সম্পাদকীয়
ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকেরা যেমন, তেমনি সাধারণ মানুষও সন্দেহের দোলাচলে। সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো কোনো একটি জায়গা অন্তত সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকে মুক্তি পাক। প্রায় তিন দশক পরে যে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা না ঘটুক, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের যে বাস্তব চিত্র, তাতে কর্তৃপক্ষের ওপর যথেষ্ট ভরসা রাখা কঠিন। কিন্তু এই নির্বাচনের গুরুত্বকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। আসন্ন ডাকসু নির্বাচন ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন করা সম্ভব হলে দেশের অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে সুনির্বাচন করা সহজতর হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের আসন্ন সভায় কিছু সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ওপরে নির্বাচনটি অবাধ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে নাকি কমবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে। তিনটি সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ভোটার ও প্রার্থীদের যোগ্যতা। বিদ্যমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শুধু নিয়মিত ছাত্ররাই ভোটার ও প্রার্থী হতে পারবেন। পিএইচডি ও এমফিল ছাত্ররা ভোটার হতে পারেন, কিন্তু প্রার্থী নন। ছাত্রসংগঠনগুলো এই বিধান শিথিল করার জন্য যেসব যুক্তির অবতারণা করছে, তা দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করাই সমীচীন। দীর্ঘদিন নির্বাচন হয়নি বলে কারও তথাকথিত বঞ্চনা প্রশমনের বিষয়টি বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এটা খাল কেটে কুমির আনার শামিল হবে। বরং অনেকেই মনে করেন যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়ার পরে কারও নিয়মিত ছাত্র থাকার সুযোগ থাকতে পারে না। তাই প্রার্থী হওয়া দূরে থাক, গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তাঁদের ভোটাধিকার থাকার বিধান বিলোপ করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, ভোটকেন্দ্র হলের ভেতরে না বাইরে হবে, তা নির্ধারণ করা। এটা আমাদের সবারই জানা যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং হল প্রশাসন প্রধানত দলীয় বিবেচনায় ঢেলে সাজানো হয়েছে। হলের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতাসীন দল–সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের হাতেই রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৪টি ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ছাত্রদল ও বামদের ১১টি সংগঠন হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের যে দাবি করেছে, তা যুক্তিসংগত। তারা বলেছে, প্রতিটি হলে ছাত্রলীগের যে আধিপত্য গড়ে উঠেছে, সেটা হলের ভেতরে কেন্দ্র স্থাপন করা হলে ভোটাভুটির নিরপেক্ষ পরিবেশকে ব্যাহত করবে। ছাত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আবাসিক হলগুলোর বাসিন্দা নন। সুতরাং হলের ভেতরে যাওয়াটাই তাঁদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং গঠনতন্ত্র সংশোধন করে হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র নিয়ে আসতে হবে।
এবং তৃতীয়ত, ছাত্র সংসদের ওপর উপাচার্যের ক্ষমতা প্রয়োগকে ভারসাম্যপূর্ণ করা। গঠনতন্ত্রের বিদ্যমান বিধানমতে উপাচার্য ছাত্র সংসদের নির্বাচিত নেতাদের বরখাস্ত করার এখতিয়ার রাখেন। এটা সবারই জানা যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্যরা আর অতীতের মতো কোনোভাবেই দলনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখেন না বা রাখাটা সম্ভব হয় না। তাই উপাচার্যের হাতে এই এখতিয়ার থাকা উচিত নয়। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে আমরা একমত হয়ে বলতে পারি যে অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতির নেতৃত্বে উপাচার্য ও ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিলের হাতে এই এখতিয়ার অর্পণ করা যেতে পারে।
৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে যা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ যাতে না ওঠে—তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। ভোটকেন্দ্রে ক্যামেরা রাখার যে দাবি উঠেছে, তা নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। নির্বাচনী প্রচারণায় সবার জন্য সমান সুযোগ থাকতেই হবে। ছাত্ররা যদি নিজ নিজ ভোট না দিতে পারেন, তাহলে এই কলঙ্কের দায় থেকে জাতির পরিত্রাণ মিলবে না।
- Courtesy: Prothom Alo/ Jan 29, 2019