Search

Wednesday, October 3, 2018

শাসক দলের শোচনীয় অবস্থা

বদরুদ্দীন উমর

৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসমাবেশ করেছে। এই সমাবেশের রিপোর্টে দৈনিক যুগান্তর বলছে, ‘জনসভা রূপ নেয় জনসমুদ্রে’। অন্যদিকে প্রথম পৃষ্ঠাতেই প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এই সমাবেশ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বিএনপির সমাবেশই প্রমাণ করেছে দলটি ক্রমেই সংকুচিত ও জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে। তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণেই দলটি জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে’ (যুগান্তর, ০১.১০.২০১৮)।

জনসমাবেশের রিপোর্টে যুগান্তরে যা বলা হয়েছে তা হল, ‘সকাল ১০টার পর থেকেই ঢাকা মহানগর ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসতে শুরু করে। বেলা ৩টার মধ্যেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় ভরে ওঠে। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আয়োজিত জনসভা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। উদ্যান পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের মূল ফটকের সামনের অংশ ও মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত সড়কটিতেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না’ (যুগান্তর, ০১.১০.২০১৮)।




সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রোববার বিএনপির সমাবেশের একাংশ। ছবি: যুগান্তর

শুধু এই রিপোর্ট নয়, সমাবেশের যে ছবি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার থেকেও এই রিপোর্টে বর্ণিত সমাবেশের অবস্থার সমর্থন পাওয়া যায়। কাজেই কেউ একজন বিএনপির সমর্থক না হলেও এই বাস্তব অবস্থাকে তার স্বীকার করতেই হবে যে, ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসভায় অগণিত লোকের সমাবেশ হয়েছিল। তাদের সমাবেশ দেখে এটা মোটেই প্রমাণিত হয় না যে, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন বা বিএনপির অবস্থা ২০১৪ সালের থেকে সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের সাধারণ সম্পাদক এ কথাই বলছেন!

এ থেকে বোঝার কি অসুবিধা আছে, আওয়ামী লীগ নিজেই বাস্তবতা থেকে কতখানি বিচ্ছিন্ন? বোঝার কি অসুবিধা আছে যে, দেশের পরিস্থিতি অনুধাবনের সামান্যতম ক্ষমতাও তাদের এখন নেই?

বোঝার কোনো অসুবিধা নেই যে, তাদের এখন দিশেহারা অবস্থা। তাদের পায়ের তলা থেকে যে মাটি সরে যাচ্ছে বা ইতিমধ্যেই সরে গেছে এই উপলব্ধি তাদের একেবারেই নেই। এ অবস্থায় তাদের ভরসা শুধু নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ। 

জনগণ বা ভোটাররা নয়, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আনুগত্যের হিসাব করেই তারা আগামী নির্বাচনে জয়ের স্বপ্ন দেখছে! এই স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে এবং আওয়ামী লীগের দুরবস্থা যতই প্রকট হচ্ছে, ততই বেশি করে সরকারি মহলের আবোলতাবোল কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এসব কথা তাদের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি না করে জনগণের কাছে হাসির ও রঙ্গরসের খোরাক জোগাচ্ছে। এর পরিণতি যে তাদের জন্য ভালো হতে পারে না, এটা বলাই বাহুল্য।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনে সব স্তরের জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরবর্তী এই পাঁচ বছরে অবস্থা অনেক খারাপ হয়েছে। এখন তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু নির্বাচনের কাছাকাছি মুহূর্তে এসেও তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সড়ক পরিবহন আইনের মতো গণতন্ত্র ও শ্রমিক বিরোধী আইন পাস করতে কোনো দ্বিধাবোধ করেনি। উপরন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ছে এই আওয়াজ তুলে মহা-আনন্দে আছে। কিন্তু তাদের এসব গণবিরোধী কাজ এবং অসার কথাবার্তা জনগণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে এটা বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের আর নেই। শুধু তাই নয়, তাদের অবস্থা এখন এমনই যে, তারা এসব বোঝাবুঝির পরোয়া পর্যন্ত করে না। যে কোনো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের পক্ষে এর থেকে করুণ অবস্থা আর কী হতে পারে?

বিএনপির এই জনসমাবেশ ঠেকানোর জন্য সরকার এবং সরকারি দল ও তাদের জোটের শরিকরা সব রকম চেষ্টাই করেছে, তবে এবার জনগণের চাপে সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে তারা পারেনি। তাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই সমাবেশ সম্পর্কে এক হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, তাদের ঢাকার প্রতিটি অলিগলিতে পর্যন্ত ঠেকানো হবে। কেন ঠেকানো হবে? যে কোনো দলই জনসভা, জনসমাবেশ ডাকতে পারে এবং ডাকার অধিকার তাদের আছে। কাজেই অন্য বিরোধী দল সমাবেশ ডাকলে তাদের লোকজনকে সমাবেশে আসতে বাধা দেয়া হবে কেন? এভাবে বাধা দেয়ার এখতিয়ার তারা কোথায় পেলেন?

তারা নিজেদের সুবিধামতো সব সময় যে সংবিধানের কথা বলেন, সেই সংবিধানের কোথায় এ কথা আছে যে সরকার ছাড়া বিরোধী দলগুলোর মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি করা বেআইনি? কোথায় আছে সরকার ও সরকারি দলের এখতিয়ার এক্ষেত্রে বাধা দেয়ার?

তারা যে ধরনের নির্বাচনই হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেছেন; কিন্তু তার দ্বারা জনগণ কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো দলকে রাজা বা রাজার দল বানাননি। নির্বাচনে জয়ের অর্থ সরকারি ক্ষমতা নিলামে ওঠা নয়। নির্বাচনে জয়ের অর্থ সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে হস্তগত করা নয়। এক কথায় সরকার কারও, কোনো দল বা ব্যক্তির সম্পত্তি নয়। সরকার গঠনের অর্থ দেশের শাসন কাজ একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিচালনার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়া। এর থেকে বেশি কিছু নয়। নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ চিরস্থায়ী জমিদারি কেনে না। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারি দলের হাবভাব, কথাবার্তা ও কাজকর্ম এমন যে মনে হয় নির্বাচনের মাধ্যমে নিলামে ওঠা জমিদারি তারা কিনে দেশের মালিক হয়েছেন।

এ কথা সবাই জানে যে, ২০১৪ সালের নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে, কোনো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনকে মুঠোর মধ্যে রেখে এবং পুলিশ প্রশাসনকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করে তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করেছিল।

এ কারণেই আগামী সাধারণ নির্বাচনে যাতে ২০১৪ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হতে পারে এজন্য বিরোধী দলগুলো এখন পুরোদমে মাঠে নেমেছে। এমনকি ২০১৪ সালে যারা করণীয় হিসেবে নিজেদের সামনে কিছুই দেখেনি, তারাও এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোট গঠন করছে এবং মহাজোট গঠন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এই প্রচেষ্টার প্রতি যে জনগণের ব্যাপক সমর্থন আছে সেটা নানাভাবেই দেখা যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে তারা সংবাদপত্র, টেলিভিশন ইত্যাদি প্রচারমাধ্যম থেকে নিয়ে বিরোধী দল ও ব্যক্তির কণ্ঠরোধের যে প্রচেষ্টা নিয়েছে এটা হল ডুবন্ত অবস্থায় খড়কুটো ধরার মতো ব্যাপার। কিন্তু খড়কুটো ধরে যে কারও পক্ষে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয় এটা জানা কথা। এর দ্বারা আওয়ামী লীগেরও শেষ রক্ষার সম্ভাবনা নেই।

জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পুলিশি সন্ত্রাস, নির্বাচন কমিশন ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে কারচুপির চেষ্টা সর্বতোভাবে করলেও যে পরাজয় ঠেকানো যায় না এর একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ হল মালদ্বীপের নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইয়েমেনি সব রকম দুর্নীতি ও দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করলেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। পরিপূর্ণ জনবিচ্ছিন্নতাই এর কারণ। এবং এই জনবিচ্ছিন্নতা হয়েছে দেশের সম্পদ অবাধে ও বেপরোয়াভাবে লুটপাট এবং তার প্রয়োজনে জনগণের ওপর চরম ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের কারণে। এভাবে দুর্নীতি ও নির্যাতন চালিয়ে কিছুদিন ক্ষমতায় থাকা যায়; কিন্তু ক্ষমতা বেশিদিন ধরে রাখা যায় না।

ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বেপরোয়া দুর্নীতি ও নির্যাতন করলে তার ফলে শেষ পর্যন্ত শাসক দলের মাথা থেকে বুদ্ধি বিদায় নেয়। বাংলাদেশের শাসক দল এবং তাদের পদলেহী শরিকরা যেভাবে কথাবার্তা বলে আসছেন তার মধ্যে বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় আর পাওয়া যায় না। ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির জনসমাবেশ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তার থেকে বোঝা যায় এটা বুদ্ধির কাজ নয়। দৃষ্টিশক্তির পরিচায়কও নয়। বুদ্ধি তাদের মাথা থেকে বিদায় নিয়েছে এবং দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়েছে। এর পরিণামে যা হওয়ার তাই হবে।

  • বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
  • কার্টসিঃ যুগান্তর / ০২ অক্টোবর ২০১৮

মৃত, প্যারালাইজড রোগী যখন ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগকারী!

গোলাম মোর্তোজা

প্যারালাইজড রোগী, এমনকি মৃত ব্যক্তি যদি গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করতে পারেন, তবে বিদেশে অবস্থান করেও জনসভায় ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ রাখতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ তাকেও মামলার আসামি করতে পারে। অবাক না হয়ে, আসুন গত কয়েকদিনের কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেই।

ঘটনাই ঘটেনি, মামলা করে রেখেছে পুলিশ: প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কেন এত ‘ভৌতিক মামলা’?: ডয়চে ভেলে, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আজগুবি মামলায় ভুতুড়ে আসামি: যুগান্তর, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গায়েবি মামলা এবার ফখরুলদের বিরুদ্ধে: প্রথম আলো, ২ অক্টোবর ২০১৮

লাখো মামলার জালে বিএনপি: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩ অক্টোবর ২০১৮

এমন আরও অনেক শিরোনাম উল্লেখ করা যায়। সেদিকে না গিয়ে ‘যুগান্তর’র প্রতিবেদনটির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক-

ক. নুরুল ইসলাম মারা গেছেন ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট। সেদিনই আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মারা যাওয়ার ৫ দিন পর, ৫ সেপ্টেম্বর নুরুল ইসলাম কামরাঙ্গীরচরে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। সেই অভিযোগে কামরাঙ্গীরচর থানায় ৫ সেপ্টেম্বর তার নামে মামলা হয়েছে।

অগ্নিসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে আজিজুল্লাহর নামে চকবাজার থানায় মামলা হয়েছে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮। আজিজুল্লাহ গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন মারা যাওয়ার প্রায় ২ বছর পর। তিনি মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে।

খুলনার যুবদল নেতা ফয়সল গাজী ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ বছরের ২৯ আগস্ট। ২ সেপ্টেম্বর দায়ের করা দাকোপ থানার নাশকতার মামলার আসামি ফয়সলও। মারা যাওয়ার তিন দিন পর তিনি নাশকতা করেছেন।

খ. কুমিল্লার মুরাদনগরের আহাদ খলিফা থাকেন বাহরাইনে। দেশে এসেছিলেন ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাহরাইনে ফিরে গেছেন। ফিরে যাওয়ার প্রায় ৮ মাস পরে মুরাদনগর থানায় ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তার নামে মামলা হয়েছে।

গ. ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় চিকিৎসার জন্যে ছেলেকে নিয়ে সাইয়েদুল আলম সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন। তিনি গাজীপুর জেলার বিএনপি নেতা। ওইদিন সকাল ১১টায় বিএনপি একটি মানববন্ধন করে। নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। যানবাহন ভাঙচুরের অভিযোগে পুলিশ একটি মামলা করে। সাইয়েদুল আলমও সেই মামলার আসামি। অর্থাৎ তিনি যখন উড়োজাহাজে আকাশে, সিঙ্গাপুরেও পৌঁছাননি সেই সময় তিনি গাজীপুরে যানবাহন ভাঙচুরে অংশ নিয়েছেন।

ঘ. ৮৬ বছরের প্যারালাইজড রোগী আবদুল খালেক সরকার। ৭ সেপ্টেম্বর বগুড়ার ধুনট থানায় পুলিশ একটি নাশকতার মামলা করেছে। সেই মামলার একজন আসামি খালেক সরকার।

ঙ. ৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর তানোর থানায় পুলিশ একটি নাশকতার মামলা করে। সেই মামলার একজন আসামি জামালউদ্দিন। সেই সময় তিনি হজ পালনের জন্যে সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন।

২.  মৃত ব্যক্তি, বৃদ্ধ প্যারালাইজড রোগী, হজ বা চিকিৎসার জন্যে বিদেশে থাকা ব্যক্তি, প্রবাসীদের নামে নাশকতা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-পুলিশের উপর আক্রমণ ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার আসামির তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকও আছেন। কোনো মামলায় ৩০ জন কোনো মামলায় ৯০ জনসহ অজ্ঞাতসংখ্যক আসামি। মামলাগুলোর প্রায় সবই বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

কয়েকদিন আগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের নামে মামলা হয়েছিল। সেই লেখার শিরোনাম করেছিলাম ‘বাদী কিছুই জানেন না, ভূত এসে মামলা করে গেল’!

এবার আর ভূতের ব্যাপার নেই। প্রায় সব মামলা করেছেন পুলিশ কর্তারা নিজেরা বাদী হয়ে।

সারা দেশে এমন মামলার প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা।

বাংলাদেশ প্রতিদিন’র ৩ অক্টোবরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দশ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ৯৫ হাজারেরও বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে এবং আসামির সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি।

শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসেই মামলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার, আসামির সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ!

গণমাধ্যম এখন পর্যন্ত অল্প কিছু সংখ্যক মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে অভিযোগে মামলা হয়েছে, সেই ঘটনা সেসব এলাকায় ঘটেনি। অথচ মামলা হয়েছে।

৩.  গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে। পুলিশ ২২টি শর্ত সাপেক্ষে জনসভার অনুমতি দিয়েছিল। শর্ত মেনেই বিএনপিকে জনসভা করতে দেখা গেছে।

জনসভায় দলীয় কর্মীদের আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে ‘সরকারবিরোধী উসকানিমূলক’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। আসামি করা হয়েছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ,মঈন খান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়দেরকে।

জনসভায় ‘উস্কানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ও মামলার আসামী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। রিজভী আহমেদ দেশে থাকলেও জনসভায় উপস্থিত ছিলেন না। ‘উস্কানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগের মামলায় পুলিশ তাকেও আসামি করেছে।

‘উস্কানিমূলক বক্তব্যে’ তারা কী বলেছেন, সুনির্দিষ্ট করে তা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।

মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, রোববার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাত সোয়া ৮টার দিকে মগবাজার এলাকায় বিএনপি সমর্থকরা হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, হত্যার উদ্দেশে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়, যানবাহন ভাঙচুর করে এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়। বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশেই এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে পুলিশ। ভাঙচুরের শিকার গাড়িগুলো দ্রুত চলে যাওয়ায় গাড়ির নাম্বার সংগ্রহ করতে পারেনি পুলিশ। আলামত হিসেবে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি বাঁশের লাঠি, দেড় লিটার পেট্রোল, বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ জব্দ করেছে।

একাধিক গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী ঘটনাস্থলে গিয়ে দোকানদার, পথচারী, ফুটপাতের শরবত বিক্রেতা, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কেউ এই এলাকায় সেদিন এমন কোনো ঘটনা ঘটতে দেখেননি। এমন কি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও ককটেল বিস্ফোরণ বা ভাঙচুরের কোনো ঘটনার কথা জানেন না।

গায়েবি মামলার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ‘অজ্ঞাতনামা’র তালিকায় যে কাউকে যে কোনো সময় আসামি করার পথ উন্মুক্ত থাকছে।

এখন পর্যন্ত বিএনপি মহাসচিবের নামে মামলার সংখ্যা ১০৬টি। অধিকাংশ নেতার নামে মামলা শতাধিক। কারো কারো নামে দুই’শ। সবার থেকে এগিয়ে আছেন হাবিবুন নবী খান সোহেল। তার নামে মামলার সংখ্যা ৪৫৩টি।

৪. রাজনীতি বা নির্বাচনী রাজনীতিতে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য, অস্বাভাবিক বিষয় নয়। অস্বাভাবিক নয়, দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিবেশ তৈরি হওয়াও। তা নিয়ন্ত্রণের জন্যে জনগণের শেষ ভরসা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এমনিতেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনআস্থায় একটা ঘাটতি আছে। সেরকম অবস্থায়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় নির্বাচনের চার মাসেরও কম সময় আগে, গায়েবি মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশের প্রতি জনআস্থার বিষয়টি কেমন হবে বা হতে পারে? সবার জন্যে সমান সুযোগ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ- তা কী শুধু কথা এবং কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
  • কার্টসিঃ The Daily Star/ Oct 3, 2018 

পদ্মা সেতুতে পারাপার কবে!

  • নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার
  • আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা প্রায় অসম্ভব 
  • পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ 
  • সময় বাড়লে সেতু নির্মাণের ব্যয়ও বেড়ে যাবে





প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু দিয়ে পারাপার করা যাবে না। সেতু তৈরির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের আগে সম্পূর্ণ কাজ শেষ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তবে সব ঠিকাদারই চান, সময় কমপক্ষে আরও দুই বছর বাড়ানো হোক। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় আপাতত এক বছরের বেশি মেয়াদ বাড়াতে চাইছে না। এমনিতেই দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের কারণে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারীদের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন এই প্রকল্পের রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। এসব বিবেচনায় নিয়েই সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন বিলম্বের কথা বলতে চাইছে না।

এমনিতেই পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তারপরও সময়ের মধ্যে হচ্ছে না সেতু নির্মাণের কাজ। এখন সময় বাড়লে সেতু নির্মাণের ব্যয়ও বেড়ে যাবে। কত বাড়বে, সেই হিসাব এখনো করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, প্রকল্প শেষ করতে সময় বেশি লাগলে এর ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি এর অর্থনৈতিক সুবিধাও কমে।

এসব বিবেচনায় সরকার প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এ সময় মেনে নিলে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার সময়সীমা দাঁড়াবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে ঠিকাদার, এমনকি সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাও মনে করছেন, এই সময়ের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হবে না।

মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ পাওয়া চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) সময়সীমা আরও দুই বছর বাড়ানোর পক্ষে। নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। তারাও সময় বাড়াতে সরকারকে চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া, প্রকল্পের কাজ তদারকিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন সেতু বিভাগকে ২০ মাস সময় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। এসব প্রস্তাব অনুসারে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২০ সালে।








এখন পর্যন্ত মূল সেতুর ৪১টি পিলারের মধ্যে ১৪টির কাজ শেষ হয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর, শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট।  ছবি: প্রথম আলো

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সরকার নির্বাচনের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের সময়সীমা বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে চাইছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই এক বছর সময় বাড়াচ্ছে। কেননা, গত আগস্ট পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে বাকি তিন মাসে বাকি ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ করার কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি না করলে ঠিকাদারের বিল দেওয়া যাবে না। এই জটিল পরিস্থিতির কারণে সময় বৃদ্ধি বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।

‘ফাস্ট ট্র্যাক’ বা অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত পদ্মা সেতু নির্মাণের বিলম্বের কারণ হিসেবে সেতু বিভাগ চারটি কারণের কথা বলেছে। যেমন: নদীর তলদেশের গভীরে নরম মাটির স্তর থাকায় সেতুর পিলার স্থাপনে সমস্যা, ২২টি পিলারের নতুন নকশা প্রণয়ন, নদীশাসনকাজে বিলম্ব এবং নদীভাঙন ও প্রবল স্রোত।

মূল সেতু ও নদীশাসনই হচ্ছে প্রকল্পের সবচেয়ে বড় কাজ। প্রকল্পের অগ্রগতি–সংক্রান্ত নথি অনুসারে, আগস্ট পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড় অগ্রগতি ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এই গতিতে এগোলে বাকি কাজ শেষ করতে অন্তত দুই বছর লাগবে। নদীশাসনের কাজের অগ্রগতি ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতি মাসে গড় অগ্রগতি ১ শতাংশের কম। এই গতিতে এগোলে কাজ শেষ হতে পাঁচ বছর সময় লেগে যেতে পারে।

সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত মূল সেতুর ৪১টি পিলারের মধ্যে ১৪ টির কাজ শেষ। পিলারের ওপর ৫টি স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) ইতিমধ্যে বসেছে। এখন সেতুর সাড়ে ৭০০ মিটার দৃশ্যমান। তবে আগামী তিন মাসের মধ্যে আর কোনো স্প্যান বসার সম্ভাবনা নেই। কারণ, পাইলিংয়ের জটিলতার কারণে ৭৫০ মিটারের সঙ্গে সংযোগ করার জন্য প্রয়োজনীয় পিলার বসানো যায়নি। সব মিলিয়ে এখন যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে ২০২১ সালের আগে কাজটি শেষ হবে না।

জানতে চাইলে প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মূল সেতুর কাজ এক বছর ও নদীশাসনের দুই বছর সময় বেশি লাগতে পারে। সময় বৃদ্ধির ফলে এর প্রভাব ও ব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যত দেরিতে সেতু চালু হবে, তত এর ব্যবহারের ফলে যে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যাবে না। আর জ্বালানি তেল, স্টিল, সিমেন্ট ও বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধি পেলে ব্যয় বাড়তে পারে বলে তিনি জানান।

বক্তব্য জানার জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সময় নিয়ে আলোচনা

পদ্মা সেতুর কারিগরি ও সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আছে ‘প্যানেল অব এক্সপার্ট’। প্রকল্প এলাকায় গত রোববার থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এই বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক হয়েছে। বছরে তিন-চারবার এই বৈঠক হয়ে থাকে। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, বাড়তি ২২টি পাইল বসানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি পাইলের চারপাশে কংক্রিটের বেড়ার মতো দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেল ও পরিবহন চলাচলের জন্য যে ডেক বা পথ বসানোর কথা, সেটির কিছু কারিগরি ত্রুটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠক সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পের অগ্রগতি এবং কবে নাগাদ শেষ হতে পারে, সেটা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। বর্তমানে মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি প্রতি মাসে গড়ে ২ শতাংশের কম। অথচ শুরুতে আড়াই থেকে ৩ শতাংশ হারে অগ্রগতির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ঠিকাদারেরা এর জন্য নকশায় জটিলতাকে দায়ী করেন। বৈঠকে ২০২০ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়।

ব্যয় কেন আরও বাড়বে

সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত আইনে বিশেষ কোনো অবস্থার সৃষ্টি না হলে দুবারের বেশি প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা যায় না। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য এই আইন শিথিল করার বিষয়ে একমত হয়েছে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু বাস্তবায়নে ২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এরপর দুই দফা ব্যয় সংশোধন করা হয়। যেমন: ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং ২০১৬ সালে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর এখন জমি অধিগ্রহণের জন্য বাড়তি যুক্ত হয়েছে আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে এখন পর্যন্ত মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে ব্যয় বেড়েছে ২০ হাজার ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৬ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সময় বৃদ্ধি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজও বাড়তে পারে—এমন ধারণা কর্মকর্তাদের। এ ক্ষেত্রে ব্যয়ও বাড়তে পারে। সময় বৃদ্ধির ফলে অবধারিত ব্যয় বৃদ্ধি পাবে নির্মাণ-উপকরণ ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে। ২০১৪ সালে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করার সময় ডলারের মূল্য ছিল ৭৮ টাকা। এখন তা ৮৪ টাকা হয়ে গেছে। উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি বাবদ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যেই ৪০০ কোটি টাকা ধরা আছে। এর বেশি হলে মোট ব্যয়ও বাড়বে। এ ছাড়া অন্যদিকে কাজ বৃদ্ধির জন্যও প্রকল্পে ৪০০ কোটি টাকা রাখা আছে। কিন্তু নদীশাসনের জন্য তোলা বালু ফেলার জায়গা কেনায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে গেছে। এই কাজে আরও জমির প্রয়োজন হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, এক বছর সময় বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তে অখুশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কারণ, এর মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। আর কাজ শেষ না হলে জরিমানা গুনতে হবে। তবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বাস দিয়েছে, প্রয়োজনে আরও সময় বাড়ানো হবে। তবে একবারে নয়, সময়-সময়। তাতে খরচও অবশ্য বাড়বে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বৃহৎ প্রকল্প বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে ব্যয় বাড়বেই। এ ছাড়া মেয়াদ বাড়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের সেতুটি ব্যবহার করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ। ফলে বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থনৈতিক যে প্রাপ্তি শুরুতে ধরা হয়েছিল, তা কমে যাবে।
  • কার্টসি: প্রথম আলো /০৩ অক্টোবর ২০১৮

ঋণের ফাঁদে পড়বে দেশ!

অর্থনীতিবিদদের মতামত


পদ্মা সেতু প্রকল্পে দেশজ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে দেশ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশনের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এ আশঙ্কার কারণ হিসেবে বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থায়ন একটি সূত্রের (বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ) পরিবর্তে অন্য সূত্র থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে।

তবে দেশের আরেক অর্থনীতিবিদ, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর পদ্মা সেতুসহ বৃহৎ প্রকল্প ঘিরে অন্য শঙ্কার কথাও বললেন। তিনি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ৪০ হাজার কোটি টাকার রেললাইন বসানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটা শেষ পর্যন্ত ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে। কিন্তু এত টাকা খরচ করে কী লাভ (রেট অব রিটার্ন) পাওয়া যাবে, তা নিয়ে কোনো পর্যালোচনা হয়নি। কবে এত টাকা উঠে আসবে জানি না। পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও এ ধরনের পর্যালোচনা করা হয়নি।’ তাঁর মতে, বেশির ভাগ বড় প্রকল্প বিদেশি টাকায় করা হচ্ছে। এতে ঋণের সুদ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে তাদের নিয়মিত প্রতিবেদন ‘ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’ প্রকাশ করেছে। এবার প্রতিষ্ঠানটি খানিকটা ভিন্নভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। দুজন অর্থনীতিবিদকে আলোচক হিসেবে রাখা হয়। তাঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান।

বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে এ সময় অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলেছে, সামষ্টিক অর্থনীতিকে চার ধরনের চাপ আছে। এগুলো হলো খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন, বিদেশি অর্থায়নের ঘাটতি; তারল্য–সংকট এবং বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি। এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে।

নির্বাচনের সময়ের অর্থনীতি

জাতীয় নির্বাচন অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে—এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, সব দেশই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

আহসান এইচ মনসুর এ সময় আশঙ্কা করে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হলে টাকা পাচার কমার কোনো কারণ থাকবে না, বরং বাড়তে পারে। তখন টাকা পাচার যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে অর্থনীতিতে সমস্যা আরও প্রকট হবে।

সুশাসন প্রসঙ্গে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে রাজনৈতিক সুশাসনের বিষয়টি আনতে হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, খেলাপি ঋণ কি শুধু অর্থনৈতিক ইস্যু, নাকি এর সঙ্গে রাজনৈতিক সুশাসনও জড়িত?

প্রবৃদ্ধি কেবল সংখ্যা নয়

আলোচনায় প্রবৃদ্ধি নিয়ে দুটি উদ্বেগের কথা বলেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কি না; প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে কি না। প্রবৃদ্ধির আলোচনায় ‘৭ শতাংশ’, ‘৮ শতাংশ’—এগুলোর কোনো মূল্য নেই।

হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, বিশ্বমন্দা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে। এখন অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করা দরকার। কেননা এখনো ৩ কোটি ৯০ লাখ দরিদ্র লোক আছে। এর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ অতিদরিদ্র। প্রবৃদ্ধির সুফল কার কাছে যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। দৃশ্যমান বেকার না থাকলেও এ দেশের যুবকেরা উপযুক্ত কাজ পাচ্ছে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এমএ পাস করে পিয়নের কাজ করছে। এ ধরনের কাজ এখন অনেক যুবকের অবধারিত ভাগ্য হয়ে গেছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রবৃদ্ধির বিতর্ককে সংখ্যার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। বিতর্ক হওয়া উচিত গুণগত মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি নিয়ে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক সুশাসনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান এ নিয়ে বলেন, ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো। কিন্তু এটি সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা না করে, মান দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রবৃদ্ধি নিয়ে বলেন, বিতর্ক হওয়া উচিত যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা মানসম্পত হচ্ছে কি না। সবাই এর সুফল পাচ্ছে কি না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, এ দেশে বলা সহজ, করা কঠিন। এখন যে উন্নয়নের প্রক্রিয়া চলছে তাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো যেন বিলীন না হয়ে যায়।

অর্থনীতিবিদদের এসব আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ঋণ ও সুদ পরিশোধের রেকর্ড খুব ভালো। বিদেশি ও দেশজ উৎস থেকে নেওয়া কোনো ঋণের অর্থ পরিশোধে বকেয়া পড়ে নেই। অর্থনীতির বর্তমান সক্ষমতা বিবেচনায় আগামী দু-তিন বছর ঋণের অর্থ পরিশোধে কোনো সমস্যা হবে না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

প্রবৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, এখন প্রবৃদ্ধি মান দিয়ে বিচার করা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে কিছু আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সময় সব দেশেই বৈষম্য একটু বাড়ে। এটা কমাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান ও কর্মসংস্থানে বেশি নজর দেওয়া উচিত।

সুদের হার ও অন্যান্য

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাস্তবতা বিবেচনা না করে শুধু ‘স্টেটমেন্ট’ দিয়ে সুদের হার নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এ কারণেই ‘নয়-ছয়’ সুদের হার কার্যকর হয়নি, হবেও না। সরকার হয়তো নির্বাচনের আগে এ অবস্থান থেকে সরে আসতে পারবে না, নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে সরে আসতে হবে। রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ১২ শতাংশ এবং কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশ দিয়ে কোনো দিনও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ বা উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া যাবে না। তাই তিনি রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে বড় প্রকল্পে দেশজ উৎসের অর্থের অংশ বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।

রিজার্ভের মজুত সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত বছর পর্যন্ত সাত মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ মজুত ছিল। এখন তা পাঁচ মাসে নেমে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে তা অচিরেই তিন মাসে নেমে আসবে।
  • কার্টসি: প্রথম আলো /০৩ অক্টোবর ২০১৮

ঢাকা ওয়াসায় হচ্ছেটা কী

অমিতোষ পাল

ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামে পরিচালক পদ বলে কিছু নেই। তবুও এই পদে দুই ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দিকে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ছুটিতে থাকলে এমডির দায়িত্ব পালন করেন এদের একজন। তাকসিম এ খানের অনুপস্থিতিতে দাপ্তরিক সব ফাইলপত্রেও স্বাক্ষর করেন একজন পরিচালক। এককথায় এমডির যাবতীয় দায়িত্বই থাকে তার। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ওয়াসাকে একাধিক চিঠিপত্র দিয়ে কারণও জানতে চেয়েছে। কিন্তু ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান কর্ণপাত করেননি। এ নিয়ে ওয়াসা প্রশাসন ও ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সদস্যদের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। 

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ঢাকা ওয়াসায় যে দু'জন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে বোর্ড অনুমোদন দেয়নি। কারণ ওয়াসার অর্গানোগ্রামে (জনবল কাঠামো) পরিচালকের কোনো পদ নেই। অর্গানোগ্রাম অমান্য করে ওই দু'জনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদেরই একজনকে এমডির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা অবৈধ। 

ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, গত ২০ আগস্ট ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান যুক্তরাষ্ট্রে যান। সে সময় তাকসিম এ খান পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেমকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে যান। সেখানে তিনি বলেন, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করবেন। এ সময় আবুল কাশেম এমডির প্রতিনিধিত্ব করবেন। এ ছাড়া রুটিন কার্যাদি সম্পাদন করবেন। প্রয়োজনে তার সঙ্গেও ই-মেইলে, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন। ওই এক মাস আবুল কাশেম এমডির দায়িত্ব পালন করেন। গত ১ অক্টোবর তাকসিম এ খান এক সপ্তাহের জন্য আবার ফিলিপাইনে যান। এই সময়ের জন্য আবারও আবুল কাশেমকে এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 

নেপথ্য কাহিনী :জানা যায়, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ঢাকা ওয়াসার তিনটি উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের (ডিএমডি) পদ শূন্য হয়। ওই বছরের ৭ জুলাই ওয়াসা বোর্ড তিনজনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। আবেদনকারীদের মধ্যে ঢাকা ওয়াসার সাবেক ডিএমডি ড. লিয়াকত আলী, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইবি) সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মঞ্জুর মোর্শেদ ও নন্দন কুমার রায় নামের তিনজন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মন্ত্রণালয় তাদের ডিএমডি পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য চিঠিও ইস্যু করে। কিন্তু এমডির পছন্দের কোনো ব্যক্তি এই তিনজনের মধ্যে না থাকায় এতে আপত্তি দেন। ওই পরীক্ষায় ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী অবসরপ্রাপ্ত আবুল কাশেম ও অবসরপ্রাপ্ত একেএম শহিদ উদ্দিনও আবেদন করেন। কিন্তু তারা উন্নীত হতে পারেননি। 

জানা যায়, এ দু'জন ছিলেন এমডির পছন্দের তালিকায়। এমডির আপত্তির কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। পরে ২৫২তম বোর্ড সভায় এমডি তাকসিম এ খান প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, তিনজন ডিএমডির পদ শূন্য থাকায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবুল কাশেম ও একেএম শহিদ উদ্দিনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বোর্ড এ প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। বোর্ড জানায়, ওয়াসার অর্গানোগ্রামে এ ধরনের কোনো পদ নেই। যে কারণে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু এরপর একতরফাভাবে আবুল কাশেমকে পরিচালক (উপদেষ্টা) ও একেএম শহিদ উদ্দিনকে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সময় তারা গাড়ি-জ্বালানি ছাড়াও মাসিক এক লাখ ৫০ হাজার টাকা করে বেতন পাবেন। গত ১৯ মার্চ থেকে তাদের নিয়োগ কার্যকর হয়। এর পর থেকেই তারা অফিসিয়াল ফাইলপত্রে স্বাক্ষর করছেন ও নিয়মিত অফিস করছেন। আর এমডি বিদেশ গেলেই আবুল কাশেম এমডির দায়িত্ব পালন করছেন। 

মন্ত্রণালয়ের বারবার আপত্তি :গত ৯ মে এই নিয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. কেএম কামরুজ্জামান সেলিম ওয়াসার এমডিকে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬-এ পরিচালক পদ সৃজনের কোনো সুযোগ আছে কি-না, থাকলে সেই ধারার বিবরণ দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকরি প্রবিধানমালা ২০১০-এর অর্গানোগ্রামে উক্ত পদ সৃজনের বিধান রয়েছে কি-না, থাকলে বিধানের বর্ণনা দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। কিন্তু ওয়াসা কোনো উত্তর দেয়নি।

গত ২৫ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগ আরেকটি চিঠি দিয়ে জানায়, ওয়াসার আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ তার কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দিতে পারবে। তবে সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে কোনো জনবল নিয়োগ দিতে হলে আগে সরকারের কাছে পেশ করতে হবে। সরকার অনুমোদন দিলে নিয়োগ দিতে পারবে। অথচ দু'জন পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিচালকের পদ সৃষ্টি না করে উক্ত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞাপন, যোগ্যতা নির্ধারণ ও পরীক্ষা গ্রহণ না করে এবং অন্যান্য কার্যাবলি সম্পাদন না করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা আইন ও সরকারের সাধারণ নীতির পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়।

এ ঘটনার পর গত ৫ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আবারও ওয়াসার এমডিকে চিঠি দিয়ে জানায়, এই নিয়োগ 'পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬ ও পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা/কর্মচারী) চাকরির প্রবিধানমালা ২০১০-এর সংশ্নিষ্ট ধারার পরিপন্থী। এটি বিধিসম্মত না হওয়ায় ঢাকা ওয়াসার দু'জন পরিচালক পদে নিয়োগ বাতিলের জন্য কেন অনুশাসন প্রদান করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে বলা হয়। পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দু'জন পরিচালকের বেতন-ভাতা বন্ধসহ তাদের দাপ্তরিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে পত্র মারফত স্থানীয় সরকার বিভাগকে অবহিত করার জন্য বলা হয়। 

এই কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবে ১৯ আগস্ট তাকসিম এ খান মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়ে জানান, তিনজন ডিএমডির পদ শূন্য। এ অবস্থায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য ২৫২তম বোর্ড সভায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। ওই সভায় ১৫ জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে আটজন উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে পাঁচজন মত দিয়েছেন। কাজেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টিতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি। বিধি মোতাবেক হয়েছে। 

তবে এ প্রসঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান সমকালকে জানান, বোর্ড সভায় এমডি বিষয়টি তুলেছিলেন। কিন্তু কেউ নিয়োগের পক্ষে মত দেননি। কাজেই সেটা অনুমোদন হয়নি।

এ অবস্থায় আবার আবুল কাশেমকে এমডির দায়িত্ব দিয়ে গত ১ অক্টোবর ফিলিপাইনে গেছেন এমডি তাকসিম এ খান। এ প্রসঙ্গে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এ প্রসঙ্গে এমডির দায়িত্ব পালনকারী আবুল কাশেম সমকালকে বলেন, মন্ত্রণালয় তার নিয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি তিনি আর কিছু শুনছেন না। বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। এমডির অনুপস্থিতিতে তিনি রুটিন ওয়ার্ক করে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, ওয়াসার অর্গানোগ্রামে না থাকলে পরিচালক পদে লোক নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা কীভাবে হলো, সেটা দেখবেন বলে জানান।

  • Courtesy: Samakal/ Oct 03, 2018

এনবিআরের অধিকাংশ উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে

আব্বাস উদ্দিন নয়ন

রাজস্ব বাড়াতে অনলাইনের মাধ্যমে তা আহরণের উদ্যোগ নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর না দেয়া বিদেশী নাগরিকদের শনাক্তকরণের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানির অর্থ পাচার রোধ ও বকেয়া রাজস্ব আহরণে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতেও (এডিআর) নিয়েছিল বিশেষ উদ্যোগ। উদ্যোগ নেয়া হয় ট্যাক্স কার্ড প্রদান, কর বাহাদুর পরিবারকে সম্মাননা, ট্যাক্স আইডি কার্ড প্রদানেও। যদিও এসব উদ্যোগের বেশির ভাগই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০ শতাংশ ঘাটতিতে রয়েছে এনবিআর।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব বাড়াতে নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হলেও অবকাঠামো সমস্যার কারণে অধিকাংশই কার্যকর করা যায়নি। কিছু প্রকল্পে সুফলের চেয়ে অর্থ ব্যয় বেশি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের আপত্তি ও সরকারি অন্যান্য সংস্থার সহায়তা না পাওয়াও এর কারণ। আবার প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণেও পিছিয়ে আসতে হয়েছে অনেক উদ্যোগ থেকে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রচলিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে ২০১৩ সালে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করে এনবিআর। ওই বছরই কর নিবন্ধন নম্বর (টিআইএন) বদলে অনলাইনভিত্তিক ই-টিআইএন পদ্ধতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। পুরনো ভ্যাট নিবন্ধন বাদ দিয়ে ২০১২ সালেই নতুন অনলাইন ভ্যাট আইন প্রস্তুত করে এনবিআর। আইনে ভ্যাটের নিবন্ধনসহ সব কার্যক্রম অনলাইনে করার কথা বলা হয়। এ উদ্যোগের পাঁচ বছরের বেশি চলে গেলেও আয়কর ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে অনলাইন এখনো নিবন্ধনেই আটকে আছে। অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতি চালু হলেও আয়কর ও ভ্যাট পুরনো পদ্ধতিতে পরিশোধের কারণে তা সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। যদিও অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করার পরই পেমেন্ট পদ্ধতিও অনলাইনে করার কথা বলেছিল এনবিআর। অন্যদিকে বারবার চেষ্টা করেও অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি। যদিও পুরনো আইনেই ভ্যাট অনলাইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে এনবিআর।

এনবিআরের আয়কর বিভাগের সংশ্লিষ্ট সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, এবারের আয়কর মেলায় গিয়ে যারা রিটার্ন জমা দেবেন, তাদের জন্য অনলাইনে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রিটার্ন জমা দেয়া বা নিবন্ধনের মতো ঘরে বসেই অর্থ পরিশোধ এখনই করা যাচ্ছে না। বেশ আগেই উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও সার্বিক প্রস্তুতির কারণে অনলাইনে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি পুরোপুরি চালু করতে কিছুটা সময় নিচ্ছি আমরা।

আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক খাতে প্রায় ৩২ হাজার মামলায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব বকেয়া পড়ে আছে এনবিআরের। আদালতের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হলেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না সংস্থাটি। এ অবস্থায় আদালতের বাইরে গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) গঠন করে এনবিআর। এজন্য রাজস্ব বোর্ডের সাবেক একজন সদস্যকে প্রধান করে একটি বিশেষ উইংও খোলা হয়। পাশাপাশি সব করাঞ্চল ও কমিশনারেটের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পাঁচ বছর পরও এডিআরের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করা যায়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির পথে গেলেও এতে এনবিআরের সফলতা উল্লেখ করার মতো নয়। ফলে এডিআর বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে এনবিআরের নতুন প্রশাসন। এছাড়া আদালতে শুনানি পর্যায়ে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি বিশেষ টিম গঠন করা হলেও তার কার্যক্রমও প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ।

এনবিআরের এডিআরের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, আদালতের বাইরে গিয়ে মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হলেও ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় তা খুব বেশি কার্যকর হয়নি। এটি সচল করতে এনবিআর অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। সাবেক একজন সদস্যকে নিয়ে নিরপেক্ষ সেল গঠন করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। তবে মামলা নিষ্পত্তির হার খুব কম হওয়ায় এ থেকে সরে আসার কথা ভাবছে এনবিআর।

দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মূল্য ঘোষণার মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ পাচার করছে, এমন অভিযোগের অনুসন্ধানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে এসব কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় একটি সেল গঠনের প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে ২০১৫ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করে এনবিআর। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক আয়কর নীতির সঙ্গে সমন্বয়হীনতা দূর করতে দীর্ঘদিন কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি সেলটির। পরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ট্রান্সফার প্রাইসিং ইউনিট নামে আরেকটি স্বতন্ত্র বিভাগ করার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। এ ঘোষণার দুই বছর পর ১৫০টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ ও আরো প্রায় ৯০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংগ্রহ করলেও দৃশ্যমান কোনো ফলাফল দেখাতে পারেনি এনবিআর।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ হাজার বিদেশী নাগরিক বৈধভাবে কর্মরত রয়েছেন। বিদেশী এসব নাগরিকের কর প্রদান বাধ্যতামূলক হলেও সর্বশেষ অর্থবছর এনবিআরে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে ১৪ হাজার। করযোগ্য আয় করলেও সরকারকে রাজস্ব না দেয়ার অভিযোগে এসব নাগরিককে খুঁজে বের করতে একটি নতুন সেল গঠন করে এনবিআর। ২০১৬ সালে গঠিত সেলটি ওই সময় বিদেশী নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড, এনজিও ব্যুরো, বেপজা, এফবিসিসিআই, ইমিগ্রেশন অফিসসহ বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দেয়। চিঠি দেয়ার দুই বছর পরও অধিকাংশ দপ্তর থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি তারা। কয়েকটি কোম্পানিতে মাঠপর্যায়ে অভিযান চালিয়েই কার্যক্রম সীমিত রেখেছে বিদেশী কর্মী শনাক্তকরণ সেল।

বিদেশী কর্মী শনাক্তকরণ সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এনবিআরের সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, কর না দেয়া বিদেশী কর্মীদের শনাক্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরে কাজ করছে এনবিআর। কিছু প্রতিষ্ঠানে অভিযানও পরিচালিত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহযোগিতা না পাওয়ায় খুব বেশি কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যায়নি। এর বাইরে আমাদের অবকাঠামো সমস্যা ও মাঠপর্যায়ে জনবল সংকটও রয়েছে।

করদাতা বৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা ও বাজেটের লক্ষ্যপূরণে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে ২০১৬ সালে ‘বাজেট ইমপ্লিমেন্টেশন ফোরাম’ গঠন করে এনবিআর। এনবিআরের সব বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত এ ফোরামের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে রাজস্ব অগ্রগতি পর্যালোচনা করে নতুন কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেন সংস্থার চেয়ারম্যান। রাজস্ব আহরণে নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা, মাঠ প্রশাসনে কাজের অগ্রগতি তদারক করা ও বকেয়া রাজস্ব আহরণে ভূমিকা রাখত এ ফোরাম। এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের উদ্যোগে নতুন উদ্ভাবনের দিকনির্দেশনাও থাকত এ ফোরামে। প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ফোরামের কার্যক্রম।

করভীতি দূরীকরণ ও করদাতাদের সঙ্গে এনবিআরের যোগসূত্র বাড়াতে করদাতাদের বিশেষ সম্মাননা দিতে আয়কর মেলা উপলক্ষে প্রত্যেক করদাতার জন্য ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড চালু করে এনবিআর। মেলায় করদাতাদের এ কার্ড দেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ আইডি কার্ড প্রদান করেন তত্কালীন চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। মেলার পরও অনেক করদাতাকে দেয়া হয় এ আইডি কার্ড। আইডি কার্ড তৈরি করতে যন্ত্রপাতি আমদানি ও নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংগ্রহে বড় ধরনের অর্থও ব্যয় করে এনবিআর। তবে এ আইডি কার্ডের কোনো ব্যবহারিক সুবিধা না থাকায় এক বছরের মাথায় তা থেকে সরে আসে সংস্থাটি। ব্যয় সংকোচন নীতি ও বিশেষ ফল না আসায় এনবিআর সরে এসেছে ‘কর বাহাদুর পরিবার’ সম্মাননার আয়োজন থেকেও। যেসব পরিবারের সব সদস্য কর দিয়ে থাকেন, তাদের মধ্য থেকে সব জেলায় একটি করে পরিবারকে এ সম্মাননা দেয়া হতো।

এছাড়াও গত কয়েক বছরে এনবিআরের নেয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং সেল, রাজস্ব ফাঁকি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং সেল। সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে জাতীয় চোরাচালানবিরোধী সেলের কার্যক্রমেও গতি নেই। এসব সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ও কয়েক মাস পর যৌথ মিটিং পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়েছে এনবিআরের কার্যক্রম। কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিনিয়োগ বাড়াতে গঠিত এনবিআরের ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন টিম ও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে গঠিত ফোকাল পয়েন্ট টিম।

বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ার প্রভাব পড়ছে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে সংস্থাটি। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক মিলিয়ে জুলাই-আগস্ট সময়ে ৩৫ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর আহরণ করেছে ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আহরণে প্রায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও প্রথম দুই মাসে অর্জিত হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধিতে বেশ সফলতা দেখিয়েছে এনবিআর। উদ্ভাবনেও বেশ এগিয়েছে সংস্থাটি। রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে এসব উদ্ভাবন ধরে রাখার পাশাপাশি আরো নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। তবে উদ্যোগ নিয়ে বসে থাকলে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।
  • কার্টসি: বণিকবার্তা / ০৩ অক্টোবর ২০১৮

Tax waiver on LNG import to cause Tk 110b revenue loss

Doulot Akter Mala



The National Board of Revenue (NBR) has estimated a total of Tk 110 billion loss in revenue collection after the government waived import taxes on Liquefied Natural Gas (LNG).

Officials said the gas sector is one of the largest revenue contributors to the national exchequer that may face a blow following withdrawal of Customs Duty (CD) and Supplementary Duty (SD) along with reduction of Advance Income Tax (AIT).

NBR has issued a Statutory Regulatory Order (SRO), dated September 30, 2018, waiving 5.0 per cent CD on import of LNG. The order came into force with retrospective effect from September 18, 2018.

In April 2018, NBR's Income Tax Wing reduced AIT on import of LNG to 2.0 per cent from 5.0 per cent.

Withdrawal of 93.24 per cent SD is also underway, officials said.

Talking to the FE, a senior NBR official said currently there are only 15 per cent Value Added Tax (VAT) at local transmission stage of LNG, and 2.0 per cent AIT on its import.

He said the import taxes have been cut in a bid to keep the prices of natural gas 'rational' in the local market.


  • Courtesy: The Financial Express /Oct 03, 2018

TIB urges govt to review Digital Security Bill

Transparency International, Bangladesh has urged the government to repeal the ‘suppressive’ sections of the Digital Security Bill 2018 which has been passed recently in the parliament amid huge opposition from different quarters. TIB also demanded a review of the entire bill, as it has apparently become, according to them, a law against freedom of speech guaranteed by the constitution.

The anti-corruption watchdog expressed its concern over the Digital Security Bill through a press note on Tuesday.

Taking the 30 September meeting between the Editors' Council and the government representatives as a positive step, the body expressed doubt whether the meeting would mitigate people’s fear about the Digital Security Bill.

Earlier, three ministers and concerned government advisors sat with the Editors' Council, a platform of editors of the country’s national dailies, where law minister made a commitment to work out amendments to the security bill to make it acceptable by all.

Executive director of TIB Dr Iftekharuzzaman said in the press note that the meeting between the Editors' Council and the government representatives is a positive step to address the concern regarding Digital Security Bill.

However, dialogues in the parliament, following the passing of the bill, that ignored recommendations from concerned bodies, is a matter of concern.

Partial review in the bill could not erase fear and insecurity among people as there are many sections in the bill that restricts media freedom.

He said enactment of law to ensure the government’s digital security is necessary, but at the same time it must also guarantee people’s constitutional rights to free speech.

TIB observed that there is no alternative but to review the entire bill in order to have a law in accordance with the country’s constitution

On September 19, the parliament passed the bill amid a lot of opposition and concerns from journalists and rights bodies.

  • Courtesy: The Financial Express /Oct 03, 2018

Change BB’s approach, develop secondary market: Experts

Channelling green financing


Channelling of green financing in Bangladesh remains largely inadequate, as the central bank's approach in this regard is hardly bearing any result, experts said at a seminar in the capital on Tuesday. At the same time, development of a secondary market is urgently needed to ensure long-term financing sources for green initiatives, they opined at a Dialogue on Green Banking.

Bangladesh Institute of Bank Management (BIBM) and Adam Smith International (ASI) jointly organised the event at a city hotel.

"It is the high time that Bangladesh Bank (BB) shifts its focus from a supply-driven approach to a demand-driven approach when it comes to green financing," said Bushra Ferdous Khan, an expert with Economic Dialogue on Green Growth (EDGG).

"And for designing a demand-driven strategy, a functional conceptualisation of the term green finance is needed," she also said.

"We need a definition that guides practical application. There should be a new way of categorisation also that creates room for acknowledging the demand for green finance by different segments of private sector."

"It should also identify the drivers that motivate the expenditure on green solutions by private businesses and consumers, and thus create private sector demand for green funds," she added.

Experts noted that 93 per cent of the total Tk 2,370.39 billion loan, disbursed as green finance between 2013 and 2017, has been loaned under the category of indirect green finance.

"This is essentially the amount loaned to any project having an effluent treatment plant (ETP) - a key priority for curbing water pollution - or similar system," Ms Bushra said.

"However, how much of this amount, loaned as indirect green finance, is actually used to operate ETPs is not traced."

"In fact, the current classification of indirect green finance should also be abolished. The banks and financial institutions should be provided with more clear instructions on how to monitor working capital loans, channelled for operating, is actually used," she added.

"BB along with World Bank is currently offering a long-term financing facility for green financing. However, that financing facility is not attractive to private sector," said Md. Fazlul Hoque, Managing Director of Plummy Fashions.

Noting that currently the government is offering only 2.0 percent tax rebate for eco-friendly garment units, he said no factory will go for green schemes for such a tax rebate.

Industry insiders at the seminar also called for developing a secondary market for generating adequate green financing.

"We have to develop a secondary market, and we have to work together for it," said Humaira Azam, Additional Managing Director of Trust Bank Limited.

She also recommended that National Board of Revenue (NBR) can also offer tax incentives for green products to encourage investment in the relevant schemes.

"The banks can also be tagged with Infrastructure Development Company Limited (IDCOL), so that they can avail low-cost IDCOL funding for green initiatives," said BB Deputy Director Asif Iqbal.

"To create demand for green financing, we need to address the supply side. Supply will create demand," said Director of BIBM Professor Dr. Shah Md. Ahsan Habib.

Underlining the need for long-term financing for eco-friendly initiatives, Supernumerary Professor of BIBM Helal Ahmed Choudhury said the involvement of capital market and insurance companies are essential for channelling such long-term funding.

Regulatory bodies like Bangladesh Securities and Exchange Commission (BSEC) and Insurance Development and Regulatory Authority (IDRA) have a crucial role for bringing such long-term investment from capital market and insurance companies.

Director General of BIBM Toufic Ahmad Choudhury also spoke on the occasion, among others.


  • Courtesy: The Financial Express/ Oct 03, 2018

ঘুষ দিলে সেবা মেলে

শাখাওয়াত হোসাইন 


মিরপুর পল্লবী এলাকার ৯৪৯ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মনিরুজ্জামান মীরদাহর একটি ওষুধের দোকান আছে ওই এলাকায়। দোকানটির লাইসেন্স নবায়ন এবং নাম পরিবর্তনের জন্য সপ্তাহজুড়ে ঘুরছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-২ অফিসে। 

গত ২৭ সেপ্টেম্বর একই কাজে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত অফিসটিতে আসেন তিনি। দোকানটির নাম পরিবর্তনের জন্য দুই হাজার পাঁচ শ টাকার বিপরীতে সাত হাজার টাকা চাওয়া হয় মনিরুজ্জামানের কাছে। এ ছাড়া লাইসেন্স বই নবায়নের জন্য চাওয়া হয় এক হাজার টাকা। অথচ বইয়ের দাম মাত্র দুইশ টাকা।

সিটি করপোরেশনের ধার্য করা টাকা ছাড়া বাড়তি কোনো অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় প্রকাশ্যে মনিরুজ্জামানের কাগজপত্র ছুড়ে ফেলা হয় ট্রেড লাইসেন্স শাখার মেঝেতে। অথচ যে ব্যক্তি ফাইল ছুড়ে ফেলেন তিনি লাইসেন্স শাখার কেউ না। সুঠাম দেহের অধিকারী, চোখে চশমা ও গায়ে ঘিয়ে রঙের ফতুয়া জড়িয়ে অনায়াসে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ও ইস্যু করার নামে ঘুষ গ্রহণ করতে দেখা গেছে তাঁকে। ডিএনসিসির অঞ্চল-২ অফিসে ঘুষের বিনিময়ে ট্রেড লাইসেন্সসহ যেকোনো কাজ করে দিতে সক্ষম এই ব্যক্তিটির নাম মো. বাবুল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবুল অঞ্চল-৩ অফিসের প্রকৌশল শাখার চেইনম্যান।

মনিরুজ্জামানকে অনুসরণ করে একটু এগিয়ে পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দ্রুত সেবা দেওয়ার নামে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা ঘুষ নেয় বাবুলসহ দশজনের বেশি দালাল ও কর্মচারী। ঘুষ না দেওয়ায় আমাকে সবার সামনে নাজেহাল হতে হলো।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি। আমার পরিচয় জানার পরও বাবুল আমার কাছে ঘুষ চেয়েছে।’

জানতে চাইলে প্রকৌশল শাখার চেইনম্যান মো. বাবুল বলেন, ‘আমি প্রকৌশল শাখায় কাজ করি। উনার লাইসেন্স নবায়নের কাজ প্রতিবছর আমিই করে দিই। মানুষের কাজ করে দিয়ে হাজারখানেক খরচের টাকা নিই।’

সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক নারীর জন্ম নিবন্ধন করতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ অফিসে আসেন তাঁর মেয়ে আয়েশা আলী। দ্রুত সময়ে সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জন্ম নিবন্ধন শাখার মো. ওয়াহিদ পাঁচশ টাকা নেন। কাজ হয়ে গেলে সরকারি ফি ছাড়াও আরো দুইশ টাকা দিতে হবে ওয়াহিদকে। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমিনের জাতীয় পরিচয়পত্রের নামে ভুল থাকায় জন্ম নিবন্ধন সনদ দিতে পারেননি ওয়াহিদ।

আয়েশা আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার সামনেই অনেকের কাছ থেকে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত টাকার বাইরে পাঁচ শ থেকে সাত শ টাকা বাড়তি নেওয়া হয়েছে। টাকা ছাড়া কথাও বলা যায় না এ অফিসের লোকদের সঙ্গে।’

অভিযোগের ব্যাপারে ওয়াহিদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভবনের অঞ্চল-১ অফিসে গত ২৭ সেপ্টেম্বর হোল্ডিং ট্যাক্স শাখায় আরিফ নামে এক ব্যক্তি অফিসটির মো. ফারুককে পাঁচ হাজার টাকা দেন। টাকার পরিমাণ নিয়ে বেশ বাগিবতণ্ডাও হয় দুজনের। কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা দিয়েই দ্রুত কেটে পড়েন আরিফ। কেন ফারুককে অর্থ দিলেন তা জিজ্ঞেস করতেই উত্তর না দিয়ে দ্রুত অফিস ত্যাগ করেন আরিফ। আর খাবার খাওয়ার অজুহাতে কক্ষ ত্যাগ করেন ফারুক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরিফ ঘুষের বিনিময়ে হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য কাজ করিয়ে দেন ডিএসসিসিতে।

সম্প্রতি রাজধানীবাসীর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দুই সিটি করপোরেশনের দশটি আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরে এবং শতাধিক সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে ঘুষ গ্রহণ এবং হয়রানির এমন আরো ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। সেবা নিতে হলে ঘুষ দিতে হবে এটিকে অনেকটা নিয়মে পরিণত করেছে সব কটি আঞ্চলিক অফিসের ট্রেড লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন ও হোল্ডিং ট্যাক্স শাখা বিভাগ। তবে তিন শাখার মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স শাখার চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ বলে অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা। আবার সেবা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রহীন ব্যক্তিরা দ্রুত ও সহজে সেবা নিতে দালাল বা কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছায় ঘুষ দেয় বলেও জানা গেছে। ডিএসসিসির মেয়র ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এসব অভিযোগ স্বীকার করলেও অস্বীকার করেছেন ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. জামাল মোস্তফা।

ভুক্তভোগীরা জানান, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু এবং নবায়ন করতে জনপ্রতি এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। টাকার পরিমাণ নির্ভর করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ওপর। প্রয়োজনীয় কাগজ না থাকলে ঘুষের পরিমাণও বাড়ে। এ ছাড়া জন্ম নিবন্ধন করতে দিতে হয় দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা। তবে আগে জন্ম নিবন্ধন করা থাকলে সে ক্ষেত্রে ঘুষের টাকার পরিমাণ বাড়ে। হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের ক্ষেত্রে নেওয়া হয় পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসির অঞ্চল-৫ অফিসে ট্রেড লাইসেন্স করতে আসা শেখেরটেক এলাকার শাকিরা নামে এক নারী বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স শাখায় টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। দুইশ টাকার বইয়ের জন্য আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নেওয়া হয়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের ক্ষেত্রেও ঘুষ দিলে কম-বেশি করিয়ে দেয় ওরা।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএনসিসির মোট পাঁচটি আঞ্চলিক অফিসে অর্ধশতাধিক দালাল সক্রিয়। এ ছাড়া এসব অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তারাও ঘুষের বিনিময়ে সেবা প্রদান করে থাকেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট শাখা ছাড়াও অন্যান্য শাখায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঘুষ নিয়ে সেবা প্রদান করেন এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। ট্রেড লাইসেন্স শাখার লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজারদের সঙ্গে যোগসাজশে ঘুষ দেওয়া ব্যক্তিদের কাজ দ্রুত করিয়ে দেন তাঁরা। এক শাখায় দায়িত্বরত কর্মীরা অনুমতি ছাড়া কিভাবে অন্য শাখায় কাজ করে তার উত্তরও জানা নেই কর্মকর্তাদের।

ডিএনসিসির অঞ্চল-২ অফিসে লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজারের সামনেই মো. বাবুল নামে প্রকৌশল শাখার চেইনম্যানকে অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।

একই রকম অভিযোগ ডিএনসিসির অঞ্চল-১ অফিসের কর্মচারী মাফিদুল ইসলাম, অঞ্চল-৩ অফিসের স্বাস্থ্য বিভাগের নমুনা সংগ্রহকারী পরিচয় দেওয়া আনোয়ার হোসেন, জন্ম নিবন্ধন শাখায় কর্মরত পিয়ন মো. রহমান এবং সাবিনা আক্তারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ পাওয়া গেছে অঞ্চল-৪-এর অফিস পিয়ন রুমা আক্তার এবং ট্রেড লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার বুলবুল আহমেদের বিরুদ্ধেও। এ ছাড়া অঞ্চল-৫-এর প্রকৌশল শাখার পিয়ন দুলালও জড়িত একই কাজে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচটি অফিসেই দালালরা নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে প্রকৃত নাম গোপন করে ছদ্মনাম ব্যবহার করে।

অঞ্চল-৩-এর স্বাস্থ্য বিভাগের নমুনা সংগ্রহকারী পরিচয় দেওয়া আনোয়ার হোসেন ঘুষের বিনিময়ে সব কটি আঞ্চলিক অফিসে কাজ করিয়ে দিতে পটু। ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ অফিসের ১৮ সেপ্টেম্বর ট্রেড লাইসেন্স শাখায় পাওয়া যায় তাঁকে। অঞ্চল-১ অফিসের ট্রেড লাইসেন্স শাখায়ও গত ২৭ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয় আনোয়ার হোসেনের। দুই স্থানেই লাল-সাদা চেক শার্ট এবং কালো রঙের ঢোলা প্যান্ট পরা ছিলেন তিনি। হাতে ছিল ট্রেড লাইসেন্স আবেদনের একাধিক ফাইলসংবলিত শপিং ব্যাগ।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখানে সঠিক পরিচয় কেউ দিতে চায় না। আমি অফিসরাদের দিয়ে দ্রুত কাজ করিয়ে দিই। বিনিময়ে প্রতিটি কাজ থেকে দুই-এক হাজার টাকা নিই। এটা অবৈধ কিছু না। টাকার ভাগ অফিসরাদেরও দিতে হয়।’

হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে এসে হয়রানির শিকার হওয়ার নজিরও রয়েছে অফিসটিতে। ট্যাক্স পরিশোধ করতে আসা উত্তরার জোয়ার সাহারা এলাকার আহসান হাবিব জানান, ‘সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা আমার হোল্ডিং নম্বর ভাড়াটিয়ার নামে নথিভুক্ত করেছেন। এখন হোল্ডিং নম্বর পরিবর্তন করতে পারছি না। তাঁদের ভুলের জন্য আমাকে নানা অফিসে দৌড়াতে হচ্ছে।’

সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিসে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুষের টাকা লেনদেন এবং সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করা হলেও বিষয়টি অজানা আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের।

অঞ্চল-২-এর নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম ফকির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধন শাখার কিছু অভিযোগ জানি আমি। তবে ট্রেড লাইসেন্স ও হোল্ডিং ট্যাক্স শাখায় অনৈতিক লেনদেন বা হয়রানির বিষয়টি আমার জানা নেই।’

ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘দ্রুত সেবা দেওয়ার কড়া নির্দেশনা দেওয়া আছে আঞ্চলিক অফিসগুলোকে। এর ব্যত্যয়ের কোনো অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পাঁচটি আঞ্চলিক অফিসের চিত্রও একই রকম। তবে অঞ্চল-৪ অফিসের সেবা প্রদান তুলনমূলক ভালো বলে জানিয়েছেন সেবাগ্রহীতারা। এই পাঁচ অফিসেও সক্রিয় অর্ধশতাধিক দালাল। এ ছাড়া ঘুষ লেনদেন সহজ ও নির্বিঘ্ন করতে কর্মকর্তারা অফিসে আসার সময় পরিচিত দালালদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অঞ্চল-২-এ কর্মরত এক আনসার সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে অর্থ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। বড় স্যাররা অফিসে আসার সময় দালালদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।’

ডিএসসিসির অঞ্চল-১ হোল্ডিং ট্যাক্স বিভাগের অফিস সহকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং ফারুক নামে দুই ব্যক্তি জড়িত অর্থ লেনদেনে। এ ছাড়া অঞ্চল-২-এর কর শাখায় কর্মরত নজরুল ইসলাম এবং শিল্পী নামে এক পিয়নকে সরাসরি অর্থ লেনদেন করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আট হাজার টাকার বিনিময়ে করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস এই প্রতিবেদককেও দেন তারা। অঞ্চল-৩ অফিসে ট্রেড লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার আবুল কালাম খান প্রকাশ্যেই নেন ঘুষ। দুই শ টাকার বই নিতে তাঁকে দিতে হয় চার শ টাকা এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে। তবে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি কালের কণ্ঠ’র কাছে অস্বীকার করেছেন আবুল কালাম আজাদ।

তবে আবুল হোসেন নামে ইমামগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘দুই শ টাকার বই নেওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে পাঁচ শ টাকা। আবুল কালাম খান আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।’

অঞ্চল-৫ অফিসে দায়িত্বরত লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার ইকবাল আহমেদ, অফিস সহকারী আবুল কালাম, জন্ম নিবন্ধন শাখার কম্পিউটার অপারেটর ওয়াহিদের বিরুদ্ধেও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ করেছেন সেবা গ্রহণকারীরা।

এ ব্যাপারে ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটের বাসিন্দা রেজানুর রহমান রাজু বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে ইকবাল আহমেদ এক হাজার তিন শ টাকার পরিবর্তে তিন হাজার টাকা দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত এক সিনিয়র কর্মকর্তাকে জানালে ফি কমিয়ে দেন তিনি।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার বলেন, ‘কিছু অভিযোগ আছে আমাদের কাছে। তবে কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি হয়রানি এবং ঘুষ গ্রহণ করে দালালরা। আগামী বছর থেকে সম্পূর্ণ অনলাইনে সেবা কার্যক্রম শুরু হবে। তখন এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘নানা সময় আমাদের কাছে দালালচক্র ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। কিন্তু এগুলো লিখিত আকারে না আসায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। এর আগে র‌্যাব বেশ কয়েকজন দালালকে ধরেছেও হাতেনাতে।’

  • কার্টসি: কালেরকন্ঠ / ০৩ অক্টোবর ২০১৮