Search

Monday, January 13, 2020

নারী কোথায় নিরাপদ?

মরিয়ম চম্পা

রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, বাস-ট্রেন, ঘরে-বাইরে- কোথায় নিরাপদ নারী? সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আলোচিত ক’টি ঘটনায়- এ প্রশ্ন সর্বত্র। রাজধানীর কুর্মিটোলায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে  ধর্ষণ এবং ধামরাইয়ে বাসে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে এক তরুণীকে। ওদিকে রাজধানীর ভাটারায় এক কিশোরীকে বাসার সামনে থেকে ডেকে নিয়ে গণধর্ষন করা হয়েছে। দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণ, নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে। এ থেকে মুক্তি কীভাবে? আর কেনইবা মানুষ এভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে ঘরে এবং বাইরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি দিন দিন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই নারীদের পদচারণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীন বিচরণে নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও প্রশ্নের মুখোমুখি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২জন। অর্থাৎ, গত ২০১৮ সালের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকে দায়ী করেন। তবে রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার আরো অনেক উপাদান আছে বলে মনে করেন তিনি। 

তার মতে, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার একটি অংশ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো মামলা হয় না। আর যেগুলোর মামলা হয় বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেখানে শতকরা মাত্র তিন ভাগ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের কোনো ঘটনায় বিচার হয় না। তবে এর বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে বলে মনে করেন তিনি। 

তিনি বলেন, যারা ধর্ষক তারা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে শক্তিশালী। অন্যদিক বাদ দিলেও লৈঙ্গিকভাবে পুরুষ শক্তিশালী। তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী। নারীদের সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্র তা পালন করছে না। আর নারীদের বাইরে বের হওয়া কিংবা কাজে যাওয়ার বিষয়গুলোকে সমাজে এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না। নারীর বাইরে বের হওয়াকে পুরুষের ক্ষমতা খর্ব হওয়া হিসেবে দেখা হয়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গণপরিবহনে ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সম্প্রতি নারীদের একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে। বাসে যাত্রী কম হলে সতর্ক থাকা। অধিক যাত্রীসংবলিত গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা। গাড়িতে না ঘুমানো। বাসে বসে পরিবারের কাউকে ফোন করে উচ্চ স্বরে নিজের অবস্থান জানিয়ে রাখা। গন্তব্যে যাওয়ার আগেই যাত্রীরা নেমে গেলে সেখানেই নেমে গিয়ে পরিবারের কাউকে ফোন করে নিয়ে যেতে বলা। গাড়ির ভেতরে অনিরাপদ বোধ করলে জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মনে করেন, নারী এখন ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তার মধ্যে নেই। তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি বাইরে যা ঘটছে তেমনি ঘরের মধ্যে একই ঘটনা ঘটছে। সুতারং নারীর নিরাপত্তার নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। বরং নারীরা এখন ২৪ ঘণ্টাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পার করছে। বাস, ট্রেন, স্কুল, কলেজ সর্বত্রই নারীরা এখন অনিরাপদ অবস্থায় আছে। এটার জন্য আমি মনে করি রাষ্ট্রের অবকাঠামো দায়ী। এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতাও এ জন্য দায়ী।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, নারী শুধু বাংলাদেশে কেন সারা পৃথিবীতে কোথাও নিরাপত্তার ভেতরে নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার একটি প্রচণ্ডরকম সংস্কৃতি দেখা গেছে। রাস্তায়, গাড়িতে, অফিসে, বাসায় কোথাও তারা নিরাপদ না। যার প্রমান অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। এদেরকে দমনের ক্ষেত্রে যে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল তা আমরা কতটুকু নিতে পারছি সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, নারী পৃথিবীর কোথাও নিরাপদ না এখন। এর কয়েকটি কারণ এবং ধরণ আছে। একটি গ্লোবাল অপরটি ন্যাশনাল। গ্লোবালি নারীদের পুঁজিবাদের অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে নারী সেখানে পণ্যের চেয়ে বেশি কিছু না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু আছে এটা তারই অংশ। অপরাধী যখন অপরাধ করে পার পেয়ে যায় তখন মানুষের মনে সমাজ, আইনি কাঠামো ইত্যাদিতে খুব বেশি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারীকে পুঁজিবাদের অংশ এবং ভোগপণ্য হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। একইসঙ্গে বিচাহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়গুলোকে কোনোভাবে যেন পলিটিক্যালি জাস্টিফাই না করা যায় তা মাথায় রাখতে হবে।       
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তিনিও প্রশ্ন রাখেন- দেশে নারীরা কোথায় নিরাপদ। সেটি ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্র বা সমাজ কাঠামোর কোথাও তারা নিরাপদ না।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ১৩ জানুয়ারি ২০২০ 

কষ্টের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে কারা

মো. আশফাকুজ্জামান


সত্তর-আশির দশকের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক না। এমন একটা সময় ছিল, যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নসহ প্রায় সব সূচকে দেশ পিছিয়ে ছিল। আজ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে মানুষ এখন এ দেশে আসছেন।

স্বাধীনতার পর প্রতি দশকেই দেশের কোনো না কোনো খাতে উন্নয়ন হয়েছে। এসবই ইতিবাচক। কিন্তু যখন দেখা যায়, কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করেন, তখন সেটা ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে।

উন্নয়নের মধ্যেও সমস্যারও যেন শেষ নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো বেকার সমস্যা। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজের বাজারে আসছেন। তাঁদের কয়েক লাখ কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। অন্যরা বেকার থেকে যাচ্ছেন। এই যখন বাস্তবতা, তখন বিদেশিরা এ দেশে অবৈধভাবে কাজ করবেন কেন?

২০১৫ সালে সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) একটি গবেষণা করেছিল। এ গবেষণা মতে, প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। তাঁরা এক বছরে ভারতে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি দেশ থেকে ভারত যে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আয় করে বাংলাদেশ থেকে। ভারত তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ করে যে দেশ থেকে, সেটি হলো বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৮ সালের একটি গবেষণা রয়েছে। এ গবেষণায় অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকেরা বৈধ পথে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার নিজ নিজ দেশে পাঠান, টাকার অঙ্কে যা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি।

উন্নয়নশীল সব দেশেই হয়তো কিছু অবৈধ বিদেশি শ্রমিক থাকেন। কিন্তু এর সংখ্যা খুবই কম। কোনোভাবেই সে সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে না। কিছু দেশের অনেক নাগরিক আছেন, যাঁরা ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন, যা আইনত অবৈধ। নিশ্চয়ই এসব অবৈধ কর্মী এ দেশে কারও না কারও সহযোগিতা পান। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

যেসব বিদেশি এ দেশে কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশই কারখানার উৎপাদনকাজে জড়িত। তাঁদের বেতনও অনেক বেশি। কিছু বিশেষায়িত ক্ষেত্রে হয়তো বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা সময়সীমা থাকা প্রয়োজন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজেদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু আমাদের সে রকম কোনো লক্ষ্য নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি এই লক্ষ্য অর্জনকে জরুরী করণীয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে? করেনি বলেই বছরের পর বছর বিদেশিরা এ দেশে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। যে সব দেশ উন্নত হয়েছে, তাদের সরকারের পাশাপাশি নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলি শিক্ষাঙ্গনে তহবিল সহায়তা দিয়ে এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে তাদের প্রয়োজনীয় কর্মশক্তির জোগানের ব্যবস্থা করেছে।

বিদেশিদের কাজের ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু কাজ বিদেশিরা করছেন, যে কাজ এ দেশের মানবসম্পদ দিয়ে করা সম্ভব। কয়েকটি ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং এজেন্সিতেও বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এটা এমন কোনো টেকনিক্যাল কাজ না। কোনো উন্নত প্রযুক্তির কাজও না। এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানেরও দরকার নেই। তাহলে কেন এখানে বিদেশিরা কাজ করছেন? এ ধরনের কাজ সারা জীবন এ দেশের মানুষই করে এসেছে।

অধিকাংশ বিদেশি কাজ করেন রপ্তানিমুখী মাঝারি ও বড় কারখানায়। বড় ব্যবসায়িক গ্রুপেও বিদেশি কাজ করেন। সবচেয়ে বেশি বিদেশি কাজ করেন পোশাক কারখানা। এর প্রায় অর্ধেকই প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিক। আরও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কত বিদেশি অবৈধভাবে দেশে কাজ করছেন, এরও সঠিক কোনো হিসাব নেই। এভাবে রাষ্ট্র তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাঁদের বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতিতে বিদেশিদের দেখা গেছে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন। তাঁদের পরিচালনা পর্ষদ পোশাক কারখানায় কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা জানতে চেয়ে সদস্যদের চিঠি দেয়। চিঠিতে বিদেশিদের নাম, পদবি, কোন বিভাগ, কাজের দক্ষতা, কত দিন ধরে করছে, জাতীয়তা ও মাসিক বেতন কত—এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। বিজিএমইএ মাত্র ৫২টি পোশাক কারখানা তথ্য পেয়েছে। সেখানে অবশ্য খুব বেশি বিদেশি কর্মীর তথ্য ছিল না।

ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, তাইওয়ান, ইরাক, আফগানিস্তান, তানজানিয়া, আফ্রিকাসহ ৪০ থেকে ৫০টি দেশের মানুষ বাংলাদেশে কাজ করেন। টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং—এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবৈধ বিদেশি কাজ করেন। এর বাইরেও আছে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, ফার্নিচার কোম্পানি, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, চামড়াজাত, গবেষণ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

দেশে যেখানে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজের বাজারে আসছেন। লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী রয়েছেন। একটা চাকরির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। সেখানে কেন যে কাজ এ দেশের মানুষ করতে পারেন, সে ধরনের কাজ বিদেশিরা করবেন? বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণজাত অঞ্চলে অনুমতি ছাড়া কোনো বিদেশি কাজ করতে পারেন না। নিয়ম সবার জন্য সমান।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে কয়েক লাখ বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বিভিন্ন ধারণা অনুযায়ী, স্থায়ী-অস্থায়ীসহ প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে থাকেন। এক হিসাবে দেখা যায়, বিদেশিরা আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যান। বাংলাদেশের কর্মীরাও বিদেশ থেকে টাকা পাঠান। ২০১৮ সালের তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। উন্নত অর্থনীতির অথবা ধনী দেশের থেকে কম উন্নত দেশে রেমিট্যান্স আসা স্বাভাবিক, এর উল্টোটা হওয়া অস্বাভাবিক।

বিনা অনুমতিতে যে বিদেশি কর্মী কাজ করবেন, তাঁকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কর্মীর কাজের সুযোগ বাড়তে থাকবে। আমাদের প্রবাসী কর্মীর সীমাহীন কষ্টে আয় করা টাকার একটা বড় অংশ আবার বিদেশিরাই নিয়ে যাবেন।

  • মো. আশফাক উজ জামান: সাংবাদিক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ১৩ জানুয়ারি ২০২০

Sunday, January 12, 2020

সরকারের এক বছর- গণতন্ত্রের পথ আরও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে

এমাজউদ্দীন আহমদ

এমাজউদ্দীন আহমদ

টানা তৃতীয়বার বর্তমান সরকার এ মেয়াদে তাদের এক বছর পূর্ণ করল। সরকারের এক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে হতাশার অনেক চিত্রই ভেসে ওঠে। তাদের তরফে বলা হয়ে থাকে তারা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পর সরকার গঠিত হলো এই সরকারকে প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক সরকার বলার অবকাশ কতটা রয়েছে তা প্রশ্নের বিষয়। গণতান্ত্রিক সরকার কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার কিছু অপরিহার্য শর্ত রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারছে না। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আমি মনে করি, সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করাটা গণতন্ত্রের অন্যতম জরুরি শর্ত। সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা দরকার, যা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এখানে অনিশ্চিত। গণতান্ত্রিক রাজনীতি বলতে যা বুঝি তাও গত এক বছরে আরও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছে। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা- এই জরুরি বিষয়গুলোও প্রশ্নবিদ্ধ।

বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর এই সরকারের শাসনামলে স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তরের যে নির্বাচন হলো তাও অস্বচ্ছ। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্লানি পরবর্তী ধাপে স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনের মাধ্যমে আরও গভীর করেছে। ক্ষমতাসীন মহল বলেছিল তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গ চাপা তো পড়েছেই, একই সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের পথ আরও সংকুচিত হয়েছে। গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা বেড়েছে। সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের যে উল্লেখ রয়েছে এর ব্যত্যয় ঘটে চলেছে। গণতন্ত্রের আকাশে অনেক নক্ষত্র থাকবে, এটিই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি কী বলে?

আইনের শাসনের কথা সরকার জোর দিয়ে বারবার উচ্চারণ করলেও বাস্তবতার সঙ্গে এরও অনেক ফারাক। মানুষের নিরাপত্তা নেই। বিগত এক বছরে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গত এক বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে দ্বিগুণ সংঘটিত হয়েছে। নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও কম ঘটেনি। এ থেকে সহজেই প্রতীয়মান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি কথার কথা হয়েই আছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে 'বালিশকাণ্ড', ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অর্থ লোপাটসহ বিভিন্ন সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতিরও কোনো দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার সরকার করতে পারেনি। এগুলো খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। ঘটনা আরও অনেক আছে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই স্বস্তির নয়। ব্যাংক খাত চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রেও সরকারের সফলতা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, এমন অনেক কিছু দফায় দফায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নিত্যপণ্য পেঁয়াজ নিয়ে যে তুঘলকিকাণ্ড ঘটল তা বিস্ময়ের। অসাধু ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা ভোক্তার পকেট কেটে নিয়ে গেল। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের চিত্রও অনুজ্জ্বল। ছাত্রলীগের বিপথগামীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরু ও তার অনুসারীরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিংবা সুস্থ সমাজের চিত্র নয়।

দেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের শিকার। শত শত কোটি টাকা লোপাট করে অনেকেই আরাম-আয়াশে জীবনযাপন করছেন, কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সামান্য ত্রুটি পাহাড়সম করে তোলা হলো। গত বছরে সরকারের আগ্রাসী মনোভাবের আরও প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। দেশের উন্নয়ন একেবারে হয়নি কিংবা অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়নি- এ কথা বলব না। কিন্তু কোনো উন্নয়ন-অগ্রগতিই টেকসই কিংবা স্থায়িত্ব পাবে না যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণতা না পায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নই গণতান্ত্রিক সরকার, রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থার চূড়ান্ত বিচার্য বিষয় নয়- এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। সমাজে বৈষম্য যে বেড়েছে তাও তো অস্বীকার করা যাবে না। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা অগ্রগতি কি নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে রইল না?

বাঙালি জাতির অহংকার মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের নাম ঢুকে গেল রাজাকারের তালিকায়। এর চেয়ে বড় মর্মবেদনা আর কী হতে পারে! এই অবমাননা কি মেনে নেওয়া যায়? এই সরকারের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে এত বড় অপকাণ্ড যাদের কারণে ঘটল তাদের বিরুদ্ধে কেন আজও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল অপরিহার্য। জাতীয় সংসদে এখন যারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছেন প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংজ্ঞাসূত্র মোতাবেক তাদেরকে বিরোধী দল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার অবকাশ কতটা আছে- এও জরুরি প্রশ্ন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত। গত এক বছরে তা বেড়েছে, কমেনি। এমতাবস্থায় সরকারের এক বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করতে গেলে হতাশার কথাই বলতে হবে। অসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জিইয়ে থাকলে এর ফল দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হওয়ার কথা নয়।

জনঅধিকারই গণতন্ত্র। শুধু সরকার দাবি করলেই কি আমরা সমস্বরে  বলতে পারব - বিগত এক বছরে গণতন্ত্রের পথ মৃসণ হয়েছে? বরং বলা যায়, এই পথ আরও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। শান্তিপূর্ণ সমাজ জীবনের যেসব শর্ত রয়েছে যেসব ক্রমেই ভেঙে পড়ছে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে। যদি 'আমার' কিংবা 'আমিত্ব'র দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো না যায় তাহলে আগামী দিনে রাজনীতি আরও শ্রীহীন হবে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমনটি তো আমাদের কাম্য নয়। 


  • লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি — সমকাল/ জানুয়ারি ৭, ২০২০

সড়কে মৃত্যুর মিছিল কেন বাড়ছে?

মরিয়ম চম্পা


ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর এলাকায় বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাবা-মেয়ে আর পুলিশের এক কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। গত সোমবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসটি বোয়ালমারী থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। মামুন পরিবহনের বাসটি যাচ্ছিল ঢাকা থেকে মাগুরায়। মল্লিকপুর এলাকায় গাড়ি দু’টির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় নিহত ছয়জনই মাইক্রোবাসের যাত্রী।

সম্প্রতি  চট্রগ্রামে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বেড়ানোর আনন্দকে বিষাদে ভরিয়ে দিয়েছে। গোটা পরিবারকে তছনছ করে ফেলেছে।

এই দুর্ঘটনায় পরিবারের বাবা ও দুই মেয়ে মারা গেছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে লরির সঙ্গে প্রাইভেটকারের সংঘর্ষে তছনছ হয়ে গেল গোটা পরিবার। সকাল আটটার দিকে ফৌজদারহাট-বন্দর বাইপাস সংযোগ সড়ক এলাকার এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান মিন্টু ও তার দুই মেয়ে। নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বান্দরবান বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে তাঁদের বহনকারী প্রাইভেটকারটি।

গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ হাজার ২’শ ২৭ জন। দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৭০২টি। নিরাপদ সড়ক চাই-এর (নিসচা) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই্থএর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই হচ্ছে মহাসড়কে। আর দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারির অভাব। অনেক নির্দেশনা, আইন মানা হয় না এবং সেগুলো নজরদারির আওতায়ও থাকে না। মূল শহরের রাস্তায় বা মহাসড়কে কম গতির যানবাহনগুলো না চলার বিষয়ে যে নির্দেশনা ছিল, তা অনেকাংশেই মানা হয় না। গত এক বছরে দেশের সড়কে যানবাহন বেড়েছে ১০ লাখেরও বেশি। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি না বাড়ার কারণে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাসড়কে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা সহ কম গতির বহু যানবাহন চলাচল করে। এছাড়া একটু পর পর দেখা যায় রিক্সা স্ট্যান্ডের মত জায়গায় মানুষ জমায়েত হয়ে থাকে। চার লেন হওয়ার পর রাস্তায় যানবাহনের গতি বেড়েছে, কিন্তু একইসাথে রাস্তায় কম গতির যানবাহন চলাচল করতে দেয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। আর এই কম গতির যানবাহনের চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পুলিশের পাশাপাশি যানবাহন চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বিনিয়োগ করে বর্তমান লোকবলের দক্ষতা বাড়ালেই অনেকাংশে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।

হাইওয়ে পুলিশের মতে, কার্যপরিধি ও জনবল কম থাকার কারণে মহাসড়কের সব অংশে নজরদারি নিশ্চিত করতে পারে না পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের মোট ৭৬টি আউটপোস্ট আছে, কিন্তু সেগুলো সকল মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক কাভার করে না। কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে তারা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সারা দেশের গণপরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ এবং মনিটরিং করার সক্ষমতা বিআরটিএর নেই। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজির মাত্রাটা অনেক বেড়েছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এটা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এবং চাঁদাবাজির কারনে গণ পরিবহনের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বেপরোয়া হয়ে গেছে। যে শর্তগুলো সড়ক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সেগুলো দেয়া হয় নি। ফলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। আইনকে হতে হয় নমনীয় এবং বাস্তবায়ন কঠোর হতে হয়। আমাদের এখানে আইন কঠোর কিন্তু বাস্তবায়ন নমনীয়। এটা থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে আইনকে সহনশীল করতে হবে। বাস্তবায়ন কঠোর করতে হবে। এটা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে সড়ক নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য কোনো মাধ্যম নেই। গাড়ির চালক যখন বেপরোয়া চালায় অথবা যাত্রীদেরকে যখন চলন্ত গাড়ি থেকে উঠতে নামতে বাধ্য করে এখানে যাত্রীদের চেয়ে চালকদের সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যাত্রীদের সচেতনতা কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। তবে পথচারি দুর্ঘটনার হার কিছুটা বেড়েছে। এজন্য সচেতনতা প্রয়োজন। এখানে আমি মনে করি, ট্রাফিক আইন শতভাগ নিশ্চিত করা জরুরী। এবং ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও অব্যবস্থাপনা গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার জন্য অন্যতম দায়ী। সুতারং ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে কাঙ্খিত সাফল্য পাওয়া অনেক কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের বিষয়।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক ডিএমপি মো: মফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেমন আইনের প্রয়োগের বিষয় আছে একইভাবে অন্যান্য কিছু বিষয় এটার সঙ্গে যুক্ত। পথচারি, চালক, মালিক সবার সচেতন হওয়ার বিষয় আছে। সব বিষয় সমন্বিতভাবে এটা প্রতিরোধে আমরা কাজ করছি। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এবং সেই কমিটি থেকে ১শ ১১ দফার একটি সুপরিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি দুর্ঘটনা ঘটে। সেগুলো নিয়ে আমরা গবেষণা করি। এবং কার কি করনীয় সেগুলো চিহ্নিত করা হয়।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দুর্ঘটনা রোধে গণ পরিবহণে শৃঙ্খলা আনতে হবে। রিকশাগুলোকে ক্রমান্বয়ে মূল সড়ক থেকে তুলে দিতে হবে। রিকশার পরিবর্তে কি আসবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। মোটরসাইকেলের বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ সড়ককে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি মহাসড়কে মিনিবাস বা ছোট ছোট গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।

  • কার্টসি — মানবজমিন/ জানুয়ারি ১১, ২০২০

Thursday, January 9, 2020

দূষিত নগরে এ কেমন জীবন

আমিরুল আলম খান



মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি। বেলা ১১টা। শ্যামলীতে একটা ব্যাংকে জরুরি কাজ সেরে এসওএস শিশুপল্লির ওভারব্রিজে উঠি মিরপুর রোড পার হতে। চারদিকে গাড়ির বিকট হর্ন, গাড়ি চলার শব্দ, সঙ্গে আরও নানা ধরনের আওয়াজ। খানিক পরেই শ্বাসকষ্ট অনুভূত হতে লাগল। মনে হচ্ছিল, ব্রিজ পার হতে পারব না। রেলিং ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে নেমে এলাম শিশুমেলার মোড়ে। সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে উবার ডাকলাম। তিন মিনিট লাগবে। আমি যেন দিশেহারা। কান ঝালাপালা করছে। সহ্য হচ্ছে না গাড়ি চলা আর হর্নের আওয়াজ। মিনিট তিনেকের মধ্যেই উবার হাজির। উঠে বসলাম। গাড়ির ভেতর গাড়ির আওয়াজ কমেছে। বাইরের বাতাসে শ্বাস নিতে হচ্ছে না। মিনিট দুয়েকের মধ্যে শ্বাসকষ্ট কমে এল। নিজেকে অনেকটাই সুস্থ মনে হলো।

ঢাকায় রোজ অন্তত কোটি দেড়েক মানুষ নানা কাজে ঘরের বাইরে চলাচল করে। তাদের ৮০ ভাগই নানা দূষণে আয়ু ক্ষয় করছে। কত শত শারীরিক–মানসিক সমস্যা নিয়ে তারা ভিড় করে ডাক্তারের দরজায় দরজায়। দূষিত বাতাস, শব্দের বাড়াবাড়িতে তাদের এমন স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়। ধুলাবালু তো আছেই; আছে ধোঁয়া, জান কবজ করা ভারী ভারী নানা পদার্থ। বাস, মিনিবাস, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, কাভার্ড ভ্যান, মোটরবাইক—সবকিছুই পাল্লা দিয়ে দূষণ ছড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে নগরে উন্নয়নের ঘোড়দৌড় তো লেগেই আছে। সরকারি–বেসরকারি হাজারো উন্নয়ন প্রকল্প। সে জন্য যেখানে–সেখানে ইট, সুরকি, পাথর, বালু, রড, সিমেন্টের পাহাড়। রাস্তা, ফুটপাত সব দখল করেই এসব উন্নয়নসামগ্রীর স্তূপ। পাল্লা দিয়ে করপোরেশনও স্তূপ করে রাখে গৃহস্থালি বর্জ্য। তার সঙ্গে হোটেল, দোকান, হাসপাতালের বর্জ্য মিশে একাকার। বর্জ্য পচে দুর্গন্ধে এলাকা নরক না হলে করপোরেশন তা সাফা করার গাড়ি, লোক কিছুই পাঠায় না। আবর্জনা ফেলার জন্য তারা উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নেয় স্কুল–কলেজের পাশের কোনো জায়গা। শিশুরা সে আবর্জনার দুর্গন্ধে বমি-বমি-গায়ে ঢোকে ক্লাসরুমের জেলখানায়। সঙ্গী লাখো কোটি জীবাণু। ফিরতি পথে আবার দুর্গন্ধ আর জীবাণুর দঙ্গল নিয়ে বাসায় আসে। কেউ দেখার নেই, প্রতিবাদ করার জো নেই।

একুশ শতকের প্রথম দুই দশক পার করেছি আমরা। তৃতীয় দশকে যে অবস্থার উন্নতি হবে, তা দুরাশা মাত্র। কারণ, বিশৃঙ্খলা বাড়ছেই দিনে দিনে। আজই সংবাদমাধ্যমের জবর খবর, ঢাকা দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত শহরে তালিকার সেরাতে আজও। গত ডিসেম্বর থেকে ঢাকা মাসের অর্ধেকজুড়েই দূষিততম নগরের তকমা নিয়ে হাজির হচ্ছে। উচ্চ আদালতের হুকুম জারি আছে রোজ পানি ছিটিয়ে শহর ধূলিমুক্ত রাখার। সে হুকুম কোথাও আমল হচ্ছে কি না, ঈশ্বর জানেন; আমরা ঢাকাবাসী তা চোখে দেখিনে, কানেও শুনিনে।

একদা ঢাকা ছিল নদীঘেরা এক চমৎকার নগরী। দুনিয়ার কয়টা শহরের চারপাশ চার–চারটা নদী বহমান, তা আমার জানা নেই। কিন্তু ঢাকা ছিল সেই বিরল শহর, যেটি চারপাশ নদীবেষ্টিত। কিন্তু হলে কী হবে? ‘সরকারকা মাল, দরিয়ামে ঢাল’—আমরা এমন রপ্ত করেছি যে গোটা নদীই দখল করে করে ওদের জান কবজ করে ফেলেছি। প্রাণীর জান কবজের কাজ আজরাইল ফেরেশতার। কিন্তু খোদ দুনিয়ার জান কবজের কাজটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে আশরাফুল মখলুকাত—মানুষ। শুধু ঢাকার নদী নয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন নদী খুঁজে পাওয়াই ভার। যদিওবা নদী কিছু অবশিষ্ট আছে, পানি তার ভয়ংকর দূষিত। বেশির ভাগ নদী এখন খাল বলেও চেনা যায় না। যেটুকু আছে, তা কচুরিপানায় ভরা। নয়তো দখলবাজরা তা দখলে নিয়ে মাছের ঘের, পুকুর বানিয়েছে, বাড়ি, দোকানের ইমারত তুলেছে।

ঢাকায় এককালে খাল ছিল বহু। এখন সেগুলোও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, উত্তরা, বারিধারায় ভদ্দরলোকদের জন্য যেসব লেক তৈরি করা হয়েছিল, তারও অবস্থা কাহিল। এমনকি কয়েক শ কোটি টাকায় নান্দনিক শোভার বার্তা দিয়ে হাতিরঝিল তৈরি করা হলো দশক দেড়েক আগে, সেটা এখন পচা পুকুরেরও অধম, চরম দূষিত। ওই এলাকার বাসিন্দারা কী করে বসবাস করে, তা কেবল মাবুদ জানেন। ওদিকে দেশের একসময়ের আইকন হোটেল সোনারগাঁও এলাকা পচা সবজি আর মাছের গন্ধে কাক-শকুনেরও অরুচি।

সেদিন দেখি, হাতিরঝিলে ছুটছে বিনোদনের কলের নৌকা। তা নৌবিহারের ব্যবস্থা যদি করেন নগরপিতা, তাহলে দুটি বিষয় মাথায় নিলে ভালো করতেন। এলাকাটা আগে সাফসুতরো করে দুর্গন্ধ তাড়িয়ে নিতেন। আর দ্বিতীয় নিদান, কলের জাহাজ না চালিয়ে দাঁড় আর হালের নৌকা চালালে নতুন প্রজন্ম ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিত মন’। বাতাস যখন বইত, ধীরে ধীরে উড়িয়ে দিলে নানা রঙিন পাল, খুশির পালে লাগত জবরদস্ত হাওয়া। তাতে হাতিরঝিলের মান বাড়ত, নাগরিকদের দেহ–মন চনমনিয়ে উঠত।

কিন্তু সেসব দিকে নজর দেবেন, তেমন লোকের এখন বেজায় অভাব। বরং দেখি, চারদিকে কোটি কোটি লোক নগরটাকেই খাবলে–খুবলে খেতে হল্লা করে আসছে ধেয়ে ধেয়ে। তাদের সঙ্গে আছেন আবার গদির ওপর বসা অনেক মানুষ। তাঁরা সবাই দল বেঁধেছে আসছে আমাদের মতো পথের মানুষের জান খাবলে খাবলে খেতে। গরিব মানুষের কলজে খাওয়া বেশ মজার। 
  • লেখক — যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
  • কার্টসি — প্রথম আলো/ জানুয়ারি ৯, ২০২০ 

ক্যাসিনোকাণ্ডে উদ্যোক্তাদের গায়ে আঁচ লাগেনি

আসাদুজ্জামান



ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সাড়ে তিন মাস পার হলেও ঢাকার চারটি ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসার উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তা–কর্মচারী হিসেবে কাগজে–কলমে দেশি–বিদেশি যাঁদের নাম আছে, তাঁদের কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। আবার এসব ক্লাব থেকে যাঁরা নিয়মিত চাঁদা তুলতেন কিংবা চাঁদার ভাগ পেতেন, তাঁদেরও বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

মতিঝিলের মোহামেডান ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ও দিলকুশা ক্লাবের নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মতিঝিলের মোহামেডান ক্লাব এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা নামের ক্লাবে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন আবুল কাশেম ও ইমরান আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি। দুজনই এখন পলাতক। আর ভিক্টোরিয়া ক্লাবটি পরিচালনা করতেন নেপালি নাগরিক নাগিন। দিলকুশা ক্লাবটির পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন রাজকুমার ও রাজিন।

র‍্যাবের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মতিঝিলের ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে প্রভাবশালী তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের আইনের আওতায় আনা হবে।

মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া ও দিলকুশা ক্লাবের রেজিস্টার ও কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেশি-বিদেশি ৪৪ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে, যাঁরা ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের একটি অংশ বিদেশি নাগরিক। ইতিমধ্যে তাঁরা পালিয়ে গেছেন।

এর বাইরে মোহামেডান ক্লাবের নথিপত্র থেকে ২৯ জন অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (ভিভিআইপি) নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা ভিআইপি অতিথি হিসেবে ক্লাবগুলোয় নানা সুযোগ-সুবিধা নিতেন এবং নিয়মিত সেখানে ক্যাসিনো খেলতেন। তাঁদের মধ্যে আছেন মিরপুর ও মতিঝিল এলাকার থানা পর্যায়ের দুজন আওয়ামী লীগ নেতা, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী, নামকরা দুজন পুস্তক প্রকাশক, সুপরিচিত একজন খল অভিনেতা এবং কয়েকজন তরুণ ব্যবসায়ী। এ ছাড়া মোহামেডান ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন, এমন অন্তত ২০০ জনের নাম মোহামেডান ক্লাবের নথিপত্র থেকে জানা গেছে।

মোহামেডান ক্লাবে ভিভিআইপি অতিথি ছিলেন ২৯ জন নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন অন্তত ২০০ জন


মোহামেডান ক্লাবের দৈনিক আয়–ব্যয়ের হিসাবপত্রে সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে, যিনি প্রতিদিন মোহামেডান ক্লাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে যেতেন। অনুসন্ধানে মোহামেডান ক্লাব থেকে চাঁদা আদায়কারী সেই সালাউদ্দিনের পরিচয় জানা গেছে। মোহামেডান ক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, সালাউদ্দিন বহিষ্কৃত কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা মমিনুল হক সাঈদের পরিচিত। সাঈদকে তিনি মামা ডাকতেন। মোহামেডান ক্লাবের ভেতরে তাস খেলার বোর্ড চালাতেন সালাউদ্দিন।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন রাজধানীর মতিঝিলের ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ক্লাবের ১৮২ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের মালিক যুবলীগ নেতা খালেদ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা করা হয় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী সহোদর এনামুল হক ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে। এরপর থেকে দুজনই পলাতক।

মতিঝিল পাড়ার দুটি ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানের তিন দিন পর গত ২১ সেপ্টেম্বর মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, দিলকুশা ও আরামবাগ ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। সেদিন কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে ক্যাসিনো খেলার বোর্ডসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।

মতিঝিল থানার পরিদর্শক মনির হোসেন মোল্লা জানান, চারটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মোহামেডানসহ চারটি ক্লাবে অভিযানের পর জিডি হয়েছিল। এর তদন্ত চলছে। এসব ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ক্লাবের নথিপত্রের তথ্য বলছে, মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় ছিলেন আবুল কাশেম ও ইমরান আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি। ক্লাবের ক্যাসিনোর সাবেক কর্মচারী আশিক রুশদি ও গান্ধী হাওলাদার বলেন, কাশেম ও ইমরান দুজনই মমিনুল হক ও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

ক্যাসিনোর মালিক আবুল কাশেমের গাড়িচালক মো. সুজন প্রথম আলোকে বলেন, ফকিরেরপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানের পর থেকে তাঁর মালিক কাশেম পলাতক। কাশেমের বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি তৈরি পোশাকশিল্প ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য ইসরাফি আশরাফ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি নিজে ক্যাসিনো খেলতেন। মোহামেডান ও গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন কাশেম ও ইমরান।

কাশেমের জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর বর্তমান ঠিকানা দেওয়া আছে ১২/বি, আলামিন টাওয়ার, শান্তিনগর। সম্প্রতি ওই বাসায় গেলে নিরাপত্তারক্ষী আবদুল মান্নান জানান, কয়েক বছর আগে ওই বাসায় থাকতেন কাশেম।

কাশেমের গাড়িচালক সুজন জানান, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলার পর থেকে আর কাশেমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। কাশেমের মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে।

মোহামেডান ক্লাবের কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মোহামেডান ক্লাব পরিচালনায় যুক্ত থাকা ১৩ নেপালি নাগরিক হলেন পঞ্চ কুমার শ্রেষ্ঠ, সুরেশ শ্রেষ্ঠ, সানু বাবু শাহি, রাধাকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ, বিকাশ, বচন রণজিৎ, ইন্দা লামিচান্স, পদাম সাউদ, সুরাজ নাগরতি, বিক্রম, প্রভিন ও নিরোজ।

মোহামেডান ক্লাবের সাবেক দুই কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগ নেতা সম্রাট একসময় নিয়মিত বসতেন ভিক্টোরিয়া ক্লাবে। এই ক্লাবের ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সম্রাট জড়িত ছিলেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাগজপত্রের তথ্য বলছে, নেপালি নাগরিক নাগিন এখানে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার অন্যতম ব্যক্তি। তাঁর নেতৃত্বে নেপালি নাগরিকেরা এই ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন।

ভিক্টোরিয়া ক্লাবের নথিপত্রের তথ্য বলছে, নেপালি নাগরিক নাগিনের নেতৃত্বে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন নেপালি ১২ নাগরিক। তাঁরা হলেন হেমন্ত শাহ, অনিল কারকি, সন্তোষ অধিকারী, পুষ্প পান্থ, ডিরাব উপেথি, কে পে আচার্য, ভুবন বোস, বিনোদ, মনোজ, নগেন্দ্র, রণজিৎ ও মিলন। এর বাইরে ভিক্টোরিয়া ক্লাবের রেজিস্টার থেকে আরও অন্তত ৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম জানা গেছে।

দিলকুশা ক্লাব রেজিস্টারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেল, ক্লাবটিতে নেপালি নাগরিক রাজকুমার ও রাজিনের নেতৃত্বে ১৬ জন নেপালি ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। এই দুজন ছাড়া অপর ১৪ নেপালি নাগরিক হলেন রমেশ, বিনোদ, রাজেশ, সঞ্জীব, জীবেন, শ্যাম, সুশীল, উমেশ, রমেশ, অশোক, চাঁদ, রোশান, দিনেশ ও রমেন।

ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত নেপালি অনেক নাগরিককে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে।

গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় নেপালিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করায় দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মতিঝিল থানার আশপাশের ক্লাবগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালিত হয়েছে। কান টানলে মাথা আসবে—এমন পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয়তো অভিযান স্তিমিত হয়েছে। ক্লাবগুলোর কাগজপত্রে যাঁদের নাম আছে, যাঁরা ক্যাসিনোর উদ্যোক্তা, কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং যাঁরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হওয়া উচিত।

  • কার্টসি — প্রথম আলো/ জানুয়ারি ৯, ২০২০ 

Monday, January 6, 2020

রাজধানীতে গণধর্ষণ — অনিরাপদ ঢাকা, অনিরাপদ দেশ!

কাকন রেজা


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেয়েকে বাস থেকে নামার পর উঠিয়ে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটি সাংস্কৃতিক কর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলেই হয়তো প্রতিবাদটা হয়েছে তাৎক্ষণিক। কিন্তু এমন ঘটনা কি আর নেই? আছে। সারাদেশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তারমধ্যে কিছু ঘটনা ‘ক্লিক’ করে অন্যগুলো আড়ালে থেকে যায়।

আজ যখন লিখছি, তখনও মনিটরে শায়েস্তাগঞ্জের একটি খবর চোখ আঁকড়ে রয়েছে। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এক স্কুলছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে এক যুবক। মেয়েটির স্পর্শকাতর অঙ্গে আঘাতের চিহ্নের কথা ফলাও করে বর্ণিত হয়েছে খবরে।

কেন হয়েছে, অনুচ্চারিত জবাব একটাই, মানুষ এতে আকর্ষিত হয়। অর্থাৎ এমন খবরও ধর্ষকামীতার ‘সহমত’ পোষণকারী। শায়েস্তাগঞ্জের এই স্কুলছাত্রীটিকে নিয়ে কোনো প্রতিবাদের কথা নেই সেই খবরে। নেই মানববন্ধন, অবরোধ কিংবা অন্য কিছু। শুধু পরিবারের লোকজন বিচার ও শাস্তি চেয়েছেন। আর সেই চাওয়ার ভাষাও অসহায়ত্বের।

অনিরাপদ ঢাকা এবং সারাদেশে আমরা সবাই অসহায়। আমার সন্তান ধর্ষিতা হবে, খুন হবে এটাই যেন এই জনপদে স্বাভাবিক। মানুষজন গণমাধ্যমে ধর্ষিতা হওয়ার বিবরণ পড়বে। বিবরণ রগরগে হলে পাঠক বেশি, ছবি হলে তো কথাই নেই।

খুনের ক্ষেত্রেও একই কথা। বিবরণে থ্রিল থাকা চাই। পড়ে-টড়ে দুদিন আলোচনা, তারপর শেষ। আর বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীটির ঘটনার মতন প্রতিবাদ শুরু হয়, তখন মানুষেরা জেগে ওঠে। যে জেগে ওঠা ‘হুজুগে’ জেগে ওঠা। জানি ‘হুজুগ’ শব্দটায় অনেকে আপত্তি করবেন। তাই ছোট করে ব্যাখ্যা করি। নুসরাতের ঘটনার পর সারাদেশে প্রতিবাদ হয়েছে। জেলায় জেলায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। খুব ভালো, কিন্তু তারপর? থেমেছে কি এসব ঘটনা?

থামেনি যে খোদ জনবহুল রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীকে গণধর্ষণ তারই প্রমাণ। তাহলে, আপনাদের প্রতিবাদ কী ছিল, কতটুকু ছিল, একটু ভেবে দেখুন তো। আর সঙ্গে ভেবে দেখুন প্রতিবাদটা ‘কেন’ ছিল। প্রতিবাদটা ‘কেন’ ছিল, এটাই মূল বিষয়। প্রতিবাদটা কি শুধু নুসরাতের জন্য ছিল, নাকি ছিল এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে? শুধু নুসরাত হত্যার বিচারই কি শেষ? না ‘এরপর’ আরও কিছু রয়েছে? এই ‘এরপর’ শব্দটির উপর প্রতিবাদীদের কোন চিন্তা ছিল না বলেই আজকে আবার প্রতিবাদে দাঁড়াতে হয়েছে।

নুসরাত কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীটি ভেঙে পড়া সমাজের এক একটি ‘সিম্বল’, প্রতীক। আমাদের সমাজ যে ভেঙে পড়েছে, আমাদের সামাজিক কাঠামো যে এমন দুর্বৃত্তপনা রুখতে অক্ষম, তারই জানান দিচ্ছে এমনসব ঘটনা। সুতরাং এসব প্রতিবাদের এবং প্রতিরোধের লক্ষ্য শুধু বিচার নয়, কাঠামো পরিবর্তন করা।

অচল কাঠামোর পরিবর্তে সচল একটি কাঠামো প্রতিস্থাপন করা। অতএব প্রতিবাদ বা বিচারই শেষ কথা নয়। বিষবৃক্ষের গোঁড়া না কেটে কাণ্ড কাটলে, নতুন কাণ্ড গজাবে। মূল উৎপাটনই মূল লক্ষ্য হতে হবে। মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে মূল কাঠামো পরিবর্তনের দিকে। ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ বা খুনের পেছনের কারণগুলো কী, এগুলো ভাবতে হবে, নির্ধারণ করতে হবে। অপরাধ বিজ্ঞানের মতে, যখন শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় থাকে, কিংবা বিচার হয় সংশয়িত, তখন মানুষের ভেতর অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। মানুষ ক্রমেই অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে।

আরেকটা কারণ হলো, ‘সিলেক্টিভ জাস্টিস’। অমুক করলে শাস্তি হবে, অমুক করলে হবে না - এমন ধারণা থেকেও সমাজে বাড়ে অপরাধ প্রবণতা। শুধুমাত্র নুসরাত বা ঢাকা ভার্সিটির মেয়েটির প্রতি সংঘটিত দুর্বৃত্তপনার বিচারই শেষ কথা নয়।

তাই যদি হয় তবে যেসব ঘটনা ‘ক্লিক’ করেনি, সেসব ঘটনায় নির্যাতিত বা নিহতরা বিচার পাবে না, কারণ তাদের জন্য কোনো প্রতিবাদ হয়নি। দেশব্যাপী না হোক নিদেনপক্ষে রাজধানীতে বা এলাকাতেও কোনো মানববন্ধন, বিক্ষোভ হয়নি।

আর এই না হওয়ায় তাদের বিচার হবে না, এমনটাই ধারণা দাঁড়াবে মানুষের মনে। এটাও এক ধরণের সিলেক্টিভ জাস্টিস। প্রতিবাদ হলে বিচার হবে, না হলে হবে না। আমাদের এমন বিচারের ধারণা থেকে বেরুতে হবে।

এমন সামাজিক কাঠামো ভাঙতে হবে, নতুন করে গড়তে হবে এমন সমাজের নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রকাঠামোকেও। আর আন্দোলনটাও হবে এমন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। তবেই যদি দেশে বিচারের ন্যায়তা তথা সব মানুষের জন্য বিচার এবং সব মানুষকে রক্ষার প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে ওঠে।

  • লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট 
  • কার্টসি — যুগান্তর/  জানুয়ারি ৬, ২০২০

Sunday, January 5, 2020

অনাস্থা ও প্রত্যাশার ঢাকা সিটি নির্বাচন

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


বাংলাদেশে ইংরেজি নতুন বছরটাও শুরু হলো একটা রাজনৈতিক অনাস্থা ও হতাশার মুখে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। ৩০ জানুয়ারি ২০২০ অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা হিসাবনিকাশ। এ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর প্রতি সৃষ্ট অনাস্থার কারণেই সে হিসাব-নিকাশের অনিশ্চয়তা নিয়েই শুরু হচ্ছে ২০২০ সালের রাজনৈতিক ক্যালেন্ডারের পাতা।

নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ফলাফল নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় জনমানুষের আস্থার সংকট এতটাই প্রকট যে, অনেকে বিজয়ের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রেখেছেন নৌকা প্রতীকের দুই মেয়র প্রার্থীকে। তারা ধরেই নিয়েছেন, যেকোনো উপায়েই হোক, নৌকার দুই প্রার্থীকে বিজয়ী করার বন্দোবস্ত করা হবেই। এ ক্ষেত্রে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের যৌথ প্রযোজনা ব্যর্থ হবে না বলে যারা ধারণা রাখেন, তারাই আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রেখেছেন। শুভেচ্ছার সঙ্গে সামান্য আবদারও করেছেন কেউ। ভোট জালিয়াতির দৌরাত্ম্য দেখিয়ে পদ দখল করলেও যারাই মেয়র হবেন, তারা যেন অন্তত মশার দৌরাত্ম্য ও ডেঙ্গু জ্বরের আতঙ্কমুক্ত শহরে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু রক্ষা করেন, সেই আবেদন রেখেছেন কেউ।

সিটি নির্বাচন নিয়ে এই আস্থাহীনতার পেছনে নিঃসন্দেহে এ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো ভূমিকা রেখেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা দক্ষিণের নৌকার মেয়র প্রার্থী সিলেকশনের বিষয়টি। যারা মনে করতেন যে, সদ্য বর্ষপূর্তি করা জাতীয় নির্বাচনের বিব্রতকর কালো আস্তর সরানোর উদ্যোগ হিসেবে সরকার ঢাকা সিটি নির্বাচনটিকে সুষ্ঠু করে হারার ঝুঁকি নিতেও পারে, তারাও এই প্রার্থী নির্বাচন দেখে দ্বিধায় পড়ে গেছেন। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচন হলে নৌকার ফলাফল কী হতে পারে, তা জানার পরও ফজলে নূর তাপসকে এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে মেয়র প্রার্থী করায় হিসাব আরও গোলমেলে করে দিয়েছে। কেউ আবার একটু ভিন্ন হিসাবও দিচ্ছেন। বলছেন, যেকোনো উপায়ে দক্ষিণ কব্জা করে উত্তরে সুষ্ঠু ভোট করে সরকার দেখাবে যে, তাদের অধীনে গ্রহণযোগ্য ভোট হয়।

যে যেই ব্যাখ্যাই দিন না কেন, সবই কিন্তু সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার প্রকট সংকটকেই তুলে ধরে। ভোটার তাদের ভোট দিতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী তা গণনা ও প্রকাশ করা হবে এই আস্থাটা কিন্তু কারোর নেই। সবাই হিসাব করছেন কৌশলের। সরকার ও নির্বাচন কমিশন কী ধরনের কৌশল নিতে পারে এবং কী কৌশল নিলে কী ফলাফল আসতে পারে বিশ্লেষণ চলছে তা নিয়েই।

কিন্তু যে দেশের মানুষ নির্বাচনকে একটা উৎসব হিসেবে নিতে চায়, সেই দেশে এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো? এর উত্তরটি পাওয়া যাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের কথায়। ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে কি না এ বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন এভাবে, এ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের কারণ রয়েছে। কেননা, এ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনে তারা নিজেদের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারেনি, অনেক কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে। বস্তুত জাতীয় নির্বাচনে যা হয়েছে, তা মূলত এক ধরনের অশুভ আঁতাত। নির্বাচন কমিশন, এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মিলে এই আঁতাত তৈরি করেছিল। যে কারণে এই নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। তাদের কাছ থেকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই না।

এ ধারণা যে শুধু সুজন সম্পাদকই পোষণ করেন তা-ই নয়। মূলত তার বয়ানে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের মতামতটিই প্রতিফলিত হয়েছে। তার কারণ, মাত্র এক বছর আগের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটির দগদগে ক্ষত হয়তো ভুলতে পারছে না দেশবাসী। কী ঘটেছিল সে নির্বাচনে, তার কিছু তথ্য হয়তো অনেকেরই মনে আছে। ... একটি আসনে যত বৈধ ভোট পড়েছে, তার ৯০ শতাংশের বেশি পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন ১১০ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ১০৮ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বাকি দুজনও আওয়ামী লীগের জোটের শরিক। অন্যদিকে, ১৪৬টি আসনে মহাজোটের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ১০ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৮৩টি আসনে তাদের ভোট ৫ শতাংশেরও কম। তাদের প্রায় সবাই ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী। নির্বাচন কমিশন সূত্রে পাওয়া ভোটের ফলাফলের প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে একটা-দুটো নয়, ৯১টি কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৫১টিতে ধানের শীষের প্রার্থীর ভোট শূন্য! ৫টি সেন্টারে ১টি করে এবং ৬টি সেন্টারে ২টি করে ভোট পেয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ৯১টির মধ্যে ৬২ সেন্টারে ধানের শীষের প্রার্থী শূন্য বা দু-একটি করে ভোট পেয়েছেন, সেই সেন্টারগুলোতে ভোট পড়ার হার অন্য কেন্দ্রের তুলনায় বেশি। এই কেন্দ্রগুলোর প্রায় সবগুলোতেই ভোট কাস্টিংয়ের হার ৯৪ থেকে ৯৯ শতাংশ।

সিরাজগঞ্জ-১ আসনেও প্রতিপক্ষ ধানের শীষের প্রার্থীকে হাজারখানেক ভোট ধরিয়ে দিয়ে নৌকার প্রার্থী জয়ী হয়েছেন সোয়া তিন লাখ ভোটে! এ আসনে ১৬৮ কেন্দ্রের মধ্যে ৮৫টি কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থী পেয়েছেন শূন্য ভোট। ১১টি কেন্দ্রে ১ ভোট করে, ১৩টি কেন্দ্রে ২টি করে ও ৬টি কেন্দ্রে ৩টি করে ভোট। অথচ এসব কেন্দ্রেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতোই ভোট পড়ার হার ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ভোটের চিত্র সারা দেশে প্রায় একই ধরনের ছিল। সুজনের দেওয়া তথ্য মতে, এ নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬ হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে, এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯টি।

কিন্তু কেন এতটা অস্বাভাবিক ফলাফল হয়েছিল সে নির্বাচনে? তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির দেওয়া তথ্যেও। ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, ৩০০ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া ৫০টি আসনের ৪৭টিতে নির্বাচনের দিন কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা পেয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়।

নির্বাচনটি এতটাই বাজে হয়েছে যে, শুধু বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, সিপিবিসহ সরকারবিরোধী অংশই নয়, সরকারের শরিক দলগুলো থেকেও জালিয়াতির অভিযোগ বা দায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নৌকার এমপি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।’

মহাজোটের আরেক শরিক দল বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ লিখিত বক্তব্যে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ উদ্দীপনা ও আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের পরে বিষণœতায় আক্রান্ত হয়েছে পুরো জাতি। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রশাসনের এক শ্রেণির অতি-উৎসাহী অংশ ভোটের পূর্ব রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত করেছে।

অনেক বিদেশি গণমাধ্যমের মতো প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টও এই নির্বাচনকে বলেছে, একটি স্বচ্ছ জালিয়াতির নির্বাচন। ‘অবিচুয়ারি অব এ ডেমোক্রেসি : বাংলাদেশ’ নিবন্ধে পত্রিকাটি বাংলাদেশের সে নির্বাচনকে বলে একটি ‘ফ্রডুলেন্টলি ট্রান্সপারেন্ট ইলেকশন’। এমন জালিয়াতির নির্বাচনের একটি দগদগে ক্ষত আছে এ দেশের মানুষের, যার বর্ষপূর্তি হলো মাত্র তিন দিন আগেই। তার ওপর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের তোড়জোড় দেখাচ্ছে নির্বাচন কমিশন, যাতে নৌকার প্রার্থী ছাড়া আর কারও সায় নেই। ইভিএম নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক আছে। এমনকী আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী বারবারা সায়মন পর্যন্ত দি আটলান্টায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন ইভিএমে জালিয়াতির বিস্তারিত। এ বিষয়ে সুজন সম্পাদক ডয়চে ভেলের কাছে বলেছেন, ইভিএম একটি বড় অংশের ভোটারদের ভোট প্রদান থেকে বঞ্চিত করছে। আমরা যদি গত জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায় ২৯৪টি কেন্দ্রে সাধারণ ব্যালট আর বাকিগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। ইভিএমে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ আর পেপার ব্যালটে ৮০ দশমিক ৮০। তাহলে ৩০ শতাংশের ফারাক কেন। সে ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। হয় ইভিএমের ত্রুটি অথবা জটিলতা, কিংবা ইভিএমের প্রতি মানুষের অনীহা থেকেই ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ দায়ভার কে নেবে? এ পদ্ধতির যৌক্তিকতা কোথায়? সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার তাই একটি মস্ত বড় ভুল হবে।

তবে সাধারণ পদ্ধতি ও ইভিএমে ভোটের এ ব্যবধানের জন্য ইভিএম কতটা দায়ী আর সাধারণ পদ্ধতিতে নেওয়া কেন্দ্রে জালিয়াতির প্রভাব কতটা সে প্রশ্নটিও থেকে যায়। কারণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। জাতীয় নির্বাচন, বিভিন্ন সিটি নির্বচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা থাকার পরও সরকারের সামনে আরেকটি সুযোগ এসেছে সে কলঙ্কের পথ থেকে সরে আসার। নতুন বছরের প্রথম মাসেই যে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটি হতে চলেছে, তা নিয়ে অনেক অনাস্থা, সন্দেহ, অবিশ্বাস থাকলেও বিএনপি এ নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। এর ফলে নির্বাচনটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে যদি প্রশাসনের ভূমিকাটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে থাকে। ইতিমধ্যে ভোটবিমুখ হয়ে পড়া মানুষকে কেন্দ্রে আনার একটা উদ্যোগ হতে পারে এই সিটি নির্বাচন।


  • লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট 
  • কার্টসি  —  দেশরূপান্তর / জানুয়ারি ২, ২০২০

এখন নিষ্ঠাবান সাংবাদিকদের জন্য কঠিন সময় — কাজী জেসিন

কাজল ঘোষ


কাজী জেসিন। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। কাজ করছেন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রায় পনেরো বছর। গণমাধ্যমে কাজ করার আগে তিনি ফ্রিল্যান্সিং করতেন লিটল ম্যাগসহ সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকায়। সর্বশেষ কাজ করেছেন যমুনা টিভিতে হেড অফ কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পদে। কাজী জেসিন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন মূলতঃ তার পলিটিক্যাল টকশোর মধ্য দিয়ে। তিনি প্রথম টকশো শুরু করেন যখন চ্যানেল আইএ তৃতীয় মাত্রা ছাড়া আর কোন টকশো ছিল না। চ্যানেল ওয়ান-এ একাল কথা, এটিএন-এ একটেল প্রতিদিন, ইটিভিতে একুশে সংকেত, বাংলাভিশনে পয়েন্ট অফ অর্ডার, যমুনা টিভিতে চব্বিশ ঘন্টা ইত্যাদি লাইভ শোর মধ্য দিয়ে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

কিছুদিন হলো মিডিয়ার বাইরে। তাকে স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছেনা। অবশেষে ফোনে কথা হলো। মানবজমিনকে তিনি বললেন তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।

লম্বা সময় আপনার অনুপস্থিতি মিডিয়ায়, কেমন আছেন?

- সৎ এবং নিষ্ঠাবান সাংবাদিকদের জন্য একটা কঠিন সময় এখন। দীর্ঘদিন হলো নানা বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছি। জানি, যা করতে পারতাম তার কিছুই করতে পারছি না। দেশে প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশে আর নির্বাচন হয় না, বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ। এরকম একটা অবস্থায় দেশে সাংবাদিকদের দায়িত্ব অনেক। যারাই তাদের দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন, তারাই বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে চাইলেও সেটা সবসময় সম্ভব হচ্ছে না। তবু এই ভেবে ভাললাগে যে ক্ষমতার কাছে মাথা নত করিনি।

ঠিক এ মুহূর্তে আপনি কি নিয়ে ব্যস্ত?

- এ মুহূর্তে আমি দেশের বাইরে। কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই মুহূর্তে যুক্ত নই।

এরপর কোন চ্যানেলে দেখতে পাব আপনাকে?

- এখনই কিছু বলতে পারছিনা। দেখা যাক।

দীর্ঘদিন সংবাদ মাধ্যমে কাজ করছেন। একজন টকশো হোস্ট, সর্বোপরি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা কি মনে হয়েছে?

- আস্থা। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দর্শকদের আস্থা রক্ষা করা। দর্শক আস্থা রেখেই সময় নিয়ে একটা টকশো দেখেন। সেখানে আপনি আপনার এনালাইসিস দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করতে পারেন না। সেজন্য যে কোন বিষয় বা তথ্য তুলে ধরার আগে সেই তথ্য বা বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নিয়ে তা করা উচিত। দর্শকদের সঙ্গে সৎ থাকা উচিত। পলিটিক্যালি বায়াসড হওয়া কোন অপরাধ না, সেক্ষেত্রে কেউ যদি তার বায়াসডনেস থেকে কোন বিষয় তার মতো করে তুলে ধরেন, সেটাও দর্শকদের জানানো উচিত যে, এই অনুষ্ঠান থেকে আমরা এই বিষয়কে সমর্থন করি। দর্শকদের  সেটা ভাল লাগবে।

আপনি যখন টকশো শুরু করেন তখন তো কোন নারী পলিটিক্যাল ইস্যুতে লাইভ টকশো শুরু করেন নি, এখন অনেকে করছেন। তাদের শো আপনার কেমন লাগে?

- নারী সাংবাদিক বা নারী টকশো হোস্ট হিসেবে না দেখাই ভাল। দেখেন ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিকশিত হবার সময় আমরা কাজ শুরু করেছি। আমার ভাল লাগে  দেখে যে নারীদের শুধু সংবাদ উপস্থাপনায় থাকার এবং রাখার মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। তবে একটা কথা বলব, সত্য তুলে ধরার মতো সাহস না থাকলে সেই শো কারো করা উচিত নয়। কারণ আল্টিমেটলি দর্শক টিভি উনার্সদের নয় দোষ দিয়ে থাকেন সেই উপস্থাপককে। আর সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য কেউ এই পেশায় আসে না। সুতরাং দর্শকদের সঙ্গে সৎ থাকা খুব জরুরি।

অনেক টকশো পরিচালনা, উপস্থাপনা করেছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আইভি এলপিএলামনাই। কাজ করেছেন ওয়াশিংটনে ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড-এ পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক সুসান মোলার-এর সঙ্গে। দেশেও বেশকিছু অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন যেমন বিসিআর সেরা উপস্থাপক, সাঁকো টেলিফিল্ম সেরা উপস্থাপক, সিজেএফবি সেরা উপস্থাপক ইত্যাদি। জাতীয় কবি সম্মেলনেও কবি সংসদ পুরষ্কার পেয়েছেন। নিজের পরিতৃপ্তির জায়গা কতটুকু?

- আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত সাংবাদিক সায়মনড্রিংয়ের সঙ্গেও কাজ করেছি। তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। পুরষ্কার দিয়ে কিন্তু পরিতৃপ্তি আসে না। সব সময় মনে হয় কিছুই করতে পারিনি আমি। তবে একটা জায়গায় আমার পরিতৃপ্তি কাজ করে, সেটা হলো, নিজের স্বার্থের জন্য কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি। আমি লড়াই করছি, করে যাব। এই বিষয়ে আজ না ভবিষ্যতে কোন এক সময় আরো কথা হবে।

বিভিন্ন সময় শুনতে পাই কিছু কিছু টেলিভিশনে সাংবাদিকরা সময়মতো বেতন পান না। এই অবস্থার সৃষ্টি কেন হলো? মিডিয়ার সামনের দিনগুলো কেমন দেখছেন?

- ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সামনে করুণ দিন অপেক্ষা করছে। মানুষ টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক অন্যান্য দেশে ও মানুষের জীবনে জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু তা টেলিভিশন এর বিকল্প হয়ে উঠেনি। আমাদের দেশের মানুষ তথ্যের জন্য এখন নির্ভর করছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ওপর। টেলিভিশনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেললে মানুষ টিভি দেখবে কেন?  আর মানুষ টিভি না দেখলে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো বিজ্ঞাপনই বা আগের মতো দেবে কেন?    
  

আপনি তো অনেক অল্প বয়স থেকে কবিতা লেখেন। দুটি বই রয়েছে আপনার। কবিতার সঙ্গে গণমাধ্যমের কোন সংযোগ আছে?

- ভাল প্রশ্ন। সংযোগ আছে। গণমাধ্যমে কাজের মধ্য দিয়ে আপনি মানুষের দুঃখ,  বেদনা, যাতনার সঙ্গে বেশি জড়িয়ে যান। আর সেগুলো কবিতায় প্রভাব ফেলে। তবে টিভিতে কাজ করতে গিয়ে কবিতায় আমি মনোযোগ দিতে পারিনি। কবি আল মাহমুদ এর একটি কথা মনে পড়ে। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, শোনো, কবিতা কিন্তু  কোন পার্টটাইম জব না, এখানে ফুলটাইম সময় দিতে হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে
- আপনাকেও ধন্যবাদ, আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য।

  • কার্টসি মানবজমিন/ জানুয়ারি ২, ২০২০

নিত্যপণ্য — বছর শুরু অস্বস্তিতে









শুরু হয়েছে নতুন বছর। ক্রেতাদের আশা ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গত বছরের চেয়ে কিছুটা কমে কিনতে পারবেন। গত বছর অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ দিকে বেশকিছু পণ্যের দাম কমার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু নতুন বছরে আবারও নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে চিনি, তেল, পিয়াজ, আদা ও রসুনের দাম। পিয়াজ গত সপ্তাহের থেকে দেশি পিয়াজ প্রায় ৩০ টাকা বেড়েছে কেজিতে। আমদানিকৃত পিয়াজের দাম হালকা কিছুটা বেড়েছে। একমাস আগে সয়াবিন তেলের যে মূল্য ছিল, এখন তা কেজিপ্রতি গুনতে হবে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি।

আর সপ্তাহের ব্যবধানে ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি দামে কিনতে হবে সয়াবিন তেল। চিনির দামও বেড়েছে। গত সপ্তাহের থেকে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি গুনতে হবে একজন ক্রেতাকে। এছাড়া মান ভেদে সপ্তাহের ব্যবধানে আদার দাম কেজিতে ৩০ টাকা এবং রসুনের দাম কেজিতে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানীর কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বেসরকারি চাকরিজীবী খলিল আহমেদ বলেন, কিছুই করার নেই ভাই। ডিসেম্বরের শেষ দিন বাড়িওয়ালা ডেকে বলে আগামী মাস থেকে নাকি ১ হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিতে হবে। এদিকে বাজারে এসে দেখি পিয়াজ, তেল ও চিনি সবকিছুর দামই বেড়েছে। এত টাকা কই পাব বলেন।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি দেশি পিয়াজ ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহে খুচরা পর্যায়ে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এদিকে আমদানি করা চীনা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। যা গত সপ্তাহে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কাওরান বাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী মোকলেছুর রহমান বলেন, নতুন মৌসুমে দেশি পিয়াজের সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণে পিয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে চিনির দাম গত সপ্তাহের থেকে ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে যে চিনি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়।

এদিকে, সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে লিটারে ৮ টাকা বেড়েছে। সঙ্গে প্যাকেটজাত চিনির দাম বাড়ানো হয় কেজিপ্রতি ৭ টাকা। এর আগে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খোলা সয়াবিন তেলের দামও লিটারপ্রতি ৮ টাকা ও পাম সুপার তেলের দাম ১৬ টাকার মতো বেড়েছে। বাজেটের পর এখন পর্যন্ত খোলা চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১২ টাকা।

টিসিবির হিসাবে, বর্তমানে গত বছরের তুলনায় ১৮টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি। আর কমেছে ৭টি পণ্যের দাম। যেসব পণ্যের দাম কমেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, চাল, রুই মাছ, ইলিশ মাছ, ব্রয়লার মুরগি, লবণ, ডিম ও লবঙ্গের দাম। চালের দাম মানভেদে কমেছে ৪ থেকে ১৮ শতাংশ, রুই মাছ ১১, ইলিশ মাছ ৬, ব্রয়লার মুরগির দাম ১১ শতাংশ, লবণের দাম ৫, ডিমের দাম ৩ ও লবঙ্গের দাম ৩০ শতাংশ কমেছে।

এছাড়া জরুরি পণ্যের মধ্যে যেগুলো দাম বেড়েছে তার মধ্যে রয়েছে- খোলা আটা, ময়দা, খোলা সয়াবিন তেল, পাম তেল, মসুর ডাল, আলু, পিয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, গুঁড়ো দুধ, গরুর মাংস, দেশি মুরগি, গরম মসলা, দারুচিনি ও এলাচি। ব্যবসায়ীরা জানান, এক সপ্তাহ আগে যে রসুনের (দেশি) কেজি ১৬০ টাকা বিক্রি হতো, সেই রসুন এখন ২০০ টাকা। আর ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আদা ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারের দামের সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দামের পার্থক্য পাওয়া গেছে। তবে টিসিবির হিসাবেও সপ্তাহের ব্যবধানে আদা ও রসুনের দাম বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪০ টাকার মতো।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশি পিয়াজ ১৬০-১৮০ টাকা এবং আমদানি করা পিয়াজ ৬০-১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে, বাজারে শীতের সবজি ভরপুর থাকলেও তা ক্রেতাদের স্বস্তি দিচ্ছে না। সরবরাহ বাড়লেও কোনো সবজির দাম কমেনি, বরং কিছু সবজির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে। সবজি বাজারে করলা, বরবটি, ঢেঁড়স, টমেটো ছাড়া সব সবজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার নিচে। বাজারে প্রতিকেজি করলা ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, বরবটি, ঢেঁড়স আর টমেটো ৬০ থেকে ৮০ টাকা এবং কাঁচা টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। এছাড়া বাজারে ছোট-মাঝারি মানের ফুলকপি ২০-২৫ টাকা, বড় ভালো মানের ফুলকপি ৩৫-৪০টাকা দরে এবং বাঁধাকপি ৩০-৩৫ টাকা, শালগম ৩০ টাকা এবং মিষ্টি কুমড়া (ছোট) ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে লাউয়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। গত সপ্তাহে যে লাউ ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। বাজারে ভালো মানের শিম ৫৫-৬০টাকা এবং নিন্মমানের সিম ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মুলা ২০-২৫ টাকা, লম্বা বেগুন ৫০ টাকা, সাদা গোল বেগুন ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে এবং নতুন আলু ২৫-২৭ টাকা, পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ৫০-৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

মাছের বাজারে কেজি প্রতি নদীর আইড় ৮০০ টাকা, বোয়াল ৫০০ টাকা, কোরাল ৪৮০ টাকা, কাতল ২৭০ টাকা, রুই ২৮০, বেলে ৫০০ টাকা, পাবদা ৫৫০ টাকা, টেংরা ৬০০ টাকা, চিংড়ি সাইজ ভেদে ৪০০-৪৫০ টাকা, পুঁটি ২৮০ টাকা, দেশি টেংরা ৪০০ টাকা, মেনি ৪০০ টাকা, নওলা ৩৮০ টাকা, বড় শিং ৪৫০ টাকা, মাগুর ৫০০ টাকা, টাকি মাছ ২৮০ টাকা এবং এক কেজির শোল ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মাংসের বাজারে গত সপ্তাহের তুলনায় ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। যা গত সপ্তাহে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানি কর্ক মুরগি ২১০ টাকা, লেয়ার মুরগি ১৮০ টাকা, দেশি মুরগি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস ৫৩০ থেকে ৫৫০ টাকা এবং খাসির মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা ডজন এবং দেশি মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা হালি।

  • কার্টসি —  মানবজমিন / জানুয়ারি ৪, ২০২০