Search

Thursday, October 4, 2018

মানবেতর জীবন কোটা আন্দোলনের নেতাদের

টিউশনি নেই, থাকার জায়গার সমস্যা


কারো বাবা মৎস্যজীবী, কারো বাবা রিকশা চালক। বাবার উপার্জনের টাকায় কোনোরকম সংসার চলে। নিজের পড়ার খরচ মেটাতে তাই টিউশনিই তাদের একমাত্র ভরসা। সেই টিউশনিও চলে গেছে। থাকার জায়গা নেই। শেষ আশ্রয়স্থল হলের বরাদ্দকৃত রুমটাও বাতিল করা হয়েছে। আজ আত্মীয়ের বাসায় তো কাল বড় ভাইয়ের বাসায়। অর্থ ও আবাসন সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন কোটা আন্দোলনের নেতারা।

আগের মতো বাইরে চলাফেরা করতে পারেন না। মামলার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। এ অবস্থায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে নিজেদের মানবেতর জীবনযাপনের বর্ণনা দিয়েছেন কোটা আন্দোলনের সাত নেতা। 

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের পড়ালেখার খরচ থেকে শুরু করে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা সবই চলে টিউশনির টাকায়। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে নানা ধরনের হুমকি ধমকি দিয়ে হল ছাড়া করা হয়। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুম থেকে বই খাতাসহ মূল্যবান জিনিসপত্রগুলো হল থেকে বের করে বারান্দায় ফেলে রাখা হয়। এখন আমরা একধরনের গৃহহীন অবস্থায় আছি। এখন অনেকটা যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছি। হল ছাড়া হওয়ার কারণে আজকে এক জায়গায় তো কাল অন্য জায়গায়। গৃহহীন থাকা অবস্থায় আমাদের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের হুমকি আসে। ফলে অনেকেই আমাদের টিউশনি দিতে চায় না। 

সাধারণ মানুষ আমাদের টিউশনি দিতে ভয় পায়। অভিভাবকরা আমাদের টিউশনি দিলে সরকার আবার তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয় কিনা সেই ভয়ে আমাদের টিউশনি দিতে চায় না। যে কারণে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে সামনের সারিতে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কারোই এখন টিউশনি নেই। তার ওপর প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে প্রতি মাসে এক থেকে দুই বার করে মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে যেতে হয়। পাবলিক বাসে আমাদের আক্রমণ হওয়ার ভয় থাকে। সব মিলিয়ে আমরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছি। নুর, মশিউর, আতাউল্লা, মামুন, বিন ইয়ামিন, রাতুল, সোহেলসহ কোটা আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের একই অবস্থা।   

কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক নেতা রাতুল সরকার বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলনে যোগদানের পর থেকেই আমার হাতে থাকা টিউশনিগুলো এক এক করে চলে যেতে থাকে। আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আমরা সকলেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। প্রত্যেককে নিজের খরচ নিজেই চালাতে হয়। আমার বাবা মো. শামীম আলী পেশায় একজন জেলে। নদীতে মাছ ধরে তা বিক্রি করে সংসার চলে। দুই ভাই বোনের মধ্যে আমি বড়। বাবার পক্ষে আমার পড়ালেখার খরচ চালানো সম্ভব নয়। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জেলে যাওয়ায় আগের সব টিউশনি হাত ছাড়া হয়ে গেছে। বড় ভাইদের দিয়ে নতুন করে টিউশনির খোঁজ নেয়া হলে রাতুল নামটি শোনার পরে অভিভাবকরা বলে পরে জানাবো। আগে যেহেতু পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে তাই অভিভাবকদের মনে সংশয় কাজ করে। আবার নতুন করে যদি ঝামেলা হয়। তারা যদি কোনো বিপদে পড়ে। এসব বিষয় মিলিয়ে অভিভাবকরা এখন আর আমাকে ডাকে না।

পড়ালেখা যেহেতু শেষ হয় নি তাই নতুন করে কোনো চাকরির জন্য আবেদন করতে পারছি না। গাজীপুরের ভাওয়াল সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রাতুল বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা থানায়। আগে যে মেসে থাকতাম সেখানেও থাকতে নিষেধ করে দিয়েছে। স্থায়ীভাবে কোনো ভাড়া বাসায় উঠবো সেই সুযোগও নেই। এখানে ওখানে আত্মীয়ের বাসায় থাকতে হয়। নিরাপত্তার কারণে তারাও এখন আর থাকতে দিতে চায় না।  

কোটা সংস্কার আন্দোলনের আলোচিত নেতা নুরুল হক নুর বলেন, ১৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের নেতাকর্মীদের হাতেগোনা যে দুই একটা টিউশনি আছে তাতে যেতেও ভয় পাচ্ছেন। যদি ছাত্রলীগ আবার তাদের ওপর হামলা করে। ইতিমধ্যে মশিউর, রাতুলসহ একাধিক নেতাকর্মীর ওপর একাধিকবার হামলা হয়েছে। মশিউরের হাতে ককটেল ধরিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। কাজেই আমাদের সকলের মনে ভয় ও শঙ্কা কাজ করে। টিউশনি শেষে রাতে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবো তো। এই শঙ্কা থেকে আমাদের স্বাভাবিক ও নিরাপদ জীবন বিপন্ন হয়ে পরেছে। প্রত্যেকটি হল যেহেতু ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে তাই হলেও আমরা নিরাপদ নই। আমাদের আবাসিক রুমগুলো ইতিমধ্যে তারা দখল করে নিয়েছে। একা বাসে ওঠার সাহস পাই না। এই বুঝি ছাত্রলীগ হামলা করে। ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই ক্লাসে যায়। এমনকি আমরা পাবলিক বাসে ওঠা বা একা চলাফেরা করাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করি। কারণ, যে কোনো সময় তারা পেছন থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা পিএম সুহেল বলেন, আন্দোলনের সময় আমাকে জেলে নিয়ে যাওয়ার পর সব টিউশনি চলে গেছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তাদের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে অভিভাবকরা জানায় নতুন টিউটর নিয়েছি। এখন আপনাকে নেয়ার সুযোগ নেই। ফলে নতুন করে টিউশনির খোঁজ করলে তারা বলে এদের পুলিশ ধরে নিয়েছিল। ঝামেলা আছে। টিউশনি দেয়া যাবে না। অথচ তারা একবারও বোঝার চেষ্টা করে না কেন  আমাদের পুলিশ ধরে নিয়েছিল। 

এদিকে বাড়িওয়ালা বলে দিয়েছে বাসা ছাড়তে হবে। রাতের বেলা পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। ঝামেলা করে। ডিবি এসে বাড়িওয়ালাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমার বাবা নেই। ৪ ভাই ও এক বোনের মধ্যে আমি চতুর্থ। নিজের খরচ নিজে চালাই। ছোট ভাইয়ের পড়া ও মায়ের খরচও আমাকে চালাতে হয়। আমরা ছাত্র মানুষ। টিউশনি করতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হয়। এই মুহূর্তে হাতে একটাও টিউশনি নেই। কিভাবে চলছি আল্লাহই ভালো জানে। বড় দুই ভাই অন্যের জমি বরগা চাষ করে কোনোমতে খেয়েপরে আছে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মশিউর রহমান বলেন, ছাত্রলীগ হলের সিট বণ্টন করে। আমরা যেহেতু তাদের বিপক্ষে চলে গেছি তাই আমাদের সিটগুলো বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আমরা এখন বাস্তুহারা। আজ ভাইয়ের বাসায় কাল বন্ধুর বাসায়, এভাবে থাকতে হচ্ছে। তাও স্থায়ী ভাবে নয়। তার ওপর যে দুই একটা টিউশনি ছিল সেগুলোও চলে গেছে। বাবা গ্রামের বাড়িতে রিকশা চালালেও বর্তমানে বেকার। নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক দূরে থাকতে হয়। দুই থেকে তিন ঘণ্টা জার্নি করে ক্লাসে আসতে হয়। তার ওপর অনিরাপত্তার বিষয়টাতো থেকেই যায়। এই বুঝি সরকারের ছাত্র সংগঠন হামলা করে। 

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, আগে আমি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এই আন্দোলনে আমরা যারা লিডিং পজিশন বা নেতৃত্বে ছিলাম তারা কেউ এখন হলে থাকতে পারছি না। হলে আমাদের কারোর কোনো সিট নেই। সবার সিট বাতিল করে দখল করা হয়েছে। দুইদিন বাদেই আমাদের সমাবর্তন। সরকারি দলের ছাত্রনেতারা আমাদের সঙ্গে এই পরিমাণ দুর্ব্যবহার করছে যে হলে এসে বন্ধুদের সঙ্গে দুটি ছবি তুলবো, হলে যাবো এই সুযোগটুকুও আমরা পাচ্ছি না। গত ৫ বছরের শিক্ষা জীবনে এটা কত যে কষ্টকর তা বলে বোঝানো যাবে না।

গতকাল হলে যাওয়ার পর আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। যেন হলে না আসি। অথচ ৫ বছরের শিক্ষা জীবনে হলের জন্য এত কিছু করলাম আজ হলে আমার স্থান হচ্ছে না। একটি যৌক্তিক আন্দোলন করেছি। যার সফলতা অনেকটা দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু আদৌ কি আমরা সরকারি চাকরি পাবো। বাবা মো. ছিদ্দিকুর রহমান একজন প্রাইমারি শিক্ষক। বাবার কষ্ট লাঘব করতে আমাকে কম বেশি টিউশনি করতে হয়। কিন্তু আজ আমরা না পারছি টিউশনি করতে। না পাচ্ছি একটি ভালো চাকরির নিশ্চয়তা। তার ওপর মিথ্যা মামলার খড়গ তো মাথার ওপর ঝুলছে। আমরা সরকারের বিপক্ষে না। আমরা চাই সরকারের পক্ষ থেকে মামলাগুলো প্রত্যাহার করে আমাদের আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হোক। 

যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, দীর্ঘ ৭ মাস আন্দোলন করাতে আমাদের অনেক আগেই হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। যারা হলে ছিলাম তারা সবাই টিউশনি নির্ভর ছিলাম। এখন আমাদের টিউশনি নেই। আমরা না পারছি নতুন করে টিউশনির ব্যবস্থা করতে না পাচ্ছি কোনো চাকরি। আমরা এখন একটা অনিরাপদ অবস্থায় আছি। আমাদের অনেকেই ক্লাসে যেতে পারছে না। পরীক্ষার হলে বসতে পারছে না। এদিকে আবাসন সংকট দেখা দিয়েছে। 

আত্মীয়স্বজনদের বাসায় ২ থেকে ৩ দিনের বেশি থাকতে পারি না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক সময় তারা আমাদের থাকতে দিতে চান না। টিউশনি ও চাকরিতো অনেক পরের কথা। এ অবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ ০৪ অক্টোবর ২০১৮

No comments:

Post a Comment