Search

Tuesday, January 8, 2019

দু’টি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সমাচার


  • একটির মহাসচিব, আরেকটির নির্বাহী পরিচালক একই ব্যক্তি
  • একটির অফিস ও ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি
  • আরেকটির চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা আ. লীগ এমপি
  • টাকা আসে নগদে ও বিকাশে
  • নামের আগে ‘সার্ক’ থাকলেও, ‘সার্ক’-এর সঙ্গে সম্পর্ক নেই


এই আবাসিক ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। ছবি: স্টার

সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসতে পারেননি। ভিসা জটিলতা না সরকারের সহায়তা না করা, বিতর্ক হয়েছে বিস্তর।

এবারের নির্বাচনে দেশি ৮১টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন এবং ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক ৩৮ জন, কূটনৈতিক বা বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন এবং বাংলাদেশে দূতাবাস বা হাইকমিশন বা বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী আলোচিত দুটি সংস্থা ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ এবং ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’।

এই দুটি সংস্থা গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, “একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের চেয়ে অনেকাংশে ভালো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, “সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ৫ হাজার ৭৬৫ জন সদস্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন।”

বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে রাজধানীর ২৪টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। এছাড়াও, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম দেশের ২১৪টি আসনের ১৭ হাজার ১৬৫টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কানাডার লেবার মার্কেট প্ল্যানিংয়ের সিনিয়র অ্যানালিস্ট তানিয়া ডন ফস্টার, মানবাধিকার কর্মী চ্যালি ডন ফস্টার, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী হাকিমুল্লাহ মুসলিম, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য নাজির মিয়া, নেপালের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদীন আলী, কলকাতা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক কমল ভট্টাচার্য, কলকাতা জজকোর্টের আইনজীবী ড. গৌতম ঘোষ এবং শ্রীলঙ্কার সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের বিশেষ প্রতিনিধি এহসান ইকবাল।

কানাডা থেকে আসা পর্যবেক্ষক তানিয়া ডন ফস্টার নির্বাচনের দিন বলেছিলেন, “...কানাডার মতোই ভোটের পরিবেশ এখানে।” (প্রথম আলো, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ এবং ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’-এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়েছে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে।

সংস্থা দুটির নাম আগে শোনা যায়নি। দেশের অন্য কোনো পর্যবেক্ষকরাও তাদের বিষয়ে জানেন না। এই সংস্থা দুটি এর আগে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়নি।

খোঁজ করতে গিয়ে ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’-এর কার্যালয় ও ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর নাম অনুযায়ী ধারণা করা যায় আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সংস্থা। মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলী নামক একজন ব্যক্তিই দুটি সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি একটির মহাসচিব এবং অন্যটির নির্বাহী পরিচালক।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইটের (https://sarchumanrights.org/) সন্ধান পাওয়া গেল। ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, সংস্থাটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ-ভিত্তিক। ‘সার্ক’-এর সঙ্গে সংস্থাটির কোনো সম্পর্ক ওয়েবসাইটের তথ্যে নেই। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় তাদের একজন করে প্রতিনিধির নাম ও ছবি ওয়েবসাইটে দেওয়া রয়েছে। অফিসের ঠিকানা বা প্রতিনিধিদের ফোন নম্বরও ডেইলি স্টার অনলাইনকে দিতে পারেননি সংস্থার মহাসচিব আবেদ আলী।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা হিসেব রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক এমপি। ‘তারা প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ সহায়তাও দিয়ে থাকেন’ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য জানিয়েছেন মহাসচিব আবিদ আলী।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালার ৪.৩ ধারায় লেখা রয়েছে, “’নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সহিত সরাসরি জড়িত ছিলেন বা আছেন কিংবা নিবন্ধন লাভের জন্য আবেদনকৃত সময়ের মধ্যে কোন নির্বাচনের প্রার্থী হইতে আগ্রহী এইরূপ কোন ব্যক্তি যদি পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদনকারী কোন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কিংবা পরিচালনা পর্ষদের বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হইয়া থাকেন, তাহা হইলে উহা যে নামেই অভিহিত হউক না কেন উক্ত সংস্থাকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন করা হইবে না।”


গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নৌকার প্রতিকৃতি তুলে দিচ্ছেন আবেদ আলী (ডান থেকে দ্বিতীয়)। সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে ছবিটি গত ২২ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু, তারা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছেন নির্বাচন কমিশন থেকে। রাজনীতিবিদদের চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা রেখে কী করে নিবন্ধন পেলো ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন?’- দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের এই প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব বলেন, “এদের ব্যাপারে এতো বিস্তারিত আমার জানা নেই।”

ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, সংস্থাটির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মো. রুহুল আমিন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শিকদার মকবুল হক, সাবেক মন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম, পার্বত্য খাগড়াছড়ি আসনে জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. সোলায়মান আলম শেঠ।

সংস্থাটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও মানিকগঞ্জ দরবার শরীফের খলিফা মো. আব্দুস সালাম এবং মহাসচিব হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবেদ আলী।

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ ঘেঁটে শুধু মহাসচিব  মোহাম্মদ আবেদ আলীর কর্মকাণ্ডই নজরে এসেছে বেশি। কখনও তিনি বিভিন্ন মানবাধিকারবিষয়ক সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন, কখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।

সর্বশেষ গত ২২ নভেম্বরের একটি ফেসবুক পোস্টে দেখা গেছে, গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নৌকার প্রতিকৃতি তুলে দিচ্ছেন আবেদ আলী ও ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাসহ অন্যান্যরা।

সংস্থাটির ফেসবুক পেজে গত ২৫ সেপ্টেম্বর একটি পোস্ট করা হয়। সেখানে আবেদ আলীর ভাষ্য, “সরকারের অধীনেই সকল ধরণের সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। সময়ের সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, পরিবর্তন হলে আমরা মেনে নিতে পারবো না। যে পরিবর্তন আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে সহায়ক, সে নিয়মকে, পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। এ সরকারের নির্বাচন কমিশন ছোট বড় ৬ হাজার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছে। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হোক। ইতোমধ্যে তাদের নির্বাচন পরিচালনার দক্ষতা আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।”

ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া অফিসের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার অনুযায়ী চলল অনুসন্ধান। টিএন্ডটি-র নম্বরে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চেষ্টা চললো, কিন্তু কেউ ফোন ধরলেন না। ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কার্যালয়ের ঠিকানার (প্লট-৭, রোড-৪/৩, ব্লক-বি, এভিনিউ-১, মিরপুর-১২) উদ্দেশে বের হলাম।


সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন-এর উপদেষ্টা প্যানেলে রয়েছেন র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি, মো. রুহুল আমিন এমপি এবং বিচারপতি শিকদার মকবুল হক। ছবি: সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন-এর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটি ছয়তলা আবাসিক ভবনের গেটে ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ লেখা একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। আবাসিক ভবনের গেট বন্ধ, ফুটো দিয়ে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। এক যুবক এসে গেট খুলে বললেন, “আপনি কে, কাকে চাই?”

সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর ভেতর থেকে তেড়ে এলেন বয়স্ক একজন। রাগত স্বরে প্রশ্ন করলেন, “কেন এসেছেন?”

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ সম্পর্কে জানতে এসেছি। তিনি বলেন, “এখানে কারো কাছে কোনো তথ্য পাবেন না, চলে যান। খুব বেশি প্রয়োজন হলে মহাসচিব আবেদ আলীকে ফোন দেন।” বলেই- আবেদ আলীর নম্বর দিয়ে, কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভেতর থেকে গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন সেই যুবক। বললেন, “ইনিই সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর সভাপতি মো. আব্দুস সালাম। কিছু মনে করবেন না, বয়স হয়ে গেছে তো, তাই স্যারের আচরণ এমন হয়ে গেছে।”

যুবকের নাম জাহেদুল ইসলাম। তিনি এই বাড়ির কেয়ারটেকার বলে জানান। “সভাপতির সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই” বললে গেট খুলে ভেতরে যেতে দিলেন। গিয়ে দেখি, ছোট্ট একটি রুম। দুটি টেবিল, চারটি চেয়ার, একটি সোফা ও একটি আলমারি। নিচতলার এই রুমটিই ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

“অফিস কি সবসময় বন্ধই থাকে?”- এমন প্রশ্নের উত্তরে যুবকটি জানালেন, “মাঝে-মধ্যে লোকজন আসেন। আবেদ আলী স্যার আজ বিকালে বা রাতে আসতে পারেন। সবে তো নির্বাচন শেষ হলো, তাই সবাই সেসব নিয়েই ব্যস্ত আছেন।”

নির্বাচনের আগে বা পরে এই কার্যালয়ে কোনো বিদেশি লোক আসেনি বলেও জানান জাহেদুল।

দুই দিনে কয়েকবার ফোনে কথা হলো মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলীর সঙ্গে। ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর হয়ে কতোজন বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে এসেছিলেন?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আটজন এসেছিলেন। আরও বেশি আসার কথা ছিলো, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের অনেকেই আসতে পারেননি।”

বাংলাদেশে এসে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা ছিলেন কোথায়?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, “বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সবাই গুলশান-২ এর ‘হোটেল এক্সিকিউটিভ ইন’-এ ছিলেন।”

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা হিসেবে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমপিরা রয়েছেন। দলীয় এমপিদের সঙ্গে নিয়ে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ করা যায়? মহাসচিব আবেদ আলী বলেন, “উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো প্রভাব আমাদের এখানে পড়ে না। কারণ এখানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টির একজন রাজনীতিক রয়েছেন। অপর একজনের নিজেরই একটি দল আছে।”

নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আপনাদেরকে অর্থায়ন করেছে কারা?- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশেষ করে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের কমিটি আছে এবং কানাডা থেকে যারা এসেছেন তারাও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে এসেছেন। আমরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে সংগঠন পরিচালনা করি। নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের একটি বাজেট ছিলো। আমাদেরকে সরকার অর্থায়ন করেনি, এমনকি নির্বাচন কমিশনও করেনি।”

“আমাদের পরিচালনা কমিটি আছে, বাইরের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, তাদেরকে আমরা প্রস্তাব দেই যে এই কাজ হচ্ছে, তোমরা আমাদের সাপোর্ট দেবে কী না? তারা যদি ভালো মনে করে, তাহলে তারা আমাদের সহযোগিতা করে,” যোগ করেন তিনি।

বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী কারা? কীভাবে অর্থ দেন তারা?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দেশের বাইরে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির লোকজন আছেন। তাদের অনেকেই আমার ও আমার কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে টাকা পাঠান। বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে বা আত্মীয়দের সহযোগিতায় তারা আমাদের কাছে টাকা পৌঁছে দেন।”

চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টারা আর্থিকভাবে সহায়তা করেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে আবেদ আলী জানান, “আমরা চাইলে উনারা নিজেদের থেকে আমাদের অর্থ সহায়তা দেন বা উনাদের বন্ধু সম্প্রদায়কে সহায়তা করতে বলেন।”

এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আপনাদের বাজেট কতো ছিল?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা তো কাউকে টাকা দিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করাইনি। যারা কর্মী আছে, তারা নিজেদের উদ্যোগে করেছে এবং তারা এই কাজটিকে উপভোগ করেছে।”

“তবে নির্বাচনের দিন যাতায়াতসহ অন্যান্য কাজে খরচ হয়েছে ৫ লাখ টাকার মতো। সবকিছু মিলিয়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

বিদেশি পর্যবেক্ষকের জন্য আপনাদের বাজেট ছিলো কতো?- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মাত্র তারা গেলেন। আর আমরা এখনও বাজেটটি শেষ করিনি। এখানে কী খরচ হয়েছে না হয়েছে, দেখতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নিজেরাই টিকিট করে এসেছেন। আমরা শুধু তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আর যে হোটেলে তারা ছিলেন, সেটি আমারই চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী বড় ভাইয়ের হোটেল। সেখানে তাদের জন্য সর্বোচ্চ কনসিডার করা হয়েছিলো।”

বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ তৈরি হলো কীভাবে? আপনাদের প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য তারা টিকেট কেটে চলে এলেন?- এ প্রশ্নের জবাবে আবেদ আলী বলেন, “বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমগুলো ফলো করে থাকেন। এছাড়াও, কানাডাতে আমাদের যে বাঙালি কমিউনিটির লোকজন রয়েছেন, তারাই পর্যবেক্ষকদের আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।”

বলা হচ্ছে- আপনারা অর্থ দিয়ে তাদের এনেছেন। তাদের পর্যবেক্ষক হিসেবে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।- এর জবাবে আবেদ আলী বলেন, “অভিজ্ঞতা অবশ্যই তাদের আছে। এর আগে ভারত ও নেপাল থেকে কমল ভট্টাচার্য, গৌতম ঘোষ, নাজির মিয়া বাংলাদেশে এসেছিলেন। আর যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তারা ২৮ ডিসেম্বর এসে অভিজ্ঞতা নিয়েছেন, সবাই একসাথে সমন্বয় করেছেন।”

আপনি দাবি করেছেন যে এটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, কেন?- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা তো মাত্র ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে অনুমোদন পেয়েছি। এছাড়াও, সব জায়গাতেই আমাদের সংগঠনের প্রোফাইল দিয়ে প্রস্তাবনা জমা দিয়ে রেখেছি। ২০১৮ সাল তো চলে গেলো, আশা করছি ২০১৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে যাবো।”

কোথায় কোথায় আপনাদের সংগঠনের কার্যক্রম রয়েছে?- এমন প্রশ্নে আবেদ আলী জানান, “দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে তাদের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এসব দেশে মূলত সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকরা সংগঠিত হয়ে নিজেরাই কমিটি গঠন করেছেন। তারপর কেন্দ্র থেকে তাদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে।”

এর আগে সার্ক হিউম্যান রাইটসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন কী না?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, করিনি, কারণ- আমরা তখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ছিলাম না।”

পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কোন যোগ্যতায় আপনারা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) থেকে অনুমোদন পেলেন?- এই প্রশ্নের জবাবে আবেদ আলী বলেন, “এখানে প্রায় ১১৮টি সংগঠন অনুমোদন পেয়েছে। সেখানে এমন সংগঠনও আছে, যাদের নির্বাচন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আসলে প্রতিষ্ঠানের কোনো ধারণা থাকে না, ধারণা থাকে ব্যক্তির।”

সার্কভুক্ত দেশগুলোতে আপনাদের কোনো কার্যক্রম আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। নামে কেনো ‘সার্ক’ যুক্ত করেছেন?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সার্কের বর্তমান মহাসচিব আমজাদ হোসেন সিয়ালের সঙ্গে আমরা বসেছি। উনি আমাদের অভয় দিয়ে বলেছেন, যেহেতু সার্কের কোনো মানবাধিকার সংগঠন নেই, আপনারা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করুন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, সার্কের আগামী মহাসম্মেলনে তারা আমাদের অনুমোদনের ব্যাপারটি ঘোষণা দেবেন।”

গত ৩ জানুয়ারি রাত পর্যন্ত ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা গেলেও, এরপর থেকে সেটিতে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না।

ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ এবং ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই জানিয়ে সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা তো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করি না, আমরা নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করি। তারপরও এই দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। আমি দেশের অনেকগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষকারী প্রতিষ্ঠানকে চিনি। তবে এদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই।”

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতী-র নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ বলেন, “আমরা এদেরকে সত্যিই চিনি না। ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম নামে এর আগে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তবে, আমার ধারণা এবার এরকম একটি মোর্চা তৈরি করা হয়েছে। এরা নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বলছে, কিন্তু এরা আর কোথাও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে কী না সেটি আমার জানা নেই।”

এই দুটি সংস্থার ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “আমার জানা মতে, তারা এবারই বোধহয় প্রথম বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। এর আগে যদি তারা পর্যবেক্ষণ করতো, তাহলে আমাদের সঙ্গে দেখা হতো।”
  • কার্টসিঃ The Daily Star /Bangla/Jan 8, 2019 

BoP deficit rises to $837m in July-Nov

Bangladesh's overall balance of payment (BoP) recorded US$ 837 million deficit during the July-November period of this fiscal year (FY), 2018-19, over the corresponding period of the previous fiscal. The overall deficit in BoP was $479 million during the same period of FY 2017-18, according to the central bank's data.

Sharp fall in the country's financial account and capital account surplus were primarily responsible for the BoP widening.

The volume of financial account surplus almost halved to nearly $2.06 billion during the first five months of the current fiscal from $4.09 billion in the matching period of last fiscal, the Bangladesh Bank (BB) data revealed.

Besides, the amount of capital account surplus dropped to $49 million during July-November of FY 19 compared to $94 million in the same period of last FY, according to the BB figures.

Meanwhile, the country's overall trade deficit narrowed down further to $6.66 billion during the first five months of the current fiscal. The trade deficit was nearly $7.61 billion during the July-November period of FY 18, the BB data showed.

Higher growth in the country's merchandise exports than that of imports reduced the country's overall trade deficit during the July-November period of FY 19.

Bangladesh's aggregate exports grew by 16.75 per cent to $16.77 billion during the first five months of FY 19 compared to $14.36 billion in the corresponding period of last FY.

On the other hand, the country's overall imports posted a 6.64 per cent growth to reach $23.43 billion in the first five months of the current fiscal against $21.97 billion in the same period of last fiscal, according to the BB data.

The country's service trade gap was $1.26 billion against in the said period of FY 19 compared to that of $2.0 billion in the matching period of last FY.
  • Courtesy: The Financial Express /Jan 08, 2019

Tax-GDP ratio concerning

EDITORIAL

Country's declining tax-GDP ratio, practically since 2017, has been   paradoxical  and   concerning    but is  not   inexplicable, to be sure. On the face of it, this   appears   ironic and defiant of conventional wisdom that the rising gross domestic product (GDP) growth rates have not yielded increased   tax revenue. This only goes to show that economic growth  does not  automatically  generate tax  revenue; it requires  serious  mobilisation   efforts  backed by an efficient    tax administration  dedicated  to collect  revenue from a  widely  cast   tax-net. At present, the direct tax regime, potentially the biggest source of revenue collection, is weak.

The focus is on the introduction of wealth and property tax on the one hand, and VAT Act and Customs Act, on the other. Since many people now block their wealth in real estate properties and lands, the rationale for wealth and property tax commends itself. It will also help bridge rising income inequalities, something which have been brought to the fore by the latest household income-expenditure survey. Now coming to the two laws in animated ferment for a long time viz. the VAT Act and Customs Act, they have been much-talked-about but not acted on, apparently for lack of political will. Many now expect to see them through with election having saddled the new government with a landslide mandate. The VAT Act of 2013 estimated a potential earning of TK. 200 billion (20,000 crores).       

Tax evasion,  flight of capital  and  inflated   Swiss account   point  to  lost  wealth  for the nation, but  not wasted  because  the   potential  remains  to encourage   them to plough  back  some of those   resources  into  productive  investments. This can be linked to non-resident Bangladeshi (NRB) initiative or to programme for poorer Bengali diaspora uplift. The declining tax-GDP ratio  is  taking place at a time  when  mobilisation of domestic resources  is  pivotal to achieving the sustainable development goals (SDGs). It is really a wake-up call  inasmuch as  on certain SDGs we  are  lagging behind  in the face of the  deadline  to meet a whole lot of  the goals  by 2030. The outlook  is  also concerning  overall  because  the  targeted  increase in  tax-GDP ratio up to  5.4 per cent  by 2020 --in the seventh five-year plan period  --  stood at 2.7 per cent in 2018 at  the halfway mark. So  a  key macro-economic indicator  of   internal  resource  mobilisation  stagnates  and an inherent  potential   for wealth creation  remains  untapped.

The underlying causes of the failure to mobilise internal resources are revealed in a glaring light. Bangladesh   is   the   second   fastest growing  economy   in  Asia, priding itself  on a low-middle  per capita  income  bracket,  with   a high-income upper  five-ten  per cent  people  the size of some East European  countries, and yet  it is   among   the least  tax-paying nation in the world. By some account, at least 30 per cent of the   population can be brought under effective income tax network. That would have greatly facilitated faster progress well   beyond the basic needs regime. It would not only befit our status as low-middle income country but also help with the transitional adjustments that entail a parting cost. 

  • Courtesy: The Financial Express/ Jan 08, 2019     

জাতীয় নির্বাচন - জেতার জন্য এত কিছুর দরকার ছিল কি?

আনু মুহাম্মদ

দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও গবেষকেরা জিজ্ঞাসা করেন, ‘নতুন’ সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা কী? কী জবাব দেব? কী প্রত্যাশার কথা জানাব? এটা ঠিক যে আমরা চাই না দেশের আগামী সরকারও নদী, পাহাড়, বন দখলকারী, সাম্প্রদায়িক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হোক। আমরা চাই, আগামী সরকার ত্বকী, তনু, দীপন, নিলয়, সাগর-রুনিসহ আরও অনেক শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষের খুনিদের বিচার করবে। ক্রসফায়ারের নামে খুন, গুম, আর পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে যৌন নিপীড়ন-ধর্ষণের অবাধ ধারা বন্ধ করবে। প্রতিবাদী কিশোর-তরুণদের দমন করতে হেলমেট আর হাতুড়ি বাহিনী জন্ম নেবে না। উন্নয়নের নামে প্রাণ–প্রকৃতিবিনাশী প্রকল্প হবে না, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প আর দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্প বন্ধ হবে। সরকার সাম্প্রদায়িকতা আর জাতিবিদ্বেষ দূর করায় সক্রিয় থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিবাজ, অদক্ষ, তোষামোদিদের আড্ডাখানায় পরিণত হবে না। সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, তার নামে বৈষম্য, অবিচার ও গণতন্ত্র হরণের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে না। এসব প্রত্যাশা কি এই ‘নতুন’ সরকারের কাছে রাখার কোনো উপায় আছে, যেখানে এই সব কটিতে এ সরকারেরই আগের পর্বে প্রধান ভূমিকা ছিল?

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে নির্বাচন নিয়ে একটা উচ্ছ্বাস তৈরি করা হয়েছিল। তবে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে সরকারের ভাবগতিক দেখে সবার মধ্যে এই ধারণা জোরদার হয়েছিল যে নির্বাচনের ফলাফল সরকারই নির্ধারণ করবে। তবে কী ফলাফল সরকার নির্ধারণ করতে চায়, তা নিয়ে বিভিন্ন মত ছিল। একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে সরকার অন্তত ২০০ আসন দলের দখলে রাখতে চেষ্টা করবে। বাকি ১০০ আসন নিজেদের শরিক ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গেলে তাদের আপত্তি থাকবে না। সরল মনে প্রশ্ন আসবে, এভাবে নির্বাচন হয় নাকি? এটা কী করে সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে, এ রকম ফলাফল সম্ভব করার জন্য যে বহুদিন ধরেই খুবই গোছানো পরিকল্পনায় কাজ হয়েছে, তা ঠিকই বোঝা গেছে। 

বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা পিআর এজেন্সিসহ দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করেছে। এসব কাজের কয়েকটি দিক ছিল প্রধান: প্রথমত, সরকারের সাফল্য এবং বাংলাদেশের জন্য আওয়ামী লীগের অপরিহার্যতা প্রচারে যত পথ ও পদ্ধতি আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার। দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে একদিকে পচানো, অন্যদিকে তার নড়াচড়ার ক্ষমতা বন্ধ করা। একদিকে হামলা, মামলা ও আটক করা, অন্যদিকে নিজেদের প্রচার বেগবান করা। তৃতীয়ত, প্রচারের মাধ্যমগুলোকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে রাখা। টিভি টক শো, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, ফেসবুক যাতে সরকারের পক্ষে থাকে তার জন্য আইনি–বেআইনি সব পথ গ্রহণ। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ তার একটি। চতুর্থত, সব প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা। পঞ্চমত, সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ।

নির্বাচনী প্রচারকালে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত আমরা একই দৃশ্য দেখেছি। সবার জন্য সমান সুযোগের কথা নির্বাচন কমিশন বলেছে, কিন্তু নেতা-কর্মী-ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-দল-মত-বয়সনির্বিশেষে নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে, উৎসবমুখর পরিবেশে একমাত্র সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষেই প্রচারণা চালানো সম্ভব ছিল। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে আমি আমার এলাকাতেও শুধু সরকারি দলের মিছিল ও পোস্টার দেখেছি। শুনেছি তাদের সুন্দর সুন্দর গান, ভুভুজেলার আওয়াজ আর বেতার-টিভিতে বিজ্ঞাপনী প্রচার। দেখেছি, শুনেছি সারা দেশে সরকারি দলের বাইরে বহু প্রার্থী এবং তাঁদের নির্বাচনী প্রচার আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার করেছে, অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রশাসন ও পুলিশ সদা সক্রিয় ছিল, সর্বাত্মক সহযোগিতায় ছিল নির্বাচন কমিশন। এ রকম ভিডিও অনেক পাওয়া যাচ্ছে, আমিও একাধিক দেখেছি, যেখানে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারদলীয় সমাবেশে বক্তারা সরাসরি কর্মসূচি ঘোষণা করছেন নৌকা ছাড়া অন্য সব প্রার্থী ঠেকানোর, হুমকি দিচ্ছেন নৌকা ছাড়া অন্য কোথাও ভোট দিলে ভয়াবহ পরিণতির। অবিরাম হামলা, মামলা, হুমকি আর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে সরকারি দলে নিশ্চিন্ত অবস্থা, উৎসবমুখর পরিবেশ, আর তা ছাড়া বাকি সবার জন্য উৎসবের বদলে ভয়ের পরিস্থিতি এটাই ছিল নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে আড্ডা ও তর্কপ্রিয়, রাজনীতিমনস্ক এবং নিজের মতপ্রকাশে আগ্রহী। নির্বাচনের সময় তাই দেশজুড়ে বিশাল আড্ডা, তর্ক-বিতর্কের আবহাওয়া, চায়ের দোকান, ফার্মেসিসহ সর্বত্র জমজমাট আলোচনা আমাদের খুব পরিচিত দৃশ্য। এবারের নির্বাচনে এই দৃশ্য ছিল না। শুধু নৌকার পক্ষেই আসর বসেছে, তা–ও প্রতিপক্ষ না থাকায় সেগুলোও জমেনি। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল নির্বাচনের আগের রাত থেকে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যাচ্ছে: কোনো কোনো কেন্দ্রে আগের রাতে বা ভোট গ্রহণের আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। অভিযোগ হলো, এর মধ্য দিয়ে ৩০ শতাংশ ভোট আগেই নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট, সমর্থক, ভোটারদের কেন্দ্রের আশপাশে আসার পথে বাধা দেওয়া হয়েছে। আক্রমণ, হুমকি, ধরপাকড়—সবকিছুই কাজে লাগানো হয়েছে। তৃতীয়ত, দিনের বেলা বিভিন্ন সময় সরকারি দলের কর্মীরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে মেরে বাক্স ভরেছে। আমি দেখেছি, আমার ভোটকেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা সকাল থেকেই খুব কম ছিল, সারা দিনে ২০ শতাংশের বেশি হয়েছে বলে মনে হয় না। চারদিকে শুধু সরকারি দলের পোস্টার আর কর্মীরা। এলাকায় আশপাশের কেন্দ্রগুলোতে অবস্থা একই রকম দেখেছি। প্রার্থী ৮ থেকে ১০ জন হলেও কোথাও কোথাও পোলিং এজেন্ট একজন।

ফলাফল দেখে বোঝা গেল, সরকারের যে প্রস্তুতি ছিল, সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মিলিত আয়োজন যা ছিল, তাতে আগে পরিকল্পনা থাকলেও বিজয় ২০০ বা ২২০ আসনে গিয়ে থামতে পারেনি। সরকারি দলের পক্ষে ভোটসংখ্যাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। উল্লিখিত সবার সম্মিলিত চেষ্টায়, উৎসাহে, পরিশ্রমে মোট ভোটের সংখ্যা এবং সরকারি দলে প্রাপ্ত ভোটের হার—দুটোই অস্বাভাবিক বেশি হয়েছে। এগুলো করতে গিয়ে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কোনো প্রার্থী অস্বাভাবিক কম এমনকি শূন্য ভোট পেয়েছেন।

নির্বাচনে বিজয়ের জন্য কি আওয়ামী লীগের এত কিছু দরকার ছিল? আগে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, প্রচারে যে একাধিপত্য তৈরি হয়েছিল, তাতে ভোটের দিন এসব কাণ্ড না করলেও আওয়ামী লীগ জিততে পারত। কিন্তু জনগণের মুখোমুখি হতে তারপরও ক্ষমতাসীন দল ভয় পেয়েছে। সে জন্যই এই ঘটনা ঘটল। রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দমন করে এ রকম একতরফা নির্বাচন সরকারি দলের শক্তি প্রমাণ করে না; বরং এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়া এই দল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। এ রকম একটি শক্তিশালী দল, যার উল্লেখযোগ্য জনসমর্থনও আছে, তার এই করুণ দশা হলো কেন, সেটাই এক বড় প্রশ্ন।

সন্দেহ নেই, ২০১৪ সালের পর এবারের নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের জন্য আরও খারাপ নজির হয়ে থাকল। তাতে অবশ্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু আসে–যাবে বলে মনে হয় না। কেননা, সরকারের কাছে, তার দেশি–বিদেশি সহযোগীদের কাছে ক্ষমতাই আসল। পথ ও পদ্ধতি বৈধ কি অবৈধ, নৈতিক কি অনৈতিক, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান বিনাশে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ফলাফল কী, সেসব বিবেচনার গুরুত্ব খুব কম।

  • আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অথনীতি বিভাগের অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জানু ৮, ২০১৯ 

কৃষকের জমি দখল করে ‘বঙ্গবন্ধু সুপার মার্কেট’


জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া কালিবাড়ি বাজার সংলগ্ন এক ভূমিহীন কৃষকের লিজ নেয়া ফসলি জমি দখল করার অভিযোগ উঠেছে। রাতারাতি দখল করা ওই জমিতে ‘বঙ্গবন্ধু সুপার মার্কেট’ নাম দিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে।

কেন্দুয়া কালিবাড়ি বাজারের কুলি ভূমিহীন কৃষক বৃদ্ধ আব্দুর রহমানের অভিযোগ, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৪৫ শতাংশ কৃষি জমি ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে ধান চাষ করে সংসার চালাতেন তিনি। ৩ দিন আগে রাতের অন্ধকারে স্থানীয় প্রভাবশালী দুর্বৃত্তরা তার লিজ নেয়া জমি জোরপূর্বক দখল করেছে। দখল করা রেলের ওই জমিতে ‘বঙ্গবন্ধু সুপার মার্কেট’ নাম দিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে।

একজন কৃষকের জমি জবর দখল করার ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জমি ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বৃদ্ধ আব্দুর রহমান।

  • কার্টসিঃ জাগোনিউজ/ জানু ৮, ২০১৯ 

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও সুশাসনই চ্যালেঞ্জ

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাই নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি এবং উদার গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে বিরোধীদের আস্থায় নেয়ার বিষয়টিকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে নতুন সরকারকে। সাবেক মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী বলেন, সরকারের এই বিপুল জয় এটাই তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এ ধরনের জয় সাধারণত প্রচলিত এবং আমাদের পরিচিত গণতন্ত্রে অত্যন্ত বিরল ব্যাপার। সংসদে কোনো সক্রিয় বিরোধী দল থাকবে না। ফলে সেখানে এক ধরনের প্রবল একাত্মবাদ চলতে পারে। এবং সেভাবে যদি তাদের কাজকর্ম অগ্রসর হয় তাহলে সরকারের সত্যিকার গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া বিরল ও দুরূহ হতে পারে। 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নতুন সরকারের সামনে নির্বাচনী ইশতেহারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এই ইশতেহারের সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশা জড়িত। এ ছাড়া দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশে উদার রাজনীতির ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, নতুনদের কাছে প্রত্যাশা তারা পুরনো মনোবৃত্তি থেকে বের হয়ে আসবে। আর পুরনো কিছু অভিজ্ঞ মন্ত্রীরা রয়েছেন, নতুন পুরাতনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কাজ করতে হবে। তবে ভালোই হবে বলে মনে করছি।

শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, প্রথমত তাদের ইশতেহারে যা যা লেখা আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ মানুষের মনে যে আশা তারা দিয়েছে সেটা ইশতেহারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদিও আমি মনে করি ইশতেহারের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক থাকে না। তারপরও তারা যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ উঠেছে সে অভিযোগ যাতে আর না উঠে সে ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুস্থ করা। বিরোধী পক্ষের ওপর অকারণে হামলা, গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা যাতে দেয়া না হয়। এটা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মানুষ উন্নয়ন চায়, পাশাপাশি গণতন্ত্র চায়। সেই গণতন্ত্র নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন অর্থবহ হবে না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, সরকার ও দল যেন এক না হয়ে যায়।

এটি সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে আমাদেরকে। প্রশাসন দলের হয়ে কাজ করে এটি বড় ক্ষতি করে গণতন্ত্রের। আমি মনে করি দলের কোনো সভা গণভবনে হওয়াটা অনুচিত। দলের সভা হবে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। সরকার-দল সব এক হয়ে গেছে মন্তব্য করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, গণতন্ত্র এখানেই হোঁচট খেয়েছে। যার কারণে প্রশাসন পুলিশ অনেক সময় সরকারের কাজ করতে গিয়ে দলেরই কাজ করে। এটা থেকে বের হতে হবে। নতুনদের ওপর প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাই ভেবে নিয়েছে পুরাতনরা যা করতে পারেনি নতুনরা তা করে দেখিয়েছে। পুরাতনরা ভালো কাজ করেছেন, কিন্তু সেটা একটা মাত্রায় এসে আটকে গেছে। যেমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি মাত্রায় গিয়ে ঘুরে ফিরে আবার পেছনের দিকে চলে এসেছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখন আনন্দ বঞ্চিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে গেল। কোচিং বাণিজ্যসহ নানা বাণিজ্যের মধ্যে পড়ে সত্যিকারের পড়ার উৎসাহ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই তরুণরা যারা আসবেন তাদেরকে এই জিনিসগুলো মাথায় রেখে দুর্বলতা, অপূর্ণতাগুলোকে ভরাট করতে হবে। এটিকেও আমি চ্যালেঞ্জ মনে করি। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা আমি মনে করি রাজনৈতিক। এবং সেটা হচ্ছে অভূতপূর্ব নির্বাচন এবং অভূতপূর্ব ফলাফল। বিশেষ করে অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেটাকে ম্যানেজ করা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এবং বিশেষ করে এই জন্য যে এই প্রেক্ষিতে জবাবদিহিতার সম্ভাব্য যে ক্ষেত্র সেটা একেবারেই সংকুচিত ও নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তারা যদি ক্ষমতাটাকে মনে করেন নিজেদের সম্পদ বিকাশের সোপান। এবং এই মানসিকতা নিয়ে যদি মন্ত্রিত্বের ভূমিকা পালন করেন সেটাও একটি চ্যালেঞ্জ। যেটা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে  সাংঘর্ষিক হবে। দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি তা হলো প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। যেটা তাদের ইশতেহারে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। এবং যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কাজেই যে আইনগুলো মতপ্রকাশ এবং বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ সেই আইনগুলোকে সংসদে সংস্কার করে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। 
  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ জানু ৮,২০১৯ 

আ'লীগের বীভৎসতায় এখনো আঁতকে ওঠেন নির্যাতিতা

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সুবর্ণচরে  গণধর্ষণের আসামি আবু ও সালাউদ্দিন গতকাল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে তারা জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নির্দেশে লাঞ্ছিত করার জন্য ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বেও আমাদেরকে দিয়ে এ ধরনের আরো অনেক অপকর্ম করানো হয়েছে। না করলে বনদস্যু-জলদস্যু কেউ এলাকায় থাকতে পারবে না শীর্ষ সন্ত্রাসী রুহুল আমিনের ভয়ে। একবার অপারগতা প্রকাশ করলে বাড়িঘরে হামলা করা হয়। আমরা বাঁচার তাগিদে এই জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছি। 

আদালত সূত্র জানায়, ধর্ষিতার পোস্ট ট্রমাটি স্টেচ ডিজ অর্ডার (পি.টি.এস.ডি) হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নবনীতা গুহ হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করেন। ধর্ষিতা জানান, কোর্টের হাকিমকে মহিলা পেয়ে আমি ধানের শীষে ভোট দেয়ায় আমার ওপর কী অত্যাচার করেছে সব কথা বলেছি, যারা আমাকে ধর্ষণ করেছে তাদের সবার নাম বলেছি।সেই দিনের বীভৎসতার কথা, যা এখনো মনে হলে আঁতকে উঠি। 

চরাঞ্চল ঘুরে জানা গেছে, ভোটের রাতে গণধর্ষণের ঘটনায় এই আলোচিত ওসি মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক মেম্বার রুহুল আমিন এবং ধানের শীষে ভোট দেয়ার তথ্য-উপাত্ত বাদ দিয়ে গণধর্ষণ মামলা রেকর্ড করে। এ নিয়ে স্থানীয় জনমনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ চলছে। 

সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য ব্যাগ্যা গ্রামে গৃহবধূ গণধর্ষণের ওই রাত থেকে পলাতক ছিল মামলায় এজাহারভুক্ত ৭ নং আসামি আবুল (৪০)। এর মধ্যে মাঝে মাঝে স্ত্রী ছেমনা খাতুনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতো আবুল। ঘটনাটি নিয়ে যখন চারদিকে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় তখন পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। 

এরপর ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। তখন ছেমনা তার স্বামী আবুলকে সেই সব বিষয়ে অবগত করেন এবং নিজ থেকে এসে পুলিশে ধরা দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আবুল তাতে কর্ণপাত করেনি। গত ২/৩ দিন ধরে ছেমনা স্বামীকে বলেন- স্বেচ্ছায় পুলিশে ধরা না দিলে তার ফাঁসি হয়ে যাবে। এর সূত্র ধরে, রোববার বিকালে ছেমনা তার স্বামী আবুলকে দেখা করার জন্য আটকপালিয়া বাজারে আসতে বলে। স্ত্রীর কথামতো বিকাল ৫টার দিকে ওই বাজারে আসে আবুল। এসময় ছেমনা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় কৌশলে আবুলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

চরজব্বার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ইব্রাহিম খলিল জানান, আবুলের স্ত্রীর সহযোগিতায় আটকপালিয়া বাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে এই মামলার এজাহারভুক্ত ৭নং আসামি। সুবর্ণচরে গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার আরো ২ ধর্ষক। অভিযুক্ত আরো দুই আসামি নোয়াখালীর সেনবাগে গ্রেপ্তার মামলা গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য ব্যাগ্যা গ্রামে ৩০শে ডিসেম্বর ধানের শীষ মার্কায় ভোট দেয়ার ঘটনায় স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে ৪ সন্তানের জননী গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আরো দুই আসামি মুরাদ (৩০), ইব্রাহিম খলিল প্রকাশ বেচু (৪০)কে সেনবাগ থেকে গ্রেপ্তার করেছে নোয়াখালী গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।  রোববার ৬ই জানুয়ারি সন্ধ্যার সময় নোয়াখালী গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি’র) ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেনের নেতৃত্বে সঙ্গীয় পুলিশ ফোর্স গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের নুরুল আমিনের (এম.পি.ডি) ব্রিকফিল্ডে অভিযান চালিয়ে সুবর্ণচরের মধ্যব্যাগ্যা গ্রামের মো. রফিকের ছেলে মুরাদ তাকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে গত ৩রা জানুয়ারি অপর এক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত অপর আসামি ইব্রাহিম খলিল প্রকাশ বেচু, একই উপজেলার আরিফের ব্রিকফিল্ড থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই নিয়ে শনিবার রাত থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ আলাদা অভিযান চালিয়ে ধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করলো। এ পর্যন্ত সর্বমোট ১০ জন গ্রেপ্তার হলো। গ্রেপ্তার হওয়া অপর দুইজন হচ্ছে মধ্যব্যাগ্যা গ্রামের টোকাইয়ের ছেলে সালাউদ্দিন ও একই গ্রামের সেরু মিয়ার ছেলে আবুল। এরই মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত ৭ জনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেছেন- নোয়াখালীতে গণধর্ষণের ঘটনাকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ গুরুত্বের কারণেই কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার অ্যাকশন নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ১০ আসামিকে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী সকল আসামি ধরা পড়বে এবং আইনানুগভাবেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সোমবার সকালে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুবর্ণচর উপজেলার মধ্যব্যাগ্যা গ্রামে গণধর্ষণের শিকার গৃহবধূর খোঁজখবর নেন বিভাগীয় কমিশনার।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পাঙ্খার বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারীদের নিরাপত্তা দাবি ও গণধর্ষণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে উপজেলা ভূমিহীন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন উন্নয়ন সংস্থা নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবির। উপজেলা ভূমিহীন সংগঠনের সভাপতি ছেরাজুল হক খোকনের সভাপতিত্বে ও পাঙ্খারবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা আক্তারের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মানবাধিকার আইনজীবী সমিতির নির্বাহী সদস্য এড. সালমা আলী, ভূমিহীন নেতা শাহানা আক্তার, ইব্রাহিম খলিল ও নুর উদ্দিন, পাঙ্খারবাজার জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসেন বাবুল, ভূমিহীন অঞ্চল কমিটির সমন্বয়ক খোদেজা বেগম, গণধর্ষণের শিকার পারুল বেগমের ওয়ার্ডের পুরুষ মেম্বার খলিল উল্যাহ, মহিলা মেম্বার আমেনা বেগম, ভুক্তভোগী অর্থসম্পদ ও সতীত্বহরণকারী ২৫ জন নারী মিনা, রহিমা, আয়েশা, মনোয়ারা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। প্রধান অতিথি সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী-ধর্ষকদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান। সমাবেশে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো নারী-পুরুষ সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। 

সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা গণধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি করেন। একই সঙ্গে স্বাধীন দেশে নারীদের নিরাপত্তার দাবি করেন। নিজেরা করি এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক খুশি কবির ডিসি, এসপি’র সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা করে গণধর্ষিতাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর অনুরোধ করেন। এদিকে বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের সভাপতি ও জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া’র শাইখুল হাদিস মাওলানা মামুনুল হক গতকাল সোমবার সকাল ১১টার দিকে যুব মসলিসের নেতাকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে যান। এসময় তিনি ভিকটিমের সুচিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে প্রকৃত আসামিদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে নরপিশাচদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।  

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ জানু ৮,২০১৯ 

আন্দোলনের ‘কৌশল’ নির্ধারণে বিকেলে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক


নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে ‘আন্দোলনের কৌশল’ খুঁজছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তবে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশ করার মাধ্যমেই এই দাবি আদায়ের পক্ষে তারা। 

আর আন্দোলনের কৌশল-কর্মসূচি নির্ধারণ করতে মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারি, বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি। বিকেল ৪টায় রাজধানীর বেইলি রোডের ফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। 

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দফতর প্রধান জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বৈঠকে ড. কামাল হোসেন ছাড়াও থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও ফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

ঐক্যফ্রন্টের একটি সূত্র জানিয়েছে, সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমপি নির্বাচিতদের শপথ নিয়ে সিদ্ধান্ত ও নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি নির্ধারণে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ফ্রন্টের ঐক্য যেন বজায় থাকে সে বিষয়েও তাগিদ দেওয়া হবে বৈঠকে। পরে সাংবাদিকদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন নেতারা।

Monday, January 7, 2019

সংসদ সদস্যদের শপথ অসাংবিধানিক

শহীদুল্লাহ ফরায়জী


বাংলাদেশের সংবিধান সংসদের মেয়াদ ৭২ (৩) মোতাবেক ৫ বৎসর  নিশ্চিত করেছে। সংবিধান মোতাবেক সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার ক্ষেত্রে দুইটি পন্থা অনুসরণীয় ১. মেয়াদ অবসানের কারণে ২. রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মেয়াদ অবসান ব্যতিত ভেঙ্গে দেওয়া।

বাংলাদেশের দশম সংসদ রাষ্ট্রপতি ভেঙ্গে দেন নি। ফলে দশম সংসদ ২৮শে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত সাংবিধানিক ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু দশম সংসদের মেয়াদ সমাপ্তির আগেই একাদশ সংসদের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। যা সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন। বিশ্বের কোন দেশে সংসদের মেয়াদ সমাপ্তি না করে পরবর্তী সংসদের কার্যক্রম শুরু হয় না। শুধু বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। আওয়ামী লীগ সরকার প্রবর্তিত সংবিধানের ১২৩(৩)ক মোতাবেক দশম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দুবারই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে নির্বাচন কমিশন

দশম সংসদের মেয়াদ অক্ষুন্ন রাখার শর্তে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানের ১২৩(৩)ক মোতাবেক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১২৩(৩)ক মোতাবেক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে। এই শর্ত পূরণের ভিত্তিতেই যেহেতু একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাই এ শর্ত পূরণ  অপরিহার্য- এই শর্ত অলঙ্ঘনীয়।

১২৩(৩)ক তে বলা হয়েছে, “মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে... তবে শর্ত থাকে যে এই দফার (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগন, উক্ত উপদফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্য রূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।” অর্থাৎ দশম সংসদের মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত একাদশ সংসদ কার্যভার গ্রহণ করতে পারবে না। এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা - এই নির্দেশনা একাদশ সংসদের নির্বাচিতগণ ও প্রজাতন্ত্রের সরকার মানতে বাধ্য। নির্বাচন কমিশন ২৮শে জানুয়ারির পূর্বে একাদশ সংসদের কার্যক্রম শুরু বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন না। একাদশের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা গেজেট প্রকাশ সব হবে ২৮শে জানুয়ারির বিবেচনায়, যাতে দশম সংসদের মেয়াদ ক্ষুন্ন না হয়। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ১৪৮(২)ক মতে যদি ২৮শে জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করতো, তা হতো সংবিধান অনুসরণে। সংবিধানের যে শর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তা অনায়াশে লঙ্ঘন করে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার।

সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও ২৮শে জানুয়ারির পূর্বেই তড়িঘড়ি করে শপথ গ্রহণ ও সরকার গঠন করা হবে অসাংবিধানিক। সাংবিধানিকভাবে একাদশ সংসদের শপথ ও সরকার গঠন অবশ্যই হতে হবে ২৮শে জানুয়ারির পর। এর ব্যতয় ঘটলে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।  

এই আইন ভঙ্গ করার কোন সাংবিধানিক এক্তিয়ার রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানের নেই। নির্বাচন কমিশনও কোন সংসদের মেয়াদকে সীমিত করতে পারে না। দশম সংসদের মেয়াদ একদিনের জন্য সীমিত করার ক্ষমতা সরকার বা একাদশ সংসদের নেই।  

যেহেতু ১২৩(৩)ক অনুযায়ী একাদশ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেহেতু সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। যেহেতু দশম সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া হয় নি তাই এর মেয়াদ অবসানের আগে একাদশ সংসদ সদস্যদের শপথ বা সরকার গঠনের  সাংবিধানিক এক্তিয়ার নেই।

১২৩(৩)ক শর্ত যুক্ত অনুচ্ছেদটি আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এক সংসদের মেয়াদ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আরেক সংসদের শপথ সংবিধান ও সংবিধানের চেতনার সঙ্গে চরম সাংঘর্ষিক। 

সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য হিসাবে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা রয়েছে। যদি ১২৩(৩)ক এর শর্ত লঙ্ঘিত হয় তাহলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২, ৯৩, ৯৮, ১১৮, ১৩৩, ১৩৫, ১৩৮, ১৪১, ১৪২, ১৪৫, ১৪৭ ও ১৫৩ অনুচ্ছেদের সকল শর্ত অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে রাষ্ট্র ও সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে পড়বে।

ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড.আম্বেদকর বলেছেন, “সাংবিধানিক আইনকে সাংবিধানিক নৈতিকতার একটি বুনিয়াদের উপর ভর করতে হয়।  ড.আম্বেদকর মতে, সাংবিধানিক নৈতিকতা স্বাভাবিক অনুভূতি নয়। এটা চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। যতই সতর্কভাবে সংবিধান রচিত হোক না কেন, সাংবিধানিক নৈতিকতার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের ক্রিয়া পদ্ধতি স্বেচ্ছাচারী, অযৌক্তিক ও খামখেয়ালী (arbitrary, erratic and capricious) হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আইনপ্রণেতা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সাংবিধানিক নৈতিকতার অনুপ্রবেশ না ঘটলে সংবিধানটি  ক্ষমতার দালালদের হাতের খেলনা হয়ে দাঁড়ায়।” আমাদের সংবিধান লঙ্ঘন ও উপেক্ষা করার মধ্যমে ক্ষমতাসীনদের হাতের খেলনায় পরিণত হচ্ছে।

২৮শে জানুয়ারির পূর্বে একাদশ সংসদ সদস্যদের শপথ এবং সরকার গঠনের দ্রুত উদ্যোগ হবে অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক।

সংবিধানের প্রাধান্য, নির্দেশনা, বিধি বিধান, শর্ত লঙ্ঘন করে সংবিধানকে সরকারের অনুকূলে ব্যবহার করার প্রবণতা সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিবে।

সংবিধান ও সংবিধানিক চেতনাকে অস্বীকার করে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না বরং ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মাকে ক্রমাগতভাবে অসম্মান করা হবে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রনায়কদের এই মুহূর্তেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ জানু ৭, ২০১৯ 

গায়েবি মামলা তুলে নিন

সম্পাদকীয়

নির্বাচন–পরবর্তী পরিস্থিতি


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ইতিমধ্যে নবনির্বাচিত সাংসদেরা শপথ নিয়েছেন এবং সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু দেশের সবখানে স্বাভাবিক শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসেনি। ভোট গ্রহণের দিন ও তার অব্যবহিত পরের দিনগুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিহিংসামূলক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। সেসবের মধ্যে ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধও আছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ‘ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে’ এক নারীকে আওয়ামী লীগের লোকজন গণধর্ষণ করেছেন—এই অভিযোগের খবরে সৃষ্ট চাঞ্চল্য ও প্রতিবাদ জাতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো অব্যাহত আছে।

এ ধরনের ঘটনা রাজনীতি বা নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসেবে ঘটে থাকলেও এগুলোর সামাজিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে। সরকারি প্রশাসন তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের জরুরি দায়িত্ব এ ধরনের প্রবণতা দমন করা এবং সংঘটিত অপরাধগুলোর আইনি প্রতিকারের লক্ষ্যে যথাযথভাবে আইন প্রয়োগে তৎপর হওয়া।

সুবর্ণচরের ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে—এটা নির্বাচনের পরে সংঘটিত অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রথম দৃশ্যমান পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে অন্তত এটা মনে হতে পারে যে এসব অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীসহ আরও যাঁদের মনে প্রতিহিংসামূলক অপরাধ সংঘটনের ভাবনা ক্রিয়াশীল রয়েছে, সুবর্ণচরে পুলিশের এই সক্রিয়তা থেকে তাঁদের কাছে এমন বার্তা যেতে পারে যে অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। সারা দেশে এ রকম বার্তা পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সে জন্য প্রয়োজন নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং তার পরের দিনগুলোতে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আইন প্রয়োগের সংস্কৃতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। একদিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীরা তাঁদের রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য এমন অপরাধের অভিযোগে মামলার শিকার হন, যেসব অপরাধ তাঁরা আদৌ করেননি। হাজার হাজার ‘গায়েবি মামলা’ করা হয়েছে, সেগুলোর আসামি করা হয়েছে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীকে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা–উপজেলায় বিএনপির অনেক নেতা–কর্মীর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ডজন ডজন ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। বিএনপির একই নেতার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে, এমন দৃষ্টান্তও কম নয়।

নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও সারা দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীদের পুলিশি হয়রানি বন্ধ হয়নি। ইতিমধ্যে দায়ের করা মামলার আসামির তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা নেওয়ার অভিযোগ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া যাচ্ছে। যেসব রাজনৈতিক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, তাঁরা ঘরে ফিরতে পারছেন না। যাঁরা নির্বাচনের পর ঘরে ফিরেছেন, তাঁরাও মামলার কারণে পুলিশি হয়রানির শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। এই মানুষগুলোর পরিবারে স্বস্তি ফিরে আসেনি।

রাজনৈতিক স্বার্থে আইনের ব্যবহার আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। শুধু তা–ই নয়, এর ক্ষতিকর প্রভাব সামাজিক সম্পর্কের অত্যন্ত গভীরে যেতে পারে। রাজনৈতিক মত পোষণ করা এবং রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ আইনের বেআইনি প্রয়োগের শিকার হলে সামাজিক সংহতি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করা ও বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীদের ভিত্তিহীন অভিযোগে পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জানু ৭, ২০১৯