নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনপুরে গত শনিবার রাতে পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া পথচারী গার্মেন্ট কর্মীকে আসামি করেছে পুলিশ। বন্দর থানায় পুলিশের করা মামলার ২১ নম্বর আসামি নিহত গার্মেন্ট কর্মী আশিকুর রহমান (২৫)। বন্দর থানার এসআই মোহাম্মদ আলী বাদি হয়ে ২৪ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করে।
মামলার এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা হলো মুকুল, মো: তাজুল, মো: মনির হোসেন, মো: মারুফ, আব্দুল মতিন, মাইনুদ্দিন, রমজান মিয়া, আনোয়ার হোসেন, মোক্তার হোসেন, মো: আরিফ, ফারুক, এছহাক মিয়া, রুবেল, সুমন, তোফাজ্জল, অপু, মুন্না, রায়হান হোসেন, রিফাত, মিজান, আশিক মিয়া, নুর নবী, মো: দিপু, মো: সুজন। তবে গার্মেন্ট কর্মী আশিকুর রহমান নিহতের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।
নিহত আশিকুর রহমানের স্ত্রী বানেছা বেগম জানান, শনিবার বিকেলে গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরে বাজার করতে মদনপুর বাজারে যায়। রাত ৯টায় স্থানীয়রা এসে জানায়, পুলিশের গুলিতে আমার স্বামী মারা গেছে। পরে রাতে স্থানীয়রা বাসায় তার লাশ নিয়ে আসে।
প্রতিবেশী মো: হাসমত আলী জানান, পেটের তাগিদে আশিক লালমনিরহাটের দক্ষিণ শিবের কুঠি গ্রাম ছেড়ে বন্দরের মদনপুরে উঠেছিলেন। সেখানে চানপুর এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। তিনি নিজে সামান্য বেতনে স্থানীয় প্যানডেক্স গার্মেন্টে চাকরি করতেন।
স্থানীয় বাসিন্দা নুসরাত জাহান জানান, আশিকুর শনিবার বিকেলে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পর সন্ধ্যায় বাজার করতে গেলে সংঘর্ষের মধ্যখানে পড়ে প্রাণ হারান। পুলিশ এ সময় ব্যাপক গুলি বর্ষণ করে।
নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা: আসাদুজ্জামান জানান, আশিকুর রহমানের শরীরের কয়েকটি স্থানে গভীর ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বাম থাইয়ের উপরের দিকে, বাম উরুতে গভীর ক্ষত চিহ্ন ছিল। এ ছাড়াও ডান দিকের উরুতেও একটি ক্ষত চিহ্ন দেখা গেছে। ক্ষত চিহ্ন থাকলেও সেখানে কোনো বুলেট পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসক জানান, ক্ষতস্থান দিয়ে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণেই আশিকের মৃত্যু হয়েছে। তবে সে শনিবার রাতেই সে মারা গেছে।
সরেজমিন বন্দরের মদনপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এখনো থমথমে পরিবেশ। আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মধ্যে। শনিবার রাতে সংঘর্ষের ঘটনার নেপথ্যে কী, তা জানতে কথা হয় স্থানীয় লোকজনের সাথে। তারা জানান, মূলত চাঁদাবাজি এবং মাদকব্যবসা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে এমন ঘটনা ঘটেছে। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নুর হোসেনের অন্যতম সহযোগী খলিল মেম্বার। তিনি মদনপুর ইউনিয়ন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ওই ওয়ার্ডের মেম্বার।
অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় যুবলীগ নেতা আমির হোসেন। চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসা নিয়ে গত বছর নভেম্বর মাসে খলিল মেম্বার ও আমীর হোসের গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়। ওই সময় খলিল মেম্বারকে কুপিয়ে জখম করে আমীর হোসেনের লোকজন। ওই ঘটনায় দুই পক্ষই থানায় মামলা করে। শনিবার রাতে পুলিশ একটি মামলার আসামি খলিল মেম্বারের দুই সমর্থককে গ্রেফতার করা পর তাদের ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্দরের মদনপুর চৌরাস্তায় আটটি অবৈধ পরিবহন স্ট্যান্ড গড়ে উঠে। প্রায় দুই হাজার সিএনজি, অটোরিকশা, বেবিট্যাক্সি, টেম্পু, লেগুনা এখান থেকে প্রতিদিন আটটি রুটে যাতায়াত করে থাকে। মদনপুর থেকে সোনারগাঁও চৌরাস্তা, নানাখী, বারদী, কাঁচপুর, মদনগঞ্জ, নয়াপুর, আড়াইহাজার যাতায়াত করে।
এ ছাড়া, এ রুটে পাঁচটি বাস কোম্পানির শতাধিক মিনিবাস চলাচল করে। প্রতিটি ছোট গাড়ি থেকে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৮০ টাকা এবং প্রতিটি বাস থেকে ১০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। এতে দেখা যায় প্রতিদিন মদনপুর পরিবহন স্ট্যান্ডকে ঘিরে লক্ষাধিক টাকা চাঁদাবাজি হয়।
এ ছাড়া, মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিপুল টাকা প্রতিদিন লেনদেন হয়। ফলে এখানে চাঁদাবাজির খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য চলে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের লড়াই। একেক সময় একেক জন দখলে নেয় চাঁদাবাজির এ খাত। শনিবারের ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা খলিল মেম্বার ও আমীর হোসেনের মধ্যে চাঁদাবাজির খাত দখল নিয়ে।
স্থানীয়রা জানায়, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলোপাতাড়িভাবে মদনপুর চৌরাস্তায় শতাধিক মিনি বাস এবং অন্যান্য যানবাহন রাখার ফলে প্রতিনিয়ত যানজটের কবলে পড়ছে মানুষ। মহাসড়কে দীর্ঘক্ষণ যানজট লেগে থাকে।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আসামি ছিনিয়ে নেয়াকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগের সংর্ষষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ আট রাউন্ড গুলি ছুড়ে। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আশিকুর রহমান নামে গার্মেন্ট কর্মী নিহত ও বাবুল নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ দিকে, এ ঘটনায় বন্দর থানার ওসি আজহারুল ইসলামকে ক্লোজড করা হয়।
সংঘর্ষের পর জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানিয়েছিলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় পুলিশের ওপর হামলা করে গাড়ি ভাঙচুর ও শটগান ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বন্দর থানার এস আই মো: আলী বাদি হয়ে ২৪ জনের নামসহ অজ্ঞাত আরো ২০০-৩০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে। এ ছাড়া, একজন নিহতের ঘটনায় পৃথক আরেকটি হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে। তবে এ ঘটনায় দুইজন গ্রেফতার ও পুলিশের অস্ত্র ও ওয়ারলেস সেট উদ্ধার করা হয়েছে।
- Courtesy: Naya Diganta /Jan 15, 2019
No comments:
Post a Comment