Search

Wednesday, February 5, 2020

গোপন কক্ষের নিরাপত্তা দিতে পারেনি ইসি!

সাইদুর রহমান

এবারের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের গোপনকক্ষের শতভাগ নিরাপত্তা দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গোপনকক্ষে ভোটারের নিরাপত্তা না থাকায় ভোটকেন্দ্রে গিয়েও ফিরে আসেন অনেক ভোটার। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল গোপনকক্ষের নিরাপত্তা থাকবে কি না? কিন্তু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ভোটে গোপনকক্ষের পাহারায় ছিল বাইরের কেউ না কেউই। অথচ গোপনকক্ষে ভোটার ছাড়া অন্য কারোর প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবচিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। যদিও কমিশন বলছে, এই গোপনকক্ষের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তাদের নিরাপত্তা শিথিলতার কারণে এমনটি হতে পারে। গোপনকক্ষের নিরাপত্তা যে বিঘ্নিত ঘটেছে তা অস্বীকারও করছে না কমিশন।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, কিছু কিছু জায়গায় এটা হয়েছে। তবে প্রতি কেন্দ্রে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ট থাকলে এই সমস্যা হতো না। তবে এই সমস্যা হলেও প্রিজাইডিং অফিসাররা কমিশনকে কিছুই জানায়নি। আমি মনে করি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনার মূল দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। নির্বাচন কমিশন যেমন কেন্দ্রভিত্তিক পরিকল্পনা করে এগিয়েছে সেই ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছিল না রাজনৈতিক দলগুলোর।

এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় উদ্বিগ্ন কমিশন। উত্তর-দক্ষিণ সিটিতে ভোট পড়েছে মাত্র ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। মাত্র ১৫ এবং ১৭ শতাংশ ভোটারের রায় নিয়ে ঢাকা উত্তরে মো. আতিকুল ইসলাম এবং দক্ষিণে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি কমের বেশকিছু কারণ সামনে এনেছে ইসি। এর মধ্যে টানা তিনদিন সরকারি ছুটি, ভোটের তারিখ পরিবর্তন, উচ্চ শ্রেণি এবং শিক্ষিত ভোটারদের বড়ো অংশের অনুপস্থিতি, ইভিএম নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা। কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা বন্ধে নির্বাচনে ইভিএম সংযোজন করা হয়। দেখা গেছে, সেই ইভিএমেও এবার কেন্দ্র দখল না করে শুধু গোপনকক্ষের দখল নিয়ে ফলাফল নিজেদের অনূকুলে আনা হয়েছে। ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটের ফিঙ্গার ম্যাচিংয়ের পর ব্যালট ইউনিটটি ছিল মূলত গোপনকক্ষে। যেসব ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন তাদের ঐ গোপনকক্ষে প্রভাবশালী ব্যক্তির উপস্থিতিতেই ব্যালট ইউনিটের বাটন চাপতে হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষ গোপনকক্ষে অবস্থান করা প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেই ভোটারের জন্য সংরক্ষিত ব্যালট ইউনিটের বাটন চেপে অন্যের ভোট দিয়েছেন। এসব ঘটনা নজরে এসেছে ইসির। ফলে ইভিএমেও যে জাল ভোট পড়তে পারে তা এবারের ভোটে প্রমাণিত হয়েছে।

ভোটকেন্দ্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ সাধারণত প্রিজাইডিং অফিসারের হাতে থাকলেও বেশিরভাগ অফিসার প্রভাবশালীদের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন। এছাড়া নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনেকেই ঝামেলায় না জড়িয়ে চলমান প্রক্রিয়ায় সঙ্গে মিশে যান। ভোটকেন্দ্রের বাইরে ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির দীর্ঘ লাইনও ছিল একটি সাজানো পরিকল্পনা।
  • কার্টসি - ইত্তেফাক/ ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২০ 

Monday, February 3, 2020

আস্থা ফেরাতে পারেনি ইভিএম

মসিউর রহমান খান

ভোটার উপস্থিতি কম

মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নারীদের গোপন কক্ষে এক পুরুষ সদস্য ঢুকে জোর করে ভোট দেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাজিদ হোসেন

ঢাকার দুই সিটি ভোটের ফল ঘোষণার পর জয়-পরাজয়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে। কেউ কেউ এ জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারকে দায়ী করছেন। এ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কমতি ছিল না।

নির্বাচনের দিন বড় ধরনের কোনো গোলযোগের ঘটনা ঘটেনি। তবে নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে- তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্নেষণ। ভোটের সব ধরনের অনিয়ম দূর করতে ইভিএম ব্যবহারের কথা জানিয়েছিলেন ইসির শীর্ষ কর্তারা। তবে ফল ঘোষণায় যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে ইভিএম তাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দুই সিটির দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণায় দেরি হওয়ায় গতকাল সাংবাদিকদের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে, ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বুথের গোপন কক্ষে বহিরাগতের উপস্থিতি  ইভিএমের সাফল্য অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন। পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধাদান, প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা ও হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগেও প্রশাসনের ভূমিকা যথাযথ ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে ইসির ওপর জনগণের আস্থাহীনতা এই ভোটের পরও একই অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্নেষকরা। নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি হরতালসহ নানা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।

এদিকে, প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ভোট পড়েছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর বলেছেন, এর কারণ জানতে গবেষণা করতে হবে। গতকাল রোববার নির্বাচন ভবনে ভোটের ফল নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতির হার উত্তরে ২৫ দশমিক ৩০ ভাগ ও দক্ষিণে ২৯ দশমিক ০০২ ভাগ। গড়ে দুই সিটিতে ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ। তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতির এ হারে ইসি অসন্তুষ্ট নয়, তবে আরও ভোট পড়লে তারা খুশি হতেন। তাদের ধারণা ছিল, ৫০ ভাগের মতো ভোট পড়বে।

ইসির কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটের সব অনিয়ম দূর করার পাশাপাশি দ্রুত ফল প্রকাশের কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু সনাতনী ব্যালটে ভোট গণনার তুলনায় ইভিএমে কম সময় লাগেনি। এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম বলেছেন, যান্ত্রিক ত্রুটিই এই দেরির কারণ। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন শনিবার রাতে ফল ঘোষণার সময়ই বলেছিলেন, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে ফল প্রকাশে দেরি হয়েছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইভিএমে এবার উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ভোট পড়েছে মাত্র ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ কাগজের ব্যালটে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দুই সিটিতে ভোট পড়েছিল ৪৩ শতাংশ। ওই নির্বাচনে দুপুরের পরপরই অধিকাংশ মেয়র প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবারে কম ভোট পড়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের আস্থাহীনতা কাজ করছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, অনাস্থার কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে যাননি, এটা তার মনে হচ্ছে না। জনগণ ছুটি পেয়েছে, অনেকে ছুটি উপভোগ করেছে। কেউ কেউ ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ছয় আসনে ভোটের হার ছিল ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ। তবে ভোটাররা কেন্দ্রবিমুখ একদিনে হয়নি বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইভিএম-ভীতি, নিজের ভোট নিজে দিতে না পারা, কেন্দ্র দখলের আশঙ্কা, সহিংসতা, ইসির নিষ্ফ্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণে ভোটাররা কেন্দ্রবিমুখ হচ্ছেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার ছাড়াই ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের আনিসুল হক টেবিল ঘড়ি মার্কায় পেয়েছিলেন চার লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট; তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির তাবিথ আউয়াল বাস মার্কায় পান তিন লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। শতকরা ভোট পড়েছিল ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওই সময় মোট ভোটার ছিল ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯০০। এবার দলীয় প্রতীকের ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন চার লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট। নিকটতম বিএনপির তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট। ভোট পড়ার হার ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। মোট ভোটার ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। গতবারের তুলনায় এবার ১২ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাননি। আতিকুল ভোট পেয়েছেন ৫৯ শতাংশ আর তাবিথ ৩৫ শতাংশ। তারা মোট ভোটারের পর্যায়ক্রমে ১৫ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

অন্যদিকে ২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৮ জন। এখানে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ইলিশ মাছ প্রতীকে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে মেয়র পদে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস মগ প্রতীক নিয়ে ভোট পান দুই লাখ ৯৪ হাজার ২৯১টি। ভোট পড়েছিল ৪৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি বছর ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ ভোটারের মধ্যে ইভিএমের ভোটে আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন চার লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ইশরাক হোসেন পেয়েছেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট। ভোট পড়েছে শতকরা ২৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। দক্ষিণে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাননি। তাপস শতকরা ৬০ শতাংশ আর ইশরাক ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। মোট ভোটারের মধ্যে তারা পেয়েছেন ১৭ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ ভোট।

ইভিএমে অনুষ্ঠিত রংপুর-৩ এবং চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে দেখা গেছে, ভোট দেওয়ার হার খুবই কম। গত বছরের ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত রংপুর-৩ আসনে ভোট পড়ে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইভিএমে অনুষ্ঠিত এই আসনে ভোট পড়েছিল ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়ে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একইভাবে গত ১৩ জানুয়ারি চাঁদপুরের হাইমচর পৌরসভার নির্বাচনে ভোট পড়ে ৪০ শতাংশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়। ব্যালটের সনাতন পদ্ধতিতে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ। আর ইভিএমের ছয় আসনে ভোটের হার ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ভোটারদের আস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনার ও সরকার ভোটারদের কোনোভাইে বিশ্বাস স্থাপন করাতে পারছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে গণতন্ত্র শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোট দিতে পারেনি- এমন অভিযোগ রয়েছে। ওই নির্বাচনে নিজের ভোট দিতে না পারায় ভোটাররা ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব এর পরের সব নির্বাচনে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে যত যাই বলা হোক না কেন, নির্বাচনগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাস্তবতা হলো, ভোটাররা যখন দেখেন তাদের ভোট আগেই হয়ে যায়, তখন তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ আর পায় না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা যেমন ছিল, তেমন ইভিএম ভীতিও কাজ করেছে। তিনি বলেন, ভোটাররা মনে করছেন, তাদের ভোটে কোনো পরিবর্তন ঘটে না; যা হওয়ার তাই হবে। তাই তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা মনে করেন, কেন্দ্রে ভোটার আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করা। ভোটারদের কেন্দ্রে আনার প্রধান কাজ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের।

  • কার্টসি - সমকাল/ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০ 

‘নেই’ আর ‘নেই’-এর নির্বাচন

বদিউল আলম মজুমদার
ডিএসসিসি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় ছিল এমন সুনসান। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাতটি কেন্দ্রে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়। পর্যবেক্ষণ থেকে আমার কিছু অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল ‘নেই’ আর ‘নেই’-এর নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভোটার নেই, ভোটারদের আগ্রহ নেই, প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট নেই, সহিংসতা নেই, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর চাপ নেই, সর্বোপরি ভোটারদের আস্থা নেই ইত্যাদি।

আমার দেখা সাতটি কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র, ঢাকা পলিটেকনিক ল্যাবরেটরি স্কুল, সেগুনবাগিচা হাইস্কুল (দুটি কেন্দ্র), বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজ (দুটি কেন্দ্র)। এর মধ্যে চারটি ছিল ঢাকা উত্তরের এবং তিনটি ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত।
বদিউল আলম মজুমদার

দিনটি শুরু হয়েছিল সকাল আটটায়, যখন আমি সপরিবার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যাই। আমরা নির্বিঘ্নেই ভোট দিতে পেরেছি। যখন বুথে উপস্থিত হই, তখন আমি মাত্র আরেকজন ভোটারকে দেখতে পাই। বাইরেও তখন কোনো লাইন ছিল না। কিছু তরুণ ঘোরাঘুরি করছিল, তাদের সবার গলায় নৌকা কিংবা সরকারি দল-সমর্থিত এবং সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন স্থানীয় কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর ব্যাজ ছিল। বিএনপি এবং বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর ব্যাজ পরা কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি আমার চোখে পড়েনি।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটি বুথে ৩৫৯ জন ভোটারের মধ্যে ৩০ জন বা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট জমা পড়ে। ঢাকা পলিটেকনিক ল্যাবরেটরি স্কুল কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পড়েছিল ১ হাজার ৫৩৫ ভোটের মধ্যে ১৭২ টি, যা ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২ হাজার ৪৫৬ জনের মধ্যে ৩৯০ জন বা ১৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট দেন।

সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের একটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৮ জনের মধ্যে ২৪৪ জন বা ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ ভোট পড়ে। ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টার মধ্যে ২ হাজার ১২৮ জনের মধ্যে ২২৫ জন বা ১০ দশমিক ৫৭ ভোট পড়ে। বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে বেলা দুইটা পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৩ জনের মধ্যে ৩৯২ জন (১৬.৫২ %), মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের পুরুষ কেন্দ্রে দুইটা পর্যন্ত ২ হাজার ২৩২ জনের মধ্যে ৪০০ জন (১৭.৯২ %), ওই প্রতিষ্ঠানের নারী কেন্দ্রে বেলা তিনটা পর্যন্ত ২ হাজার ৬৯৩ জনের মধ্যে ২৭০ জন (১০.০৩ %) ভোট দেন। আমি তিনটার দিকে যখন মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে যাই, তখন সেখানে ভোটারের উপস্থিতি প্রায় ছিলই না, বাইরেও তেমন কাউকে দেখা যায়নি।

আমার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ঘোষিত ভোটের হার সংগতিপূর্ণ নয় বলেই আমার মনে হয়। ইভিএমে ভোট গ্রহণ করায় দ্রুত ফল ঘোষণা করার কথা থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত সব ফলাফল পাওয়া যায়নি, যা এই সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে। ইভিএম ব্যবহারের কারণে পুনর্গণনা করে তা বের করারও সুযোগ নেই—কমিশন যে তথ্য দিয়েছে, তাই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তবে ভোটের হার কম হলে নির্বাচন অবাধ হয় না এবং জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।

এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি শুধু নগণ্যই ছিল না, ভোটারদের মধ্যে ভোট দেওয়ার আগ্রহও অনেক কম ছিল। বেলা তিনটার দিকে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে পাঁচজন যুবকের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যারা খালি রাস্তা পেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে নির্বাচনের আগে দুই প্রধান দল একে অপরের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলের যে অভিযোগের তির ছুড়েছে, তাতে তারা আতঙ্কিত হয়ে ভোট দিতে যায়নি। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশের ফলে তাদের মধ্যে আরও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে যে ভোটের ফলাফল এরই মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে।

আমি যে সাতটি কেন্দ্রে গিয়েছি, তার একটিতেও ধানের শীষের কোনো এজেন্ট দেখিনি। ছয়টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা বলেছেন যে ধানের শীষের এজেন্ট আসেইনি। আরেকটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ধানের শীষের এজেন্ট এসেছিল, কিন্তু তারা কোথায় তা তাঁর জানা নেই।

এসব কেন্দ্রের বাইরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের একধরনের জটলা, বস্তুত মহড়া দেখেছি, যা অন্যদের ওপর একধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে বাধ্য। তবে কোথাও কোনো উত্তাপ দেখিনি। কেন্দ্রে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকার কারণেই কোনো উত্তাপ-উত্তেজনা ছিল না।

যে কয়টি কেন্দ্রে আমি গিয়েছি, সেগুলোতে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অনেক কেন্দ্রেই নিচতলার পরিবর্তে ওপরের তলায় বুথ স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে বুথ ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়। সেখানে বয়স্ক ব্যক্তিকে ধরাধরি করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে দেখেছি।

সাতটি কেন্দ্রে অনেকের সঙ্গে আলাপ করে তাদের মধ্যে ব্যাপক আস্থার অভাব অনুভব করেছি—ইভিএমের ওপর আস্থার অভাব, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার অভাব। ইভিএম ও ইভিএমের দুর্বলতা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি আগে থেকেই ছিল। এর সংগত কারণও রয়েছে। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনারও স্বীকার করেছেন যে আগের ভোটে ব্যবহৃত ইভিএমে ত্রুটি ছিল (যুগান্তর, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯), যে ত্রুটির ব্যাপারে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি এবং তা দূরীকরণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা-ও বলেননি। এ ছাড়া ইভিএমের ব্যবহার সম্পর্কেও কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ দেখা যায়নি। ইভিএম নিয়ে সন্দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইভিএম পরিচালনাকারী নির্বাচনী কর্মকর্তা তথা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে ভোটারদের মনে ব্যাপক আস্থাহীনতা। গত জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেকের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে, তারা ভোটকেন্দ্রে গেলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তাতে কিছু আসবে-যাবে না—যাদের জেতার তারাই জিতবে। জনমনে গড়ে ওঠা এই সন্দেহ ও আস্থার সংকট কমিশন দূর করতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, সাতটি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণের সময় আমার কাছে একাধিক ব্যক্তি বেশ কিছু অভিযোগ করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের নেতা-কর্মী বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন। জিজ্ঞেস করলে একজন বলেন, যেমন ভোট হওয়ার কথা, তেমনই হচ্ছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের মধ্যে আস্থার অভাব তো কাটেইনি, বরং আরও প্রকট হয়েছে।

পরিশেষে, এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আবারও সুস্পষ্ট হলো যে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ভোটারদের আস্থাহীনতার সমস্যা ব্যাপক। ফলে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ নির্বাচনই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের একমাত্র পন্থা। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে জাতি হিসেবে আমরা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারি, যার মাশুল দল-মতনির্বিশেষে ভবিষ্যতে সবাইকেই গুনতে হবে।

  • বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
  • প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০ 

‘শত বছরের সেরা’ নির্বাচন ও কাকের গল্প

সোহরাব হাসান
ডিএসসিসি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় ছিল এমন সুনসান। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে এক ধরনের হিসাব ছিল। নির্বাচনের পর আরেক ধরনের হিসাব। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হয়ে এখন দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষায়। উত্তরে আতিকুল ইসলাম ৯ মাসের অনুশীলন শেষে জনসেবায় পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করবেন। নির্বাচনী প্রচারে তেমনটিই বলেছিলেন। দক্ষিণে ফজলে নূর তাপস মেয়র হিসেবে নতুন হলেও ১১ বছর জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। পেশায় একজন আইনজীবী। তিনি উন্নত ও আধুনিক ঢাকা গড়ার কাজ শুরু করবেন প্রথম দিনে থেকেই।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচন বানচাল ও প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা প্রতিটি কেন্দ্রে ৫০০ সশস্ত্র ক্যাডার আনার পরিকল্পনা নিয়েছিল। বিএনপির সব ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা ব্যর্থ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ দুই মেয়র প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছে। ঢাকা তাদেরই দখলে থেকে যাচ্ছে। এ বিজয়কে খাটো করে দেখার উপায় কী!

অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, নির্বাচনে হারলেও তারা লাভবান হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতা-কর্মীরা মাসখানেক ধরে সক্রিয় ছিলেন। নেতা-কর্মীদের পালিয়ে বেড়াতে হয়নি। এটি তাদের প্রথম লাভ। দ্বিতীয় লাভ এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। লাভের ফল ঘরে তুলতে এক দিন তারা হরতালও পালন করেছে।

তবে নির্বাচনের পর ‘ইত্তেফাক’ চমৎকার একটি শিরোনাম করেছে: ‘আওয়ামী লীগের ভোটাররাই গেল কই’। তাপস-আতিকের প্রচারণায় বিপুল লোকসমাগম থাকলেও ভোটের দিন তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী যেখানেই গেছেন, আমরা দেখেছি তাঁদের পেছনে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক। তাঁরা ভোট দিলেও নৌকা প্রতীকে ৩০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, আওয়ামী লীগের মিছিলে থাকা কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিএনপির লোকজনও ছিলেন। যদি সেটি না হবে, তাহলে কেন্দ্রে ভোটারের আকাল কেন হলো?

পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা স্লোগান দিতে দিতে মানুষের ঘুম নষ্ট করেছেন। পোস্টারে পোস্টারে ঢাকা শহর ছেয়ে ফেলেছেন। এমনকি ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। কিন্তু ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা মোট ভোটারের মাত্র ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন। উত্তরে আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন ৪ লাখ ১৫ হাজার ৮০২ ভোট। আর দক্ষিণে ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট। অন্যদিকে বিএনপির তাবিথ আউয়াল ২ লাখ ৪২ হাজার ৮৪১ ও ইশরাক হোসেন ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫১২ ভোট পেয়েছেন কেন্দ্রে কোনো এজেন্ট-সমর্থক না পাঠিয়েই।

নব্বই-পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৩ শতাংশের কম ভোট পায়নি। এমনকি ২০০১ সালে তাদের ভূমিধস পরাজয়ের সময়ও আওয়ামী লীগ ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর যখন সারা দেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার, তখনই তাদের প্রার্থীর বাক্সে ভোটের খরা।

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তাঁকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। তিনি কত শতাংশ ভোট পেলেন, সেটি বিবেচ্য নয়। সে ক্ষেত্রে ১৫ কেন ৫ শতাংশের কম ভোট পেলেও আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হতেন। সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কেননা ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব বিরোধী দলই বর্জন করেছিল। এরশাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমান। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিদেশে চাকরি দিয়েছিলেন। আর এরশাদ তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করেছিলেন। পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে আবার ভোট নেওয়া হয়। এখানে সেই ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তাতে ভোটের হার ৫৫ থেকে ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৯১, ১৯৯৬ (১২ জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের কথা বলা যায়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও ভোটারের উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল। ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬০ শতাংশ, ২০১৭ সালে পৌরসভা নির্বাচনে ৭৪ শতাংশ, ২০১৮ সালে পাঁচ সিটি নির্বাচনে ৫৭ শতাংশ থেকে ৭৮ শতাংশ। আর এবারে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, উত্তরে ২৫ দশমিক ৩ ও দক্ষিণে ২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। বাস্তব দৃশ্য অবশ্য বলে ভিন্ন কথা।

সিটি নির্বাচনে কম ভোট পড়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা যেসব কারণ দেখিয়েছে, সেটি মেনে নিলে বিএনপিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দল হিসেবে মেনে নিতে হয়। তাঁরা বলেছেন, বিএনপির নেতিবাচক প্রচারের কারণে ভোটার কম এসেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় বিএনপি চাইলে কেন্দ্রে ভোটার বেশি আসেন, আর না চাইলে ভোটারের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

আওয়ামী লীগের নেতারা একদিকে বলেন, বিএনপির জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, অন্যদিকে দাবি করছেন, তাদের জন্যই ভোটারের উপস্থিতি কম হয়েছে। কোনটি সত্য? যদি বিএনপির জনপ্রিয়তা না-ই থাকবে তাহলে কীভাবে তারা ভোটারদের প্রভাবিত করল?

নির্বাচনের আগে তিন দিন ছুটি থাকায় ঢাকার অনেক মানুষ নাকি গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এ রকম কথাবার্তা বলেছেন তাঁরা। ভোটের আগে তিন দিন ছুটি ছিল না। ছুটি ছিল এক দিন। সরস্বতীপূজায় সরকারি অফিস আদালত খোলাই ছিল। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র কিংবা আশপাশের এলাকায় যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা ঢাকারই বাসিন্দা হলেও ভোটার গ্রামের। ১ ফেব্রুয়ারি গ্রামের ভোটাররা ঢাকায় ছিলেন আর ঢাকার ভোটাররা গ্রামে বেড়াতে গেছেন, এই আজগুবি তথ্য কেউ বিশ্বাস করেন না।

আওয়ামী লীগের নেতাদের কথাবার্তা শুনে নাসিরউদ্দিন হোজ্জার সেই বহুল কথিত কাকের গল্প মনে পড়ল। একজন হোজ্জাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বলুন তো এই শহরে কত কাক আছে?’ তিনি বললেন, ‘৯ হাজার ৯৯৯টি।’ এরপর গুনে দেখা গেল তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। তখন নাসিরউদ্দিন হোজ্জা বললেন, ‘যদি কাকের সংখ্যা বেশি হয় বুঝতে হবে অন্য কোথাও থেকে কাকেরা এখানে বেড়াতে এসেছে। আর যদি কম হয় তাহলে বুঝতে হবে এখান থেকে তারা অন্য কোনো শহরে বেড়াতে গেছে।’

সিটি নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনও। ভোট শেষ হওয়ার পর সিইসি হাসিমাখা মুখে বলেছেন, ভোটারের উপস্থিতি ৩০ শতাংশের কম। তবে দুর্মুখেরা বলেন, গত বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হলে ভোটারের উপস্থিতি ৮০ শতাংশ হতো না বা দেখানো যেত না—২০ শতাংশের কম হতো। গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম-১২ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ২৩ শতাংশেরও কম।

সিটি নির্বাচনের আগে বিএনপির অতি বিচক্ষণ নেতারা তাঁদের সমস্ত শক্তি ও বাক্য ব্যয় করেছেন ইভিএমের পেছনে। ইভিএম কত খারাপ সেটি প্রমাণের জন্য তাঁরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে ইভিএম-ই তাদের ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছে। ইভিএমের কারণে নির্বাচন কমিশন অন্তত দিনের ভোট রাতে করতে পারেনি। ২০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্র না এলেও ৮০ শতাংশ দেখাতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশনে গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ (উত্তরে ২৫.৩ ও দক্ষিণে ২৯ শতাংশ) ভোট পড়ে থাকলে ৭৩ শতাংশ ভোটার এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাঁরা ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

যে নির্বাচনে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোটার গরহাজির থাকেন, সেই নির্বাচনকেই আওয়ামী লীগ নেতারা শত বছরের সেরা নির্বাচন বলে দাবি করেছেন। এর চেয়ে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব আর কী হতে পারে?

  • সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
  • প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০ 

স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ এবং...

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে গত রোববার ধর্ষণের একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে স্কুলপড়ুয়া নবম শ্রেণির ৪ জন ছাত্রী বেড়াতে গিয়ে ৩ জনই ধর্ষণ এবং অপরজন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঘটনাটি বর্তমানে ‘টক অব দ্য টাউন’ হিসেবে বিবেচিত। শুধু টাঙ্গাইল নয়, বাস্তবে সারা দেশেই শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী, ছাত্রী, গৃহিণী এবং অশীতিপর বৃদ্ধা পর্যন্ত এ ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এর আগেও সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ জানিয়ে সাধারণ মানুষ, মানবাধিকার সংগঠন, এনজিও এবং পত্রিকা ধর্ষকদের বিচার দাবি করছে। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আমি সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণের সংস্কৃতি, কার্যকারণ এবং করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।

স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি

বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে দেশে বর্তমানে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বিরাজ করছে। ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বলতে এমন এক সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়, যেখানে সমাজের প্রত্যেক নারী, শিশু কিংবা কিশোরী বালিকা ধর্ষণের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি। এ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ নারী-নারীর মধ্যে প্রায় ৪ জন নারী-শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। আমরা দেখতে পাই ১৯৯১, ২০০১, ২০১১ ও ২০১৮ সালে প্রতি লাখে ধর্ষণের হার যথাক্রমে ০.৩৯ জন, ২.৩৭ জন, ২.৩৮ জন ও ২.৪৫ জন। শুধু পরিসংখ্যান বিবেচনায় ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের এ হার বাড়ার পরিমাণ প্রায় প্রতি লাখে ১.৩৫ জন বা এক-তৃতীয়াংশ (বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ওয়েবসাইট, ২০১৯)।

মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তিন সন্তান নিয়ে বসেছেন রাজিয়া সুলতানা। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এ নারীর দুই বছর বয়সী শিশুসন্তান আয়েশা মণিকে গত বছরের জানুয়ারিতে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ছবি: দীপু মালাকার












যদিও নারী ও শিশুর প্রতি সার্বিক সহিংসতা বা নির্যাতনের প্রকাশিত ঘটনার মাত্রা আরও অনেক বেশি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে প্রতি লাখে এ হার ৮.১৮ জন ও ৭.২১ জন। আর ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজার ১৫৯টি এবং হার বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করলে প্রায় এটা আগের প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে মোট নারী ও শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৭৩২টি, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১৩টি (আসক, ২০২০)। প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও আরও অনেক বেশি। পরিসংখ্যান বিবেচনায় বাংলাদেশে যে ধর্ষণের সংস্কৃতি বিরাজমান, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ এসব পরিসংখ্যান দেয় না।

ডয়েচে ভেলের তথ্যানুযায়ী, বিদেশি সমীক্ষা মোতাবেক বাংলাদেশে ধর্ষণের হার প্রতি লাখে ১০ জন এবং সমগ্র বিশ্বে আমাদের অবস্থান ৪০তম। ধর্ষণের বেলায় আমাদের থেকে অধঃপতিত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, লেসোথো, বোতসোয়ানা, সোয়াজিল্যান্ড ও সুইডেনে ধর্ষণের হার যথাক্রমে প্রতি লাখে ১৩২ জন, ৯৩ জন, ৮৩ জন, ৭৮ জন ও ৬৩ জন (ডয়েচে ভেলে, ৬ অক্টোবর ২০১৯)। কিন্তু আমার মতে, এসব দেশের মধ্যে বেশির ভাগ আফ্রিকার দারিদ্র্য ও গৃহযুদ্ধপীড়িত দেশ। যদিও পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রতি লাখে ৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়, যা বাংলাদেশের তুলনায় কম। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে বাংলাদেশের তুলনায় ধর্ষণের হার বেশি, সেখানে ব্যাপক জৈবিক, সাংস্কৃতিক, শ্রেণিগত ও নগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বিরাজমান। উল্লিখিত প্রতিটি রাষ্ট্রই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত উপাদানে ‘অসমজাতীয়’।

জৈবিক নয়, সামাজিক

ধর্ষণকে সাধারণত পুরুষের জৈবিক তাড়না হিসেবে দেখা হয়। এর অর্থ হলো ধর্ষণ জৈবিক কাজ হলেও তা সামাজিক কারণে সংঘটিত হয়। সে কারণে এর জৈবিক নয়, সামাজিক প্রতিকারের প্রয়োজন। সামগ্রিক অপরাধের বিচারে ধর্ষণ গুরুতর সহিংস অপরাধ। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পায় না বা প্রকৃতপক্ষে প্রকাশ করা হয় না এবং তার কারণও সামাজিক। ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পেলে পুরুষের যতটা মর্যাদাহানি হয়, তার চেয়ে ঢের বেশি মর্যাদাহানি হয় ক্ষতিগ্রস্ত নারীর।

ধর্ষিত নারী ও শিশুর অধিকাংশেরই অবস্থান সামাজিকভাবে প্রান্তিক। মূলত ধর্ষণের প্রান্তিক পর্যায়ের খেটে খাওয়া পোশাককর্মী, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী নারী, দরিদ্র স্বল্পশিক্ষিত ছাত্রী, গৃহবধূ এবং আদিবাসী নারী। পুলিশ স্টাফ কলেজের (২০১৮) গবেষণা অনুযায়ী, ধর্ষিত নারী ও শিশুদের ৭০.৯ শতাংশের মাসিক কোনো আয় নেই এবং ১৯.৪ শতাংশ নারী ও শিশুর মাসিক আয় ১০ হাজার টাকারও নিচে। এদের গড় মাসিক আয় মাত্র ২ হাজার ৮৪১ টাকা। যার কারণে এসব নারী ও শিশুর মামলা, বিচারিক প্রক্রিয়ায় সমান অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না, ন্যায়বিচারও তাঁরা পান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের বিপরীতে ধর্ষকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা ভালো। একই গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ধর্ষকদের সামাজিক অবস্থানের মধ্যে ১৪.৯ শতাংশ ধনিক শ্রেণির সন্তান, ৯.১ শতাংশ রাজনীতিবিদের সন্তান/আত্মীয় এবং ৪.৬ শতাংশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। এখানে প্রান্তিক ধর্ষিত নারী ও শিশুর সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান ধর্ষকদের সামাজিক বৈষম্যই ধর্ষণের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি

বাংলাদেশে ধর্ষণের হার বাড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় বিচারের হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে মেট্রোপলিটন এলাকায় নারী ও শিশু ধর্ষণের ট্রাইব্যুনালে যে বিচারগুলো হয় সেখানে মাত্র ২.৬ শতাংশ মামলায় চূড়ান্ত বিচারের রায় হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ অপরাধীর মধ্যে ৩৩.৪ শতাংশ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রায়ানের তথ্য মোতাবেক, প্রতি হাজার ধর্ষণের মধ্যে ৩৮৪টি পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ হয়, ৫৭টিতে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে, ১১টি বিচারিক প্রক্রিয়ায় যায়, ৭টি তে ১ বছরের বেশি শাস্তি দেওয়া হয় এবং ৬টিতে কারাগারে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা প্রক্রিয়ায় তদন্ত, ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট ও আইনজীবীর অনাগ্রহ বা পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে চূড়ান্ত রায়ে মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। আইনগতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাদের ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত চার্জ দেওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের কর্মভার ও পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে অথবা প্রভাবশালী মহলের চাপ থাকায় মামলার চার্জশিট সঠিক সময়ে দেওয়া হয় না। আবার মামলার চার্জশিটের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দুর্বলতার কারণেও ভুক্তভোগী নারী ও শিশু ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।

শুধু ধর্ষণসহ যেকোনো অপরাধের বিচার ও শাস্তিদানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে অপরাধ ও শাস্তির সঙ্গে অপরাধী ও ভিকটিমের বর্ণ, সংস্কৃতি, শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম ও রাজনৈতিক অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ধর্ষণের বিচার নয় কেবল, বাংলাদেশে যেকোনো অপরাধের মধ্যে কোনটিকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে, কাকে বিচারপ্রক্রিয়ায় আনা হবে, কাকে বাদ দেওয়া হবে বা কাকে ফাঁসি দেওয়া হবে; তার সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, সাগর-রুনি হত্যার বিচার কেন হয় না বা বিশ্বজিতের খুনিরা কেন মুক্তি পেয়ে যান অথবা ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের শিকার তনুর পরিবার কেন বিচার পায় না বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের মামলায় কথিত আসামি মজনু কেন ধরা পড়ে—এসবের সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে না মেলাতে পারলে অভ্যন্তরগত জটিল বিষয়গুলো উপলব্ধি করা যাবে না।

ধর্ষকের পৃষ্ঠপোষণ

সরকারগুলো এখানে ধর্ষণের সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে বিভিন্নভাবে। ১. দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মী বা দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত বলে যে ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, তিনি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এর আগে গত বছর সাতক্ষীরায় ছাত্রলীগের নেতার কাছে সংস্কৃতিকর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এর আগে জাবি, শাবির ঘটনা তো সবার জানা। ২. পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনীতে কর্মরত এমনকি স্থানীয় প্রশাসনে থাকা জনপ্রতিনিধিরা ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হলেও যথাযথ বিচার হচ্ছে না। ৩. ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও মিডিয়ার বাইরে হলগুলোতে নাটক-সিনেমা-যাত্রার বিভিন্ন প্রদর্শনীতে কুরুচিপূর্ণ স্থূল পর্নো ভিডিও অবাধে নির্মিত ও প্রদর্শিত এমনকি বাজারজাত হচ্ছে। তার একটি প্রদর্শনীগত ফলাফল (demonstration effect) রয়েছে ।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে সামাজিকীকরণেরও ভূমিকা আছে। জন্মের পর থেকেই পরিবার, স্কুল কিংবা বৃহৎ সামাজিক কাঠামোতে নারীর এবং পুরুষের আলাদা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া জড়িত। সামাজিকীকরণের ভিন্নতার কারণে নারী ও পুরুষের মর্যাদা বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। নারীকে যেখানে অক্রিয় (Passive) করে গড়ে তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকে, সেখানে পুরুষকে গড়ে তোলা হয় বীরপুরুষ রূপে। ফলে পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় পুরুষেরা বড় হয়ে ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্র হয়ে ওঠেন। আর এই আধিপত্যবাদী মানসিকতার কারণে লিঙ্গই প্রধান হয়ে ওঠে।

আরেকটি বিষয় ধর্ষণের পেছনের কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করে বলে রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারা সামনে নিয়ে আসেন। ভারতে বিজেপি নেতারা স্কুলে স্কার্ট নিষিদ্ধের কথা বলেছেন। ইতালিতে স্কুল পর্যায়ে আগেই আন্ডারওয়্যার দেখা যায় এমন স্কার্টকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামি ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো নারীদের পর্দার কথা বলে নারীর ক্ষমতায়ন বা চলাচলকে রোধ করতে চায়। তারা ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে জড়িয়ে আলোচনা করে। অথচ ধর্ষণের শিকার হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই (৫৫%)। আবার নারীদের ক্ষেত্রে যাঁরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ধর্ষকের অপরিচিত। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীর চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করলে কোনো সমাধান হবে না বরং তাতে নারীর ক্ষমতায়ন ও বিকাশের পথ রুদ্ধ হবে।

উল্লিখিত কারণগুলো বিবেচনা নিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর অধস্তনতামূলক মর্যাদার প্রথা ভেঙে সমমর্যাদার ও সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত সন্ত্রাসী ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। নারী-পুরুষের জন্য স্বাভাবিক মুক্ত সমাজ নির্মাণ করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধর্ষণসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে জনগণের সামাজিক অঙ্গীকার ও অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল।
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০ 

বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া - নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের মূল্যায়ন করে বিশিষ্টজনরা বলছেন, এই নির্বাচনের চিত্র হতাশার। নির্বাচনে ভোটের যে হার তাতে মনে হচ্ছে মানুষ নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভয়ে লোকজন ভোট দিতে যায়নি। ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি। টার্গেটকৃত কেন্দ্রগুলোতে সাহায্য করার নামে সরকার দলের প্রার্থীর এজেন্টরা বেশ কিছু কেন্দ্রে এ কাজগুলো করেছে। সব মিলিয়ে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত এবং নির্ধারিত ভোট হয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেক নেতিবাচক প্রচারণা হয়েছে। বিগত একাধিক নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি।

রাতে ভোট হয়েছে। এসকল কারণে অনিহার জায়গা থেকে ভোটাররা ভোট দিতে যায়নি। ভবিষ্যতে দেখা যাবে ভোটারশূণ্য যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তাদের নৈতিকা থাকছে না। এত কম ভোট পড়া বর্তমান ইসির জন্য স্বাভাবিক হতে পারে, বাংলাদেশের ভোটারদের জন্য নয়।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, এত কম ভোটার অংশগ্রহণে যেটা স্পষ্ট সেটা প্রথমত, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরে ভোটারদের আস্থা নেই বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, অবাধে ইচ্ছামত ভোট দিতে পারবে সেই বিশ্বাসও চলে গেছে বলে প্রতিয়মান হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ একটি সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন সেটাই হারিয়ে গেছে। গত ১০০ বছরে গণতন্ত্র ছাড়া চার থেকে পাঁচটি দেশে উন্নয়ন হয়েছে। আর গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের চেষ্টা করেছে এমন দেশের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। অতএব, নির্বাচন তথা গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের উন্নয়ন সম্ভব না। মুখে নিজেকে যত বড় উন্নয়নের রোল মডেল বলে দাবি করিনা কেনো আমার আশঙ্কা প্রকৃত অর্থে জনগণের উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া এবং ইসি যে ভোটের তথ্য দিয়েছে এটা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে, ইভিএমএ ভোট হয়েছে এবং ইভিএমএ অনেকগুলো দুর্বলতা আছে। ইভিএম যে ত্রুটিপূর্ণ এটা আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশন কয়েকদিন আগেই বলেছেন। ত্রুটি দূর করার জন্য ইসি কি করেছেন এবং কি ত্রুটি সেটা তিনি আমাদের বলেননি। ইভিএম নিয়ে মানুষের সন্দেহ আছে। আগের সিটি নির্বাচনও ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে তাদের প্রতি জনগণের বিশ্বাস রাখাটা দূরুহ। মানুষ নির্বাচনের প্রতি বিমূখ হয়েছে। তাদের ধারণা আমরা যাই বা না যাই তাতে কি আসে যায়। যে নির্বাচিত হওয়ার তা হবেই। ভোট দিলাম কি না দিলাম। গেলেও যে ভোট দিতে পারবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তার ত্রুটি ছিল। এমনকি তাদের নিজেদের দলের লোকেরা পর্যন্ত বিমূখ ছিল। মোটা দাগে বলা যায়, সন্দেহ, আস্থাহীনতা এবং নিরাপত্তার ত্রুটি এসকল কারণে ভোটার উপস্থিতি এবং ভোট কম পড়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের সমান প্রতিযোগীতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে ভোটারগণ ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহ পায়নি। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আস্থার সংকট ছিল। ভোটাররা ভেবেছেন ভোট দিতে গিয়ে লাভ নেই। অথবা যারা গিয়েছেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। অনেকে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেননি। ফলে এই নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন তারা আস্থার সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম-এর নামে তামাশা হয়েছে। অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিসটা হচ্ছে যেখানে ভোট দিবে মানুষ সেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন ঢুকে গেছে। বাধ্য করেছে বা প্রভাবিত করেছে ভোট দিতে। এটা সব পত্র-পত্রিকায় এসেছে। আমি বলবো গত সংসদ নির্বাচন যেটা ছিল নৈশ নির্বাচন। সেখানে যদি দশে শূন্য পেয়ে থাকে তাহলে এই নির্বাচনে ওরা দশে দুই পেয়েছে। নির্বাচনে চরম একটা আনফ্রেন্ডলি পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। প্রথমত, এখানে মানুষের কোন আস্থা ছিলনা যে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে। এ জন্য বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট দানে বিরত ছিল। সাধারণত যে সংখ্যায় ভোটার যায় তার এক তৃতীয়াংশের মত ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়েছে। তাদের মধ্যেও বহু সংখ্যক মানুষ ভোট দিতে পারেনি নিজের পছন্দ মত। অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। আবার অনেককে ভোট দিতে বাধ্য করেছে। তারপরেও বিএনপি যে ভোট পেয়েছে এটা তো বিস্ময়কর বলতে হয়। বুঝাই যাচ্ছে এত কিছুর পরও যে, বিএনপি ভোট পেয়েছে যদি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন হতো তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয়কর ফল আসতো।

নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য থাকে প্রকৃত জণপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা কোন প্রকৃত জণপ্রতিনিধি পাইনি। ইভিএম এবং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা আরো বাড়বে। ইভিএম যে বাংলাদেশে কতটা অনির্ভরশীল হতে পারে এবং কতটা অনিয়ম করতে পারে সেটার একটা প্রমাণ আমরা দেখলাম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ইভিএম বলেন আর যাই বলেন এগুলোর পেছনে যে মানুষ আছে আর যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সেখানে যদি কোনরকম সুষ্ঠু, স্বচ্ছতা বা সততা না থাকে তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মেশিন আনলেও নির্বাচন ঠিকমত করতে পারবে না।
  • কার্টসি - মানবজমিন/ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

Sunday, February 2, 2020

কম ভোটার উপস্থিতি অনিবার্য ছিলো

আশ্রাফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আরেকজন। ২. ছবি তুলছে, পেছন থেকে কেউ একজন বলার পর ঘুরে তাকান তিনি। ৩. এরপরই কালো কাপড় দিয়ে তৈরি গোপন কক্ষে মাথা নিচু করে ফেলেন তিনি। কামরাঙ্গীরচর চর, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি।

গতকালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হবে না এমনটা অনুমিত ছিলো। কারণ, সাধারণ মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনের পাশাপাশি সাম্প্রতিক কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন যেভাবে হয়েছিলো, তা নির্বাচনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করেছে। যার কারণে বড় সংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাননি। তারা জানতেন তাদের মতামত নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে না।

সাধারণত, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনসাধারণের তেমন একটা গুরুত্ব দেখা যায় না। তবে এবার সবচেয়ে খারাপ যা হলো তা হচ্ছে- ভোটাররা প্রার্থীদের সম্পর্কেও তেমন একটা ধারণা রাখেননি। আগে প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের তথ্যসহ স্লিপ দিয়ে আসতেন। নির্বাচনকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন। আমার মনে হয় না প্রার্থীরা এবার এই কাজটি করেছে। অনেকে বিভ্রান্তও হয়েছেন। ভোটকেন্দ্রগুলোতে গিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে কে কোন দলের, তা জানতেন না অনেক ভোটার।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একটি দলের প্রার্থীরাই নির্বাচনী প্রচারণার দাপটে ছিলো। আমি যে এলাকায় থাকি সেখানে বিরোধীদলের প্রার্থীদের তৎপরতা খুব বেশি দেখিনি। বিরোধীদলের প্রার্থীদের কোনো পোস্টার ছিলো না এবং সাধারণ মানুষ দেখতেই পারছিলেন নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। যা দেখে বোঝা যায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার যে নির্বাচনী পরিবেশ দেখে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবেন, তা তৈরি করা হয়নি।

শুধু এটাই নয় যে মানুষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না বলে ভোট দিতে যাননি। প্রচারণা যেভাবে হয়েছে তাতেও তারা বিরক্ত। যেদিকেই গিয়েছেন সেদিকেই প্রচারণার অপ্রয়োজনীয়তা চোখে পরেছে। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে শহরের পরিবেশ উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রচারণার সময় তারা যা করেছেন, তা তাদের প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ বিপরীত। লেমিনেটিং করা পোস্টার এবং লাউডস্পিকার ব্যবহার করে যেভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবেশ। এটা চলবেই। আমাদের বুঝতে হবে যে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে এবং যেই নির্বাচিত হন না কেনো, তার উচিত একে বসবাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা। দুঃখের বিষয়, প্রচারণার পদ্ধতির মাধ্যমে প্রার্থীরা জনসাধারণকে একটি ধারণা দিয়েছেন যে তারা সেই চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম নন।

তাছাড়া নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ভোটারদের সন্দেহ ছিলো। প্রযুক্তি ব্যবহারে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না। ইভিএমের কার্যকারিতা সম্পর্কেও সন্দেহ ছিলো। যথাযথ মেশিন কেনা হয়েছিলো কী না, তদারকি করার কোনো ব্যবস্থা আছে কী না ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে ইভিএম প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। নির্বাচন কমিশনও নিশ্চিত করেছে যে প্রশ্নটি কখনই যাতে মুছে না যায়। শুরু থেকেই ইভিএমের বিষয়টি যেভাবে সামনে এসেছিলো, তা মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি করেছিলো। ভোটের প্রতি নিরুৎসাহিত হওয়ার এটি একটি বড় কারণ হতে পারে।

সামগ্রিকভাবে, আমি বলবো নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই অসন্তোষজনক ছিলো। এটা পরিষ্কার ছিলো যে, নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করছে না। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারেনি এবং কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যও করেছেন। প্রার্থী এবং প্রার্থীদের সমর্থকরা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তা তারা আমলে নেয়নি। প্রচারণার সময় সহিংসতা এবং প্রার্থীর ওপর আক্রমণ হওয়ার ঘটনায়ও কাওকেই দায়বদ্ধ করা হয়নি।

জনগণ আশা করে নির্বাচন কমিশন স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে। তাদের কাজে ক্ষমতাসীনদের কোনো প্রভাব থাকবে না। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। প্রশাসনের উচিত তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলা এবং সব ধরণের সহায়তা দেওয়া। দুঃখের বিষয়, নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষের আস্থা হারিয়েছে।

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে লেখাটি তৈরি করেছেন নাজনীন তিথি
  • কার্টসি - ডেইলি স্টার / ফেব্রুয়ারি ২, ২০২০ 

Friday, January 31, 2020

উৎসব ও উৎকণ্ঠার ভোট

সাখাওয়াত সায়ন্ত

ঢাকার দুই সিটিতে ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ভোটকেন্দ্রিক উৎসব ও উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে উৎসবটা বেশ জমে উঠেছে। এত পোস্টার, এত মাইকিং, ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এত নির্বাচনী গান-প্যারোডি আগের কোনো নির্বাচনে হয়েছে বলে মনে হয় না। শহরের প্রতিটা অলিগলি-পাড়া-মহল্লা ছেয়ে গেছে পোস্টারে। যদিও এই পোস্টার প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীরা। এই অতিপ্রচার নিয়ে বিশেষ করে শব্দদূষণ নিয়ে অনেকে বিরক্ত।

নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থী ও তাদের দলীয় সমর্থকদের উৎসব দেখা গেলেও এই উৎসব ভোটারদের উৎকণ্ঠা কাটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ভোট কেমন হবে এই প্রশ্নটি যেকোনো সাধারণ ভোটারকে জিজ্ঞেস করলেই তারা কেমন যেন এক রহস্যময় হাসি দিয়ে এর উত্তর এড়িয়ে যান।

পোস্টার, মাইকিং, গানবাজনা, ঢোলবাদ্যের আড়ালে ঢাকা পড়া এই যে ভোটারের উৎকণ্ঠা তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে কমই। নিজেরা বেশি প্রচার চালিয়ে, বিরোধী দলকেও কিছুটা সুযোগ দিয়ে নির্বাচনকে উৎসবমুখর বানানোটাও আওয়ামী লীগের কোনো বিশেষ কৌশল কি না সেটা জানা যাবে আর দুদিন পরই। প্রচারের ডামাডোলের আড়ালে তাদের কী কৌশল লুকিয়ে আছে, সেই উৎকণ্ঠা থেকেও মুক্ত নয় শহরবাসী।

সাধারণ ভোটারের পাশাপাশি এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই প্রধান দলের উৎকণ্ঠাও কম নয়। সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই শিবিরের উৎকণ্ঠা দুই ধরনের। আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠা কী নিয়ে তা বুঝতে হলে এই সংবাদ শিরোনামগুলো মনে রাখাই যথেষ্টÑ ‘মেয়র জেতাতে মরিয়া আওয়ামী লীগ’ (দেশ রূপান্তর), ‘আ.লীগের ভাবনায় শুধুই জয়’ (প্রথম আলো)। এই প্রতিবেদনই বলে দেয় আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই হারতে চায় না এই নির্বাচনে। যেকোনোভাবে জিততে মরিয়া দলটি। তারা মনে করছে, ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার এই নির্বাচনে তারা হারলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার গল্পের বেলুন ফুটো হয়ে যাবে। এতে করে মনোবল ভেঙে যাবে তাদের নেতাকর্মীদের। আর মাত্র এক বছর আগে নগণ্যসংখ্যক ভোট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা বিএনপি এখন জিতে গেলে আগের নির্বাচনগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের আর বলার কিছু থাকে না। এই নির্বাচনে বিজয়ী হলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হতে পারে। তারা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নিতে পারে। সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তারা রুখে দাঁড়াতে পারে। আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এইসব উৎকণ্ঠা আছে আওয়ামী লীগের।

কিঞ্চিৎ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করে, ঢাকা সিটি নির্বাচনে হেরে গেলেই সরকারের পতন হবে, এমন তো নয়। তাই নির্বাচন ব্যবস্থা যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং তার পুরোটা দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে তা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এই নির্বাচনটি সুষ্ঠু সুন্দর গ্রহণযোগ্য করা উচিত। একাদশ জাতীয় নির্বাচন তাদেরকে যে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে তার বিপরীতে তারা এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলতে পারবে যে এই সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। এই ফর্মুলা প্রয়োগ করেই হয়তো অনেকে বলছেন, ঢাকা দক্ষিণে যেকোনোভাবে জয় কেড়ে নেবে আওয়ামী লীগ। আর কিছুটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে উত্তরে হারার ঝুঁকি নিতেও পারে আওয়ামী লীগ। কারণ হিসেবে এই গ্রুপটা মনে করছে, শেখ পরিবারের ছেলে তরুণ নেতা তাপসকে এমপি থেকে পদত্যাগ করিয়ে সিটি নির্বাচনে নামানো হয়েছে, পরাজয় মেনে নেওয়ার জন্য নয়। ব্যারিস্টার তাপস নিজেও বলেছেন, হারার জন্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে আসিনি। কিন্তু পুরান ঢাকার সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনকে হারিয়ে অভিজাত ধানম-ি থেকে আসা তাপসকে জেতাতে যে বেগ পেতে হতে পারে, তা ঢাকতে উত্তর সিটিতে পরাজয়ের ঝুঁকি নেবে কি তারা? আ.লীগ তখন বলতে পারে, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে উত্তরে বিএনপি জিতল কীভাবে?

কিন্তু এই দুই গ্রুপের বাইরেও আরেক গ্রুপ আছে যারা কোনো যুক্তিতেই আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করতে নারাজ। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনকেন্দ্রিক লজ্জাশরম ভেঙে গেছে অনেক আগেই। আর মাত্র দুদিন পরেই জানা যাবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোন গ্রুপের ধারণা সঠিক হয়।

আসলে ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ আছে উভয় সংকটে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে হারলেও বিপদ। কারচুপি করে জিতলেও বিপদ। কেউ মনে করতে পারেন, কত নির্বাচনে কত রকম জালিয়াতিই তো করা হলো। তাতে কী এমন বিপদটা হয়েছে? বিএনপি তো কিছুই করতে পারল না! তারা হয়তো ভাবে না, জাতির সামনে ভোট ডাকাতি প্রমাণিত হলে সেটাও কম ক্ষতি নয় দলটির জন্য। তাই ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠা উভয়মুখী ও ব্যাপক।

অন্যদিকে এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উৎকণ্ঠা আওয়ামী লীগের মতো নয়। বিএনপির উৎকণ্ঠার জায়গাটা যে কী তাও বোঝা যায় দেশ রূপান্তরের শিরোনাম থেকেইÑ ‘পুলিশের জেনে ফেলার ভয় : গোপনে এজেন্ট তালিকা করছে বিএনপি’। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি জানে, এই নির্বাচনে তাদের যতটুকু প্রচারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটা লোক-দেখানো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আগের নির্বাচনগুলোতে বিএনপিদলীয় পোলিং এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে, গ্রেপ্তার করে কীভাবে কেন্দ্রগুলো ধানের শীষের এজেন্টশূন্য করা হয়েছিল তা জানে বিএনপি। তাই দলটির সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠাটি পোলিং এজেন্ট নিয়ে। একটা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা কতটা ভেঙে পড়লে, একটা সরকার বিরোধী দলের প্রতি কতটা নিপীড়নমূলক হলে বিএনপির মতো একটি বড় দলের  পোলিং এজেন্টের তালিকা করতে হয় গোপনে! কেন্দ্রে শক্তভাবে দলীয় এজেন্ট না থাকলে যে ভোটাররা ভোট দিতে অস্বস্তি বোধ করেন তা তো সবারই জানা। অভিযোগ আছে, সরকারদলীয় এজেন্ট ও প্রশাসনের লোকজন ভোটারদের বাধ্য করেন তাদের সামনে ভোট দিতে। আবার কোথাও আরও এক ডিগ্রি এগিয়ে ভোটারকে কষ্ট না দিতে তার ভোটটি তারাই দিয়ে দেন বলেও জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী। তাই বিএনপির প্রথম ও প্রধান উৎকণ্ঠা, এত ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দলীয় এজেন্টরা কেন্দ্রে থাকবেন কি না সেটা নিশ্চিত করা।

বিএনপির দ্বিতীয় উৎকণ্ঠা ইভিএম নিয়ে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে, বিরোধী দলকেও কিছুটা প্রচারের সুযোগ দিয়ে, আপাতদৃষ্টিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখিয়ে ইভিএম কারসাজি করে ফলাফল পাল্টে নৌকাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে কি না সে উৎকণ্ঠাও আছে বিএনপির। ঢাকা সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে ইভিএমের বিরোধিতা করে দলটি একাধিক আলোচনা অনুষ্ঠানের মূলে আছে ইভিএম জালিয়াতি নিয়ে উৎকণ্ঠা।

বিএনপি মনে করে, সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের যেভাবে অপমান-অপদস্ত করেছে তার জবাব তারা সুযোগ পেলে ভোটের মাধ্যমে দেবে। কেননা গুম, খুন, মানবাধিকার হরণ, গণতন্ত্র ধ্বংস, শেয়ারবাজার লুট, ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার, অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্যসহ এত কিছু নিয়ে জনগণের ক্ষোভ আছে যে, তার জবাব সাধারণ ভোটাররা নিশ্চয়ই ভোটের মাধ্যমে দেবে। তাছাড়া এই শহরটাকে বসবাস উপযোগী রাখতে না পারা, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, জলাবদ্ধতাসহ অনেক বিষয়েও ঢাকার মানুষ মহাবিরক্ত এই সরকার ও তাদের মেয়রদের ওপর। এই শহরটি যানজটে পৃথিবীর নিকৃষ্ট, বসবাসের উপযোগিতার বিচারেও নিকৃষ্ট। বায়ুদূষণে পৃথিবীর সেরা। নারীর জন্য অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও চতুর্থ। আরও কত সব কলঙ্কতিলক এই শহরের কপালে জুটেছে। দক্ষিণের নৌকার প্রার্থী তাপসও বলেছেন, অচল ঢাকাকে তিনি সচল ঢাকা বানাবেন।

টানা এগারো বছর দেশের ক্ষমতায় ও প্রায় অর্ধযুগ সরকারদলীয় মেয়র থাকার পরও ঢাকা অচল নগর হয়ে থাকা, ঢাকার কপালে  এত কলঙ্ক লেপন করা, ঢাকাকে মানুষের জন্য অনিরাপদ নগরী বানিয়ে রাখার কথা মানুষ ভুলবে না। অন্যদিকে জনগণের করের টাকা শহরবাসীর সেবায় ব্যবহার না করে লোপাট করাও মানুষ ভুলবে না। তাদের যে মানুষ ভোট দেবে না, এটা শুধু বিএনপি কেন অনেকেরই ধারণা। তাই ভোটপ্রাপ্তি নিয়ে বিএনপির উৎকণ্ঠা কম। শুধু ভোটারদের কেন্দ্র পর্যন্ত নিতে পারলেই হলো। বিএনপির উৎকণ্ঠা সরকার ও তাদের অনুগত নির্বাচন কমিশনের জালিয়াতির আশঙ্কা নিয়ে।   

এই উৎকণ্ঠা নির্বাচনের ফলাফল না আসা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, নাকি ভোট চলা অবস্থায়ই পরিষ্কার হয়ে যাবে সেটা আসলে কার ওপর নির্ভর করে? এ প্রসঙ্গে সিটি নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেছেন ‘এজেন্টদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। যাদের পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে তাদের ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। বাকিটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। প্রধানমন্ত্রী কেমন নির্বাচন চান তা ভোটের দিন স্পষ্ট হবে।’

মানুষ হয়তো সব সময় জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে পারে না। কিন্তু জালিয়াতদের ঘৃণা করতে পারে অনায়াসে। সেই ঘৃণাও এক সময় জালিয়াতদের কঠিন পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

  • লেখক-চিকিৎসক ও কলামনিস্ট/ 
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর / জানুয়ারি ৩১, ২০২০ 

Wednesday, January 29, 2020

আপনি ভোট দিতে আসছেন তো?

আলী রাবাত

আমি ভোটার। কবে যে ভোটার হয়েছিলাম তাও মনে নেই। প্রতিবারই ভোট কেন্দ্রে যাই। কখনও ভোট দেই, কখনও দেই না। ভোট না দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বলা হয়, আমার ভোট নাকি দেয়া হয়ে গেছে। তারপরও আমার মধ্যে ভোটের কৌতূহল, আকুতি। একধরনের আনন্দ কাজ করে।

নিকট অতীতে ভোট দিতে গিয়ে শুনলাম রাতেই নাকি হয়ে গেছে। একদল লোক কেন্দ্রের সামনে  জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরা নাকি ভোট দেয়ার জন্য লড়াই করছে। বাস্তবে তা কিন্তু নয়। এটা এক ধরনের কৌশল। ভিন্নমতাবলম্বী ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারে, এটা সে কৌশলেরই অংশ। সব কৌশলের শেষ কথা হচ্ছে ভোটারকে কেন্দ্রমুখী হতে না দেয়া। আগের রাতে এজেন্টকে ভয়ভীতি, কিংবা গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো পুরনো কৌশল।

এখন কৌশল হচ্ছে এজেন্টদের মাইক্রোবাসে তুলে ৬৫ কিলোমিটার দূরে ফেলে আসা। আইনের লোকেরা এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করছে। কেউ প্রতিবাদ জানায়, কেউ জানায় না। বলে, এটাও নাকি আধুনিক ভোটের অংশ। এসব জেনেও আমি ভোট দিতে যাবো। এবারতো মেশিনে ভোট। যদিও আমি জানি না কীভাবে ভোট দেবো? এখানেও নাকি গায়েবি ভোটের সুযোগ আছে। তা কী করে সম্ভব! দু’বার বোতাম টিপতে হয়। একবার টিপলে ছবি আসবে। তখন সটান দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলবে, আপনার ভোট হয়ে গেছে। ভোটার যেই ঘুরে দাঁড়ালেন তখনই ভোট গেল এক নির্দিষ্ট মার্কায়। এটা নাকি মেশিনের কেরামতি। এ নিয়ে দেশজুড়েই সরস আলোচনা। এই রাজধানীতে নানা গুঞ্জন, মেশিনও কি তাদের দমাতে পারবে না? যারা গায়েবি ভোটে বাজিমাত করতে চায়।

অনেকে বলেন, ওসব বাজে কথা। দেশে দেশে এ মেশিন বাতিল হয়ে গেছে। পাশের দেশে চালু থাকলেও জালিয়াতির পথ বন্ধ করেছে। আমাদের এখানে বাতিল মাল চালু করার জন্য কী যে প্রাণান্তকর চেষ্টা। নির্বাচন কমিশনতো মরিয়া। তাদের মরিয়া হতে হবে দু’  কারণে। এক. উপরওয়ালারা চায় তাই এটা চালু করতে হবে। অন্য কারণ বলবো না। বলে নিজের বিপদ ডেকে আনবো নাকি? বাংলাদেশে যারা এ মেশিনের জনক তারা নীরব কেন? বুঝতে পারি না। বুঝার কী দরকার। না বুঝলেও চলে। বেশি বুঝতে গেলেইতো বিপদ। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। কৌতূহলবশত পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই আপনি কি ভোট দিতে যাবেন? তার জবাব শুনে একদম আক্কেল গুড়ুম। ভোট দিতে হয় নাকি! আপনি কেন্দ্রে না গেলেও ভোট হয়ে যায়। ফলাফলতো আগেই জানা যায়। বললাম ভাই, এবারতো যন্ত্রে ভোট হচ্ছে। হেঁসে দিয়ে বললেন, তাহলেতো ষোলকলা পূর্ণই হয়ে গেল। টকশো শুনেতো তাই মনে হচ্ছে।

বেশিরভাগ টকশোপ্লেয়ার নানা ছলচাতুরি আর অনিয়মের কথা বলছেন। কী রকম সেটা? সেদিন শুনলাম, ভোট গণনার সময় নাকি মেশিন একমুখী হয়ে যায়। কম্পিউটারে নাকি প্রোগ্রামিং করা  থাকে। এজন্য কিছু অস্থায়ী স্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। চোখ কান খোলা রাখলেই জানতে পারবেন। ভোটের পরিবেশ আপাতত ভালো। ২৪ ঘণ্টা পার হলেই অন্য এক পরিবেশ দেখা যাবে। সেটা আবার কী? পুরনো মামলার সুবাধে চলবে ব্যাপক অভিযান। এর ফলে মামলাহীন লোকেরাও পালাবে। এতোসবের কী দরকার। আরে ভাই এসব না করলে শান্তি বিরাজ করবে, ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হবে।

আর কেন্দ্রমুখী হলেই সব হিসাব নিকাশ যাবে ওলটপালট হয়ে। তাহলে ভোটের দরকার কি? সিলেকশন পদ্ধতিতে গেলেই তো সব সমস্যার সমাধান। কাড়িকাড়ি টাকা বাঁচবে। খুনখারাবি হবে না। পরিবেশও দূষণ হবে না। শুধু সমস্যা হবে কাগজওয়ালাদের। ওরা তখন কী লিখবে? ভিডিও ফুটেজতো ইশারায় হাওয়া করে দেয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেতো প্রতিদিনই চমকপ্রদ খবর আসে। তাতে কি? মানুষতো ওসব বিশ্বাস করে না। এতোকিছুর পরও আমি ভোট দিতে যাবো। আমাকে ভোট দিতেই হবে। আসুন সবাই মিলে কেন্দ্রে যাই। নিজের ভোট নিজে দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করি। আপনি আসছেন তো?

  • কার্টসি - মানবজমিন/ জানুয়ারি ২৯, ২০২০ 

Tuesday, January 28, 2020

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রক্তের রাখিবন্ধন

রুমিন ফারহানা

‘সীমান্তে গরু আনতে গিয়ে নিহত হলে দায় নেবে না সরকার’ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে যে কারোরই মনে হতে পারে এই কথাটি কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন। কিন্তু না, কথাটা বলেছেন বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী। ২৩শে জানুয়ারি নওগাঁর পোরশা উপজেলার দুয়ারপাল সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ জওয়ানদের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হন। পোরশা সীমান্ত খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা বলে ২৫শে জানুয়ারি সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি ওই বক্তব্য দেন।
রুমিন ফারহানা

২০১৭ সালে একটি সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রচণ্ড ভাইরাল হয়েছিল। গোবিন্দ গৌতম নামের এক নেপালি যুবক ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল (ভারতের যেকোনো মন্ত্রীর চাইতে বেশি ক্ষমতাবান মানুষ ইনি) বিষয়টি নিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন দোভাল।

নিহতের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন এবং ওই বিষয়ে তদন্তের জন্য নেপাল সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন দোভাল। নানা বিবেচনায় আমাদের চেয়ে দুর্বল রাষ্ট্র নেপালের ক্ষেত্রে ভারত যা করলো আমাদের ক্ষেত্রে কেন করে তার ঠিক উল্টোটা, এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

সীমান্ত হত্যা নিয়ে গত জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা বাড়ার কারণ সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু লোকের বেপরোয়া আচরণ। তাদের ব্যাপারে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফ’র প্রতিবদেন একই। তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চলছে।’

বিজিবি’র পক্ষ থেকেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে বারবার। ২০১৬ সালে তৎকালীন বিজিবি প্রধান স্পষ্টভাবে জানান ‘গরু চোরাকারবারি বন্ধ না হলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ সম্ভব নয়’।

যুক্ত করছি সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধে ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ না করে আমাদের নিজেদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আর যারা মারা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত।’

সর্বশেষ গতকাল আলোচিত বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করতে হলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই বলে মনে করেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি আমরা, এই বক্তব্যগুলোর একটা কমন প্যাটার্ন আছে।

প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের যে গল্প আমরা শুনি তাতে আমাদের এটা জানানো হয় মৃত ব্যক্তির নামে কয়টি এবং কী ধরনের মামলা আছে। জনগণের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় যেহেতু এই ব্যক্তির নামে এই ধরনের অভিযোগ আছে, সেহেতু তাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা যায়।

ঠিক তেমনি সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উঁচু পদে অসীনদের প্রত্যেকটা বক্তব্যে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা আছে যেহেতু কিছু বাংলাদেশি সীমান্তে গরু চোরাচালান এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু সে সব মানুষকে বিএসএফ গুলি করে মেরে ফেলতে পারে।

ধরে নেয়া যাক কিছু বাংলাদেশি গরু চোরাচালান কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ভারতে প্রবেশ করে। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পৃথিবীর আর সব দেশের মতো ভারতেও আইন আছে। আমাদের কেউ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশ করেই থাকে তাহলে তাদের আইনের আওতায় নেয়াই একটা সভ্য রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হওয়া উচিত। যদিও বিএসএফ নানা সময়ে এই হত্যার পেছনে একটা যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করে। তারা বলে শুধুমাত্র বিএসএফ আক্রমণের শিকার হলেই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারা সীমান্তে গুলি করে। ব্যাখ্যাটা পরিচিত লাগছে না? হ্যাঁ, এটাই সেই ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং পুলিশও চালায় পাল্টা গুলি... এই গল্পের এই ভারতীয় সংস্করণ এটা।

অসাধারণ মানবিক কোনো সরকারের কথা বাদই দেই ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কোনো সরকার যদি এই দেশে ক্ষমতায় থাকতো তাহলে তারা ভারতের সরকারকে খুব শক্তভাবে জানিয়ে দিতে পারতো কোনো বাংলাদেশি যদি কোনো কারণে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে তাহলেও তাকে কোনোভাবেই বিএসএফ হত্যা করতে পারে না। সেই সরকার ভারতকে জিজ্ঞেস করতো প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হলেও ভারত সেটা কেন সেটা মেনে চলছে না? সেটা এই সরকার করছে না, এমনকি চুপ থাকছে না। বরং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজন এমন সব কথা বলছে যেটা এই ধরনের সীমান্ত হত্যার একটা শক্ত নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

এমন সময়ে সীমান্তে বাংলাদেশিদেরকে হত্যা করা হচ্ছে যখন সরকার দলীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশ-ভারত রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ দেশ। কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথামতো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বিরাজমান। এমন সম্পর্কের মধ্যেই আওয়ামী লীগের ১১ বছরে প্রায় ৩৫০ জন, গত বছর ৪৩ জন আর এই বছর এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়া স্থলসীমান্ত আছে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের। চীন ভারতের চাইতে অনেক বড় শক্তি, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা আছে, এসব বিবেচনায় এই দুইটা দেশকে সরিয়ে রাখা যাক। কিন্তু বাকি দেশগুলো এমনকি বাংলাদেশের তুলনায় নানা দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র। এইসব দেশের সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মৃতের সংখ্যা শূন্য। বাংলাদেশ সরকারের লজ্জা হওয়া উচিত।

গোবিন্দ গৌতমের মৃত্যুর পর ভারতকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, কারণ সে সময় নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল কারো করুণায় ক্ষমতায় আসেননি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকেননি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় থাকা দহল জনগণকে নিয়ে এই নৃশংসতার প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই নৈতিক শক্তি তার ছিল। ঠিক এখানেই বাংলাদেশ সরকারের খামতি।

আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেনা-পাওনা বিষয়টি খুব জরুরি। ভারত বাংলাদেশ থেকে কি পেয়েছে তা খুব স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর এক উক্তিতে। তিনি বলেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য এই দেয়ার বদলে ৫৪ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, তিস্তা চুক্তি, বাণিজ্য বৈষম্য, সীমান্তে কাঁটাতার, শুল্ক-অশুল্ক বাধা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নেয়া, সিএএ এবং এনআরসি’র নামে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ পুশইন করার হুমকিসহ আরো অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার বাইরে যা পেয়েছে বাংলাদেশ তা হলো ভারতের প্রত্যক্ষ মদতে জনগণের ম্যান্ডেটহীন একটি সরকার এবং সীমান্তে বাংলাদেশিদের রক্তাক্ত লাশ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথার্থই বলেছেন ভারতের সঙ্গে রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ বাংলাদেশ। তার কথা ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে সংহতি তা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেই বলছি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল হিসেবে নিয়মিত যে লাশ পড়ে তা ভারতের সঙ্গে আরেক রক্তাক্ত রাখিবন্ধন তৈরি করে, এবং সেটাও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই থাকবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।

  • লেখক: সংসদ সদস্য
  • কার্টসি - মানবজমিন/ জানুয়ারি ২৮, ২০২০