Search

Thursday, November 7, 2019

৭ নভেম্বর : ইতিহাসের অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


বাংলাদেশ হলো রাজনৈতিক বিভাজনের এক উর্বর ক্ষেত্র। এখানে পক্ষপ্রতিপক্ষ, দলউপদল সব সময়ই প্রকট। ঘৃণার বীজ বপনের প্রতিযোগিতা চলে প্রতিনিয়ত। এই প্রতিযোগিতায় যখন যে পক্ষই জিতুক, নিশ্চিতভাবে সব সময়ই হারে দেশ। হেরে যায় দেশের রাজনীতি। একটা দেশে বিভাজন প্রকট হলে সেখানে দেশবিরোধী দালাল শ্রেণির উদ্ভব হয় অধিক হারে। ফলে বিদেশি শক্তি ও দেশবিরোধী শক্তির সখ্য গড়ে ওঠে সহজেই। এতে চূড়ান্ত ক্ষতিটা হয় দেশেরই।

বাংলাদেশে যে সব বিষয় নিয়ে বড় ধরনের বিভাজন বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম ৭ নভেম্বর। এই দিনটিকে ঘিরে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক বলয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অবস্থান বরাবরই ভিন্ন মেরুতে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ৭ নভেম্বর ছিল সরকারি ছুটির দিন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে ছুটি বাতিল করায় এ দিনকে ঘিরে বিভাজন আরও পোক্ত হয়। এ দিনটি উদযাপনেও আছে ভিন্নতা। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ৭ নভেম্বরকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ পালন করে সেনা হত্যা দিবস হিসেবে। আর জাসদ করে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে। এই তিন রকম দিবস হওয়ার পেছনেও কারণ আছে। অনেকেই মনে করেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ধারাবাহিকতা হচ্ছে নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান। ফলে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ৭ নভেম্বরকে ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এ দিনে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবন ফিরে পেয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনে দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে এসেছিলেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং বিএনপি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ঘরানার দলের জন্য ৭ নভেম্বর এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর জাসদ কেন এ দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে তার ধারণা পাওয়া যাবে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এর একজন সাক্ষী তৎকালীন মেজর ও পরে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত)  সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীকের বয়ানে। তিনি লিখেছেন, ‘৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে অনেক অফিসার নিহত হয়েছিলেন, তাদের হত্যাকারী কে? বেশিরভাগের হত্যাকারী জাসদপন্থি সৈনিক সংস্থা বা জাসদের গণবাহিনী? হত্যাকারীদের নির্দেশদাতা কে? উত্তর, এই কলামে আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে না পারলেও পাঠক বুঝে নেবেন। ৭ নভেম্বর তারিখে ব্যর্থ হয়ে, পুনরায় সৈনিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাসদ। পুনরায় সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সৈনিকদের সংগঠিত করা শুরু করেছিল, জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করার নিমিত্তে। সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়েছিল তৎকালীন জাসদ। ৭ নভেম্বরের আগে এবং ৭ নভেম্বরের পরে দুই কিস্তিতে সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢোকানোর কাজটি, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ ছিল। ৭ নভেম্বরের পরের চেষ্টা, আগের চেষ্টা থেকে বেশি বিপজ্জনক বিবেচিত হয়েছিল’ (৭ নভেম্বর ১৯৭৫ : একজন সাক্ষীর স্মৃতিচারণ, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীক, ৭ নভেম্বর, ২০১৭, দৈনিক ইনকিলাব)।

সুতরাং এই জাসদের পক্ষে যেমন আওয়ামী লীগের সুরে লাইন ধরে ৭ নভেম্বরের মূল্যায়ন সম্ভব নয়, আবার জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির সুরে কথা বলাও সম্ভব নয়।

৭ নভেম্বরকে বুঝতে হলে কয়েকটি ডেটলাইন বোঝা জরুরি। একটু দেখে নেওয়া যাক ১৯৭৫ এর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সেই উত্তাল দিনগুলোতে কী ঘটেছিল!

০৩ নভেম্বর : সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অভ্যুত্থান। তাজউদ্দীন আহমদ ও অপর তিন জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় নিহত।

সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগ-সিবিপি-ন্যাপ এর কর্মী-সমর্থকদের মিছিল।

০৪ নভেম্বর : অভ্যুত্থানকারীদের চাপে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রদান ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ। কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্মীদের দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে লিফলেট বিতরণ। লিফলেটে সৈনিকদের বিদ্রোহ করা এবং ‘ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতক খালেদ চক্র’কে উৎখাত করার আহ্বান।

৬ নভেম্বর : বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ।

জাতীয় সংসদ বাতিল ঘোষণা।

জিয়াউর রহমানের তরফ থেকে আবু তাহেরের কাছে সাহায্যের আবেদন।

ঢাকায় প্রকৌশলী আনোয়ার সিদ্দিকীর বাসভবনে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দের বৈঠক। আখলাকুর রহমানসহ অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও  সামরিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

৭ নভেম্বর : সেনানিবাসগুলোতে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকদের অভ্যুত্থান; বন্দি জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সামরিক সহযোগী অজ্ঞাতনামা বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে নিহত।

রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ। তিন বাহিনীর প্রধানদের উপ-সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত।

রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের ভারত পলায়ন। (সূত্র: মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ, আলতাফ পারভেজ, পৃষ্ঠা ৪২৮-২৯)।

৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধানের পদ গ্রহণ করার বিষয়টি বেশিরভাগ অফিসার ও সাধারণ সৈনিকরা মেনে নিতে পারেনি। এতে সেনাবাহিনীতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। একদিকে খালেদ মোশাররফের ভাই এবং মায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় মিছিল, অন্যদিকে জাসদের লিফলেটের বক্তব্য অনেকের মনে একটা ভিত গেড়ে দিল যে, ৩ তারিখের সেনাঅভ্যুত্থান ভারতপন্থি এবং তা করা হয়েছে ভারতপন্থি আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় স্থাপনের জন্য। সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল যে, খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি এবং ভারতের সমর্থনেই তিনি অভ্যুত্থান করেছেন।

পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের আলোচনায় অবধারিতভাবে তিনটি নাম বারবার আসে। জিয়াউর রহমান, আবু তাহের ও  খালেদ মোশাররফের নামই সব সময় থাকে আলোচনার কেন্দ্রে। তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) এবং তাহের ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল, যার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল জাসদের সঙ্গে। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে তিনি সরাসরি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরই মধ্যে গঠিত হয় সেনাসদস্যদের নিয়ে সৈনিক সংস্থা এবং গণবাহিনী। এই তিনজনের মধ্যে সংগত কারণেই জিয়াউর রহমান থাকেন আলোচনার মধ্যমণি। ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি, জিয়াউর রহমানের বন্দিত্ব ও মুক্ত হয়ে  সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা, পরবর্তী সময়ে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ তাকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে দেয়। স্বাধীনতার ঘোষণা ও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে জিয়াউর রহমান আগে থেকেই ছিলেন পরিচিত ও জনপ্রিয়। তার আর্থিক দুর্নীতিমুক্ত পরিচিতিও তাকে এক ভিন্ন অবস্থান এনে দেয়। দেশের দুটি মহাক্রান্তিলগ্নে ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের দায়িত্ব এসে ধরা দিয়েছিল তার হাতে।

লে. কর্নেল এম এ হামিদ (অব.), মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.), মেজর জেনারের আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)-সহ তৎকালীন বহু সেনা অফিসারের লেখায় যে সত্যতা বেরিয়ে আসে তাতে এটা স্পষ্ট যে, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ৭ নভেম্বর দেশ অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে চলতে শুরু করে জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লবকে যারা কর্নেল তাহের ও জাসদের একক কৃতিত্ব হিসেবে দেখিয়ে জিয়াউর রহমানকে ছোট করতে চান তারা হয়তো মাথায় রাখেন না যে একজন অফিসার তার বাহিনীর মধ্যে কতটা জনপ্রিয় হলে সৈনিকরা তাকে মুক্ত করে আনতে পারে। জিয়াউর রহমান তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন বলেই কর্নেল তাহের  সেটাকে কাজে লাগিয়ে অভ্যুত্থান করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে তৎপর হয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর নিয়ে যত বিভাজন, ভিন্নমত ও আলোচনা-সমালোচনাই থাকুক, যত প্রশ্নই অমীমাংসিত থাকুক, সেটা হয়তো ইতিহাসের নিয়মেই একদিন মীমাংসিত হবে। তবে একটা বিষয়ে অনেকেই একমত, এ দিনটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন নায়কের উত্থান ঘটেছিল। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

  • লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট 
  • কার্টসি —  দেশ রূপান্তর / নভেম্বর ৭, ২০১৯

No comments:

Post a Comment