‘স্বপ্নভঙ্গ’ বইয়ে বিচারপতি সিনহা
২০১৭ সালে বর্তমান সরকারের চাপে পদত্যাগ ও দেশান্তরি হতে বাধ্য হয়েছি বলে দাবি করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। একটি স্বপ্নভঙ্গ : আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র-এ শিরোনামে সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে এ দাবি করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। প্রতিষ্ঠিত কোনো পাবলিকেসন্স বইটি প্রকাশ না করলেও বইটি স্বত্ব দেয়া হয়েছে ললিতমোহন-ধনভতি মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনকে।
বইটিতে বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সাফল্য-ব্যর্থতা, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, প্রতিরক্ষা ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা, আদালত অবমাননা, বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।
এ ছাড়া বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নিয়ে। বইটির শেষ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে বিচারপতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে। প্রত্যেকটি অধ্যায়ে তথ্যের পাশাপাশি তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বইটির মুখবন্ধে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা দাবি করেন, সিলেটের একটি আদালতের অ্যাডভোকেট থেকে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার সুযোগ হলেও ২০১৭ সালে বর্তমান সরকার কর্তৃক জোরপূর্বক দেশত্যাগ, পদত্যাগ ও নির্বাসনে যেতে বাধ্য হই। এটা ছিল বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজির বিহীন ঘটনা। বইটিতে তিনি আলোচনা করেছেন বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের বাড়াবাড়ি, জরুরি অবস্থায় ডিজিএফআইয়ের বিতর্কিত ভূমিকা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। উল্লেখ্য, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে বাস করছেন।
চাপের মুখেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছি : সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বই নিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, বাংলাদেশের এই সাবেক প্রধান বিচারপতি দাবি করছেন- তাকে সরকারের চাপ এবং হুমকির মুখে দেশত্যাগ করতে হয়েছে।
এ বইতে বিচারপতি সিনহা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন কোন পরিপ্রেেিত সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ হয়েছিল এবং কিভাবে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তারপর কেন তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের একটি এজেন্সির হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মুখে তিনি দেশ ছেড়েছেন। বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি যেন সরকারের প যায়, সেজন্য তার ওপর সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
সিনহার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত একটি মামলার আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে। এ রায় নিয়ে মতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কাছ থেকে প্রচ চাপের মুখে বিচারপতি সিনহা দেশ ছেড়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
বইটির মুখবন্ধে সুরেন্দ্র সিনহা লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের অন্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমার কঠোর নিন্দা করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ কেবিনেট মন্ত্রীরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে বদনাম করতে শুরু করেন।
আমি যখন আমার সরকারি বাসভবনে আবদ্ধ, আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না, তখন সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় আমি অসুস্থ। আমি চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি।’ ‘একাধিক মন্ত্রী বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবো।"
‘অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যখন আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই তখন একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমি পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টা করি যে, আমি অসুস্থ নই এবং আমি চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না।’
‘আমি আশা করছিলাম যে, আমার প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত ছুটি- এ দুটো মিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে এবং শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সরকার ওই রায়ের যে মর্মবস্তু অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর তা বুঝতে পারবে।’ ‘শেষ পর্যন্ত একটি এজেন্সির ভীতি প্রদর্শন এবং আমার পরিবারের প্রতি হুমকির কারণে আমি বিদেশ থেকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেই।’
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ নিয়ে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাতকার দিয়েছেন। গত বছরের নানা নাটকীয় ঘটনাবলির পর কোনো গণমাধ্যমে এটিই ছিল তার প্রথম সাাৎকার। তিনি সাাৎকারে বলেন, ‘আমাকে যখন কমপ্লিটলি হাউজ অ্যারেস্ট করা হলো, ...তখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন একজন করে ডাক্তার আমার কাছে পাঠানো হতো। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’
‘এর মধ্যে এক এজেন্সি চিফ এসে বললেন, হ্যাঁ আপনাকে বলা হলো আপনি বিদেশ যাবেন, আপনি যাচ্ছেন না।’ ‘আমি বললাম, কেন যাবো আমি বিদেশে?’
‘আপনি চলে যান আপনার টাকা-পয়সার আমরা ব্যবস্থা করছি।’
“আমি বললাম, এটা হয় না। আমি আপনাদের টাকা নেবো না। আর আপনারা বললেই আমি ‘ইয়ে’ করব না। আমি চাই সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমি আলাপ করি । ব্যাপারটা কী হয়েছে আমি জানতে চাই। (তিনি) বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে কথা বলবেন না।” বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের ইমপিচ করার মতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে পার্লামেন্টের সদস্যদের দেয়ার পর ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করে এবং সাত সদস্যের একটি বেঞ্চে আপিলের শুনানি হয়।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বইতে লেখেন, ‘জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখেন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ সর্বসম্মত রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।’ সেখানে তিনি লেখেন, ‘ওই সিদ্ধান্তের পর সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে, যাতে সেই রায়কে বাতিল করার জন্য আইনি পদেেপর আহ্বান জানানো হয়।’
- কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮