সম্পাদকীয়
একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিবহন খাতের উন্নতিও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অর্থনৈতিক অবকাঠামোয় পরিবহন ব্যবস্থা হলো ভিত্তিপ্রস্তর। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা বাণিজ্য ও শিল্পায়নকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ, যারা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের জন্য তো সুশৃঙ্খলিত পরিবহন ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যে আমরা যতটা এগোতে পেরেছি, পরিবহন ব্যবস্থাকে সে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত করতে পারিনি।
পণ্য পরিবহনে নৌ ও রেলপথ ব্যবহার করা হলেও দেশের সিংহভাগ পণ্য পরিবহন করা হয় সড়কপথে। আর পণ্য পরিবহনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এ মহাসড়ককে বলা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন।
দেশের আমদানি-রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় এ পথে। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় এ মহাসড়ক যে ধরনের পরিকল্পনা দাবি করে, তা দেয়া যাচ্ছে কিনা, এটি ক্রমেই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য পরিবহন ব্যয় বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। এক্ষেত্রে কেবল আফ্রিকার কিছু দেশ এগিয়ে রয়েছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, কিলোমিটারপ্রতি প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ভারত, পাকিস্তানে আমাদের চেয়ে কম ব্যয় হয়। ফলে অবধারিতভাবে প্রশ্ন ওঠে, আমাদের এখানে ব্যয় বেশি কেন? অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতের পর সবাই, বিশেষ করে ব্যবসায়ীগোষ্ঠী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কারণ এর ফলে সড়কপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সহজ, দ্রুত, যানজটমুক্ত ও উন্নততর হয়। কিন্তু এ স্বস্তি বেশি দিন টেকেনি। দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত হয়েছে বটে, কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রামে যাতায়াতের সময় দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এজন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে যানজটকে। যানজটের কারণে পণ্য পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে, সার্বিকভাবে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজটের বিরূপ প্রভাব যে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনের খরচে পড়ে, সে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের থাকলেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়। কিন্তু চালুর পর পরই নকশা ও পরিকল্পনার বিভিন্ন অসঙ্গতি সামনে আসে। পরিকল্পনায় লেভেল ক্রসিং, ফ্লাইওভার, সার্ভিস সড়ক, মহাসড়কের পাশে বাজারসহ সংশ্লিষ্ট বেশকিছু ইস্যুতে প্রয়োজনীয় নজর দেয়া হয়নি। এ ঘাটতিগুলো এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক নির্মাণের আগে সংশ্লিষ্ট সব দিক বিবেচনায় নেয়াই যুক্তিসঙ্গত ছিল। এবং অবশ্যই আগামী ১৫-২০ বছরের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় পরিকল্পনা সাজানোর দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এমনটা হয়নি। যথাযথ ও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবেই এখন এ মহাসড়ক সামগ্রিকভাবে একটি বিশৃঙ্খল ও যানজটে আক্রান্ত মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। এত অর্থ ও সময় ব্যয় করে নির্মিত চার লেনের কোনো সুফল বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। এখন আবার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। একটি মহাসড়ককে নিয়ে বারবার প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশের জন্য বিলাসিতা নয় কি? এ বিষয়গুলোয় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর জবাবদিহি চাওয়া উচিত।
দেশের অর্থনীতির খাতিরেই মহাসড়কটি যানজটমুক্ত করতে হবে এবং এতে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। তা না হলে পরিবহন ব্যয় স্বাভাবিক করা যাবে না। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বাজার, উল্টো পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। হাইওয়ে পুলিশকে সুশৃঙ্খলভাবে যান চলাচল ও চালকদের আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরো দক্ষ ও উন্নত করতে পদক্ষেপ নেয়া চাই। সড়ক-মহাসড়কের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে সার্বক্ষণিক তত্পরতা দেখাতে হবে। দায়সারা সংস্কার আর আমরা দেখতে চাই না।
- কার্টসিঃ বণিকবার্তা/ নভেম্বর ২৯,২০১৮