আতর বিক্রেতা ইউসুফ আলী (ডানে)।
তালাবদ্ধ ছোট্ট কাঠের বাক্স। দৈর্ঘ্য দুই হাত, প্রস্থ এক হাত। বাক্সের পাশে রাখা একটা কাঠের টুল। লোহার শিকল দিয়ে বাক্সের সঙ্গে টুলটি বাঁধা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় প্রায় তিন মাস ধরে এভাবে পড়ে আছে বাক্স-টুল। এর মালিক ইউসুফ আলী (৫৪) নাশকতার ১১ মামলায় এখন কারাগারে। ২৫ বছর ধরে তিনি বায়তুল মোকাররম এলাকার হকার। আতরসহ নানা জিনিস বিক্রি করেন। ইউসুফের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তিনি ট্রেন দুর্ঘটনায় বাঁ হাত হারান। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি ভাতাও পাচ্ছেন ইউসুফ।
ইউসুফের স্ত্রী মনোয়ারা বলেন, সেদিন ছিল শনিবার (৩ নভেম্বর, ২০১৮)। সকালে দোকানে যান তাঁর স্বামী। বেলা দুইটার পর মোবাইল ফোনে খবর পান, তাঁর স্বামী ইউসুফকে বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে ধরে নিয়ে গেছে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ। থানায় যাওয়ার পর পুলিশ তাঁকে জানায়, নাশকতার মামলায় তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার অংশ হিসেবে সরকারবিরোধী নাশকতামূলক কার্যক্রম চালানোর অভিযোগের মামলায় ইউসুফকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ আদালতকে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে ইউসুফের নাম বলা হয়েছে—ইউসুফ ওরফে হাতকাটা ইউসুফ।
ইউসুফের স্ত্রী মনোয়ারা বলেন, আইনজীবীরা বলছেন, ১১টি মামলায় আলাদা আলাদা জামিন নিতে হলে অনেক টাকা লাগবে। একটি মামলায় জামিনের জন্য কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা, সে হিসাবে দুই লাখ টাকার বেশি লাগবে, যা খরচ করার সামর্থ্য তাঁদের নেই। তাই স্বামী কবে মুক্তি পাবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না।
নাশকতার একটি মামলায় [মোহাম্মদপুর ৫৪ (৯) ১৮] পুলিশ অভিযোগ করেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে মোহাম্মদপুর থানার বছিলার শাহজালাল হাউজিং ১ নম্বর রোডের মাথায় খালি জায়গায় ইউসুফ আলীসহ বিএনপি ও এর অঙ্গ–সংগঠনের ২০০ থেকে ২৫০ জন নেতা-কর্মী জড়ো হন। নির্বাচন বানচাল করার জন্য নাশকতামূলক কার্যকলাপ ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়ার জন্য গোপন সভার জন্য সেখানে তাঁরা একত্র হন।
বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় পড়ে আছে ইউসুফের বাক্স-টুল।
আদালত ও আইনজীবী সূত্র বলছে, গত বছরের ৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ইউসুফকে মোহাম্মদপুর থানার ১১টি নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলাগুলো বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনে করা।
ইউসুফের আইনজীবী মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইউসুফের বাঁ হাত নেই। তিনি একজন অ্যাজমা রোগী। হাতে তাঁর সব সময় থাকে নেবুলাইজার। এমন একজন বয়স্ক শারীরিক প্রতিবন্ধী অসুস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশ এতগুলো হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে জেলে ভরে রেখেছে। কোনো রাজনীতির সঙ্গে ইউসুফ জড়িত নন।
মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন জানান, ইউসুফ জামিন আবেদন করেছেন একাধিকবার। কিন্তু জামিন হয়নি তাঁর।
ইউসুফের মুক্তি চান
ইউসুফ থাকেন মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার বস্তিতে। গত শনিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে পাওয়া গেল ইউসুফের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমকে। ছোট্ট ঘর। এই ঘরে স্ত্রী আর ছয় বছরের ছোট্ট মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে থাকেন ইউসুফ।
মনোয়ারা বললেন, তাঁর স্বামী ইউসুফ কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। দিন এনে দিন খান। তাঁর আয়ে সংসার চলে। অথচ পুলিশ বিনা দোষে তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করে একের পর এক মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে।
মনোয়ারা ইউসুফের দ্বিতীয় স্ত্রী। আগের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ১২ বছর আগে তিনি মনোয়ারাকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে আছে তিন ছেলে আর দুই মেয়ে।
ইউসুফের মেয়ে ইয়াসমিন আক্তার মোহাম্মদপুর থানার ২৯ নম্বর ওয়ার্ড যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবা ইউসুফ রাজনীতি করেন না বলে দাবি ইয়াসমিনের। তিনি বলেন, তাঁর বাবা বহু বছর ধরে বায়তুল মোকাররম এলাকায় ব্যবসা করেন। তিনি কোনো দিন দেখেননি, তাঁর বাবা ইউসুফ বিএনপির কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। মিথ্যা মামলায় তাঁর বাবাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইউসুফ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি ভাতা পান বলে জানান তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম।
তবে একটি মামলার বাদী মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ইউসুফের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে যদি দেখা যায় ইউসুফ নির্দোষ, তাহলে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
ইউসুফকে অনেক আগে থেকে চেনেন চান্দু হাওলাদার। ইউসুফের মোহাম্মদপুরের বাসার সামনের চান্দুর দোকান। তিনি বলেন, ইউসুফ আওয়ামী লীগের সমর্থক। কোনো রাজনীতি করেন না। বায়তুল মোকাররম এলাকায় হকারি করেন।
গত রোববার দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের নিচতলার গিয়ে ইউসুফের ছোট্ট দোকানের খোঁজ পাওয়া যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যবসায়ী এনামুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ বছর ধরে চেনেন ইউসুফকে। অনেক আগে থেকে ইউসুফ বায়তুল মোকাররম এলাকায় ব্যবসা করে আসছেন। তিন মাস হলো ইউসুফের দোকান বন্ধ আছে। শুনেছেন, রাজনৈতিক মামলায় ইউসুফ কারাগারে আছেন।
ইউসুফের দোকানের বাঁ পাশের দোকানদার মনির হোসেন। তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে তিনি চেনেন ইউসুফকে। তাঁকে তিনি ভালো মানুষ হিসেবে জানেন।
ইউসুফের স্ত্রী মনোয়ারা জানান, স্বামী জেলে যাওয়ার পর থেকে পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, যতবার তাঁর (স্বামী) সঙ্গে দেখা হয়েছে, ততবার স্বামী দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তাঁকে বলেছেন, বিনা দোষে আর কত দিন তাঁকে জেল খাটতে হবে।
শারীরিক প্রতিবন্ধী ইউসুফের মুক্তি দাবি করেন মনোয়ারা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে সুমাইয়া রোজ রাতে বাবার কথা মনে করে কান্নাকাটি করে।’
শারীরিক প্রতিবন্ধী ইউসুফের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ইউসুফের বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নেবেন।
- প্রথম আলো/ জানু ৩০, ২০১৯
- https://goo.gl/yJx42w