Search

Tuesday, November 5, 2019

একাত্তরের সূর্যসন্তান

মনজুর আহমদ

অস্তাচলে হারিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর এক উজ্জ্বল সূর্য। একাত্তরের ঘোর বিভীষিকাময় দিনগুলোতে যিনি  আলোকবর্তিকা হাতে মুক্তি পথের দিশারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা অবশেষে নিজেকে সমর্পণ করলেন মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে। নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। পাঁচটি বছর লড়াই করেছেন মৃত্যুর সঙ্গে। কিন্তু ‘জীবনেরে কে রুধিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে...’, সেই অসীম আকাশের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন তিনি।

সাদেক হোসেন খোকা, ঢাকাবাসীর প্রিয় খোকা ভাই, অনেক অভিধায় অভিহিত তিনি, অনেক পরিচয় রয়েছে তার।  কিন্তু সঠিক কোন পরিচয়ে তিনি শ্রদ্ধার আসন দখল করে রয়েছেন মানুষের মনে? অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র ছিলেন তিনি, ছিলেন একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ছিল তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা, গোপীবাগকেন্দ্রিক ব্রাদার্স ইউনিয়নের কর্মকর্তা ছিলেন। তবে অবশ্যই বলা যায়, এসব কিছুর  ঊর্ধ্বে তার যে পরিচয়টি অম্লান হয়ে রয়েছে, তা তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়।

তিনি ছিলেন ঢাকা কাঁপানো মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা যখন কেঁপেছে সারা বাংলাদেশ তখন উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব তখন দু’চোখ মেলে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েছে। একাত্তরে ঢাকার বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেয়া গেরিলাদের একজন ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয়, একটি গ্রুপের কমান্ডার।

একাত্তরে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সাদেক হোসেন খোকা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ছাত্র ইউনিয়নের আরো কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে ঢাকা ছাড়েন। প্রথমে যান নরসিংদীর শিবপুর, সেখান থেকে আগরতলা।  সেখানে গিয়ে দুই নম্বর সেক্টরে যোগ দেন তারা। খালেদ মোশাররফ ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’। বসবাসের অনুপযুক্ত, পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই ক্যাম্পের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন ঢাকা শহরের ছেলে। তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মেজর হায়দার। তার কাছে তিন সপ্তাহের গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সম্মুখ যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য তাদের এক গভীর রাতে পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বাধীন একটি সাব-সেক্টরে। সেখানে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষ করে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ। সাদেক হোসেন খোকা প্রথমবারের মতো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন কসবা-মন্দাভাগ সীমান্তে। এখানে যুদ্ধ করেই মূলত তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এসএমজি, এসএলআর, চাইনিজ রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র পরিচালনার।

সব ধরনের প্রশিক্ষণের পর সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে ৪০ যোদ্ধার একটি গ্রুপ গঠন করে তাদের পাঠানো হয় ঢাকায় অপারেশনের জন্য। ঢাকায় আরো ২৫ জন যুক্ত হয় তাদের সঙ্গে। এর আগেও কয়েকটি গ্রুপ ঢাকায় অভিযান চালিয়েছে। তবে কিছু ভুল-ত্রুটির জন্য তাদের সবগুলো অভিযান সফল হতে পারেনি। কয়েকজন ধরাও পড়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে। সেই সব অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্লেষণ করে সাদেক হোসেন খোকার দল তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। তারা টার্গেট নির্ধারণ করতেন প্রচারের গুরুত্ব বিবেচনা করে, যাতে অপারেশনের খবর মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায় এবং শত্রুও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। তখন পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছিল। খোকা এবং তার গ্রুপের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন বড় ধরনের কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের প্রচারণার অসত্যতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার। এই লক্ষ্যেই তারা একের পর এক অপারেশন চালিয়ে গেছেন। তারা অপারেশন চালিয়েছেন পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরে, উড়িয়ে দিয়েছেন শান্তিনগরে সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর, রাজারবাগে নির্বাচন কমিশন ভবন, শহীদুল্লাহ হলের দক্ষিণে অবস্থিত বিমান বাহিনীর রিক্রুটিং কেন্দ্র, বায়তুল মোকাররমের বিপরীতে গ্যানি’জ বিপণি বিতান প্রভৃতি। প্রতিটি অপারেশনেই তারা সাফল্য পেয়েছেন এবং এর মধ্যদিয়ে তারা সন্ত্রস্ত করে দিয়েছেন পাকিস্তানিদের। প্রতিটি অপারেশনের পরই তারা ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়তেন এবং জনগণের মধ্যে মিশে গিয়ে আক্রমণের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতেন। সব অভিযানই যে তারা গোপনে সম্পন্ন করতে পেরেছেন তা নয়। কোথাও কোথাও তাদের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। দারোয়ান বা পাহারাদের নিরস্ত্র করে তাদের চাপের মধ্যে রাখতে হয়েছে।

সাদেক হোসেন খোকা ও তার গ্রুপের দুঃসাহসিক তৎপরতা আজ এক কিংবদন্তি। বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয় যখন শুনি, পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের ছদ্মবেশে সাদেক হোসেন খোকা সেই ভয়ঙ্কর শত্রুপুরীর ভেতরে ঢুকে গেছেন এবং পর পর কয়েকদিন রেকি করে এসেছেন, দেখে এসেছেন ভেতরের সব কিছুর অবস্থান।

এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে এক দফা জানাজা শেষে তার মরদেহ নেয়া হয়েছে ব্রুকলিনের একটি ফিউনারেল হোমে। পাসপোর্ট না থাকায় জটিলতা দেখা দিয়েছিল লাশ ঢাকায় নেয়া নিয়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় তার এবং তার স্ত্রীর পাসপোর্ট নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে জমা দেয়া হয়েছিল নবায়নের জন্য। দীর্ঘ সময়েও সে পাসপোর্ট আর ফেরত পাননি তারা। তাদের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে সরকারিভাবে কিছু বলাও হয়নি। তবে শেষ মুহূর্তে সৌজন্য দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাত্তরের সূর্য সন্তান খোকার লাশ দেশে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছেন তিনি। তার সবুজ সংকেতে লাশ এখন যাচ্ছে ঢাকায়। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাবের পরই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতারা শেষ মুহূর্তে খোকাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন।

ঢাকা কাঁপানো মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুকে একাত্তরে উদিত একটি সূর্যের অস্তাচলে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। শঙ্কা লাগে এ ভাবে শেষ সূর্যটির অস্ত যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবে উজ্জ্বল আমাদের একাত্তর কি গভীর অমানিশার কবলে নিমজ্জিত হবে!

  • কার্টসি— মানবজমিন/ ৫ নভেম্বর ২০১৯

No comments:

Post a Comment