Search

Sunday, November 3, 2019

জিয়ার অবদান : ইতিহাস যা বলে

নাজিম উদ্দিন আহমেদ পান্না


বাংলাদেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু বিপথগামী সৈন্যের হাতে শহীদ হন। আমাদের ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র শহীদ জিয়া। বাংলাদেশের এই অমিততেজা বীর যোদ্ধা রাষ্ট্রনায়ক শুধু এ দেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কই নন, আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামের একজন কাণ্ডারিও।

জিয়াউর রহমানের মধ্যে অনেক বৈশিষ্ট্য ও গুণের সমাবেশ ছিল। স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুুদ্ধের সংগঠক ও সেক্টর কমান্ডার, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি, ইসলামি উম্মাহর ঐক্যপ্রচেষ্টার অগ্রদূত, সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা, তৃতীয় বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা ও আধিপত্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক।

১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর সেনা আমলাতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। সামরিক আমলাতন্ত্রের সাথে ষড়যন্ত্রে মিতালি গড়ে তোলেন পিপিপি নেতা ভুট্টো। ক্ষমতার লড়াইয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয় অনিবার্য। মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ১৯৭৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান ভারত সফরকালে ভোজসভায় ভারতের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডি বলেন, 'Your position is already assured in the annals of the history of your country as a brave freedom fighter, who was the first to declare the independence of Bangladesh. (সূত্র : অধ্যাপক শামসুল হকের Bangladesh in International politics, Page-96)

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণদানকালে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেন, 'The other country has pushed across the border people who did not Vote for their Government, but voted for the regime they wanted. There is no other crime which these people have committed, because they cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrrested and not before. He himself, so far as I know has not asked for independence even now.' (সূত্র : Bangladesh documents, Information ministry, Govt of India, Vol-ll, page-275)। এই বক্তব্যে ইন্দিরা উল্লেখ করেন মরহুম শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।

প্রখ্যাত আইনজীবী এবং মুজিব সরকারের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পদ্মাতীরের আগারগাঁও গ্রামে বসে আমি এবং তাজউদ্দীন আহমদ জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলাম। মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক-সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষকে উজ্জীবিত করে।’ (সূত্র : স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, ১৫ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৫)। এ ছাড়া সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ও জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের লেখনী ও বক্তব্যে শহীদ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধকালে শুধু সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নন, তিনটি সেক্টর সমন্বয়ে গঠিত জেড-ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭২ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কর্নেল পদে এবং ১৯৭৩ সালের মধ্যভাগে ব্রিগেডিয়ার ও শেষভাগে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

জিয়াউর রহমান বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও দূরদর্শী ছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তিনি ১৯৭৭ সালে ‘একুশে পদক’ প্রবর্তন করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আজকের শিশুই আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তাই তিনি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শিশু একাডেমি। 

কৃষকবন্ধু জিয়াউর রহমান আধুনিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। ১৯৭৪-৭৫ সালে সারা দেশে ধান উৎপন্ন হয়েছিল এক কোটি ১১ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন। ১৯৮০-৮১ সালে সমগ্র দেশে ধান উৎপন্ন হয় এক কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন। একটি নিরক্ষর জাতির পক্ষে উন্নয়ন অসম্ভব। ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান জাতীয়ভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি চালু করেন। ১৯৭৬ সালে জিয়া সরকার আইন করে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসের শিক্ষকদের বকেয়া বেতন প্রদান করেন। স্বাধীনতার পর শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। শহীদ জিয়া দুর্র্নীতির অবসান ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে চেষ্টা করে সফল হন। 




১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে মোট খাদ্যসাহায্য এসেছিল ৫১ কোটি মার্কিন ডলারের ওপরে। তখন জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি ৬০ লাখ। গাণিতিক হিসাবে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য ছিল প্রায় ৬.৭ মার্কিন ডলার। অন্য দিকে ১৯৮১ সালে দেশে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ কোটি। খাদ্যসাহায্য এসেছিল ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের সমমূল্যের। গাণিতিক হিসাবে মাথাপিছু ২.৮ মার্কিন ডলার। প্রধানত দুর্র্নীতির কারণে ৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে লাখো আদমসন্তান প্রাণ হারায়। দুর্নীতিমুক্ত হওয়ায় ১৯৮১ সালে দেশে খাদ্যসঙ্কট ছিল না। এ দেশের কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে শহীদ জিয়া ‘খাল কাটা’ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। তার শাসনামলে ১৪০০ খাল খনন হয়। ফলে কৃষিতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়। মুজিব সরকারের তুলনায় শহীদ জিয়ার সরকার আমলে জিডিপি ৩.৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে জিয়াউর রহমান উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পল্লীর জনগণ যেন সুচিকিৎসা পায় তার ব্যবস্থা করেন। তিনি পল্লী চিকিৎসক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ফলে মাত্র এক বছরেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন ২৭ হাজার পল্লী চিকিৎসক।

১৯৭৬ সালে জিয়া ‘রাজনৈতিক দল বিধি ১৯৭৬’ জারি করেন। ফলে দেশে বহু দলের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালে চারটি বিভাগীয় শহরে জিয়া সরকার ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা শহীদ জিয়া। প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ধর্ম বিভাগ’ গঠন করেছিলেন। এটা পূর্ণাঙ্গ ধর্ম মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত হয়। জিয়াউর রহমান সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেন। যুবসমাজকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার লক্ষ্যে জিয়া সরকার গঠন করেন যুব কমপ্লেক্স।

স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোনো প্রাপ্তি বা অবদান ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইসলামি দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জিয়াউর রহমান সফর করেন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরান, পাকিস্তান, মালি, সেনেগাল, সিরিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ। মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় জিয়া বলিষ্ঠ ও স্বাধীনচেতা ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ফলে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। তদুপরি ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্টার চাপ প্রয়োগ করেও ইরানের বিরুদ্ধে জিয়ার সমর্থন আদায় করতে পারেননি। ইরান-ইরাকের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে জিয়াউর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮১ সালে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অন্যতম সহসভাপতি পদ লাভ করে বাংলাদেশ। শহীদ জিয়ার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সে সময় বাংলাদেশ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জেরুসালেম সমন্বয় কমিটি, ছয় সদস্যবিশিষ্ট জাতিসঙ্ঘের জেরুসালেম সমন্বয় কমিটি, তিন সদস্যবিশিষ্ট আল কুদস কমিটি ও তিন সদস্যবিশিষ্ট ইরান-ইরাক কমিটির সদস্য মনোনীত হয়। 

জিয়াউর রহমান শিল্পসংস্কৃতির উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৮১ সালে ঢাকায় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তিনি। ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট ছাত্রাবাস ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ শহীদ জিয়ার অবদানের সাক্ষ্য দেয়। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজনে তিনি সার্ক গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পারিষদের সদস্যপদ লাভ করে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বাংলাদেশের আপত্তির কারণেই ১৯৭৯ সালে জাতিসঙ্ঘ ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেনি। ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান মক্কার কাছে তায়েফে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন।

নারীসমাজের কল্যাণসাধনে জিয়াউর রহমান মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। নারীসমাজকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে জিয়া প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় মহিলা সংস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূত ও মহিলা অডিটর জেনারেল নিয়োগ করেন। তিনি মহিলা পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি বাহিনী গঠন করেন। মহিলা হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করেন। মহিলাদের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে নন-জেগেটেড পদে ১৫ শতাংশ, গেজেটেড পদে ১০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেন। শহীদ জিয়ার মন্ত্রিসভায় মহিলা মন্ত্রী ছিলেন একাধিক। জিয়া ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। শাহাদতবার্ষিকীতে বিজয়ী জাতির বিজয়ী নেতার স্মৃতির প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।


  • লেখক আইনজীবী
  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত/ জুন ২, ২০১৫

No comments:

Post a Comment