Search

Tuesday, January 29, 2019

৫ বছরে বেওয়ারিশ লাশ ৬২১৩


২০১৮ সালের নভেম্বরের ১ তারিখ। বাংলাদেশের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দাতব্য সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম একটি লাশ ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে উদ্ধার করে। পরে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ প্রাথমিক সুরতহাল করে আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে দিয়ে দেয় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি দাফনের জন্য। 

ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো আরো হাজার খানেক বেওয়ারিশ লাশের মতই। কিন্তু ঘটনার মোড় নেয় যখন আঞ্জুমান মফিদুলের কর্মীরা তাকে দাফনের আগে গোশলের জন্য নেন। মৃত ব্যক্তির কোমরে কিছু কাগজ খুঁজে পান তারা। সেই সময় উপস্থিত থাকা একজন কর্মী ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন এভাবে, তিনি বলছিলেন ‘আমরা তার কোমরে আইডি কার্ড আর ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড পাই। আইডি কার্ড দিয়ে শনাক্ত করা যায়নি। এরপর পুলিশকে জানালে তারা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে তার পরিচয় বের করেন। দেখা যায় তিনি চট্টগ্রামের বিশাল বড়লোক ফ্যামিলির লোক। পরে তাদের খবর দিলে তারা এসে লাশ নিয়ে যায়’। চট্টগ্রামের এই পরিবারটির সাথে আমি কথা বলেছি। তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। কিন্তু পরিবারটি বলেছে- তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং এই ঘটনায় এতটাই বিপর্যস্ত যে, এখন আর এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলেন না তারা। 

বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা

বেওয়ারিশ লাশের ওয়ারিশ বা পরিবার-পরিজনের খবর পাওয়া যায় হাজারে দুই থেকে তিনটা। আঞ্জুমান মফিদুল বলছে ২০১৪ সালের জানুয়ারি ১ তারিখ থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্ব^র এই পাঁচ বছরে ৬ হাজার ২১৩ জনকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে তারা। অর্থাৎ প্রতি বছরে ১ হাজারের বেশি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে যাদের কোনো ওয়ারিশ পাওয়া যায়নি। 

ঢাকায় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্রের কার্যালয়। সংস্থাটি ২০১৮ সালের নিখোঁজদের যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে এর সংখ্যা ৩৪। পরবর্তীতে ১৯ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে। যাদের অধিকাংশ বিভিন্ন মামলায় পুলিশের কাছে আটক আছে। আর বাকি ১৫ জন নিখোঁজ। 

পরিবারগুলো কি খোঁজ করে?

এই নিখোঁজদের একজন মোহন মিয়া। যিনি ঢাকার মিরপুর থেকে ২০১৮ সালের ১০ জুন নিখোঁজ হন। মোহন মিয়ার স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলছিলেন তারা আঞ্জুমান মফিদুলে যাননি। কারণ তার আশা তার স্বামী একদিন ফিরে আসবেন। তিনি বলছিলেন ‘তার শত্রুতা ছিল বাড়ি ঘর নিয়ে। মুদি দোকান ছিল আমার স্বামীর, সে তো কোনো সন্ত্রাসী না, নেতাও না যে, তারে মেরে ফেলবে। নিখোঁজের পর আমরা অনেকবার পুলিশের কাছে গিয়েছি। কিন্তু আঞ্জুমান মফিদুলে যাইনি। আমরা বিশ্বাস করি সে ফিরে আসবে একদিন’। আরো একজন নিখোঁজ ব্যক্তির বাবা বলছিলেন তার ছেলের খোঁজে একাধিক বার থানা-পুলিশ করেছেন কিন্তু আঞ্জুমান মফিদুলে যাননি। কারণ পুলিশ তাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তার ছেলেকে তারা খুঁজে বের করবেন। সে ঘটনার পার হয়ে গেছে ছয় মাস। 

তিনি বলছিলেন ‘অনেক কিছু করলাম। মিডিয়া করলাম, থানা-পুলিশ করলাম। পুলিশ বলতো আপনার ছেলেকে পাবেন। এখন সেই ওসিও ট্রান্সফার হয়ে গেছে’। বেশির ভাগেরই লাশের খোঁজ করতে কেউ আসে না এখানে। যেসব পরিবারে কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ থাকেন দীর্ঘদিন, তারাও যান না কারণ তাদের আসা থাকে একদিন হয়ত নিখোঁজ ব্যক্তিটি পরিবারের কাছে ফিরে আসবে এই আশায়। এছাড়া অনেক সময় লাশগুলো এমন অবস্থায় থাকে যে, সেগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। বলছিলেন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের একজন কর্মকর্তা রাশিদুল ইসলাম। 

মি. ইসলাম বলছিলেন, ‘যদি কোনো পরিবার এসে একটা টাইম লিমিট বলতে পারেন যে, ঐ সময়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটেছে বা ব্যক্তির বর্ণনা দিতে পারে তাহলে আমরা আমাদের নথি ঘেঁটে মেলানোর চেষ্টা করি। তবে সেটা খুব কম হয়। বছরে দুই-তিনটা এমন কেস থাকে। তারপর আগে ছবি তোলার সিস্টেম ছিল না। এখন কিছুদিন হল হয়েছে। কিন্তু লাশগুলো এত বিকৃত অবস্থায় থাকে যে, পরিবারের লোক আসলেও শনাক্ত করতে পারে না’। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি পরিচয় শনাক্ত করতে পারে? 

একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার সুরতহাল, ময়নাতদন্ত, জিডি, মামলা সব কিছু হয় সংশ্লিষ্ট থানাতে। এর একটা কপি দেয়া হয় আঞ্জুমান মফিদুলে। এছাড়া দেশের সব থানাতে এই বিবরণ বা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাহলে কেন একটা ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না? আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী পুলিশ ইন্সপেক্টর (মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশন্স) সোহেল রানার সাথে। 

প্রশ্ন: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে একটা বেওয়ারিশ লাশ পাওয়ার পর আপনারা কী করেন তার পরিচয় বের করার জন্য?

উত্তর : ময়নাতদন্ত হয়, পরিচয় জানার জন্য থাম্প ইম্প্রেশন থেকে এনআইডির সাথে মেলানোর চেষ্টা করি, প্রাথমিকভাবে যদি না পরিচয় পায় সেেেত্র ডিএনএ নমুনা নিয়ে সিআইডিকে পাঠায়। এছাড়া মামলা হয়। জনপ্রিয় পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দেয়, সব থানার ইউনিটগুলোকে জানানো হয়। 

প্রশ্ন: আপনি ডিএনএ নমুনা, পত্রিকাতে বিজ্ঞাপনের কথা বলছেন এসব কি বিশেষ কেসের ক্ষেত্রে নাকি সব ক্ষেত্রে করেন?

উত্তর : এসব আমরা সব অশনাক্তকৃত লাশের ক্ষেত্রে করে থাকি।

প্রশ্ন: যেহেতু একটা লাশের সব তথ্য আপনাদের কাছে থাকে সেেেত্র এটা কি খুব কঠিন কাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য খুঁজে বের করা?

উত্তর : নিশ্চিত সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকতে পারে খুঁজে না পাওয়ার পিছনে, যে সকল েেত্র অনেক সময় বা কখনো কখনো সম্ভব নাও হতে পারে।

পুলিশ বলছে এভাবে তারা একটি লাশ শনাক্তের জন্য তিনমাস তদন্ত করতে থাকেন। তারা দাবি করছেন এর ফলে সন্তোষজনক সংখ্যক লাশের শনাক্ত করা গেছে তবে সেই সংখ্যাটি দিতে পারেননি। এদিকে সেটাই যদি হয় তাহলে আঞ্জুমান মফিদুলের পাঁচ বছরে ৬ হাজারের বেশি বেওয়ারিশ লাশের যে হিসেব দিচ্ছে তার সংখ্যাটা অনেকটা কম আসতো। 

আদৌ কি সম্ভব পরিচয় বের করা? মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলছিলেন, যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সব রকম তথ্য রয়েছে সেেেত্র একটা লাশের শনাক্ত করা কঠিন কিছু না। 

তিনি বলছিলেন, ‘কেন একটা লাশের শনাক্ত করা যাবে না, নিশ্চয় যাবে। এটা শুনলে মনে হবে আমরা বিষয়টি নিয়ে কি সচেতন কিন্তু এটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। যদি পুলিশের উচ্চ পর্যায় থেকে সেই নির্দেশনা থাকে, পলিটিকাল উইল (রাজনৈতিক ইচ্ছা) থাকে তাহলে এটা হবে। পুলিশের অনেকগুলো কাজের মধ্যে এটাকে হায়েস্ট ইম্পর্টেন্স দিয়ে করা উচিত। এখন অনেক প্রযুক্তি বের হয়েছে সেগুলো ব্যবহার করে অবশ্যই বের করা যায়। তবে তার জন্য দরকার বাহিনীগুলোর সদিচ্ছা’। বাংলাদেশের বেওয়ারিশ লাশের দাফনের জন্য আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের ২৭টি শাখা সক্রিয় রয়েছে সারা দেশে। তবে দেশের যে কোনো প্রান্তে কোনো বেওয়ারিশ লাশ পেলে পুলিশ তাদের নির্দিষ্ট কার্যক্রম শেষ করে সৎকারের বা দাফনের জন্য ঢাকাতে পাঠিয়ে দেন। 

ঢাকার দুইটি স্থানে সেসব লাশের দাফন হয়। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে পরিবারগুলো অপোয় থাকেন তাদের নিখোঁজ আপনজনের, অপরদিকে হাসপাতালের মর্গ, থানা-পুলিশ সব পার করে একজন মৃত ব্যক্তির হয়ত স্থান হয় বেওয়ারিশ লাশের তালিকায়। যেটার খবর শুধু তার পরিবারের কাছেই যায় না।
  • দিনকাল/ জানু ২৯,২০১৯ 

No comments:

Post a Comment