সম্পাদকীয়
গায়েবি মামলা
বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ বলে পরিচিত। তাই বলে যা ঘটেনি, ঘটনার সামান্য আভাসও দেখা যায়নি, সেই কল্পিত কাহিনি সম্বল করে মামলা করার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর এর একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপির মহাসচিবসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের। এটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপকৌশল ছাড়া কিছু নয়।
সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, গত রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসভার পর ঘরে ফেরার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলটির বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়, ‘রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য দেন এবং তাঁদের এমন বক্তব্যের পর রাত আটটার দিকে হাতিরঝিল থানার মগবাজার রেলগেট এলাকায় বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও জামায়াত-শিবিরের ৭০ থেকে ৮০ জন নেতা-কর্মী জড়ো হন। তাঁরা রাস্তায় যানবাহন চলাচলে বাধা দেন। তাঁরা পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইটপাটকেল ছোড়েন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মারধর করেন, ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান।’
প্রথম আলোর প্রতিনিধি পরদিন সেখানকার ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে পুলিশের দাবির কোনো সত্যতা পাননি। ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেছেন, ‘এ রকম তো কোনো খবর পাইনি।’ মগবাজার এলাকায় বিএনপি ভাঙচুর করেছে, আর সেখানকার মানুষ খবর জানবেন না, এটি কী করে সম্ভব? এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা মাত্র। তিনি বলেছেন, বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ফেরিতে প্লেট চুরির মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে প্লেট চুরির কাল্পনিক মামলা দেওয়া হলেও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এখন গায়েবি মামলা ন্যায্যতা পায় না। দুটিই নিন্দনীয় ও আইনের শাসনের পরিপন্থী।
বিএনপির দাবি, ১৯টি জেলা ও মহানগরে ৫৮টি গায়েবি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শেরপুর জেলায় আটটি, টাঙ্গাইলে চারটি, দিনাজপুরে ছয়টি, নারায়ণগঞ্জে দুটি, খুলনায় চারটি, খুলনা মহানগরে তিনটি, শরীয়তপুর জেলায় একটি, মাদারীপুরে দুটি, মাগুরায় দুটি, পটুয়াখালীতে দুটি, সিরাজগঞ্জে দুটি, ভোলায় একটি, নেত্রকোনায় দুটি, কুমিল্লায় আটটি, ময়মনসিংহে তিনটি, নরসিংদীতে দুটি, হবিগঞ্জে দুটি এবং রাজশাহী মহানগরে চারটি। আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৪০ জন নেতা-কর্মীকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ জন নেতা-কর্মীকে।
রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নামে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা করা শুধু বেআইনি নয়, উসকানিমূলকও। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজনেরা যে আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেটাই সত্যে পরিণত করলেন পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাঁরা যদি ঘটনা না ঘটলেও উসকানির গন্ধ পান, সংবাদমাধ্যমে কিছু প্রকাশ না পেলেও ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করবেন, তাতে সন্দেহ কী। নির্বাচন সামনে রেখে অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের এসব গায়েবি মামলা নির্বাচনের পরিবেশই শুধু ব্যাহত করবে না, সরকারকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে।
এসব মামলার তদন্ত করতে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় কমিশন চেয়ে তিনজন আইনজীবী যে রিট করেছেন, তার সুবিচার প্রত্যাশিত।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৪ অক্টোবর ২০১৮