ড. মো: মোর্শেদ হাসান খান
স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশ আজ এক গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে পথ চলছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। জাতীয় জীবনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে আজ এমন একজন মানুষ সম্পর্কে দু-চারটি কথা লিখতে যাচ্ছি, যিনি জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে। তিনি আর কেউ নন- তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে সুপরিচিত, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর ঘৃণ্য হামলা চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনায় কিছুটা কমতি থাকায় পাক বাহিনীর গণহত্যা ও প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে জাতি যখন হতাশ ও বিভ্রান্ত, ঠিক তখনই আশার আলোকবর্তিকা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সে দিনের মেজর জিয়াউর রহমান। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি উপেক্ষা করে জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতে জাতি উজ্জ্বীবিত হয়েছিল। তিনিই প্রথম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। ২৫ মার্চ রাতে তিনি যখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করলেন, তখন তিনি দেখলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৩০০। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। মাত্র সাতজন অফিসার এবং ৩০০ সৈন্য নিয়ে ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য ও অপ্রতুল অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি তার বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এই বিদ্রোহ ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ, যা জিয়াউর রহমানের মতো নায়কের পক্ষেই সম্ভব ছিল। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে জিয়াউর রহমান এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তী সময়ে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। রণাঙ্গনে তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সবসময় সামনে থাকতেন এবং কমান্ডারদের সৈনিকদের সামনে থাকতে পরামর্শ দিতেন। এভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও তারপর জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের দু’দিন আগে সিলেটের এমসি কলেজের পাশ দিয়ে সিলেট শহরে ঢোকার আগে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছিল জিয়ার বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে সহকর্মীরা তাকে পিছিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন সবাই মরে গেলেও সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, বিশেষ করে রণক্ষেত্রে তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। রণক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা অনেক আগের। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি অসাধারণ রণনৈপুণ্য দেখিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে ওই যুদ্ধে অংশ নেন। পাক-ভারত যুদ্ধে তার আলফা কোম্পানি সবচেয়ে বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছিল। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি জিয়াকে চিনতেন না। ১৯৭১-এর আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি ভিন্ন্ ধরনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহস ও বীরত্ব দেখান। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি আবার তার কর্মস্থলে ফিরে যান, যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানকে কেউ খাটো করে দেখলে ভাবতে হবে সে একজন মূর্খ, সে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানে না এবং জানে কিন্তু অস্বীকার করে সে একজন জ্ঞানপাপী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে দিন জিয়ার অগ্রণী ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে স্বীকার না করা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জিয়াউর রহমানের অবদান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
সিপাহি-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’-এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সিপাহি-জনতা। ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এদেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মাণ করে। তৎকালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাতের আঁধারে বিদ্রোহ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন। ওই দিন জাতীয় চার নেতাকেও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাককে পদচ্যুত করে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ চার দিন দেশ ও দেশের জনগণ দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। ৬ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার সময় সশস্ত্রবাহিনীর পুনরুত্থানকারী চক্রের বিরুদ্ধে বীর জনগণ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহিরা বিপ্লব ঘটিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন।সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লবের চার দিনের দুঃস্বপ্নের ইতি হয়। আওয়াজ ওঠেন ‘সিপাহি-জনতা ভাই ভাই’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হয়।
জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ফিরে পান। এরপর সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যেমন উদ্যোগ নেন, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সব ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। রাজনীতিকে অস্থিরতা কাটিয়ে একটি সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক বাহিনীর লোক হয়েও তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সাধারণত মিলিটারি শাসকেরা রাজনীতিবিদদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সামরিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের চেষ্টা করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সমরনীতির প্রভেদ বুঝতেন। দেশের একটি অন্ধকার সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৭৫-এর ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।
জিয়াউর রহমান যখন জাতির হাল ধরেন, তখন জাতি হিসেবে আমরা ছিলাম বহুধাবিভক্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেশের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে যে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে, তা দেশের অর্থনৈতিক, উন্নয়ন, সামাজিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয়তার পরিচয়ের এক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয় জীবনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন।
‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’র ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সব মতের মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। ‘দেশ’ ও ‘মানুষ’ই তার রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শের পরিচয় একটা বক্তৃতার মাধ্যমে আমি তুলে ধরছি। ১৯৭৬-এর ১৩ মার্চ রামপুরা টেলিভিশন ভবনে বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেনÑ ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ (দৈনিক বাংলা, ১৪ মার্চ, ১৯৭৬)
জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘জাতীয় সেনাবাহিনী’ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। প্রশিক্ষণ, কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা দিয়ে অফিসারদের নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগাতে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন তাদের।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সামরিক বাহিনীর একটা ক্ষুদ্র গ্রুপের সংঘটিত অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলেও এটা সত্য যে, তিনিই সামরিক বাহিনীতে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। উন্নত প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বয়ে ও সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সামরিক বাহিনীর মনোবলকে উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দুর্বল-শক্তিশালী সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সবার সাথে পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বৈদেশিক নীতি নির্দিষ্ট ও বাস্তবায়ন করেন। জোট নিরপেক্ষ এবং ইসলামি দেশগুলো ও বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের সম্মেলনে তার ব্যক্তিগত এবং সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। ব্যক্তিগত কূটনীতির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির দীর্ঘমেয়াদি সফলতাকে তিন ভাগে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, তিনি জাতিসঙ্ঘকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তির আবহ তৈরি করার লক্ষে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার উন্নয়ন ঘটান। ফলে বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। তিনি উপমহাদেশের জন্য একটি স্থানীয় শান্তি কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আসিয়ানের মতো সংস্থা গড়ার উদ্যোগ নেন, যা পরবর্তীকালে সার্ক প্রতিষ্ঠা পায়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির আরেকটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে বহুমুখীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্যকে উৎসাহিত করা। তার শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা।
ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশীয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহামারী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর, ১৯৭৯)
এ সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশল নিয়েও বিশ্ববাসী উচ্চ ধারণা পোষণ করে। বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি বহির্বিশ্বের আস্থা সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটা অবদান হলো নাগরিক বাহিনী গঠনের চিন্তা বাস্তবায়ন করা। তিনি এক কোটি নারী ও পুরুষকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) গঠনের মাধ্যমে দেশ গঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন। জিয়াউর রহমানের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ ছিল উল্লেখ করার মতো। কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিশেষ প্রচার পেয়েছিল। জিয়াউর রহমান আমলানির্ভর প্রকল্প না করে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এতে কৃষকদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এভাবে জিয়াউর রহমান ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশকে রফতানিমুখী বাংলাদেশে পরিণত করতে সক্ষম হন। তার যোগ্য ও ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বন্ধুহীন বাংলাদেশ বন্ধুত্বের জাল বিস্তার করে বিশ্বে নেতৃত্বদানে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
এ বছরের ১৯ জানুয়ারি বিশ্বের নানা প্রান্তে নানান আয়োজনে জিয়াউর রহমানের ৮১তম জন্মদিন পালিত হতে যাচ্ছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে তার ভক্ত-অনুরক্ত ও আদর্শের ধ্বজ্জাধারী ধারক ও বাহকদের জন্য রইল অশেষ ভালোবাসা ও আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।
- লেখক অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/জানুয়ারি ১৮, ২০১৭
No comments:
Post a Comment