তৈমূর আলম খন্দকার |
তৈমূর আলম খন্দকার |
টোকাই, মস্তান, সম্রাট, মাফিয়া প্রভৃতি আমাদের সমাজে বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু শব্দ অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রচারিত। টোকাই শব্দটি বাংলা সংস্কৃতি বা বাংলা অভিধানে সদ্য আমদানি করা। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর এখন অনেক সমাদর, আগে যা ছিল না। টোকানি থেকে টোকাই শব্দের উৎপত্তি। মানুষের অপ্রয়োজনীয় বা মূল্যহীন দ্রব্যাদি, যা ফেলে দেয়া বা পৌরসভার আবর্জনা থেকে সংগৃহীত পরিত্যক্ত দ্রব্য সের দরে বিক্রি করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারাই টোকাই বা টোকানি নামে পরিচিত ছিল। খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট রণবীরের আঁকা একটি কার্টুন প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ‘টোকাই’ শব্দটি আলোচনায় আসে। টোকানি এখনো আছে, তবে টোকানি থেকে টোকাইদের পদমর্যাদা বেড়েছে। কারণ, টোকাইরা এখন সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক ভায়োলেন্সে জড়িত হয়ে টোকানিদের চেয়ে অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। টোকানিদের গন্তব্যস্থল ভাঙ্গারির দোকান পর্যন্ত, অন্য দিকে বর্তমানে টোকাইদের অবস্থান অনেকটা এগিয়ে। কারণ, তারা এখন জমি দখল, সন্ত্রাস ও রাজনীতিতে ব্যবহার হচ্ছে। টোকাই পৃথিবীর উন্নত দেশেও রয়েছে। যাদের অন্যতম পেশা চুরি, ছিনতাই বা ছিঁচকে চোর; যারা সাধারণত Street Boy হিসেবে চিহ্নিত। আদালতের ভাষায় তারা Deliquent। বিগত সময়ে দু’টি সরকার বাংলাদেশে টোকাইদের সুস্থ ভাবধারায় নিয়ে আসার জন্য ‘পথশিশু’ ও ‘পথকলি’ বিভিন্ন নামে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও সংশ্লিষ্ট সরকারের ইতি টানার সাথে সাথে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেছে।
লন্ডন কিংস কলেজের একজন শিক্ষয়ত্রী স্যালি আটকিনসন শেফার্ড ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তিন বছরের মতো অবস্থান করে বখে যাওয়া শিশুদের নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ২২ জন স্ট্রিট চিলড্রেন ও পুলিশ, সমাজকর্মী, বিচার বিভাগসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ৮০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে মতামত দিয়ে টোকাই বা স্ট্রিস্ট চিলড্রেনদের ‘Illicit child Labour’ বলে আখ্যায়িত করেছেন (সূত্র : The gangs of Bangladesh)। স্যালি আটকিনসন শেফার্ডের গবেষণা মতে, তিনি বাংলাদেশে মাফিয়া চক্রের সন্ধান পেয়েছেন, যাদের তিনি ইংরেজি ভাষায় Mastaan (মস্তান) নামে অভিহিত করেছেন। ‘মস্তান’ একটি বাংলা বা ইংরেজি শব্দ নয়, বরং ভারতে অভিধানিকভাবে হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি থেকে এর উৎপত্তি। মুম্বাই থেকে রিলিজ হওয়া সিনেমায় মস্তানের ভূমিকা প্রকাশ পায়। কিন্তু কার্যত মস্তান বলতে তার গবেষণায় llicit child Labour, অর্থাৎ অবৈধ কাজে ব্যবহৃত শিশু শ্রমিকদের গডফাদারদের বোঝানো হয়েছে। এ গবেষকের মতে, মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, হত্যা ও রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার জন্য মাস্তানেরা টোকাই বা রাস্তার শিশুদের ভাড়া করে ব্যবহার করে।
২০১০ সালে ‘Urban Crime and Violence in Dhaka’ নামকরণে প্রকাশিত বইতে উল্লেখ করা হয়, মস্তানেরা পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি ও অব্যাহত রাখে। ওই গবেষকের মতে, মস্তানদের থেকে পুলিশ নিয়মিত টাকা পেয়ে অবৈধ কাজের বৈধতা দেয়। তিনি আরো মনে করেন, রাজনীতিবিদেরা তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য মস্তানদের ব্যবহার করে। ওই গবেষকের মতে, ‘Mastaans operate under the shelter of god father, who are mainly Ministers, Members of Parliament and Business leaders.’ অর্থাৎ মস্তানেরা গডফাদার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় যাদের মধ্যে মন্ত্রী, পার্লামেন্ট সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতারা রয়েছেন।
২০১২ সালে ইউনিসেফ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত জাতি এবং জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাদের মতে, ঢাকার এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি অধিবাসী রাস্তাঘাটে বা বস্তিতে বসবাস করে; যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা বা বেঁচে থাকার জন্য ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। ওই সব পরিবারের শিশু সন্তান নিজেরা অবৈধ কাজের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার হয়ে নিজেরাই এক সময় টোকাই থেকে মস্তানে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ ২০ জন ‘টপ টেরোরিস্টদের’ নাম প্রকাশ করে, যাদের অধীনে শতাধিক টোকাই বাহিনী রয়েছে; যাদের কাজ হচ্ছে মস্তানদের নির্দেশ মোতাবেক অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে অর্থ রোজগার করা। ২০১০ সালের ৩১ মার্চ ডেইলি স্টার পত্রিকায় ‘Crime gants grip city’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়, ডাকাত শহীদ ১২০ জনের একটি অপরাধী চক্র লালন-পালন করত। মস্তানদের নিয়ন্ত্রণে বস্তিভিত্তিক অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে, যাদের বেশির ভাগই পথশিশু বা টোকাই। ওই অপরাধী চক্র বিভিন্ন নামে বিশেষ করে দলনেতা নামে প্রথম অক্ষর দ্বারা পরিচিত। যেমন- ‘পি’ গ্রুপ, ‘আর’ গ্রুপ প্রভৃতি। মস্তানদের কাজ হচ্ছে টোকাইদের দিয়ে অপরাধ ও ভায়োলেন্স সংগঠিত করে তাদের সুরক্ষা দেয়া। চাঁদাবাজি, চুক্তিভিত্তিক খুন, জমি দখল, দোকান দখল, ফুটপাথ দখল প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থসম্পদের মালিক হওয়াই মস্তানদের একমাত্র উদ্দেশ্যে এবং এরা বেশির ভাগই মাফিয়া চক্রের অধীনে কাজ করে। এসব বেআইনি কাজ করার জন্য মস্তান বা মাফিয়ারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পুলিশ ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে। রাজনৈতিক দল পরিচালনা, ব্যয়বহুল নির্বাচনের অর্থের জোগান দেয়ার জন্য মস্তান বা মাফিয়ারা স্বেচ্ছায় ব্যবহার হয়, পক্ষান্তরে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে প্রচুর ক্ষমতা ও অর্থের মালিক হয়। মস্তানেরা সরকারি ও বিরোধী দল যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, তাদের অনেককেই আর্থিক সহায়তা দেয়। যে দল ক্ষমতায় আছে এবং যে দল ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদেরকে মাফিয়ারা আর্থিক জোগান দেয় এবং ক্ষমতাবানদের প্রকাশ্যে সহায়তা করে এবং যারা ক্ষমতায় নেই তাদের আর্থিক সহায়তা দেয় গোপনে। এভাবেই মস্তান ও মাফিয়ারা অনেক শক্তিধর।
অন্যতম গবেষক Sergi A (২০১৫)-এর মতে, ‘Mafia and Polities as concurrent government actor’ এবং তাদের ‘Concurrent goverance’ এখতিয়ার বা অধিক্ষেত্র রয়েছে। Concerance Juridection বলতে একসাথে চলাকে বোঝায়। খারাপ রাজনৈতিক নেতারা মস্তানদের দিয়ে বিভিন্ন এলাকা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তার ব্যাখ্যা গবেষক উল্লেখ করেন, যা নিম্নরূপ-
‘(1) It demonstrates that mastaan groups in Dhaka work in collusion with corrupt politicians, (2) It shows that street children are aware of organised crime, this means that it infiltrates life on the streets and that young people share inforation about mastaans with their peers and presumably the adults in their lives & (3) It reveals children’s knowledge of the connection between mastaans and politics, this shows that, even at a young age, children are able to call into question the authority of corrupt politicians.’ ওই তথ্যাদি ২০১৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ‘Asian Journal of Criminology’ থেকে সংগৃহীত।
রাজনীতিবিদ ও মস্তানদের সম্পর্কের নেপথ্যে
ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের প্রধান টার্গেট ‘ক্ষমতা’ এবং বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের দরজা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ‘জাতীয় নির্বাচন’ নামক একটি প্রহসনমূলক নাটকের মাধ্যমে এখন ক্ষমতার পরিবর্তন হয় যার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসী বাহিনীর লোক, যারা বাহুবলে কেন্দ্র দখল করে সিল মারতে পারে। মাফিয়া, মস্তানদের হাতে প্রচুর পরিমাণ টাকা এবং অবৈধ অস্ত্র যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেহেতু সন্ত্রাসী মস্তানদের ওপর রাজনীতিবিদেরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগিয়ে মস্তানেরা পালাক্রমে রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি শিকার করে নিচ্ছে। ফলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মদদ ছাড়া মস্তান বা মাফিয়া হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ, দেশে প্রচলিত আইনগুলো অনেক কঠিন, কিন্তু এর প্রয়োগ হয় রাজনৈতিক প্রভাবে। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের কাছে জাতি ও রাষ্ট্র অসহায় হয়ে পড়েছে। সরকার নিজেই যেখানে কেন্দ্র দখলের রাজনীতি করে, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য মস্তান ও পুলিশ তথা আইনকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে; সেখানে এ অপব্যবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করা একটি অবাস্তবতা মাত্র। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় অর্থ ও প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল। নতুবা টোকাইরাই সম্রাট হবে, জনগণ থাকবে অসহায়।
- লেখক আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ।
- কার্টসি — নয়াদিগন্ত/নভেম্বর ১, ২০১৯
No comments:
Post a Comment