গোলাম মর্তুজা ও আসাদুজ্জামান
- পুলিশ এ পর্যন্ত ৫১টি মামলায় ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে
- গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২
- গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অন্তত চারজন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী
- দুই শিক্ষার্থীকে শিশু গণ্য করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তাদের মধ্যে অন্তত চারজন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এই চারজনের মধ্যে দুজনকে আদালত শিশু গণ্য করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন।
আন্দোলনের সময় সংঘাত, ভাঙচুর, উসকানি ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ এ পর্যন্ত ৫১টি মামলায় ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এঁদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া এজাহারে নাম থাকায় পলাতক আছেন ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ জন শিক্ষার্থী। তাঁরা ২১টি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র।
আন্দোলনের সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার না করতে এবং এদের কেউ আটক হলে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দিতে পুলিশের একটা নির্দেশনা ছিল। তখন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, স্কুল-কলেজের একজন শিক্ষার্থীকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে মামলার নথি থেকে দুই শিশুসহ স্কুল-কলেজের চার শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, উত্তরা পশ্চিম থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া তিন শিক্ষার্থী আসামির দুজনকে ‘শিশু’ হিসেবে গণ্য করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন আদালত। এই দুজন হলো মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দুই ছাত্র। যদিও মামলার এজাহারে তাদের বয়স ‘১৮’ উল্লেখ করা হয়েছে। অপরজন আইইউবিএটির ছাত্র। তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
তুরাগ শাখা ছাত্রলীগের সদস্য দীন ইসলামের ওপর হামলা ও মোটরসাইকেল ভাঙচুরের অভিযোগে উত্তরা পশ্চিম থানায় ৫ আগস্ট ১১২ জনকে আসামি করে এই মামলা করেছিলেন দীনের বাবা পরশ আলী। মামলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৬২ নেতা-কর্মী এবং ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ২টি স্কুল-কলেজের ৫০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এদের বিরুদ্ধে দীন ইসলামের সোনার চেইন ও মুঠোফোন ছিনতাই এবং ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগও আনা হয়।
ছাত্রলীগ নেতা দীন ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট বনানী থেকে ফেরার পথে হামলার শিকার হন তিনি। এ ঘটনার সঙ্গে যুবদলের লোকজন জড়িত ছিলেন। তাহলে এত শিক্ষার্থীকে আসামি করলেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের নেতাদের পরামর্শে এ মামলা দেওয়া হয়েছে।
উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের কিছু ছেলেকে মারধর করে জখম ও তাঁদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছিল। তাঁরাই ভিডিও ফুটেজ দেখে এসব ছাত্রসহ অন্যদের নামে মামলা করেছেন।
৪ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হিউম্যান হলার ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে এক কলেজছাত্রসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন পুরান ঢাকার কে এল জুবিলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়ে আছে। তার আইনজীবী জাকির মোল্লা বলেন, জগন্নাথের সামনে সেদিন কোনো ভাঙচুরই হয়নি। কলেজে টাকা জমা দিয়ে ফেরার সময় কিছু ছাত্র তাঁকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। ওর বাবা ইটভাটায় কাজ করেন।
রমনা থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার এক ছাত্র। তার আইনজীবী তৌসিফ মাহমুদ বলেন, মামলায় তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৮ বছর। কিন্তু সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তার বয়স ১৩ বছর ১ মাস।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই
অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর আইনজীবীরা প্রথম আলোকে বলেছেন, মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়নি। বেশির ভাগ ছাত্রকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে সন্দেহজনকভাবে। আদালতকেও তাঁরা এসব কথা বলেছেন। তাঁরা জানান, আজ রোববার ও আগামীকাল ছাত্রদের জামিনের জন্য ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে শুনানি করবেন। আদালত যদি জামিন না দেন, তাহলে এসব ছাত্রের ঈদ কাটবে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে।
অন্তত ১০ জন ছাত্রের বাবা-মা জানিয়েছেন, আদালতের দিকেই তাকিয়ে আছেন তাঁরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেদোয়ান ও তারিকুলের আইনজীবী কবির হোসাইন বলেন, অভিভাবকেরা বেশ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।
ছাত্রদের বিরুদ্ধে করা আটটি মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের মামলায় সন্দেহজনকভাবে ছাত্রদের গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সংঘাতের সময় ঘটনাস্থল থেকে তেমন কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পরে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগকেই শনাক্ত করে বা ধরে পুলিশে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তবে গ্রেপ্তার হওয়াদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে ফেসবুকের পোস্ট বা মুঠোফোনের ছবি ছাড়া তেমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই পুলিশের হাতে। আবার কয়েকটি মামলার বাদীও হয়েছেন সরকারপন্থী নেতারা।
ঢাকা মহানগরের উত্তরা, রমনা ও ওয়ারী বিভাগের তিনটি থানার দুই ওসি এবং একজন পরিদর্শকের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা হয়। তাঁরা বলছেন, আন্দোলনের পর থেকেই তাঁরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে একে-ওকে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা পেয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়া অনিশ্চিত
ভাঙচুর ও ফেসবুকে উসকানিমূলক তথ্য দেওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের আইনজীবীরা আদালতকে বলেছেন, কারাগারে থাকার কারণে ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে পারছেন না। তাঁদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ছেন তাঁরা।
রমনা থানার মামলায় গ্রেপ্তার বুয়েটের ছাত্র দাইয়ান নাফিসের আইনজীবী ফায়জুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দাইয়ান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়ছেন। ১ সেপ্টেম্বর তাঁর পরীক্ষা। কারাগারে থাকায় পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে পারছেন না।
ফেসবুকে ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ নিয়ে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন রাফসান আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র তিনি।
১ আগস্ট গ্রেপ্তার হন আরমানুল হক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তাঁর আইনজীবী সাবিবা বেগম বলেন, আদালতকে তিনি জানিয়েছেন, চলতি মাসের ১৬ আগস্ট তাঁর পরীক্ষা ছিল। কিন্তু কারাগারে থাকায় পরীক্ষা দিতে পারেননি।
এর আগে বাড্ডা ও ভাটারা থানার মামলায় গ্রেপ্তার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্তত ১০ জন ছাত্রের আইনজীবী আদালতকে জানান, কারাগারে থাকার কারণে পরীক্ষা দিতে পারছেন না তাঁরা। তবে কোনো ছাত্রই জামিন পাননি।
শিক্ষার্থীদের বাবা-মা ও স্বজনেরা থানার পুলিশ, আদালত আর কারাগারে ঘুরেই দিন পার করছেন। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র ইকবাল হোসেনের বাবা দুলাল হোসেন বলেন, তাঁর ছেলেকে ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ৪ আগস্ট ধানমন্ডিতে সংঘর্ষে অংশ নেওয়া, আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া অন্য চারজনকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সবাই ঈদ করবে আর আমার ছেলেটা জেলে থাকবে!’
বয়স্কদের জামিন
রেলওয়ে রেঞ্জ অফিসের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী ৬৩ বছরের গফুর মিয়া আটক হন আরামবাগ থেকে। বাস ভাঙচুর, হত্যাচেষ্টা ও চুরির অভিযোগে করা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। এ মামলায় ৬ আগস্ট ফয়েজ হোসেন (৫৮) ও হুমায়ুন কবীর মুজিব (৩৯) নামের আরও দুজনকেও গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পরদিন শুনানি শেষে আদালত তাঁদের জামিন দেন। আদেশে আদালত বলেন, হত্যাচেষ্টা ও চুরির অভিযোগ সুনির্দিষ্ট নয়। আসামিরা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তাই তাঁদের জামিন দেওয়া হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারা শিশু। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে তারা জামিন পাবেই। অজামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ না থাকলে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করতে হয়। আর যেসব শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছরের ওপরে কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকে, অপরাধ যদি অজামিনযোগ্য না হয়ে থাকে, তাহলে তো এসব শিক্ষার্থীর জামিন পাওয়ার অধিকার আছে। তার থেকেও বড় কথা সামনে তাঁদের পরীক্ষা। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকলে তাঁদের জামিনের বিষয়টি আদালত বিবেচনা করতে পারেন।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ আগস্ট ১৯,২০১৮