- ১০ বছরে আমুর আয় বেড়েছে ১৩ গুণের বেশি
- ৫ বছরে মায়ার মোট আয় বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি
- মৎস্য খাতে আইনমন্ত্রীর বার্ষিক আয় ৩ কোটির বেশি
- খাদ্যমন্ত্রীর ভাতার বাইরে বিশেষ কোনো আয় নেই!
- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এখন গাড়ির সংখ্যা তিনটি
- ভূমিমন্ত্রী ডিলুর কাছে নগদ টাকা ১ কোটি ৩১ লাখ
- জুনাইদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১০ গুণের বেশি
মন্ত্রিসভার আট সদস্যের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁদের আয় বেড়েছে, বেড়েছে সম্পদও। অনেকেরই আয়ের বড় উৎস মন্ত্রী হিসেবে পাওয়া ভাতা। অবশ্য কেউ কেউ ব্যবসা থেকে বাড়তি আয় দেখিয়েছেন।
হলফনামায় মন্ত্রীরা স্ত্রীসহ নির্ভরশীলদের সম্পদের বিবরণও দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, তাঁদের স্ত্রীদের সম্পদও বেড়েছে। আবার উভয়েরই নগদ অর্থ ছাড়াও আছে নানা ধরনের বিনিয়োগ।
আমুর আয় বেড়েছে
১০ বছরে শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর আয় বেড়েছে ১৩ গুণের বেশি। অথচ একই সময়ে তাঁর স্থাবর সম্পত্তি আড়াই লাখ টাকা কমেছে। নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তাঁর বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৬ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এবারের হলফনামায় বছরে প্রায় ৮২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
এবারের হলফনামায় অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার টাকার তথ্য দিয়েছেন মন্ত্রী। এর মধ্যে বন্ড, ঋণপত্র অথবা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। একই সময়ে তাঁর স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ টাকার (বন্ড, ঋণপত্র, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ) অস্থাবর সম্পত্তি ছিল, যা বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ২০০৮ সালে আমির হোসেন আমু ও তাঁর স্ত্রীর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এবার তিনি দেখিয়েছেন ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পত্তি।
মায়া পরিবারের আয় বেড়েছে
পাঁচ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার আয়ের উৎস ও মোট আয় বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি। আয় বেড়েছে তাঁর স্ত্রীরও। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দাখিল করা তাঁর হলফনামায় আয়ের একমাত্র উৎস দেখানো হয়েছিল বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া। এ থেকে তাঁর মোট বার্ষিক আয় উল্লেখ করা হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা । ওই একই উৎস থেকে তখন তাঁর স্ত্রীর আয় দেখানো হয়েছিল ১২ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
এবারের হলফনামায় মায়া ভাড়া বাবদ ৫ লাখ ৭১ হাজার টাকা, চৌধুরী গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্টার থাইয়ের পরিচালক হিসেবে বার্ষিক ২৪ লাখ টাকা, মন্ত্রী হিসেবে সম্মানী ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা এবং ব্যাংক মুনাফা বাবদ আয় ৫ লাখ ২১ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। তাঁর স্ত্রীর আয় দেখানো হয় ৩১ লাখ টাকার মতো। এ ছাড়া মায়ার হলফনামায় কিছু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়েছে।
মাছ চাষে আইনমন্ত্রী
পাঁচ বছর আগে কৃষি খাত (মৎস্য) থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বার্ষিক কোনো আয় ছিল না। বর্তমানে এই খাতে তাঁর বার্ষিক আয় ৩ কোটি টাকার বেশি। পাঁচ বছর আগে আনিসুল হকের নামে কোনো সঞ্চয়পত্র, মৎস্য খামার, অকৃষিজমি ও স্বর্ণ ছিল না। বর্তমানে তাঁর নামে ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, তিনটি মৎস্য খামার, ২৯ লাখ টাকার অকৃষিজমি ও ২০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাংকে আমানত ও আইন পেশা থেকে আনিসুল হকের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। তা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি টাকার বেশি। তবে তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের কোনো আয় নেই বলে উভয় হলফনামায় উল্লেখ রয়েছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আছে আইনমন্ত্রীর। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেখিয়েছেন মন্ত্রী। এর বাইরে আনিসুল হক গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন সম্পদ হলফনামায় দেখিয়েছেন।
ভাতার বাইরে নগণ্য আয় কামরুলের
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভাতার বাইরে বিশেষ কোনো আয় নেই। তিনি নিজের ও নির্ভরশীলদের বার্ষিক মোট আয় দেখিয়েছেন ২৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২৫ লাখ টাকাই আসে মুক্তিযোদ্ধা ও মন্ত্রী হিসেবে পাওয়া ভাতা থেকে। এর বাইরে ভাড়া, ব্যাংকের সুদ আর টক শোর সম্মানী থেকে আয় করেন তিনি।
কামরুল ইসলাম এবার স্থাবর সম্পত্তি দেখান ৫৪ লাখ টাকা। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে কামরুলের মাত্র ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকার স্থাবর সম্পত্তি ছিল। নবম ও একাদশ দুই সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় স্ত্রীর স্থাবর সম্পত্তির কোনো তথ্য দেননি কামরুল ইসলাম। নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কামরুলের স্ত্রীর ১৫ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পত্তি ছিল। এবারের নির্বাচনে স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের কোনো তথ্য দেননি তিনি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের কাছে প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পত্তির তথ্য দিয়েছেন কামরুল। এর মধ্যে একটি গাড়ির দাম উল্লেখ করেছেন প্রায় ৭৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা।
রেলমন্ত্রীর কাছে নগদ ২০৩২ টাকা
মন্ত্রী হওয়ার পর রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের সম্পদ বেড়েছে। তবে তাঁর কাছে নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ কম। তাঁর স্ত্রী হনুফা আক্তারের কাছে নগদ টাকা, ব্যাংক, বিমা ও আমানত হিসেবে জমা টাকার পরিমাণ বেশি।
হলফনামা অনুযায়ী মুজিবুল হকের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে নগদ ২ হাজার ৩২ টাকা আছে। স্ত্রী হনুফা আক্তারের কাছে আছে ২ হাজার ২৫৮ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের নামে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে জমা ৬০ হাজার টাকা।
২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর মুজিবুল হক বিয়ে করেন। তাই এবার হলফনামার অস্থাবর সম্পদে স্ত্রীর নামের কলাম পূরণ করেন, যেখানে আগে লিখতেন প্রযোজ্য নয়। এতে স্ত্রীর নামে সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স ও জীবন বিমার টাকাসহ ৭০ লাখ টাকা আছে। স্ত্রীর নামে ২১ লাখ টাকার আমানত ও ৮৭ ভরি সোনা দেখিয়েছেন তিনি। মন্ত্রীর নিজের নামে দুটি মোটরগাড়ি আছে। এর বাইরেও কিছু সম্পদ দেখিয়েছেন তিনি।
মোজাম্মেল হকের এখন তিন গাড়ি
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের আয় ও সম্পদ সবই বেড়েছে। ১০ বছর আগে তাঁর কোনো গাড়ি ছিল না। এখন তাঁর গাড়ির সংখ্যা তিনটি। ২০০৮ সালে তিনি আইনজীবী ছিলেন। এবার তিনি পেশা পাল্টে কৃষি, মৎস্য ও পোলট্রি ব্যবসা উল্লেখ করেন।
নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আ ক ম মোজাম্মেল হকের হলফনামা অনুযায়ী, বর্তমানে কৃষি খাত থেকে তাঁর আয় ১৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া থেকে আয় ৩৬ হাজার, পোলট্রি ব্যবসা থেকে আয় ১৯ লাখ ৯০ হাজার, সঞ্চয়পত্র থেকে আয় ২৬ হাজার এবং ভাতা বাবদ আয় আরও ২৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৮০ টাকা।
মন্ত্রী হয়ে কোটিপতি ডিলু
দশম সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর কোনো নগদ টাকা ছিল না। তবে মন্ত্রী হয়ে ১ কোটি ৩১ লাখ নগদ টাকা এবং ৯৩ লাখ টাকা দামের একটি গাড়ি ও একটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। আয় বেড়েছে সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্য ভাতা থেকে। তবে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ভূমিমন্ত্রীর কোনো টাকা নেই। কোনো বন্ড ও শেয়ারও নেই তাঁর। সঞ্চয়পত্রেও কোনো বিনিয়োগ করেননি।
জুনাইদের সম্পদ বেড়েছে
পাঁচ বছরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের বার্ষিক আয় তেমন না বাড়লেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। আগের থেকে তাঁর স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকার সম্পদও বেড়েছে তিন থেকে চার গুণ। মন্ত্রী দম্পতির দাবি, চাকরির বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হওয়া ও বিনা খরচে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় সংগত কারণে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৪ সালে জুনাইদের আয় ছিল ১৮ লাখ টাকার মতো, যা এখন ৪০ হাজার টাকার মতো বেশি। একই সময়ে তাঁর স্ত্রীর আয় ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকার মতো বেড়ে প্রায় ১২ লাখ ৮১ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে। জুনাইদ আহ্মেদ হলফনামায় নিজ নামে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন, যা আগের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। এ ছাড়া ৭০ লাখ টাকা মূল্যের জিপগাড়ি, ৪১ তোলা স্বর্ণ ও ২ লাখ ৯০ হাজার টাকার আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথাও উল্লেখ রয়েছে। স্ত্রীর নামেও রয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ। যা আগের হলফনামায় উল্লেখ করা অস্থায়ী সম্পদের প্রায় তিন গুণ বেশি। স্ত্রীর নামেও রয়েছে ৪৫ লাখ টাকার ১টি নিশান এক্সট্রেইল কার ও ৬৯ তোলা স্বর্ণ।
জুনাইদ আহ্মেদের ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকার সম্পত্তিতে। জুনাইদ আহ্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ও আমার স্ত্রীর বেতন-ভাতা বেড়েছে। জীবনযাপনের বেশির ভাগ খরচ সরকারিভাবে মেটানো হয়। তাই সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।’
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮