একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম গতকাল (১৬ নভেম্বর) বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, বাংলাদেশেও হবে না। নির্বাচন কমিশন একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। যেটা সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবে।’
প্রায় একই রকমের কথা কয়েকমাস আগে বলেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। অন্য কমিশনাররা তখন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এখন আরেক কমিশনার আবার বললেন। নির্বাচন কমিশনার হয়ে একথা তারা বলতে পারেন কিনা বা কেন বলছেন?
এ বিষয়ে আজ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের চার জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘একজন নির্বাচন কমিশনারের পক্ষে এ ধরনের কথা বলা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তারা তো বলবেন যে, আমরা শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন করার আপ্রাণ চেষ্টা করব। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, একথা বলাটা একেবারেই অযাচিত ও অবিবেচনাপ্রসূত।’
পূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকেও প্রায় একই ধরনের বক্তব্য আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা আগে থেকেই অজুহাত তৈরি করে রাখছেন। যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বলতে পারেন, আমরা তো আগেই বলেছিলাম। ছেলেমানুষি ব্যাপার হয়ে গেল একদম।’
‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না- এমন নিশ্চয়তা নেই, নির্বাচন কমিশনারদের কেউই এসব কথা বলতে পারেন না।’ ভাষ্য হাফিজউদ্দিনের।
নির্বাচন কমিশনের বর্তমান ভূমিকার প্রেক্ষাপটে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কি না? প্রশ্নের জবাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অতীত রেকর্ড তো ভালো না। সে কারণে এখনও আস্থাশীল হতে পারছি না। এখন দেখা যাক- নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সম্পর্কে কতটুক সচেতন, কীভাবে তারা পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করেন।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেকজন সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, এটি নির্বাচন কমিশনারদের কিছুটা দায়িত্ব-জ্ঞানহীন আচরণ। এ ধরনের বক্তব্যে দুটি অর্থ থাকে। একটি হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা- নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনেক সমস্যা থাকে, শেষ পর্যন্ত শতভাগ সুষ্ঠু হয় কী না। আর একটি হচ্ছে অভিপ্রায়- শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রচেষ্টা। কিন্তু, এই বক্তব্যে এক ধরনের অভিপ্রায়ের ঘাটতি আছে। ওনাদের তো একমাত্র বলা উচিত যে, শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য আমরা শতভাগ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।’
‘একজন বিশ্লেষক বা বাইরের একজন এই কথা বলতে পারেন। কিন্তু সাংবিধানিক পদমর্যাদার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনারদের দায়িত্ব হলো দুই পর্যায়ের। একটি হচ্ছে- তারা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আর একটি হলো- নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য বিশ্বাস অটুট রাখবেন। কিন্তু, এ ধরনের বক্তব্য এই দুটি পর্যায়কেই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে’ মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগেও, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য এসেছে উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘গতকাল কবিতা খানম যা বলেছেন, তা আমাদের জন্য বিশেষভাবে বিরক্তির কারণ। কারণ- নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব কেবল প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনই নয়। অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তাদের সক্ষমতাও প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু, তার আগেই তাদের বক্তব্যে যদি একটি বিশেষ অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়, তাহলে এটি দুর্ভাগ্যজনক। এর জন্য তাদের অনুশোচনাবোধে ভোগা উচিত।’
এতদসত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখার ব্যাপারে প্রশ্নের জবাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘ইতিমধ্যে একটি আস্থাহীনতার জায়গা থেকে পুরো বিষয়টি এগুচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা যদি নাও থাকে, তারপরেও জন আকাঙ্ক্ষার যে চাপ আছে, সেই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার কিছুটা হলেও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে এগিয়ে এসেছে, সেহেতু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা এবং প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার অভিপ্রায় পুনর্ব্যক্ত করা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনারের পদে আসীন থেকে তিনি একথা বলতে পারেন না। উনি তো উল্টো বলতে পারতেন যে, শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন অঙ্গীকারবদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এমন এক ক্রান্তিলগ্নে একজন নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসলে তাতে বিভ্রান্তির জন্ম হয়। নির্বাচন কমিশন যদি আগেভাগেই বুঝেতে পারে যে, নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নেই; তারপরও তা স্বীকার করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’
‘কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের আর কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যেসব বিষয়কে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করবে, সেসব নিয়ে তারা অভ্যন্তরীণ আলোচনা অব্যাহত রাখতে পারে। এর থেকে উত্তরণে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল এবং সর্বোপরি দেশের জনগণের সহযোগিতা চাইতে পারে। কিন্তু তারা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত কি কি দিক নির্দেশনা দেবেন, তা কেন প্রকাশ্যে আসবে?’ প্রশ্ন রাখেন মনজুরুল।
‘এখন থেকেই নির্বাচন কমিশনের এসব বিষয়ে নেতিবাচক কথা বলা উচিত নয়। নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত দিক নির্দেশনামূলক বৈঠকে গণমাধ্যমকে ডাকা উচিত নয়। কারণ- নির্বাচন কমিশন কোনো “ননসেন্স অর্গানাইজেশন” নয়। নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হবে না, নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকানোর নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না, এসব বাহানা দেওয়াও ঠিক না’ মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘যদি বলতেই হয়, নির্বাচন কমিশনারদের বলা উচিত যে, শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা দুই শতভাগ প্রস্তুত আছি। তাহলেই নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা থাকবে, অন্যথায় নয়।’
নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমার কাছে ব্যাপারটি খুব অদ্ভুত মনে হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে অনেক কিছু করা সবসময় সম্ভব হয় না। কিন্তু আপনি যখন দায়িত্বে থাকবেন, তখন আপনাকে তো শতভাগ চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এটি বলে দেওয়া তো ঠিক না, শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা। তাদের যা দরকার সবই দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের কথা বললে তো বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। এর কারণে মানুষের মধ্যে বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝি ও হতাশার সৃষ্টি হবে।’
‘নির্বাচন কমিশনারদের তো বলা উচিত ছিল, যেকোনো মূল্যে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন করব। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চাই। প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম সবার সহযোগিতা চাইবেন তারা। তারা আগে থেকেই হাল ছেড়ে দেবেন কেন?’ প্রশ্ন ড. তোফায়েলের।
এর আগে, গত ৭ আগস্ট পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ তার নেই।’
এ বিষয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘যুদ্ধের আগেই তারা পরাজয় বরণ করছেন কেন? এতে তো নৈতিকতা দুর্বল হয়ে যায়। যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন, তারা তো অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজটি পরিচালনা করেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সুরক্ষার বিষয়টি তো নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু এরকম যদি হয়, একজন নির্বাচনী কর্মকর্তাকে কেউ হুমকি দিল বা লাঞ্ছিত করল, সেক্ষেত্রে আপনি তার সুরক্ষা না দিয়ে বললেন যে এমনটি তো হবেই। তাহলে তো কেউ আর নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হবেন না।’
‘আমি সেদিক থেকেই বলতে চাই, নির্বাচন কমিশনের বুঝতে হবে যে সে যুদ্ধে নেমেছে। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্যই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের মেয়াদে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাকিগুলো কিন্তু অতিরিক্ত দায়িত্ব। জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাদের দায়িত্ব এবং এটিকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করাই হলো তাদের জন্য মরণপণ যুদ্ধ। এখানে যদি তারা নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই বলে দেয় যে, সুষ্ঠু হবে না। তাহলে তো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে তাদের থাকাই উচিত না। তাদের সবারই পদত্যাগ করা উচিত। যারা অনিয়ম ঠেকাতে পারবে, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে, তাদেরই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা উচিত’ মন্তব্য তোফায়েল আহমেদের।
- Courtesy: The Daily Star /Bangla online/ Nov 18, 2018