৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের পথেই এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. এম ইহতেশামুল (তানিম) বারী। তিনি এশিয়ার রাজনীতি ও সাংবিধানিক আইন নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন। ডেকিন মিডিয়ায় গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় দেশটিতে নতুন এক শঙ্কার ক্ষেত্র তৈরি করেছে, কেননা এর মাধ্যমে সেখানে একদলীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
ড. বারী তার নিবন্ধে বলেন, বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে এলেও দলের নেতাদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের দমননীতির কারণে তারা গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। নির্বাচনে সরকারি দলের লোকেরা প্রিজাইডিং অফিসারের সহায়তায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলেন। এই ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তারা পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের ভোটে সত্যিকার অর্থে একটি চিন্তাশীল সরকার গঠনে তাদের অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করেছেন।
ড. বারী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টিতে বিজয়ী হয় এবং বিরোধীদের ওপর নির্মম দমন অভিযান চালানোর মাধ্যমে অর্জিত এই বিজয় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের পর যারা নির্বাচনে নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছেন এবং যারা বিরোধী দলকে ভোট দিয়েছেন তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার ওপর জোর দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যেসব সাংবাদিক নির্বাচনে নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছেন তাদের ২০১৮ সালে পাস করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া বিরোধী দল বিএনপিকে ভোট দেয়ায় চার সন্তানের জননী এক নারীকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ কয়েকজন মিলে গণধর্ষণ করেন।
ড. বারী বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ২০১১ সালে বাতিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ওপর তাদের কর্তৃত্ব সংহত ও নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পথ সুগম করে। তিনি বলেন, প্রতিটি সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পার্লামেন্ট বাতিল ও নতুন পার্লামেন্ট গঠনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন হিসেবে কেবলমাত্র রুটিন কাজগুলো করে থাকে।
উদাহরণ স্বরূপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার কর্মকর্তাদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করে না এবং সরকারি সম্পদ নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর এই সরকার ১৯৬৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযাগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়ার পর বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় একনায়কতন্ত্রের পথেই এগিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম এ পথে পা রাখে। বিরোধী দল বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করে।
তিনি বলেন, এই বিতর্কিত নির্বাচন দেশের জনগণের দৃষ্টিতে কোন অর্থেই আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দিতে পারেনি। বরং এই সরকার নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা খর্ব করা, বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ করে বিরোধীদের কণ্ঠ স্তব্ধ করাসহ নানাবিধ দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরপর পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে তাদের কর্তত্ববাদী শাসন পাকাপোক্ত করেছে।
ড. বারী বলেন, বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে হলে সংবিধানে ‘অর্থবহ সংস্কার’ আনা প্রয়োজন যাতে এর মাধ্যমে অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন নিশ্চিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি অর্থবহ পরিবর্তনই কেবল সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকারের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত এবং বাংলাদেশকে স্বৈরতন্ত্রের পথে আরো এগিয়ে যাওয়া থেকে ফেরাতে পারে।
- নয়া দিগন্ত / ১৭ জানুয়ারি ২০১৯
No comments:
Post a Comment