আবু আহমেদ
আমাদের মুদ্রা টাকা মার্কিন ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে, তবে ধীরে ধীরে। এই মূল্য হারানো আমাদের মতো দেশের কাছে শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। শঙ্কা হলো, সামনের দিনগুলোয় টাকা-ডলার বিনিময়ের ক্ষেত্রে আরো বিপক্ষে চলে যায় কিনা। গত তিন মাসে আমাদের রফতানির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।
এটা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আগামী তিন মাস দেখার বিষয়। বিশ্বে এখনো কিন্তু অনেক অর্থনীতি আছে, যেগুলোর রফতানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতদিন আমাদের অর্থনীতির মজবুত ভিত গড়তে অব্যাহত রফতানি প্রবৃদ্ধি সহায়কের ভূমিকা রেখেছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক বছর ধরেই ৩২-৩৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে আছে। এটাও সম্ভব হয়েছে আমাদের অব্যাহত বর্ধিত রফতানির কারণে। অন্য মুখ্য কারণ হলো, ৮০ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে আছে, তাদের বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রেরণ। না হলে আমাদের কে সাহায্য করবে? আন্তর্জাতিক ঋণ বিক্রেতারা আমাদের অতটা ঋণ কেনার জন্য অফার করত না, যদি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির অবস্থা নড়বড়ে থাকত। তারা এখন দেখছে বাংলাদেশ পরিশোধ করতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের কাছে ঋণ বিক্রয় করো। ঋণ কিনে কোনো অর্থনীতি উপরে উঠতে পারেনি। অর্থনীতি উপরে ওঠে নিজেদের আয়-রোজগারে।
আবু আহমেদ |
সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের মানুষ যদি মনে করে তাদের দেশ উন্নতি করবে, তাহলে উন্নতি করবে। একটা আশাবাদী জনগোষ্ঠী নিজেদের সামনে নিতে প্রতিনিয়তই চেষ্টা করতে থাকে এবং তারা সফলও হয়। যাহোক, আজকের বিষয়টি অন্য ইস্যু। কথা হলো, আমরা আমাদের মুদ্রা টাকাকে ডলারের বিপরীতে আরো মূল্য হারাতে দেব কিনা। মূল্য হারানো বা মূল্য হারাতে দেয়াকে অনেকে টাকার অবমূল্যায়ন হিসেবে দেখেন। তবে সত্য হলো, এখন আমাদের স্তরে আছে এমন অর্থনীতিগুলোর কোনোটিই ঘটা করে বা ঘোষণা দিয়ে তাদের মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন করে না। যা সত্য তা হলো, সংশ্লিষ্ট মুদ্রা যখন ক্রয়ক্ষমতা হারাতে থাকে, তখন এমনিতেই বিনিময়ের বাজারে ওই মুদ্রার মূল্য পড়তে থাকে। বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার ক্ষেত্রে এমন অবস্থার উদ্ভব হয়েছে কি? তাহলে কেন দাবি তোলা হবে যে টাকাকে আরো পড়তে দেয়া হোক। যারা টাকাকে পড়তে দিতে বলছেন, তারা অতি ক্ষুদ্র বা ক্ষীণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টাকে দেখছেন। বাংলাদেশে অর্থনীতির সামষ্টিক স্থিতিশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। মূল্যস্ফীতি কম থাকা মানে টাকার ক্রয়ক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকা। টাকার ক্রয়ক্ষমতা অক্ষুণ্ন ছিল বলেই সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও করপোরেট পর্যায়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের টাকার মানের ওপর যদি আস্থা ঢিলেঢালা হয়ে যেত, তাহলে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও থমকে যেত। কমপক্ষে প্রকৃত হিসাবে তা-ই হতো। সে অবস্থায় আমরা অনেক কম বিদেশী বিনিয়োগ পেতাম।
যারা টাকার অবমূল্যায়ন চাইছেন, তারা সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনছেন না। তাদের বড় যুক্তি হলো, টাকার অবমূল্যায়ন হলে রফতানি বেড়ে যাবে। অতীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে আমাদের মতো অর্থনীতিগুলো রফতানি বাড়াতে কমই সফল হয়েছে। রফতানি বাড়ে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে রাখার মাধ্যমে। আর আজকের রফতানি প্রবৃদ্ধির বড় অনুঘটক হলো, অর্থনীতিগুলো আমাদের রফতানি করতে কী সুবিধা দিচ্ছে। অন্যরা যদি আমাদের বিশেষ সুবিধা না দিয়ে জোটভুক্ত অন্য মিত্রদের বেশি সুবিধা দেয়, তাহলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেও কি আমরা রফতানি বাড়াতে পারব?
আমরা কি ভিয়েতনামের রফতানি মূল্যের ধারেকাছেও যেতে পারব? পারব না এজন্য, ভিয়েতনাম এরই মধ্যে বড় অর্থনীতিগুলোয় রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে। আর ওই সুবিধাটাই হলো অন্যতম কারণ কেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি চীন-আমেরিকার বাণিজ্য বিরোধের প্রেক্ষাপটে তাদের স্থাপনাগুলো ভিয়েতনামে সরিয়ে নিচ্ছে। সেজন্যই পণ্য রফতানি বাড়াতে গেলে বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে অর্থনৈতিক জোটে শামিল হওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যর্থ। ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ নিজে চেষ্টা করে না। চেষ্টাটা যা করে তা হলো ভারতের মাধ্যমে। ফলে জোট গঠনে কথা হয় অনেক। কিন্তু কাজ হয় না। ভারত আমাদের কাছে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য বিক্রি করে। বাংলাদেশ অতি কষ্টে অনেক দিন অপেক্ষা করে মাত্র গত অর্থবছরে ১ বিলিয়ন ডলারের রফতানি পণ্য ভারতে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। তা নিয়েও ভারতের একটা মহল প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছে। তারা তাদের সরকারকে বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য ঠেকাও।
যাহোক, ভারতকে নেতা মেনে বাংলাদেশ যদি মনে করে কোনো অর্থনীতি জোটকে এগিয়ে নিতে পারবে, তাহলে মনে হয় না ওই জোটটা বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে কোনো বড় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে রফতানি বৃদ্ধিতে কিছুটা সফলতা আসতে পারে, যদি দেখা যায় যাদের কাছে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে তাদের চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা আছে। বাংলাদেশ যে ধরনের পণ্য রফতানি করে, ওইসব পণ্যের জন্য ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা স্থিতিস্থাপকতা নেই বললেই চলে। তাহলে যারা টাকার অবমূল্যায়ন চাইছেন, তারা কেমন করে শুধু মূল্য কমিয়ে বেশি বিক্রি করবেন। মূল্য কমানোর ব্যাপারটা আসতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা থেকে। যে কৌশল ও যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে। যারা টাকার অবমূল্যায়ন চাইছেন তাদের যুক্তি হলো, আমাদের রফতানি পণ্যকে বিদেশীদের জন্য সস্তা করে দিতে হবে। সেটা কীভাবে? সেটা হলো এভাবে: আগে তারা ১ ডলার দিয়ে ৮৪ টাকা পেত। এখন তাদের সেই একই ডলার দিয়ে ৮৭-৮৮ টাকা পেতে দাও, যাতে তারা বেশি একক পণ্য বাংলাদেশ থেকে কিনতে পারে। কিন্তু এ যুক্তি অতি দুর্বল এবং কার্যকর হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে।
বাংলাদেশের যে একটি মাত্র পণ্য মোট রফতানির ৮০ শতাংশ অধিকার করে আছে, সেই আরএমজির কাঁচামাল ও অন্য উপকরণ আসে বিদেশ থেকে। তৈরি পোশাক খাতে স্থানীয় উৎস থেকে ভ্যালু অ্যাডিশন কত? যদি ৭০-৭৫ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশনের উৎস হয়ে থাকে বিদেশ থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাপড় ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে, তাহলে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশী রফতানিকারকদের আদৌ উপকার হবে কি? অবমূল্যায়ন হলে তাদের তো সেই বেশি মূল্যেই ওইসব পণ্য কিনতে হবে। আসলে যেটা মনে হয় সেটা হলো ওই যে সামান্যটুকু নিট ভ্যালু অ্যাডিশন তারা এ দেশে করে, তার মূল্য বেশি পেতে চাইছে। এতে স্বল্পমেয়াদে তাদের হাতে কিছু বাড়তি অর্থ প্রবাহিত হলেও হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা হবে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আমরা এতদিন দেখে আসছি তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ফেরত আসতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বড় শাস্তি পাবেন দেশের নিম্ন আয়ের ভোক্তারা। আর টাকার অবমূল্যায়ন হলে আমাদের রফতানি বাড়বে তার গ্যারান্টিইবা কী?
আমাদের রফতানিকারকদের গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির স্বার্থ দেখা উচিত। টাকার অবমূল্যায়নই যদি রফতানি বৃদ্ধির জন্য ভালো পথ হতো তাহলে অনেক দেশ অন্য কিছু না করে শুধু এ কাজটিই করত। আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে আরো কিছু সংস্কার করতে হবে। সংস্কারগুলোর মধ্যে থাকা উচিত করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমানো। বিশ্বের অন্য অর্থনীতিগুলো ঠিক তা-ই করছে। আমরা বহু বছর ধরে এক জায়গায় করপোরেট কর ধরে রেখেছি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে সরকারি খাতে অনেক অলস সম্পদ আছে। আমাদের বিশ্বাস হয় না, ওইসব সম্পদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় থেকে অর্থনীতিতে আয়ের জোগান দেবে। ওইসব সম্পদকে কোম্পানি করে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে জনগণের কাছে বিক্রি করে দেয়া ভালো হবে। অন্য বিষয় হলো, সরকার যেসব বড় স্থাপনা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করছে, ওগুলোকে অর্থনৈতিক ব্যবহারের আওতায় আনতে হবে। ওগুলো যারা ব্যবহার করবে তাদের বলা হোক ফি বা প্রাইস দিতে। আর সব নীতির উপরে হতে হবে অর্থনীতিতে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। মুদ্রার বিনিময় বাজারে টাকার মূল্য কোন দিকে যাচ্ছে, এটা লক্ষ করার বিষয়। মানুষকে এমন ধারণা দেয়া যাবে না যে আমাদের মুদ্রা মূল্য হারাবে। মূল্য যাতে না হারায় সেই লক্ষ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারশক্তির তোড়ে যদি মূল্য পড়ে যায়, সেটা দেখা যাবে। কিন্তু কারো কথা ধরে বা কেউ চাইছেন বলে টাকার মূল্য কমাতে হবে, এটা যাতে না ঘটে।
- আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ/ অনারারি অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- কার্টসিঃ বণিক বার্তা/ নভেম্বর ১৪, ২০১৯
No comments:
Post a Comment