বর্তমানে তো ভোট ডাকাতি ও চুরি হচ্ছে — সাখাওয়াত হোসেন
সরকারি কর্মকর্তারা বেশি আলীগার হয়েছেন — তোফায়েল আহমদ
ইসির কর্মকর্তারা একটি দলের পক্ষে নিচ্ছে — শারমিন মুর্শিদ
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। স্বাধীন। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানও নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন আরো চারজন কমিশনার। দেশে গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির স্টিয়ারিং কার হাতে? সিইসি’র নের্তৃত্বে গঠিত ৫ কমিশনারের হাতে — নাকি সরকারি আমলা ইসি সচিবের হাতে? প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সিদ্ধান্ত ইসির হাতে থাকা উচিত। আমরা সঠিক ভাবে ইভিএম চালু করতে পারি নাই। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তিন মাসে চার লাখ ইভিএম কিভাবে বসানো হবে?
অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, ইসিকে আগে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তারা বেশি আওয়ামী লীগার হয়েছেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের আগে তার ভালো-মন্দ দিকগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত।
ব্রতি’র প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ বলেন, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে আমরা অাগে থেকে কথা বলে আসছি। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না --- ইসি এটাই জানিয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষপটে ইসির কর্মকর্তারা একটি দলের পক্ষে নিচ্ছে।
‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারে ইসি প্রস্তুত নয়’ --- প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এ ঘোষণা দিয়েছেন কয়েক মাস আগে। তার এই মতের সঙ্গে সব মহল একমত হওয়ার পরও হঠাৎ ইসি সচিব হেলাল উদ্দিন আহমদ ১৬ জুলাই সাংবাদিকদের জানান, ইভিএমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি, সময় আছে। কমিশন ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে। খুলনা সিটি নির্বাচনের পর কমিশন সচিব ঘোষণা দেন, ভোটার উপস্থিতিতে ইসি খুশি, নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণ যোগ্য হয়েছে। অথচ কয়েকদিন পর গাজীপুর নির্বাচনের সময় সিইসি খুলনার নির্বাচনে অনিয়মের কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে বলেন, গাজীপুরের নির্বাচন খুলনার মতো বিতর্কিত হবে না। কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, খুলনা সিটির নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অথচ গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর সচিব প্রতিক্রিয়া দেন ভোট নিরপেক্ষ ও সুন্দর হয়েছে, কিন্তু সিইসি নীরব।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নয়’ -- মর্মে ইস্যুটি প্রায় ফয়সালা হয়ে যায় ২০১৭ সালে। এ তথ্যটি নিশ্চিত করে বেসরকারি সংস্থা ব্রতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুর্শিদ। ওই বছরের মাঝামাঝি সময় নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপেে বসে। সেখানে দু’একজন ছাড়া সকলেই এ মুহুর্তে ‘ইভিএম নয়’ মত দেন। আওয়ামী লীগ থেকে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় কিনা পরীক্ষা নিরীক্ষার পক্ষে মত দেয়া হয়। কিন্তু বিএনপি থেকে ইভিএম-এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়। নির্বাচন নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারাও ইসিকে পরামর্শ দেন, ইভিএম দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এ মুহুর্তে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য। নতুন করে বিতর্কে না গিয়ে নির্বাচনের অগ্রসর হওয়া উচিত। পরবর্তীতে সিইসি কে এম নূরুল হুদা ‘সব রাজনৈতিক দল ও ভোটাররা ইভিএমের পক্ষে মত দিলে জাতীয় নির্বাচনও ইভিএম ব্যবহার হবে’ অভিমত দিলে বিএনপি থেকে ‘এটা দুরভিসন্ধিমূলক ও গভীর রহস্য’ অভিহিত করে বিবৃতি দেয়া হয়। অতপর সিইসি বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসি ইভিএম ব্যবহারের ব্যাপারে প্রস্তুত নয়’। সিভিল সোসাইটি, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক-গবেষকরাও একাদশ নির্বাচন ইস্যুতে ইভিএম বিতর্ক না করার পরামর্শ দিলে সিইসি স্পষ্ট করে ঘোষণা দেন ‘স্টেকহোল্ডাররা না চাইলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম নয়’। কিন্তু ১৬ জুলাই নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালউদ্দীন আহমদ হঠাৎ করে ইভিএম বিতর্ক সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি-না সে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সময় আছে কমিশন ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে। অর্ধশত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন না দেয়া এবং একের পর এক স্থানীয় নির্বাচনে নিয়ন্ত্রিত ভোট হওয়া নিয়ে ইসির ওপর মানুষ যখন আস্থা রাখতে পারছে না তখন কেন নতুন করে ইভিএম বিতর্ক? আর ইসির কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত সিইসি এবং কমিশনারদের বদলে সরকারি কর্মকর্তা ইসি সচিব কেন আগে প্রকাশ করেন?
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের অভিমত হলো নির্বাচন কমিশনের ইমেজ তলানিতে। কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ কার্যত নির্বাচন কমিশনকে সরকারের মেরুদণ্ডহীন আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। কে এম নূরুল হুদা কমিশনের প্রতি প্রত্যাশা ছিল ইসির কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্য-গ্রহণযোগ্য’ করে তুলবেন। মানুষের আস্থা অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। নির্বাচন কমিশনের একাদশ জাতীয় সংসদের রোডম্যাপ ঘোষণা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর ইসির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। কিন্তু খুলনা ও গাজীপুর নির্বাচন বর্তমান ইসির প্রতি মানুষের আস্থা আবার পড়েছে তলানিতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞের মতে, নির্বাচন কমিশন সরকারের ‘তালুবন্দী’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। তারা সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ করে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভোটের নামে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যে এখন আর ব্যালট পেপার ছিনতাই, সংঘাত-সংঘর্ষের প্রয়োজন পড়ে না। প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে এমনিতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করা যায়।
একাদশ নির্বাচন ইস্যুতে জাতিসংঘ, বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা, ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জার্মানি ইত্যাদি দেশের কূটনীতিকরা মাঠপর্যায়ে থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন কমিশনের কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা গত দেড় বছরে কয়েক দফা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নানান পরামর্শ দিয়েছেন। তারা নির্বাচনের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাসও দেন। তারা খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসির পক্ষপাতিত্বের কৌশলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গত ১৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন বাংলাদেশ সরকার যেন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজন করে এটাই আশা করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বৈঠকে মার্শা বার্নিকাট নির্বাচনগুলো যতোটা সম্ভব অনিয়মমুক্ত করার জন্য সরকারের অবস্থান কি সেটাও জানতে চান বার্নিকাট। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এর আগে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশেরই প্রতিফলন ঘটে থাকে জাতীয় নির্বাচনে। ঢাকায় কর্মরত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার অ্যালিসন বেক বলেছেন, আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট-ই শুধু নয়, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াই শান্তিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের সবস্তরের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার প্রত্যাশা করেন।
জানতে চাইলে সাবেক কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের কমিশন সময় ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। তার পর আমরা সঠিক ভাবে চালু করতে পারি নাই। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তিন মাস সময় আছে সে খানে চার লাখ ইভিএম কিভাবে বসাবে পরে তা আমার জানা নেই। আমি চাই ইভিএম আস্তে আস্তে চালু হোক। তিনি বলেন, আগে শুনতাম ইভিএম ভোট হ্যাক করবে। কিন্তু বর্তমানে তো ভোট ডাকাতি ও চুরি হচ্ছে। তা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। তার মানে বেড়া ক্ষেত খেলে করার কিছু নাই।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের আগে তার ভালো-মন্দ দিকগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত। আর নির্বাচনের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। যে প্রযুক্তি গ্রহণ করা হোক না কেন তা রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে তা করা উচিত। খুলনা ও গাজীপুর সিটির ভোট নিয়ে বর্তমান কমিশন বির্তকের সৃষ্টি করছে। আগামীতে এ রকম থাকলে কি হবে তা বলা যাচ্ছে না। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আসতে আসতে ইভিএম চালু করা যেতে পারে, তবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য নয়। কারণ এত গুলো যন্ত্র নাই এবং জনবলও সংকটে রয়েছে। তার পর ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে রাজনীতিক দলগুলোর সাথে কথা বলতে পারে ইসি। তার আগে কিছু নয়। তারা যদি মতামত দেয় তা হলে দুই একটিতে করতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান সিটি নির্বাচন নিয়ে ইসিকে জনগণ বিশ্বাসে নিতে পারছে না। এগুলো করতে হলে ইসিকে আগে বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। বর্তমান আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তারা বেশি আওয়ামী লীগ হয়েছেন। এ কারণে নিরপেক্ষ বিষয়টি উঠে যাচ্ছে। আর মাঠে থাকা বিএনপি কোনো বিয়ষ নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারছে না।বেসরকারি সংস্থা ব্রতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুর্শিদ ইনকিলাবকে বলেন, ইভিএম ব্যববার নিয়ে আমরা আগে কথা বলে আসছি। তখন ইসি আমাদের জানিয়েছে সমান্য কিছু কেন্দ্র ইভিএম ব্যবহার হবে। তবে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না। কিন্তু কয়েকটি সিটিতে ইভিএম ব্যবহার করেছে ইসি সাধারণ মানুষ কিছু বলে নাই। আর পর এখন ইসি এখন বলছে ইভিএম ব্যবহার করবে তার মানে এখনে কিছু খাকতে পারে। বর্তমান ইসির আমলে যে কয়েকটি নিবাচন হয়েছে সব গুলো নিয়ে বির্তক হচ্ছে। ইভিএম নয় আগের পুরাতন নিয়মে জাতীয় নির্বাচন দরকার। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষপনে ইসির কর্মকর্তারা একটি দলের পক্ষে নিচ্ছে এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে সামনে অনেক কঠিন সময় পার করতে হবে।
- সূত্র — ইনকিলাব। বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৯, ২০১৮।
---