Search

Sunday, January 20, 2019

সেদিনের কমল ‘নায়ক থেকে মহানায়ক’


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরের মতো আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। অপারেশন সার্চলাইট নামের হানাদারদের গণহত্যাযজ্ঞে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে গোটা জাতি। ঠিক তখনই চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে বজ্রকণ্ঠে ভেসে আসলো— ‘প্রিয় দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি...’, এরপর রণাঙ্গণে সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব এবং ৭৫ পরবর্তী সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে দিশেহারা জাতিকে পথ দেখানো। এভাবেই নায়ক থেকে রুপান্তর হওয়া মহানায়কের ৮৩তম জন্মদিন ১৯ জানুয়ারি

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সংগঠক, প্রথম সেক্টরের কমান্ডার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।

জন্ম ও শৈশবে তাঁর ডাক নাম ছিলো কমল। তাঁর পিতা মনসুর রহমান এবং মাতা জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়। 

পিতামহ ছিলেন মৌলভী কামালউদ্দিন। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। দাদার আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের শিশুমনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে ছোট্ট কমল এর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিল চাচা ডা. ক্যাপ্টেন মমতাজুর রহমান। জিয়াউর রহমানের মা জাহানারা খাতুন ছিলেন জলপাইগুড়ির বিখ্যাত টি ফ্যামিলির মেয়ে। প্রখর স্বাজাত্য বোধ ছিল তার মধ্যে। তেজী, স্পষ্টভাষী মহিলা হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। পিতা মনসুর রহমান ছিলেন একজন কেমিস্ট, চাকরিজীবী। কমল বাগবাড়ির গ্রাম্যস্কুলে দুই বছর পড়াশুনা করে। এরপর কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় তাঁকে। দশ এগারো বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া চলে। এরপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলো। 

ভারতবর্ষ ভাগের পর তাঁর পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান। ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই জিয়াউর রহমান ওরফে কমলকে ভর্তি করে দেয়া হল করাচি একাডেমি স্কুলে, যার বর্তমান নাম তাইয়েব আলী আলভী একাডেমি। ১৯৫২ সালে করাচি একাডেমি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করলেন জিয়াউর রহমান। ভর্তি হলেন ডিজে কলেজে।

কর্মজীবনের শুরুতেই দেখিয়েছেন অসীম বীরত্ব

১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগ দিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। করাচিতে দুই বছর চাকুরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন।

১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের অন্যতম। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টিতামঘা-ই-জুরাত মেডাল লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। অ্যাডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান এবং কয়েক মাস বৃটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।

জিয়ার ঘোষণাতেই দিশেহারা জাতি পায় অনুপ্রেরণা

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মেজর জিয়ার কণ্ঠে সেই ঘোষণা মুহূর্তের মধ্যেই দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায়। জিয়ার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে দিশেহারা জাতি পঙ্গপালের ন্যায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সংলগ্ন সেক্টরে সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের মুক্তিবাহিনীর প্রথম সামরিক ব্রিগেড জেড ফোর্স (Z Force) তথা জিয়াউর ফোর্স গঠিত হয়। এটির তুরা ব্রিগেড নামেও পরিচিতি আছে। ব্রিগেডটি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এর অনুমোদন সাপেক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে গঠিত হয়। ৭ জুলাই, ১৯৭১ ব্রিগেডটি গঠিত হয় ১ম, ৩য় এবং ৮ম ব্যাটালিয়ন এর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সমন্বয়ে। এটাই ছিল তৎকালীন স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রথম একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড। পরে আক্রমণ ও প্রতিরোধ শত্রুদের বড় ধরনের চাপে ফেলতে সম্পূর্ণ দেশকে কিছু সেক্টর-এ ভাগ করা হয়।

মেজর জিয়া এবং তার বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কয়েকদিন তাঁরা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, রাঙামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেনী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং তারপর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য কৃতিত্বের ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। 

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি কুমিল্লার একটি বিগ্রেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে, ঐ বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের ২৫শে আগস্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রত্যক্ষ গণভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন নিবেদিত প্রাণ সৈনিক।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফল ছিলেন এই মহানায়ক

ব্যস্ত কর্মময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফল ছিলেন এই কর্মবীর। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যেমন ১৯৭১ সালে ৬৪ হাজার বর্গমাইলের সীমানার ভেতর থেকেই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তেমনি রাষ্ট্রক্ষমতায়ও তিনি সফল হোন। সেসময়ে কৃষি বিপ্লব, আজকের বাংলাদেশের প্রাণ গার্মেন্টস শিল্প এবং প্রবাসে শ্রমিক রফতানির সুচনা সবই হয়েছে এই মহানায়কের হাত ধরে। যা আজকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেন। এসব কিছুকে আদর্শ বা নীতিগত, কাঠামোগত, আইনগত, উন্নয়নগত ও প্রথাগত পরিবর্তন বলে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি-বিশ্বাস ও জীবনবোধের নিরিখে তিনি সংবিধান সংশোধন করেন। ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন। সংবিধানে ও উন্নয়ন কৌশলে সমাজতান্ত্রিক ধারা (তথাকথিত অধনতান্ত্রিক পথ) পরিহার করেন, মুক্ত অর্থনীতি, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতিতে উগ্র বাম ও উগ্র ডানের সমদূরত্বে মধ্যপন্থা অনুসরণ করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। সর্বাত্মক এ পরিবর্তনের নিরিখেই সমাজতাত্ত্বিকেরা তাঁকে আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বলে অভিহিত করেছেন।

জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চার এবং রাজনীতিকে গণমুখী ও অর্থনৈতিক মুক্তির অভিসারী করে তোলার লক্ষ্যে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তিনিই এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কর্মে উৎপাদনে জেগে ওঠে এবং শুরু হয় স্বনির্ভর ও আধুনিক বাংলাদেশের যাত্রা। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশকে গড়ে তুলেন ইমারজিং টাইগার হিসাবে। উজ্জ্বল করেন দেশের মুখ।

তবে এই উজ্জ্বলতা বেশিক্ষণ থাকতে দেয়নি ঘাতকরা। জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী অফিসারের হাতে শাহাদত বরণ করেন। অকাল অবসান ঘটে নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে উঠা এক জিয়াউর রহমানের। জিয়াউর রহমান উত্তরাধিকার সূত্রে নেতা ছিলেন না, ক্ষমতার দাপটেও তাঁর ওপর মহত্ত্ব আরোপিত হয়নি। তিনি নেতৃত্ব কর্তৃত্ব মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন নিজ কর্তব্যগুণে। 

  • ব্রেকিংনিউজ/ জানু ১৯, ২০১৮ 

No comments:

Post a Comment