Search

Tuesday, January 29, 2019

সৃজনশীলতা হারিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত এনসিটিবি

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মূল কাজ হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রম নিয়ে গবেষণা ও সৃজনশীল বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া। অথচ গবেষণা ও সৃজনশীল পাঠ্যবই তৈরির পরিবর্তে এই প্রতিষ্ঠানের এখন মূল কাজ হয়ে গেছে কেনাকাটা ও বই নিয়ে বাণিজ্যের অংশীদার হওয়া। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি এখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

এতে এনসিটিবি তার মূল চরিত্র হারিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। গড়ে উঠেছে নানামুখী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীরাও। এমনটিই বলেছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৭ সালে এনসিটিবি নিয়ে তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে।

সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে খোদ সরকারও কোটি কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ্যবইয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এদের সাথে সমঝোতা বা তাদের দাবির কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরের প্রাথমিকে পাঠ্যবই ছাপার পুনঃটেন্ডার করতে গিয়ে। পুনঃটেন্ডার করে প্রাথমিকের পাঠ্যবই বিদেশে ছাপাতে হয়েছে। অথচ দেশীয় মুদ্রাকররা এর তীব্র বিরোধিতা করলেও এনসিটিবির শীর্ষপর্যায় থেকে ছাপার কাজ বিদেশীদের হাতে দেয়ার জন্য সব ধরনের নাটক সাজানোর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি টেন্ডারের শর্ত ও বিধি লঙ্ঘন করে এ কাজ করা হয়েছে।

এনসিটিবির সামগ্রিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, এনসিটিবি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখানে শিক্ষাবিদেরা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম ও কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা করবে। নতুন নতুন ধারণা ও সৃজনশীল মেধা দিয়ে শিক্ষাবিদদের পরামর্শ অনুসারে কারিকুলাম সাজাবে। পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলাম এখনো সেকেলে।

অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আক্ষেপ করে বলেন, এনসিটিবি প্রতি বছর পাঠ্যবই ছাপার বাণিজ্যের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। অথচ তাদের দায়িত্ব ছিল, প্রতি কয়েক বছর পরপরই পাঠ্যবইয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন কিছু দেয়া। এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তকের গবেষক ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে বৈঠক না করে, বই ছাপার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সাথে বৈঠক করছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে তা পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়। তার আগে হয়েছিল ১৯৯২ সালে। পাঠ্যবইয়ের কারিকুলামের পরিবর্তন আগামীতে কবে হবে, তা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই নীতিনির্ধারক মহলের। তবে এনসিটিবির শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, নতুন সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী কারিকুলামের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে কিছু একটা হতে পারে। কী হবে তার কার্যক্রম শুরু হবে নির্দেশনা পাওয়ার পর।

এনসিটিবির প্রশাসনিক বিন্যাস সম্পর্কে হচ্ছে বিভিন্ন কথা প্রচলিত থাকলেও, এখানে যারা নিয়োগ পান তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আত্মীয় স্বজন বলেই পরিচিত। এ ছাড়া রয়েছে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরের পদায়ন। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ, গবেষণা কর্মকর্তাসহ নানা পদে যারা নিয়োজিত তাদের কারোরই অতীত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এখানে রয়েছেন, অর্থনীতিতে পাস করা কর্মকর্তা, যিনি প্রাথমিকের বাংলা বইয়ের সম্পাদনা করেন। এরূপ বিভিন্ন ধরনের জগাখিচুড়ি নিয়ে চলছে এনসিটিবি বছরের পর বছর। সরকার পরিবর্তন হলে শুধু বদলায় এর কর্মকর্তা। গত তিন দফায় একই সরকার ক্ষমতায় থাকায় এবং টানা দুই টার্মে একই ব্যক্তি শিক্ষামন্ত্রী থাকায় এখানে গড়ে উঠেছে বড় ধরনের অনিয়মের সিন্ডিকেট।

প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে জুনিয়র কর্মকর্তার শাসন কায়েম হয়েছে। উপসচিব (কমন) এবং ঊর্ধ্বতন ভাণ্ডার কর্মকর্তা হিসেবে ২৪তম বিসিএস কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই দু’টি পদে এর আগে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হতো। উৎপাদন নিয়ন্ত্রক পদেও অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা পদায়ন পেয়েছেন। বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং তার সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বারৈ নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট এখানেও সক্রিয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ প্রতিষ্ঠানে (এনসিটিবিতে) কর্মরতদের বেশির ভাগই বছরের পর বছর একই পদে চাকরি করছেন।

বিতরণ নিয়ন্ত্রণ জিয়াউল হক, ঊর্ধ্বতন ভাণ্ডার কর্মকর্তা আবু হেনা মাশুকুর রহমান, ঊধ্বর্তন বিশেষজ্ঞ মোখলেস উর রহমান, বিশেষজ্ঞ পারভেজ আক্তারসহ অধ্যাপক হাসমত মনোয়ার, আলেয়া আক্তার, মোস্তফা সাইফুল আলম, সৈয়দ মাহফুজ আলী, চৌধুরী মুসাররাত হোসেন জুবেরী, সাহানা আহমেদ প্রমুখ সর্বনিম্ন ছয় বছর থেকে এক যুগ একই পদে ও একই কর্মস্থলে কর্মরত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে ক্যাডার কর্মকর্তা আছেন মোট ৬১ জন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হিসেবে মূল চাকরি কলেজে শিক্ষকতা। কিন্তু তারা লেকচারার হিসেবে যোগদান করার পর এখনো একই প্রতিষ্ঠানে থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।

মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্র জানান, এনসিটিবি কারিকুলাম গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কখনোই রূপ পায়নি। এখানে যাদের পদায়ন করা হয় গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে, তাদের কারোই গবেষণা কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এখানে কর্মরত রয়েছেন গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে। এখানে নিয়োজিত গবেষণা কর্মকর্তারা এখন কাজ করেন, ছাপাখানায় বই ছাপা কেমন হচ্ছে তা তদারকিতে। ছাপা বই ঠিকমত ট্রাকে উঠছে কি না, তার নজরদারিতে।

এনসিটিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গবেষণার পরিবর্তে আমার কাজ হচ্ছে প্রতিদিন মুদ্রাকরদের সাথে দেন-দরবারে ব্যস্ত থাকা। তাদের সাথে ঝগড়া মেটানো। কারিকুলাম নিয়ে মনোসংযোগের ফুসরত কোথায়?

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, এনসিটিবি গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু বই ছাপা ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে এমনটি নয়। এনসিটিবির আইন ও বিধিমালার মধ্যে রয়েছে, বই ছাপা ও সরবরাহের কাজ করার। আর কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না, এটিও সঠিক নয়। তিনি জানান, প্রাথমিকের পাঠ্যবই রিভিউর কাজ শেষ হয়েছে। মাধ্যমিকের কাজ চলছে।
  • নয়া দিগন্ত/ ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

No comments:

Post a Comment