Search

Sunday, November 3, 2019

বিপ্লব ও সংহতি দিবস - ফিরে দেখা ৭ নভেম্বর

ড. মোর্শেদ হাসান খান


স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর একমাত্র দিন যেদিন সামরিক ও বেসামরিক জনগণ একত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আনন্দ মিছিলে যোগ দেয়। সে দিন সিপাহি-জনতা এক কাতারে মিশে গিয়েছিল। কিশোর, তরুণ, যুবক, সামরিক, বেসামরিক কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সিপাহিরা তাদের সামরিক বাহন এবং সাঁজোয়া যানে সাধারণ মানুষকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছিল। এমন অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় ঘটনা আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি- প্রথমবারের মতো এমন সিপাহি-জনতার ঢল বাংলাদেশে যে দিন দেখা উচিত ছিল, তা হলো আমাদের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। এটা ঘটেনি একমাত্র ভারতীয় সেনাবাহীনির হীনম্মন্যতা ও কূটকৌশলের কারণে। তারা একদমই চায়নি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুক। অথচ এই মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব সহজে ঘায়েল করে ফেলে। অথচ শুধু হীনম্মন্যতার কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সেনাবাহিনী পরিচালিত কোনো সেক্টরকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় ঢাকায় থাকতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে কোনো কারণ ছাড়াই সিলেট পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী আজ পর্যন্ত আমাদের বিজয় দিবসকে তাদের বিজয় হিসেবে পালন করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবসের উৎসব ম্লান হয়ে যায় তাদের সঙ্কীর্ণতার জন্য।

এরপর রাজপথে জনতার ঢল নামে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। লাখো জনতা হাজির হয় বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। এই ঢল ছিল শুধু বেসামরিক জনগণের। এক বুকভরা আশা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে বাংলার জনগণ তাকে মাথায় তুলে নেয়। অথচ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই আনন্দ-বিষাদ, হতাশায় রূপ নেয়। ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকার এবং লাগামহীন অন্যায়, অত্যাচার এবং জুলুমে ভারাক্রান্ত একটি আশাহত জনপদ। 



পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয় যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুর্ভিক্ষ হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায়। যথারীতি আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকরা এই দুর্ভিক্ষের জন্য বাইরের শক্তিকে দোষারোপ করে। ড. অমর্ত্য সেনের গবেষণায় দেখিয়েছেন দেশে খাদ্যাভাব না থাকা স্বত্ত্বেও শুধু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ছিল ১৯৭৩ সালের দুর্ভিক্ষ। শেখ মুজিবের শাসনামলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এতটাই হ্রাস পায়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে তাদের ব্যাপক কারচুপি এবং ভোট ডাকাতির মাধ্যমে নির্বাচনে জিততে হয়।

আওয়ামী লীগ এতটাই নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। অথচ যে জাতি মাত্র চার বছর আগে পাকিস্তানি হিংস্র হানাদারদের বিরুদ্ধে খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় একটা শূন্যতা বিরাজ করছিল। এ সময় আওয়ামী লীগেরই একজন জ্যেষ্ঠ নেতা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের নির্দেশনার বাইরে খুব একটা যেতে পারছিলেন না। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয় যেটা ছিল খুবই স্বাভাবিক কারণ তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ অকর্মণ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। একমাত্র জেনারেল ওসমানীর সুপারিশ এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে তিনি এই পদ পেয়েছিলেন। অথচ জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন তার তুলনায় অনেক পেশাদার এবং সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয়। হয়তো জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান থাকলে হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানকে অকালে প্রাণ দিতে হতো না।




১৯৭৫ এর নভেম্বরের শুরুর দিক থেকে সেনাবাহিনীতে একদল উচ্চাভিলাসী কিন্তু বিভ্রান্ত জ্যেষ্ঠ অফিসার সক্রিয় হওয়া শুরু করে। তারা সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনার দোহাই দিয়ে আরো বিশৃঙ্খল কাজ শুরু করে। সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করে তাদের নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফকে নেতৃত্বে আনার প্রচেষ্টা নেয়। এত কিছুর পরও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ তার সেনাপ্রধানের পদটা শুধু নিশ্চিত করেন। এ দিকে ঘটে যায় জেল হত্যার মতো ঘৃণ্য ঘটনা। আর খুনি বাহিনী নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়ে। যে ব্যক্তি নিজের বাহিনী সামলানোর মতো যথেষ্ট নয়, তার সেনাপ্রধান হওয়ার উচ্চাভিলাস আসলেই বিস্ময়কর। এখানে বলে রাখা বাঞ্ছনীয়, আওয়ামী লীগ ঢালাওভাবে শেখ মুজিব হত্যা এবং জেল হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে। এটা আসলে একমাত্র তাদের হতাশা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এর কোনো ঘটনার সময় জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন না। আওয়ামী লীগের কাছে তার একমাত্র অপরাধ হলো তিনি দেশের মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পেরেছিলেন। আরো অপরাধ হলো সুশাসনের মাধ্যমে তিনি দেশকে সামনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর শেখ মুজিবুর রহমান যে একজন ব্যর্থ শাসক, জনগণ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এক বিপন্ন সময়ে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর বিভ্রান্ত জাতিকে পথ দেখিয়েছে। দৃঢ়চিত্তে হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা করেছে। সেই জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর আবার জনগণকে বিভ্রান্তি এবং অনিশ্চয়তা থেকে আশার আলো দেখায় ৭ নভেম্বরে জিয়াউর রহমানের ভাষণ। জনগণ উপলব্ধি করতে পারে, দেশের শাসনভার এখন একজন দেশপ্রেমী, মুক্তিযোদ্ধা, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির হাতে। আর তাই নতুন শাসককে বরণ করতে রাজপথে কাতারে কাতারে নেমে আশে সিপাহি-জনতা নির্বিশেষে। এই দিনই ৭ নভেম্বর। আমাদের নতুন করে পথ চলার অনুপ্রেরণা।

  • কার্টসি —  নয়াদিগন্ত/নভেম্বর ৬, ২০১৬। 

No comments:

Post a Comment