শামীম রাহমান
দেশের সবচেয়ে ভালো মহাসড়কগুলোর একটি ঢাকা-চট্টগ্রাম। পরিবহন মালিক ও ব্যবসায়ীদের হিসাবে ২৬৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি বর্তমানে অতিক্রম করতে পণ্যবাহী একটি যানবাহনের সময় লাগছে গড়ে ১০ ঘণ্টা। এ হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় অতিক্রম করছে ২৬ দশমিক ৬ কিলোমিটার পথ। অথচ আট-দশ বছর আগেও সড়কটি দিয়ে একটি পণ্যবাহী যান ঘণ্টায় ৩৮ থেকে ৪৪ কিলোমিটার গতিতে চলত। চার লেন হওয়ার পরও সড়কটিতে যানবাহনের গতি বাড়েনি, উল্টো কমেছে।
দেশে পণ্য পরিবহনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রুট ঢাকা-বুড়িমারী। সড়কটিতে পণ্যবোঝাই একটি গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ১৫ কিলোমিটার। একইভাবে ঢাকা-বাংলাবান্ধা রুটে চলাচলরত একটি পণ্যবোঝাই যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় মাত্র ১৭ কিলোমিটার। অথচ কয়েক বছর আগেও এসব মহাসড়কে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের উপরে ছিল।
সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে হারে যানবাহন বাড়ছে, সে অনুযায়ী সড়ক বাড়ছে না। উন্নত হচ্ছে না সড়ক অবকাঠামোও। এর বাইরে সড়কের পাশে হাটবাজার, টোল প্লাজার কার্যক্রমে ধীরগতি মহাসড়কে যানবাহনের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত এক যুগে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহনের গতি কমেছে ঘণ্টায় গড়ে ছয় কিলোমিটার। ২০০৪-০৫ সালে দেশের মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৩৪ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার। ২০১৬-১৭ সালে তা ঘণ্টায় ২৮ দশমিক ৫৪ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। যদিও প্রতি বছরই বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের হিসাব বলছে, গত নয় বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোর নকশা করা হয় ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা বিবেচনায় রেখে। আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে এ সক্ষমতা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কগুলোয় জরিপ চালিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগার। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মহাসড়কের সক্ষমতার অর্ধেক গতিতে যানবাহন চলছে।
কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০০৪-০৫ সালে দেশে ভারী ও মাঝারি ট্রাকের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। ২০১৬-১৭ সালে তা ৩১ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ভারী ট্রাকের গতি কমেছে ঘণ্টায় নয় কিলোমিটার। ছোট ট্রাকের গতি কমেছে আরো বেশি। ২০০৪-০৫ সালে দেশে ছোট ট্রাকগুলো ঘণ্টায় গড়ে ৪২ কিলোমিটার গতিতে চলেছে, বর্তমানে নেমে এসেছে মাত্র ২৯ কিলোমিটারে।
মহাসড়কে ট্রাকের গতি কমে যাওয়ার বিষয়ে একমত ব্যবসায়ীরাও। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, যানবাহন বিশেষ করে পণ্যবাহী যানবাহনের গতি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ যানজট। এতে আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের টোল প্লাজাগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে। কারণ, মহাসড়কটিতে যানজটের প্রধান কারণ টোল প্লাজা। পাশাপাশি রেল অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হলে সড়কে চাপ কমবে। সড়কও এতে গতি পাবে।
সড়কপথে দূরপাল্লায় চলাচলের প্রধান মাধ্যম বড় বাস। এক যুগের ব্যবধানে ঘণ্টায় আট কিলোমিটার গতি কমেছে বড় বাসের। ২০০৪-০৫ সালে দেশে বড় বাসের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ৩৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। একইভাবে ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতি কমেছে মিনিবাসের। ২০০৪-০৫ সালে মহাসড়ক দিয়ে ঘণ্টায় গড়ে ৩১ কিলোমিটার গতিতে মিনিবাস চললেও এখন চলছে গড়ে ঘণ্টায় ২৬ কিলোমিটার গতিতে।
বড় বাসের গড় গতি কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার। গতি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে যেভাবে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে, সেভাবে সড়ক-মহাসড়ক বাড়েনি। সড়ক অবকাঠামোও উন্নত হয়নি। সুতরাং এসব গাড়ি চলাচল ও গতিবেগ স্বাভাবিক রাখার জন্য যে ধরনের সড়ক অবকাঠামো দরকার, তা আমাদের নেই।
শুধু ট্রাক কিংবা বাস নয়, সড়ক-মহাসড়কে গতি কমেছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারেরও। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে মাইক্রোবাসের, প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৩ কিলোমিটার। ২০০৪-০৫ সালে মাইক্রোবাসের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৪৯ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ৩৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। একইভাবে ২০০৪-০৫ সালে প্রাইভেট কারের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৩৯ কিলোমিটার। বর্তমানে গড় গতি ঘণ্টায় ৩৩ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
মহাসড়কে যানবাহনের গড় গতি কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ফলে সড়ক ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এর প্রভাবে আমাদের যে রোড নেটওয়ার্কটি আছে, তাতে চাপ পড়ছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সড়ক নেটওয়ার্ক বাড়ানো হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, দুই লেনের সড়ককে চার লেন করা হচ্ছে। সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে যেমন এক ধরনের সংকট তৈরি হয়, ঠিক এমনটাই হচ্ছে আমাদের সড়ক-মহাসড়কে।
বিভিন্ন সড়কে চলমান নির্মাণ ও উন্নয়নকাজও যানবাহনের গতি কমাতে ভূমিকা রাখছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান। এগুলো শেষ হতে আরো কয়েক বছর লাগবে। তখন সড়ক-মহাসড়কের চিত্রটি পাল্টে যাবে।
বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা যানবাহনের গতি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলছেন সড়কে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধিকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, ২০১০ সালে সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহন ছিল প্রায় ১৫ লাখ। বর্তমানে এ সংখ্যা সাড়ে ৩৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। দেশে যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি সড়কের পরিমাণ, যদিও বছর বছর মোটা টাকা বিনিয়োগ করছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের হিসাব বলছে, গত নয় বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হয়েছে আরো ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
ভাঙাচোরা সড়ককে গতি কমার আরেকটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) তথ্য বলছে, দেশের ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের ২১ শতাংশের বেশি ভাঙাচোরা দশায় রয়েছে। একইভাবে ৪ হাজার ২০০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের ২৪ শতাংশ ভাঙাচোরা। আর ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়কের মধ্যে ২৯ শতাংশই ভাঙাচোরা। সামগ্রিকভাবে দেশের রোড নেটওয়ার্কের ২৬ দশমিক ৩২ শতাংশই ভাঙাচোরা দশায় আছে বলে এইচডিএমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গত ২০ বছরে দেশে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। সে অনুপাতে সড়কের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে যান চলাচলের গতি কমবে, এটাই স্বাভাবিক। টোল প্লাজাও যানবাহনের গতি কমিয়ে দেয়ার আরেকটি কারণ। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে টোল প্লাজায় একটা বড় সময় চলে যায়। আবার রাস্তা যদি খারাপ থাকে, তাহলে গতি এমনিতেই কমে যাবে। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে কনস্ট্রাকশন কাজ চলার কারণেও গতি কমতে পারে। আমাদের বেশির ভাগ মহাসড়কেই ডিভাইডার নেই। এতে যে গাড়িটি রাস্তার ডান পাশ দিয়ে চলার কথা, সেটি অনেক সময় বাম পাশে চলে আসে। এর প্রভাবে বাম পাশ দিয়ে চলা গাড়িগুলোর গতি কমে আসে। মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা এবং চালক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা মহাসড়কে যানবাহনের গতি কমিয়ে দেয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
- কার্টসিঃ বণিক বার্তা/ ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮