৩ ডিসেম্বর ২০১৮, আশপাশের দোকান থেকে খাবার কিনে এসে হাইকোর্টের প্রাঙ্গণে বসে খাচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার প্রায় ২০০ ব্যক্তি আদালতে হাজির হয়ে স্থানীয় থানায় দায়ের করা একটি মামলার অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন করেন। তাদের অনেকে জামিন পান। ছবি: আরমান হোসেন
পুলিশি হেনস্তার ভয়ে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্ভয়ে প্রচারণা চালাতে পারবেন কী না সে নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তারা।
যেমন, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে বিএনপি প্রার্থী সাইফুল আলম নীরব নিজের মনোনয়নপত্র নিজে জমা দিতে পারেননি। ঢাকা-১২ আসনের এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে ২৬৭টির মতো মামলা। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তার কাঁধেই এতো বেশি মামলার বোঝা।
এমনকি, আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনে ৩,০৬৫ সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি মামলার শিকার।
দলের সহযোগীদের মাধ্যমে পাঠানো নীরবের মনোনয়নপত্র রিটার্নিং কর্মকর্তা গ্রহণ করেছেন। ভোটের মাঠে এখন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
নীরব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “বুঝতে পারছি না, প্রচারণা যখন শুরু হবে তখন আমি কীভাবে কাজ করবো। কেননা, পুলিশ নিয়মিত বাসায় হানা দেয়। শুধু আমিই না, আমার দলের কোনো নেতা-কর্মীই বাসায় থাকতে পারছেন না।”
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপির শাসনামলে নীরব নানাভাবে বিতর্কিত হয়েছিলেন। যুবদলের এই সভাপতি এখন জামিনে থাকলেও গত ২০১০ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তার হলফনামায় দেখা যায়, মামলাগুলোর অধিকাংশ হয়েছে সন্ত্রাসী কাজে অংশ নেওয়া, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, বোমাবাজি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর অভিযোগে।
নীরবের বিরুদ্ধে দায়ের করা ২৬৭টি মামলার মধ্যে ৯৯টি তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়াও, ৯৫টি মামলা রয়েছে বিচারাধীন। মামলাগুলোর অধিকাংশ দায়ের করা হয়েছিলো ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে।
কিন্তু, মজার বিষয় হচ্ছে, চলতি বছরে বিএনপি কোনো বড় ধরনের আন্দোলনে না নামলেও নীরবের বিরুদ্ধে নতুন করে ৫৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
একই আসনে বিএনপি বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রেখেছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার আনোয়ারুজ্জামানকে। তবে নগর বিএনপির এই নেতার বিরুদ্ধেও রয়েছে ৭২টি মামলা। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো নীরবের মামলাগুলোর মতোই।
আনোয়ারুজ্জামানের ৭২টি মামলার মধ্যে ৩০টি মামলার চার্জ গঠনের শুনানি চলছে এবং ২৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তিনি এখন জামিনে রয়েছেন।
কিন্তু, নীরব বা আনোয়ারুজ্জামান ব্যতিক্রম নন।
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির অধিকাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে ফৌজদারি মামলা। কারো কারো বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১০০টিরও বেশি।
যেমন, হলফনামা অনুযায়ী ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা এসএম জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৩৭টি মামলা। সেগুলোর মধ্যে ৪৮টি বিচারাধীন এবং ৫৭টি রয়েছে তদন্তাধীন। এছাড়াও, ২৬টি মামলায় হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। আর একটিতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।
ঢাকা-১৮ আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়া জাহাঙ্গীরকে লড়াই করতে হবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেত্রী সাহারা খাতুনের বিরুদ্ধে।
সব মামলায় জামিনে থাকা জাহাঙ্গীর ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমাকে গোপনে প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়া, আর কোনো পথ খোলা নেই।”
বিএনপির অপর নেতা নবীউল্লাহ নবীর বিরুদ্ধে রয়েছে ১০০টির বেশি মামলা। দলের ঢাকা দক্ষিণ শাখার সহ-সভাপতি নবী ঢাকা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
নবীর ১২১টি মামলার মধ্যে ৫৬টি তদন্তাধীন এবং ৩৭টিতে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে।
তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ঘটনাটি আরও অদ্ভুত। কারাগারে থাকা এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে ১০৮টি মামলা। তিনি পাবনা-৫ আসন থেকে নির্বাচনে লড়াইয়ের জন্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
শিমুলের হলফনামায় রয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার ৬৪টি মামলায় হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে।
বিএনপির পাবনা শাখার সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মান্নান বলেন, “শিমুল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। তিনি ভুয়া মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। দল যদি তাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় তাহলে আমরা তার প্রচারণার কাজে অংশ নিবো।”
পাবনায় শিমুলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার।
ঢাকা-৪ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে রয়েছে ৮০টি মামলা। বিকল্প হিসেবে তার ছেলে তানভীর আহমেদকেও প্রার্থী করা হয়েছে। কিন্তু, তানভীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৭৫টি ফৌজদারি মামলা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দলের অন্তত ৫৩৭ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বিএনপি আরও জানায়, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে দলটির ৮৫ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৪,১২৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আরও ৩ লাখ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৪৬টি মামলা এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে রয়েছে ৪২টি।
দলটির দেওয়া তথ্যে আরও জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপির ২৫ লাখ ৭০ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৯০ হাজারের মতো মামলা দেওয়া হয়েছে।
এসব মামলার অধিকাংশ দায়ের করা হয়েছে ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সালে মধ্যে এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। সেসময় বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়েছিলো। বিভিন্নস্থানে সেই আন্দোলন সহিংসতার রূপও নিয়েছিলো।
এছাড়াও, ২০১৫ সালে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা দায়ের করা হয়। তখন দলটি সারাদেশে লাগাতার অবরোধ পালন করেছিলো। সেই অবরোধ প্রায় তিনমাস চলেছিলো।
২০১২ সাল থেকে দায়ের করা এসব মামলায় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অনেকে কারাগারে রয়েছেন। অনেকে আবার পলাতকও।
- The Daily Star /Bangla/Dec 05,2018