- বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত উপেক্ষিত
- বেসরকারি নতুন ৯ ব্যাংকের অবস্থা এখনও বেশ দুর্বল
নতুন ব্যাংকের আর প্রয়োজন নেই- বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন মতামত উপেক্ষা করে নতুন তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে এ পদক্ষেপ। এসব ব্যাংকের উদ্যোক্তা বা নেপথ্যে যারা আছেন, তারা সবাই সরকারের খুব ঘনিষ্ঠজন। এর আগে একই প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতে নতুন ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ‘দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে আর কোনো নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই।’ এর আলোকে ২০১১ সালে সরকার নতুন ব্যাংক দেয়ার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতেও এই মতামত দেয়া হয়।
এ বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ব্যাংকগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারে না।
গত দুই সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ব্যাংকগুলোর প্রায় সবকটির অবস্থাই এখন খারাপ। এ কারণে তারা মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় আর নতুন ব্যাংক দেয়া উচিত হবে না।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ২০১৩ সালে নতুন ব্যাংক দেয়ার সময় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, দেশে অর্থনীতিতে নতুন ব্যাংক এলে ব্যাংকিং খাতে একধরনের প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। এতে গ্রাহকরা উপকৃত হবে। কর্মসংস্থান হবে। শিল্প খাতে অর্থায়নের দুয়ারের বহুমুখী পথ খুলে যাবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সেনাবাহিনী ও বিজিবির মতো পুলিশ বাহিনীকেও একটি ব্যাংক দেয়া হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এভাবে ব্যাংক দিলে ক্ষতি নেই। আর প্রক্রিয়াধীন নতুন তিন ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাংকগুলোর অনুমোদন এখনও দেয়া হয়নি। তাদের কাগজপত্রে ঘাটতি আছে। এটি রাজনৈতিক বলা যাবে না। কারণ রাজনৈতিক হলে এক বোর্ডে চার ব্যাংক দিয়ে দিতে পারত। তা কিন্তু করা হয়নি।
এত ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন নেই বলার সুযোগ নেই। কারণ এখনও সব মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসেনি।
মূলত সংখ্যা নয়, ব্যাংকের মান এবং ঋণমান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, নতুন ব্যাংকগুলো যাতে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের ভারে আক্রান্ত এবং ফারমার্স ব্যাংকের মতো যেন না হয়।
সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল, দেশের অর্থনীতিতে আর নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। যেসব ব্যাংক আছে, সেগুলোকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিকমানের নীতিমালায় এনে পরিচালিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেননা ওই সময়েও ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার বেশি ছিল। মূলধন ঘাটতিও ছিল ব্যাপক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী (প্রয়াত) এম সাইফুর রহমান বেসরকারি খাতে আর কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছিলেন।
ফলে বিএনপি সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। যদিও ওই সময়ে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে ১০৬টি আবেদন পড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপত্তি করে।
এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায়ও এ বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও নতুন ব্যাংক না দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়।
কিন্তু ২০১০ সালের শেষদিকে সরকার বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১১ সালে ব্যাংক দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও তীব্র আপত্তি তোলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ থেকেও নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই পর্যায়ে সরকারের ওপরমহলের নির্দেশে অর্থমন্ত্রী নতুন ব্যাংক দেয়ার বিপক্ষের অবস্থান থেকে সরে এসে ব্যাংক দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন।
একপর্যায়ে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের একটি সংস্থা। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন ব্যাংক দেবে। এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাস্তবায়ন করবে। এটিই তাদের কাজ। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তার অবস্থান থেকে সরে এসে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। যেসব ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে, তার একটি তালিকা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়। এই তালিকা অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়।
এর সবই ছিল রাজনৈতিকভাবে সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তাদের নামে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- মধুমতি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক এবং সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক।
রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এসব ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৩ সালে। অথচ কার্যক্রমে আসার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কবলে পড়ে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পেরে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের আস্থার সংকট তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এ সরকারের শুরুতে নতুন ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু চাপের মুখে তারা লাইসেন্স দিতে বাধ্য হয়। কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম এবং সব ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণই প্রমাণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সময়ের বিরোধিতা সঠিক ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নতুন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৭১৩ কোটি টাকা। এতে এক বছরের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
খেলাপি প্রবৃদ্ধি প্রায় সাড়ে তিনগুণ। খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে ফারমার্স ব্যাংকের। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
সরকারের শেষ সময়ে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে আবার আলোচনা উঠলে অর্থমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, সরকারের এই মেয়াদে আর কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে না।
গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ডিজিটাল ব্যাংক নামে একটি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন। ওই চিঠিতে অর্থমন্ত্রী লেখেন, সরকারের এই মেয়াদে আর কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে না। এ কারণে জিডিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। এখন আর ব্যাংক দেয়া ঠিক হবে না।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন ব্যাংক বেশি হয়ে গেছে। তাহলে তিনি কীভাবে নতুন ব্যাংকের প্রস্তাব পাঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে। এভাবে দ্বিমুখী নীতি ব্যাংকিং খাতকে অনেক ক্ষতি করেছে। তিনি থাকলে আরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মন্ত্রীর অমতেও কোন প্রেসার গ্রুপের চাপে আরও নতুন ব্যাংক দেয়া হচ্ছে, তা খতিয়ে বের করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
এদিকে বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে আরও চারটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানায় কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আরও ৩টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। গ্রুপের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি মোরশেদ আলম। একই গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান হচ্ছেন জসিম উদ্দিন। তিনি বাংলা ব্যাংকেরে পর্ষদের চেয়ারম্যান।
পিপলস ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতা এমএ কাসেম এবং সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মা জাহানারা হক।
এছাড়াও এই সরকারের আমলে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানায় সীমান্ত ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিশেষায়িত প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়েছে।
- কার্টসিঃ যুগান্তর/ নভেম্বর ১৪,২০১৮