চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সুবর্ণচরে গণধর্ষণের আসামি আবু ও সালাউদ্দিন গতকাল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে তারা জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নির্দেশে লাঞ্ছিত করার জন্য ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বেও আমাদেরকে দিয়ে এ ধরনের আরো অনেক অপকর্ম করানো হয়েছে। না করলে বনদস্যু-জলদস্যু কেউ এলাকায় থাকতে পারবে না শীর্ষ সন্ত্রাসী রুহুল আমিনের ভয়ে। একবার অপারগতা প্রকাশ করলে বাড়িঘরে হামলা করা হয়। আমরা বাঁচার তাগিদে এই জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছি।
আদালত সূত্র জানায়, ধর্ষিতার পোস্ট ট্রমাটি স্টেচ ডিজ অর্ডার (পি.টি.এস.ডি) হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নবনীতা গুহ হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করেন। ধর্ষিতা জানান, কোর্টের হাকিমকে মহিলা পেয়ে আমি ধানের শীষে ভোট দেয়ায় আমার ওপর কী অত্যাচার করেছে সব কথা বলেছি, যারা আমাকে ধর্ষণ করেছে তাদের সবার নাম বলেছি।সেই দিনের বীভৎসতার কথা, যা এখনো মনে হলে আঁতকে উঠি।
চরাঞ্চল ঘুরে জানা গেছে, ভোটের রাতে গণধর্ষণের ঘটনায় এই আলোচিত ওসি মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক মেম্বার রুহুল আমিন এবং ধানের শীষে ভোট দেয়ার তথ্য-উপাত্ত বাদ দিয়ে গণধর্ষণ মামলা রেকর্ড করে। এ নিয়ে স্থানীয় জনমনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ চলছে।
সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য ব্যাগ্যা গ্রামে গৃহবধূ গণধর্ষণের ওই রাত থেকে পলাতক ছিল মামলায় এজাহারভুক্ত ৭ নং আসামি আবুল (৪০)। এর মধ্যে মাঝে মাঝে স্ত্রী ছেমনা খাতুনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতো আবুল। ঘটনাটি নিয়ে যখন চারদিকে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় তখন পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়।
এরপর ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। তখন ছেমনা তার স্বামী আবুলকে সেই সব বিষয়ে অবগত করেন এবং নিজ থেকে এসে পুলিশে ধরা দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আবুল তাতে কর্ণপাত করেনি। গত ২/৩ দিন ধরে ছেমনা স্বামীকে বলেন- স্বেচ্ছায় পুলিশে ধরা না দিলে তার ফাঁসি হয়ে যাবে। এর সূত্র ধরে, রোববার বিকালে ছেমনা তার স্বামী আবুলকে দেখা করার জন্য আটকপালিয়া বাজারে আসতে বলে। স্ত্রীর কথামতো বিকাল ৫টার দিকে ওই বাজারে আসে আবুল। এসময় ছেমনা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় কৌশলে আবুলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
চরজব্বার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ইব্রাহিম খলিল জানান, আবুলের স্ত্রীর সহযোগিতায় আটকপালিয়া বাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে এই মামলার এজাহারভুক্ত ৭নং আসামি। সুবর্ণচরে গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার আরো ২ ধর্ষক। অভিযুক্ত আরো দুই আসামি নোয়াখালীর সেনবাগে গ্রেপ্তার মামলা গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য ব্যাগ্যা গ্রামে ৩০শে ডিসেম্বর ধানের শীষ মার্কায় ভোট দেয়ার ঘটনায় স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে ৪ সন্তানের জননী গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আরো দুই আসামি মুরাদ (৩০), ইব্রাহিম খলিল প্রকাশ বেচু (৪০)কে সেনবাগ থেকে গ্রেপ্তার করেছে নোয়াখালী গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রোববার ৬ই জানুয়ারি সন্ধ্যার সময় নোয়াখালী গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি’র) ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেনের নেতৃত্বে সঙ্গীয় পুলিশ ফোর্স গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের নুরুল আমিনের (এম.পি.ডি) ব্রিকফিল্ডে অভিযান চালিয়ে সুবর্ণচরের মধ্যব্যাগ্যা গ্রামের মো. রফিকের ছেলে মুরাদ তাকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে গত ৩রা জানুয়ারি অপর এক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত অপর আসামি ইব্রাহিম খলিল প্রকাশ বেচু, একই উপজেলার আরিফের ব্রিকফিল্ড থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই নিয়ে শনিবার রাত থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ আলাদা অভিযান চালিয়ে ধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করলো। এ পর্যন্ত সর্বমোট ১০ জন গ্রেপ্তার হলো। গ্রেপ্তার হওয়া অপর দুইজন হচ্ছে মধ্যব্যাগ্যা গ্রামের টোকাইয়ের ছেলে সালাউদ্দিন ও একই গ্রামের সেরু মিয়ার ছেলে আবুল। এরই মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত ৭ জনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেছেন- নোয়াখালীতে গণধর্ষণের ঘটনাকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ গুরুত্বের কারণেই কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার অ্যাকশন নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ১০ আসামিকে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী সকল আসামি ধরা পড়বে এবং আইনানুগভাবেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সোমবার সকালে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুবর্ণচর উপজেলার মধ্যব্যাগ্যা গ্রামে গণধর্ষণের শিকার গৃহবধূর খোঁজখবর নেন বিভাগীয় কমিশনার।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পাঙ্খার বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারীদের নিরাপত্তা দাবি ও গণধর্ষণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে উপজেলা ভূমিহীন কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন উন্নয়ন সংস্থা নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবির। উপজেলা ভূমিহীন সংগঠনের সভাপতি ছেরাজুল হক খোকনের সভাপতিত্বে ও পাঙ্খারবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা আক্তারের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মানবাধিকার আইনজীবী সমিতির নির্বাহী সদস্য এড. সালমা আলী, ভূমিহীন নেতা শাহানা আক্তার, ইব্রাহিম খলিল ও নুর উদ্দিন, পাঙ্খারবাজার জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসেন বাবুল, ভূমিহীন অঞ্চল কমিটির সমন্বয়ক খোদেজা বেগম, গণধর্ষণের শিকার পারুল বেগমের ওয়ার্ডের পুরুষ মেম্বার খলিল উল্যাহ, মহিলা মেম্বার আমেনা বেগম, ভুক্তভোগী অর্থসম্পদ ও সতীত্বহরণকারী ২৫ জন নারী মিনা, রহিমা, আয়েশা, মনোয়ারা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। প্রধান অতিথি সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী-ধর্ষকদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান। সমাবেশে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো নারী-পুরুষ সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন।
সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা গণধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি করেন। একই সঙ্গে স্বাধীন দেশে নারীদের নিরাপত্তার দাবি করেন। নিজেরা করি এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক খুশি কবির ডিসি, এসপি’র সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা করে গণধর্ষিতাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর অনুরোধ করেন। এদিকে বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের সভাপতি ও জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া’র শাইখুল হাদিস মাওলানা মামুনুল হক গতকাল সোমবার সকাল ১১টার দিকে যুব মসলিসের নেতাকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে যান। এসময় তিনি ভিকটিমের সুচিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে প্রকৃত আসামিদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে নরপিশাচদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
- কার্টসিঃ মানবজমিন/ জানু ৮,২০১৯
No comments:
Post a Comment