মরিয়ম চম্পা
রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, বাস-ট্রেন, ঘরে-বাইরে- কোথায় নিরাপদ নারী? সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আলোচিত ক’টি ঘটনায়- এ প্রশ্ন সর্বত্র। রাজধানীর কুর্মিটোলায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ এবং ধামরাইয়ে বাসে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে এক তরুণীকে। ওদিকে রাজধানীর ভাটারায় এক কিশোরীকে বাসার সামনে থেকে ডেকে নিয়ে গণধর্ষন করা হয়েছে। দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণ, নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে। এ থেকে মুক্তি কীভাবে? আর কেনইবা মানুষ এভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে ঘরে এবং বাইরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি দিন দিন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই নারীদের পদচারণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীন বিচরণে নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও প্রশ্নের মুখোমুখি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২জন। অর্থাৎ, গত ২০১৮ সালের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকে দায়ী করেন। তবে রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার আরো অনেক উপাদান আছে বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার একটি অংশ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো মামলা হয় না। আর যেগুলোর মামলা হয় বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেখানে শতকরা মাত্র তিন ভাগ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের কোনো ঘটনায় বিচার হয় না। তবে এর বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, যারা ধর্ষক তারা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে শক্তিশালী। অন্যদিক বাদ দিলেও লৈঙ্গিকভাবে পুরুষ শক্তিশালী। তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী। নারীদের সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্র তা পালন করছে না। আর নারীদের বাইরে বের হওয়া কিংবা কাজে যাওয়ার বিষয়গুলোকে সমাজে এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না। নারীর বাইরে বের হওয়াকে পুরুষের ক্ষমতা খর্ব হওয়া হিসেবে দেখা হয়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গণপরিবহনে ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সম্প্রতি নারীদের একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে। বাসে যাত্রী কম হলে সতর্ক থাকা। অধিক যাত্রীসংবলিত গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা। গাড়িতে না ঘুমানো। বাসে বসে পরিবারের কাউকে ফোন করে উচ্চ স্বরে নিজের অবস্থান জানিয়ে রাখা। গন্তব্যে যাওয়ার আগেই যাত্রীরা নেমে গেলে সেখানেই নেমে গিয়ে পরিবারের কাউকে ফোন করে নিয়ে যেতে বলা। গাড়ির ভেতরে অনিরাপদ বোধ করলে জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মনে করেন, নারী এখন ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তার মধ্যে নেই। তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি বাইরে যা ঘটছে তেমনি ঘরের মধ্যে একই ঘটনা ঘটছে। সুতারং নারীর নিরাপত্তার নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। বরং নারীরা এখন ২৪ ঘণ্টাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পার করছে। বাস, ট্রেন, স্কুল, কলেজ সর্বত্রই নারীরা এখন অনিরাপদ অবস্থায় আছে। এটার জন্য আমি মনে করি রাষ্ট্রের অবকাঠামো দায়ী। এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতাও এ জন্য দায়ী।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, নারী শুধু বাংলাদেশে কেন সারা পৃথিবীতে কোথাও নিরাপত্তার ভেতরে নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার একটি প্রচণ্ডরকম সংস্কৃতি দেখা গেছে। রাস্তায়, গাড়িতে, অফিসে, বাসায় কোথাও তারা নিরাপদ না। যার প্রমান অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। এদেরকে দমনের ক্ষেত্রে যে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল তা আমরা কতটুকু নিতে পারছি সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, নারী পৃথিবীর কোথাও নিরাপদ না এখন। এর কয়েকটি কারণ এবং ধরণ আছে। একটি গ্লোবাল অপরটি ন্যাশনাল। গ্লোবালি নারীদের পুঁজিবাদের অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে নারী সেখানে পণ্যের চেয়ে বেশি কিছু না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু আছে এটা তারই অংশ। অপরাধী যখন অপরাধ করে পার পেয়ে যায় তখন মানুষের মনে সমাজ, আইনি কাঠামো ইত্যাদিতে খুব বেশি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারীকে পুঁজিবাদের অংশ এবং ভোগপণ্য হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। একইসঙ্গে বিচাহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়গুলোকে কোনোভাবে যেন পলিটিক্যালি জাস্টিফাই না করা যায় তা মাথায় রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তিনিও প্রশ্ন রাখেন- দেশে নারীরা কোথায় নিরাপদ। সেটি ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্র বা সমাজ কাঠামোর কোথাও তারা নিরাপদ না।
- কার্টসি - মানবজমিন/ ১৩ জানুয়ারি ২০২০