Search

Sunday, December 2, 2018

মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক

বদিউল আলম মজুমদার

গত ২৮ নভেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী প্রার্থীরা তাঁদের মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। কাল ২ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তারা মনোনয়নপত্র বাছাই করবেন। বাছাইপ্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে মনোনয়নপত্র গ্রহণ বা বাতিল করা হবে। তাই বাছাইপ্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো।

বাছাইপ্রক্রিয়ায় অনেকগুলো বিষয় খতিয়ে দেখা হয়, যার একটি হলো মনোনয়নপত্রে ভুলত্রুটি। ছোটখাটো ত্রুটির জন্য, যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধন করা যায়, মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় না। আরেকটি বিবেচনার বিষয় হলো মনোনয়নপত্রের অসম্পূর্ণতা। যেমন হলফনামা কিংবা আয়কর রিটার্নের কপি সংযুক্ত না থাকলে মনোনয়নপত্র বাতিলযোগ্য। এ ছাড়া মনোনয়নপত্রে প্রস্তাব/সমর্থনকারীর যোগ্যতা তাঁরা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার কি না এবং মনোনয়নপত্রে প্রার্থী ও প্রস্তাব/সমর্থনকারীর স্বাক্ষর সঠিক কি না। এসব বিষয়, বিশেষত হলফনামায় তথ্য গোপন করা অথবা মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে।

প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। প্রার্থী অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া, দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক হলে সংসদ সদস্য হতে বা থাকতে পারবেন না। আমাদের সংসদ সদস্যদের কারও কারও বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়গুলো রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরূপণ করা আবশ্যক।

এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়, তাহলে তিনিও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন। অতীতে দণ্ড (কনভিকশন) ও সাজা (সেনটেন্স) স্থগিত না হলেও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমাদের আদালত সংসদ সদস্য হতে বাধা প্রদান করেননি, যার দুই দৃষ্টান্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আর নির্বাচন কমিশন কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেননি, বরং বিষয়টি নির্বাচন–পরবর্তীকালে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সুরাহাযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও  আবদুর রহমান বদির দণ্ডপ্রাপ্তির পর সংসদ সদস্য পদে থেকে যাওয়ার বিষয়ও প্রাসঙ্গিক।

গত ২৮ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল ইসলাম আলমের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ ডা. জাহিদসহ বিএনপির পাঁচ নেতার দুর্নীতির অভিযোগে প্রাপ্ত দণ্ড স্থগিত করার আবেদন খারিজ করার আদেশ দেন। সংবাদমাধ্যমের খবর, তাঁরা সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না বলে আদালত পর্যবেক্ষণ দেন। আপিল বিভাগ এই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তাই এই পাঁচজনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়, যদি না নির্বাচন কমিশন তাঁদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, পর্যবেক্ষণ আদালতের নির্দেশ নয়। এটি দিকনির্দেশনামূলক (ডিরেক্টরি), অবশ্যপালনীয় (ম্যান্ডেটরি) আদেশ নয় এবং কমিশনের পক্ষ থেকে এটি গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। উদাহরণস্বরূপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলায় বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, যা মানা হয়নি।

এই রায়ের সূত্র ধরে দাবি করা হচ্ছে যে বেগম খালেদা জিয়া এবং আরও অনেকে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হবেন। তবে আইনজ্ঞদের মতে অন্য যাঁরা এ ধরনের সাজাপ্রাপ্ত আছেন, তাঁদেরও আদালতে গিয়ে দণ্ড স্থগিতের আবেদন করার সুযোগ থাকবে। কারণ, কোনো অবস্থাতেই দণ্ড স্থগিত করা যাবে না ডা. জাহিদের মামলায় আপিল বিভাগ তেমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে আমরা শুনিনি। আর অতীতে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ক্ষেত্রে চেম্বার জজ তাঁর দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্তির রায় স্থগিত করেছেন (ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বনাম বাংলাদেশ ৬২ ডিএলআর (এডি)২০১০)।

এ প্রসঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো যে ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. রইসউদ্দিনের একক বেঞ্চ সাবিরা সুলতানার দণ্ড ও সাজা স্থগিত করেন, যার ফলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য হবেন বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক দণ্ডপ্রাপ্তের দণ্ড স্থগিতের পক্ষে যৌক্তিকতা ভিন্ন। যেমন কেউ কেউ যুক্তি দেন যে একটি দলের প্রধান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিলে তাঁর স্থায়ী ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকার [মো. মামুন ওয়ালিদ হাসান বনাম রাষ্ট্র, ২০১৭(২)এলএনজে)] মামলায় রায় দেন যে বিশেষ ক্ষেত্রে অবিচার ও স্থায়ী পরিণতি রোধে হাইকোর্ট একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত করতে পারেন।

এ ছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের সংজ্ঞা আমাদের আইনে নেই। তবে এ ব্যাপারে উচ্চ আদালত তিনটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যথা: মানুষ এর দ্বারা ‘শকড’ বা মর্মাহত হয়েছে কি না; যে কর্মের (যেমন অর্থ আত্মসাৎ) জন্য দণ্ডিত, সে অপরাধ (আত্মসাৎ) করার উদ্দেশ্যেই কর্মটি করা হয়েছে কি না; এবং সমাজ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নীতিবিবর্জিত বলে মনে করে কি না এবং হেয় চোখে দেখে কি না। তাই বেগম জিয়ার দণ্ড নৈতিক স্খলনের আওতায় পড়ে কি না, তা সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বিবেচনায় নিতে হবে।

সংবিধান ছাড়াও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২-এর ১২ ধারাতেও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। আরপিও-এর ১২(ট) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত থাকলে তিনি সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হবেন। পণ্য সরবরাহ, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন, এমনি আইন পরামর্শমূলক সেবা প্রদানও ব্যবসায়িক সম্পর্কের আওতায় পড়েন বলে আইনজ্ঞদের ধারণা।

আমাদের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে, এমনকি বর্তমানেও সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন অতীতে রাজশাহী-৪ থেকে নির্বাচিত এনামুল হক রাজশাহীর কাটাখালীতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১১)। এর আগে তাঁর মালিকানাধীন এনা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মধ্যে রাজশাহীতে বহুতল সিটি সেন্টার নির্মাণের চুক্তি হয়। আশা করি তিনি বর্তমানে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত নন।

সম্প্রতি প্রথম আলোর (২৪ নভেম্বর ২০১৮) এক প্রতিবেদনে ঢাকা-১৪ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ আসলামুল হকের সিএলসি নামের ভাড়াভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে অবৈধভাবে ১১ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকারের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হওয়ারই কথা। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া অন্য সাংসদের বিরুদ্ধেও সরকারের কাছে পণ্য সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ [ধারা ১২] অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের কোনে চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণকারী ওই পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণের পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। সরকার বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন অযোগ্যতা প্রযোজ্য [ধারা ১২]। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এ বিষয়ের দিকেও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মনোযোগ দিতে হবে।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ চাই

সম্পাদকীয়

নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা


ডিসেম্বর শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচনী মাসে প্রবেশ করল। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন। শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা ধরনের সহিংস ঘটনার খবর আসছে। যেমন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত, নেত্রকোনায় জেলা কৃষক লীগের এক নেতা খুন, যশোরের বেনাপোলে আওয়ামী লীগের নেতা আমিরুল ইসলাম খুন, খুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ, শেরপুরে বিএনপির অফিসে ভাঙচুর ইত্যাদি। এ ছাড়া স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনসহ আরও নানা ধরনের অপরাধ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটেছে।

নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক বিরোধের কারণে খুনোখুনিসহ নানা ধরনের সহিংস ঘটনা বেড়ে যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ যদি পক্ষপাতহীনভাবে পেশাগত দায়িত্ববোধ থেকে এগুলো দমনে সচেষ্ট না হয়, ক্ষমতাসীন পক্ষ যদি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছাড় পায়, তাহলে এ পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। কারণ, আইন প্রয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর মধ্যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরস্পরকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জোরালো হতে পারে। তাই নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের সহিংস ঘটনা দ্রুত তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করাসহ আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে, দলনির্বিশেষে নির্বাচনের সব প্রার্থী ও তাঁদের কর্মী–সমর্থকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাত কিংবা নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নেই। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অন্যতম মৌলিক দিক এই যে সবার জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করা হবে। অর্থাৎ আইনের শাসনের মৌলিক নীতি থেকে সরে যাওয়া চলবে না।

একটি উদ্বেগের বিষয় হলো, কোনো দেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়, যখন রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যায়, তখন রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন পেশাদার অপরাধীরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। সহিংস অপরাধ সংঘটনে তাদের ব্যবহার করা অপেক্ষাকৃত সহজ হতে পারে; অর্থের বিনিময়ে তারা রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তা ছাড়া, তারা তাদের দৈনন্দিন অপরাধবৃত্তিতেও বাড়তি উৎসাহ–উদ্দীপনা বোধ করতে পারে।

নির্বাচনী সহিংসতার আড়ালে খুনখারাবিসহ গুরুতর অপরাধ করে পার পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ—এই ধারণা থেকে পেশাদার অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব সার্বিক নির্বাচনী পরিবেশেও পড়বে। তাই নির্বাচনকেন্দ্রিক সব ধরনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রয়াস সব মহলেই থাকা একান্ত জরুরি। সে জন্য বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ভাবনা যদি কারও মনে থেকে থাকে, তবে প্রথমেই তা পরিত্যাগ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, যেকোনো সহিংস ঘটনা ঘটামাত্র তার আইনি প্রতিকারের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তৎপর হতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিচালিত হয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের দ্বারা, নির্বাচনকালে একটি দলীয় সরকার দেশ পরিচালনা করছে, এ অবস্থায় আইন প্রয়োগকারীদের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা করা কতটা বাস্তবসম্মত—এমন হতাশাবাদী প্রশ্ন না তুলে আমরা সরকারকে বলব, আইনকে তার নিজস্ব পথে চলতে দিতে হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত সব অপরাধের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে, এ ক্ষেত্রে সরকারের বাধা দেওয়া নয়, বরং সহযোগিতা করাই সাংবিধানিক দায়িত্ব।

নির্বাচন কমিশন, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবার আন্তরিক সহযোগিতায় নির্বাচনকালে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল থাকবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

ভোটার নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন?

গোলাম মোর্তোজা

সংসদে যাওয়ার যে পথ, সেই পথের চাবি কার হাতে? টকশোর উপস্থাপকের এ প্রশ্নের উত্তর ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে দিতে হয়নি। সরল উত্তর ‘জনগণ’। জাতীয় সংসদের এবারের নির্বাচনটি একাদশতম। ১৯৯০ সালের পরের চারটি এবং ৭৩’র (কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও) নির্বাচন, অর্থাৎ পাঁচটি নির্বাচন ছাড়া ‘জনগণের চাবি’র তোয়াক্কা করা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে এই পাঁচটি নির্বাচনে জনগণের ভোট নিয়ে সংসদ সদস্যরা সংসদে পৌঁছে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের ৭৯’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ৩৯টি আসন দেওয়া হয়েছিল। বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো আরও অনেক আসনে। এরশাদের ৮৬’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আসন দেওয়া হয়েছিল ৭৬টি। আরও শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগ যখন বিজয়ের পথে, তখন ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল টেবিলে।

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮’র নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ অভিযোগ তুললেও তা গুরুত্ব পায়নি। কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও এই নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে এমন নির্বাচনকেই বোঝানো হয়। ‘অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়’-এমন কথা বলার পর, সিইসির আর পদে থাকার যৌক্তিকতা থাকার কথা নয়। ‘শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন পৃথিবীর কোথাও হয় না, বাংলাদেশেও হবে না’-এমন বক্তব্য দেওয়ার পর পদ ছাড়তে না পারাটাও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জন্যে সম্মানজনক নয়।

প্রথমত: ‘শতভাগ সুষ্ঠু’- এমন ইউটোপিয়ান কোনো নির্বাচন বাংলাদেশের কেউ-ই প্রত্যাশা করছেন না।

দ্বিতীয়ত: ইউরোপের অনেক দেশ আছে, সেসব দেশে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে কোনো অভিযোগ পরাজিত পক্ষ তোলেন না। প্রশ্ন আসে তাহলে সেগুলো কতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন? ফলে ‘শতভাগ’ শব্দটি আমদানির ক্ষেত্রে কোনো সৎ উদ্দেশ্য আছে, তা বিশ্বাস করা যায় না।

২.
কোনো ইউটোপিয়ান জগত নিয়ে নয়, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছি। এই নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট দিতে পারবেন কিনা? নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অধিকার ফিরে পাবেন কিনা? তর্ক তোলা যেতেই পারে, তাহলে কী এখন মানুষের ভোটের অধিকার নেই? বিগত সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর (নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর বাদে) বিবেচনায় এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হওয়ার সুযোগ নেই। আসন্ন নির্বাচনে ‘হ্যাঁ’ হওয়াটা প্রত্যাশিত। তার জন্যে কিছু কাজ করার আছে নির্বাচন কমিশনের।

প্রথমেই আসে সবার জন্যে ‘সমান সুযোগ’ তৈরির বিষয়। একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-এমপিরা পদে বহাল, এমন বাস্তবতায় সবার জন্যে সমান সুযোগ একটি ইউটোপিয়ান প্রত্যাশা। অর্থাৎ, সবার জন্যে সমান সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা আছে, এমনটা ভাবার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী আচরণবিধিতে কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলেছিলেন সিইসি। কিন্তু, পরে আর তেমন কিছু করেনি।

প্রশাসনে রদবদল করার দাবি তোলা হয়েছে, পরবর্তীতে ৯২ জনের একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনে দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই দাবি জোরালোভাবে সামনে আনা হচ্ছে কেন? জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপি, তারা কয়েকবার ক্ষমতায় ছিল। তারা খুব ভালো করে জানে যে, ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচনের আগে কীভাবে প্রশাসনে নিজ মতাদর্শের লোকজনদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে রাখা হয়। কারণ কাজটি বিএনপিও করেছিলো।

অতীতে দেখা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন প্রশাসনে কিছু রদবদল করে। বলা যায়, এটা নির্বাচন কমিশনের প্রায় নিয়মিত কাজেরই অংশ। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন কিছুটা আস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এবার নির্বাচন কমিশন নির্দেশনা দেওয়ার জন্যে যখন পুলিশসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ডেকে কথা বলেছেন, সেখানে রদবদলের প্রসঙ্গটি এসেছিলো। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘বদলির চিন্তা’ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা যায় না। নির্বাচনের আগে যেন বদলি করা না হয়। যদিও একথা কারোরই অজানা নয় যে, সরকারি চাকরিতে বদলি খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। বদলির সঙ্গে স্বাভাবিক কাজ করতে পারা বা না পারার সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

নির্বাচন কমিশন কথা দিয়েছে, বদলি করা হবে না। বিরোধীদলের প্রথম দাবির বিষয়ে ইসি বলেছিলো ‘ঢালাও অভিযোগ’ বিবেচনায় নেওয়া হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে বিবেচনা করে দেখা হবে। সুনির্দিষ্ট তালিকা দেওয়ার পর ইসি বলেছে, বিরোধীদলের বদলির দাবি বিবেচনায় নেওয়া হবে না। ইসি তদন্ত করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বলেনি।

ইসি বলেছে, পুলিশ তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলছে।

দেখা যাচ্ছে ‘গায়েবি’ মামলাতেও গ্রেপ্তার চলছে। সিইসির বক্তব্য অনুযায়ী, ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী-ই তা চলছে?

‘নাশকতার’ বা রাষ্ট্রীয় কাজে ‘বাধা দেওয়ার’ অভিযোগের মামলায় অন্য অনেকের জামিন হলেও, সম্ভাব্য প্রার্থীর জামিন হচ্ছে না। একই রকম ঘটনায় আদালতের দুই রকমের নির্দেশনায় জনমানুষ বিভ্রান্ত। ‘গায়েবি’ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও, মুক্তি মিলছে না। অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। পুরনো এবং ‘গায়েবি’ মামলায় বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকবে না- তা বলা যাচ্ছে না। এসব মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ হাজার হাজার আসামী থাকায়, যে কাউকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ থাকবে। সব কিছুই নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে পুলিশকে কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বা হবে, তার উপর। আর সত্যি যদি এখনকার পুলিশি কর্মকাণ্ড ইসির নির্দেশনাতেই চলছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে ‘সমান সুযোগ’ বিষয়টি কল্পনার চেয়েও বহু দূরে অবস্থান করতে পারে।

৩.
নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে, রাজনীতিতে অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ ততো জোরালো হবে।

সরকার-পক্ষ উন্নয়নের প্রচারাভিযান আরও জোরদার করবে। পদ্মাসেতু, বিদ্যুৎ, মাথাপিছু আয় বেড়ে দ্বিগুণ- প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নশীল দেশ, রাস্তা, ফ্লাইওভার, নির্মাণাধীন মেট্রোরেল সাফল্যের সঙ্গে গ্রেনেড হামলা, পেট্রোল বোমা সহিংসতার কথাও বলা হবে।

বিরোধী-পক্ষ তুলে ধরবে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে সবচেয়ে নিম্নমানের অবকাঠামো নির্মাণের চিত্র।

দমন-নিপীড়ন, ব্যাংকসহ আর্থিকখাত কেলেঙ্কারি, টাকা পাচার, রিজার্ভ চুরি, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় দুর্নীতি, রেন্টাল-কুইক রেন্টালে দলীয় লোকদের দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া, চালসহ দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ কালাকানুন, গুম-খুন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের হাতুড়ি পেটা-গ্রেপ্তার-জেল-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র সামনে আনবে।

দুই পক্ষ তাদের সুবিধা বিবেচনায় যেভাবেই বিষয়গুলো সামনে আনুক না কেন, ভোটারদের প্রভাবিত কতটা করা যাবে? খুব একটা করা নাও যেতে পারে। কারণ সরকার বা রাজনীতিবিদরা যে কথা যেভাবেই উপস্থাপন করুক না কেন, সবই ভোটাররা দেখেছেন-জেনেছেন-বুঝেছেন। ভোটারদের মনের আনন্দ-বেদনা, স্বস্তি বা ক্ষোভেরই প্রকাশ দেখা যেতে পারে, যদি সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশে ভোটাররা ভোট দিতে পারেন।

৪.
ব্রিটেনের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্স বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে ‘সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি বা লেভেল প্লেইং ফিল্ড’র ধারে-কাছেও নেই, এবং বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন চলছেই’।

মার্কিন কংগ্রেস বলছে, স্থিতিশীলতার জন্যে হুমকি জামায়াত-শিবির এবং হেফাজত। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আগে থেকেই ছিল, হেফাজত নতুন যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। এক্ষেত্রে এক ধরণের ‘সমান অবস্থা’ তৈরি হওয়ায়, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের সুযোগ কমে গেছে।

প্রার্থীরা মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় ফিরে যাবেন। দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করবে। কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত সহযোগী হিসেবে যোগ দিবে। প্রশাসন নিরপেক্ষ বা কোন পক্ষ নিবে? নির্বাচন কমিশনের ‘সব ঠিক আছে’ ভূমিকার পরিবর্তন হবে কিনা?

ধারণা করা খুব কঠিন নয়, আঁচ করা যায় কেমন থাকবে সামগ্রিক মাঠের পরিস্থিতি।

নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষকদের ‘মূর্তি’র রূপ ধারণ করতে বলে দিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, এক কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা যাবে না। কেন্দ্রের ভেতরে তো অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবেই না। যাবে না সরাসরি সম্প্রচার করাও।

বিগত নির্বাচন কমিশন সংবাদকর্মীদের এসব করার সুযোগ দিয়ে বিপদে পড়েছিলো। ইসি দেখাতে চেয়েছিল ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়েছিলেন। সংবাদকর্মীরা এক কেন্দ্রে ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন অবস্থান করে যে চিত্র দেখিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ইসির বক্তব্যের মিল ছিল না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আগে থেকে সজাগ হওয়ার বিষয়টি, অনেক রকমের আশঙ্কা তৈরি করছে।

৫.
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশনের কাছে। সেই ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান দিয়েছে। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের নৈতিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ। সাহস এবং উদ্যোগেও ঘাটতি আছে। ফলে সরকার আন্তরিকভাবে না চাইলে, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে, বিশ্বাস করা কঠিন।

নির্বাচনী ইশতেহার লেখার কাজ চলছে। অনেক ভালো ভালো আশা জাগানো কথা থাকবে ইশতেহারে। কতটা বাস্তবায়ন হলো, সেসব নিয়ে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে। যে জনগণ বা ভোটারদের উদ্দেশে লেখা হচ্ছে ইশতেহার, সেই ভোটারদের প্রথম অধিকার হলো সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারার অধিকার।

সেই ভোটাররা সুষ্ঠু পরিবেশে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারবেন তো?

মানুষের ভোটের অধিকারের কথা কতটা গুরুত্ব পাবে ইশতেহারে? ভোটার নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন? ইশতেহার কী তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে?

  • Courtesy: The Daily Star /Bangla online/ Dec 02, 2018

Critical points raised by House of Commons

EDITORIAL

Serious questions on elections need answers

The report presented in the UK House of Commons recently had a lot to say about the “level playing field” that our Election Commission (EC) keeps touting. Given the way we have treated reports published abroad in the past, the ruling party will surely claim it is a conspiracy, while the party in opposition will hail it as the truth. Our position is that it has a lot of merit.

What we gather from the “research briefing” is that the harassment of political opponents is ongoing in Bangladesh. While the ruling alliance is free to break EC rules, the opposition is finding more and more of its electoral candidates in jail, with cases against some, not to talk about ordinary party activists. There is a massive dearth of trust between the government and the opposition parties about whether the December 30 polls will be free, fair and inclusive.

That questions have been raised about the jail term of former PM and leader of the biggest opposition party Khaleda Zia being extended to 10 years from five as being a ploy to keep her from participating in the election is not going to find favour with the ruling party. The brief goes on to raise alarm about human rights violations in the country, with emphasis on the misuse of criminal charges, unlawful killings and the culture of enforced disappearances. Even more alarming is that the threat of jihadist terrorism is apparently far from being extinguished.

This paper has repeatedly highlighted the dangers of the vacuum created by an opposition-less political arena and how that space is increasingly being filled up by fringe parties espousing religious extremism. It would be wise to take heed of this very real threat and strive towards an inclusive election so that politics in our country remains within the grasp of legitimate parties who answer to the people. At the risk of repetition, we say that in making the election credible and participatory, the ruling party's role and responsibility are far greater than others', save perhaps only that of the EC.

  • Courtesy: The Daily Star/ Dec 02, 2018

Moody's sounds alarm on Bangladeshi banks

US ratings agency gives negative outlook


Global credit ratings giant Moody's put Bangladesh's banking system on 'negative watch' despite the country's robust economy, as pressure mounts on the Bangladesh Bank and the government to take drastic actions to fix the sector.

The reason for the negative outlook is the worsening asset quality, said Tengfu Li, a Moody's analyst.

Underlying weaknesses in corporate governance, especially at state-owned banks, has led to nonperforming loan ratios rising to 10.4 percent as of June.

And the growing stock of unclassified rescheduled loans poses further risk to asset quality, said the report 'Banking System Outlook - Bangladeshi banks: High asset risks drive negative outlook despite robust economy'.

At the end of June, the state banks' total NPL stood at 28.24 percent, according to data from the Bangladesh Bank.

In fact, of the total Tk 89,340 crore of NPL of the banking sector, the state banks accounted for Tk 42,852 crore.

The outlook expresses Moody's expectation of how bank creditworthiness will evolve in this system over the next 12 to 18 months.

Moody's outlook is based on six key drivers. Specifically, Moody's assesses the banks' operating environment as stable; asset risk as deteriorating; capital as deteriorating; profitability and efficiency as deteriorating; funding and liquidity as stable; and government support as stable.

Credit costs will increase in tandem with the deterioration in asset quality, said the report, which was unveiled on November 29. Such a situation will lead to an erosion of the banks' profitability, especially when the expansion of net interest margins will also be limited under regulatory pressure.

Capitalisation will moderate because of weaker capital generation despite earnings retention by the private sector banks to meet the higher capital requirements beginning in 2019.

State-owned banks will remain undercapitalised and dependent on capital infusions from the government, the report said.

Banks in Bangladesh though will continue to maintain adequate funding and liquidity.

While financial conditions tightened during the first half of 2018, the situation has stabilised after monetary easing measures were implemented.

The lowering of the ceiling for bank's loan-deposit ratio from March next year will further mitigate funding risks, the report said.

Moody's expects the Bangladesh government to remain supportive of the banking system, given the government's track record of taking pre-emptive measures against banking failures.

“The government also has the capacity -- as reflected in the country's modest general and external debt burden -- to support the banks in times of need.”

In its last credit outlook in March, Moody's gave Bangladesh a stable rating of Ba3, as in the past several years.

  • Courtesy: The Daily Star/ Dec 02, 2018 

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর ঝুঁকিতে — মুডি’স ইনভেস্টর্স সার্ভিসের রিপোর্ট

খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ভবিষ্যৎ অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি-মুডিস। প্রতিষ্ঠানটি বৃহস্পতিবার (২৯ নভেম্বর) তাদের ‘ব্যাংকিং সিস্টেম আউটলুক-বাংলাদেশি ব্যাংকস’ শীর্ষক রিপোর্টে বলেছে, ‘দেশটির অর্থনীতি অনেক ভালো হলেও ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক।’

মুডি’স-এর বিশ্লেষক টেংফু লি বলেন, ‘বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক তৈরি গার্মেন্ট শিল্পের কারণে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া ও রেমিট্যান্সের হার ফের বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় ভোগ/ব্যয়ে সহায়ক হবে।’ তিনি বলেন, ‘তবে বেশ খণ্ড-বিখণ্ডিত ব্যাংকিং খাতে ‘অ্যাসেট কোয়ালিটি’ বা ঋণের মান অবনতিশীল। কর্পোরেট গভর্ন্যান্সে অন্তর্নিহিত দুর্বলতার (বিশেষ করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহে) কারণে খেলাপি ঋণের অনুপাত এ বছরের জুন নাগাদ ১০.৪ শতাংশে পৌঁছেছে। অশ্রেণিভুক্ত পুনঃতফশিলকৃত ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় তা ‘অ্যাসেট কোয়ালিটি’র ওপর আরো ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।’

মুডি’স-এর এই বিশ্লেষণ সংস্থাটির ‘ব্যাংকিং সিস্টেম আউটলুক- বাংলাদেশি ব্যাংকস: হাই অ্যাসেট রিস্কস ড্রাইভ নেগেটিভ আউটলুক ডিসপাইট রোবাস্ট ইকোনমি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

মুডি’স-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পূর্বাভাস মূলত ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। নির্দিষ্ট করে বললে, মুডি’স বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহের পরিচালনা পরিবেশকে স্থিতিশীল, বিনিয়োগ ঝুঁকিকে অবনতিশীল, পুঁজি অবনতিশীল, মুনাফা অর্জন ও কার্যক্ষমতা অবনতিশীল, অর্থায়ন ও তারল্য স্থিতিশীল এবং সরকারি সহায়তাকে স্থিতিশীল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, অ্যাসেট কোয়ালিটির অবনতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের ব্যয় (ক্রেডিট কস্ট) বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর লাভ করার সক্ষমতা হ্রাস করবে, বিশেষ করে যখন সুদ থেকে প্রাপ্ত আয়ও সীমিত থাকবে।

পুঁজি তৈরির হার দুর্বলতর হওয়ায়, লাভকে পুঁজিতে রূপান্তরের হারও কমবে, যদিও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো আগামী বছর পুঁজি বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা পূরণে আয় ধরে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর পুঁজি আগের মতোই অপর্যাপ্ত থাকবে। সরকারের পুঁজি-প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল থাকবে।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে অবশ্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও তারল্য থাকবে। ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে আর্থিক পরিস্থিতি চাপের মধ্যে পড়লেও, অর্থ সংক্রান্ত কড়া নিয়মনীতি সহজ করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হওয়ায় এখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়েছে। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে অগ্রিম অর্থ জমা রাখার অনুপাত সীমিত হওয়ায় (যা ২০১৯ সালের মার্চ থেকে কার্যকর হবে) অর্থায়নের ঝুঁকি আরো হ্রাস পাবে।

মুডি’স ধারণা করছে, বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকিং সিস্টেমের প্রতি আগের মতোই সহায়ক থাকবে। ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সমস্যা হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার রেকর্ড রয়েছে সরকারের। এমনকি প্রয়োজনের সময় ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেয়ার সামর্থ্য সরকারের রয়েছে, যেটা দেশটির তুলনামূলক কম সাধারণ ও বৈদেশিক ঋণের ভার দেখে বোঝা যায়। 
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/  ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

অন্য কেউ ভোট দিয়ে দিলেও আসল ভোটার ভোট দিতে পারবেন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজনের ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেলেও আসল ভোটার তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা যদি এ ধরনের অভিযোগে আসল ভোটারকে চিহ্নিত করতে পারেন তাহলে ভোটারকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দিতে হবে। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জাস্ট অ্যালাউ হিম উইদআউট এনি কোয়েশ্চেন’। 

গতকাল শনিবার নির্বাচন কমিশন ভবনে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে অনেক সময়   দেখতে পাই ভোটার এসে অভিযোগ করে তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। নির্বাচনী কর্মকর্তারা যদি ঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলে এরকম হওয়ার কথা নয়। একজনের ভোট আরেকজনে দিতে পারার কথা নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আইনে এরপরও আসল ভোটারের ভোট দেয়ার বিধান আছে।

প্রিজাইডিং কর্মকর্তা যদি সন্তুষ্ট হন যে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিই সত্যিকার ভোটার, তার ভোটটা অন্য কেউ দিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তিনি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। প্রয়োজনে কর্মকর্তারা আইনটাকে ফলো করবেন। তাহলেই আর কেউ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবে না।

তবে ভোটকেন্দ্রে প্রকাশ্যে কেউ ব্যালটে সিল মারতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। জনসম্মুখে ভোট দেয়াকে বেআইনি উল্লেখ করে কর্মকর্তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। 

নির্বাচন কমিশনার জানান, অনেক ভোটার বলতে পারেন আমার ভোট আমি প্রকাশ্যে দিয়েছি এতে অসুবিধা কোথায়? যেহেতু আইনে এটা পারমিট করে না, কর্মকর্তারাও অ্যালাউ করবেন না। প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের প্রতিও নির্দেশনা থাকবে, প্লিজ ডোন্ট অ্যালাউ ইট। ভোট দেয়ার এমন প্রক্রিয়া বেআইনি ও এ ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।  

মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের নির্বাচনের আসল কাণ্ডারি উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন করেন আপনারা, ইলেকশনের পরিকল্পনা করে কমিশন ও সচিবালয়। আপনাদের কাছেই আমাদের সবকিছু, মান, সম্মান-ইজ্জত ন্যস্ত। আপনাদের ভূমিকার ওপরই নির্ভর করবে কমিশনের ইমেজ কেমন হবে? নির্বাচনী কর্মকর্তারা ব্যর্থ হলে কমিশনকে বলা হবে অপদার্থ, অথর্ব ও মেরুদণ্ডহীন কমিশন। তিনি বলেন, নির্বাচন মানেই কিন্তু একদিন। সূচিতে ৪৬-৪৫ দিন যাই থাকুক না কেন নির্বাচন মানে একদিন, ভোটের দিন। নির্বাচনের দিন কি হলো তার ওপরই নির্ভর করবে কমিশনের সফলতা-ব্যর্থতা। ভোটের দিন যদি আইনানুগ কাজ না হয়, তাহলে পরে কিন্তু আমরা সবাই প্রশ্নবিদ্ধ হবো। 

তিনি আরো বলেন, পত্রিকা খুললেই একটাই কথা, সবার  ভেতরেই শঙ্কা ভোট দিতে পারবেন কিনা? ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কিনা? কর্মকর্তারা যদি ব্যালটটাকে ঠিকমতো সংরক্ষণ করেন, কেন্দ্রটাকে ঠিকমতো তৈরি করেন, সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করেন তাহলে এরকম ভাবনা হওয়ার কথা নয়। আপনারা যদি কাউকে জোর করে বের করে না দিয়ে এজেন্টদের ঠিকমতো রাখেন তাহলে কোনোভাবেই একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারবে না। কোনো ভোটারকে চিহ্নিত না করা পর্যন্ত তাকে ব্যালট পেপার দেয়া যাবে না। এসব নিশ্চিত করতে পারলেই কোনোভাবে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে কিনা- ভোটারদের এমন শঙ্কা আপনাদের দেখার বিষয় নয়। রফিকুল ইসলাম বলেন, ভোটার কেন্দ্রে আসলে তার ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা আপনাদের কাজ। ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে আসার পরিবেশ তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করবেন। এরপরও কোনো অঘটন ঘটলে কমিশন সেখানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে। 

নির্বাচনী সরঞ্জাম ঠিকভাবে বুঝে নিতে এবং ভোটের পর যথাসময়ে ফেরত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দেন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাবার পর তার দেখভাল করা কর্মকর্তাদেরই দায়িত্ব উল্লেখ করে প্রয়োজনে ভোটের আগের রাতে নিজ সন্তানের মতো এসব পাহারা দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের সিদ্ধান্তই সব। 

তিনি ভোটগ্রহণে যে সিদ্ধান্তই নেবেন সবাইকে তা মেনে চলতে হবে। নির্বাচনের আগে যেকোনো ধরনের অনিয়ম ঠেকাতে সারা দেশে নির্বাচনী তদন্ত কর্মকর্তা কমিটি করা হয়েছে। এসব কমিটির সদস্য ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রায় সাত লাখ নির্বাচনী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন বলেও জানান তিনি। কর্মশালায় আরো বক্তব্য দেন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান ও নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক। নয়টি জেলা থেকে আসা প্রায় চারশ’ কর্মকর্তা এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন।   

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/  ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

বেড়াতে গেছে আচরণবিধি

শাহদীন মালিক

হাইকোর্টে দু-তিনজন নিয়মিত বই বিক্রেতা আছেন। প্রায় সপ্তাহে একবার আইনের নতুন বই নিয়ে আইনজীবীদের রুমে রুমে যান। ‘স্যার, বইটা গতকালই বেরিয়েছে। দাম ছয় শ টাকা, কিন্তু আপনার জন্য চার শ টাকা।’ দুই শ টাকা বাঁচানোর আনন্দে কিনে ফেলি। তাঁদের বদৌলতে আইনি বইয়ের খোঁজে দোকানে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। দু-চার শ টাকার বই হলে সহজেই কিনে ফেলি। আর দাম যদি হাঁকে দশ হাজার টাকা, তখন ঢোঁক গিলে আমতা-আমতা করে বলি, দুই সপ্তাহ পরে এসো। বলা তো যায় না, এই দুই সপ্তাহে বড় মক্কেল পেয়েও যেতে পারি।

নির্বাচন কমিশনের ছাপানো ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল’-এর দুইটা কপি কিনে ফেলেছি গত সপ্তাহে। বইটিতে দাম লেখা নেই। ধরে নিচ্ছি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট হরেক ধরনের কর্মচারী, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, এজেন্টসহ সবারই কাজে লাগবে। কিছু কপি নিশ্চয়ই বিলি করা হবে বিনে পয়সায়। এই সময়ের জন্য ম্যানুয়েলের ২৭৮-২৮৮ পৃষ্ঠায় ছাপানো ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এক অর্থে সাদামাটা বিধিমালা। নির্বাচনের আগে অর্থাৎ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগের দিন। অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দল, মনোনয়নপ্রত্যাশী, প্রার্থী, সমর্থক এবং অন্যান্য ব্যক্তি কে কী করতে পারবেন বা পারবেন না, তার বেশ বিস্তারিত বৃত্তান্ত আছে এই বিধিমালার মোট ১৯টি বিধিতে। কিছু ফিরিস্তি অনেকেরই জানা হয়ে গেছে।

উক্ত বিধিমালার ৮ বিধি অনুযায়ী কোনো প্রকার ট্রাক, বাস কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে কোনোরূপ শোডাউন করা যাবে না এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও সকল প্রকার মিছিল বা শোডাউন করা নিষেধ। বিধি ১২তে বলা আছে, ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের শুধু তিন সপ্তাহ আগে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করা যাবে। অর্থাৎ আজ ১ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল প্রকার নির্বাচনী প্রচারণা চালানো নিষেধ। কিন্তু পত্রপত্রিকায় খবর দেখছি, কিছু কিছু জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে শোডাউন করা হয়েছে, কোথাও কোথাও জোরেশেরে নির্বাচনী প্রচারণামূলক কাজ শুরু হয়ে গেছে। যেমন প্রথম আলো ৩০ নভেম্বরের কাগজে ৫ পৃষ্ঠায় একটা খবরের শিরোনাম হলো ‘সাংসদ এনামুলের আচরণে বিধি মানার লক্ষণ নেই’।

অন্যদিকে এই খবরও দেখলাম যে বিধিমালার কোনো লঙ্ঘনই সিইসির নজরে আসেনি। তাই ভাবছি, নির্বাচনী আচরণ বিধিমালাটা দেশের বাইরে বেড়াতে চলে গেছে কি না। বিধিমালা বেড়াতে গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন লাটে উঠতে পারে। এখন থেকেই এই আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন কঠিনভাবে দমন না করলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই বাড়তে থাকবে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশন এখন থেকেই কঠোর না হলে ১০ দিন পরে অনেক দেরি হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা এবং বহু মানুষ নিহত ও আহত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অনেক বড় বড় নেতা অনেকবার।

এই বিধিমালা লঙ্ঘনে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিধি ১৭(৪) এ ‘নির্বাচনী তদন্ত কমিটি’ গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ভালো ব্যাপার হলো, নির্বাচন কমিশন ২৫ নভেম্বর একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সারা দেশে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, সহকারী জজ ইত্যাদি) সমন্বয়ে মোট ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি কমিটির এখতিয়ারভুক্ত এলাকাও এই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই নির্বাচনী তদন্ত কমিটির তালিকা শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ মোটেও যথেষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনকে পত্রপত্রিকায় ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে জানাতে হবে। দরকার হলে কুমিল্লা জেলার নির্বাচন তদন্ত কমিটির নাম-ঠিকানা কুমিল্লার সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন দিতে হবে। অর্থাৎ জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে সবাইকে জানাতে হবে, যাতে আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি জানতে পারেন, তিনি অভিযোগ নিয়ে কোথায় যাবেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯১ক ধারায় বলা আছে যে নির্বাচনী তদন্ত কমিটিকে তদন্ত শেষ করতে হবে তিন দিনের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত নির্বাচন ম্যানুয়েলটি ভালো হয়েছে। অবিলম্বে অন্তত ১০টি কপি দেশের ৬৪টি জেলার বার লাইব্রেরিতে পাঠাতে হবে।

মোদ্দাকথা, নির্বাচন কমিশন চোখ-কান বন্ধ রেখে আচরণ বিধিমালাকে এখন বেড়াতে পাঠিয়ে দিলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিধিমালা, নির্বাচনী তদন্ত কমিটি আনুষঙ্গিক ব্যাপারে প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা আজ থেকেই নিতে হবে। এর দায়িত্ব শুধু এবং একমাত্র নির্বাচন কমিশনের ওপর।

  • ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিন

সম্পাদকীয়

সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত নির্ভয় ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। আগে যা–ই ঘটুক না কেন, তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মী–সমর্থকদের আচরণ সংযত হবে, কাউকে ভয়ভীতির মধ্যে থাকতে হবে না, সেটাই প্রত্যাশা ছিল। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও সে রকম আওয়াজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর বেশ কিছু দিন চলে গেলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি যে খুব বদলায়নি, সেটাই জানা গেল সংবাদমাধ্যমের খবরে। বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখনো দ্বিমুখী আক্রমণের শিকার। একদিকে গায়েবি মামলার কারণে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা এখনো তাঁদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, হুমকি দিয়ে চলেছেন। 

বরিশালের গৌরনদীতে পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. হান্নান শরীফ ভয়ভীতির কারণে বাড়িতে থাকছেন না। এ অবস্থায় গত বুধবার রাতে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে তাঁর খোঁজ করেন। যখন তাঁরা জানতে পারেন তিনি বাড়িতে নেই , তখন তাঁরা হুমকি দেন যে ৩০ ডিসেম্বরের আগে যেন বাড়ি না ফেরেন। একই ঘটনা ঘটেছে উপজেলা যুবদল সভাপতি স্বপন শরীফের বাড়িতেও। এ ব্যাপারে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা সাফাই গাইতে গিয়ে যা বলেছেন, তা হাস্যকর। তাঁদের দাবি, বিএনপি ইস্যু তৈরি করার জন্যই এই কাণ্ড করে থাকতে পারে। যেখানে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেখানে এলাকায় না গিয়ে তারা ইস্যু তৈরি করবে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। আর পুলিশও অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে দায় এড়িয়ে গেছে। 

এর আগে গৌরনদী পৌরসভার মেয়র হুমকি দিয়েছিলেন যে বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন এলাকায় এলে তাঁকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হবে। স্বপন এখনো নিজের এলাকায় যেতে পারেননি। তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বরিশাল শহরে। প্রথম আলোয় এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মেয়র পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে খবরের প্রতিবাদ করলেও প্রতিবেদনের কোথায় ভুল তথ্য আছে, তা দেখাতে পারেননি। তাঁর এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ রকম ভয়ভীতি বা হুমকির ঘটনা শুধু এই দুটি উপজেলায় ঘটেছে, তা নয়। আরও অনেক স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি গায়েবি মামলা, পুরোনো নাশকতার মামলায় বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারের পর জামিন নেওয়ার জন্য তঁাদের স্বজনদের আদালত চত্বরে ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। আবার মামলায় জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় বিএনপির একাধিক প্রার্থীকে কারাগারেও যেতে হয়েছে।

এ অবস্থায় কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায়? প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা তফসিল ঘোষণার পর সবকিছুই নাকি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করেছেন। এটাই কি নিয়ন্ত্রণের নমুনা?

নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু এসব ঘটনায় তার উল্টো চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছেন। এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিরোধী দলের প্রার্থীদের যাতে মামলা ও হামলার ভয়ে পালিয়ে না থাকতে হয় কিংবা ক্ষমতাসীন দলের কেউ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে আসতে না পারেন, এটা নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশন মুখেই শুধু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে। বাস্তবে কিছুই করছে না। এই নিষ্ক্রিয়তা ও নিস্পৃহতার  সংস্কৃতি থেকে নির্বাচন কমিশন বেরিয়ে আসতে না পারলে, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং এসব অন্যায় আচরণ বন্ধ হোক।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

Saturday, December 1, 2018

ক্যাঙ্গারু কোর্ট ও নতজানু নির্বাচন কমিশন

তৈমূর আলম খন্দকার


১/১১ সরকার, এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না এবং এখনো নাই। (তবে মাননীয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎসময়ে বলেছিলেন যে, ১/১১ সরকারের অবৈধ সরকারের সব কর্মকাণ্ডের তিনি বৈধতা দেবেন ক্ষমতা এসে) ওই অবৈধ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী (যিনি ঠুনকো মামলায় বর্তমানে কারারুদ্ধ) গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাঘা নেতা যারা ১/১১ সরকারের কাছে তখনো নতজানু হননি, তাদের গ্রেফতার করে সংসদ ভবনে কোর্ট বসিয়ে বিচারনামক প্রহসন করা হয়। তখন দুই প্রধানমন্ত্রীকেই কোর্টে সে হাজির করা হতো বিচারের জন্য। তখন ওবায়দুল কাদের এবং আমি নিজেসহ রাজনীতির মাঠে বিদ্যমান অনেকেই কারাগারে একত্রে ছিলাম, একজনের বাড়ির খাবার আরেকজন খেয়ে অনেক তৃপ্তি পেতাম। খোশগল্প এবং কার বিরুদ্ধে কী মামলা তৈরি হচ্ছে, এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। ওবায়দুল কাদের ও আমি এক সাথেই ছিলাম। তখন দেখেছি কার কতটুকু সাহস, কে কতটুকু হিম্মত নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন।

তখন জাতীয় সংসদ ভবনে অবস্থিত আদালতকে আওয়ামী লীগ প্রধান ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে সম্বোধন করতেন এবং সেই কোর্টের রায় দিয়েই প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এখন ঘায়েল করছেন। আদালতে গিয়েও ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ কোনো আশ্রয় পাচ্ছে না। মনে করা যায়, সেখানেও সরকারের ইশারা-ইঙ্গিতের বাইরে কিছুই হচ্ছে না। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের মতের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার চার দিন পরে উগান্ডার প্রধান বিচারপতির লাশ ড্রেনে পাওয়া গিয়েছিল। একটি রায় পছন্দ মতো না হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভাগ্যে কী জুটেছে তা ইতিহাসের পাতায় খুঁজতে হবে না, বরং সম্প্রতি চোখের সামনেই ঘটেছে। বিচারপতি সিনহার ভাষ্যমতে, তাকে লাথি মেরে বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা হয়েছে।

অথচ তিনি ছিলেন সরকারি ঘরানার একজন পৃষ্ঠপোষক। তার কথায় ও আচরণে প্রধানমন্ত্রীর একজন ভাবশিষ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। বিদায়ের লগ্নে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষের কারণে তার এই বিদায়ের সুর। আরো আশ্চর্যের বিষয়, যে রায়ে সিনহার কপাল পুড়ল সেই রায়ে আপিল বিভাগের সব বিচারপতিই স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু সিনহা যখন রক্তচক্ষুর আওতায় আসলেন তখন তারা একযোগেই বলে বসলেন যে, সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান সিনহা বাবুর সাথে নৈতিকতার প্রশ্নে আদালতে একত্রে আর বসবেন না। যারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, সমাজ ও জাতির ভাগ্য বিধাতা, তারা অতিসুন্দর বাক্যে মনোভাব প্রকাশ করাই যুক্তিযুক্ত। বিষয়টি যদি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের সমস্যা হিসেবে দেখা দিতো, তারা হয়তো (অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ) এমনিভাবে বলত যে, ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’। দুদকসহ বিভিন্ন মামলায় বিচারপ্রার্থীদের নিজেকে Defend করার সুযোগ সঙ্কুচিত করে দিয়েছিলেন।

র প্রতিদান তিনি পেয়েছেন। কারণ সিনহাকে গলা ধাক্কা দেয়ার প্রতিবাদে তিনি নিজেকে ডিফেন্ড করার ফুরসতই পাননি। বরং পদত্যাগ করে তার দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন। দুদকের মামলাগুলোতে বিরোধীদের তিনি নাজেহাল করেছেন, অথচ দুদকের মামলার ভয়েই তার এই আত্মসমর্পণ। বিচারপতি আবদুল ওহাব মিয়া জীবনভর বিচারপ্রার্থীদের রিলিফ দিয়েছেন, সরকারের তাঁবেদারি করেননি। অনেকে বলে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি থেকে স্থায়ী প্রধান বিচারপতি হওয়ার আশায় তিনি নি¤œ আদালতের বিচারকদের সরকারি আমলাদের কাছে দায়বদ্ধ করে গেছেন। তিনি বিদায়লগ্নে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী আইনজীবীদের কোনো সংবর্ধনা পেলেন না। এই বিচারপতিকে চিনি দীর্ঘ দিন। পেশাগত জীবনে তাকে পেয়েছি একজন সহকর্মী হিসেবে, যাকে একজন আদর্শ ও নীতিবান মানুষ হিসেবে জেনেছি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবে তার ভূমিকাকে শ্রদ্ধা করি। আইনজীবী নেতা শামছুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে জনাব ওহাবের সাথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। বিচারপতি সিনহাকে বিচারপতি ও আইনজীবী হিসেবে পেয়েছি। দুর্নীতি বা সরকারের পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে তুলনামূলকভাবে বিচারপতি ওহাবের মান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে।

যা হোক, সরকারি বিরোধীদের শায়েস্তা করে সিনহা কতটুকু লাভবান হলেন? যার জন্য করা হলো চুরি, তারাই তো তাকে চোর বললেন। অর্থাৎ লাথি তাদের পায়েই খেয়েছেন যাদের স্বার্থ রক্ষায় সিনহা ছিলেন আবেগাপ্লুত। বিচারপতি সিনহা নিজে সাম্প্রদায়িক না অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রীয় খরচে একটি মূর্তি স্থাপন করেছেন, যে মূর্তি পাহারা দেয়ার জন্য দু’জন পুলিশ পালাক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক এই বাংলাদেশে কোনো মূর্তি পাহারা দেয়ার জন্য পুলিশ লাগে না। তা হলে সিনহার মূর্তির জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে পাহারা কেন? যাদের খুশি করার জন্য ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশের সর্বোচ্চ বিচারাঙ্গনে তিনি মূর্তি স্থাপন করেছিলেন তারাও তো তার করুণ বিদায়লগ্নে অশ্রু ঝরাতে এলেন না। এরই নাম কি কর্মফল?

সংবিধান মোতাবেক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনকালে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে বলে নির্বাচন কমিশন বারবার ঘোষণা দিচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত গ্রেফতার বন্ধ থাকবে বলে কমিশন ঘোষণা দিলেও জামিন নেয়ার জন্য আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি ফেরা হয় না। আগাম জামিন নিয়ে বাড়িতে যাওয়া মাত্র আরেকটি মামলা এসে হাজির। আইনি বর্বরতার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কোনো ‘রা’ নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কি মানুষের এ দুর্দশার কথা জানেন না?

বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, উচ্চ আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি না হওয়া কোনো বিষয়কে চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়া যাবে না, এটাই স্বীকৃত আইন। ক্যাঙ্গারু কোর্টের মামলা থেকে প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীরা খালাস পেয়ে গেলেন, অথচ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃক একই আইনে দায়ের করা মামলা চলমান রইল, এ কেমন বিচারের ব্যবস্থা? সার্চ লাইট দিয়ে খোঁজ করে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন সাবেক রাজকর্মচারীকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যেখানে সিনিয়র বিচারপতিরা সে দায়িত্ব পালন করতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। সরকারের চাহিদা/পছন্দমতো নিয়োগকৃত প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার মেরুদণ্ড কতটুকু সোজা রাখতে পারছেন, তা জাতি অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করছে। সব কিছুর পরও, বিচার বিভাগই মানুষের শেষ ভরসা। সে ভরসা থেকে যদি মানুষের মন উঠে যায়, তবে বুক ভরা বেদনাময় নিঃশ্বাস ত্যাগ করার জন্য মানুষের আর জায়গা থাকে না।

ক্যাঙ্গারু আদালত থেকে নির্বিচারে যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, উচ্চ আদালতে সরকারি ঘরানার লোকজন খালাস পেলেও বিরোধীদের ললাট থেকে সেই সিলমোহর মোছা যায়নি। হাইকোর্ট যাদের সাজা স্থগিত করেছে, তারাও নাকি নির্বাচন করতে পারবেন না। যদি তাই হয় তবে সাজা স্থগিত করার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা মোতাবেক সাজা স্থগিত করার জন্য হাইকোর্টের যে রায় রয়েছে, সেই ক্ষমতা খর্ব করার জন্য আইন সংশোধন করতে হবে। হাইকোর্টের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাজা স্থগিত হওয়া ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন না।

বাংলাদেশের আইন এখন দুই ভাবে প্রযোজ্য। নির্বাচন কমিশনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের আইনও এখন দুইভাগে প্রবাহিত হচ্ছে। সরকারি দলের আইন ভঙ্গে যেন কোনো অপরাধ হয় না। আইনকে ব্যবহার করে চলছে নিপীড়ন এবং বিরোধীদের ওপর যে পুলিশ-আমলা যত বেশি নির্যাতন করতে পারবে তার সৌভাগ্য তত বেশি, এটাই এখন নাকি প্রমোশনের যোগ্যতা।

দেশবাসী অবশ্যই বিরোধী দলের ওপর এ নির্যাতনের খোঁজখবর রাখেন। বিষয়টি অবশ্যই সত্য যে, হাইকোর্ট আগাম জামিন দেয় বলেই নির্যাতিত দেশবাসী এখনো কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে পারে। বিচার বিভাগ যদি তাদের বিচারিক সিদ্ধান্তে দু’পক্ষকে (সরকার-বিরোধী দল) সমভাবে দেখেন তবে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুদকের যে মামলায় মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া খালাস পেয়েছেন, একই মামলায় তিনি বিএনপির আমলে মন্ত্রী হলে খালাস পেতেন কি-না তা জনমনে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। বিচার বিভাগ সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা। জনগণের নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ সম্মানিত বিচার বিভাগ করবেন, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

  • লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/নভেম্বর ৩০,২০১৮