মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় বিদেশিদের ৪ সুপারিশ
‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের’ ৫৭ ধারা এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের’ ধারাগুলো সংশোধনসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় সাংবিধানিক ব্যবস্থা জোরদারের সুপারিশ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। গত মে মাসে জেনেভায় ‘ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউয়ে (ইউপিআর)’ বাংলাদেশ এ সুপারিশের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে মতামত জানানোর সময় চেয়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বলেছে, কোনো মন্তব্য ছাড়াই তারা এ সুপারিশ গ্রহণ করছে। অর্থাৎ ওই সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করবে।
২০০৬ সালের ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের’ ৫৭ ধারার মতো মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টিকারী আইন/ধারাগুলো পর্যালোচনা ও সংশোধনের সুপারিশ করেছিল মেক্সিকো। নরওয়ের সুপারিশ ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা, যাতে অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। সুইডেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক রীতি ও মানের সঙ্গে সংগতি রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া সাজানোর সুপারিশ করেছিল। কোনো মন্তব্য না করেই বাংলাদেশ এসব সুপারিশ গ্রহণ করার কথা জানিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশের ইউপিআর প্রতিবেদনে এসব বিষয় থাকছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় বাংলাদেশ যখন জাতিসংঘে জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার করছে তখন দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার জোরালো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের ফলে ৫৭ ধারাসহ পুরো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বাতিল হবে। ৫৭ ধারার আওতায় যেসব ব্যবস্থা ছিল, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারায় ভেঙে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫৭ ধারায় অপরাধের যে পরিসরগুলো ছিল, নতুন আইনে তার পরিসর আরো বাড়ানো হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল’কে গণমাধ্যম ও বাক্স্বাধীনতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘একদিকে ওই বিলের ৮, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারাগুলোর ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্বেগ ও মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা তাদের স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে বিতর্কিত ৩২ ধারার ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ অনুসরণের সুপারিশ করার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত হতাশা ও দুঃখজনক।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবিধানের মূল চেতনা, বিশেষ করে মুক্তচিন্তা, বাক্স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীন বিকাশের পথ ব্যাপকভাবে রুদ্ধ হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা বোধ সৃষ্টি করবে।’
জানা গেছে, গত মে মাসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় সরকার বিভিন্ন দেশের ১৬৭টি সুপারিশ গ্রহণ করে এবং ৬০টি গ্রহণ করতে অপারগতা জানায়। ২৪টি সুপারিশের জবাব দিতে সরকার সময় নিয়েছিল এবং সেগুলো গত ১০ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনের আগেই জানানোর কথা ছিল।
সে অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার যে জবাব দিয়েছে তা গত ৩১ আগস্ট মানবাধিকার পরিষদ তার সদস্য ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বিতরণ করেছে। এর আগে গত ১৪ মে জেনেভায় ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশকে এ বছর গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়ার আহ্বান জানায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ তুলে উদ্বেগ এবং প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানায়। অস্ট্রেলিয়াও এ বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
কানাডা আগামী নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক দলসহ সবার মত প্রকাশ ও সমবেত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশকে সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে জাপান বাংলাদেশকে সব দলের পূর্ণ অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা জোরদারের সুপারিশ করেছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এসবের জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো সমবেত হওয়ার ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোর স্বাধীনতা চর্চা করে। তিনি বলেন, এটি দুঃখজনক যে ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনী প্রক্রিয়া বর্জন বা ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। অনেকেই এর নিন্দা জানিয়েছে। সরকার যেকোনো মূল্যে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ সম্প্রতি যেসব সুপারিশের জবাব দিয়েছে, সেগুলোর অন্যতম ‘আদিবাসী’ ইস্যু। সরকার বলেছে, এ দেশের সংবিধানে ‘ইন্ডিজেনাস’ (আদিবাসী) বলে কিছু নেই। এ দেশের সব নাগরিকই এই ভূখণ্ডের আদিবাসী। তবে সরকার কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের নিজস্ব ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে।
‘গুমের’ অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বলেছে, এ দেশের আইনি ব্যবস্থায় ‘গুম’ বলে কিছু নেই। অপহরণের মতো অপরাধগুলো এ দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের অপরাধের দায়মুক্তি নেই।
একইভাবে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ বলে কোনো ব্যবস্থাও বাংলাদেশের আইনে নেই। সরকার সব নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় অঙ্গীকারের কথা জানিয়ে বলেছে, সমকামীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন তারা অনুভব করছে না।
মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা বিলোপের সুপারিশের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরে সরকার বলেছে, অত্যন্ত গুরুতর ও ঘৃণ্য অপরাধের ক্ষেত্রেই শুধু এ ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছু ধাপে পর্যালোচনার সুযোগ রেখে এটি কার্যকর করা হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের ইউপিআর প্রতিবেদন আজ মানবাধিকার পরিষদে উত্থাপনের পর এগুলো নিয়ে আলোচনা শেষে তা গৃহীত হবে।
- কার্টসিঃ কালের কণ্ঠ/ সেপ্টেম্বর ২০,২০১৮