বদিউল আলম মজুমদার
গত ২৮ নভেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী প্রার্থীরা তাঁদের মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। কাল ২ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তারা মনোনয়নপত্র বাছাই করবেন। বাছাইপ্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে মনোনয়নপত্র গ্রহণ বা বাতিল করা হবে। তাই বাছাইপ্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো।
বাছাইপ্রক্রিয়ায় অনেকগুলো বিষয় খতিয়ে দেখা হয়, যার একটি হলো মনোনয়নপত্রে ভুলত্রুটি। ছোটখাটো ত্রুটির জন্য, যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধন করা যায়, মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় না। আরেকটি বিবেচনার বিষয় হলো মনোনয়নপত্রের অসম্পূর্ণতা। যেমন হলফনামা কিংবা আয়কর রিটার্নের কপি সংযুক্ত না থাকলে মনোনয়নপত্র বাতিলযোগ্য। এ ছাড়া মনোনয়নপত্রে প্রস্তাব/সমর্থনকারীর যোগ্যতা তাঁরা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার কি না এবং মনোনয়নপত্রে প্রার্থী ও প্রস্তাব/সমর্থনকারীর স্বাক্ষর সঠিক কি না। এসব বিষয়, বিশেষত হলফনামায় তথ্য গোপন করা অথবা মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। প্রার্থী অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া, দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক হলে সংসদ সদস্য হতে বা থাকতে পারবেন না। আমাদের সংসদ সদস্যদের কারও কারও বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়গুলো রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরূপণ করা আবশ্যক।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়, তাহলে তিনিও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন। অতীতে দণ্ড (কনভিকশন) ও সাজা (সেনটেন্স) স্থগিত না হলেও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমাদের আদালত সংসদ সদস্য হতে বাধা প্রদান করেননি, যার দুই দৃষ্টান্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আর নির্বাচন কমিশন কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেননি, বরং বিষয়টি নির্বাচন–পরবর্তীকালে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সুরাহাযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও আবদুর রহমান বদির দণ্ডপ্রাপ্তির পর সংসদ সদস্য পদে থেকে যাওয়ার বিষয়ও প্রাসঙ্গিক।
গত ২৮ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল ইসলাম আলমের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ ডা. জাহিদসহ বিএনপির পাঁচ নেতার দুর্নীতির অভিযোগে প্রাপ্ত দণ্ড স্থগিত করার আবেদন খারিজ করার আদেশ দেন। সংবাদমাধ্যমের খবর, তাঁরা সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না বলে আদালত পর্যবেক্ষণ দেন। আপিল বিভাগ এই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তাই এই পাঁচজনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়, যদি না নির্বাচন কমিশন তাঁদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, পর্যবেক্ষণ আদালতের নির্দেশ নয়। এটি দিকনির্দেশনামূলক (ডিরেক্টরি), অবশ্যপালনীয় (ম্যান্ডেটরি) আদেশ নয় এবং কমিশনের পক্ষ থেকে এটি গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। উদাহরণস্বরূপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলায় বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, যা মানা হয়নি।
এই রায়ের সূত্র ধরে দাবি করা হচ্ছে যে বেগম খালেদা জিয়া এবং আরও অনেকে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হবেন। তবে আইনজ্ঞদের মতে অন্য যাঁরা এ ধরনের সাজাপ্রাপ্ত আছেন, তাঁদেরও আদালতে গিয়ে দণ্ড স্থগিতের আবেদন করার সুযোগ থাকবে। কারণ, কোনো অবস্থাতেই দণ্ড স্থগিত করা যাবে না ডা. জাহিদের মামলায় আপিল বিভাগ তেমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে আমরা শুনিনি। আর অতীতে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ক্ষেত্রে চেম্বার জজ তাঁর দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্তির রায় স্থগিত করেছেন (ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বনাম বাংলাদেশ ৬২ ডিএলআর (এডি)২০১০)।
এ প্রসঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো যে ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. রইসউদ্দিনের একক বেঞ্চ সাবিরা সুলতানার দণ্ড ও সাজা স্থগিত করেন, যার ফলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য হবেন বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক দণ্ডপ্রাপ্তের দণ্ড স্থগিতের পক্ষে যৌক্তিকতা ভিন্ন। যেমন কেউ কেউ যুক্তি দেন যে একটি দলের প্রধান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিলে তাঁর স্থায়ী ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকার [মো. মামুন ওয়ালিদ হাসান বনাম রাষ্ট্র, ২০১৭(২)এলএনজে)] মামলায় রায় দেন যে বিশেষ ক্ষেত্রে অবিচার ও স্থায়ী পরিণতি রোধে হাইকোর্ট একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত করতে পারেন।
এ ছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের সংজ্ঞা আমাদের আইনে নেই। তবে এ ব্যাপারে উচ্চ আদালত তিনটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যথা: মানুষ এর দ্বারা ‘শকড’ বা মর্মাহত হয়েছে কি না; যে কর্মের (যেমন অর্থ আত্মসাৎ) জন্য দণ্ডিত, সে অপরাধ (আত্মসাৎ) করার উদ্দেশ্যেই কর্মটি করা হয়েছে কি না; এবং সমাজ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নীতিবিবর্জিত বলে মনে করে কি না এবং হেয় চোখে দেখে কি না। তাই বেগম জিয়ার দণ্ড নৈতিক স্খলনের আওতায় পড়ে কি না, তা সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বিবেচনায় নিতে হবে।
সংবিধান ছাড়াও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২-এর ১২ ধারাতেও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। আরপিও-এর ১২(ট) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত থাকলে তিনি সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হবেন। পণ্য সরবরাহ, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন, এমনি আইন পরামর্শমূলক সেবা প্রদানও ব্যবসায়িক সম্পর্কের আওতায় পড়েন বলে আইনজ্ঞদের ধারণা।
আমাদের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে, এমনকি বর্তমানেও সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন অতীতে রাজশাহী-৪ থেকে নির্বাচিত এনামুল হক রাজশাহীর কাটাখালীতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১১)। এর আগে তাঁর মালিকানাধীন এনা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মধ্যে রাজশাহীতে বহুতল সিটি সেন্টার নির্মাণের চুক্তি হয়। আশা করি তিনি বর্তমানে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত নন।
সম্প্রতি প্রথম আলোর (২৪ নভেম্বর ২০১৮) এক প্রতিবেদনে ঢাকা-১৪ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ আসলামুল হকের সিএলসি নামের ভাড়াভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে অবৈধভাবে ১১ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকারের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হওয়ারই কথা। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া অন্য সাংসদের বিরুদ্ধেও সরকারের কাছে পণ্য সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ [ধারা ১২] অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের কোনে চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণকারী ওই পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণের পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। সরকার বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন অযোগ্যতা প্রযোজ্য [ধারা ১২]। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এ বিষয়ের দিকেও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মনোযোগ দিতে হবে।
- ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৮