Search

Sunday, December 1, 2019

এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে আমরা কী করব!

বদিউল আলম মজুমদার

আমাদের নির্বাচন কমিশনে আবারও নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চার কমিশনারের মতামত না নিয়েই সিইসি ও কমিশনের সচিব কর্তৃক ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ নিয়ে এ দ্বন্দ্ব, যা স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে একজন কমিশনারের দাবি। স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমান হুদা কমিশন গঠনের পরপরই অন্য কমিশনারদের না জানিয়ে সিইসি ও সচিবের উদ্যোগে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে ইসি ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয়। অন্য তিন কমিশনার তখন নীরব ছিলেন, যদিও ইসি সে সময় বলেছিলেন যে বদলির বিষয়ে কমিশনারদের জানারও প্রয়োজন নেই (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০১৭)। আমরা মনে করি, ইসি সচিবের অবস্থান শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বিদ্যমান আইন, এমনকি আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

উল্লেখ্য, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তথা নিজেদের স্বার্থহানির কারণে ইসি সচিব ও অন্যান্য কমিশনারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলেও জনস্বার্থ সমুন্নত রাখতে তাঁদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ ও বিরোধ পরিলক্ষিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে জালিয়াতি ঘটেছে, যেখানে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৭৩-৮৯ ধারায় বর্ণিত প্রায় সব নির্বাচনী অপরাধে প্রশাসনিক ও নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত হয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, সেখানে মাহবুব তালুকদারের ক্ষীণ প্রতিবাদ ছাড়া অন্য সবাই ছিলেন নিশ্চুপ। তাঁরা আরও নিশ্চুপ ছিলেন প্রশিক্ষণের নামে জনগণের অর্থ লোপাটের ব্যাপারে। তাই এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সিইসি এবং অন্তত তিনজন নির্বাচন কমিশনার জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছেন।
বদিউল আলম মজুমদার

জনস্বার্থ জলাঞ্জলি প্রদান ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলেছে। উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতি তারই প্রমাণ বহন করে। তবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিণতি রয়েছে। নির্বাচনই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের একমাত্র পন্থা। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা রদবদলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা আশা করেছিলাম যে জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করার দায় মাথায় নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়েই তাঁদের সাংবিধানিক পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু আত্মমর্যাদাবিবর্জিত এবং নির্বাচনী, এমনকি সম্ভাব্য ফৌজদারি অপরাধে জড়িত এই কমিশন নিয়ে আমরা এখন কী করব! এ ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এবার নিয়োগ-বদলি নিয়ে কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে আসা যাক। অনেকেরই স্মরণ আছে যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কমিশনকে সহায়তার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর মাধ্যমে কমিশনের একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উহার জন্য একটি স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন।’

আর এই স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একজন সচিবসহ বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে। অনেকের আরও স্মরণ থাকার কথা যে কমিশন যাতে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে, সে লক্ষ্যে ড. হুদা কমিশনের আমলে কমিশনে বেশ কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ পান। এসব নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা। বস্তুত, কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বই হলো কমিশনকে সহায়তা প্রদান। তাই তাঁদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির এখতিয়ার কমিশনেরই হওয়া আবশ্যক। কারণ, কমিশনেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। কমিশনের সচিব বা অন্য কোনো কর্মকর্তার ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। অর্থাৎ কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ‘বস’ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন।

তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী ‘সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হইবেন’। আইনের ৪(১৩) (খ) উপধারা অনুযায়ী, সচিবের দায়িত্ব ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা’। এ ছাড়া আইনের ৪(১৩) (ছ) উপধারায় সচিবকে ‘মাঠপর্যায়ের অফিসারসমূহের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণে’র দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। আর সচিবের এসব দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশনকে সহায়তা প্রদান। আইনের ৪(১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করিবে এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক উহার ওপর অর্পিত অন্যান্য যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করিবে।’ অর্থাৎ সচিবেরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি কমিশনের নিকট দায়বদ্ধ।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনে নির্বাচন কমিশনের কাছে এ দায়বদ্ধতার কথা আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আইনের ১৪(১) ধারা অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিকট দায়ী থাকিবেন’। অর্থাৎ আইনে সচিবকে সুস্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ করা হয়েছে, যদিও সিইসির মাধ্যমে। তাই সিইসির অন্য কমিশনারদের পাশ কাটিয়ে সচিবকে নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই, কারণ, কমিশন একটি যৌথ সত্তাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান (Composite body) [জাতীয় পার্টি বনাম ইলেকশন কমিশন [৫৩ ডিএলআর (এডি) (২০০১)]।

এমনকি অন্য কমিশনারদের বাদ দিয়ে সিইসি এককভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ধারা ৪ অনুযায়ী, ‘কমিশন উহার চেয়ারম্যান বা উহার কোনো কর্মকর্তাকে এই আদেশের অধীন উহার সকল বা যে কোন কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করিবার জন্য ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিবে’। অর্থাৎ পুরো কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দায়িত্ব না দিলে তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জাতীয় পার্টি বনাম ইলেকশন কমিশন মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে যেকোনো দায়িত্ব পালন বা ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই কমিশন থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে হবে, অন্যথায় তাঁর কার্যক্রম এখতিয়ারবহির্ভূত (Coram nonjudice) হবে।’

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি বিখ্যাত রায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষমতার পরিধি আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে। পাঠকদের কারও কারও হয়তো জানা আছে যে ভারতের স্বনামধন্য সিইসি টি এন সেশন একসময় সিইসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র কমিশনার ছিলেন। ভারত সরকার ১৯৯৩ সালে আরও দুজনকে কমিশনে নিয়োগ দেয়, যা জনাব সেশন মেনে নেননি। ফলে কমিশনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং সিইসি নিজে ও একাধিক নাগরিক উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনের সভাপতি এবং “...সভাপতির দায়িত্ব হবে সভায় সভাপতিত্ব করা, নিয়মকানুন বজায় রাখা, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা, সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লিপিবদ্ধকরণ নিশ্চিত করা এবং এর কার্যক্রম নির্ঝঞ্ঝাটভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে যা কিছু প্রয়োজন তা করা।...তাঁর দায়িত্ব হলো সভায় এমনভাবে আচরণ করা, যাতে তিনি তাঁর সহকর্মীদের আস্থা ও সম্মতি অর্জন করতে পারেন। একজন সভাপতি এটি অর্জন করতে সক্ষম হবেন না, যদি তিনি কমিশনের অন্য সদস্যদের তাঁর অধস্তন মনে করেন...যদি সিইসিকে ঊর্ধ্বতন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, এই অর্থে যে তাঁর কথাই চূড়ান্ত, তাহলে তিনি পুরো কমিশনকেই অকার্যকর ও আলংকারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন।’

প্রসঙ্গত, নির্বাচনসংক্রান্ত ভারতীয় ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান—যথাক্রমে অনুচ্ছেদ ৩২৪ এবং ১১৮ ও ১১৯—প্রায় একই রকম এবং আমাদের সংবিধানেও সিইসিকে কমিশনের সভাপতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কমিশনে চলমান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে সিইসি এবং সচিবের অবস্থান সম্পূর্ণরূপে আইনের পরিপন্থী।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক.
  • কার্টসি — প্রথম আলো/  ০১ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজধানীতে সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকা কঠিন

মেহেদী হাসান

জীবনযাত্রার ব্যয় অব্যাহতভাবে বৃদ্ধির ফলে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে রাজধানীতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে বসবাসকারী সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে আলোচিত বিষয়।

সম্প্রতি অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এ অবস্থাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবাপণ্যের দাম। এর সাথে প্রতি বছর রাজধানীতে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। বাড়ছে সন্তানের শিক্ষার খরচ। সব কিছু মিলিয়ে অনেকের অবস্থা করুণ। দীর্ঘ দিন ধরে রাজধানীতে বসবাসের কারণে অনেকে চাইলেও গ্রামে চলে যেতে পারছেন না।

অন্যদিকে রাজধানীতে তাদের পক্ষে টিকে থাকাও ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। সীমিত আয় থেকে বাড়িভাড়া, সন্তানের লেখাপড়ার মতো নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের খরচ ঠিক রাখতে গিয়ে মৌলিক চাহিদা খাদ্যের খরচও কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বড় কোনো অসুখ না হলে ডাক্তার ও ওষুধের কথা ভাবতে পারেন না অনেকে। অনেকেই বছরের পর বছর সন্তান নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন না। পারছেন না প্রিয় সন্তানদের অনেক আবদার ও সখ পূরণ করতে।

রাজধানীতে বসবাস করলেও অনেকের আসলে গ্রামের অনেক গরিব পরিবারের চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন সেকথা কাউকে তারা বোঝাতেও পারেন না বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। উচ্চশিক্ষিত কিন্তু সীমিত আয়ের অনেকে বলেছেন, গ্রামের অনেক গরিব ও শহরের বস্তির অনেকের চেয়েও তাদের অবস্থা খারাপ।

গ্রামের গরিব লোকজন বর্তমানে অনেক উৎস থেকে অনেক ধরনের সহায়তা পান এবং গ্রামে তেমন আর শোচনীয় গরিব মানুষ নেই। কিন্তু রাধধানীর অনেক শিক্ষিত লোকের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। আর এর মূলে রয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

পেঁয়াজের স্মরণকালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার আড়ালে বেড়ে গেছে চাল, আটা, ময়দা, তেল, আলু, চিনিসহ আরো কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। ফলে আরেক দফা কঠিন হলো রাজধানীর সীমিত আয়ের মানুষের জীবন। অপর দিকে ঘৃর্ণিঝড়সহ দুই দফা বৃষ্টির কারণে বাজারে চলছে শীতের সবজির আকাল।

রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা ও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনায়েত বলেন, এক বছর আগেও মাসে বিুদ্যৎ বিল আসত পাঁচ থেকে ৬০০ টাকা করে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১৮ শ’ থেকে ১৯ শ’ টাকা করে। এরই মধ্যে দু’দিন আগে আবার দেখলাম সরকার বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাসের বিল ছিল ৫০০ টাকা। সেটা এখন সাড়ে ৯০০ টাকা। তবে সম্প্রতি মিটার বসানোয় খরচ কেমন হয় তা জানি না।

এনায়েত তার সীমিত আয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি তিন রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। প্রতি বছর এক হাজার টাকা করে বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়। বাড়িওয়ালা এ মাস থেকে পানির বিল ৫০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা করেছেন। বিদ্যুৎ বিলের বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে কাতর স্বরে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে মাসে দুই হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়া কেমন করে সম্ভব?

এনায়েত জানান, তার তিন সন্তান। এর মধ্যে দু’টি প্রাথমিকে এবং একজন মাধ্যমিকে পড়ে। বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর কারণে সন্তানের শিক্ষার ব্যয় তার সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে। কিন্তু তিনি চাইলেও এ ব্যয় কমাতে পারছেন না। তাহলে লেখাপড়াই বন্ধ করে দিতে হয় উল্লেখ করে এনায়েক বলেন, রাজধানীতে বেসরকারি স্কুল মানেই খরচ আর খরচ। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে অন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধির কারণে আমরা দারিদ্র্য হয়ে পড়েছি। ২৮ বছর ধরে রাজধানীতে বাস করছি। চাইলেও এখন আর গ্রামে ফিরে যেতে পারছি না। গ্রামে সে ধরনের কোনো আয়ের ব্যবস্থাও নেই। ফলে বাধ্য হয়ে কোনোমতে টিকে আছি রাজধানীতে।

এনায়েতের মতো অবস্থা রাজধানীর অনেক বাসিন্দারই। সীমিত আয়ের অনেকে জানিয়েছেন, বাড়ি ভাড়া, সন্তানের লেখাপড়াসহ কিছু নির্দিষ্ট ব্যয় ঠিক রাখতে গিয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছেন না তারা।

অনেকে বলেছেন, বাজার থেকে সব সময় কম দামে বেছে বেছে নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। মৌলিক কিছু পণ্য ছাড়া কখনো কোনো বাড়তি খাবার যেমন ফল, তৈরি খাবার, একটু বেশি দামের মাছ, গোশত এবং মুখরোচক কোনো কিছু সন্তানদের তারা কিনে দিতে পারেন না। সন্তানদের নিয়ে কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেন না।

রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় অতিমাত্রায় বৃদ্ধির কারণে অনেকে যেমন পরিবার নিয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছেন, তেমনি অনেকে আবার রাজধানীতে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরুই করতে পারছেন না। যদিও তারা দীর্ঘ দিন ধরে এখানে কর্মরত। অনেকে বিয়ে করলেও স্ত্রী সন্তান গ্রামে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে।

গত তিন দশকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সস্তার দিন শেষ হয়ে যায় মূলত ২০০৬ সাল থেকে। ২০০২ সাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম চড়া হতে থাকে। অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে দুর্যোগ বয়ে আনে। বিপুলসংখ্যক মানুষের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে পড়ে এর বিরুপ প্রভাব। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিজনিত নানামুখী সঙ্কট ক্রমে তীব্র হয়েছে রাজধানীতে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০১ সালে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে শতকরা মাত্র ১ ভাগ। ২০০২ সালে হঠাৎ করে তা ৪ ভাগে উন্নীত হয়। ২০০৫ সালে এটা বেড়ে শতকরা ৬ ভাগে দাড়ায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তখন এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছে যে, ২০০৬ সালে শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায় জিনিসপত্রের দাম। আর ২০০৭ সালে এটা আরো বেড়ে হয় শতকরা ১৮ ভাগ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। ২০০১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় শতকরা ৫ ভাগ। আর ২০০৬ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৩ ভাগ। ২০০৭ সালে বাড়ে শতকরা ১৬ ভাগ। ক্যাবের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ হার নির্ণয়ে চাল ডালের সাথে শাড়ি, লুঙ্গি, ফলসহ হরেক রকম জিনিস রয়েছে। এসব বাদ দিলে মূলত অপরিহার্য নিত্যপণের দাম বৃদ্ধির হার এ সময় অনেক বেশি ছিল।

  • কার্টসি — নয়া দিগন্ত/ ০১ ডিসেম্বর ২০১৯

‘অনিরাপদ সড়ক’ কেড়ে নিয়েছিল দুই দ্রুততম মানবকে

দেশের ইতিহাসের সেরা দুই অ্যাথলেট। দুজনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায়।










অনিরাপদ সড়ক এ দেশের দুঃখ। ক্রীড়াঙ্গনেরও হাহাকার। সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল দুই ইতিহাস-সেরা স্প্রিন্টার শাহ আলম ও মাহবুব আলমকে। এসএ গেমসের ১৩তম আসরের শুরুর দিনে এই দুই কীর্তিমানকে সামান্য শ্রদ্ধা...

এসএ গেমস এলেই শাহ আলমের কথা খুব মনে হয়। সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ সাফল্য বুভুক্ষু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে একাধিকবার জয়ের আনন্দে আনন্দিত করেছিলেন তিনি। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পরপর দুবার রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন আলম। ইতিহাস-সেরা এই অ্যাথলেটকে আমরা হারিয়েছি বড় অবেলায়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য অনিরাপদ সড়কের বলি হয়েছিলেন এই কীর্তিমান।

মাত্র ২৮ বছর বয়সেই এ দেশের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ, দেশকে অনেক কিছুই দেওয়ার বাকি ছিল তাঁর। ১৯৯০ সালের ২৯ মে নিজের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী থেকে মোটরসাইকেলে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু পথে পাবনার কাশিনাথপুরে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান তিনি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন। গাংনীর সাহেবনগর গ্রামে বাবা-মা আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফিরছিলেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে কেড়ে নেয় তাঁকে।

শাহ আলম নামটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৮৪ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে। সেবার সাইদুর রহমান ডন, আফতাব মোল্লা, মুজিবুর রহমান মল্লিকের সঙ্গে দল বেঁধে শাহ আলম জিতেছিলেন ১০০ মিটার রিলের সোনার পদক। সেবারই ফটো ফিনিশে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সোনার পদকটি হাতছাড়া হয়। আফতাব মোল্লার দুর্ভাগ্য, তিনি ভারতের স্প্রিন্টার আদিল সুমনওয়ালার কাছে সোনার পদক হারান। সেই অপূর্ণতাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন শাহ আলম। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে শাহ আলম আদিল সুমনওয়ালার গড়া ১০.৯০ সেকেন্ডের রেকর্ডটি ভেঙে (১০.৮০) দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ‘দ্রুততম মানব’ হয়ে দেশকে গর্বিত করেন। এখানেই তিনি থেমে যাননি। দুই বছর পর ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে নিজের রেকর্ড ভেঙে ১০.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্টের মুকুট নিজের করে নেন। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে স্প্রিন্টে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শাহ আলমের মাধ্যমেই।

১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ওই মুকুটটা ধরে রাখতে পারেননি শাহ আলম। সেবার কোনো মতে ব্রোঞ্জ জেতেন। শাহ আলমের জন্য সেটি ছিল নিদারুণ ব্যর্থতাই। দ্রুততম মানবের খেতাব হারিয়ে বিচলিত আলম নিজেকে ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৯০ সালের ২৯ মে তিনি ফিরছিলেন সে বছরই বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি শুরু করতে। ইসলামাবাদে সোনার পদক হারানো শাহ আলম এশিয়ান গেমসকেই নিজের ফেরার মঞ্চ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আর হয়নি। দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন কিনা, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি কখনোই। তাঁর মৃতদেহ শনাক্তই হয়েছিল অনেক পরে। তবে এটা ঠিক, শাহ আলমের মৃত্যু হতবিহ্বল করে দিয়েছিল গোটা দেশকে।

অনিরাপদ সড়ক শাহ আলমের মতোই কেড়ে নিয়েছিল আরেক দৌড়বিদকে। বাংলাদেশের খেলার ইতিহাস লিখতে গেলে শাহ আলমের মতোই মনে করতে হবে তাঁর কথা—মাহবুব আলম। ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ছিল তাঁর। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) সাফ গেমসে বলা নেই, কওয়া নেই ঝড়ের বেগে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে ফেলেছিলেন মাহবুব। শাহ আলমের একজন যোগ্য উত্তরসূরিকেই যেন সেদিন খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে ফটোফিনিশে ২০০ মিটারের সোনা হাতছাড়া হয় মাহবুবের। কিন্তু ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। কুমিল্লা থেকে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ফেরার পথে কাঁচপুরের কাছে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় মাহবুবের মাইক্রোবাসের।

এস এ গেমসের আরও একটি আসরের শুরু আজ থেকে। এমন দিনগুলোতে শাহ আলম কিংবা মাহবুব আলমরা আসেন বড় দীর্ঘশ্বাস হয়েই। আরও একজন শাহ আলম অথবা মাহবুবকে তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতা সেই দীর্ঘশ্বাসকে আরও প্রলম্বিত করে। এস এ গেমসের অ্যাথলেটিকসে ১৪ বছর ধরে সোনা জিততে না পারা বাংলাদেশ একজন শাহ আলম অথবা মাহবুবকে খুঁজে বেড়ায় খুব করেই।

  • কার্টসি — প্রথম আলো/ ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ 

বিষের সঙ্গে এইসব দিনরাত

আমিরুল আলম খান

গত কয়েক দিনে ঢাকার আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা। হেমন্ত, শীতে কুয়াশা থাকে। তাই তেমন বিচলিত হইনি। কিন্তু নাক-চোখ জ্বলছিল, শ্বাস নিতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। ভাবছিলাম, বয়স বেড়েছে, তাই এসব লক্ষণ। কিন্তু প্রথম আলো (২৫ নভেম্বর, ২০১৯) প্রথম পাতায় একই সঙ্গে দুটি খবর আর ভেতরে সম্পাদকীয় লিখে জানিয়ে দিল আসল সমস্যা অনেক গভীর এবং তা খুবই মারাত্মক। ইফতেখার মাহমুদের রিপোর্ট, ‘ঢাকা কাল ছিল সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর’ এবং রাজীব হাসানের ‘ঢাকার গাছপালাও বড় বিপদে’, সঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্য ‘কারও কি কোনো দায়িত্ব নেই? বায়ুদূষণের বাড়াবাড়ি’ পড়ে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। রিপোর্ট দুটির শিরোনামই উদ্বেগ তৈরির জন্য যথেষ্ট।

এদিনের রিপোর্ট ঢাকার বাতাস কতটা দূষিত তার ওপর। দুনিয়াব্যাপী বাতাসে দূষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। নভেম্বর মাসের আট দিনের বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে দূষিত। এই তালিকায় আরও আছে কলকাতা, দিল্লি, করাচি, বেইজিং, উলানবাটোর। এসব শহরের দূষণের মাত্রা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায় প্রায়ই।

কিন্তু দুশ্চিন্তার আরও কারণ আছে। শুধু ঢাকা নয়, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সাভার, ময়মনসিংহ, রংপুরের বাতাসের মানও খুব খারাপ ছিল এদিন। বোঝা যাচ্ছে, সারা দেশের বাতাস মাত্রাতিরিক্ত দূষিত। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বাতাসের মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। ঢাকায় এদিন বাতাসের গড় মান ছিল ২২০; কিন্তু কারওয়ান বাজারে তা ছিল ভয়াবহ মাত্রায় বেশি, ২৯৮! আন্তর্জাতিক হিসাবে বাতাসে দূষণের মানের এই সূচক ২০০ ছাড়ালে ঘরের জানালা বন্ধ রাখা, সাইকেল না চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মাস্ক ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়। খুব জরুরি না হলে শিশু ও বৃদ্ধদের বাইরে যেতেই নিষেধ করা হয়।

দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯-এর তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শুধু দূষিত বাতাসের কারণে অন্তত ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা গেছে! অন্য এক তথ্য বলছে, বাতাসের দূষণে মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীতে পঞ্চম। ঢাকা শহরে বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি!

ঢাকার বাতাসদূষণের জন্য মূলত শহরের আশপাশের ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলা দায়ী। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই বলাই ভালো। বিপর্যয় মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের যে উদ্যোগ আয়োজন থাকা দরকার, তা তেমনভাবে নেই। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশও তামিল হয় না এ দেশে। প্রথম দরকার শহরে এবং সারা দেশে প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষের সমারোহ এবং বিস্তৃত জলাশয়। তাহলে এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে মোট বন এলাকা দেশের ভূ-ভাগের ৬-৭ শতাংশ মাত্র, যা হওয়া উচিত অন্তত ২৫ শতাংশ। আর নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন পানির বড়ই অভাব। ঢাকা শহরে সামান্য কিছু লেক আছে বটে; কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য। তা ছাড়া এসব লেকের পানিও এমন দূষিত যে সেদিকে তাকাতেও ভয় হয়।

ধানমন্ডি, গুলশান, এমনকি এত ঢোল পেটানো হাতিরঝিলের পানিও ভীষণ দুর্গন্ধ, চরম দূষিত। দূষিত ঢাকা শহরের চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের পানি। এত দূষিত যে কোনো জলজ প্রাণীও এসব নদ-নদীতে বাঁচতে পারে না। আলকাতরার মতো কালো রং সেই পানির। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ভরাট করা হচ্ছে অন্যান্য জলাশয়, নিচু ভূমি, খাল, নদী। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স তথ্য দিচ্ছে, ২০১০ সালের ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) নির্ধারিত জলাভূমির ২২ শতাংশই ২০১৯ সালের মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। তথ্য আরও বলছে, ঢাকার বাতাসে ইটভাটা থেকে ৫৮ শতাংশ, রাস্তা ও মাটির ধুলা এবং মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়ায় প্রায় ২৬ শতাংশ দূষণ ঘটে। বাকিটা অন্যান্য বর্জ্য সূত্রে দূষিত হয়।

অন্যদিকে সবুজ গাছের বেষ্টনী কমতে কমতে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। গত কয়েক বছরে বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত এলাকায় লাখ লাখ বৃক্ষ সাবাড় করা হয়েছে উন্নয়নের নামে। অন্যত্রও একই চিত্র। কিন্তু এই নির্বিচার বৃক্ষ নিধনযজ্ঞের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কেবল লুটপাটের। সবকিছুই হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে। কিন্তু বিকল্প কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। দূষণের মাত্রা কত ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। ঢাকায় এখন সুস্থ সবল কোনো গাছ খুঁজে পাওয়া কঠিন। শুধু ঢাকার কথাই বা বলি কেন, গোটা দেশের অবস্থা কমবেশি একই রকম।

গাছের এমন বিবর্ণ দশা শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে থেকেই। এ নিয়ে প্রচুর রিপোর্ট কাগজে ছাপা হয়েছে, টিভিতে দেখানো হয়েছে। কিন্তু টনক নড়েনি কারও। ঢাকা শহরে এবং দেশের জাতীয় সড়কগুলোর পাশের গাছগুলোর মরণদশার শুরু অনেক আগে থেকেই। পাতার ওপর ধুলা জমে প্রথমে তার খাবার তৈরিতে বাধার সৃষ্টি করে। এরপর পানির অভাবে তার খাবারে টান পড়ে আরও বেশি বেশি। এরপর নানা টক্সিক উপাদান গাছের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

গাছ কমে গেলে অক্সিজেন তৈরিও কমে যায়। ফলে জীবনদায়িনী অক্সিজেনের অভাবে বিপন্ন হয় অন্য সব প্রাণীও। শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবী এত দূষিত হয়ে উঠেছে যে তার অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে এই গ্রহের তাপমাত্রা। মানুষ তাই শঙ্কিত। জীবের জন্য পানি অপরিহার্য। পানির নিয়মিত সরবরাহ বিঘ্নিত হলে প্রাণ বিপন্ন হবেই। নগর পরিকল্পনায় তাই জলাশয় ও সবুজ গাছের বেষ্টনী অতি আবশ্যকীয় শর্ত। গাছের নিয়মিত পরিচর্যাও। বৃষ্টির পানি ছাড়াও তাই জলসিঞ্চন নগরকর্তাদের নিয়মিত দায়িত্ব। উপযুক্ত বৃক্ষ নির্বাচন, পরিকল্পিত বৃক্ষায়ণ এবং পরিচর্যা ছাড়া কোনো নগর টিকে থাকতে পারে না। আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে শাসকদের অন্যতম কাজ ছিল জলাশয় সংরক্ষণ ও বৃক্ষ পরিচর্যা। মোগল সম্রাটেরা হিন্দুস্তানে বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যায় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাউড লককে। তিনি ছিলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেন এবং কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের কিউরেটর। এখনো রমনা এলাকায় মিন্টো ও হেয়ার রোডে প্রাউড লকের বৃক্ষসজ্জা কিছুটা টিকে আছে।

নিয়মিত জলসিঞ্চনের জন্য মাটির তল দিয়ে পাইপ বসিয়ে ফোয়ারায় গাছের পাতার ওপর পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া সারা দুনিয়ায় এক সাধারণ দৃশ্য। এর ফলে একই সঙ্গে অনেক কাজ হয়। ধুলো ধুয়ে যায়, গাছপালা দরকারি পানি পায়, শহরের তাপমাত্রাও কমে। কিন্তু আমাদের নগরপিতারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা, শুধু ঠিকাদার দিয়ে কাজ চলে না। আর ঠিকাদার যদি অসৎ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নগরবৃক্ষের তালিকা তৈরি করা উচিত বিশেষজ্ঞ দিয়ে। তাঁরাই নকশা করে দেবেন, কোথায় কোন কোন গাছ কেমনভাবে লাগাতে ও পরিচর্যা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নগর বৃক্ষায়ণ ও পরিচর্যা একটি বিজ্ঞান। আমলা, ঠিকাদার দিয়ে এ কাজ হয় না।

  • আমিরুল আলম খান: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
  • কার্টসি — প্রথম আলো /৩০ নভেম্বর ২০১৯

Friday, November 29, 2019

Ashfakus Samad Bir Uttam — story of a patriot

Ishtiaq Aziz Ulfat 


He was the first born, the coveted one, he was the sunshine of my parents, the special one in the family. And special he was. He was over six feet tall, lanky yet handsome. He was naturally charming and full of life. He always left behind a little of himself in which ever path he walked, whomever he came across. I guess, that is why even thirty three years after his death his friends and everyone who used to know him speak of him so fondly, taking pride in their acquaintance with him. It is as if they still derive some nobleness, some modesty by knowing, by being associated with this gallant, noble yet gentle human being.

This was Abu Moyeen Mohammad Ashfaqus Samad. A long name indeed which is why his friends had affectionately cut it down to Ashfi. Though his nick name was Nishrat, my parents had a special name for their special son; they lovingly called him Tani. We younger siblings according to custom called him Bhaiya. But by whatever name he was called it didn't matter. All loved him. It is indeed very difficult to accept his death, especially an untimely death. He was just 21, gone from us forever.

Lt Ashfaqus Samad has been laid to rest close to where he had breathed his last, in Joymonirhat in Rangpur district, having been killed in a frontal battle against the occupation Pakistani Army in the Liberation War of '71. The only solace is that he laid down his life to liberate his motherland, that he died in free territory and that he breathed free air before he died. He was brave and he died young.

The Pakistani Army's brutal assault on the unarmed people of Bangladesh (the then East Pakistan) coincided with the end of his honours final of DU. His subject was statistics and he was awaiting a reply from MIT in Chicago where he was seeking admission. But who knew then that he had been chosen for a bigger and better task, to serve his nation, to die for it and thus live forever. Who could ask for more?

The night of 25th March in 1971

On the fateful night of the 25th of March we were standing around the traffic circle in front of The Daily Ittefaq office. The street was full of people, and everybody in a state of tense apprehension, full of energy, but did not know what to do. We first saw two flares shooting up at the sky around 10 pm. The first one going up around the Gulistan area and the other one above the Rajarbagh police line. Even after all these years I can clearly picture the "fireworks", as if some thing that was happening just last night. The light from the flares lighting up the dark sky some how signaling the end of an era and the beginning of another --- the end of Pakistan (as it was) and the beginning of Bangladesh. I say this today in retrospect because at that moment we really could not anticipate the magnitude of destruction and horror that the Pakistan Army had let loose on the innocent people of Bangladesh on that fateful night.

We heard the sounds of gunfire a few minutes after seeing the flares, but the tanks actually rolled in around midnight. They took their position by the same traffic circle where we were standing a little while ago and fired the first shells targeting the Ittefaq office. The shellings shook our house. Very soon the newspaper office was ablaze and the flame went sky high. Our house being only a 100 yards away started getting the heat. The iron bars on the windows started to get hot and we kept pouring water on them fearing that the wooden window shutters might catch fire at any moment. Most of the employees of the press had crossed over to our house and went to safety through the back, except the ill-fated ones who took the direct hits. The fires and shootings raged on for about two hours after which things started quieting down, except occasional gunshot sounds. Even then we were so scared that we all huddled together all night long on the ground floor in a narrow space under the staircase. The next morning we crossed over the wall to see the damage next door. It was the first of the many horrendous sights that I would witness over the next few months till liberation. There were about a dozen bodies, scattered all over the machine room of the press, most of them burnt beyond recognition.

We were all confined to our house, glued to the radio till the next morning, when curfew was lifted for a couple of hours. In spite of my mother shouting at us not to leave the house we strayed out. Having gone just about 500 yards from our house I came across a scene which really changed my whole attitude towards life --- a small boy aged about ten had tried to crawl under a gate, probably when he had found the gate too high to cross over. The marauding Pakistani army had shot him dead as he had just put his head through the gap under the gate and there he was lying in a dried up pool of blood. This was when I realised that it was all over, that we were no longer Pakistan and that we were a new nation and we must now fight for our liberation and fight for a free Bangladesh. My friends and I continued to move about and went to Shakari Bazar into old town, where we saw that most of the houses were burnt, looted and marked with bullets. In one of the houses we saw another heart rendering scene; two bodies clinging together burnt to the bone as if making a statement saying, "together --- even in death". From here we went on to Jagannath Hall at Dhaka University where a huge number of students had been killed and the bodies were littered all over. On the field next to it we saw the hastily made mass graves of the ill-fated who were lined up, shot and killed; their hair, clothes and limbs still showing through the grass. (This killing was later shown on TV after liberation as it had been taped by some amateur photographer).

Bhaiya left home for the first time on 27 March, 1971. At that moment it was only he who knew that he was going to return shortly. On April 4, Bhaiya and three of his close friends made their way back into Dhaka. They had brought back with them six 303 rifles, 25 grenades and several hundred rounds of ammunition. They had done this at a time when most others were either making their way out of Dhaka to safety or were thinking about it. He had done this act when it was unthinkable. Yes, Bhaiya and his friends were the first guerillas to have taken up arms against the Pakistani Army in Dhaka City. Bhaiya's other friends were Shahidullah Khan Badal, Masud Omar known more to his friends as Masud Pong, and Badiul Alam Bodi who was later picked up by the barbarian Pak army and was tortured to death.

Bhaiya and his friends had acquired these arms from Kishoreganj where Major Shafiullah had positioned himself with 2nd Bengal. Badal Bhai had established contact with Lt. Helal Murshed, and their trust further cemented when Col Zaman (later on Commander of Sector 6) had found his way there. Major Khaled Musharraf with his 4th Bengal were heading north towards Akhaura from B'baria, and Lt Mahbub also arrived in Kishoreganj to establish contact with the other fragmented resistance forces. Later on Shafiullah, Khaled and Zia and others were to congregate at Teliapara in Sylhet at a tea estate where the first training camp for the FFs was to be established.

Bhaiya's group of four having arrived in Dhaka around dusk chose to halt for the night at our house. We had no clue of what they were up to, but they had to take my father into confidence, and my father, a man born with raw courage always stood by his children and encouraged them in all their naughty but bold and creative acts. They smuggled the arms to our roof only to be shifted to another friend's house in Dhanmondi the next day, this friend being Tawhid Samad and another recruit of that moment was their friend Wasek. But it didn't take them very long to realise that they could do little with their new found arsenal. Bhaiya and his friends decided to go up north and join with the resistance forces there. Only Bodi Bhai stayed back.

In the meantime my second brother Tawfiq had also left home to join the resistance struggle at Roumari in Rangpur where he had some friends. I also left home with a couple of friends on the 18th of April, and after about two weeks on the road we managed to reach Agartala, from where we eventually ended up at Matinagar, Sonamura, the first training camp for Freedom Fighters at that Sector, which was later on moved to Melaghar. Here we took crash courses on small arms and explosives from Capt Haider. We were amongst the first batches of trained guerillas who initiated sabotage operations in Comilla and Dhaka. Later on in Dhaka we joined up with the same group which Badal Bhai and Bhaiya had organised before their departure from here. We worked with this cell and organised and recruited many more Freedom Fighters who undertook many small and big operations in the city.

Ashfaqus Samad, Bir Uttam


Bhaiya had come home to Dhaka for the last time in early June and that was the last time that his near and dear ones saw him. Soon after his return to camp he was selected for training as a commissioned officer where he successfully completed his training and was sent to liberate areas in the northern part of Bangladesh. He was now Lt Asfaqus Samad with his own company to lead. He and his company liberated many areas of Bangladesh till they reached a place called Raiganj, forty kilometres north-west of Kurigram. The Pakistan Army had set up a strategic stronghold there. If they could be routed from this bastion the occupation army's next line of defence would recede to Kurigram. Lt Samad and his fellow officers were planning to launch an attack on this stronghold when he received orders transferring him to Sector Headquarters. His reaction was typical of him. He sent a message through courier that he would report to duty in a few days time. He did not want to miss the big assault. After all he and his colleague Lt Abdullah had been planning it.

The date of the assault was fixed for Nov 19, 1971. Ironical as it may seem, it was the same day that his parents, being haunted by Pakistan army due to their son's involvement in the freedom struggle had left Dhaka for sanctuary, either in a liberated area or in India, where they had also hoped to meet their beloved son. While Lt Samad's parents embarked on this perilous trip towards the west, Samad himself was sitting in a bunker way up north preparing his line of attack on the Pakistanis.

The occupation Army's position was strong indeed. Over the bridge on the river Dudhkumar they had placed six medium machine guns. Across the river they held fortified positions in several buildings where there were at least three more heavy machine guns with them. The enemy had a good sight over the plain area on the west of the river.

The Mukti Bahini and the allied forces decided to launch a five company strong attack --- two of the companies were of the Mukti Bahini commanded by Lt Samad, one was a Rajput company commanded by Major Opel of the allied army and two companies were of the Border Security Force. They would advance in the dark of the night, dig in their positions on the bank of the river and take on the enemy.

The advance was smooth. Digging in was about to begin. Then there was an explosion. A mine had exploded somewhere near the position of the Rajput company. The occupation hordes opened up with every thing they had.

Lt Samad's reaction, who was in one flank, was instantaneous. He ordered his troops to retreat a few hundred yards and take cover. He then ordered his faithful JCO to leave his wireless set behind and go back to join his troops. He himself would call in artillery support. He would not budge from his own position. Realising the danger his JCO did not want to leave his Commander.

Meanwhile the situation had become precarious. The Mukti Bahini companies as well as those of the allied forces were finding it difficult even to take cover. Firing from the enemy was intense. Lt Samad took his second and last decision. He shifted his position a little and moved his own medium machine gun with him. Then he opened up with his weapon to give cover to his troops. The enemy immediately concentrated all its fire on the young soldier. The unequal fight lasted for twenty minutes, but valuable twenty minutes in which time the Mukti Bahini troops had reached safety. Suddenly after those breath taking twenty minutes the soldiers on the liberation army could not see any more spitting of fire from Lt Samad's machine gun.

The faithful JCO made a daring trip back to his commander's position. There he found the commander lying motionless. A bullet had pierced through his forehead. But there was no sign of agony on his face. He was lying in peace. Only his fingers were clenched, those long thin fingers which people say is a mark of artistic inclination, those fingers which Lt Samad's father and mother so lovingly caressed and kissed even after he had grown up. Gone was the darling of Mr. Azizus Samad, a lion of a father, best friend to his children, who had suffered indescribable misery and torture in the hands of the Pakistan army who had come looking for his guerilla sons. Gone was the darling of Mrs. Sadeqa Samad a prize-winning teacher, a Fulbright Scholar, an Honorary Judge whose mission in life was to love other's children and educate them. Gone was a valiant freedom fighter. And as long as they lived never had a day gone by with out his mother shedding tears for her son, never had a moment gone by without his father gazing out of the window, may be thinking about his son, or may be wandering about him and wishing for death to embrace him at its earliest, so that he could join his beloved son his beloved Tani.

The soldiers who fought under Lt Samad's command loved him true and they fought a fierce battle to recover his body, in the process five of them laid down their lives. They also held their mission dear. They and the allied forces finally overran the occupation army position. In the battle Major Opel also laid down his life. The allies confirmed their friendship in a stream of blood. After the victory the soldiers performed the last rites of their fallen commander and comrades. Lt Samad and three of his comrades were laid to eternal rest in a Joymonirhat mosque compound with a 27 gun salute.

May be Lt Samad had an ordinary death in an ordinary Battle but ordinary he was not. Uncanny as it may sound, two statements on two different occasions still make me wonder about something extra ordinary about him. Once in a conversation with my mother he had said in a matter of fact way, "Amma, we are four brothers, can't you dedicate just one for a greater cause, for the Liberation of our Motherland?" Naturally he had not expected an answer from her. But little did we realize that he was speaking of himself in a surrealistic way, or did he?

Another time replying to a letter received from his friend Ruma, he wrote on the 3rd of Nov 1971, "It is nice to receive your lovely letter here at the battle front. Your letter reminds me in this bunker, amidst all these explosions that there is another world out there beyond this arena of death and destruction." He did not forget to make a point of the main purpose of his being out there at the front, fighting a war. And so without even realizing he patriotically wrote, "You should be glad to know that I am writing to you from a free territory of Bangladesh and I have to tell you that I never realized how sweet it is to smell and breathe free air in free Bangladesh." But at the end he did not forget the reality around him, and that death might be just round the corner which is so common fold in war. In the last paragraph he writes, "I liked your poem immensely. So, it seems that there will be a poem or an epitaph inscribed on our mass graves. I propose that you write it. And of course do not forget to leave a flower."

Souls like Ashfaqus Samad and thousands like him have sacrificed their lives so that we have a free land of our own, a land to develop or to destroy. Our land liberated by us, to be ruled by us, our destiny in our own hands.

Let us believe this "worst of times" we are in, shall pass too and a new generation will be born. And they will see to it that all crisis is over come, that all challenges are met with bravery, just as our generation did in 1971. Yes, patriots will again be born --- if need be they will rise from the Ashes.

Ishtiaq Aziz Ulfat 



— The writer was a Freedom Fighter in Sector-2.
—  The piece was first published on March 26, 2004 in the Daily Star. 

Link —  https://bit.ly/2Du35m2


Thursday, November 28, 2019

দূষিত রাজধানী দূষিত দেশে বসবাস

সায়ন্ত সাখাওয়াৎ

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা : নিরীহ মানুষের নীরব ঘাতক দূষিত বায়ু (যুগান্তর, ২৬ নভেম্বর ২০১৯), বিশ্বে সবচেয়ে বায়ু দূষিত দেশের তালিকায় প্রথম বাংলাদেশ (দৈনিক ইত্তেফাক, ০৬ মার্চ, ২০১৯), সবচেয়ে দূষিত বায়ুতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮), বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী ঢাকা, সবচেয়ে দূষিত বাংলাদেশ (ডেইলি স্টার, ০৬ মার্চ, ২০১৯)- এই সংবাদ শিরোনামগুলো বলে দেয় আমরা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছি।

সাম্পªতিককালে বেশ উদ্বেগের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে ঢাকার বায়ুদূষণ। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের ‘গ্যাস চেম্বার’ আখ্যা পাওয়া দিল্লির বাতাসের চেয়েও ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজুy¨য়াল’-এর বায়ুমান সূচকে (একিউআই) বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ঢাকা।
সায়ন্ত সাখাওয়াৎ

২৬ নভেম্বর ২০১৯ এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দৈনিক যুগান্তর লেখে– বিশ্বগণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার বায়ুদূষণের কারণে শিরোনাম হয়েছে দিল্লি। সেখানে দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, সেখানে স্কুলগুলো পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বায়ুমান পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজু¨য়ালের তথ্যমতে, ভারতের দিল্লি, কলকাতা এমনকি পাকিস্তানের লাহোরকে হটিয়ে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর সূচকে সবার ওপরে চলে গেছে প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা। বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে যুগান্তর লেখে– সারা দেশে সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা পরিচালনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম, শিল্পকারখানার উন্মুক্ত নিঃসরণ ও যানবাহনের ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, কঠিন বর্জ্য ও বায়োমাস পোড়ানো বায়ুদূষণের মূল কারণ। আর রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে ভবন ও অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ উন্মুক্তভাবে করার ফলে শহরের বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বাড়ছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থাৎ এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, মেট্রোরেলসহ অন্য প্রকল্পগুলোকে কার্যকর পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা প্রতিপালন, সঠিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণপূর্বক মাটি, বালি ও অন্যান্য সামগ্রী পরিবহন, সংরক্ষণ, কার্যকর কর্মপরিবেশ রক্ষা করা, সময়মতো রাস্তাঘাট সংস্কার, মেরামত ও বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়মিত পানি ছিটানোসহ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণসামগ্রী অর্থাৎ মাটি ও বালি পরিবহনে মাটি-বালির একটি অংশ রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে যা পরবর্তী সময়ে বায়ুদূষণ সৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ, ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশে দীর্ঘদিন স্ত‚পীকরণ ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনের সময় অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থাপনার ফলে একটি অংশ রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনার ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ফলে বায়ুদূষণের সৃষ্টি করছে।

২০১৮ সালের বায়ুতে দূষণের মাত্রা নিয়ে ২০১৯ সালে আইকিউএয়ার, এয়ারভিস্যুয়াল ও গ্রিনপিসের প্রকাশিত গবেষণা  প্রতিবেদন থেকে আমরা জেনেছিলাম বায়ুদূষণে আমরাই সেরা। আর আমাদের পরেই আছে দেশ পাকিস্তান ও ভারত। বাতাসের মধ্যে ‘পিএমটুপয়েন্টফাইভ’ নামে পরিচিত যে সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি হিসাব করে এ প্রতিবেদেন করা হয় তাতে ১০০-তে আমাদের প্রাপ্তি ছিল ৯৭.১। এই স্কোর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের ৭৪.২৭ এবং তৃতীয়তে থাকা ভারতের ৭২.৫৪। আর সবচেয়ে কম দূষিত তিন দেশ আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার স্কোর যথাক্রমে ৫.০৫, ৬.৫৭ ও ৬.৮২। সবচেয়ে কম দূষণের দেশের তুলনায় ৯২ পয়েন্ট বেশি পাওয়া আমরা যে কতটা ভয়াবহ খারাপ অবস্থানে আছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি খারাপের দিক থেকে সেরা বাংলাদেশের সঙ্গে, দ্বিতীয় সেরা পাকিস্তানের ব্যবধানটা কিন্তু অনেক বড় (২২.৮৩)! অর্থাৎ দ্বিতীয় সেরা পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় ২৩ পয়েন্ট বেশি নিয়ে আমরা সেরা খারাপ হয়েছি। এই ‘পিএমটুপয়েন্টফাইভ’ কণাগুলো মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। পিএমটুপয়েন্টফাইভ এমন সব দূষণকণাকে বোঝানো হয়, যাদের ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের বেশি না।

এর আগের বছরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম স্থানে। অর্থাৎ দ্বিতীয়। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম যখন এ সূচকটি তৈরি করা হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। গত এক যুগে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮)।

আওয়ামী লীগ সরকারের নেতারা পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর আসে। বায়ুদূষণে এক যুগে ৫৪ ধাপ পিছিয়ে প্রথম হওয়ার জন্যই কি সে পুরস্কার!

বাংলাদেশের বায়ুদূষণের প্রধান কারণ কী সে বিষয়ে প্রথম আলো লিখেছে, ২০১৬ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের কেইস প্রকল্পের আওতায় ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস ও ধরন নিয়ে একটি জরিপ হয়েছে। নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব এয়ার রিসার্চের মাধ্যমে করা ওই জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে প্রায় এক হাজার ইটভাটায় নভেম্বরে ইট তৈরি শুরু হয়। এসব ইটভাটা বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। কথা হলো, এই সব ইটভাটা কি ২০০৬ সালের আগে ছিল না? তাহলে নতুন আর কী সব কারণ যুক্ত হলো যা বাংলাদেশকে সেরা দূষিত দেশ বানিয়ে দিল? বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে বলে ওই রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়েছে। আর এর মধ্যে প্রায় সোয়া লাখ যে বাংলাদেশের থাকবে সে ধারণা পাওয়া যায় বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট থেকে (বায়ুদূষণে এক বছরে বাংলাদেশে লক্ষাধিক প্রাণহানি : গবেষণা  প্রতিবেদন, এপ্রিল ০৪, ২০১৯)। রিপোর্টে লেখা হয়, ঘরে-বাইরে বায়ুদূষণের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে; দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুই গবেষণা সংস্থা। হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন নামের দুই গবেষণা সংস্থার এক যৌথ প্রতিবেদনে।

দেশে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। প্রতি বছর যুক্ত হয় নতুন ৩ লাখ রোগী এবং বছরে মারা যায় প্রায় ৫০ হাজার রোগী। দি চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর চলতি বছরের মার্চ মাসে তাদের ৩৯তম বার্ষিক সাধারণ সভা ও বৈজ্ঞানিক সম্মেলন জানিয়েছে এই তথ্য। আর এর কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পরিবেশ দূষণকারী যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যাবৃদ্ধি, শব্দদূষণ ও শিল্প-কারখানার নির্গত ধেঁঁায়াকে। এসব কারণে দেশে বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অব্যাহত বায়ুদূষণের ফলে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, শ্বাসনালি ও ফুসফুসে নিউমোনিয়া সংক্রমণ, সিওপিডি এবং ফুসফুসের ক্যানসার ছাড়াও বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার রোগ বেড়েই চলেছে। শুধু বায়ুদূষণই নয়, অন্যান্য প্যারামিটারেও ঢাকার অবস্থা বেগতিক। কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় বসবাস অযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট পেয়েছে। এ সার্টিফিকেটটি দিয়েছে লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ‘ইআইইউ’। চলতি বছরে ১৪০টি দেশ নিয়ে করা হয়েছে এই তালিকা। বসবাসের অযোগ্য শহরের এ তালিকায় ঢাকার থেকে খারাপ দুটি শহর হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক এবং নাইজেরিয়ার লাগোস। বছর দুই আগে এই র‌্যাংকিংয়ে আমরা প্রথম ছিলাম। এবার হয়েছি তৃতীয়। এ বছরই আমরা যানজটে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছি। শুধু তা-ই নয়, সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও ঢাকা পঞ্চম। এই তালিকাটিও করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রেখে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে ঢাকা চতুর্থ অনিরাপদ নগরী। আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ষষ্ঠ অনিরাপদ নগরী ঢাকা। নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ মহানগরের মধ্যে বিশ্বে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা। যৌন সহিংসতা বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ; এখানে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জিপজেটের করা পর্যবেক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা (ঢাকা কেন অযোগ্য শহর, দৈনিক দেশ রূপান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)

বিশেষ ব্যবস্থায় ট্রাফিক এড়িয়ে এসি গাড়িতে চলা রাষ্ট্র পরিচালকরা হয়তো বুঝবেন না এই শহরে নাকে-মুখে রুমাল বা হাত চেপে চলা মানুষের কষ্ট। ধুলায়-গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ রাস্তায় বের হলেই নিজের অজান্তই তার হাতটা ঢাল হয়ে দাঁড়ায় নাক-মুখের সামনে। ছোট্ট শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সময় নাক চেপে হাঁটে বা বাহনে বসে থাকে। এই সব দেখেও যাদের লজ্জা হয় না তারাই হাসিমুখে কেবল উন্নয়নের গল্প শোনাতে পারেন।

  • লেখক— সায়ন্ত সাখাওয়াৎ/ চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি — দেশ রূপান্তর/ ২৮ নভেম্বর, ২০১৯

Wednesday, November 27, 2019

মিলনের আত্মত্যাগ ও আজকের বাংলাদেশ

সেলিনা আখতার

 শহীদ ডা.শামসুল আলম খান মিলন



একজন মায়ের জীবনে তাঁর সন্তানের লাশ দেখার মতো মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক ঘটনা বোধ হয় পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। বুকে একটিমাত্র গুলির অব্যর্থ আঘাতে মিলন রাজপথে লুটিয়ে পড়েছিল। মিলনের গুলিবিদ্ধ স্থানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আমার চোখে আজও জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে সে স্থানটি। অনেকটা জায়গাজুড়ে আমার প্রিয় সন্তানের বুকের ছোপ ছোপ রক্তে যেন বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি ভেসে উঠেছিল। ২৯ বছর ধরে এ দৃশ্য আমি ভুলতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি, এ দেশের ও সমাজের মানুষগুলো আমাকে ভুলতে দেয়নি। মিলনের হত্যার সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক শক্তি দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। গণতন্ত্রের লেবাস পরে এর নেতারা সংসদের আসন অলংকৃত করেছেন। এই হত্যার কোনো বিচার হয়নি। সে কারণেই হয়তো তাঁর দলের একজন নেতা কিছুদিন আগে শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে সদর্পে উচ্চারণ করেছেন ‘নূর হোসেন একজন ইয়াবাখোর নেশাখোর ছিল।’ অপর একজন নেতা (সেই দলেরই) শহীদ মিলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘মিলনকে হত্যা করা হয়েছে কি না, সেটা বিতর্কিত বিষয়।’

সেলিনা আখতার শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মা

অথচ ডা. মিলন হত্যার ব্যাপারে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। ওর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ আছে পরিষ্কারভাবে, একটি ‘৩০৩’ বুলেট মিলনের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে রক্তক্ষরণ ঘটায়। ৩০৩ বুলেট কাদের কাছে থাকে, তা দেশবাসী জানে। 

দেশের জন্য, জাতির জন্য যারা নিঃস্বার্থভাবে জীবন উৎসর্গ করে গেল, তাদের সম্পর্কে অশালীন উক্তি করতেও এরা দ্বিধাবোধ করেন না। ক্ষমতায় যাওয়ার কূটকৌশল জানাটা এঁদের প্রধান লক্ষ্য। মিলন হত্যার পর দীর্ঘ ২৯ বছর পার হয়েছে। বারবার চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত শহীদ মিলনের স্মৃতি রক্ষায় একটি রাস্তার নামকরণ করা সম্ভব হয়নি। গত বছর ঢাকা দক্ষিণের মেয়রকে বলা হয়েছিল। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, কোনো রাস্তার নামকরণ করা সম্ভব হবে না। একজন সৎ, আদর্শবান, রাজনীতিসচেতন, নির্লোভ ব্যক্তিত্বের অধিকারী শহীদকে শ্রদ্ধা জানাতে যে জাতি ব্যর্থ হয়, সে জাতির তরুণেরা দেশপ্রেমে কখনো উদ্বুদ্ধ হয় না। 

মিলন আজীবন সংগ্রাম করেছিল, আন্দোলন করেছিল এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ও শৃঙ্খলিত জাতিকে মুক্ত করার জন্য। ১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর মিলন নিজের জীবন উৎসর্গ করে গণমানুষের সেই মুক্তির দুয়ার খুলে দিয়েছিল। শৃঙ্খলমুক্ত জাতি সেদিন আনন্দ-উল্লাসে রাজপথ প্রকম্পিত করেছিল। আর আমার পরিবারের সবার হৃদয়ে ছিল মরুভূমির হাহাকার। সে দিনগুলো আমার হৃদয়াকাশে কোনো দিন ম্লান হওয়ার নয়। হৃদয়ের নীরব রক্তক্ষরণ আজীবন আমাকে কাঁদাবে। 

মনে মনে ভাবি, মিলনের স্বপ্নগুলোকে যদি আমি বাস্তবায়ন করতে পারতাম, তাহলে হয়তোবা এ ক্ষরণ কিছুটা লাঘব হতো। কিন্তু আমি অক্ষম এক মা, যার শারীরিক বা মানসিক কোনো শক্তিই আজ আর অবশিষ্ট নেই। জীবনসায়াহ্নের এ বেলায়, আমার ছেলের স্বপ্নপূরণের সাধ্য আমার কোথায়? সমাজ আর রাষ্ট্রের সে দায়িত্ব পালনের কথা! কিন্তু তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। মিলনের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সংগঠন গড়ার চেষ্টা করছি। ওর স্মৃতি রক্ষা করতে হলেও ওর স্বপ্নগুলোর কিছু অন্তত বাস্তবায়নের মাধ্যমে করতে হবে। কিন্তু কর্মীর অভাবে তা-ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন মনে হচ্ছে। জানি না আমার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য কতজনকে আমার পাশে পাব। বর্তমান সমাজে মানুষ বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। কারও জন্য এতটুকু সময় ব্যয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। 

মিলন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। যে আকাঙ্ক্ষা দেশের তরুণসমাজকে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করেছিল, তার কতটুকু বর্তমান সমাজে বিদ্যমান? কোথায় সমতাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা? বর্তমান সমাজে নেই মানবিক মূল্যবোধ, নেই ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা, প্রশাসনে নেই স্বচ্ছতা, শিক্ষার মানে ধস নেমেছে। দেশের তরুণসমাজ আজ মাদকাসক্ত, অবৈধভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চলেছে দীর্ঘদিন। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারের সম্মুখ কাতারে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমান সমাজে নারী ও শিশুর জীবনও নিরাপদ নয়। স্বাস্থ্য খাতেও চলছে চরম নৈরাজ্য।

সামরিক শাসনের অবসানের ২৯ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমরা উন্নয়নের মহাসড়কের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা কি পূর্ণতা পেয়েছে? সমাজ আজ স্পষ্টত দুটি ভাগে বিভক্ত। ধনী আরও ধনী হয়েছে, দেশের ধন-সম্পদ গুটিকয় মানুষের কুক্ষিগত। কাঠামোগত উন্নয়নই উন্নয়ন নয়। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, তাদের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়নের মাপকাঠি। সমাজে নৈতিক ও গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ঘটেনি। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে প্রতিনিয়ত। তরুণসমাজের কিছু অংশ আজ বিপথগামী। তরুণসমাজের এ অবক্ষয় রোধে সমাজ ও রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে পরিবারের। এ ক্ষেত্রে পরিবারের দায়িত্বটাই বেশি। প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব তাদের সন্তানদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা। কিশোর বয়স থেকেই মাতা–পিতা সন্তানের মনে সামাজিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো যদি জাগাতে সক্ষম হন, তাহলে সন্তানেরা সঙ্গদোষে বা পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনৈতিক কিছু শিখলেও তা তাদের চরিত্রকে ততটা প্রভাবিত করতে পারে না। 

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ, সুন্দর সামাজিক জীবন দেওয়ার দায়িত্ব আপনার, আমার সবার। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে নৈতিক জাগরণ, সুস্থ জীবনাদর্শের চর্চা, দেশপ্রেমের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ক্রমাগত বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রহীনতা বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের থিওরিও ছিল গণতন্ত্র নয়, দেশের জন্য উন্নয়নই আসল। আইয়ুব খানের সেই নীতির পরিণতি কী হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। 

  • সেলিনা আখতার ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মা।
  • কার্টসি — প্রথম আলো/ নভেম্বর ২৭, ২০১৯ 

Tuesday, November 26, 2019

একাদশ সংসদ নির্বাচন যেমন দেখেছি

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন




দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হচ্ছে দেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও চারদলীয় ঐক্যজোট নির্বাচন বয়কট করেছিল। ফলে একতরফা একটি নির্বাচনে প্রায় সকল আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ সরকার আবারো ক্ষমতাসীন হয়। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের দাবি ছিল- সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই ন্যায্য দাবিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বাধ্য হয়ে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করে এবং অন্যদেরও নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানায়।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে শতকরা মাত্র ৫-১০ ভাগের বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি। সরকারের ‘একান্ত বাধ্যগত’ নির্বাচন কমিশন সারা দেশে ‘ভুতুড়ে’ ভোটকে আমলে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। এতে দেশে একটি ভোটারবিহীন অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক পার্লামেন্ট গঠিত হয়। সেখানে জাতীয় পার্টির এক অংশকে ক্ষমতায় এবং অপর অংশকে বিরোধী দলে বসিয়ে জাতির সাথে তামাশা করা হলো। গায়ের জোরের জনবিচ্ছিন্ন সরকার তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়কালে দেশে নজিরবিহীন নৈরাজ্য, অপশাসন এবং বিরোধী দলের ওপর সীমাহীন নির্যাতন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা, বানোয়াট ও ‘গায়েবি’ মামলা দিয়ে এবং ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে বিএনপিকে দুর্বল করার সর্বাত্মক প্রয়াস চালায়।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে নির্বাচন থেকে পুনরায় দূরে রাখার অভিপ্রায়ে, কৌশল হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বানোয়াট ও মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তিনি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন, সেজন্য তার শাস্তি বৃদ্ধি এবং প্রাপ্য জামিন থেকে বঞ্চিত করা হলো।

দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শক্রমে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট দেশনেত্রীর মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টির উদ্দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠিত হয়। 

ড. কামাল ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। নেতৃত্বহীন ও লক্ষ্যহীন অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সকল প্রার্থী ধানের শীষ মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ক্ষমতাসীন সরকার তার গণতান্ত্রিক চরিত্র ও মূল্যবোধের অভাবে বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। জনগণ বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির গণভোট হিসেবে গণ্য করে এবং ধানের শীষের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থনের মাধ্যমে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছে। সরকার স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে, জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। তাই ক্ষমতাসীন দল ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগের রাতেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়। তা এতটাই লাগামহীন ছিল যে, সারা দেশে বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলকে ছয়টিসহ বিরোধী দলকে মাত্র আটটি আসন দিয়ে ক্ষমতাসীনরা ২৯২টি আসন দখল করে নিয়েছে।

এমন একটি প্রহসনমূলক, নজিরবিহীন ও ভোট ডাকাতির কথিত নির্বাচনে আমি নিজে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) এবং কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। বিরোধী দল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হবে, এমন ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশের মতো আমার নির্বাচনী এলাকায়ও শুরু হয়েছিল প্রশাসনকে ব্যবহার করে গায়েবি মামলা, হয়রানি ও গ্রেফতার। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে নির্বাচনের মাঠ থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের এলাকাছাড়া করে দেয়া হয়। বিনা প্রতিরোধে ‘ভোট ডাকাতি’র সব আয়োজন সম্পন্ন হলো। 

নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সাথে নির্বাচন-পূর্ব আলোচনায় নির্বাচনে ‘সমতল ভূমি’ সৃষ্টির যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে এর সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। নির্বাচনের পর দেশী-বিদেশী মিডিয়া এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের একাদশ নির্বাচনকে ভুয়া, অগ্রহণযোগ্য এবং ‘গণতন্ত্রের কফিনে সর্বশেষ পেরেক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গণতন্ত্রের কোনো মানদণ্ডেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়েছে বলে তারা তা মেনে নেননি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে কী পরিমাণ কারসাজি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ভোট ডাকাতি হয়েছে, তার নমুনা আমার দু’টি নির্বাচনী আসনের ফলাফল পর্যালোচনা করলেই দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ দু’টি আসনে ভোটের ফলাফলের একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ প্রদান করা হলো-

একাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-১ এবং ২ আসনের ভোটের ফলাফল

কুমিল্লা-১ :
















কুমিল্লা-২ :



কুমিল্লা-১ এবং কুমিল্লা-২ আসনের কথিত নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, এ দুটো নির্বাচনী এলাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশে ভোটের নামে কী পরিমাণ জালিয়াতি, কিভাবে ২৯ ডিসেম্বর রাতে বাক্স ভরে এবং পূর্বপরিকল্পিত ছকে অবিশ্বাস্য ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে।

নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিগত নির্বাচনগুলোতে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭০ শতাংশের কম। বাংলাদেশে কোনো জাতীয় নির্বাচনে এর বেশি উপস্থিতি অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। ৭০ শতাংশের অতিরিক্ত ভোটার উপস্থিতি, সম্ভব ভোট ডাকাতি, একযোগে ব্যালটে সিল মেরে দেয়া বা আগের রাতে বাক্সে ভোট ভর্তি করে দেয়ার মাধ্যমে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে তাই ঘটেছে দেশ-বিদেশে সর্বজনস্বীকৃত। কুমিল্লা-১ আসন দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত। ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দাউদকান্দি উপজেলায় ৯২ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫৫টি ভোটকেন্দ্রে ৭০ শতাংশের কম ভোটার উপস্থিত হয়েছে, যা মোটামুটি স্বাভাবিক বলে গণ্য করা যায়। অবশিষ্ট ৩৭টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৭১ থেকে ১০০ শতাংশ। এটা সম্ভব হয়েছে আগের রাতে এবং ভোটের দিন সকালে কেন্দ্র দখল করে নৌকায় একতরফা সিল দেয়ার মাধ্যমে। হুমকি-ধমকি ও প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ভোটাররা যে ৫৫টি ভোটকেন্দ্রে মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে ভোট দিতে পেরেছে, সেখানে ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছে মোট ৫৫৬৭১ ভোট এবং নৌকা পেয়েছে ২১৭৮১ ভোট। ৭১ শতাংশের ঊর্ধ্বে প্রাপ্ত ভোটের অবশিষ্ট ৩৭টি কেন্দ্রে ধানের শীষ পেয়েছে ২৭৩৭৮ ভোট এবং নৌকা পেয়েছে মোট ৫৪৬২৬ ভোট। উল্লেখ্য ৯০ শতাংশের ঊর্ধ্বে প্রাপ্ত ভোটের ছয়টি কেন্দ্রে ধানের শীষকে দেয়া হয়েছে ১৭৯১ ভোট আর নৌকাকে দেয়া হয়েছে ১২৯০০ ভোট। 

কুমিল্লা-১ আসনের অপর উপজেলা, নদীবেষ্টিত মেঘনা উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ভোটের আগের রাত থেকে ভোটকেন্দ্রের ধারে-কাছেও যেতে দেয়া হয়নি। আগের রাতেই নৌকা সমর্থকরা ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রায় সব ভোট নৌকায় সিল মেরে বাক্সে ভর্তি করে দেয়। নির্বাচনের দিন সকালে ‘ভোট শেষ হয়ে গিয়েছে’ এই কথা বলে ভোটকেন্দ্র থেকে ভোটারদের সরিয়ে দেয়া হয় প্রশাসনের সহযোগিতায়। ফলে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তির ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১টি, যে কেন্দ্রে ধানের শীষ পায় ১৪৩২ ভোট এবং নৌকা পায় ৪৩৯ ভোট। জনগণ ভোট দিতে পারলে ফলাফলের ধরন এ রকম হওয়ারই কথা। কিন্তু প্রস্তুতকৃত ফলাফলে দেখা যায়, অবশিষ্ট ৩৫টি কেন্দ্রে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে এবং এই ৩৫টি কেন্দ্রে ধানের শীষকে দেয়া হয় মোট ১০৬৫৬ ভোট, আর নৌকার ভোট দেখানো হয় মোট ৭৭২৬৩ ভোট। এই উপজেলায় একটি ভোটকেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখানো হয়, যা কোনোক্রমেই স্বাভাবিক নয়। এ অবস্থায় কুমিল্লা-১ আসনের দাউদকান্দিতে আমি এগিয়ে থেকেও মেঘনা উপজেলায় ভোটের নজিরবিহীন কারচুপি এবং আগের রাতে ভোট ডাকাতি করে আমাকে এই আসনে ‘পরাজিত’ করা হয়েছে।

কুমিল্লা-২ আসনটি হোমনা ও তিতাস উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ আসনে মরহুম এম কে আনোয়ার অতীতে সংসদ সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর কারণে এই আসনে বিএনপি থেকে আমাকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। কুমিল্লা-২ আসনের তিতাস উপজেলাটি আগে দাউদকান্দি উপজেলার অংশ ছিল। দাউদকান্দি উপজেলায় গোমতী নদীর উত্তরে অবস্থিত ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি সরকারের সময় তিতাস নামে একটি নতুন উপজেলা প্রতিষ্ঠা করেছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি নবগঠিত তিতাস উপজেলার শুভ উদ্বোধন করেন। এ কারণে নতুন এ উপজেলার জনগণ দলমত নির্বিশেষে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থক ও গুণগ্রাহী। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নবগঠিত তিতাস উপজেলাকে আমার নির্বাচনী এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে হোমনা আসনের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে তিতাসের জনগণ আমাকে ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তিতাস উপজেলায় সর্বস্তরের মানুষ আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন প্রদান করে। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই আসনের হোমনা উপজেলা ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। ইতঃপূর্বে হোমনা আসনে ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে বিএনপি যতবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, ততবারই বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন (প্রথমে মর্তুজা হোসেন মোল্লা ও পরবর্তীতে চারবার মরহুম এম কে আনোয়ার বিজয়ী হন)। এই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে হোমনা উপজেলার জনগণ আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করেছে। নির্বাচনে আমার জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোটের আগের রাতে (২৯ ডিসেম্বর) প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কুমিল্লা-২ আসনের উভয় উপজেলার ভোটকেন্দ্রগুলো চর দখলের মতো করে দখলে নিয়ে একতরফা নৌকায় সিল মেরে ভোটের অপমৃত্যু ঘটান।

কুমিল্লা-২ আসনের ঘোষিত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হোমনা উপজেলার ৫৪টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র তিনটি কেন্দ্রের প্রাপ্ত ভোট ৭০ শতাংশের নিচে। বাকি ৫১টি কেন্দ্রে ৭০ শতাংশের ওপরে ভোট প্রাপ্তি দেখানো হয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, ৭১ থেকে ৮০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের ১৭টি কেন্দ্রে ধানের শীষে ১৯০৮ ভোট, আর নৌকায় ৩১৪৭৪ ভোট। ৮১ থেকে ৯০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের ২৭টি কেন্দ্রে ধানের শীষ ১৩২৯ আর নৌকা মার্কায় ৬২৪৯৯ ভোট। ৯১ থেকে ১০০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের সাতটি কেন্দ্রে ধানের শীষকে ২৪৮ আর নৌকা মার্কায় ১৭৫৯৯ ভোট দেখানো হয়েছে। হোমনার ৫৪টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে মোট ৪২১৮ ভোট এবং নৌকা মার্কায় মোট ১১৬৯৪৯ ভোট দেখানো হয়েছে। হোমনায় ভোটের নামে কী ধরনের অনৈতিক ও কদর্য কাণ্ড হয়েছে, তা এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন। একই ভাবে কুমিল্লা-২ আসনের তিতাস উপজেলার ঘোষিত ফলাফল থেকেও একই চিত্র পাওয়া যায়। এ উপজেলার ৪৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৭০ শতাংশের নিচে প্রাপ্ত ভোটের কেন্দ্র মাত্র ৩টি। বাকি ৪২টি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হিসাব ৭০ শতাংশের ওপরে। তিতাসের ৪৫টি কেন্দ্রে ধানের শীষের পক্ষে মোট ১৬২০৫ ভোট এবং নৌকার ৮৯৩৪৯ ভোট দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একজন বড় ব্যবসায়ীর স্ত্রী। তিনি হোমনা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না। নির্বাচনে আগে হোমনার কেউ তার নাম পর্যন্ত জানত না। এ অবস্থায় ভোটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে সহজেই বোঝা যায়, সারা দেশের মতো কুমিল্লা-২ আসনের হোমনা ও তিতাস উপজেলার জনগণ ভোট দিতে পারেনি। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র ২৯ ডিসেম্বর রাতে এবং ভোটের দিন সকালে দখল করে ব্যালটে নৌকায় সিল দিয়ে বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই আসনে ৯০ শতাংশ ভোটারকে ভোটে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকরা ধানের শীষের জোয়ার দেখে বুঝতে পেরেছিল, জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ দিলে নৌকার নিশ্চিত ভরাডুবি হবে। তাই সরকারি দল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভোট ডাকাতির মতো ঘৃণ্য, অনৈতিক ও জঘন্য কাজটি করে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতির এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে।

কুমিল্লা-১ এবং ২ আসনের মতোই আগের রাতে ভোট ডাকাতির ঘটনা সমগ্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। দেশ-বিদেশের সবার কাছে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও এ অনৈতিক এবং নজিরবিহীন অপকর্মের নগ্নচিত্র ফলাওভাবে প্রচার করা হয়েছে। এ সত্ত্বেও সরকার প্রধান জোরগলায় বলেছেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েই তাকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। এ ধরনের মন্তব্য ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত জনগণের সাথে তামাশা মাত্র। গায়ের জোরের সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে এক ভয়ঙ্কর চরিত্রে রূপ ধারণ করেছে। 

দেশে চলছে শাসক দলের নেতাকর্মী আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনোবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতি। নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ও সামাজিক প্রচারমাধ্যমে প্রতিদিন এসব খবরের বড় শিরোনাম হচ্ছে। সরকারের অনৈতিক ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডে লুণ্ঠিত হয়েছে শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও সরকারি কোষাগার। দেশের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত; আইন-বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত। পেঁয়াজসহ জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলীয়করণের মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারখানায় পরিণত করা হয়েছে। মেধাবী সোনার ছেলেরা কেউ দানবে পরিণত হচ্ছে এবং তাদের তাণ্ডবে অনেক সোনার ছেলে প্রাণ দিচ্ছে। দুঃশাসনে রাষ্ট্রের উচ্চ থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত পচন ধরেছে, বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আর এসব কিছুই হচ্ছে দেশে গণতন্ত্রের অভাবে। 

তাই দেশ এবং জনগণকে রক্ষা করতে হলে দেশের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই সত্যটি যতদ্রুত উপলব্ধি করা হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল হবে।

  • লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ নভেম্বর ২৪, ২০১৯ 

Monday, November 18, 2019

আইনের ‘সরকারি’ শাসন

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

মূল বক্তব্যে যাবার আগে ভীষণ আলোচিত চারটি ঘটনা একটু দেখে নেয়া যাক। গত ১০ বছরে এমন ঘটনার উদাহরণ অনেক দেয়া যাবে, তবে এই ঘটনাগুলো বেছে নেয়ার কারণ ঘটনাগুলো ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। চারটি ঘটনার মধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং রাষ্ট্রের জন্য খুবই ভীতিকর মিল আছে; সেই মিলের জায়গাটি নিয়েই এই লেখা।

১. মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে পেশাগত অসদাচরণ, শৃঙ্খলা-আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। গত বছর এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন তুরিন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখাও করেন। তুরিনকে অপসারণের কারণ হিসেবে আইনমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালেরই আরেকজন প্রসিকিউটর জনাব জিয়াদ আল মালুম বলেছেন তুরিনের অপরাধ একটি ফৌজদারি অপরাধ।

কিন্তু আমরা এখনো তার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী ব্যবস্থার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখতে পাইনি, তার বিরুদ্ধে শাস্তি অপসারণেই শেষ হয়েছে।

২. তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে বিশেষ নিরীক্ষায় ধরা খেয়ে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল কয়েক দফায় আত্মসাৎকৃত ৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে (ইফা) গত ১০ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নয়-ছয় করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ইনি তুরিন আফরোজ এর চাইতে অনেক বেশি ভাগ্যবান, দুর্নীতির প্রমাণ থাকলেও এখনো তিনি স্বপদে বহাল আছেন, কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক।

৩. কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা এস পি হারুন কী করেছে তার চমৎকার দলিল হয়ে থাকবে মানবজমিনের দু’টি রিপোর্ট। তার গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ অধ্যায়ের উপরে করা সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট দু’টো আমাদেরকে হতবাক করে দেয়। একটা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্বে থেকে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্মের বীভৎস অপব্যবহার করে একজন মানুষ কি করে সাধারণ জনগণকে, ব্যবসায়ীদেরকে নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা এবং জমি হাতিয়ে নিয়েছেন।

সম্প্রতি চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যান নারায়ণগঞ্জে। তার এই অপরাধের জন্য সরকার তাকে শাস্তিমূলক ভাবে ঢাকায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে বদলি করে। এই ঘটনার কারণে হারুনকে বদলি করা হয়েছে তার প্রমাণ আছে হারুনের বিদায় দিনের বক্তব্য। ফেইসবুক এর ভাইরাল হওয়া বক্তব্যে দেখা যায় কাঁদতে কাঁদতে হারুন ওই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে বলছেন, তাকে চক্রান্ত করে নারায়গঞ্জ থেকে সরানো হয়েছে।  বলা বাহুল্য, হারুনের শাস্তিও বদলিতেই শেষ হয়েছে। তিনি নিয়মিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন ভাতাও পাচ্ছেন।

৪. এর কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অপসারিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডে বরাদ্দকৃত দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে ৮৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই নজিরবিহীনভাবে তাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে দেন। শোভন-রাব্বানী যে চাঁদা চেয়েছিলেন এটারও প্রমাণ আছে। একটি জাতীয় পত্রিকার কাছে তারা বলেছিলেন এই উন্নয়ন কর্মকা-ের ‘ন্যায্য’ হিস্যা তারা চেয়েছিলেন। আত্মস্বীকৃত এই অপরাধীদের শুধু অপসারণেই সবকিছু শেষ হয়েছে, কোন ফৌজদারি ব্যবস্থা আমরা তাদের বিরুদ্ধে দেখিনি।

হ্যাঁ, এই ঘটনাগুলোর মধ্যকার মিলটি হলো ভয়ঙ্কর ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়েও সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিরা কেউ দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পান, কেউ শাস্তিমূলক বদলি হন এমনকি কেউ নিজ পদে থেকে যান বহাল তবিয়তে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যধারা মতাবেক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফৌজদারি কার্যবিধিতে স্পষ্ট বলা আছে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে থানায় ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) দায়ের করতে হবে। এফআইআর দায়েরের সাথে যেহেতু গ্রেফতারের বিষয়টি জড়িত তাই অভিযুক্তকে জামিন নিতে হয়। এফআইআর পর পুলিশ তদন্ত করে হয় তাদের নামে চার্জশিট দাখিল করে অথবা তারা চার্জশিট থেকে অব্যহতি পায়। অথচ ওপরে আলচিত এই সকল ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে সব ভয়ঙ্কর অভিযোগ ওঠা, ভিডিও ফুটেজ বা অডিও ক্লিপ থাকা সত্ত্বেও আইনের স্বাভাবিক পথে না গিয়ে বারবার বলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে। এই ধরণের আচরণ অপরাধীকে শুধু স্বস্তিতেই রাখে না, বরং নতুন নতুন অপরাধী তৈরিতে সাহায্য করে। দেশে আইনও আছে, শাসনও আছে, নেই কেবল আইনের শাসন। আইনের শাসনের জন্য বিচার দৃশ্যমান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যে দেশে আইনের প্রয়োগ, গতি, ফলাফল ব্যক্তির পরিচয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন সে দেশে আর যাই হোক ন্যায়বিচার, সুশাসন বা আইনের শাসন কিছু ক্লিশেই শব্দের বাইরে ভিন্ন কোনো অর্থ বহন করে না।
  • কার্টসি— মানবজমিন /১৮ নভেম্বর ২০১৯