গোলাম মোর্তোজা
সংসদে যাওয়ার যে পথ, সেই পথের চাবি কার হাতে? টকশোর উপস্থাপকের এ প্রশ্নের উত্তর ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে দিতে হয়নি। সরল উত্তর ‘জনগণ’। জাতীয় সংসদের এবারের নির্বাচনটি একাদশতম। ১৯৯০ সালের পরের চারটি এবং ৭৩’র (কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও) নির্বাচন, অর্থাৎ পাঁচটি নির্বাচন ছাড়া ‘জনগণের চাবি’র তোয়াক্কা করা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে এই পাঁচটি নির্বাচনে জনগণের ভোট নিয়ে সংসদ সদস্যরা সংসদে পৌঁছে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের ৭৯’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ৩৯টি আসন দেওয়া হয়েছিল। বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো আরও অনেক আসনে। এরশাদের ৮৬’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আসন দেওয়া হয়েছিল ৭৬টি। আরও শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগ যখন বিজয়ের পথে, তখন ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল টেবিলে।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮’র নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ অভিযোগ তুললেও তা গুরুত্ব পায়নি। কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও এই নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে এমন নির্বাচনকেই বোঝানো হয়। ‘অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়’-এমন কথা বলার পর, সিইসির আর পদে থাকার যৌক্তিকতা থাকার কথা নয়। ‘শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন পৃথিবীর কোথাও হয় না, বাংলাদেশেও হবে না’-এমন বক্তব্য দেওয়ার পর পদ ছাড়তে না পারাটাও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জন্যে সম্মানজনক নয়।
প্রথমত: ‘শতভাগ সুষ্ঠু’- এমন ইউটোপিয়ান কোনো নির্বাচন বাংলাদেশের কেউ-ই প্রত্যাশা করছেন না।
দ্বিতীয়ত: ইউরোপের অনেক দেশ আছে, সেসব দেশে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে কোনো অভিযোগ পরাজিত পক্ষ তোলেন না। প্রশ্ন আসে তাহলে সেগুলো কতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন? ফলে ‘শতভাগ’ শব্দটি আমদানির ক্ষেত্রে কোনো সৎ উদ্দেশ্য আছে, তা বিশ্বাস করা যায় না।
২.
কোনো ইউটোপিয়ান জগত নিয়ে নয়, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছি। এই নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট দিতে পারবেন কিনা? নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অধিকার ফিরে পাবেন কিনা? তর্ক তোলা যেতেই পারে, তাহলে কী এখন মানুষের ভোটের অধিকার নেই? বিগত সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর (নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর বাদে) বিবেচনায় এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হওয়ার সুযোগ নেই। আসন্ন নির্বাচনে ‘হ্যাঁ’ হওয়াটা প্রত্যাশিত। তার জন্যে কিছু কাজ করার আছে নির্বাচন কমিশনের।
প্রথমেই আসে সবার জন্যে ‘সমান সুযোগ’ তৈরির বিষয়। একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-এমপিরা পদে বহাল, এমন বাস্তবতায় সবার জন্যে সমান সুযোগ একটি ইউটোপিয়ান প্রত্যাশা। অর্থাৎ, সবার জন্যে সমান সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা আছে, এমনটা ভাবার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী আচরণবিধিতে কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলেছিলেন সিইসি। কিন্তু, পরে আর তেমন কিছু করেনি।
প্রশাসনে রদবদল করার দাবি তোলা হয়েছে, পরবর্তীতে ৯২ জনের একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনে দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই দাবি জোরালোভাবে সামনে আনা হচ্ছে কেন? জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপি, তারা কয়েকবার ক্ষমতায় ছিল। তারা খুব ভালো করে জানে যে, ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচনের আগে কীভাবে প্রশাসনে নিজ মতাদর্শের লোকজনদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে রাখা হয়। কারণ কাজটি বিএনপিও করেছিলো।
অতীতে দেখা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন প্রশাসনে কিছু রদবদল করে। বলা যায়, এটা নির্বাচন কমিশনের প্রায় নিয়মিত কাজেরই অংশ। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন কিছুটা আস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এবার নির্বাচন কমিশন নির্দেশনা দেওয়ার জন্যে যখন পুলিশসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ডেকে কথা বলেছেন, সেখানে রদবদলের প্রসঙ্গটি এসেছিলো। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘বদলির চিন্তা’ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা যায় না। নির্বাচনের আগে যেন বদলি করা না হয়। যদিও একথা কারোরই অজানা নয় যে, সরকারি চাকরিতে বদলি খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। বদলির সঙ্গে স্বাভাবিক কাজ করতে পারা বা না পারার সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
নির্বাচন কমিশন কথা দিয়েছে, বদলি করা হবে না। বিরোধীদলের প্রথম দাবির বিষয়ে ইসি বলেছিলো ‘ঢালাও অভিযোগ’ বিবেচনায় নেওয়া হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে বিবেচনা করে দেখা হবে। সুনির্দিষ্ট তালিকা দেওয়ার পর ইসি বলেছে, বিরোধীদলের বদলির দাবি বিবেচনায় নেওয়া হবে না। ইসি তদন্ত করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বলেনি।
ইসি বলেছে, পুলিশ তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলছে।
দেখা যাচ্ছে ‘গায়েবি’ মামলাতেও গ্রেপ্তার চলছে। সিইসির বক্তব্য অনুযায়ী, ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী-ই তা চলছে?
‘নাশকতার’ বা রাষ্ট্রীয় কাজে ‘বাধা দেওয়ার’ অভিযোগের মামলায় অন্য অনেকের জামিন হলেও, সম্ভাব্য প্রার্থীর জামিন হচ্ছে না। একই রকম ঘটনায় আদালতের দুই রকমের নির্দেশনায় জনমানুষ বিভ্রান্ত। ‘গায়েবি’ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও, মুক্তি মিলছে না। অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। পুরনো এবং ‘গায়েবি’ মামলায় বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকবে না- তা বলা যাচ্ছে না। এসব মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ হাজার হাজার আসামী থাকায়, যে কাউকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ থাকবে। সব কিছুই নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে পুলিশকে কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বা হবে, তার উপর। আর সত্যি যদি এখনকার পুলিশি কর্মকাণ্ড ইসির নির্দেশনাতেই চলছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে ‘সমান সুযোগ’ বিষয়টি কল্পনার চেয়েও বহু দূরে অবস্থান করতে পারে।
৩.
নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে, রাজনীতিতে অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ ততো জোরালো হবে।
সরকার-পক্ষ উন্নয়নের প্রচারাভিযান আরও জোরদার করবে। পদ্মাসেতু, বিদ্যুৎ, মাথাপিছু আয় বেড়ে দ্বিগুণ- প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নশীল দেশ, রাস্তা, ফ্লাইওভার, নির্মাণাধীন মেট্রোরেল সাফল্যের সঙ্গে গ্রেনেড হামলা, পেট্রোল বোমা সহিংসতার কথাও বলা হবে।
বিরোধী-পক্ষ তুলে ধরবে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে সবচেয়ে নিম্নমানের অবকাঠামো নির্মাণের চিত্র।
দমন-নিপীড়ন, ব্যাংকসহ আর্থিকখাত কেলেঙ্কারি, টাকা পাচার, রিজার্ভ চুরি, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় দুর্নীতি, রেন্টাল-কুইক রেন্টালে দলীয় লোকদের দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া, চালসহ দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ কালাকানুন, গুম-খুন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের হাতুড়ি পেটা-গ্রেপ্তার-জেল-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র সামনে আনবে।
দুই পক্ষ তাদের সুবিধা বিবেচনায় যেভাবেই বিষয়গুলো সামনে আনুক না কেন, ভোটারদের প্রভাবিত কতটা করা যাবে? খুব একটা করা নাও যেতে পারে। কারণ সরকার বা রাজনীতিবিদরা যে কথা যেভাবেই উপস্থাপন করুক না কেন, সবই ভোটাররা দেখেছেন-জেনেছেন-বুঝেছেন। ভোটারদের মনের আনন্দ-বেদনা, স্বস্তি বা ক্ষোভেরই প্রকাশ দেখা যেতে পারে, যদি সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশে ভোটাররা ভোট দিতে পারেন।
৪.
ব্রিটেনের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্স বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে ‘সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি বা লেভেল প্লেইং ফিল্ড’র ধারে-কাছেও নেই, এবং বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন চলছেই’।
মার্কিন কংগ্রেস বলছে, স্থিতিশীলতার জন্যে হুমকি জামায়াত-শিবির এবং হেফাজত। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আগে থেকেই ছিল, হেফাজত নতুন যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। এক্ষেত্রে এক ধরণের ‘সমান অবস্থা’ তৈরি হওয়ায়, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের সুযোগ কমে গেছে।
প্রার্থীরা মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় ফিরে যাবেন। দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করবে। কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত সহযোগী হিসেবে যোগ দিবে। প্রশাসন নিরপেক্ষ বা কোন পক্ষ নিবে? নির্বাচন কমিশনের ‘সব ঠিক আছে’ ভূমিকার পরিবর্তন হবে কিনা?
ধারণা করা খুব কঠিন নয়, আঁচ করা যায় কেমন থাকবে সামগ্রিক মাঠের পরিস্থিতি।
নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষকদের ‘মূর্তি’র রূপ ধারণ করতে বলে দিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, এক কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা যাবে না। কেন্দ্রের ভেতরে তো অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবেই না। যাবে না সরাসরি সম্প্রচার করাও।
বিগত নির্বাচন কমিশন সংবাদকর্মীদের এসব করার সুযোগ দিয়ে বিপদে পড়েছিলো। ইসি দেখাতে চেয়েছিল ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়েছিলেন। সংবাদকর্মীরা এক কেন্দ্রে ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন অবস্থান করে যে চিত্র দেখিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ইসির বক্তব্যের মিল ছিল না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আগে থেকে সজাগ হওয়ার বিষয়টি, অনেক রকমের আশঙ্কা তৈরি করছে।
৫.
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশনের কাছে। সেই ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান দিয়েছে। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের নৈতিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ। সাহস এবং উদ্যোগেও ঘাটতি আছে। ফলে সরকার আন্তরিকভাবে না চাইলে, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে, বিশ্বাস করা কঠিন।
নির্বাচনী ইশতেহার লেখার কাজ চলছে। অনেক ভালো ভালো আশা জাগানো কথা থাকবে ইশতেহারে। কতটা বাস্তবায়ন হলো, সেসব নিয়ে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে। যে জনগণ বা ভোটারদের উদ্দেশে লেখা হচ্ছে ইশতেহার, সেই ভোটারদের প্রথম অধিকার হলো সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারার অধিকার।
সেই ভোটাররা সুষ্ঠু পরিবেশে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারবেন তো?
মানুষের ভোটের অধিকারের কথা কতটা গুরুত্ব পাবে ইশতেহারে? ভোটার নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন? ইশতেহার কী তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে?
- Courtesy: The Daily Star /Bangla online/ Dec 02, 2018
No comments:
Post a Comment