Search

Sunday, December 29, 2019

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন!

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, বিরোধী দল দমন এবং বীভৎস দুর্নীতিকে সরিয়ে রাখলে যে বিষয়টি সবচেয়ে  বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো ‘নির্বাচন’। ২০১৪ সাল থেকে সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনেই মানুষের ভোটের আর কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না।

২০১৪ সালে অতিবিতর্কিত একতরফা একটি তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হওয়ার পর সকলেই ধারণা করেছিল এর মেয়াদ ৫ বছর দূরে থাকুক, কয়েক মাসও সম্ভবত হবে না। এমনকি সরকারের তরফ থেকে এমনও বলা হয়েছিল যে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, অচিরেই সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সম্ভবত সে সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি যে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দলীয় ক্যাডার, প্রভাবশালী বিদেশি বন্ধুদের সহায়তায় জনগণকে তুচ্ছ করে ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করা যায়। সবারই নিশ্চয়ই স্মরণে আছে- সে সময়ে কীভাবে নানা নাটক করে জবরদস্তিমূলক বিরোধী দল গঠন করা হয়েছিল। যা অদ্যাবধি গৃহপালিত বিরোধী দল নামেই বেশি পরিচিত। তামাম বিশ্বেই ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ এক নতুন কনসেপ্ট।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরে সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও একচেটিয়া একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনে রূপ নেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্ধারিত একাদশ সংসদ নির্বাচনটি যে কোনোভাবেই এর ব্যতিক্রম হবে না, তা যেকোনো বিবেচনাতেই বোঝা উচিত ছিল। এই ‘নির্বাচন’ যদি কাউকে বিস্মিত করে থাকে তাহলে সেটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৈন্যতা। দশম সংসদ নির্বাচনের পরে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা হয়েছে তেমনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরেও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার স্বয়ং, গবেষণা সংস্থা টিআইবি, বিদেশি গণমাধ্যম, বিদেশি পর্যবেক্ষক, সুজন প্রত্যেকেই নির্বাচনটির কঠোর সমালোচনা করেছে। এই নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমি সাক্ষী দিয়ে বলছি, এই নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু জনগণ ভোট দিতে পারেনি।’ যেই নির্বাচনে তথাকথিত নির্বাচিতরাই প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে স্পষ্ট বলেন, মানুষ ভোট দিতে পারেননি সেটা আর যাই হোক কোনোভাবেই নির্বাচনের সংজ্ঞায় পড়ে না।

অতি সম্প্রতি ঘোষিত হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ। নির্বাচন নিয়ে মানুষের উৎসাহ বা প্রত্যাশা তেমন না থাকলেও দলগুলো ইতিমধ্যেই তাদের প্রার্থী মনোনয়নের ইঙ্গিত দিয়েছে।

এই দেশের মানুষ এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটকেন্দ্র বিমুখ। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি সংসদে দাঁড়িয়ে রাশেদ খান মেননের উক্তি- ‘আজান দিয়েও আজকাল ভোটার আনা যায় না’। তাই খুব সম্ভব ভোটকেন্দ্র বিমুখ মানুষকে কেন্দ্রে আনার জন্যই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করলেন ‘আমি আশ্বস্ত করছি, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে’। নির্বাচন সুষ্ঠু করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং নির্বাচন পরিচালনার সকল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের একক। এই বিষয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক কী করে আশ্বস্ত করেন তা আমার বুঝে আসে না। ভোট সুষ্ঠু করবার দায়িত্ব যখন তিনি নিচ্ছেন তার অর্থ কি এই নয় যে, এতদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দলীয় ক্যাডার এবং প্রশাসনই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র বাধা ছিল। তিনি তার বক্তৃতায় আরো বলেন, ‘আমি আশ্বস্ত করছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে সবধরনের সহায়তা করবে সরকার। আপনারা নির্বাচনে আসুন, ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হবে।’ 

অথচ বিষয়টি সরকারের জন্য ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়, এটা বাধ্যবাধকতা। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে আশ্বস্ত করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ‘সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। ভোট নিয়ে ভয়ের কারণ নেই’। ‘সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না’ কথাটির মাঝেই লুকিয়ে আছে যে সত্য তা হলো মানুষ এটা জানে যে সরকার নির্বাচনে যাচ্ছেতাইভাবে হস্তক্ষেপ করে।

পরবর্তীতে অবশ্য সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের নির্বাচনে হাত না দেয়া সংক্রান্ত উদারতার কারণ তিনি নিজেই স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে- ‘সিটি ভোটে হেরে গেলে সরকারের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না’। এর সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় জাতীয় নির্বাচনে হেরে গেলে যেহেতু মাথায় আকাশ ভাঙার বিষয় থাকে, তাই সেখানে যেনতেনভাবে নির্বাচনে জেতা যেতেই পারে। আর হারলে আকাশ ভেঙে পড়বে না এমন দুই একটি নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দিয়ে সরকারি দল হেরে গেলেও দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে এমন কথা বলা যাবে বৈকি বুক ফুলিয়ে।

গত ২৫শে ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কেন নির্বাচন নিরপেক্ষ, শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না এ প্রশ্নের উত্তর আত্মজিজ্ঞাসার কারণে আমাকে খুঁজতে হয়েছে। 

আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দি’। বর্তমানে নির্বাচন প্রক্রিয়া যে সরকারের একেবারে কব্জায় আছে যে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একটি নিরপেক্ষ, শুদ্ধ, ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেটি জনাব তালুকদারের এই বক্তব্যে খুব স্পষ্ট। এমনকি নির্বাচন কমিশন চাইলেও নির্বাচন আদৌ অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সেটার জন্য কমিশনকে সরকারের ইচ্ছে-অনিচ্ছের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। অবশ্য জনাব তালুকদার ছাড়া সিইসিসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্য সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছেন, তাই নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য কমিশনকে সরকারের সঙ্গে কোনোরকম লড়াইয়ে নামতে হয়নি।

সেই সভায় জনাব তালুকদার আরো বলেন, ‘নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পদযাত্রা অবারিত করতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে’। বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসন্ন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিগত ওই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না’। কিন্তু কাগজে-কলমে স্বাধীন থাকা নির্বাচন কমিশন যতই ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করুক না কেন, সরকার না চাইলে আমাদের মতো দেশে যে নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় তা একজন শিশুও বোঝে। যে কারণে জনাব তালুকদার বারবারই নির্বাচন প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন।

মাহবুব তালুকদার খুব গুরুত্বপূর্ণ আর একটি কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অবৈধভাবে নির্বাচিতদের জনগণের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি কোন কমিটমেন্ট থাকে না’। কথাগুলো নতুন নয়, কিন্তু তথাকথিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে একজন নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব রাখে তো বটেই। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট না থাকা সরকার কেমন হতে পারে। এ ধরনের একটি রেজিমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ কোনো একক ব্যক্তি বা দলের পক্ষে সম্ভব নয়, একমাত্র জাতীয় ঐক্যই পারে এর থেকে আমাদের মুক্ত করতে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 

বাড়ছে শিক্ষিত বেকার

চাহিদামাফিক জনশক্তি গড়ে তুলুন


সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদের নেতৃত্বে একটি দল ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপ অনুযায়ী, শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার বলে জানানো হয়েছিল। বিবিএসের জরিপের তুলনায় বিআইডিএসের অনলাইন জরিপে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। বাংলাদেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা জানতে কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস কিংবা অন্য কোনো খাতে একটি শূন্য পদে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দেখলেই সেটি অনুমান করা যায়।

বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা এই জরিপ করলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো অসত্য বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই জরিপের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কেবল বিআইডিএস বা বিবিএসের জরিপ নয়, দেশি-বিদেশি প্রায় সব জরিপ ও পরিসংখ্যানেই বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে। কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ।

দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, এটি আনন্দের খবর। কিন্তু সেই আনন্দ মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যখন আমরা তাদের বড় একটি অংশকে কাজে লাগাতে পারি না। শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই শিক্ষার পেছনে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিপুল বিনিয়োগ থাকে। শিক্ষিত তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ যদি বেকার থাকে, তাহলে আমরা ওই শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত বা যুগোপযোগী বলব?

জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করতে হবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চলেছি, যা সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এর অর্থ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে, কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার কেউ নেই। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
  • কার্টসি- প্রথম আলো/ ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯

নির্বাচন কমিশন আঁতাতে লিপ্ত — বদিউল আলম মজুমদার


নির্বাচন কমিশনের জনগনের আস্থা নেই বলে মন্তব্য করেছেন  সুশানের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার৷ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন তিনি৷

ডয়চে ভেলে: ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? সুষ্ঠ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে কিনা?


বদিউল আলম মজুমদার: এ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের কারণ রয়েছে৷ কেননা, এ নির্বাচন কমিশনের নিরেপক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে৷  গত জাতীয় নির্বাচনে তারা নিজেদের বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে পারেনি, অনেক কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে ৷ বস্তুত জাতীয় নির্বাচনে যা হয়েছে তা মূলত এক ধরনের অশুভ আঁতাত৷ নির্বাচন কমিশন, এক শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী  ও সরকারি দলের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা মিলে এ আঁতাত তৈরি করেছিল৷ যে কারণে এই নির্বাচনের কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে জনমনে ব্যপক সন্দেহ রয়েছে৷ তাদের কাছ থেকে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের আশা করা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই না৷

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়েছে৷ এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?


ইভিএম একটি বড় অংশের ভোটরদের ভোট প্রদান থেকে বঞ্চিত করছে৷  আমরা যদি গত জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায় ২৯৪ টি কেন্দ্রে সাধারণ ব্যলট আর বাকীগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে৷ ইভিএমে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ আর পেপার ব্যালটে ৮০ দশমিক ৮০৷ তাহলে ৩০ শতাংশের ফারাক কেন৷ সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে৷ হয় ইভিএমের ত্রুটি অথবা জটিলতা, কিংবা ইভিএমের প্রতি মানুষের অনীহা থেকেই ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷৷ এ দায়ভার কে নেবে৷ এ পদ্ধতির যৌক্তিকতা কোথায়? সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম-এর ব্যবহার তাই একটি মস্ত বড় ভুল হবে৷ কেননা ভোটররা যদি ভোট দিতে না পারেন, আপনার পদ্ধতি যদি ভোটরদের মাঝে অনীহা তৈরি করা, তাহলে সেটি কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য কোন ব্যবস্থা নয়৷

বিএনপি একদিকে সরকারকে অবৈধ বলছে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছে আবার এই সরকার ও একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷  বিএনপির এ অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?


রাজনৈতিকভাবে বিএনপির নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে, তারা অনেক দুর্বল অবস্থানে চলে এসেছে৷  যদিও তাদের অনেক জনসমর্থন আছে বলে অনেকে মনে করে৷  তবে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে৷ একটি রাজনৈতিক দল যদি ক্ষমতায় আসতে চায় তাহলে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে৷ এদিকে তারা যদি নির্বাচনে না যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনেরা যে সকল অভিযোগ করছে, সে অভিযোগলো আরো  শক্তিশালী হবে৷৷ আমার মনে হয় না নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় আছে৷  তবে বিএনপি রাজপথে সরব হতে না পারার কারণ হলো যে, রাজপথ যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ও সরকারি দলের অংগসংগঠনের দখলে থাকে তাহলে সেখানে সরব হওয়া অসম্ভব৷

গত জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ভোটরদের উপস্থিতি কম ছিল ৷ সিটি কর্পোরেশনের এ  নির্বাচনটিকে ভোটারদের দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?


ভোটারদের কম উপস্থিতির কারণ অনেক৷ যেমন অনেকের ধারণা আমি ভোট দিলেও কিছুই যায় আসে না আবার অনেকে ভাবছেন আমি ভোট দিতে গেলে ভোট দিতে যে পারবো তার নিশ্চয়তা নেই৷ নির্বাচন বিষয়ে মানুষের মধ্যে ব্যপক অনাস্থা ও অনীহা সৃষ্টি হয়েছে৷  যা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলেছে৷ এটি একটি অশনি সংকেত, কারণ নির্বাচনই একমাত্র সুষ্ঠ, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মকান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের পন্থা৷  এটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তা কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না৷

আপনি বলছে নির্বাচন কমিশন ‘আঁতাত‘ করছে তাই নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে৷ কিন্তু আসছে নির্বাচন নিয়ে তো নাগরিক সমাজকে সরব হতে দেখা যাচ্ছে না৷ এটি কেন হচ্ছে?


সিভিল সোসাইটি ধ্বংস করে দিয়েছে৷ দুয়েকজন ছাড়া সিভিল সোসাইটির অধিকাংশই অনুগত ও সুবিধাপ্রাপ্ত৷ দুর্ভাগ্যবশত দুয়েকটি গণমাধ্যম ছাড়া কেউ দায়িত্বও পালন করছে না৷ সেলফসেন্সরশিপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে৷

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী বলে আপনি মনে করেন?


এ নির্বাচন কমিশন আমাদের মহা অনিষ্ট করে ফেলেছে৷ তাদের স্বউদ্যোগে পদত্যাগ করা উচিত৷  তা না হলে  সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত৷  বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে৷

  • কার্টসি - ডয়চে ভেলে/ 27.12.2019

Thursday, December 26, 2019

কৃষকের নীরব কান্না

আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারের ধান ক্রয়


ধানই কৃষকের জীবন। দেশের প্রায় সব কৃষক ধান চাষ করেন। পেঁয়াজ-মরিচসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করেন হাতেগোনা কিছু কৃষক। পেঁয়াজদের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে যখন তোলপাড়; তখন ধানের দাম নিয়ে কৃষকরা চরম হতাশ। ‘কৃষকের অ্যাপ’ নামে ‘ডিজিটাল পদ্ধতি’তে লটারি করে ধান সংগ্রহের সরকারের প্রচারণা মিডিয়ায়। মধ্যসত্ত¡ভোগী ঠেকাতে ‘মনিটরিং কমিটি’ গঠণের ঘোষণা। সবই ফাপা বেলুন। প্রতিমণ ১০৪০ টাকা (প্রতি কেজি ২৬) দরে কৃষককের কাছ থেকে ২৬ লাখ টন ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়ে সরকার নীরব। ধান বিক্রি করতে না পেরে চোখের পানি ফেলছে লাখ লাখ কৃষক। আড়াই থেকে তিন কেজি পেঁয়াজের দামে একমণ ধান বিক্রি করতে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন।

দেশের এলাকা ভেদে অনুক‚ল আবহাওয়ায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে ১৮ থেকে ২২ মণ ধান পেয়েছেন কৃষকরা। অথচ ন্যায্যম‚ল্য নেই। লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করা হচ্ছে। ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েও কৃষকের কাছ থেকে ধান নেয়া হচ্ছে না। সিডিন্ডকেটের মাধ্যমে ফড়িয়াদের কাছ থেকে ক্রয়ের লক্ষ্যে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে বিলম্ব হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ফেলে ৪৯১টি উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬টি উপজেলায় সরকার ধান ক্রয় শুরু হয়েছে। ইনকিলাবের প্রতিনিধিরা জানান, সারাদেশের বাজারগুলোতে প্রকার ভেদে ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা মণ দরে। যদিও সার, বীজ, সেচসহ বিঘা প্রতি ধান আবাদে কৃষকের খরচ হয়েছে ১১ থেকে ১৩ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি লোকসান গুণতে হচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ধান মাড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে ক্ষোভ-হতাশা কৃষকের চোখে-মুখে। ধানের ন্যায্য দাম পেতে সরকারের দিকে তাকিয়ে কৃষকরা। তারা বলছেন, সরকার ধান ক্রয় করলে কিছুটা লাভের মুখ দেখতেন। কিন্তু গত বছরের চেয়ে কম দামে লোকসানেই বিক্রি করতে হচ্ছে ধান। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার উৎপাদন বেশি হওয়ায় দেশের অনেক অঞ্চলের কৃষক ধানের দরপতনের আশঙ্কা করছেন। ইনকিলাবের ব্যুরো, আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা প্রতিনিধিরা সারাদেশের ধানের বাজার ও কৃষকদের খোঁজ খবর নিয়ে এই প্রতিবেদন লিখেছেন।

কৃষকের মন ভাল নেই যশোরে

যশোর ব্যুরো থেকে বিশেষ প্রতিনিধি মিজানুর রহমান তোতা জানান, বৈরী আবহাওয়া ও নানা সমস্যা মোকাবেলা করে অনেক কষ্টে উৎপাদন করা রোপা আমন ধানের মূল্য না পেয়ে ঘরে ঘরে কৃষকরা হাহাকার করছেন। তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে কৃষক পরিবারের মাঝে। সরকারের ক্রয় পদ্ধতি সাধারণ কৃষকদের কোন উপকারে আসেনি। প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে বড়জোর ৬শ’টাকা। মাঠচিত্র হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার জের টানতে হচ্ছে কৃষকদের। কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন আবার ভোক্তারাও চালের মূল্য কম পাচ্ছেন না। মাঝখানে লাভের অংশ যাচ্ছে কাদের পেটে-এসব বিষয় যাদের দেখভাল করার দায়িত্ব, তাদের নীরবতা এবং ‘দেখা যাক, দেখছি, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’-এমন বক্তব্যের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকায় মজুদদার, পাইকারী ব্যবসায়ী ও মিলারদের ফি-স্টাইলে কাজকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে। যশোর সদর উপজেলার ডাকাতিয়া গ্রামের আব্দুল মান্নান বললেন, ‘আমি কয়েকদফা ধান হাটে তুলে দাম না পেয়ে বিক্রি করিনি। তবে বাধ্য হয়ে মাত্র ৬শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি। মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ড, আখতারুজ্জামান জানান, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে দারুণ অসন্তোষ। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের মতে, জরুরিভাবে কৃষকদের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দরকার। তার কথা, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবেই কৃষক শুধু ধান নয়, সব কৃষিপণ্যের মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ লিয়াকত আলী জানান, জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে লটারীর মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ৬শ’ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হয়েছে। সদর উপজেলায় এখনো শুরু হয়নি। পাইলট প্রোগ্রামে লটারীর মাধ্যমে ধান ক্রয় শুরু হবে বৃহস্পতিবার থেকে। চাল ক্রয়ও এখনো শুরু হয়নি। শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের কৃষক জসিম উদ্দীন বললেন, লটারীর মাধ্যমে সাধারণ কৃষকরা সরকারী মূল্যে ধান বিক্রি করার সুযোগ পায়নি। হাটবাজারে আড়তদার, পাইকারী ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরদের দাপট চলছেই। তারা নানাভাবে সহজ সরল কৃষকের কাছ থেকে কম মূল্যে ধান ক্রয়ের ফন্দিফিকির আঁটে। এবারও তার ব্যতয় ঘটেনি।

বাম্পার ফলনেও হাসি নেই

রাজশাহী ব্যুরো থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, রাজশাহী অঞ্চলে এবারো আমনের ভাল ফলন হয়েছে। ধান কাটাই মাড়াইও প্রায় শেষ। চারিদিকে নতুন ধানে মৌ মৌ করা গন্ধ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী উৎপাদন হয়েছে। তারপরও হাসি নেই আবাদকারীদের মুখে। কারন ঘাম ঝরানো ঋনের ফাঁসে আটকানো স্বপ্নের সোনালী ফসলের কাংখিত দাম নেই। য্ াদাম চলছে তাতে হতাশ। সরকারের কাছে ধান নিয়ে যেতে পারছেনা প্রান্তিক কৃষক। সর্বত্র ফড়িয়া দালাল, মিলার আর রাজনৈতিক দুবৃত্ত। বরাবরের মত এদের হাতে বন্দী ধানের বাজার।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবার রাজশাহী অঞ্চলে রাজশাহী, নওগা, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জে এবার ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিনলাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে নয়লাখ সত্তর হাজার মে:টন ধান। বাস্তবে সব জেলায় আবাদ বেশী হওয়ায় (চার) জেলায় বারোলাখ সত্তর হাজার মে:টন ধান উৎপন্ন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিনলাখ মে:টন ধান বেশী হয়েছে।

ধান উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে খ্যাত নওগা জেলায় সবচেয়ে বেশী ধান উৎপাদন হয়েছে একলাখ ৯৭ হাজার মে.টন। রাজশাহী জেলায় ৭৬ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে তিনলাখ ৮৮ হাজার মে.টন ধান উৎপাদন হয়েছে। নাটোর জেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ হাজার ৮৫৬ হেক্টর জমিতে। বাস্তবে আবাদ হয় ৬৯ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে। ধান উৎপাদন হয়েছে তিনলাখ ৩৪ হাজার ৩৭০ মে.টন। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৫২ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে দুইলাখ ৪০ হাজার মে:টন ধান উৎপাদন হয়েছে। মাঠের হিসাব বলছে প্রত্যেক জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ ও উৎপাদন দুটোই বেশী হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় ফলন বাম্পার। এই বেশী ফলন যেন কাল হয়েছে আবাদকারীদের। ধানের দাম নেই। সর্বত্র সিন্ডিকেট বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে মনপ্রতি ছয়শো হতে সাতশো টাকার মধ্যে। যাতে উৎপাদন খরচ উঠছে না।

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক মকবুল জানান, একবিঘা জমিতে ধান আবাদ করতে হালচাষ, বীজ সার, সেচ, কীটনাশক, মজুরী, ঝাড়াই, মাড়াই করতে খরচ পড়ছে আট থেকে দশ হাজার টাকার মত। বিঘাপ্রতি ফলন হচ্ছে চৌদ্দ থেকে ষোল মন। ফলে বর্তমান দামে বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে পাঁচ ছয় হাজার টাকা। এমনি অভিযোগ প্রায় সব এলাকার কৃষকের।

রাজশাহী জেলায় ধান উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫০ মে:টন। সেই ধান সরকারী ক্রয় কেন্দ্রে কৃষকেরা ধান বিক্রি করার জো নেই। ধানে চিটা আদ্রতা নানা অভিযোগ তুলে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে কৃষকের কাছে কার্ড দেওয়া হলেও তা কিনে নিচেছ বিশেষ সিন্ডিকেট। ফলে সরকারের ভাল উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেনা কৃষক। কৃষকরা বলছেন সরকারী ক্রয়মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকা। বাজারে মনপ্রতি আট নয়শো টাকা পেলেও তাদের লোকসান ঠেকানো যেত।

চারিদিকে শুধু ধান আর ধান। এত ধান নিয়ে ফড়িয়া মিলার সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে কত কম দামে ধান কিনে নেয়া যায়। তারা মোবাইলে মোবাইলে হাটের ধানের দাম নিয়ন্ত্রন করছে। এরাই কম দামে ধান কিনে সরকারী খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছে। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে সরকারের ধান চাল কেনার উদ্যোগ এদের হাতে জিম্মী। বিগত বোরো আবাদের লোকসান কাটাতে এবার বেশী জমিতে আবাদ করে লোকসান পোষানোতো দূরে থাক উল্টো লোকসানের ফাঁস আরো আঁটো সাঁটো হলো। মোট উৎপাদনের দেড় দু’শতাংশ ধান সরকার কিনছে। বাকী ধান নিয়ে হাটে মাঠে ফড়িয়া মিলাররা খেলছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন ধানের উৎপাদন ভাল হলেও সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনার কারনে কৃষক নায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রমাগত লোকসান হলে কৃষক ধান আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আমন ধান মানে নবান্নের উৎসব। ঘরে ঘরে পিঠা পায়েসের আয়োজন। এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছেনা।

বগুড়ায় দরপতন

বগুড়া ব্যুরো থেকে মোহসিন রাজু জানান, আমন মওশুমের কাটা মাড়্ইায়ের কাজ শেষ হওয়ায় বগুড়ায় হাট বাজার গুলোতে ধানের সরবরাহ প্রচুর। ক্রেতার অভাবে সময়মত ধান বিক্রি না হওয়ায় দাম পড়তির দিকে। চলতি সপ্তাহে বগুড়ার বৃহত্তম ধানের বাজার নন্দীগ্রাম, কাহালু এবং দুপচাঁচিয়ায় মান ভেদে আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৬শ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত। উৎপাদক চাষীরা এই দামে সন্তষ্ট নন। তারা জানিয়েছে, মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে ধানের এই দরপতন। চাষীরা আরো বলেছে, চারা (বিচন) ক্রয়, জমিচাষ,নিড়ানী এবং সব শেষে কাটা মাড়াইয়ের খরচ হিসাব করলে প্রতিমন ধান উৎপাদনের খরচ পড়েছে, কোন এলাকায় ৮শ’ কোন এলাকায় ৯শ’ টাকা। এর ফলে এখন যে বাজার দর তাতে উৎপাদক চাষীদের প্রতিমন ধান বিক্রি করে লস হবে দেড়শ’ দু’শ টাকা ।

বগুড়ার খাদ্য বিভাগে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ১ ডিসেম্বর থেকে সরকারিভাবে প্রতিমন ১শ’৪০ টাকা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। এই ক্রয় কার্যক্রম চলবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রæযারি পর্যন্ত। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বগুড়ায় এবছর ১লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবেই জানা গেছে, এবছর বগুড়ায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে। মিল মালিকদের দাবি, বিরাজিত শৈত্য প্রবাহ কমে আসলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকলে ধানের বাজারদর উর্ধমুখি হবে তখন লাভবান হবে কৃষক।

ময়মনসিংহে ফড়িয়া-মধ্যস্বত্তভোগী

ময়মনসিংহ থেকে মো. শামসুল আলম খান, জানান, ময়মনসিংহ ধানের ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত কৃষকরা। এতে কৃষক পর্যায়ে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সরকারী ধান ক্রয়ে ফায়দা লুটছে স্থানীয় ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্তভোগীরা। কৃষকরা বলছেন সরকারী ভাবে অপ্রতুল পরিমান ধান সংগ্রহ এবং ধান ক্রয় প্রক্রিয়ায় ফড়িয়া-মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণের কারণে ধানের ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ কৃষক অথচ বৃদ্ধি পাচ্ছে চালের ম্যূল্য। চলতি রোপা আমন মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। অথচ এক মন ধান উৎপাদন খরচ বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি।

কৃষকরা আরো জানায়, মৌসুম অনুযায়ী বর্তমানে এক মন ধানের মূল্য হবার কথা এগারো’শ থেকে বারো’শ টাকা। ধান মৌসুমের শুরুর দিকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। কারণ অনেকেই ধার-দেনা করে ধান আবাদ করছেন। এখন দেনা শোধ এবং পরিবারের প্রয়োজনেই তাদের তাৎক্ষণিকভাবে ধান বিক্রি করতে হয়। ফলে ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হচ্ছে কৃষকরা।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ড. মোছা: নাসরিন আক্তার বানু জানান, ময়মনসিংহ জেলায় মোট কৃষক রয়েছে ১০ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৬জন। চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে ধান। এতে ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২৮ হাজার ৭২৮ মেট্রিক টন।

এদিকে ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সরকারী ভাবে ময়মনসিংহ জেলায় ধান ক্রয় করা হবে ২৭ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন। এ হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার কৃষকের কাছ থেকে সরকারী ভাবে ধান সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু ময়মনসিংহ জেলায় মোট কৃষক রয়েছে ১০ লাখের অধিক। ফলে সবার কাছ থেকে সরকারী ভাবে ধান ক্রয় করা সম্ভব নয়।

ধান কৃষকের গলার ফাঁস

দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, এবারও ধানের দামে ধ্বস নেমেছে। ধানের দাম সর্ব নি¤œ পর্যায়ে নেমে আসায় ধান এখন কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাড়িয়েছে। দিনাজপুরে মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মন দরে। যা দিয়ে উৎপাদন খরচই উঠছে। ফলে ধান বিক্রি করে নিজের খরচ যোগানো দূরের আবাদের শুরু থেকে করা ঋন পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই যতক্ষন ধান আছে ততক্ষণ পাওনাদারকে বুঝিয়ে রাখা যাচ্ছে। কিন্তু ধান বিক্রি করলেই পাওনাদারের খড়গ হস্তের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সরকারীভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় কার্যক্রম বাজারে উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে নাই। লটারীর মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করা হলেও অনেক কৃষকই জানেন না কিভাবে কোথায় ধান দিতে হবে। আবার নাম কৃষকের ধান দিচ্ছে নেতা ও ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে খাদ্য বিভাগ এখনও মিলারদের সাথে চুক্তি সম্পাদন না করায় মিলাররা সরকারী গোডাউনে চাল দেয়া শুরু করতে পারেনি। ফলে গোডাউনে ধান চালের স্তুত হলেও বাজারজাতের সমস্যা দেখা দিয়েছে মিলারদের জন্য। সবকিছু মিলে ধানের দাম সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে বলেই সংশ্লিষ্ট মহল মত প্রকাশ করেছে।

দিনাজপুরের বিভিন্ন ধান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা গুটি স্বর্ণা ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ মন (সেরের হিসাবে) দরে। পাশাপাশি চিকন কালাজিরা জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা মন দরে। অধিক উৎপাদনশীল হওয়ায় কৃষকেরা মোটা অর্থাৎ গুটি স্বর্ণা ধানই বেশী আবাদ করে থাকে। এক বিঘা জমিতে গুটি স্বর্ণ ২০ থেকে ২২ মন উৎপাদন হলেও চিকন জাতের কালাজিরা উৎপাদিত হয় ৮ থেকে ৯ মন। এছাড়া চিকন জাতের ধান আবাদে খরচ পড়ে দ্বিগুন। তাই সাধারন কৃষকের কাছে গুটি স্বর্ণ ধান আবাদ জনপ্রিয়। অবশ্য সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চিকন জাতের বিআর-২৮সহ কালাজিরা ধান আবাদে উৎসাহিত করছে কৃষককে। কেননা চিকন জাতের চাল সহজে রফতানিযোগ্য।

দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের দন্ডপানি গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন তার মোট জমি রয়েছে ৯ বিঘা। এর মধ্যে দুই বিঘায় আবাদ করেছেন চিকন জাতের কালাজিরা ধান। বাকি ধান আবাদন করেছেন গুটি স্বর্ণ। তার মতে ৭ বিঘা জমিতে গুটি স্বর্ণ আবাদ করে গড়ে ২২ মন করে ধান পেয়েছেন। ৭ বিঘা জমির ধান বিক্রি করে তিনি পাবেন প্রায় ৯০ হাজার টাকা। হাল, পানি সেচ, সার ও বিষ প্রয়োগ শেষে উৎপাদিত ধান কেটে বাড়িতে এনে মারাই করতে খরচ পড়ে গেছে এক লক্ষের উপর। তবে কালাজিরা ধান মাত্র ২ বিঘাতে আবাদ করেও ২০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেছেন। আগামীতে ধান আবাদ না করে জমি চুক্তি দিয়ে অন্য কোন ব্যবসা করার চিন্তা করছেন কৃষক তোফাজ্জল। এ অবস্থা গ্রামের প্রায় সকল কৃষকের।

আলাপ হলো সদর উপজেলার ফার্মের হাটে কৃষক আমিনউদ্দিনের সাথে। সে বললো কাক ডাকা ভোরে শীতকে উপেক্ষা করে বাজারে ধান এনেছি ৩০ বস্তা। ভটভটি ভাড়া করে ধান এনে বিপাকে পড়েছি। বাড়ীতে ফড়েয়ারা যে দাম বলেছে বাজারে তার চেয়েও কম দাম বলছে। গুটি স্বর্ণ ধান ৩৭ কেজি হিসাবে ৫২৫ টাকা বলছে। এই ধানই বাড়ীতে বলেছিল ৫৫০ টাকা। একটু বেশী পাওয়ার আশায় ভটভটিতে খরচ দিয়ে বাজারে এনে বিপদে পড়েছি। এখন ফেরতে নিয়ে গেলে আবারও ভটভটির খরচ যোগাতে হবে। তবে মনে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশী পাওয়া যাবে যদি বাকিতে ধান দেয়া হয়। এই টাকা পেতেও বেগ পেতে হয় কৃষককে। তাই মনে ২৫ টাকা কম হলেও নগদে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় কৃষক।

এদিকে সরকার এবার অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা দরে ধান ক্রয়ের কার্যক্রম শুরু করে। সারা দেশে কৃষকদের কাছ থেকে মোট ৬ লক্ষ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের ঘোষনা দেয়। এছাড়া মিল মালিকদের কাছ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন সিদ্ধ এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ সংগ্রহ করার কথা ঘোষনা করা হয়। সরকারী ক্রয় মুল্য হিসাবে ৩৭ কেজি অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে পূর্ব নিয়ম মোতাবেক এক মন ধানে দাম পড়ে ৯৬০ টাকার বেশী। কিন্তু বাজারে এই ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মন দরে। দামের এই তারতম্যের কারন হচ্ছে বাজারে ধান ক্রয়ে ক্রেতাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা না থাকা। দিনাজপুরের জেলা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান জানান, জেলায় এবার মোট ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেহেতু লটারীর মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের ত্বত্তাবধানে কৃষক নির্বাচন করা হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টনের বেশী ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। অপরদিকে মিল মালিকদের সাথে খাদ্য বিভাগ এখনও চুক্তি না করায় মিল মালিকেরা এখনও সরকারী গোডাউনে চাল দেয়া শুরু করতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজার থেকে পূর্নদোমে ধানও কিনতে পারছে না মিলাররা। তবে অন্য একটি সুত্র মতে মিলাররা ধান ক্রয় করছে ঠিকই কিন্তু তা সিন্ডিকেট করেই ক্রয় করছে।

চট্টগ্রামে দরপতনে হতাশ

চট্টগ্রমা থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে আমনের ভালো ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। বাজারে ধানের দর পাচ্ছেন না তারা। সরকারিভাবে কৃষক পর্যায়ে ধান, চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলেও তার কোন প্রভাব নেই ধানের বাজারে। প্রান্তিক চাষিদের অভিযোগ, ধান বিক্রি করে চাষের খরচও মিলছে না। এতে হতাশ চাষিরা ধানের আবাদে নিরুৎসাহিত হবেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। চাষীদের অভিযোগ মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে ধানের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে।

এবার চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলায় আমনের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আবাদ এবং ফলনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, ল²ীপুরে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৬২ হাজার ২৯৬ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৭ হেক্টর। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৪২ মেট্রিক টন (চাল)। গতকাল পর্যন্ত পাঁচ জেলায় ৯৪ শতাংশ আমন কাটা শেষ হয়েছে। আর তাতে ফলন পাওয়া গেছে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন। হাইব্রিড, উফশি এবং স্থানীয় তিন জাতের আমনের ফলন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। চাষিরা জানান, বাজারে ধানের দর পড়তি। খাদ্য বিভাগের হিসাবে গতকাল ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ২০ টাকা। বাস্তবে বাজারে প্রতিকেজি ধান ১৪ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারভেদে দামেরও তারতম্য রয়েছে। মীরসরাই সাহেরখালী ইউনিয়ের কৃষক শামসুল হক জানান, প্রতিকেজি ধান ১৩টাকা আর আড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৫০টাকায়। ধানের দরপতনে ক্ষতিরমুখে পড়েছেন জানিয়ে বলেন, ধান বিক্রি করে খচরও আসছে না। গ্রামের কৃষকরা হতাশ বলেও জানান তিনি।

খুলনাঞ্চলের কৃষকরা হতাশ

খুলনা ব্যুরো থেকে আবু হেনা মুক্তি জানান, খুলনাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ফলন ভাল হলেও কৃষক দাম পাচ্ছে না। ভরা মৌসুমে ধানের মণ ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। প্রান্তিক চাষিরা এ মূল্যে ধান বিক্রি করলে আসল টাকাই শুধু ঘরে উঠবে। আবার অনেক বর্গা চাষির মন প্রতি ৫০-১০০ টাকা লোকসান গুনতে হবে। খুলনা এলাকায় এবার কারেন্ট পোকার কারণে ধান তুলনামুলক কম হয়েছে। তার উপর ধানের মুল্য নেই। কৃষি সরঞ্জামাদির মূল্য প্রতিনিয়িত বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে ধান এখন যেন কৃষকের গলার ফাস। তবে দেরি করে চাষ করায় তাঁদের জমিতে এখনো ধান রয়েই গেছে বা মাড়াইয়ের কাজ চলছে। যেসব কৃষকরা মাড়াই শেষে ধান বাজারজাত শুরু করেছেন, তারা পড়েছেন বিপাকে। বাজারে ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।

খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকার কৃষক বিকারুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমি ৪ বিঘা জমিতে এবার ধান চাষ করেছি। ঘূর্ণিঝড়ে ধানের কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হয়। অতপর কারেন্ট পোকার আক্রমন। আর ধান তুলে এখন বিক্রির সময় দাম কম। অথচ সার বীজের দাম ছিল বেশি। ফলে আমার আসল টাকা ঘরে উঠবে না। এরপর নিজের শ্রম তো আছেই। ধান চাষ করে কৃষকদের আর লাভ হয় না। এখন ক্ষতিই হয়। বাজারে ধানের যে দাম, তার চেয়ে চালের দাম প্রায় দ্বিগুন। কিন্তু এটি হওয়ার কথা নয়। ধানের দামের সঙ্গে বাজারে চালের দামের অনেক ফারাক। ফলে ধানের দাম কম হলেও চালের দামের কোনো হেরফের দেখছি না।

কুমিল্লায় লোকসানের আশঙ্কা

কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান, আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এবারে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৪২৭ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৫ হাজার ১২২ মেট্রিকটন। কুমিল্লায় আমন ধান কাটা অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তবে কৃষকদের মধ্যে যাদের নাম তালিকায় নেই তারা ধানের সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছেন।

কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ডিজিটাল ব্যবস্থা ‘কৃষক অ্যাপ’ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যারা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছেন তারা সরকারি দরে ধান বিক্রি করতে পারলেও যাদের নাম লটারিতে আসতে পারেনি তাদেরকে বাজারে লোকসানে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, সরকার ঘোষণা দিয়েছে ধান ২৬ টাকা কেজি কিন্তু ধান বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা কেজি। এতে ধান বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে।

কিশোরগঞ্জ ফলন ভাল দাম নেই

কিশোরগঞ্জ থেকে নাসিম খান জানান, ধানের ব্যাপক আবাদ হয়েছে। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ বা রোগ বালাইয়ের প্রকোপ না থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। কৃষক পরিবারের পাকা ধান তুললেও মনে আনন্দ নেই। কারণ প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো দাম পাচ্ছে না। হতাশ চাষিরা। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। কৃষকরা জানালে হতাশার কথা। তাঁরা বলেন, ধান উৎপাদনে যে খরচ হয়েছে, সেই তুলনায় দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাঁরা লোকসানের আশংকায় রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ধানের দাম না বাড়লে লোকসানের পাল্লা আরো ভারী হবে। সদর উপজেলার কলাপাড়া গ্রামের কৃষক আঃ ছাত্তার বলেন, ধানের আবাদ করে যে খরচ হয়েছে সেই খরচ তুলে আনাটাই কঠিন হয়েছে দাঁড়িয়েছে। করিমগঞ্জ উপজেলার কান্দাইল গ্রামের কৃষক ঝাড়– মিয়া বলেন বর্তমানে কৃষকদের ৬০০-৭০০ টাকা মন ধরে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র জানা গেছে চলতি আমন মৌসুমে কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় আবাদ হয়েছে ৮১ হাজার ২ শত ৫০ হেক্টর জমিতে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লক্ষ ২৫ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন; উৎপাদনব হয়েছে ২ লক্ষ ৫২ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন।

নেত্রকোনায় বঞ্চিত কৃষক

নেত্রকোনা থেকে এ কে এম আব্দুল্লাহ জানান, নেত্রকোনায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পায় তার জন্য সরকার ২০ নভেম্বর থেকে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করার ঘোষনা প্রদান করেন। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য নির্ধারিত সময়ের এক মাস চলে গেলেও নেত্রকোনায় ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে এখনো সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। মঙ্গলবার পর্যন্ত কৃষকদের তালিকাই চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি সংশিষ্ট উপজেলাগুলোর কৃষি বিভাগ।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মওসুমে জেলার ১০টি উপজেলার ১৩টি খাদ্য গুদামে ১৩ হাজার ৫২ মেট্রিক টন আমন ধান সংগ্রহের কথা রয়েছে। এ ছাড়াও ১১ হাজার ৫ শত ৮৯ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও ২ শত ৩১ মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহ করার কথা। গত ২০ নভেম্বর থেকে ধান সংগ্রহের অভিযান শুরুর কথা থাকলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত পূর্বধলা উপজেলায় মাত্র ৪ মেট্রিক টন ও কেন্দুয়া উপজেলায় ১ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হয়েছে। জেলার পূর্বধলা, কেন্দুয়া, বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জ উপজেলায় ধান সংগ্রহ অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলেও কৃষকরা সরাসরি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছে না। তারা স্থানীয় হাট-বাজারে ও মহাজনদের কাছে কম মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।

দুর্গাপুর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামের কৃষক আবুল মিয়া বলেন, এখন কৃষকের কাছে ধান আছে। কিন্তু আর কয়েক দিন পর এই ধান তাদের হাতে থাকবে না। ধান চলে যাবে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের হাতে। কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ী গ্রামের কৃষক মতি মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাথার ঘাঁম পায়ে ফেলে জমি চাষাবাদ করে ধান ফলাই, কিন্তু ধানের ন্যায্য মূল্য পাই না। এখন সরকার লটারীতে কৃষকের ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। একটি গ্রামে দুইশো জন কৃষক থাকলেও লটারিতে মাত্র পাঁচ থেকে দশ জন কৃষক সরকারী নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারে।

দুর্গাপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু বক্কর সিদ্দিক, মদন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইলিয়াস আহম্মেদ ও সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জয়নাল আবেদিন জানান, ‘কৃষি বিভাগ লটারির মাধ্যমে যে দিন চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রস্তুুত করে খাদ্য বিভাগকে হস্তান্তর করলে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় সম্ভব হবে।’ এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, কৃষকদের তালিকা প্রায় শেষের দিকে। দ্রæতই সেই তালিকা খাদ্য বিভাগকে হস্তান্তর করা হবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বলেন, কৃষকের তালিকা চ‚ড়ান্ত না হওয়ায় বেশ কয়েকটি উপজেলায় ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করা যায়নি।

শেরপুরে কৃষকের মুখে নেই হাসি

শেরপুর থেকে মো. মেরাজ উদ্দিন জানান, বন্যায় ক্ষতি হলেও কৃষকরা বসে থাকেনি, নিজ উদ্যোগেই জ্বালা সংগ্রহ করে রুপন করেছিল আমন ধান। লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশী জমিতে করা হয়েছিল আমন ধানের আবাদ। ইতিমধ্যে ধান প্রায় কাটা শেষ। বাম্পার ফলন হয়েছে আমন ধানের। কিন্তু নেই দাম। কম দাম থাকায় কৃষকরা দিশেহারা। চলতি আমন মওসুমের শুরুতেই শেরপুরের ৫২টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার মধ্যে ৪৩টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা পাহাড়ী ঢল ও বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। এতে সবজরি পাশাপাশি আমন ধানের জ্বালারও বেশ ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে সরকারীভাবে কৃষকদের জ্বালার ব্যবস্থা করা না হলেও কৃষকরা নিজেরাই জ্বালার ব্যবস্থা করে আমন ধানের চারা রোপন করে। ফলে এবছর শেরপুরে লক্ষামত্রার চেয়ে ১হাজার হেক্টর বেশী জমিতে আমন ধানের আবাদ করে কৃষক।

চলতি মওসুমে শেরপুর জেলায় ধানের আবাদ করা হয় ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল ২লক্ষ ৫৬ হাজার মেট্রিকটন চাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এবার আমন ধানের আবদও হয় ভাল। ফলে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। ফলনে কৃষক খুশি হলেও দাম নিয়ে হতাশ কৃষক। কৃষকের প্রত্যাশা ছিল সরকার ১ হাজারেরও বেশী টাকা মনে ধান ক্রয় করা শুরু করলে কৃষক ধানের দাম ভাল পাবে। এখন পর্যন্ত শেরপুর জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ধানের মূল্য মোটা ধান ৫শ ৮০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা মন ধরে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতিমন ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ২শ টাকারও বেশী। কৃষকরা জানান, তারা ধানের আবাদ ছেড়ে অন্য লাভজনক ফসল করার পথ খুঁজছেন। শেরপুর সদর উপজেলার হেরুয়া গ্রামের আব্দুল মালেক বলেন, বারবার ধানের দাম না পেয়ে আমাদের খুব খারাপর অবস্থা। আমরা যদি ধানের দাম না পাই, তাইলে আবাদ করে কি করমু। শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আলাহাজ্ব মো: আশরাফুল উদ্দিন জানান, এবার কৃষকরা বাম্পার ফলন পেয়েছে। কিন্তু দামটা কম থাকায় কৃষকের একটু সমস্যা হয়েছে। 
  • কার্টসি - ইনকিলাব/ ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

নীরব ও ধীর আত্মহত্যার দিকে চলেছি আমরা

আমিরুল আলম খান

দেশের মানুষ ভালো নেই মোটেই। এ কথা ঠিক, এখন মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ আগের মাপে নেই। কিন্তু জ্বলেপুড়ে নিকেশ হচ্ছে যে মানুষের দেহখানাই। রোগশোক আদি ব্যাধির কূলকিনারা নেই। যেমন তেমন অসুখ নয়, একেবারে রাজব্যাধি। ক্যানসার এখন হামেশাই ধরা পড়ছে। লিভার অচল, কিডনি বিগড়ে যাচ্ছে অনেকেরই। ফুসফুসে ইনফেকশন, হৃৎপিণ্ড যখন-তখন থেমে যাচ্ছে। মেরুদণ্ড নুয়ে পড়ছে। বদহজম নিত্যসঙ্গী। রোজগারপাতি সব ডাক্তার আর ওষুধের দোকানে ঢেলেও নিস্তার নেই। আট আনার বড়ি আট টাকায়ও মিলছে না। ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, ওসব চলে গেছে ক্লিনিক আর বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্যের গারদে। এত রোগী যে কোথাও তাদের ঠাঁই নেই অবস্থা। তাতে বণিকদের পোয়াবারো।

রোগের এমন বিস্তার নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ। তামাম দুনিয়া বিষাক্ত। মাটি, পানি, বাতাস—সবকিছুই বিষে বিষে জ্বলছে। সে বিষে খালবিল, নদীনালা, সাগর একাকার। গাছ বিষাক্ত, ফল বিষাক্ত। পানি বিষাক্ত, মাছ বিষাক্ত। বিষাক্ত তাবৎ খাদ্যশস্য। মানুষের পেটে ঢুকছে বিষ। অহরহ। সাগরের পানিতে মিশছে বিষ, তা গিয়ে জমা হচ্ছে মেরু বরফে। প্লাস্টিকে সয়লাব সাগর। মাছের পেটে সে প্লাস্টিক। সেখান থেকে মানুষের পেটেও। প্লাস্টিক হজম হয় না, প্লাস্টিক মারাত্মক বিষ। প্লাস্টিক বিষে প্রাণিকুল নীলকণ্ঠ।

পরিবেশ বিপর্যয়ের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম ছয়ের মধ্যে। একে তো ছোট্ট ভূখণ্ড, তার ওপর জনঘনত্বের চাপ দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি এই বাংলাদেশে। উন্নত দেশের তুলনায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান আর আর্থিক সামর্থ্যে সে বহু পিছিয়ে। পিছিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিচর্চায় এবং কর্মদক্ষতায়ও। দুদিন আগে বিশ্বের সর্বোচ্চ বায়ুদূষিত, সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর এক দিন গেল ঢাকা শহরে। এদিকে বাংলাদেশে আগামী ২০৩১ সাল নাগাদ চালু হতে পারে ৩০টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর একবার তা চালু হলে বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে এর নিজস্ব সৃষ্টি এসব কার্বনবোমা। কী বিপুল দূষণ, কী বিপুল অপচয়!

আকাশ ছুঁয়ে উঠছে ইমারত। কংক্রিটের জঙ্গল। সে জঙ্গল বানাতে তৈরি হচ্ছে বিষ। ঠাসাঠাসি মানুষ। তাদের নিশ্বাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বমি সারা দিন। ঘরের মধ্যে উনুন, ঘরের মধ্যে বিষ বানানোর কারখানা। গ্যাসের চুলো, ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিংমেশিন, এয়ারকন আরও কতশত গ্যাজেট। এসব চলে বিদ্যুতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দূষিত হয় পরিবেশ, ব্যবহারেও। যত বেশি বিদ্যুতের ব্যবহার, তত বেশি দূষণ। অথচ গ্যাজেট আর বিদ্যুৎ ছাড়া একালের জীবন অচল। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বিপজ্জনক দুটি পথই অনুসরণ করা হচ্ছে—কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ। দুটিই মারাত্মক ঝুঁকির প্রযুক্তি। তা ছাড়া বাংলাদেশে বসতবাড়ি আর কারখানা একাকার। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকার মধ্যে তফাত নেই কোনো।

তেল পোড়ানো কৃষিযন্ত্র এ দেশে আসতে শুরু করে ১৯৬০-এর দশকে। ইরি চাষের জন্য নদী-বাঁওড়ের পানি তুলতে লো-লিফট পাম্প দিয়ে শুরু। তারপর আসে শ্যালো আর ডিপ টিউবওয়েল। মাটির নিচের পানি তুলে চাষ। তাতে মাটির তলার লোহা আর আর্সেনিক উঠে আসছে। ফসলের খেতে কারখানার সার, কারখানার বিষ। সার গাছের খাদ্য জোগাবে, বিষ মারবে পোকামাকড়। তাতে হবে সবুজবিপ্লব, না-খেয়ে মরবে না মানুষ। সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তা খুব কাজে দিয়েছিল। নইলে, কত কোটি মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মরত, তার হিসাব করা যেত না। সবকিছুই পরিমিত হলে ভালো। কিন্তু শিল্পবিপ্লব পরিমিতি মানে না। শিল্পের চাকা চালু রাখতে চাই বিপুল প্রাকৃতিক কাঁচামাল ও জ্বালানি। প্রকৃতি নিধন করে আসে কাঁচামাল, জ্বালানির সিংহভাগ মাটির তলার কয়লা, তেল, গ্যাস।

একশ্রেণির মানুষের লোভ সীমাহীন। তারা খাদ্য–বাণিজ্যে পেয়ে গেল মহাধনশালী হওয়ার সূত্র। খাদ্য তৈরি হবে বটে, কিন্তু তা হবে বিষাক্ত। তাদের বিত্ত অঢেল। তা দিয়ে দুনিয়ার সেরা বিজ্ঞানীদের কিনে নিতে কোনো অসুবিধা নেই। খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি আর রোগবৃদ্ধির এক নতুন ফর্মুলা নিয়ে তাদের বাণিজ্য। রোগ বাড়লে নিরাময়ের দাওয়াই নিয়ে হাজির তাদের অনেকেই। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য এবার জমজমাট ওষুধের ব্যবসা। সোজা বাংলায়, ‘সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে’।

দুনিয়ার ভুখানাঙ্গা মানুষ সংখ্যায় অধিক। তারাই এদের সহজ শিকার। তাতে লাভের মওকা বেশিই। খাদ্য তো নয়, বিষ। মানুষের লোভের কারখানায় বানানো বিষ। এ এক নয়া ফাঁদ, নয়া ছাদ। এ ছাদে সব ভোগই নারকীয় ধ্বংস ডেকে আনে।

এই খাবার আর বিষের মালিকদের বড়ই পেয়ার করে দুনিয়ার সাফাই গাওয়া মুরুব্বিরা। মনভোলানো বাহারি নাম তাদের। সনদ জারির একচেটিয়া মালিক-মোক্তার তারাই। দুভাবে তারাই সিলমোহর এঁকে দেয় দুবারে। উৎপাদন উল্লম্ফনে বেজায় খুশি তারা। সবুজবিপ্লবের নামে তার মুক্তি ঘটে দুনিয়াজুড়ে। তারপর শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এবার উলটো বয়ান। নির্বিচার সার, কীটনাশক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তত দিনে তা চালান হয়ে যায় গরিব দুনিয়ায়। সেখানেই খাবারের সংকট বেশি। সেসব বিষে গুদাম ভরা হয় গরিব দেশের। তখন উন্নত দেশ থেকে এনে বসানো হয় আস্ত কারখানাটাই। পুরোনো কারখানার ডাম্পিং স্টেশন গরিব দেশগুলো। তাতে খরচ কমে, বাড়ে লাভের অঙ্ক।

বাংলাদেশে এমন কত বিষ বিক্রি হয়? ‘ডার্টি ডজন’ কথাগুলো খুব পরিচিত এ যুগে। এক ডজন জীবনঘাতী বিষের তালিকা সেটি। অল্ড্রিন, ক্লোরোডেন, ডিডিটি, ডাইএল্ড্রিন, এন্ড্রিন, হেপ্টাক্লোর, হেক্সাক্লোরোবেনজিন (এইচসিবি), মাইরেক্স, টোক্সাফেন, পিসিবি, পিডিডি, পিসিডিএফ। এ সবই উন্নত দেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে নানা ব্র্যান্ডের নামে তা চলছেই। এ দেশের দুর্বল শাসনের সুযোগে লোভী ব্যবসায়ীরা তা দেদার বিক্রি করেন, পাহাড়সম মুনাফা লোটেন।

সরকারই এসব বাজারে বিক্রি আর কৃষক ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনিপ্রিয় করেছে বিভিন্ন সময়ে। কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো বা ফরমালিন দিয়ে পচন ঠেকানোর প্রযুক্তি এরাই জনগণকে শিখিয়েছিল। এখন বাজারে গেলেই বিষাক্ত ফল, বিষাক্ত সবজি, বিষাক্ত মাছ-মাংস। তাতে মেশানো হয় কার্বাইড, নয়তো ফরমালিন। খাদ্যে বিষাক্ত রং। গবাদিপশু-পাখি মোটাতাজা করতে নানা স্টেরয়েড, ইউরিয়া খাওয়ানো চলছেই। মোরগ-মুরগির খাবার, কিংবা মাছের খাবার তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত উপাদানে। আর সেসব বিষ মানুষের পেটে গিয়ে সৃষ্টি করছে নানা রকম জটিল রোগব্যাধি।

মানুষের খাবার নিয়ে, রোগব্যাধি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলছে জঘন্য ব্যবসা। জনস্বাস্থ্যের জন্য এ হুমকি মোকাবিলায় জোর তৎপর না হলে মহাবিপদ আসন্ন। সন্তানদের দুধে–ভাতে রাখার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠলেও কিছুই যেন করার নেই। আমাদের লোভ আর অক্ষমতার কাছে বন্দী আমাদের ভবিষ্যৎ। এক ধীর আত্মহত্যার দিকে চলেছে পৃথিবী।

  • আমিরুল আলম খান: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
  • কার্টসি - প্রথম আলো/২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ 

নুরুল হক কেন বারবার মার খান

আলী রীয়াজ


অভিযোগটি গুরুতর এবং উদ্বেগজনক। যিনি এই অভিযোগটি করছেন বা আশঙ্কার কথা বলেছেন, তাঁর পদমর্যাদা বিবেচনা করলে কোনোভাবেই একে হেলাফেলার বিষয় মনে করার কারণ নেই। যে জায়গায় এই ধরনের ঘটনার বিষয় বলা হয়েছে, সেখানে এই ধরনের ঘটনা–দুর্ঘটনার আশঙ্কাও যেকোনো বিবেচনায় একজন নাগরিককে উদ্বিগ্ন ও সক্রিয় করে তোলার কথা। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। উপরন্তু যা ঘটেছে, তা হচ্ছে উল্টো।

আক্রান্তদের দেখতে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুরুলের সঙ্গে তিনি কেবল যে বিতর্কেই জড়িয়ে পড়েছেন তা নয়, তিনি কার্যত আক্রমণকারীদের ভাষায় ‘বহিরাগতদের’ বিষয়েই বেশি উৎসাহী হয়েছেন, যেন আক্রান্তদের দোষারোপ করতেই সেখানে তিনি হাজির হয়েছেন। নুরুলকে কেন ‘এক ঘণ্টা আটকে’ রেখেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি দাবি করেছেন আহত নুরুলের কাছে।

আলী রীয়াজ




এই প্রশ্ন উপাচার্য তাঁর সঙ্গী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানীকে করেননি। প্রক্টরের অফিসের ১০০ গজের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে নির্বাচিত ডাকসু ভিপিকে আটকে রাখার সময় তিনি কী করছিলেন, সেই প্রশ্ন উপাচার্য প্রক্টরকে করেননি। আক্রান্ত ছাত্রদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা ওই সময়ে তিনবার প্রক্টরকে ফোন করেছেন, কিন্তু প্রক্টর আসেননি, উপরন্তু যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের সেখানে যেতে নিষেধ করেছেন। ছাত্রদের এই অভিযোগ মিথ্যা নয়, কেননা উপাচার্যের উপস্থিতিতেই প্রক্টর বলেছেন, ‘তোমাদের নিষেধ করেছি যেতে। তোমরা গেছ কেন?’ নিরুদ্বিগ্ন উপাচার্য মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ষড়যন্ত্র করে দিনেদুপুরে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটতে গিয়েছিল, আর প্রক্টর ১০০ গজ দূরে বসে পৌনে দুই ঘণ্টা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, সেই হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে যাঁরা এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সেখানে না যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই তথ্যগুলো আমাদের বিবেচনায় রাখা জরুরি। কেননা, উপাচার্যের ‘মনে হওয়া’ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। নুরুল তাঁর ওপর উপর্যুপরি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে রোববারের হামলার পরে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে মেরে ফেলারই পরিকল্পনা করছে’ (প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯)।

উপাচার্যের এই ধরনের ‘বোধ হয়’ যে হত্যাকাণ্ড ঘটার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এই বোধোদয় হয় না যে এই জন্য অন্ততপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটা মামলা করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘অভিভাবক’ হিসেবে এই দায়িত্ব তাঁর ওপরে বর্তায়—এ কথা বলা নিরর্থক, কেননা উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত কয়েক বছরে তাঁদের আচরণ দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা এখন আর সেই জায়গায় নেই। তাঁদের কাজ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের রক্ষা করা। তিনি যে এই আনুষ্ঠানিকতাটি পর্যন্ত করতে চাইলেন না, সেটা নিশ্চয় এ ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি যা–ই বলুন না কেন, এই হামলা নিয়ে তিনি আসলে খুব উদ্বিগ্ন নন।

ঘটনার দুই দিন পরে প্রথম মামলাটির বাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়; পুলিশ। মঙ্গলবার শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রইচ উদ্দীন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। পুলিশ বলেছে, ভুক্তভোগীরা এসে মামলা করেন কি না, সে অপেক্ষায় ছিল তারা। কিন্তু কেউ না আসায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। সেই মামলায় সাত-আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন (প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)। কিন্তু এই মামলার আসামিরা কথিত ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ নেতা-কর্মী, তাঁদের কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় হামলা যাঁরা করেছেন, সেই ছাত্রলীগ কর্মীদের বাদ দিয়েই মামলা করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পুলিশের এই মামলার উদ্দেশ্য যতটা না অপরাধীদের আটক করা, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাদের রক্ষা করা।

নুরুল হকের পক্ষে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ ৩৭ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

শুধু পুলিশের মামলাই নয়, ঘটনার পরে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একই সুরে অভিযুক্ত করছেন কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে। হামলার ঘটনাকে ‘বর্বর ও পৈশাচিক’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক (যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯); ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এই হামলা ‘অন্যায় ও গ্রহণযোগ্য নয়। একজন ডাকসুর ভিপির গায়ে হাত তোলা, সমস্ত ছাত্রসমাজের জন্য কলঙ্ক’ (প্রথম আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)। কিন্তু এই নিয়ে ডাকসু ভিপির ওপরে হামলা হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে দুইবার হামলা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ নামে। বাকি পাঁচবার আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নামেই হামলা চালানো হয়েছে। কেবল যে নুরুলই এই হামলার শিকার হয়েছেন, তা–ও নয়, গত কয়েক বছরে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের, ভিন্নমতের মানুষের ওপর মামলা-হামলা-নির্যাতন স্বাভাবিক বলেই ক্ষমতাসীনেরা প্রচার করেছেন, গর্ব করেই বলেছেন।

আজকে একটি ঘটনার মুখে কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে দোষারোপ করার মধ্য দিয়ে আর সব হামলাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাই বরং সুস্পষ্ট। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও উপাচার্য ‘বহিরাগতদের’ নিয়েই ব্যস্ত আছেন। এখন এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ আর ছাত্রলীগ দুটি আলাদা বিষয়। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠা থেকে রোববারের হামলা পর্যন্ত যে ছাত্রলীগের কর্মীরাই এর সদস্য, সেটা সবার জানা। এঁরাই যখন অন্য সময়ে অন্যত্র অন্যদের ওপরে হামলা চালিয়েছে, তাতে বাহবা দেওয়ার লোকের অভাব হয়নি। তাঁদের আচরণকে উসকে দেওয়া, সমর্থন করা, বৈধতা দেওয়ার ঘটনার সূচনা আজকে হয়নি; যাঁরা তা করেন তাঁদের পরিচয় কারোরই অচেনা নয়। ১৭ ডিসেম্বর যখন এঁরাই নুরুলের ওপরে হামলা করেছিল, সেই সময়েও নুরুল ডাকসু ভিপিই ছিলেন। কিন্তু সেই হামলাকে কেন ‘ছাত্রসমাজের জন্য কলঙ্ক’ বলার মতো লোক পাওয়া যায়নি, সেটা নিশ্চয় আমরা প্রশ্ন করতে পারি। হামলাকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নামই এখন বলা হচ্ছে কিন্তু ছাত্রলীগের নাম বলা হচ্ছে না কেন, সেটাও বোঝা দরকার।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ধরনের একটা পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কী করে যুক্ত থাকেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি। এই সংগঠনের একাংশের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য রেখেছেন বলে চোখে পড়েনি।

‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নাম ধারণ করে সংঘটিত এই ন্যক্কারজনক অপরাধ যে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অবমাননাকর, এই নিয়ে অবশ্যই দ্বিমত নেই। দুর্ভাগ্যজনক যে মুক্তিযুদ্ধের নামে এই ধরনের আচরণ কেবল এরাই করেনি, আজকেই তার সূচনা হয়নি। রাজনীতির অঙ্গনে এবং ক্ষমতাসীনদের দ্বারা এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে ও ঘটছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের গোষ্ঠীস্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নকে ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হন না। ২০১৫ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য এবং তাঁর বিরোধীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন করেছেন ও ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যবহার করেছেন, তখন তাঁদের দুই পক্ষের নাম ছিল ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ এবং ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তার চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ (আলী রীয়াজ, ‘আকাশ ভেঙে পড়েনি’, প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। প্রতিবছর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কথাটা যতবার উচ্চারিত হয়, সারা বছর এই নিয়ে স্বাধীন গবেষণায় শিক্ষকেরা তার কত অংশ উৎসাহী? মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিতর্কিত তালিকা প্রকাশের দায়িত্বহীন আচরণে যতটা উৎসাহী, গবেষণায় তার কিয়দংশও নয় (রোজিনা ইসলাম, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় কাজ ও গবেষণা নেই’, প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৯)।

ডাকসু ভিপির ওপরে সর্বশেষ হামলার প্রেক্ষাপটও আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। ১৭ ডিসেম্বর থেকে উপর্যুপরি এই সব হামলার সূত্রপাত হয়েছে; তার কারণ হিসেবে নুরুল হক বলেছেন, ‘১৭ ডিসেম্বর তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিক পঞ্জির প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করেন। ওই দিনই কিছু ঝামেলা হয়। ১৮ ডিসেম্বরও হামলা হয়। এসবের জের ধরে (রোববারের) হামলা হয়েছে’ (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯)। এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম ঘটল, তা নয়, অক্টোবর মাসে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করার পেছনেও ছিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসম চুক্তি বিষয়ে ফেসবুকের পোস্ট। এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সমালোচনা সহ্য করতে অনীহ। বিবিসি জানাচ্ছে যে সর্বশেষ হামলায় অভিযুক্তরা বলেছেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নিয়ে আন্দোলন করার এখতিয়ার নেই ডাকসু ভিপির। তাঁদের এই অবস্থান যে একেবারেই তাঁদের নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার, তা নয়।

রোববারের হামলার ঘটনা বহুমাত্রিক, এর প্রতিক্রিয়া বুঝতে হলে এর বিভিন্ন মাত্রা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

  • আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
  • কার্টসি - প্রথম আলো/২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ 

Brain damage?

From the murder of Zubair to Bishwajit to Abrar – unruly Chhatra League activists have engaged in numerous disgraceful acts and many of them have met consequences. And yet the others are unwilling to learn a lesson. Why?
Ducsu VP is being taken to hospital after a group of Chhatra League activists attack him. Photo: TBS

It was assumed that brutal murder of Buet student Abrar by Chhatra League men would be a fresh wakeup call for unruly leaders and activists of the ruling party's student front.

But just one and a half months down the line the assumption has been proven wrong once again. This time they demonstrated their recklessness on Dhaka University campus on Sunday.

A group of BCL leaders and activists mercilessly beat up DUCSU Vice-President Nurul Haq Nur and two dozen others. They seem to have learnt nothing from consequences of the Abrar murder, let alone from other misdeeds by their fellows in past.   

Those who beat Abrar to death did not learn anything from the fate of Chhatra League president and general secretary who were forced to resign amid allegations of controversial activities just a month prior to that.
Injured students are being taken to hospital. Photo: TBS

For the Abrar murder, 25 Buet students— most of them leaders and activists of Chhatra League -- were accused in the charge sheet submitted by the police.

The accused in the Abrar murder might have forgotten about the consequence of Biswajit killing. A group BCL men hacked tailor Biswajit to death in public in old Dhaka in 2012. Eight activists of the student front were sentenced to death and 13 others to life imprisonment for the murder.

Before the killing of Biswajit, some BCL men tortured and stabbed Zubair Ahmed, a final year student of Jahangirnagar University at the beginning of 2012. He succumbed to death the following day.

Zubair, who himself was a Chhatra League activist, was stabbed by a rival group. The murder stirred protests across the campus. Then-vice chancellor Prof Sharif Enamul Kabir had to resign following protests by students. Five BCL men were sentenced to death by a special tribunal for the murder.

The murder of Biswajit, Zubair and Abrar were not isolated incidents.

Some BCL men have engaged in countless disgraceful acts like extortion, violence, killing and other criminal activities in the last decade, after the Awami League returned to power in early 2009.

Chhatra League men attacks Biswajit in Old Dhaka. Photo: Collected

Their controversial activities have embarrassed the government and the party high command.

Annoyed at their controversial actions, Sheikh Hasina quit as the BCL's organisation chief in April 2009 and directed the law enforcement agencies to take stern action against those involved in criminal activities, extortion and tender manipulation.

But many leaders and activists of the student front are still uncontrollable.

It seems no warning issued by the AL high command is working.

The above examples indicate many Chhatra League men are unable to learn lessons and correct themselves.

But why?

We may look for the answer in the studies conducted by neuroscientists in UK, USA and other countries.

Take first the study conducted by former British Foreign Secretary David Owen, who is also a neuroscientist, and Jonathan Davidson, a professor of psychiatry and behavioral sciences at Duke University.

A decade ago in an article published in British medical journal Brain in February 2009 they focused on mental health of people who exercise power. 

From the left- Abrar, Zubair and Biswajit

The article on the intersection of health and politics titled 'Hubris Syndrome: An Acquired Personality Disorder?' proposed the creation of a psychiatric disorder for leaders who exhibited, among other qualities, "impetuosity, a refusal to listen to or take advice and a particular form of incompetence when impulsivity, recklessness and frequent inattention to detail predominate."

Later, other neuroscientists in USA and UK also conducted researches to shed more light on the impact on brain of people who exercise power. They have come up with the startling claim that power causes brain damage.

In their view, people under the influence of power may act reckless, become more impulsive, less risk-aware and also loss contact with reality.

They term it as Hubris syndrome which "is a disorder of the possession of power."

What Lord Acton said a hundred year ago that 'power corrupts, absolute power corrupts absolutely' is now more understandable after the research findings of the neuroscientists.

Are Chhatra League leaders and activitists who engage in unruly and criminal activities suffering from Hubris syndrome? Has uncontrolled power damaged their brains and made them reckless? Is this the reason they are unable to learn lessons from past misdeeds and to correct themselves?

  • Courtesy- The Business Standard/ DECEMBER 26, 2019

Tuesday, December 24, 2019

মুক্তিযুদ্ধ: চমৎকার এক হাতিয়ার

রুমিন ফারহানা
রুমিন ফারহানা

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর, গত ১৬ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো ‘রাজাকারের তালিকা’–যা ইতোমধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেওয়ায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে মনে হতেই পারে, এই তালিকা নিয়ে কথা বলার তেমন আর কিছু নেই। আমরা জানি, ক্ষমতাসীন দল ২০০৯ সাল থেকে ভোটে এবং ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আছে যে নিয়ামকগুলোর ওপর ভিত্তি করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতাবিরোধীদের বিচার। মজার বিষয় হলো, এই দু’টি বিষয়কে উপজীব্য করে কাজ করতে গেলে যে বিষয়গুলো প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তা হলো– ১) রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তালিকা, ২) মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা, ৩) শহীদদের তালিকা, ৪) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য যুদ্ধাহতের তালিকা, ৫) মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা।

সম্প্রতি ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সারাদেশ যখন প্রতিবাদমুখর, তখন প্রখ্যাত লেখক খুশবন্ত সিংয়ের লেখার একটি অংশ নিজের ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে আলোচনায় এসেছেন সৌরভকন্যা সানা গাঙ্গুলী। খুশবন্ত সিংয়ের বিখ্যাত বই ‘দ্য ইন্ড অব ইন্ডিয়া’র একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি ফ্যাসিস্ট সরকারের একটি দল বা গোষ্ঠীর প্রয়োজন হয়। নিজেদের স্বার্থে তারা ওই দল বা গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে গিয়ে সেগুলোকে অশুভ শক্তিতে পরিণত করে। দুই-একটি দল দিয়ে এটা শুরু হয়। কিন্তু তা কখনোই সেখানে শেষ হয় না। ঘৃণার ওপর নির্ভর করে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে নিজেকে ধরে রাখতে তারা প্রতিনিয়ত ভয় বা দ্বন্দ্বের আবরণ তৈরি করে।’

জানা কথাগুলোই আবার আমাদের সামনে এলো।

ফ্যাসিজমের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে মূল যে লক্ষণগুলোর কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সেগুলো হলো—শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ, যেখানে শাসন ব্যবস্থায় বারবার উঠে আসে দেশাত্মবোধক নীতিকথা, স্লোগান, গান ইত্যাদি; মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিতে অবজ্ঞা, যে কারণে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্যিক সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়; ঘৃণার চাষ—যেখানে দেশাত্মবোধকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে একটি নির্দিষ্ট বিপদের ব্যাপারে ঘৃণা করতে উৎসাহিত করা হয়; চরম পুরুষতান্ত্রিকতা; নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম; জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ; করপোরেট শক্তির সুরক্ষা; চরম ক্রান্তীয়করণ ও দুর্নীতি এবং প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন।

আমি মনে করি, বাংলাদেশে বর্তমানে এই সবক’টি লক্ষণ খুব স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বিশেষ করে গত কয়েক বছর জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়িয়ে যেভাবে জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে, সেটি মেরামতের কাজ আজ  শুরু করলেও কত বছরে শেষ হবে কিংবা আদৌ মেরামতযোগ্য কিনা, সেগুলো বড় প্রশ্ন। লাখো শহীদের রক্ত আর লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের মূল্যে কেনা যে স্বাধীনতা তার ইতিহাস এখন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটা জাতির জন্য এর চেয়ে বড় পরাধীনতা আর কী হতে পারে? ইতিহাস তো কোনও বদ্ধ বিষয় না, এটা নিয়ে গবেষণা হবে, লেখা হবে, মানুষের মধ্যে তর্কবিতর্ক হবে, ন্যারেটিভ-কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি হবে। খোদ ভারতে যেমন গান্ধীকে একজন ‘ঈশ্বর’ বানানোর চেষ্টা আছে, তেমনি আবার একজন ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা আছে। আবার ভারত ভাগের জন্য জিন্নাহকে দায়ী করার প্রচলিত ন্যারেটিভের বিপরীতে নেহরু আর বল্লবভাই প্যাটেলকে দায়ী করার ন্যারেটিভও আছে। এসব প্রচণ্ড বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক তৈরি করে। ভারতীয় সমাজে কিন্তু আইন করে এসব আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ার কোনও চেষ্টা হয় না। অথচ যে জাতি তার দেশের জন্য যুদ্ধ করা মানুষের একটা তালিকা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সঠিকভাবে তৈরি করতে পারে না, কিংবা কে জানে তৈরির ইচ্ছাও রাখে কিনা, যে কারণে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও বদলাতে থাকে, সেক্টর কমান্ডার, বীর উত্তমকেও রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়ে রাজাকার খেতাব পেতে হয়, সেই জাতির ইতিহাসের ভাগ্যে যে দুর্ভোগ আছে, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। 

ইতিহাস নিয়ে এই ‘তাইরে-নাইরে’র মধ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর মহা সাড়ম্বরে ঘোষিত হলো ‘রাজাকারের তালিকা’। সেখানে ৩৮ জন নারী, ৯২ জন হিন্দু এবং বর্তমান সরকারের তালিকাভুক্ত বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে। মজার বিষয় হলো, যে মানবতাবিরোধী বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগে এত শোরগোল এবং যাকে পুঁজি করে সরকারের বিনা ভোটে এই টিকে থাকা, সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের একজনের নামও এই তালিকায় নেই। এটি এই তালিকাকে কেবল প্রশ্নবিদ্ধই করে না বরং সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়। এই তালিকা প্রকাশের মাত্র ১ দিন আগে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ‘সম্প্রীতি, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির বিজয়’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের ভেতরে জামায়াতের লোকও আছে। আওয়ামী লীগে কত রাজাকার আছে। বিপদের সময় এরা ভয়ানকভাবে আসে। রাজাকারদের লিস্ট করার আগে এই রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘... এখনও রাজাকার আছে। অনেক রাজাকার আছে। এখনও আছে। এমনকি আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার আশপাশেও আছে।...তাদের নাম বললে আমার আর ঢাকায় আসা হবে না। তাই আমি নাম বলতে চাই না। এই হচ্ছে অবস্থা।’ এই যদি হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বাদানকারী দলটির  অবস্থা, তাহলে আমাদের মতো আমজনতাদের উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় কী? আর খোদ আওয়ামী লীগের একজন আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু, একজন ট্রাস্টেড অ্যান্ড টেস্টড ফ্রেন্ড, যখন স্পষ্টভাবে বলেন আওয়ামী লীগে রাজাকার আছে, তখন তা অবিশ্বাস করি কী করে?

‘রাজাকারের তালিকা’ প্রকাশের পর যখন তুমুল বিতর্ক চারপাশে, তখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জানালেন তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানালেন, তালিকার সঙ্গে একটি নোট ছিল, যা আমলে নিলে এত বিতর্কের জন্ম হতো না। জানা যায়, অতি গোপনীয় এই নোটে বলা হয়েছিল, তালিকাভুক্ত ১ হাজার ২৫৪টি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নথি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা ১০ হাজার ৭৮৫ জন। তবে তালিকাভুক্ত  ১ হাজার ২৫৪টি নথির মধ্যে ৩৫২টি নথি দালাল আইন সংশ্লিষ্ট না হওয়ায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম-সংবলিত নথির সংখ্যা পাওয়া গেছে ৯০২টি। আর তালিকাভুক্ত ১০ হাজার ৭৮৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ৯৯৬ জন সরকারের সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন বা আবেদন করে আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

রাজাকারের তালিকা নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড কতগুলো অনিবার্য প্রশ্ন তুলে দেয় আমাদের মনে-

১) ৯৯৬ জনের মধ্যে কতজন আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন?

২) যাদের নাম অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাদের নাম কি সে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের তালিকায় আছে? যদি না থাকে তাহলে তো তাদের নাম নিশ্চিতভাবেই অভিযুক্তদের তালিকায় আছে।

৩) আদালত থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের বাদ দিলে যে কয়জন সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন, তারা তো নিশ্চিতভাবে অভিযুক্ত, নয় কি? তাদের সংখ্যা কত?

৪) এই ৯৯৬ বাদে তালিকার বাকি ৯৭৮৯ জন কি তাহলে দালাল আইনে দালাল হিসেবে অভিযুক্ত?

৫) স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যাদের নাম এই দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত, যাদের কয়েকজনের এরমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে ফাঁসি হয়েছে, তাদের নাম এই তালিকায় এলো না কী করে?

৬) যেখানে মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা নিয়ে খুব বড় প্রশ্ন আছে, সেখানে কারো নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে, এটা কারও রাজাকার না হওয়ার পক্ষে কোনও যুক্তি হতে পারে কিনা?

৭) আইনি প্রক্রিয়া শেষ না করে শুধু দালাল আইনে অভিযুক্ত কাউকে ‘রাজাকার’-এর মতো ভয়াবহ অভিযোগ দেওয়া কি আইনগত বা নৈতিকভাবে সঠিক?

অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকায় জন্য যে দলটি মুক্তিযুদ্ধকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, সেই দলটি এর আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করতে গিয়েও নানা রকম প্রতারণাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ঠিক একইভাবে রাজাকারের তালিকা তৈরিতেও এই সরকার শুরুতেই ভীষণ রকম বিতর্কের জন্ম দিলো। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার ঠিক যেভাবে তাদের পছন্দমতো একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে মানুষের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে জাতিকে বিভাজিত করে ক্ষমতায় থাকবার চেষ্টা করে, তার চমৎকার উদাহরণ হলো আওয়ামী সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধ’।

এই সরকার মূলত মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার—তার কোনোটাই ২০ বছরের শাসন আমলে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা প্রতিষ্ঠা করার কথা বাদই দিলাম, যদি সত্যিকার অর্থে ন্যূনতম কোনও শ্রদ্ধাবোধ থাকতো মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, তাহলে অন্তত এই দেশ প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান আছে কিংবা যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করেছে, তাদের নামের তালিকাটুকু তৈরিতে অন্তত কিছুটা মনোযোগী হতো। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে কেবল যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার হাতিয়ার হতো না।

  • লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য
  • কার্টসি - বাংলা ট্রিবিউন/ ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯

ঢাবিতে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় বাড়ছে ছিনতাই

তাওসিফুল ইসলাম/ঢাবি প্রতিনিধি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে স্বাধীন বাংলার সূত্রপাত সেখানেই স্বাধীনভাবে চলাচলের সময় আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ঢাবির মত জায়গায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। যা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ক্যাম্পাসের সুনাম নষ্ট করছে তেমনি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায়ও বিঘ্ন ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জড়িত থাকেন সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। কখনো কখনো শাস্তির আওতায় আসলেও প্রায় ঘটনাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন তারা।

তবে শিক্ষার্থীদের দাবি তারা ঘটনা ঘটার পরে শুধু প্রতিবাদ করতে চাননা, বরং তার আগেই এর প্রতিরোধ চান তারা। ঘটনা ঘটার আগেই এর বিরুদ্ধে সতর্কতা এবং চৌকিদারিত্বমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে রাত আর দিন একই রকম। অনেকে রাতে না ঘুমিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়। টিএসসি, ফুলার রোড, পলাশি, কার্জন হল, মলচত্বর, বটতলা, শহিদ মিনার, স্বাধীনতা চত্বর, জগন্নাথ হলের মোড়, শিববাড়ী, ভিসি চত্বর—এসব আড্ডার জায়গা হিসেবে পরিচিত শিক্ষার্থীদের কাছে। ইদানীং এসব জায়গায় রাতে আড্ডা দিতে আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এমনকি চলাচলের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের জন্য। কারণ, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব স্থানে ছিনতাইয়ের পরিমাণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি ও চারুকলা অনুষদ এলাকায় মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বেড়েছে।

গত এক বছরে এসব জায়গায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩০টিরও বেশি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, সব ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কারণ মামলা করলেও এসবের কোন ফল নেই। বড় ধরণের ছিনতাই হলে সবাই জেনে যায়, তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হলে জানাজানি কম হয়।

এসব অসাধু কার্যকলাপের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়িত বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে ছিনতাইয়ের। হয়েছে মামলাও। অনেককে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তারপরও হলে থেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী। আবার কখনো কখনো দুয়েকজনকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ।

ছিনতাইয়ের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম ও রবিন আহমেদকে শাহবাগ থানা আটক করা হয়। গত ১২ ডিসেম্বর তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাত ১০টায় আটক করা হয়। জানা যায় আজিমপুর এলাকা থেকে ঘুরতে আসা শামস ও শুভ নামে দুই ব্যক্তিকে মারধর করে এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে টাকা উত্তোলন করে তারা। আটকের বিষয়টি স্বীকার করে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান। নাহিদ এবং শুভ মহসিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তারা মহসিন হলের পরিচিত ছাত্রলীগ কর্মী।

গত শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় শহীদ মিনার এলাকায় ক্যামেরা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়রি করেছেন ক্যামেরার মালিক বিশ্বজিৎ সরকার মিল্টন। শহীদ মিনার এলাকায় শুক্রবার সকালে শুটিং করছিলেন তাদের ইউনিট। উক্ত এলাকার শুটিং শেষে স্পট পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় যাবার জন্য শুটিং ইউনিটের ৩ জন রিকশায় রওয়ানা হোন। রওয়ানা হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বাইকে করে দু’জন ছিনতাইকারী রিকশায় থাকা ক্যামেরাম্যানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ক্যামেরাবাহী ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলে যায়।

গত ২৩শে সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের উপর ছাত্রদলের মোবাইল এবং বাইক ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠে। ঢাবি শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিজবুল্লাহ। অভিযোগ রয়েছে, হিজবুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিনতাই চক্রের প্রধান। তার নেতৃত্বাধীন চক্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে ছিনতাই করে বেড়ায়। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের মামলায় পুলিশ তাকে আটক করে।

২০১৯ সালের শুরুতেই পলাশী এলাকায় এক পথচারীর মোবাইল ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র ও হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আমির হামজার বিরুদ্ধে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করে ভুক্তভোগীরা। এ ঘটনায় তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। 

২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ মিনার এলাকায় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের শিক্ষানবিশ টেকনিশিয়ান সাইফুদ্দিন সিফাত ও ‘স্বপ্ন’ সুপারশপের বিপণন কর্মী রিয়জুল ইসলাকে তুলে নিয়ে এসে তাদের পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র ও হল শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আখতারুজ্জামান (তৃতীয় বর্ষ, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ) ও একই হলের ছাত্রলীগ কর্মী রাজিউর রহমানসহ (তৃতীয় বর্ষ, সংগীত বিভাগ) পাঁচ জনের বিরুদ্ধে। 

এছাড়া, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকার বুয়েট হাইস্কুলের পাশে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের এক নারী কর্মীর গাড়ি আটকানোর অভিযোগে বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র ও হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিবের (অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম) বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ভুক্তভোগী ওই নারী।

ফুলার রোড এলাকায় অবস্থিত স্বাধীনতা চত্বরে প্রতাপ আদিত্য নামে একজনকে ছিনতাইকারীরা শরীরে তিনটি স্থানে ছুরিকাঘাত করেছে ছিনতাইকারীরা। তার সুস্থ হতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। এ ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়িত বলে অভিযোগ করেন তিনি। 

ছিনতাইয়ের ঘটনা কমিয়ে আনতে ক্যাম্পাসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় সিসি টিভি ক্যামেরা ও প্রশাসনিক চৌকি বসানোর দাবি জানিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অবস্থান ও ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রশাসন। রাতে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবস্থান কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ছিনতাই বন্ধ হওয়ার মত এখনো প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এলাকায় অহরহ এমন ছিনতাইয়ের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা অভিযোগ করে বলেন, নিজ ক্যাম্পাসে যদি জানমালের নিরাপত্তা না থাকে তাহলে আর কোথায় নিরাপত্তা পাব? সন্ধ্যার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বর ও রাস্তাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে যায়। তারা আরো বলেন, প্রশাসনের গাফলতির জন্য এখনো কোন চৌকিদারিত্বমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আইন শৃঙ্খলা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ১১৩টি সিসি ক্যামেরা আমরা লাগিয়েছি। কিছু ক্যামেরা অকার্যকর হলেও বাকিগুলো কাজ করছে। ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আসছে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। যেহেতু ক্যাম্পাস উন্মুক্ত এখানে ক্যাম্পাসের বা বহিরাগত অনেকেই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রক্টরিয়াল টিমের কারণে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে এখন। তিনি আরো বলেন, এরকম অসাধু কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের তালিকা আমাকে শিক্ষার্থীরা দিলে আমরা ব্যবস্থা নিব।

কার্টসি - The Daily Campus / dec 24, 2019 
https://bit.ly/34OPxwU