সায়ন্ত সাখাওয়াৎ
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা : নিরীহ মানুষের নীরব ঘাতক দূষিত বায়ু (যুগান্তর, ২৬ নভেম্বর ২০১৯), বিশ্বে সবচেয়ে বায়ু দূষিত দেশের তালিকায় প্রথম বাংলাদেশ (দৈনিক ইত্তেফাক, ০৬ মার্চ, ২০১৯), সবচেয়ে দূষিত বায়ুতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮), বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী ঢাকা, সবচেয়ে দূষিত বাংলাদেশ (ডেইলি স্টার, ০৬ মার্চ, ২০১৯)- এই সংবাদ শিরোনামগুলো বলে দেয় আমরা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছি।
সাম্পªতিককালে বেশ উদ্বেগের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে ঢাকার বায়ুদূষণ। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের ‘গ্যাস চেম্বার’ আখ্যা পাওয়া দিল্লির বাতাসের চেয়েও ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজুy¨য়াল’-এর বায়ুমান সূচকে (একিউআই) বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ঢাকা।
সায়ন্ত সাখাওয়াৎ |
২৬ নভেম্বর ২০১৯ এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দৈনিক যুগান্তর লেখে– বিশ্বগণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার বায়ুদূষণের কারণে শিরোনাম হয়েছে দিল্লি। সেখানে দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, সেখানে স্কুলগুলো পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বায়ুমান পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজু¨য়ালের তথ্যমতে, ভারতের দিল্লি, কলকাতা এমনকি পাকিস্তানের লাহোরকে হটিয়ে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর সূচকে সবার ওপরে চলে গেছে প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা। বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে যুগান্তর লেখে– সারা দেশে সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা পরিচালনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম, শিল্পকারখানার উন্মুক্ত নিঃসরণ ও যানবাহনের ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া, কঠিন বর্জ্য ও বায়োমাস পোড়ানো বায়ুদূষণের মূল কারণ। আর রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে ভবন ও অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ উন্মুক্তভাবে করার ফলে শহরের বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বাড়ছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা/প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থাৎ এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, মেট্রোরেলসহ অন্য প্রকল্পগুলোকে কার্যকর পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা প্রতিপালন, সঠিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণপূর্বক মাটি, বালি ও অন্যান্য সামগ্রী পরিবহন, সংরক্ষণ, কার্যকর কর্মপরিবেশ রক্ষা করা, সময়মতো রাস্তাঘাট সংস্কার, মেরামত ও বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়মিত পানি ছিটানোসহ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণসামগ্রী অর্থাৎ মাটি ও বালি পরিবহনে মাটি-বালির একটি অংশ রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে যা পরবর্তী সময়ে বায়ুদূষণ সৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ, ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশে দীর্ঘদিন স্ত‚পীকরণ ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনের সময় অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থাপনার ফলে একটি অংশ রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনার ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ফলে বায়ুদূষণের সৃষ্টি করছে।
২০১৮ সালের বায়ুতে দূষণের মাত্রা নিয়ে ২০১৯ সালে আইকিউএয়ার, এয়ারভিস্যুয়াল ও গ্রিনপিসের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আমরা জেনেছিলাম বায়ুদূষণে আমরাই সেরা। আর আমাদের পরেই আছে দেশ পাকিস্তান ও ভারত। বাতাসের মধ্যে ‘পিএমটুপয়েন্টফাইভ’ নামে পরিচিত যে সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি হিসাব করে এ প্রতিবেদেন করা হয় তাতে ১০০-তে আমাদের প্রাপ্তি ছিল ৯৭.১। এই স্কোর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের ৭৪.২৭ এবং তৃতীয়তে থাকা ভারতের ৭২.৫৪। আর সবচেয়ে কম দূষিত তিন দেশ আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার স্কোর যথাক্রমে ৫.০৫, ৬.৫৭ ও ৬.৮২। সবচেয়ে কম দূষণের দেশের তুলনায় ৯২ পয়েন্ট বেশি পাওয়া আমরা যে কতটা ভয়াবহ খারাপ অবস্থানে আছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি খারাপের দিক থেকে সেরা বাংলাদেশের সঙ্গে, দ্বিতীয় সেরা পাকিস্তানের ব্যবধানটা কিন্তু অনেক বড় (২২.৮৩)! অর্থাৎ দ্বিতীয় সেরা পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় ২৩ পয়েন্ট বেশি নিয়ে আমরা সেরা খারাপ হয়েছি। এই ‘পিএমটুপয়েন্টফাইভ’ কণাগুলো মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। পিএমটুপয়েন্টফাইভ এমন সব দূষণকণাকে বোঝানো হয়, যাদের ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের বেশি না।
এর আগের বছরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম স্থানে। অর্থাৎ দ্বিতীয়। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম যখন এ সূচকটি তৈরি করা হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। গত এক যুগে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮)।
আওয়ামী লীগ সরকারের নেতারা পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর আসে। বায়ুদূষণে এক যুগে ৫৪ ধাপ পিছিয়ে প্রথম হওয়ার জন্যই কি সে পুরস্কার!
বাংলাদেশের বায়ুদূষণের প্রধান কারণ কী সে বিষয়ে প্রথম আলো লিখেছে, ২০১৬ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের কেইস প্রকল্পের আওতায় ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস ও ধরন নিয়ে একটি জরিপ হয়েছে। নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব এয়ার রিসার্চের মাধ্যমে করা ওই জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে প্রায় এক হাজার ইটভাটায় নভেম্বরে ইট তৈরি শুরু হয়। এসব ইটভাটা বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। কথা হলো, এই সব ইটভাটা কি ২০০৬ সালের আগে ছিল না? তাহলে নতুন আর কী সব কারণ যুক্ত হলো যা বাংলাদেশকে সেরা দূষিত দেশ বানিয়ে দিল? বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে বলে ওই রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়েছে। আর এর মধ্যে প্রায় সোয়া লাখ যে বাংলাদেশের থাকবে সে ধারণা পাওয়া যায় বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট থেকে (বায়ুদূষণে এক বছরে বাংলাদেশে লক্ষাধিক প্রাণহানি : গবেষণা প্রতিবেদন, এপ্রিল ০৪, ২০১৯)। রিপোর্টে লেখা হয়, ঘরে-বাইরে বায়ুদূষণের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে; দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুই গবেষণা সংস্থা। হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন নামের দুই গবেষণা সংস্থার এক যৌথ প্রতিবেদনে।
দেশে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। প্রতি বছর যুক্ত হয় নতুন ৩ লাখ রোগী এবং বছরে মারা যায় প্রায় ৫০ হাজার রোগী। দি চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর চলতি বছরের মার্চ মাসে তাদের ৩৯তম বার্ষিক সাধারণ সভা ও বৈজ্ঞানিক সম্মেলন জানিয়েছে এই তথ্য। আর এর কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পরিবেশ দূষণকারী যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যাবৃদ্ধি, শব্দদূষণ ও শিল্প-কারখানার নির্গত ধেঁঁায়াকে। এসব কারণে দেশে বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অব্যাহত বায়ুদূষণের ফলে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, শ্বাসনালি ও ফুসফুসে নিউমোনিয়া সংক্রমণ, সিওপিডি এবং ফুসফুসের ক্যানসার ছাড়াও বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার রোগ বেড়েই চলেছে। শুধু বায়ুদূষণই নয়, অন্যান্য প্যারামিটারেও ঢাকার অবস্থা বেগতিক। কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় বসবাস অযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট পেয়েছে। এ সার্টিফিকেটটি দিয়েছে লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ‘ইআইইউ’। চলতি বছরে ১৪০টি দেশ নিয়ে করা হয়েছে এই তালিকা। বসবাসের অযোগ্য শহরের এ তালিকায় ঢাকার থেকে খারাপ দুটি শহর হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক এবং নাইজেরিয়ার লাগোস। বছর দুই আগে এই র্যাংকিংয়ে আমরা প্রথম ছিলাম। এবার হয়েছি তৃতীয়। এ বছরই আমরা যানজটে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছি। শুধু তা-ই নয়, সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও ঢাকা পঞ্চম। এই তালিকাটিও করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রেখে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে ঢাকা চতুর্থ অনিরাপদ নগরী। আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ষষ্ঠ অনিরাপদ নগরী ঢাকা। নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ মহানগরের মধ্যে বিশ্বে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা। যৌন সহিংসতা বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ; এখানে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জিপজেটের করা পর্যবেক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা (ঢাকা কেন অযোগ্য শহর, দৈনিক দেশ রূপান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)
বিশেষ ব্যবস্থায় ট্রাফিক এড়িয়ে এসি গাড়িতে চলা রাষ্ট্র পরিচালকরা হয়তো বুঝবেন না এই শহরে নাকে-মুখে রুমাল বা হাত চেপে চলা মানুষের কষ্ট। ধুলায়-গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ রাস্তায় বের হলেই নিজের অজান্তই তার হাতটা ঢাল হয়ে দাঁড়ায় নাক-মুখের সামনে। ছোট্ট শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সময় নাক চেপে হাঁটে বা বাহনে বসে থাকে। এই সব দেখেও যাদের লজ্জা হয় না তারাই হাসিমুখে কেবল উন্নয়নের গল্প শোনাতে পারেন।
- লেখক— সায়ন্ত সাখাওয়াৎ/ চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
- কার্টসি — দেশ রূপান্তর/ ২৮ নভেম্বর, ২০১৯
No comments:
Post a Comment