আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারের ধান ক্রয়
ধানই কৃষকের জীবন। দেশের প্রায় সব কৃষক ধান চাষ করেন। পেঁয়াজ-মরিচসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করেন হাতেগোনা কিছু কৃষক। পেঁয়াজদের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে যখন তোলপাড়; তখন ধানের দাম নিয়ে কৃষকরা চরম হতাশ। ‘কৃষকের অ্যাপ’ নামে ‘ডিজিটাল পদ্ধতি’তে লটারি করে ধান সংগ্রহের সরকারের প্রচারণা মিডিয়ায়। মধ্যসত্ত¡ভোগী ঠেকাতে ‘মনিটরিং কমিটি’ গঠণের ঘোষণা। সবই ফাপা বেলুন। প্রতিমণ ১০৪০ টাকা (প্রতি কেজি ২৬) দরে কৃষককের কাছ থেকে ২৬ লাখ টন ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়ে সরকার নীরব। ধান বিক্রি করতে না পেরে চোখের পানি ফেলছে লাখ লাখ কৃষক। আড়াই থেকে তিন কেজি পেঁয়াজের দামে একমণ ধান বিক্রি করতে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন।
দেশের এলাকা ভেদে অনুক‚ল আবহাওয়ায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে ১৮ থেকে ২২ মণ ধান পেয়েছেন কৃষকরা। অথচ ন্যায্যম‚ল্য নেই। লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করা হচ্ছে। ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েও কৃষকের কাছ থেকে ধান নেয়া হচ্ছে না। সিডিন্ডকেটের মাধ্যমে ফড়িয়াদের কাছ থেকে ক্রয়ের লক্ষ্যে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে বিলম্ব হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ফেলে ৪৯১টি উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬টি উপজেলায় সরকার ধান ক্রয় শুরু হয়েছে। ইনকিলাবের প্রতিনিধিরা জানান, সারাদেশের বাজারগুলোতে প্রকার ভেদে ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা মণ দরে। যদিও সার, বীজ, সেচসহ বিঘা প্রতি ধান আবাদে কৃষকের খরচ হয়েছে ১১ থেকে ১৩ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি লোকসান গুণতে হচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ধান মাড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে ক্ষোভ-হতাশা কৃষকের চোখে-মুখে। ধানের ন্যায্য দাম পেতে সরকারের দিকে তাকিয়ে কৃষকরা। তারা বলছেন, সরকার ধান ক্রয় করলে কিছুটা লাভের মুখ দেখতেন। কিন্তু গত বছরের চেয়ে কম দামে লোকসানেই বিক্রি করতে হচ্ছে ধান। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার উৎপাদন বেশি হওয়ায় দেশের অনেক অঞ্চলের কৃষক ধানের দরপতনের আশঙ্কা করছেন। ইনকিলাবের ব্যুরো, আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা প্রতিনিধিরা সারাদেশের ধানের বাজার ও কৃষকদের খোঁজ খবর নিয়ে এই প্রতিবেদন লিখেছেন।
কৃষকের মন ভাল নেই যশোরে
যশোর ব্যুরো থেকে বিশেষ প্রতিনিধি মিজানুর রহমান তোতা জানান, বৈরী আবহাওয়া ও নানা সমস্যা মোকাবেলা করে অনেক কষ্টে উৎপাদন করা রোপা আমন ধানের মূল্য না পেয়ে ঘরে ঘরে কৃষকরা হাহাকার করছেন। তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে কৃষক পরিবারের মাঝে। সরকারের ক্রয় পদ্ধতি সাধারণ কৃষকদের কোন উপকারে আসেনি। প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে বড়জোর ৬শ’টাকা। মাঠচিত্র হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার জের টানতে হচ্ছে কৃষকদের। কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন আবার ভোক্তারাও চালের মূল্য কম পাচ্ছেন না। মাঝখানে লাভের অংশ যাচ্ছে কাদের পেটে-এসব বিষয় যাদের দেখভাল করার দায়িত্ব, তাদের নীরবতা এবং ‘দেখা যাক, দেখছি, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’-এমন বক্তব্যের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকায় মজুদদার, পাইকারী ব্যবসায়ী ও মিলারদের ফি-স্টাইলে কাজকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে। যশোর সদর উপজেলার ডাকাতিয়া গ্রামের আব্দুল মান্নান বললেন, ‘আমি কয়েকদফা ধান হাটে তুলে দাম না পেয়ে বিক্রি করিনি। তবে বাধ্য হয়ে মাত্র ৬শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি। মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ড, আখতারুজ্জামান জানান, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে দারুণ অসন্তোষ। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের মতে, জরুরিভাবে কৃষকদের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দরকার। তার কথা, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবেই কৃষক শুধু ধান নয়, সব কৃষিপণ্যের মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ লিয়াকত আলী জানান, জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে লটারীর মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ৬শ’ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হয়েছে। সদর উপজেলায় এখনো শুরু হয়নি। পাইলট প্রোগ্রামে লটারীর মাধ্যমে ধান ক্রয় শুরু হবে বৃহস্পতিবার থেকে। চাল ক্রয়ও এখনো শুরু হয়নি। শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের কৃষক জসিম উদ্দীন বললেন, লটারীর মাধ্যমে সাধারণ কৃষকরা সরকারী মূল্যে ধান বিক্রি করার সুযোগ পায়নি। হাটবাজারে আড়তদার, পাইকারী ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরদের দাপট চলছেই। তারা নানাভাবে সহজ সরল কৃষকের কাছ থেকে কম মূল্যে ধান ক্রয়ের ফন্দিফিকির আঁটে। এবারও তার ব্যতয় ঘটেনি।
বাম্পার ফলনেও হাসি নেই
রাজশাহী ব্যুরো থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, রাজশাহী অঞ্চলে এবারো আমনের ভাল ফলন হয়েছে। ধান কাটাই মাড়াইও প্রায় শেষ। চারিদিকে নতুন ধানে মৌ মৌ করা গন্ধ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী উৎপাদন হয়েছে। তারপরও হাসি নেই আবাদকারীদের মুখে। কারন ঘাম ঝরানো ঋনের ফাঁসে আটকানো স্বপ্নের সোনালী ফসলের কাংখিত দাম নেই। য্ াদাম চলছে তাতে হতাশ। সরকারের কাছে ধান নিয়ে যেতে পারছেনা প্রান্তিক কৃষক। সর্বত্র ফড়িয়া দালাল, মিলার আর রাজনৈতিক দুবৃত্ত। বরাবরের মত এদের হাতে বন্দী ধানের বাজার।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবার রাজশাহী অঞ্চলে রাজশাহী, নওগা, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জে এবার ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিনলাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে নয়লাখ সত্তর হাজার মে:টন ধান। বাস্তবে সব জেলায় আবাদ বেশী হওয়ায় (চার) জেলায় বারোলাখ সত্তর হাজার মে:টন ধান উৎপন্ন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিনলাখ মে:টন ধান বেশী হয়েছে।
ধান উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে খ্যাত নওগা জেলায় সবচেয়ে বেশী ধান উৎপাদন হয়েছে একলাখ ৯৭ হাজার মে.টন। রাজশাহী জেলায় ৭৬ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে তিনলাখ ৮৮ হাজার মে.টন ধান উৎপাদন হয়েছে। নাটোর জেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ হাজার ৮৫৬ হেক্টর জমিতে। বাস্তবে আবাদ হয় ৬৯ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে। ধান উৎপাদন হয়েছে তিনলাখ ৩৪ হাজার ৩৭০ মে.টন। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৫২ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে দুইলাখ ৪০ হাজার মে:টন ধান উৎপাদন হয়েছে। মাঠের হিসাব বলছে প্রত্যেক জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ ও উৎপাদন দুটোই বেশী হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় ফলন বাম্পার। এই বেশী ফলন যেন কাল হয়েছে আবাদকারীদের। ধানের দাম নেই। সর্বত্র সিন্ডিকেট বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে মনপ্রতি ছয়শো হতে সাতশো টাকার মধ্যে। যাতে উৎপাদন খরচ উঠছে না।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক মকবুল জানান, একবিঘা জমিতে ধান আবাদ করতে হালচাষ, বীজ সার, সেচ, কীটনাশক, মজুরী, ঝাড়াই, মাড়াই করতে খরচ পড়ছে আট থেকে দশ হাজার টাকার মত। বিঘাপ্রতি ফলন হচ্ছে চৌদ্দ থেকে ষোল মন। ফলে বর্তমান দামে বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে পাঁচ ছয় হাজার টাকা। এমনি অভিযোগ প্রায় সব এলাকার কৃষকের।
রাজশাহী জেলায় ধান উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫০ মে:টন। সেই ধান সরকারী ক্রয় কেন্দ্রে কৃষকেরা ধান বিক্রি করার জো নেই। ধানে চিটা আদ্রতা নানা অভিযোগ তুলে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে কৃষকের কাছে কার্ড দেওয়া হলেও তা কিনে নিচেছ বিশেষ সিন্ডিকেট। ফলে সরকারের ভাল উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেনা কৃষক। কৃষকরা বলছেন সরকারী ক্রয়মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকা। বাজারে মনপ্রতি আট নয়শো টাকা পেলেও তাদের লোকসান ঠেকানো যেত।
চারিদিকে শুধু ধান আর ধান। এত ধান নিয়ে ফড়িয়া মিলার সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে কত কম দামে ধান কিনে নেয়া যায়। তারা মোবাইলে মোবাইলে হাটের ধানের দাম নিয়ন্ত্রন করছে। এরাই কম দামে ধান কিনে সরকারী খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছে। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে সরকারের ধান চাল কেনার উদ্যোগ এদের হাতে জিম্মী। বিগত বোরো আবাদের লোকসান কাটাতে এবার বেশী জমিতে আবাদ করে লোকসান পোষানোতো দূরে থাক উল্টো লোকসানের ফাঁস আরো আঁটো সাঁটো হলো। মোট উৎপাদনের দেড় দু’শতাংশ ধান সরকার কিনছে। বাকী ধান নিয়ে হাটে মাঠে ফড়িয়া মিলাররা খেলছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন ধানের উৎপাদন ভাল হলেও সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনার কারনে কৃষক নায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রমাগত লোকসান হলে কৃষক ধান আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আমন ধান মানে নবান্নের উৎসব। ঘরে ঘরে পিঠা পায়েসের আয়োজন। এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছেনা।
বগুড়ায় দরপতন
বগুড়া ব্যুরো থেকে মোহসিন রাজু জানান, আমন মওশুমের কাটা মাড়্ইায়ের কাজ শেষ হওয়ায় বগুড়ায় হাট বাজার গুলোতে ধানের সরবরাহ প্রচুর। ক্রেতার অভাবে সময়মত ধান বিক্রি না হওয়ায় দাম পড়তির দিকে। চলতি সপ্তাহে বগুড়ার বৃহত্তম ধানের বাজার নন্দীগ্রাম, কাহালু এবং দুপচাঁচিয়ায় মান ভেদে আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৬শ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত। উৎপাদক চাষীরা এই দামে সন্তষ্ট নন। তারা জানিয়েছে, মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে ধানের এই দরপতন। চাষীরা আরো বলেছে, চারা (বিচন) ক্রয়, জমিচাষ,নিড়ানী এবং সব শেষে কাটা মাড়াইয়ের খরচ হিসাব করলে প্রতিমন ধান উৎপাদনের খরচ পড়েছে, কোন এলাকায় ৮শ’ কোন এলাকায় ৯শ’ টাকা। এর ফলে এখন যে বাজার দর তাতে উৎপাদক চাষীদের প্রতিমন ধান বিক্রি করে লস হবে দেড়শ’ দু’শ টাকা ।
বগুড়ার খাদ্য বিভাগে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ১ ডিসেম্বর থেকে সরকারিভাবে প্রতিমন ১শ’৪০ টাকা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। এই ক্রয় কার্যক্রম চলবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রæযারি পর্যন্ত। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বগুড়ায় এবছর ১লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবেই জানা গেছে, এবছর বগুড়ায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে। মিল মালিকদের দাবি, বিরাজিত শৈত্য প্রবাহ কমে আসলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকলে ধানের বাজারদর উর্ধমুখি হবে তখন লাভবান হবে কৃষক।
ময়মনসিংহে ফড়িয়া-মধ্যস্বত্তভোগী
ময়মনসিংহ থেকে মো. শামসুল আলম খান, জানান, ময়মনসিংহ ধানের ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত কৃষকরা। এতে কৃষক পর্যায়ে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সরকারী ধান ক্রয়ে ফায়দা লুটছে স্থানীয় ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্তভোগীরা। কৃষকরা বলছেন সরকারী ভাবে অপ্রতুল পরিমান ধান সংগ্রহ এবং ধান ক্রয় প্রক্রিয়ায় ফড়িয়া-মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণের কারণে ধানের ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ কৃষক অথচ বৃদ্ধি পাচ্ছে চালের ম্যূল্য। চলতি রোপা আমন মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। অথচ এক মন ধান উৎপাদন খরচ বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি।
কৃষকরা আরো জানায়, মৌসুম অনুযায়ী বর্তমানে এক মন ধানের মূল্য হবার কথা এগারো’শ থেকে বারো’শ টাকা। ধান মৌসুমের শুরুর দিকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। কারণ অনেকেই ধার-দেনা করে ধান আবাদ করছেন। এখন দেনা শোধ এবং পরিবারের প্রয়োজনেই তাদের তাৎক্ষণিকভাবে ধান বিক্রি করতে হয়। ফলে ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হচ্ছে কৃষকরা।
ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ড. মোছা: নাসরিন আক্তার বানু জানান, ময়মনসিংহ জেলায় মোট কৃষক রয়েছে ১০ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৬জন। চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে ধান। এতে ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২৮ হাজার ৭২৮ মেট্রিক টন।
এদিকে ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সরকারী ভাবে ময়মনসিংহ জেলায় ধান ক্রয় করা হবে ২৭ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন। এ হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার কৃষকের কাছ থেকে সরকারী ভাবে ধান সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু ময়মনসিংহ জেলায় মোট কৃষক রয়েছে ১০ লাখের অধিক। ফলে সবার কাছ থেকে সরকারী ভাবে ধান ক্রয় করা সম্ভব নয়।
ধান কৃষকের গলার ফাঁস
দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, এবারও ধানের দামে ধ্বস নেমেছে। ধানের দাম সর্ব নি¤œ পর্যায়ে নেমে আসায় ধান এখন কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাড়িয়েছে। দিনাজপুরে মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মন দরে। যা দিয়ে উৎপাদন খরচই উঠছে। ফলে ধান বিক্রি করে নিজের খরচ যোগানো দূরের আবাদের শুরু থেকে করা ঋন পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই যতক্ষন ধান আছে ততক্ষণ পাওনাদারকে বুঝিয়ে রাখা যাচ্ছে। কিন্তু ধান বিক্রি করলেই পাওনাদারের খড়গ হস্তের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সরকারীভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় কার্যক্রম বাজারে উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে নাই। লটারীর মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করা হলেও অনেক কৃষকই জানেন না কিভাবে কোথায় ধান দিতে হবে। আবার নাম কৃষকের ধান দিচ্ছে নেতা ও ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে খাদ্য বিভাগ এখনও মিলারদের সাথে চুক্তি সম্পাদন না করায় মিলাররা সরকারী গোডাউনে চাল দেয়া শুরু করতে পারেনি। ফলে গোডাউনে ধান চালের স্তুত হলেও বাজারজাতের সমস্যা দেখা দিয়েছে মিলারদের জন্য। সবকিছু মিলে ধানের দাম সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে বলেই সংশ্লিষ্ট মহল মত প্রকাশ করেছে।
দিনাজপুরের বিভিন্ন ধান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা গুটি স্বর্ণা ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ মন (সেরের হিসাবে) দরে। পাশাপাশি চিকন কালাজিরা জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা মন দরে। অধিক উৎপাদনশীল হওয়ায় কৃষকেরা মোটা অর্থাৎ গুটি স্বর্ণা ধানই বেশী আবাদ করে থাকে। এক বিঘা জমিতে গুটি স্বর্ণ ২০ থেকে ২২ মন উৎপাদন হলেও চিকন জাতের কালাজিরা উৎপাদিত হয় ৮ থেকে ৯ মন। এছাড়া চিকন জাতের ধান আবাদে খরচ পড়ে দ্বিগুন। তাই সাধারন কৃষকের কাছে গুটি স্বর্ণ ধান আবাদ জনপ্রিয়। অবশ্য সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চিকন জাতের বিআর-২৮সহ কালাজিরা ধান আবাদে উৎসাহিত করছে কৃষককে। কেননা চিকন জাতের চাল সহজে রফতানিযোগ্য।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের দন্ডপানি গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন তার মোট জমি রয়েছে ৯ বিঘা। এর মধ্যে দুই বিঘায় আবাদ করেছেন চিকন জাতের কালাজিরা ধান। বাকি ধান আবাদন করেছেন গুটি স্বর্ণ। তার মতে ৭ বিঘা জমিতে গুটি স্বর্ণ আবাদ করে গড়ে ২২ মন করে ধান পেয়েছেন। ৭ বিঘা জমির ধান বিক্রি করে তিনি পাবেন প্রায় ৯০ হাজার টাকা। হাল, পানি সেচ, সার ও বিষ প্রয়োগ শেষে উৎপাদিত ধান কেটে বাড়িতে এনে মারাই করতে খরচ পড়ে গেছে এক লক্ষের উপর। তবে কালাজিরা ধান মাত্র ২ বিঘাতে আবাদ করেও ২০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেছেন। আগামীতে ধান আবাদ না করে জমি চুক্তি দিয়ে অন্য কোন ব্যবসা করার চিন্তা করছেন কৃষক তোফাজ্জল। এ অবস্থা গ্রামের প্রায় সকল কৃষকের।
আলাপ হলো সদর উপজেলার ফার্মের হাটে কৃষক আমিনউদ্দিনের সাথে। সে বললো কাক ডাকা ভোরে শীতকে উপেক্ষা করে বাজারে ধান এনেছি ৩০ বস্তা। ভটভটি ভাড়া করে ধান এনে বিপাকে পড়েছি। বাড়ীতে ফড়েয়ারা যে দাম বলেছে বাজারে তার চেয়েও কম দাম বলছে। গুটি স্বর্ণ ধান ৩৭ কেজি হিসাবে ৫২৫ টাকা বলছে। এই ধানই বাড়ীতে বলেছিল ৫৫০ টাকা। একটু বেশী পাওয়ার আশায় ভটভটিতে খরচ দিয়ে বাজারে এনে বিপদে পড়েছি। এখন ফেরতে নিয়ে গেলে আবারও ভটভটির খরচ যোগাতে হবে। তবে মনে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশী পাওয়া যাবে যদি বাকিতে ধান দেয়া হয়। এই টাকা পেতেও বেগ পেতে হয় কৃষককে। তাই মনে ২৫ টাকা কম হলেও নগদে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় কৃষক।
এদিকে সরকার এবার অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা দরে ধান ক্রয়ের কার্যক্রম শুরু করে। সারা দেশে কৃষকদের কাছ থেকে মোট ৬ লক্ষ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের ঘোষনা দেয়। এছাড়া মিল মালিকদের কাছ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন সিদ্ধ এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ সংগ্রহ করার কথা ঘোষনা করা হয়। সরকারী ক্রয় মুল্য হিসাবে ৩৭ কেজি অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে পূর্ব নিয়ম মোতাবেক এক মন ধানে দাম পড়ে ৯৬০ টাকার বেশী। কিন্তু বাজারে এই ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মন দরে। দামের এই তারতম্যের কারন হচ্ছে বাজারে ধান ক্রয়ে ক্রেতাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা না থাকা। দিনাজপুরের জেলা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান জানান, জেলায় এবার মোট ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেহেতু লটারীর মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের ত্বত্তাবধানে কৃষক নির্বাচন করা হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টনের বেশী ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। অপরদিকে মিল মালিকদের সাথে খাদ্য বিভাগ এখনও চুক্তি না করায় মিল মালিকেরা এখনও সরকারী গোডাউনে চাল দেয়া শুরু করতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজার থেকে পূর্নদোমে ধানও কিনতে পারছে না মিলাররা। তবে অন্য একটি সুত্র মতে মিলাররা ধান ক্রয় করছে ঠিকই কিন্তু তা সিন্ডিকেট করেই ক্রয় করছে।
চট্টগ্রামে দরপতনে হতাশ
চট্টগ্রমা থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে আমনের ভালো ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। বাজারে ধানের দর পাচ্ছেন না তারা। সরকারিভাবে কৃষক পর্যায়ে ধান, চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলেও তার কোন প্রভাব নেই ধানের বাজারে। প্রান্তিক চাষিদের অভিযোগ, ধান বিক্রি করে চাষের খরচও মিলছে না। এতে হতাশ চাষিরা ধানের আবাদে নিরুৎসাহিত হবেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। চাষীদের অভিযোগ মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে ধানের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে।
এবার চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলায় আমনের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আবাদ এবং ফলনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, ল²ীপুরে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৬২ হাজার ২৯৬ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৭ হেক্টর। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৪২ মেট্রিক টন (চাল)। গতকাল পর্যন্ত পাঁচ জেলায় ৯৪ শতাংশ আমন কাটা শেষ হয়েছে। আর তাতে ফলন পাওয়া গেছে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন। হাইব্রিড, উফশি এবং স্থানীয় তিন জাতের আমনের ফলন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। চাষিরা জানান, বাজারে ধানের দর পড়তি। খাদ্য বিভাগের হিসাবে গতকাল ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ২০ টাকা। বাস্তবে বাজারে প্রতিকেজি ধান ১৪ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারভেদে দামেরও তারতম্য রয়েছে। মীরসরাই সাহেরখালী ইউনিয়ের কৃষক শামসুল হক জানান, প্রতিকেজি ধান ১৩টাকা আর আড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৫০টাকায়। ধানের দরপতনে ক্ষতিরমুখে পড়েছেন জানিয়ে বলেন, ধান বিক্রি করে খচরও আসছে না। গ্রামের কৃষকরা হতাশ বলেও জানান তিনি।
খুলনাঞ্চলের কৃষকরা হতাশ
খুলনা ব্যুরো থেকে আবু হেনা মুক্তি জানান, খুলনাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ফলন ভাল হলেও কৃষক দাম পাচ্ছে না। ভরা মৌসুমে ধানের মণ ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। প্রান্তিক চাষিরা এ মূল্যে ধান বিক্রি করলে আসল টাকাই শুধু ঘরে উঠবে। আবার অনেক বর্গা চাষির মন প্রতি ৫০-১০০ টাকা লোকসান গুনতে হবে। খুলনা এলাকায় এবার কারেন্ট পোকার কারণে ধান তুলনামুলক কম হয়েছে। তার উপর ধানের মুল্য নেই। কৃষি সরঞ্জামাদির মূল্য প্রতিনিয়িত বেড়েই চলেছে। সব মিলিয়ে ধান এখন যেন কৃষকের গলার ফাস। তবে দেরি করে চাষ করায় তাঁদের জমিতে এখনো ধান রয়েই গেছে বা মাড়াইয়ের কাজ চলছে। যেসব কৃষকরা মাড়াই শেষে ধান বাজারজাত শুরু করেছেন, তারা পড়েছেন বিপাকে। বাজারে ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।
খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকার কৃষক বিকারুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমি ৪ বিঘা জমিতে এবার ধান চাষ করেছি। ঘূর্ণিঝড়ে ধানের কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হয়। অতপর কারেন্ট পোকার আক্রমন। আর ধান তুলে এখন বিক্রির সময় দাম কম। অথচ সার বীজের দাম ছিল বেশি। ফলে আমার আসল টাকা ঘরে উঠবে না। এরপর নিজের শ্রম তো আছেই। ধান চাষ করে কৃষকদের আর লাভ হয় না। এখন ক্ষতিই হয়। বাজারে ধানের যে দাম, তার চেয়ে চালের দাম প্রায় দ্বিগুন। কিন্তু এটি হওয়ার কথা নয়। ধানের দামের সঙ্গে বাজারে চালের দামের অনেক ফারাক। ফলে ধানের দাম কম হলেও চালের দামের কোনো হেরফের দেখছি না।
কুমিল্লায় লোকসানের আশঙ্কা
কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান, আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এবারে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৪২৭ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৫ হাজার ১২২ মেট্রিকটন। কুমিল্লায় আমন ধান কাটা অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তবে কৃষকদের মধ্যে যাদের নাম তালিকায় নেই তারা ধানের সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছেন।
কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ডিজিটাল ব্যবস্থা ‘কৃষক অ্যাপ’ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যারা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছেন তারা সরকারি দরে ধান বিক্রি করতে পারলেও যাদের নাম লটারিতে আসতে পারেনি তাদেরকে বাজারে লোকসানে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, সরকার ঘোষণা দিয়েছে ধান ২৬ টাকা কেজি কিন্তু ধান বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা কেজি। এতে ধান বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ ফলন ভাল দাম নেই
কিশোরগঞ্জ থেকে নাসিম খান জানান, ধানের ব্যাপক আবাদ হয়েছে। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ বা রোগ বালাইয়ের প্রকোপ না থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। কৃষক পরিবারের পাকা ধান তুললেও মনে আনন্দ নেই। কারণ প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো দাম পাচ্ছে না। হতাশ চাষিরা। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। কৃষকরা জানালে হতাশার কথা। তাঁরা বলেন, ধান উৎপাদনে যে খরচ হয়েছে, সেই তুলনায় দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাঁরা লোকসানের আশংকায় রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ধানের দাম না বাড়লে লোকসানের পাল্লা আরো ভারী হবে। সদর উপজেলার কলাপাড়া গ্রামের কৃষক আঃ ছাত্তার বলেন, ধানের আবাদ করে যে খরচ হয়েছে সেই খরচ তুলে আনাটাই কঠিন হয়েছে দাঁড়িয়েছে। করিমগঞ্জ উপজেলার কান্দাইল গ্রামের কৃষক ঝাড়– মিয়া বলেন বর্তমানে কৃষকদের ৬০০-৭০০ টাকা মন ধরে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র জানা গেছে চলতি আমন মৌসুমে কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় আবাদ হয়েছে ৮১ হাজার ২ শত ৫০ হেক্টর জমিতে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লক্ষ ২৫ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন; উৎপাদনব হয়েছে ২ লক্ষ ৫২ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন।
নেত্রকোনায় বঞ্চিত কৃষক
নেত্রকোনা থেকে এ কে এম আব্দুল্লাহ জানান, নেত্রকোনায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পায় তার জন্য সরকার ২০ নভেম্বর থেকে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করার ঘোষনা প্রদান করেন। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য নির্ধারিত সময়ের এক মাস চলে গেলেও নেত্রকোনায় ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে এখনো সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। মঙ্গলবার পর্যন্ত কৃষকদের তালিকাই চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি সংশিষ্ট উপজেলাগুলোর কৃষি বিভাগ।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মওসুমে জেলার ১০টি উপজেলার ১৩টি খাদ্য গুদামে ১৩ হাজার ৫২ মেট্রিক টন আমন ধান সংগ্রহের কথা রয়েছে। এ ছাড়াও ১১ হাজার ৫ শত ৮৯ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও ২ শত ৩১ মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহ করার কথা। গত ২০ নভেম্বর থেকে ধান সংগ্রহের অভিযান শুরুর কথা থাকলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত পূর্বধলা উপজেলায় মাত্র ৪ মেট্রিক টন ও কেন্দুয়া উপজেলায় ১ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হয়েছে। জেলার পূর্বধলা, কেন্দুয়া, বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জ উপজেলায় ধান সংগ্রহ অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলেও কৃষকরা সরাসরি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছে না। তারা স্থানীয় হাট-বাজারে ও মহাজনদের কাছে কম মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
দুর্গাপুর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামের কৃষক আবুল মিয়া বলেন, এখন কৃষকের কাছে ধান আছে। কিন্তু আর কয়েক দিন পর এই ধান তাদের হাতে থাকবে না। ধান চলে যাবে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের হাতে। কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ী গ্রামের কৃষক মতি মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাথার ঘাঁম পায়ে ফেলে জমি চাষাবাদ করে ধান ফলাই, কিন্তু ধানের ন্যায্য মূল্য পাই না। এখন সরকার লটারীতে কৃষকের ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। একটি গ্রামে দুইশো জন কৃষক থাকলেও লটারিতে মাত্র পাঁচ থেকে দশ জন কৃষক সরকারী নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারে।
দুর্গাপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু বক্কর সিদ্দিক, মদন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইলিয়াস আহম্মেদ ও সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জয়নাল আবেদিন জানান, ‘কৃষি বিভাগ লটারির মাধ্যমে যে দিন চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রস্তুুত করে খাদ্য বিভাগকে হস্তান্তর করলে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় সম্ভব হবে।’ এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, কৃষকদের তালিকা প্রায় শেষের দিকে। দ্রæতই সেই তালিকা খাদ্য বিভাগকে হস্তান্তর করা হবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বলেন, কৃষকের তালিকা চ‚ড়ান্ত না হওয়ায় বেশ কয়েকটি উপজেলায় ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করা যায়নি।
শেরপুরে কৃষকের মুখে নেই হাসি
শেরপুর থেকে মো. মেরাজ উদ্দিন জানান, বন্যায় ক্ষতি হলেও কৃষকরা বসে থাকেনি, নিজ উদ্যোগেই জ্বালা সংগ্রহ করে রুপন করেছিল আমন ধান। লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশী জমিতে করা হয়েছিল আমন ধানের আবাদ। ইতিমধ্যে ধান প্রায় কাটা শেষ। বাম্পার ফলন হয়েছে আমন ধানের। কিন্তু নেই দাম। কম দাম থাকায় কৃষকরা দিশেহারা। চলতি আমন মওসুমের শুরুতেই শেরপুরের ৫২টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার মধ্যে ৪৩টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা পাহাড়ী ঢল ও বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। এতে সবজরি পাশাপাশি আমন ধানের জ্বালারও বেশ ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে সরকারীভাবে কৃষকদের জ্বালার ব্যবস্থা করা না হলেও কৃষকরা নিজেরাই জ্বালার ব্যবস্থা করে আমন ধানের চারা রোপন করে। ফলে এবছর শেরপুরে লক্ষামত্রার চেয়ে ১হাজার হেক্টর বেশী জমিতে আমন ধানের আবাদ করে কৃষক।
চলতি মওসুমে শেরপুর জেলায় ধানের আবাদ করা হয় ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল ২লক্ষ ৫৬ হাজার মেট্রিকটন চাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এবার আমন ধানের আবদও হয় ভাল। ফলে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। ফলনে কৃষক খুশি হলেও দাম নিয়ে হতাশ কৃষক। কৃষকের প্রত্যাশা ছিল সরকার ১ হাজারেরও বেশী টাকা মনে ধান ক্রয় করা শুরু করলে কৃষক ধানের দাম ভাল পাবে। এখন পর্যন্ত শেরপুর জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ধানের মূল্য মোটা ধান ৫শ ৮০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা মন ধরে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতিমন ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ২শ টাকারও বেশী। কৃষকরা জানান, তারা ধানের আবাদ ছেড়ে অন্য লাভজনক ফসল করার পথ খুঁজছেন। শেরপুর সদর উপজেলার হেরুয়া গ্রামের আব্দুল মালেক বলেন, বারবার ধানের দাম না পেয়ে আমাদের খুব খারাপর অবস্থা। আমরা যদি ধানের দাম না পাই, তাইলে আবাদ করে কি করমু। শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আলাহাজ্ব মো: আশরাফুল উদ্দিন জানান, এবার কৃষকরা বাম্পার ফলন পেয়েছে। কিন্তু দামটা কম থাকায় কৃষকের একটু সমস্যা হয়েছে।
- কার্টসি - ইনকিলাব/ ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯