জেসমিন মলি
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন ও বিধি অনুযায়ী কোনো অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হয় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে। আর মামলা দায়েরের পর তদন্ত শেষ করতে হয় সর্বমোট ১৮০ দিনে। কিন্তু বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি অনুসন্ধান থেকে শুরু করে মামলা ও তার তদন্ত সাত বছরেও শেষ করতে পারেনি দুদক। যদিও সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে বেসিক ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে।
বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ পায় ২০১১ সালের ডিসেম্বরে। এরপর অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। একাধিকবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদল করে সাড়ে চার বছর পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৬টি মামলা করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। যদিও একটি মামলার তদন্তকাজও এখনো শেষ করতে পারেনি দুদক। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েক দফা পর্যবেক্ষণ আসার পর ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেয় দুদক। তাকে পাঁচ দফা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তার পরও মামলার তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
তবে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে শুধু বেসিক ব্যাংকই নয়, অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি তদন্তে অগ্রগতি দেখতে পাবেন। আর্থিক খাতসহ সব খাতের দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। তবে কতগুলো বিষয়ে আমাদের প্রধান ফোকাস থাকবে। আর্থিক দুর্নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা আমাদের পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে আর্থিক দুর্নীতি বন্ধের চেষ্টা করব।
২০০৯-১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তা অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে এ অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৫ সালে রাজধানীর তিনটি থানায় যে ৫৬টি মামলা দায়ের হয়, তাতে আসামির সংখ্যা ১৫৬। মামলায় আসামিদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা রয়েছেন ২৬ জন। বাকি ১৩০ জন আসামি ঋণগ্রহীতা ৫৪ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ও সার্ভে প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন। ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ১৫ জনকে গ্রেফতার করে দুদক। এর মধ্যে ছয় ব্যাংক কর্মকর্তা বর্তমানে কারাগারে আছেন। বাকি নয় ব্যবসায়ী জামিনে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজে-কলমে থাকলেও বেসিক ব্যাংকের এসব ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই অস্তিত্বহীন। এ কারণে বারবার যোগাযোগ করা হলেও গ্রাহকপক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ফলে তাদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা দেখছেন না ব্যাংক কর্মকর্তারা।
বেসিক ব্যাংকের এ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের পক্ষ থেকে ৫৬টি মামলা হলেও কোনোটিতেই ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও পর্ষদ সদস্যদের অভিযোগপত্রে আসামি করা হবে কিনা, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বেই মামলার তদন্ত আটকে আছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
তদন্ত শেষ করতে এত বেশি সময় লাগার বিষয়টি বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ঘটনা। এটি শুধু অভিযোগ নয়, এ নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়েছে। তার পরও তদন্ত শেষ করতে দুদকের এত সময় কেন প্রয়োজন হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এক হতে পারে তাদের সামর্থ্যের ঘাটতি, আরেক হতে পারে সদিচ্ছার ঘাটতি। এছাড়া আমি আর কোনো কারণ দেখি না। আমি মনে করি, দুদকের যে আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য, সেটা যদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করে, তাহলে এ ধরনের কেলেঙ্কারি দ্রুতই নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত থেকেও একাধিকবার পর্যবেক্ষণ এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের কয়েক দফা পর্যবেক্ষণের পর ব্যাংকটির তত্কালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেয় দুদক। পাঁচ দফা জিজ্ঞাসাবাদে ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল হাই বাচ্চু দাবি করেন, ঋণ দেয়ায় কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে তিনি নেননি। তত্কালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফখরুল ইসলাম যেসব ঋণ অনুমোদনের নথি পর্ষদে উপস্থাপন করতেন, সবার অনুমতি সাপেক্ষে তিনি সেসব অনুমোদন দিতেন। এখানে যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, তবে সেটি ভুলে হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি আবদুল হাই বাচ্চুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক। এর অংশ হিসেবে তার ভাই শেখ শাহরিয়ার পান্নার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য যাচাই করে দেখতে চেয়েছে দুদক। গত বছর বাচ্চু ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংকিং লেনদেনের সব ধরনের নথিপত্র চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে উপপরিচালক শামসুল আলমের সই করা একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিল।
উল্লেখ্য, আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর পদত্যাগ করেন আবদুল হাই বাচ্চু।
- Courtesy: Banikbarta/ Jan 16, 2019
No comments:
Post a Comment