ধুর ভাই কিসের ইলেকশনের কথা কন? আমি তো কুনো ভুটের আলাপ পাই না। লোকজন সব দাবড়ানির ভয়ে মরতাছে। আইজ অর বাড়ি পুলিশ যায়, কাইল তার বাড়ি ডিবি যায়। ভুটের মইধ্যে যায়া মরব? আমি গরিব মানুষ। দুকানদারি কইরে খাই, আমার বাড়িও পুলিশ আসে! আমার ভায়রা আবার বিএনপি করে তো! সেই কারণে তারা ভাবে আমিও বিএনপি।’ পান চিবুতে চিবুতে কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের পঞ্চাশোর্ধ্ব চা–দোকানি হাতেম আলী। লুঙ্গির খুট দিয়ে পানের পিক মুছতে মুছতে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে নিচ্ছিলেন কেউ তাঁর কথাগুলো শুনে ফেলল কি না। আমি তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘ভোটের ভাব কেমন বোঝেন?’ তখন তিনি ওই কথাগুলো বলছিলেন। কিন্তু যখন তাঁকে নিজের পরিচয় জানালাম, তখন তিনি থমকে গেলেন। তারপর মুহূর্তে ইউটার্ন নিলেন। তখন বললেন উল্টো কথা। তখন তাঁর কথার অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো: খুব সুন্দর ভোটের পরিবেশ আছে। নির্বাচনের আমেজ এখনো নেই বটে, তবে ভোট হচ্ছে বলে সবাই আনন্দে আছে।
সেখানে মানিক নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন। তিনি বললেন, ইলেকশন নিয়ে মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য নেই। সবাই একধরনের চাপা আশঙ্কার মধ্যে আছে। গায়েবি মামলা ও ধরপাকড়ে বিরোধী শিবিরের লোকজন চাপে আছে।
এলাকাটি গাজীপুর–২ আসনের মধ্যে পড়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ থেকে টিকিট পেয়েছেন জাহিদ আহসান রাসেল। বিএনপির শিবির থেকে তাঁকে মোকাবিলা করবেন এম মঞ্জুরুল করিম রনি ও সালাহ উদ্দিন সরকার। ‘ভোটে কে পাস করবে বলে মনে হয়?’—এই প্রশ্নের জবাবে হাতেম আলী বললেন, ‘ভুট যুদি শ্যাষ পর্যুন্ত হয় আর দাঙ্গা–ফ্যাসাদ ছাড়া হয়, তাইলে নির্ঘাত কনটেস্ট হবে। এই পুরা গাজীপুরে একচাইটা বইলা কিছু নাই। কড়া ফাইট কইরা পাস করতে হইব।’
গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির অফিসে স্থানীয় আইনজীবী ও সাংবাদিক আসাদুল্লাহ বাদল বললেন, গাজীপুর শহর ও তার আশপাশের এলাকায় প্রচুর পোশাক কারখানা ও অন্যান্য শিল্পকারখানা আছে। এসব শিল্পকারখানায় লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এদের একটা বিরাট অংশ স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ভোটার। তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। এখানকার ভোটারদের মধ্যে মতাদর্শগত দিক থেকে একটি মিশ্র ব্যাপার আছে। ফলে একচেটিয়া জনসমর্থন কোনো নেতারই নেই। স্বচ্ছ ভোট হলে এই ভোটারদের রায় একটি নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠবে।
বাদল বললেন, প্রতিদিনই এখানে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সরকারদলীয় প্রার্থীরাই মূলত আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। এখন এখানে সরব আছেন সরকারপন্থীরা। বিরোধীরা নানা ধরনের আশঙ্কা ও আতঙ্কে নীরব। তাঁদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আছে। ১৫ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী মাঠে নামলে হয়তো বিরোধীদের সরকারপন্থীরা ধাওয়া করতে পারবে না। তখন কিছুটা সমতা আসবে। সে পরিস্থিতি হলে এই নীরব ভোটাররা প্রকাশ্যে আসবেন। তখন নির্বাচনী আমেজ টের পাওয়া যাবে। তবে তিনি মনে করেন, এখন জনমনে থমথমে ভাব আছে। সরকারপন্থী ও বিরোধীরা একটা শীতলযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
গাজীপুর-১ আসনে (কালিয়াকৈর উপজেলা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডগুলো নিয়ে গঠিত) আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে লড়বেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিএনপির তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর সঙ্গে তাঁর মূল লড়াই হবে। কালিয়াকৈরে সেখানকার ভোটার নজরুল পাশার সঙ্গে কথা হলো। নজরুল বললেন, এখানে এই দুই প্রার্থীই হেভিওয়েট। ভোট স্বচ্ছ হলে তঁাদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। তবে নজরুল মনে করেন, মোজাম্মেল হক এখানকার ভোটার নন বলে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে।
গাজীপুর-৩ আসনে (শ্রীপুর উপজেলা এবং গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়ালগর ও পিরুজালী ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত) আওয়ামী লীগের প্রার্থিতায় পরিবর্তন এসেছে। টানা ৩০ বছর এখান থেকে প্রার্থী হয়ে এসেছেন আইনজীবী মো. রহমত আলী। তাঁর অসুস্থতার কারণে এবার তাঁর ছেলে আইনজীবী জামিল হাসান দুর্জয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে দল মনোনয়ন দিয়েছে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজকে। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সাধারণ মানুষের কাছে সবুজের জনপ্রিয়তা অনেক। তিনি অনেক আগে থেকেই তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। আমতলী এলাকার বাচ্চু মিয়া বললেন, ‘সবুজ ভাই সবার সাথে কোলাকুলি করে বহুত আগে থাইকা। বিএনপির মধ্যেও সে জনপ্রিয়। তার কুনো ক্ষতি বিএনপির লোকজনও চায় না।’ সবুজের সঙ্গে বিএনপির হয়ে লড়াইয়ে থাকবেন অধ্যাপক ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু।
গাজীপুর-৪ আসনে (কাপাসিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত) তাজউদ্দীনকন্যা সিমিন হোসেন রিমির সঙ্গে লড়বেন প্রয়াত বিএনপি নেতা হান্নান শাহর ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান।
কাপাসিয়া সদর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আজগর হোসেন খান বলছিলেন, এই দুই প্রার্থীরই পারিবারিক ঐতিহ্য আছে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর রক্ত রিমির গায়ে বইছে। অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যে ফকির আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ফকির মজনু শাহর বংশধর হলেন শাহ রিয়াজুল হান্নান। দুজনের বিষয়েই জনমনে অগাধ শ্রদ্ধা আছে। তবে ভোটাররা যদি ব্যক্তি ইমেজকে সরিয়ে দিয়ে নৌকা এবং ধানের শীষ প্রতীককে মাথায় নিয়ে ভোট দেন, তাহলে কী ফল হবে তা নীরব ভোটাররা সরব না হওয়া পর্যন্ত আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ উপজেলা, গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়ন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২ নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত) আসনে আওয়ামী লীগের মেহের আফরোজ চুমকি এবং বিএনপির এ কে এম ফজলুল হক মিলন লড়বেন।
আমতলী বাজারের জাকির হোসেন মনে করেন, ভোট সুষ্ঠু হলে তাঁদের মধ্যেও তীব্র লড়াই হবে। কিন্তু লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, তার চুম্বক কথা হলো আপাতত সরকারপন্থী ও সরকারবিরোধীদের মধ্যে একটা শীতল যুদ্ধ চলছে। ভোটে তার চূড়ান্ত প্রতিফলন দেখা যাবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮