Search

Tuesday, November 5, 2019

যুদ্ধদিনের খোকা


সুমন মাহমুদ


অন্য বন্ধুদের মতো বাড়িতে না জানিয়েই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য, একদল তরুণের ওই গেরিলা যুদ্ধ অনেকের কাছে ছিল বিস্ময়ের।
২০০১ সালে যখন মন্ত্রী, তখন এক আলাপে নিজের মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনার রোমন্থন করেছিলেন খোকা।
“আমি যুদ্ধে যাব- এটা মা-বাবা কাউকে জানাইনি। বলতে পার, একরম হঠাৎ করে বাসা থেকে চলে হয়ে গেলাম যুদ্ধের পথে।”
যুদ্ধে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলন, “পাকিস্তানিরা আমাদেরকে শোষণ করবে, নির্যাতন করবে, আমাদের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাবে, এটা তো মনে নেওয়া যায় না। যুদ্ধ যাওয়ার প্রতীক্ষায় দিন গুণছিলাম, একদিন হঠাৎ করেই বন্ধু-বান্ধবসহ আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলাম। হয়ে গেলাম গেরিলা, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য।”
‘লম্বা ইতিহাস’র খানিকটা সেই আলাপে বলেছিলেন এই গেরিলা যোদ্ধা।
“মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি দিককার কথা। বায়তুল মোকাররমই ঢাকার তখন একমাত্র বড় মার্কেট ছিল। একদিন দেখি দুপুরে বেলায় বায়তুল মোকাররমের সামনে বড় বড় ক্যামেরা দিয়ে শুটিং হচ্ছে। আমার একটু কিউরিসিটি হল, এখানে কী হচ্ছে? রোজার ঈদের আগে বড় বড় দোকানে দেখানো হচ্ছে যে, ঈদের মার্কেটিং হচ্ছে, বেচা-কেনা হচ্ছে, মানে দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিকভাবে চলছে। এটা দেখানোর জন্য পাকিস্তানিরা শুটিং করছে। শুনলাম ডিএফপি এই শুটিং করছে।
“তখন আমার মাথা ঢুকল, এই ডিএফপিকে তো তাহলে ধরতে হয়। কোথায় ডিএফপি? খোঁজ-খবর নিতে নিতে জানা গেল, শান্তিনগরে এসবি অফিসের পাশেই ডিএফপি (ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন্স) অফিস। এই অফিস থেকেই এসব কাজ করা হয়। তখন আমরা পরিকল্পনা করলাম এই অফিসে অপারেশন চালাব।

“ক্র্যাক প্লাটুনের আমরা তিনজন ছুটির দিনে, মানে সেদিন হাফ অফিসের দিন ছিল, অপারেশনে বেরুলাম। দিনটি ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজের পরে অপারেশন। আমরা একটা কালো ব্যাগের মধ্যে দুইটা স্টেনগান ও এক্সপ্লোসিভ নিয়ে যাই। ডিএফপির গেইটে গেলাম। যে দারোয়ান ডিউটিতে ছিল, তাকে অফিসের এক কর্মকর্তার নাম বলি যে, তার (ওই কর্মকর্তা) দেশের বাড়ি থেকে এক আত্মীয় উনার জন্য জিনিস পাঠিয়েছেন। এই কথায় দারোয়ান অফিসের গেইট খুলে ঢুকতে দেয়। ভেতরে ঢুকে আমরা ব্যাগ থেকে অস্ত্র বের করে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিই, তাকে বোঝাই যে আমরা মুক্তিযোদ্ধা। এক পর্যায়ে দারোয়ান বলে যে, সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। তার ছোট ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা। বিষয়টা আমাদের জন্য ইজি হয়ে গেল।”
“তারপর একটা পর্যায়ে আমরা সেই ২০ পাউন্ড ওজনের এক্সপ্লোসিভটা রুমের ভেতরে রাখি। এক্সপ্লোসিভের বৈশিষ্ট্য হল, যত চাপ দিয়ে রাখা যাবে, এটার ক্যাপাসিটি তত বাড়বে। তখন কয়েকটা স্টিলের আলমারি দিয়ে ওই এক্সপ্লোসিভ চাপা দিলাম, তারপর বিস্ফোরণ ঘটাই। সেই বিস্ফোরণের পর সারা বিশ্বে শিরোনাম হয়েছিল- পূর্ব পাকিস্তানে দামাল মুক্তিযোদ্ধারা অশান্ত করে তুলেছে ঢাকাকে। এরকম বিস্ফোরণ এযাবত পাকিস্তানে আর হয়নি। এটা পাকিস্তানের সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এভাবে দিনে-দুপুরে এরকম একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধারা, এটা কী করে সম্ভব!”
ডিএফপি ছাড়া রাজারবাগের কাছে মোমিনবাগে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়, ঢাকা হলের পেছনে এয়ারফোর্সের রিক্রুটিং সেন্টারও খোকার নেতৃত্বে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।
খোকা বলেছিলেন, “আমাদের অপারেশনের স্পিরিট ছিল শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখা। ঢাকার মানুষকে জানান দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধ ঢাকায়ও চলছে। আমাদের গ্রুপ বিশেষ করে ছোট-বড় অনেক অপারেশন আমরা করেছি ঢাকায়।”
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি তুলে ধরে খোকা বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই বাংলাদেশ থেকে আমরা কয়েকজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা শহরে গিয়ে সিপিএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্কসবাদী) অফিসে যাই। সেখানে আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দকে পাই। সেখান থেকে আমাদের যাত্রা ২ নম্বর সেক্টরে। মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর এটিএম হায়দারের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। সেখানে আমাদের শহীদুল্লাহ খান বাদল আমাদের বিভিন্ন গ্রুপে পাঠিয়ে দেন।
“ট্রেনিংয়ের পর মেজর হায়দারের নেতৃত্বে আমি কুমিল্লার সালদা নদীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। সেই দিন রাতে সেই দুঃসাহসিক অপারেশনের কথা স্মরণ করলে শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। মাথার উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারে টমি গান-ব্যারেল গানের আগুনের স্ফূলিঙ্গের মতো কী যেন ছুটে যাচ্ছে। যেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। পাকিস্তানি সৈন্যদের আমরা সেই অপারেশনেই পিছু হটাতে বাধ্য করেছিলাম।”
খোকার ভাষায়, “মুক্তিযুদ্ধ ছিল সার্বজনীন। কোনো দল, কোনো গোষ্ঠি, কেনো ব্যক্তি, কোনো পরিবারের একক কারও অবদান ছিল না, এই অবদান বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের। এর সুফলও সার্বজনীন হওয়া উচিৎ।”

 — লেখক প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

No comments:

Post a Comment