলোএই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল এই আয়োজনে সহায়তা করে।

১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিনটি সামনে রেখে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, একাধিক সাংসদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি, অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারের হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে। ১৯৭২ সালে দম্পতিপ্রতি সন্তান ছিল ৬ দশমিক ২ জন। এখন তা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৩ জন। এসব উপাত্ত উল্লেখ করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে নিতে চাই না। এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত আছে। চীন তাদের জনসংখ্যা নীতি থেকে সরে এসে এখন দুই সন্তানের ওপর জোর দিচ্ছে।’

সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, কোনো দম্পতি কত সন্তান কখন নেবেন, এ ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন ধরনের পদ্ধতি তাঁরা বেছে নেবেন, সেই স্বাধীনতা দম্পতির থাকতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত যেন শেষ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।

সাংসদ বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার জন্য সঠিক তথ্য-উপাত্তের বিকল্প নেই। বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত আলাদা করে থাকা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকা পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এসব অঞ্চলের জন্য পৃথক কর্মসূচি নিতে হবে।

মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় ইউএনএফপিএর টেকনিক্যাল কর্মকর্তা আবু সাইদ হাসান বলেন, বাংলাদেশের জনঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে ১২ লাখ মানুষের। বছরে ৫৮ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। এতে গর্ভপাত যেমন বাড়ছে, আবার গর্ভপাতজনিত কারণে মাতৃমৃত্যুও বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সবার জন্য সহজলভ্য হলে ৪০ শতাংশ গর্ভপাত এড়ানো সম্ভব হবে। জোর করা যাবে না, তবে যাঁর সেবা প্রয়োজন তিনি যেন প্রয়োজনের সময় তা পান।

ইউএনএফপিএর ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সাথিয়া দোরাইস্বামী বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিকার’ বা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এসব স্লোগানের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা সেবা এখন যুক্ত হয়েছে। এই সেবাকেও এখন অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ যেভাবে সেবা চায়, যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায়, তাকে তা-ই দিতে হবে। চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আগের মাঠকর্মী দিয়ে ২০১৮ সালের মাঠের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

সরকারের কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার। তিনি বলেন, দেশে খাবার বড়ি ও কনডমের ব্যবহার বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুতে কোনো সংকট নেই। মাঠে জনবলের সংকট দূর করতে আট হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

অভিনেত্রী মৌসুমী বলেন, বুঝে না-বুঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা নানা অঘটনের শিকার হয়। কম বয়সী মেয়ে যখন দুই-তিন সন্তানের মা হয়ে যায়, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড়। কোটি কোটি মানুষের সামনে পরিবার পরিকল্পনা ও মানবাধিকারের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।

অধিকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক বলেন, ‘আমি আমার পরিবার নিয়ে যে পরিকল্পনা করি—কখন সন্তান নেব, কীভাবে তাকে বড় করে তুলব, কোথায় তার শিক্ষা হবে—নিজের এই পরিকল্পনা যদি দেশের সব মানুষের জন্য করি, তাহলেই কর্মসূচি সফল হবে।’ তিনি বলেন, অনেক মানুষ এখন সচেতন। পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১০০ ভাগ দম্পতির কাছে এই সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন ঘণ্টার এই গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপদেষ্টা গওহার নঈম ওয়ারা।

গোলটেবিলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেসা বলেন, জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। দেশের কিশোরী মায়েদের সংখ্যা যেমন কমানো দরকার, পাশাপাশি এদের জন্য পরিকল্পনা থাকা দরকার।

দেশে আইইউডি ও ইমপ্লান্ট সরবরাহে কিছু সমস্যা আছে উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এফপি ২০২০-এর ফোকাল পারসন আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই দুটি সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে হয়। এর সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের আরও মনোযোগী হতে হবে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা নার্সিং কলেজের দুজন ছাত্রী অংশ নেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আসমা আকতার বলেন, পরিবার পরিকল্পনা মানে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়। মানুষকে বোঝাতে বা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে মিডওয়াইফরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেরাকের সহযোগী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তাসনিয়া আহমেদ বলেন, কর্মসূচি সফল করতে হলে পুরুষদের অংশগ্রহণ সমানভাবে জরুরি। 

অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মাসুমা বিল্লাহ বলেন, আর্থসামাজিক কারণে এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বেশি বয়সে বিয়ে হলে যৌতুকও বেশি দিতে হয়। বিয়ে হওয়া কিশোরীরা প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবাও কম পায়।

  • Courtesy: Prothom Alo /Jul 08, 2018

Sunday, July 8, 2018

‘হাতুড়ির নিচে জীবন’

গোলাম মোর্তোজা




কবি বা কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় নয় এটা। আবার কবির কবিতাই তো সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এরশাদের সামরিক নিপীড়নের কালে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’। মাত্র তিন শব্দের বাক্য দিয়ে কবি যা বুঝিয়েছেন, লক্ষ শব্দ লিখেও তা বোঝানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। যখনই লেখা হোক, বহু বছর বা যুগ পরেও তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বারবার।

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গেও পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’।

কোটা সংস্কার বিষয়ে বহুদিন ধরে কিছু তর্ক চলছে। কিছু প্রশ্ন সামনে আনা হচ্ছে। আজকের লেখায় সেই সব সাধারণ কিছু প্রসঙ্গ- প্রশ্ন বিষয়ে দু’একটি কথা দিয়ে শুরু করি।

১. ‘কোটা বাতিল করা যাবে না। আমি কোটার পক্ষে। কোটা থাকতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে কোটা থাকতে হবে’- একথা বলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।

প্রথমত, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কোটা সংস্কারের দাবিকে যৌক্তিক মনে করার অধিকার যেমন আছে, অযৌক্তিক মনে করারও অধিকার আছে।

দ্বিতীয়ত, কোটা থাকবে না, বাতিল করতে হবে- এ কথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতরা কখনো বলেননি। যৌক্তিক শতাংশে কোটা থাকার কথাই তারা সব সময় বলে এসেছেন। কোটা বাতিলের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী কোটা থাকার কথাও তিনি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংসদে এবং সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য যদি কার্যকর হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, জেলা কোটা থাকবে না।

সুতরাং যারা বলছেন ‘কোটা থাকতে হবে, বাতিল করা যাবে না’- তাদের দাবি করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আন্দোলনকারীদের অবস্থান আর আপনাদের অবস্থানে কোনো পার্থক্য নেই, নেই সমালোচনারও কিছু।

২. ‘ যারা আন্দোলন করছেন, তারাই শুধু মেধাবী? যারা কোটায় চাকরি পাচ্ছেন, তারা কি মেধাবী নয়? তারাও তো বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই চাকরি পাচ্ছেন। সুতরাং তারাও মেধাবী।’

প্রথমত, বিতর্কটা কে মেধাবী, কে মেধাবী নয়- তা নিয়ে নয়। যিনি কোটায় চাকরি পাচ্ছেন তিনি মেধাবী নন, সে কথাও কেউ বলছেন না। মেধার ভিত্তিতে চাকরি আর মেধাবী, এই দুটি বিষয় সচেতন বা অসচেতনভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হবেন, তাদের ভেতর থেকে মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করা হোক। একথা সত্যি যে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন সবাই (কোটা সুবিধা প্রাপ্তরাও) । পাশাপাশি আরও বড় সত্যি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একজন হয়তো ৩০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন না। আর কোটা প্রাপ্তজন হয়তো ৭০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন। শুধু বিসিএস পরীক্ষায় ৫৬ শতাংশ চাকরি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। এখানেই ‘মেধার ভিত্তিতে’ প্রসঙ্গ আসছে। কোটা প্রাপ্তজন মেধাবী নন, সেটা বলা হচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ৩০০তম জন অবশ্যই ৭০০তম জনের তুলনায় মেধাবী এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তারই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। যেহেতু সেটা ঘটছে না, সেহেতু দাবি তোলা হয়েছে ৫৬ শতাংশ নয়, কোটা ১০ বা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। এতে বৈষম্য কমে আসবে। আরও একটি তথ্য সবার জানা থাকা দরকার, ৫৬ শতাংশ কোটা শুধু বিসিএসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্ষেত্রে কোটা অনেক বেশি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন ক্যাডার চাকরিতে কোটা ৬১ শতাংশ। ৭০ শতাংশ কোটা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে। রেলওয়েতে কোটা ৮২ শতাংশ। ৯৬ শতাংশ কোটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।

৩. ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন তারা বিএনপি-জামায়াত। তারা সরকারবিরোধী। তারা শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।’- এই অভিযোগ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রীদের।

প্রথমত, গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা গত তিন মাস অনুসন্ধান করে কোটা  আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দের কারও বিএনপি বা জামায়াত সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। সুতরাং আন্দোলনকারীরা সবাই বিএনপি বা জামায়াত এই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, যে কোনো দাবি সরকারের কাছেই করতে হয়। সরকারের কাছে দাবি তোলা মানে সরকার বিরোধিতা নয়।

তৃতীয়ত, সরকারের বা সরকারের কাজের বিরোধিতা করার অধিকার দেশের সব নাগরিকের আছে। একইভাবে সমর্থন করার অধিকারও আছে। সরকারের কাজের বিরোধিতা করা মানে দেশের বিরোধিতা করা নয়, সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাও নয়। সরকার আর দেশ বা রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

চতুর্থত, অস্থিতিশীল যে পরিবেশ তৈরি করা হলো, তার দায় কার? কোটা সংস্কারের দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নেওয়ার তিন মাস পরও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। কবে হবে সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রজ্ঞাপন জারির কোনো অগ্রগতি নেই।

আন্দোলনকারীরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান জানান দিতে চেয়েছিলেন। তারা রাস্তায় নেমে আসেননি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকেননি, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেননি। মনে রাখা দরকার, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা ছাড়া অন্যগুলো করার অধিকার তাদের আছে। সংবাদ সম্মেলনকারীদের উপর আক্রমণ করার অধিকার ছাত্রলীগের নেই। যে অধিকার নেই, সেই অধিকার প্রয়োগ করে ছাত্রলীগ নুরুলদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এখানে ‘মারামারি’ হয়নি। শুধু ‘মারা’ হয়েছে। ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আহত করেছে। লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েছে। ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করেছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। একজন শিক্ষার্থী এখনও নিখোঁজ।

আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে তার পক্ষে একটিও তথ্য বা প্রমাণ নেই। ছাত্রলীগ পিটিয়ে-নিপীড়ন করে পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে, তার পক্ষে ভিডিও চিত্রসহ যাবতীয় প্রমাণ আছে।

প্রথমত, যে কোনো দাবি বা আন্দোলনের সঠিক প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা না করলে, বিরোধী দল সুযোগ নিতে চাইবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এই সুযোগ নিতে চাওয়ার দায় আন্দোলনকারীদের নয়। এই দায় সরকারের। যদি বিরোধী দল কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেটা নিয়েছে সরকারের ভুল দমননীতির কারণে।

৪. শিক্ষার্থীদের জীবন চলে গেল হাতুড়ির নিচে, দেখার কেউ থাকল না। ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোটা আন্দোলনের নেতা তরিকুলের জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে। ভিডিও চিত্রে মামুনের দানবীয়তা ধারণ করা আছে, এক্সরে রিপোর্টে আছে তরিকুলের টুকরো হয়ে যাওয়া পায়ের ছবি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মেরুদণ্ড।


‘হাতুড়ির নিচে জীবন’র কিছু খণ্ড চিত্র-

ক. তরিকুলকে রাজশাহী সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়নি। তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন তরিকুলের ভাই-বোন- বন্ধুরা।

খ. নুরুলকে ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা করা হয়নি। আনোয়ার খান মেডিকেলে আনা হয়েছে। পুলিশের ভয়ে মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নুরুল নিজেই গণমাধ্যমকে সেকথা বলেছেন।

গাজীপুরের কোনো একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। দরিদ্র বাবা জমি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় এসেছেন।

গ. সবাই গাজীপুর থেকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসেন। নুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। কোনো অপরাধ ছাড়া তাকে পিটিয়ে আহত করেছে ছাত্রলীগ। তার চিকিৎসার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিলো না। ঢাকা মেডিকেল বা বেসরকারি মেডিকেলে করতেও দিল না। তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে গাজীপুরে।

ঘ. ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ঙ. কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুককে শহীদ মিনারে লাথি- ঘুষি- পিটিয়ে অজ্ঞান করে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। ভিডিও চিত্রে তা দেখা গেছে। একদিন পর জানা গেল ডিবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তুলে নিলো ছাত্রলীগ, পাওয়া গেল ডিবির কাছে!

চ. ‘আপনি কুলাঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়েছেন। আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে’- রাশেদের বাবাকে ফোন করে একথা বলেছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেছেন রাশেদের বাবা। সোহাগ বলেছেন, রাশেদের বাবা অসত্য বলছেন।

জ. সাপ মারার মতো একজনকে দশ বারোজন মিলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত এবং লোহার হাতুড়ি দিয়ে রড সোজা করার মতো আঘাত করে পায়ের হাড়-কোমর ভেঙে দেওয়া নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রশাসন একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সহস্রাধিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৪ জন তরিকুলদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন। ভিসি এই ১৪ জনকে বলেছেন ‘সরকারবিরোধী’। তিনি বলেছেন, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষকরা সরকারের বিরোধিতা করছেন।

শিক্ষকরা যে মুক্তচিন্তা, মুক্ত কথা বলার অধিকার রাখেন, ৭৩’র অধ্যাদেশ তাদের সেই অধিকার দিয়েছে, ভিসি মহোদয় তা ভুলে গেছেন।

ঝ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিপীড়ন বা ছাত্রলীগের হামলা বিষয়ে প্রথম তিন দিনে কিছু জানেনইনি। ভিসি বলেছেন, গ্রেপ্তার ছাত্রদের দায় বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। ‘শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা’- বলেছেন শিক্ষক নেতা। বলেননি যে, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা বা তারা নিপীড়িত হলে তাদের দেখা শিক্ষকদের দায়িত্ব নয়। এমন বাক্য না বলেও তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দুই হাজারের অধিক শিক্ষকের মধ্যে নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন অল্প কয়েকজন শিক্ষক। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের পক্ষে শিক্ষক- আইনজীবী- সমাজকর্মীরা প্রতিবাদ করছেন। পুলিশ তাদেরও অপমান- অসম্মান করছেন।

৫. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম মানুষের সাংখ্য প্রায় ১১ কোটি। এর মধ্যে কাজ নেই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি কর্মক্ষম মানুষের। অর্থনীতির অবস্থা ভালো, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’-এই চিত্রের মাঝেও সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, এই একটি পরিসংখ্যান তার প্রমাণ বহন করছে। যারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছেন, তারা এই  কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীরই অংশ। আন্দোলনকারীদের উপর হামলা যারা করছে, তারাও এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। মূল সমস্যা কাজের নিশ্চয়তার অভাব। বিনিয়োগ বা কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, কোটা বৈষম্য দূর না করে, হাতুড়ি পেটা করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দমন করা যাবে বলে মনে হয় না। আরও বড় হানাহানির আশঙ্কা তৈরির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
  • The Daily Star/ jul 8,2018 

দায় কার?

আসিফ নজরুল

হাতুড়ি দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তরিকুলকে। তরিকুলের অপরাধ, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই প্রতিবাদ সমাবেশকে দাঁড়াতেই দেয়নি ছাত্রলীগ। এঁদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রামদা, হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে চড়াও হন। নির্বিচার মারধরের একপর্যায়ে তরিকুলের পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়।

হাতুড়িওয়ালা আবদুল্লাহ আল মামুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। হাতুড়ি হাতে তাঁর ছবি, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করার ছবি এবং তরিকুলের ভাঙা হাড়ের এক্স-রের ছবিতে এখন সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে। মামুনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন অনেকে। কিন্তু দোষটা কি আসলে শুধু হাতুড়িওয়ালা মামুন ও তাঁর মতো আক্রমণকারীদের?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা অস্বীকারও করেননি যে তাঁরা পিটিয়েছেন তরিকুলকে। তাঁরা নাকি ধারণা করেছিলেন যে তরিকুলদের সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের লোক থাকতে পারে, এবং এই সমাবেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণকারী কিছু ছাত্রলীগ নেতাও এমন বক্তব্য দিয়েছেন। এর সোজাসাপ্টা মানে হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন কেউ অস্থিতিশীলতা বা নাশকতার চেষ্টা করছে, শুধু এমন ধারণা হলেই তাঁরা তাকে হাতুড়ি, রামদা, লাঠি দিয়ে পেটাতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে এটা দেশের কোন আইনে লেখা আছে? বাংলাদেশে কোনো আইন বা সংবিধানে কি লেখা আছে যে কোনো সমাবেশে গোলযোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে সেখানে নির্বিচার হামলা করে কারও হাড়গোড় ভেঙে দেওয়ার অধিকার সরকারি ছাত্রসংগঠনের রয়েছে? নেই। এ ধরনের আশঙ্কা সত্যি থাকলে কেবল পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, উপযুক্ত প্রমাণ থাকলে কাউকে গ্রেপ্তার করবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এমন কোনো আশঙ্কাও ছিল না। এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম হামলা চালিয়ে আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হককে গুরুতরভাবে আহত করা হয়, সেদিন তাঁরা মাত্র একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়েছিলেন। অল্পসংখ্যক মানুষ সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে সেখানে গোলযোগের আশঙ্কা কীভাবে থাকে? বা শহীদ মিনারে পরবর্তী সময়ে নীরব মানববন্ধনে কীভাবে নাশকতার আশঙ্কা থাকে? দশ-পনেরোজন মিলে একজনকে পেটানোর সময় মরিয়াম নামের ছাত্রীটি তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলে কোন আশঙ্কায় তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়?

আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের লোক থাকতে পারে, তারা ইন্ধন দিতে পারে এই যুক্তিও হামলার পক্ষে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কোনো আইনে কি লেখা আছে যে বিএনপি-জামায়াত করলে সে কোনো সমাবেশে বা আন্দোলনে যোগ দিতে পারবে না? বাংলাদেশের কোনো আইন বা কোথাও এটি লেখা নেই।

কোনো সমাবেশে কারও হাতে অস্ত্র বা বিস্ফোরক থাকলে তাকে নাশকতার ইন্ধন বলা যেতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা বরাবর সমাবেশ করেছেন বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি আর জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে। এসব কি নাশকতার ইন্ধন?

গোটা আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপর যে হামলাগুলো ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ একতরফা এবং বেআইনি। সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে, যা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

কিন্তু তারপরও এই হামলার দায় ছাত্রলীগের একার নয়। আমাদের এটিও বিবেচনা করতে হবে, তাদের এসব গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ক্যামেরার সামনে নির্দ্বিধায় করার সাহস কে বা কারা দিয়েছে। তাদের নির্বিচার হামলার ঠিক আগে আগে হয় পুলিশ আক্রমণের স্থান ত্যাগ করেছে অথবা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশ এই আক্রমণে কোনো বাধা দেবে না এটি না জানলে কীভাবে তাঁরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা করেন? এটা তাঁদের কারা জানাতে পারে নিশ্চিতভাবে? এসব অপরাধ করার পরও ছাত্রলীগের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, তঁাদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করার সাহস পায়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেননি। রাষ্ট্রের পুলিশ, গোয়েন্দা, আদালত এমন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান কোন শক্তির দাপট বা হস্তক্ষেপে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছে ছাত্রলীগ। এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনকে ওই শক্তিই পেটোয়া বাহিনীতে রূপান্তর করছে। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক বর্বরতার ঘটনাগুলোর মূল দায়দায়িত্ব তাদেরই। 

দায়দায়িত্ব আমাদেরও আছে। আমাদের কেউ কেউ অতীতে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। অথচ এত বড় বর্বর আক্রমণের ঘটনাগুলোর পর আমাদের সেসব প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবীর অনেকে নিশ্চুপ রয়েছেন। দায় আমাদের এসব মৌসুমি বিবেকবানদেরও।

দায় রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতিগুলোরও। এঁদের অনেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ঢল দেখে একে ন্যায়সংগত আখ্যায়িত করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। আজ সেই আন্দোলনের নেতাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হয়রানিমূলক মামলার পর তাঁরা নিশ্চুপ থেকেছেন, কেউ কেউ এমনকি শোচনীয় ও দায় এড়ানো বক্তব্য প্রদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেই দিয়েছেন আঠারো বছরের ওপরের কারও দায়দায়িত্ব তাঁর নিজের। অথচ তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অভিভাবক হওয়ার কথা তাঁরই। আর আঠারো বছরের ওপরের ছাত্রদের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজের দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছে এ দেশের বহু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

আশার কথা, বাম ছাত্রসংগঠনসহ কিছু মানুষ এই নৈরাজ্যকর সময়ে তবু প্রতিবাদ করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন। একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, তাঁদের চিকিৎসা দিতে বাধাদান ও হয়রানিমূলক মামলার প্রতিবাদ করা মৌলিক একটি মানবাধিকার। এই প্রতিবাদ না থাকার মানে হাতুড়ি আর রামদাকে মেনে নেওয়া, পুলিশ আর সরকারি ছাত্রসংগঠনের অনাচারকে মেনে নেওয়া, নিজেকে বিবেকবর্জিত বা পলায়নপর মানুষ হিসেবে ঘোষণা করা।

আমরা বেশির ভাগ সুবিধাভোগী মানুষ যদি এমন হয়ে যাই, তাহলে এই সমাজে শক্তিতন্ত্র আরও জেঁকে বসবে। এক অশুভ শক্তির প্রতিবাদ না করতে পারলে অন্য অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলব। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিবান্ধব একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। সরকার এটি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারলেই তা সবার জন্য মঙ্গলকর হতো। দেরিতে হলেও কোটা সংস্কারের জন্য সরকার কমিটি ঘোষণা করেছে। এই কমিটি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই।

কমিটির কাজ দ্রুত শেষ করে ন্যায়সংগতভাবে কোটা সংস্কারের পদক্ষেপ নিলে এই আন্দোলনের পেছনে অশুভ শক্তি আছে কি না, এ নিয়ে সরকারকে দুর্ভাবনায় থাকতে হবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলে ছাত্রসমাজের ক্ষোভ ও মনোবেদনাও বহুলাংশে হ্রাস হওয়ার কথা। আর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এটিও প্রমাণিত হবে যে এসব হামলার পেছনে সরকারের কারও কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।


  • আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮