Search

Sunday, February 16, 2020

টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ


অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশি টাকা প্রতিবেশী দেশের মুদ্রার তুলনায় অতিমূল্যায়িত। চীন, ভারত, পাকিস্তান তাদের মুদ্রামান কমিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার টাকার মান না কমিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, টাকার মান কমিয়ে দিলে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই নীতি কত দিন কার্যকর থাকবে। দীর্ঘ মেয়াদে এই টাকা কোথা থেকে আসবে? রপ্তানি–প্রণোদনাও তো রপ্তানি–ধস ঠেকাতে পারছে না। প্রণোদনার কারণে রেমিট্যান্স ও তথ্যপ্রযুক্তি আয় বেড়েছে, তবে বৈদেশিক মুদ্রা এই মুহূর্তে সংকটে নেই বলে নগদ প্রণোদনা খুব বেশি জরুরি নয়। টাকার মান সামান্য কিছু অবমূল্যায়ন করেও একই টার্গেট অর্জন সম্ভব।

সঞ্চয়পত্র সুদ বনাম এক অঙ্কের সুদ

ডাকঘরে আমানতের সুদের হার এক ধাক্কায় সরকার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আগে যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন তা ৬ শতাংশ। এর আগে সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। ব্যাংকের সুদ ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৬ বা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকে রাখাও যা, না রাখাও তা, সঞ্চয়পত্রে সুদও তা। সরকার কেন এটা করল? অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের কথায়, ‘রাজস্ব কমে যাওয়ায় সরকার প্রথমে হাত দিল ব্যাংকে। ছয় মাসের মধ্যে এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করল। তারপর নতুন আইন করে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থে হাত দিল। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার পুঁজিবাজারে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের হারানো তহবিলের ঘাটতি কমাতে। অথচ ব্যাংকের টাকা যারা নিয়ে গেল, তাদের ধরছে না। এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোয় জনগণের দুর্বল অংশ যে পেনশনভোগী, তাঁদের আয়ে হাত পড়ল। তাঁদের সুদ বাবদ রাষ্ট্রের খরচ কমল। ওদিকে ইউএনওদের ৯৪ লাখ টাকার গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

সরকারের ঋণ বনাম ব্যক্তি খাতের ঋণ

যেখানে সরকার নিজেই অতি উচ্চ পরিমাণে ব্যাংকঋণ করছে, সেখানে বেসরকারি খাতে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে কীভাবে? ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশে স্থবির হয়েছে। সরকারের অতি উচ্চ ঋণের প্রভাবে ১১ বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।

স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নেওয়ার বিপদ

স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের স্থিতি ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতা, এমনকি ওয়াকআউটের মধ্যেই সরকার স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার আইন পাস করেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রমবর্ধনশীল রাজস্বঘাটতির বিপরীতে সরকার তার অতি উচ্চ ব্যয় নির্বাহের নতুন জোগান পেলেও এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা। উদ্বৃত্ত অর্থ যাতে একেবারেই না থাকে, সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়াতে পারে, এতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী উৎসাহ পাবে। নিজস্ব তহবিলের স্থিতি ও তার বিপরীতে আয় না আসায় সরকারের ওপর অতি নির্ভরশীল হবে সেবা, গবেষণা ও পরিকল্পনা। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের সিদ্ধান্ত আর্থিক কারণে নিতে পারবে না বিধায় স্বায়ত্তশাসিত কাঠামো বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশঙ্কা হয়। মারাত্মক আর্থিক বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনায় এবং তহবিলের নিশ্চয়তা না থাকায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো গতি হারাতে পারে। মোটকথা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে। তা–ই যদি হয়, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের পথে এটা একটা কালো অধ্যায় হয়েই থাকবে।

নিম্নপর্যায়ে আমানত সুরক্ষার ঝুঁকি

আমানত সুরক্ষার খসড়া আইনে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র এক লাখ টাকা। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লালবাতি জ্বললে মাঝারি ও বড় আমানতকারীদের সুরক্ষাহীন হয়ে ভীত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক অঙ্কের সুদনীতির সঙ্গে এটা সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। কেননা, ৬ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতির সমান বা তারও কম সুদের ফলে লোকে যখন ব্যাংকে টাকা রাখতেই উৎসাহ হারাচ্ছে, তখন দরকার ছিল গ্রহণযোগ্য শতাংশ হারে আমানতের বিমা নিশ্চয়তা দেওয়া। ২০০০ সালের আইনেও এক লাখ টাকার সুরক্ষা থাকলেও ২০ বছর পরে এসেও তা মূল্যস্ফীতি যোগ করে পুর্নির্ধারণ করা হয়নি—যেমনটা ভারতে করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। নতুন আইনে টাকার অঙ্ক বদলায়নি, সংযোজন শুধু নন–ব্যাংকিং আর্থিক খাত। আমানত সুরক্ষার অঙ্ক বাড়ালে বিমা খরচ কিছুটা বাড়লেও নতুন আমানত উৎসাহ পেত। কিন্তু তা না করায় লোকে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দেবে। এতে ঋণপ্রবাহে দীর্ঘতর নেতিবাচক ধারা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংক মালিক, পরিচালক ও ব্যবসায়ী—এই চার পক্ষ বোঝাপড়ায় একের পর এক জালিয়াতির মুখে আর্থিক খাত যখন টালমাটাল, তখন এমন আইন বৈধ এবং অবৈধ উভয় ধরনের পাচার বাড়াতেই উৎসাহ দেবে। আশঙ্কা হয়, উদ্দেশ্যমূলক ব্যাংক লোপাট করে, আইনি কাঠামোয় দায়মুক্তি দেওয়ার ফন্দি এটা নয় তো! এর মাধ্যমে আমরা কি এই সংকেত পাচ্ছি যে, ব্যাংকগুলো আবারও লুটের কবলে পড়তে যাচ্ছে? বড় ধরনের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে, নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত কমে ঋণপ্রবাহে আরও বেশি নেতিবাচক ধারা সৃষ্টি করতে পারে।

ভারতের অনুকরণ!

সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিযুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত নিজেই অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে। তথাপি ভারত মূল্যস্ফীতি ও অন্য বিষয়াদি আমলে নিয়ে আমানত সুরক্ষা স্থিতি এক লাখ রুপি থেকে পাঁচ লাখ করেছে। উপরন্তু, প্রতিটি অর্থনীতি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আলাদা। ভারতে বাংলাদেশের মতো এত বিশাল খেলাপি ঋণ এবং সরকারি ঋণের সংস্কৃতি নেই। তাই ভারতের পলিসি বাংলাদেশে নকল করা বেমানান। ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম পরিষ্কার করে দুটো বিষয় উপস্থাপনা করেছেন, যার ভাবানুবাদ এমন: ‘ভারতীয় অর্থনীতির সমস্যা সাপ্লাই সাইডে নয়, বরং ডিমান্ড সাইডে। অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিক ক্রয়ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার, এমনকি করপোরেট করে ছাড় বা বড় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিলে এ সময় কাজ হবে না। বরং এই সময়ে পণ্য কীভাবে বেশি বিক্রি হবে, তার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন কৃষকের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বর্তমান বিজেপি সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় মেধাবীদের সমন্বয় করে অর্থনীতি পরিচালনা করছে না বলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে।’

বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি ও করপোরেট পণ্য বিক্রিতে ভাটা এসেছে। গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়লেও কর্মসংস্থানে দেখা দিয়েছে নেতিবাচকতা। ২০১০ সালের পর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমে নেমেছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে। কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অর্থবছরের শুরুতে। পণ্যবাজারে বিক্রয় হ্রাস, কর্মসংস্থানে ভাটা, ব্যক্তি ও বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যহীনতায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমতাবস্থায় টাকার খোঁজে দিশেহারা হয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। অর্থ ব্যবস্থাপনায় দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের সমন্বিত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সৎ, সতর্ক, প্রজ্ঞাবান না হলে চোখের পলকেই বদলে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র!

  • ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০ 

বায়ু ও শব্দদূষণ - ঢাকার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, বাঁচান


‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’—এই কথা রবীন্দ্রনাথ রূপকার্থে লিখেছিলেন, বায়ুদূষণের কথা ভেবে লেখেননি। কারণ, বায়ুদূষণ কিংবা শব্দদূষণ বলতে এখন যা বোঝায়, রবীন্দ্রনাথের কালে অন্তত এই অঞ্চলে তা ছিল না। এখন ভারী কারখানা, ইটের ভাটা, রাসায়নিক প্ল্যান্ট, হাইড্রোলিক হর্ন, মাইকের উচ্চ শব্দ, ইত্যাদির উৎপাতে কুবাতাস ও কুশব্দ এতটাই বেড়েছে যে বিশেষত ঢাকাবাসী শ্বাসরোধকর অবস্থায় পড়ে গেছে।

পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিস তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য দিয়েছে তা ভয়াবহ। তারা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকালমৃত্যু হয়েছে। বছরে ৪০ লাখ মানুষ অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছে চিকিৎসা নিতে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে, গত বুধবার ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল, দূষণের দিক থেকে যা বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ।

এর পাশাপাশি আছে শব্দদূষণ। গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দের সহনীয় মাথা ৫০ ডেসিবেল হলেও ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ৯০ ডেসিবেলের বেশি মাত্রায় শব্দ হয়। কোথাও কোথাও তা ১২০ ডেসিবেলও ছাড়িয়ে যায়। ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন শব্দদূষণে আক্রান্ত। এভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। এদের একটি অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে যাবে।

এ কথা ঠিক যে বায়ুদূষণ হঠাৎ করে ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে আনা কঠিন। কারণ, এর জন্য দূষণ ঘটানো বহু ইটের ভাটা, কারখানা, যানবাহন ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। গত দেড় বছরে অবৈধ ইটভাটাগুলোর ৬২ শতাংশ বন্ধ করা গেছে। কিন্তু কিছু কিছু উদ্যোগ আছে, যা দ্রুত নেওয়া যায়। শহরে যখন-তখন যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টিকে পরিকল্পনার আওতায় আনা এবং দূষণ ঠেকাতে কিছু নিয়মকানুন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ আছে। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে পাকা রাস্তার বাইরের সব জায়গায় ঘাসের আচ্ছাদনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার ক্ষেত্রে সে উদাহরণ অনুসরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়ক বিভাজকে গাছ লাগানো হয়। কিন্তু সেই বিভাজকের মাটি ঘাস দিয়ে ঢাকা থাকে না, এর ধুলা বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। গাছ লাগানোর পাশাপাশি গাছে নিয়মিত পানি দেওয়া এবং ঢাকার সব ফাঁকা জায়গা ঘাসের আচ্ছাদনে ঢেকে দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।

অন্যদিকে শব্দদূষণ তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও কিছু উদ্যোগ যথেষ্ট। বিশেষ করে গাড়ির হর্ন এবং মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার প্রশাসন চাইলেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। যেহেতু এর সঙ্গে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্পর্ক নেই বললেই চলে, সেহেতু এটি করতে গেলে প্রশাসনকে বড় ধরনের কোনো চাপের মুখেও পড়তে হবে না।

মোদ্দা কথা, ঢাকা শহরকে বায়ু ও শব্দদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে প্রথম দরকার নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন। দূষণাসুরকে বধ করতেই হবে, এই লক্ষ্যে অটল থেকে যদি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলেই শ্বাসরোধকর অবস্থা থেকে ঢাকা বেরিয়ে আসবে।

  • কার্টসি - প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০ 

Monday, February 10, 2020

অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে — সালেহ উদ্দিন আহমেদ

তামান্না মোমিন খান

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সার্বিক দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবগুলো সূচক নিম্নমূখী। শুধু রেমিট্যান্স একটু ভালো। বাকি আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আয় ও ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতির একটা চাপ আছে। অর্থমন্ত্রী এটা অনুভব করেছে। তার মানে এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, আমার মতে এইসব নিয়ে বলার কিছু নেই।

সদিচ্ছা থাকলে সিরিয়াসলি নিলে সমস্যা উত্তরণ করা সম্ভব। শুধুমাত্র কথাবার্তা বলে বা বক্তব্য দিয়ে কোন লাভ হবে না। সমস্যা উত্তরণের জন্য শক্ত হাতে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং ব্যাংকগুলোকে ঠিকমত শৃঙ্খলা এবং তাদের যে নিয়ম-কানুন তা পরিপালনে শক্ত হতে হবে। কোনরকম ছাড় দেয়া যাবে না। যারা রপ্তানিকারক তাদের অনেক ঝামেলা আছে। ফরেন একচেঞ্জ- এখানেও ঝামেলা আছে। সেটার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ

সাবেক এই গভর্নর বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে তো এখন চায়নার বিষয়টি আছে। অর্থনীতির বহুমাত্রিক বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। উনারা জানেন সমস্যাগুলো কোথায়। প্রয়োজন হলে আরও ভালোভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু বললেই হবে না ভালো করছি, ভালো চলছে। অন্যায় সুবিধা, ছাড় দেয়া এগুলো সব বন্ধ করতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এখনই অ্যাকশন নিতে হবে, যেহেতু অর্থমন্ত্রী উপলব্ধি করেছেন।  

সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বহুমাত্রিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থপনা। ব্যাংকিং খাততো আছেই। ব্যাংক, বীমা, পুঁজিবাজারও বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যহীনতা, ঋণ ঘাটতি এগুলো ঠিক করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থপনা যদি সঠিক না হয় দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০ 

খালেদা জিয়াকে নিয়ে খোলা চিঠি

রুমিন ফারহানা

‘কেমন আছেন?’ আর সব চিঠির মতো এই প্রশ্নটা করছি না শুরুতেই। কারণ আপনার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা ভীষণ অবান্তর। ছয় মাসের মতো হয়ে গেল শেষবার আপনাকে দেখেছি সামনা সামনি, হাসপাতালের প্রিজন সেলে। কষ্টে ব্যথায় যন্ত্রণায় বারবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন আপনি। খবর পাই আপনার অবস্থা প্রতিদিন আরো খারাপের দিকে যায়। আপনি খারাপ আছেন, ভীষণ খারাপ আছেন।

মনে পড়ছে প্রায় ১০ বছর আগের একটা দিনের কথা। আপনার সঙ্গে বহু বছর পর আবার আমার দেখা হয়েছিল আপনার অফিসে। কী গভীর মমতার দৃষ্টি নিয়ে সেদিন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন! কী অসাধারণ মায়াভরা কণ্ঠে কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার, বাবা-মার।

একজন আইনজীবী হিসেবে আমি পেশাগতভাবে ভালো করছি সেটা আপনি জানতেন উল্লেখ করে পরামর্শ দিয়েছিলেন মন দিয়ে যেন প্র্যাকটিস করে যাই। কিন্তু আমার লক্ষ্য সরে গেল আপনার অকুণ্ঠ স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার কারণেই।

আমার বাবা অলি আহাদ ইন্তেকাল করেন ২০১২ সালের ২০শে অক্টোবর। বাবা যেদিন চলে যান, ঠিক সেদিনই আপনি চীনে দীর্ঘ রাজনৈতিক ভ্রমণ শেষ করে মাত্রই দেশে ফিরেছেন। কোনো শারীরিক, মানসিক ক্লান্তির তোয়াক্কা না করে বিমানবন্দর থেকে আপনি সরাসরি চলে এসেছিলেন হাসপাতালে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। আজীবন আদর্শবাদী রাজনীতি করা একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদের প্রতি আপনার গভীর শ্রদ্ধা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম সেদিন। যদিও এর আগে পরে বহুবারই এই শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ আমি দেখেছি। গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। সেই স্পর্শ আমাকে সাহস দিয়েছিল জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার। এর কিছুদিন পরই ২০১৩ সালে আমাকে না জানিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন যাবার প্রতিনিধি দলে আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন। তার কিছুদিন পরই আমাকে স্থান দিয়েছিলেন ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সব বিশাল নাম সেই কমিটিতে তখন। তার কিছুদিন পর আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক বানালেন আপনি। কতটা পেরেছি জানি না, আমার ওপর অর্পিত প্রতিটি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি সর্বান্তকরণে। বহুবার কানে এসেছে অনেকের অনেক কথাকে দু’পায়ে ঠেলে শক্তভাবে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন আপনি। এত ভালোবাসা, স্নেহ আর বিশ্বাসের ঋণ কি দিয়ে চুকাবো আমি?

এমন গল্প শুধু আমার না, এমন ব্যক্তিগত গল্প আছে এই দলের অসংখ্য মানুষের- যাদের আপনি ‘কিছু না’ থেকে পরিণত করেছিলেন ‘অনেক কিছু’তে।
রুমিন ফারহানা

যখন বেড়ে উঠছিলাম একটু একটু করে, বুঝতে শুরু করেছি সমাজ-রাজনীতি তখন থেকেই দেখেছি আপসহীন শব্দটা এই দেশে আপনার নামের একটা প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। সেটার এক অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ চাক্ষুষ করেছিলাম যেদিন সর্বশেষ আপনাকে দেখতে যাই হাসপাতালে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ম্যাডাম অনেক সাংবাদিক তো প্যারোলের কথা জানতে চায়, কি বলবো? অসুস্থতায়, দুর্বলতায় আপনার ক্ষীণ কণ্ঠটি চকিতে কঠোর হয়ে উঠলো, জানালেন, আপনি প্যারোল চাইবেন না, কারণ আপনি জামিনের হকদার।

দেশের এক রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্ন, এক-এগারোর পর সেই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলাম। সেই সময় আপনার মামলার মতো মামলায় কত মানুষের জামিন করিয়েছি আমরা। আইনের একেবারে প্রাথমিক পাঠ এর ছাত্ররা, এমনকি সাধারণ সচেতন মানুষও জানে বেশি বয়স, নারী, শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক অবস্থানের যেকোনো একটি গ্রাউন্ডেই একজন মানুষ জামিন পেতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে এর সবগুলো আছে, কিন্তু জামিন পান না আপনি। একটা সরকার এই রাষ্ট্রের প্রশাসন, বিচার সবকিছু একত্র করে সর্বশক্তিতে নেমেছে আপনাকে জেলে আটকে রাখার জন্য। কারণ আপনাকে বন্দি করা গেলে বন্দি হয় গণতন্ত্র, বন্দি হয় দেশের ১৭ কোটি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।

এটা অনুমিতই ছিল। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া ছাড়া একটার পর একটা মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পথে এই সরকারের প্রধান বাধা আপনি। সেই স্বৈরাচারী এরশাদের সময় থেকেই আপনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক আপনি। ক্ষমতাসীন দলটি এরশাদের সঙ্গে আপস করে তার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে সাহায্য করেছিল, শুধু আপনার দৃঢ়তার কারণেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেনি এরশাদ। এরপর এক এগারোর সরকার আপনাকে জোর করে দেশ থেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আপনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, যাননি, যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও জুগিয়েছিল দেশে ফিরে আসার সাহস।

আপনার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস বলে আপনাকে ভয় পাবারই কথা যেকোনো স্বৈরশাসকের। পাচ্ছে বর্তমান স্বৈরাচারটিও।

যে অভিযোগে আপনার ওপর এই বিপর্যয় নেমে এসেছে, কি বীভৎস মিথ্যা সেটা। একটি পয়সাও এদিক-সেদিক হয়নি বরং বেড়েছে সেটা অনেক। আপনাকে নিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটছে এমন একটা দেশে যে দেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়, বিদেশে পাচার হয় প্রতিবছর। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতারাও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। সর্বোচ্চ পর্যায়ের অঙ্কের কথা কল্পনায় আনতেও ভয় লাগে।

আমি জানি দীর্ঘ ১১ বছর বীভৎস সব নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের নেতাকর্মীরা। জানেন ম্যাডাম, এখন আমাদের মধ্যে দেখা হলে প্রাথমিক কুশলের পর অনিবার্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে কার বিরুদ্ধে কয়টা মামলা। অসংখ্য কর্মী মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেল খেটেছে, বহু কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্রসফায়ারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে, অনেক কর্মী এখনো গুম হয়ে আছে। তাদের সবার কষ্ট বুকে ধারণ করেই তো আজ আপনি কারাগারে। আপনি চাইলে, একটু ইশারা করলে কি না হতে পারত? আরাম আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের চেয়ে ১৭ কোটি মানুষের জীবন বড় হয়ে উঠলো যে আপনার কাছে। আপনি যে বেগম খালেদা জিয়া, ইতিহাসে রাষ্ট্রনায়ক হবার জন্য যার জন্ম।

এই দেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করা একজন আইনজীবী, বিচারাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই জানি বিচার প্রক্রিয়ায় আপনার মুক্তি হয়তো সম্ভব না। বাকি থাকে নানামুখী প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। সংসদ, টকশো, কিংবা পত্রিকার কলাম যখন যেখানে পেরেছি আপনার ওপর বীভৎস নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। রাস্তায়ও আমাদের কর্মীরা নেমেছে। কিন্তু সরকারের মামলার খড়গও নেমে এসেছে সবার ওপর, আমার বিরুদ্ধেও কয়েকটি মামলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে।

এটা যেমন সত্যি, পরিস্থিতি ভীষণ প্রতিকূল, তেমনি এটাও সত্যি এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাদের পথ বের করতে হবে। মা, পারছি কি আমরা?

এতবড় দল আপনার, কিন্তু দুই বছরের বেশি জেলে থাকার পরও সেই বিশাল দল সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি আপনাকে মুক্তি দিতে, এটা ভেবে কি আপনার মনে কষ্ট হয় খুব? আগেই বলেছি অনেকে ‘কিছু না’ থেকে ‘অনেক কিছু’তে পরিণত হয়েছে আপনার আশীর্বাদে। আপনার এই দুর্দিনে আমাদের দায়িত্ব আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি- এই অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিটা মুহূর্তে।

মা’গো, আমরা লজ্জিত, আপনার কাছে অপরাধী। আপনার যোগ্য সন্তান হতে পারিনি আমরা। কিন্তু মা দেশের মানুষ মুক্তির যে স্বপ্ন দেখে- গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদাপূর্ণ সমাজের যে আশা আজও বুকে ধারণ করে তা আপনাকে ঘিরেই। তারা বিশ্বাস করে আপনার হাতে দেশ নিরাপদ, নিরাপদ দেশের মানুষ। আপনি বারবার মুক্ত করেছেন এদেশের মানুষকে। এবারও আপনার হাত ধরেই আসবে গণমানুষের মুক্তি। আপনি তাদের একমাত্র আস্থা আর বিশ্বাসের ঠিকানা। সাধারণ মানুষই তাদের স্বার্থেই মুক্ত করে আনবে আপনাকে। তাদের হৃদয়ের সিংহাসনে আপনি রানীর আসনে অসীন থাকবেন চিরকাল।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০ 

‘উন্নত’ দেশ ও কম ভোটতত্ত্ব: কল্পনা না বাস্তবতা

গোলাম মোর্তোজা

বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এত ভালো, এত ভালো যে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। শুধু ভালো আর ভালোর মাঝেই হঠাৎ করেই পৃথিবীর সেরা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, “দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।”

হঠাৎ করে কী এমন ঘটে গেল যে, এত ভালো থেকে “ভালো না” হয়ে গেল?

এক বছর আগে পর্যন্ত নির্বাচন ছিল এদেশের মানুষের কাছে উৎসব। উৎসবের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, মৃত ভোটারও ভোট দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বগুড়ার ভোটার দেশে না ফিরেও ভোট দিয়েছিলেন, পোস্টাল বা অনলাইন ভোটের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও। শতভাগ ভোটের পাশাপাশি, তালিকার চেয়ে বেশি ভোটারের ভোট দেওয়ার ঘটনাও দৃশ্যমান হয়েছিল।
গোলাম মোর্তোজা

কিন্তু, পহেলা ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট উৎসব দৃশ্যমান হয়নি। অত্যন্ত কম সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে এসেছেন। ভোটার উপস্থিতি কম যে এবারই প্রথম দৃশ্যমান হয়েছে, তা নয়। উপনির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে যায়নি। তখন বলা হয়েছে, বিএনপি অংশ নেয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় মানুষ ভোট দিতে আসেনি। বিএনপি অংশ নেওয়ায় এবারের সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন যুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে যুক্তি দেওয়া বন্ধ হয়নি।

“সিটি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেনি তাদের একটি বড় অংশ খুব আরাম আয়েশে আছে। বাসায় খুব আরামে বসে পোলাও খাচ্ছে” নির্বাচনের দিন হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে একথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

নির্বাচন কমিশন সচিব কম ভোটার উপস্থিত বিষয়ে বলেছেন, তিনদিন ছুটি ছিল। ভোটাররা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, এটাই ১০০ বছরের মধ্যে সেরা নির্বাচন।

ভোট কেন কম পড়ল, প্রথমাবস্থায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত। তারপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, উন্নত দেশে কত মানুষ ভোট দিতে আসেন? গণতন্ত্রের উদাহরণ আমেরিকা। সেখানে কত শতাংশ ভোট পড়ে? সেসব দেশের গণতন্ত্র কি ধ্বংস হয়ে গেছে?

ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগের বিজয়ী মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, “দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ যে উন্নতির দিকে যাচ্ছে তার প্রমাণ ভোটার উপস্থিতি কম।”

এমন কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন।

সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, উন্নত দেশের মানুষ ভোট দিতে যায় না। উন্নত দেশের নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়ে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, উন্নত দেশের মানুষের কাজ ও জীবনযাপনের নিশ্চিত নিরাপত্তা থাকায় তারা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেন না। কোন দল ক্ষমতায় এলো, কে এমপি বা মেয়র সেসব সংবাদ রাখেন না বা রাখার প্রয়োজন মনে করেন না।

কথাটা যে পুরোপুরি অসত্য তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলোর মেয়র নির্বাচনে ২০-২৫ শতাংশ ভোট পড়ার নজির রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কম ভোট পড়ার এমন নজির সর্বজনীন কি না? পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর ভোটের চিত্র কেমন?

এশিয়ার সবচেয়ে ও পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ জাপান। জাপানের রাজধানী টোকিওর ২০১৪ সালের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এশিয়ার আরেক উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ২০১৮ সালের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ইংল্যান্ডের ২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে চারটি শহরের চিত্র দেখে নেওয়া যাক। লন্ডনে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ব্রিস্টলে ২৪ শতাংশ, লিভারপুলে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ, ম্যানসফিল্ডে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ জার্মানির ২০১৬ সালের বার্লিন ও মিউনিখের সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৪৪ দশমিক ০১ শতাংশ। ২০১৬ সালের রোমের সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫০ দশমিক ০১ শতাংশ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লির বিধান সভা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬২ দশমিক ০৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। উত্তর আমেরিকার আরেক উন্নত দেশ কানাডা। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে কানাডার ৬৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। জার্মানি ও ফ্রান্সের ২০১৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৭৬ দশমিক ০২ শতাংশ এবং ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নরওয়ের ২০১৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৪৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল ২০১৯ সালের সুইজারল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে। ইংল্যান্ডের ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৬৭ দশমিক ৩০ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে জাপানের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

সুতরাং বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে বা উন্নত হয়ে গেছে, এ কারণে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোট কম পড়েছে, কোনো বিবেচনায় কি এটা যুক্তি হতে পারে? যেসব উন্নত দেশের ভোটের চিত্র এখানে উল্লেখ করা হলো, সেসব দেশের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৪০-৫০ হাজার ডলার কম। মাথাপিছু ৫০ হাজার ডলার আয়ের মানুষ ভোট দিতে যায়, আর বাংলাদেশের ২০০০ ডলার আয়ের মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায় না!

ঢাকার মানুষ যে ভোট দিতে গেল না, তার প্রকৃত কারণ যে ‘উন্নত’ হয়ে যাওয়া নয়, যুক্তি দিয়ে তা না বোঝালেও চলে। তিনদিনের ছুটি, ফেসবুক বা পোলাও-কোরমা খাওয়াও যে কারণ নয়, যারা এসব কথা বলছেন তারাও তা জানেন। আসলে প্রকৃত কারণ আড়াল করতে চাইলে এমন অনেক কথা সম্ভবত বলতে হয়।

নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন গণপরিবহন বন্ধ করে দিল। মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেরও অনুমোদন থাকল না। যিনি ভোটার হয়েছিলেন মোহাম্মদপুরে, বাসা বদল করে তিনি হয়ত চলে গেছেন উত্তরায়। তিনি উত্তরা থেকে মোহাম্মদপুরে কীভাবে আসবেন ভোট দিতে? বিষয়টি হয় নির্বাচন কমিশন বিবেচনায় নেয়নি, বা যাতে ভোট দিতে আসতে না পারেন তা বিবেচনায় নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটারদের উৎসাহিত করার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই অভিযুক্ত ছিল।

ইভিএমে ভোট হলে রাতে ভোট বা কারচুপির সুযোগ থাকবে না, নির্বাচন কমিশনের এই যুক্তিতে মানুষের আস্থা ফিরে আসেনি। ইভিএমসহ সব যন্ত্রই মানুষ দ্বারা পরিচালিত। মানুষ যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত নয়। মানুষের সন্দেহ ইভিএমের প্রতি ছিল না। সন্দেহ এবং অনাস্থা ছিল নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইভিএমে ফলাফল পরিবর্তন বা জালিয়াতি করা যায় না। ইভিএমে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হবে মেশিন সেভাবে কাজ করবে। এবং যাদের নিয়ন্ত্রণে ইভিএম থাকবে, তারা প্রোগ্রাম পরিবর্তন করতে পারবেন। প্রযুক্তির এই যুগে এসব তথ্য কমবেশি সবাই জানেন।

অনাস্থা বা বিশ্বাসহীনতা নির্বাচন কমিশনের প্রতি হওয়ায়, ভোটের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়েছেন। ইভিএমে না হয়ে নির্বাচন ব্যালটে হলেই যে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরে আসতো, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। বাস্তবের ঘটনা আর নির্বাচন কমিশনের অবস্থান বা বক্তব্যে কোনো মিল খুঁজে পাননি ভোটাররা। এই বিশ্বাসে তারা পৌঁছে গেছেন যে, তাদের ভোটের কোনো গুরুত্ব নেই।

নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করতে শুরু করলেন যে, বিএনপি সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় নিয়ে এসেছে। তারা ভোটকেন্দ্র দখল করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের অভিযোগের জবাবে বিএনপি নেতারা বললেন, আওয়ামী লীগ সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় জড়ো করেছে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের সুযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলল, পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ বের হবেন না। বহিরাগতরা ঢাকা ছাড়ুন।

বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশের রাজধানী শহরে কেন ‘বহিরাগত’ হবেন? ‘পরিচয়পত্র’ সঙ্গে রাখার নির্দেশনা আসবে কেন? একটা আতঙ্ক ছড়ালো ভোটের আগের দিন। ভোটার কম উপস্থিতির এটাও একটি কারণ। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব বক্তব্য বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে নীরবতা পালন করতে দেখা গেল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে এমন কথা বলানোর নির্দেশনা কী তাহলে নির্বাচন কমিশনই দিয়েছিল?

ভোটারদের আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, সরকারেরও। সেদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ আনা হয় নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে। নাগরিক সমাজ তো ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করেননি। বিএনপিকে অভিযুক্ত করা হয়, তাদের ডাকে মানুষ রাস্তায় নামে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সম্মিলিত ডাকেও মানুষ ভোটকেন্দ্রে এলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সত্যি-সত্যি জনগণ থেকে কতটা দূরে সরে গেছেন? রাজনীতিবিদদের আত্মোপলব্ধিতে কি আসছে বা আসবে বিষয়টি?

  • কার্টসি - ডেইলিস্টার / ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০

Sunday, February 9, 2020

কম ভোট পড়াই কি এখন নতুন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে যাচ্ছে?

 ড. বদিউল আলম মজুমদার


গত কয়েকদিন যাবত আমি বার বার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি: কেমন হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটির নির্বাচন? এর উত্তর খুঁজতে নির্বাচনের পরে সুজন-এর ফেসবুক পেজে আমরা একটি অনলাইন ভোটের ব্যবস্থা করি। এতে চার হাজারেরও বেশি মানুষের সাড়া পড়েছে। যারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের প্রায় ৯৪ শতাংশই বলেছেন যে নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। যদিও অনলাইন ভোট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, এটি জনসাধারণের ধারণার অনেকটা ইঙ্গিত বহন করে।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক নির্বাচন সম্পর্কে আমি প্রায় দুই ডজন সাংবাদিককে, যারা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করেছেন, তাদেরকে তাদের মতামত জিজ্ঞাসা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে, তাদের কারোর কাছেই মনে হয়নি যে নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারির সিটি নির্বাচনে আমি নিজেও সাতটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে চারটি ঢাকা উত্তরের এবং বাকি তিনটি ঢাকা দক্ষিণের। এই কেন্দ্রগুলোতে আমি প্রিজাইডিং অফিসার এবং অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তখন অনেক ভোটারের সঙ্গেও কথা বলেছি। পরিদর্শনকালে আমি অনেককে দেখতে পেয়েছি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাজ পরে কেন্দ্রের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করছেন, যা ছিলো নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ এবং তারা একটি শোডাউনের অংশ হিসেবে সেখানে অবস্থান করছিলেন।

তবে আমি কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি পেয়েছি খুব নগণ্য এবং জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচনের প্রতি আগ্রহও দেখেছি অতি সামান্য। আমি যে কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছি সেখানে বিরোধীদলের মেয়র প্রার্থীদের কোনো এজেন্ট দেখতে পাইনি। কেন্দ্রগুলোতে আমি কোনো ধরনের সহিংসতাও দেখিনি, যা ছিলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কয়েকজন নির্বাচনী কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, গত জাতীয় নির্বাচনের মতো তারা চাপও অনুভব করেননি। সামগ্রিকভাবে, সেখানে আমি লক্ষ্য করেছি ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক অনীহা (cynicism) উদাসীনতা (resignation)।

ভোটারদের অনীহা ও উদাসীনতার কারণেই সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে, যেখানে আমি গিয়েছি, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৫৯ জনের মধ্যে ৩০ জন (বা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ) ভোট দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর পর্যন্ত ৩ হাজার ১৯৮ জনের মধ্যে ২৪৪ জন (বা ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ), বেগম রহিমা আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৩ জনের মধ্যে ৩৯২ জন (১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ), মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের পুরুষ কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২ হাজার ২৩২ জনের মধ্যে ৪০০ জন (বা ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ) এবং ওখানকার নারী কেন্দ্রে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২ হাজার ৬৯৩ জনের মধ্যে ২৭০ জন (বা ১০ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ) ভোট দিয়েছিলেন। আমার নিজের দেখা এ নগণ্য ভোটের হারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ঢাকা উত্তরের ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণের ২৯ শতাংশের ফলাফল সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

নির্বাচন কমিশন গভীর রাত পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করতে না পারার কারণেও ঘোষিত ফলাফল নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইভিএম থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে ফলাফল পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু, কমিশন গভীর রাত পর্যন্ত সে ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী কমিশনের বিরুদ্ধে ফলাফল পাল্টানোর এবং ‘ডিজিটাল কারসাজি’র অভিযোগ তুলেছেন। দৈনিক মানবজমিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আলমগীরের জালিয়াতির অভিযোগের কারণে ঢাকা দক্ষিণের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।

দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কম ভোট পড়ার জন্য মোটাদাগে চারটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ। নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএমগুলোতে পেপার ট্রেইল (ভোটার ভেরিফিকেবল পেপার অডিট ট্রেইল- ভিভিপিএটি) নেই। উল্লেখ্য, অধিক নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিতের স্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ২০১১ সালের এক আদেশের কারণে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তাদের ইভিএেম ভিভিপিএটি সংযুক্ত করেছে। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের গঠিত প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। নির্বাচন কমিশন তারপরও ভিভিপিএটি ছাড়াই ইভিএম ক্রয় করেছে। পেপার ট্রেইল থাকলে ভোটগুলো পুনরায় গণনা করা যেতে পারে, যার ফলে ফলাফল নিয়ে ওঠা অভিযোগের সহজেই সমাধান হতে পারে।

আমাদের ইভিএমের আরেকটি দুর্বলতা হলো: কিছু কিছু ভোটারের ক্ষেত্রে তাদের আঙ্গুলের ছাপ শনাক্ত করতে না পারা। যেমনটি হয়েছিলো ড. কামাল হোসেন, এমনকী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষেত্রেও। এই দুর্বলতার কারণে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএম ওভাররাইড এবং ভোটারদের পরিচয় আপলোড করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো। গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষেত্রে নির্বাচন কর্মকর্তাদের এই ক্ষমতা দেওয়া ছিলো। সাম্প্রতিক নির্বাচন দুটোতে এই ক্ষমতা দেওয়া ছিলো এক শতাংশ ভোটারের জন্য, যা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের দেওয়া একটি বিশেষ কোড দিয়ে বাড়ানো যেতো।

নির্বাচন কর্মকর্তারা যদি তাদের আঙুলের ছাপ না নিয়েই ভোটারদের পরিচয় আপলোড করতে পারতেন, তাহলে তারা ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের অনুপস্থিতিতে ভোটও দিতে পারতেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ইতোমধ্যেই উঠেছে। উল্লেখ্য, ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা উত্তরের ৪৫টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ৭৮ দশমিক ২১ শতাংশ।  ঢাকা দক্ষিণের ৫০টি কেন্দ্রে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ৭৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। ভোট পড়ার এসব উচ্চ হার নিয়ে অনেকের মধ্যে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। প্রসঙ্গত নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিলো- The only safe election is a low-tech election. (February 4, 2020)।

কম ভোট পড়ার দ্বিতীয় কারণ হলো: নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার অভাব। গত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকার কারণে অনেক নাগরিক এবারের ভোট বর্জন করেছেন। তাদের অনেকের মনে ধারণা হয়েছে যে, তাদের ভোটের কোনো প্রভাব নির্বাচনে পড়বে না। এছাড়াও, অনেকের মনে আশঙ্কা ছিলো যে ভোটকেন্দ্রে গেলেও তাদের ভোট দিতে দেওয়া হবে না।  তাদের প্রার্থীরা কোনো না কোনোভাবে বিজয়ী হবেনই, এই আত্মবিশ্বাসের কারণে এমনকী অনেক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরাও ভোট দিতে যাননি।

কম ভোট পড়ার তৃতীয় কারণ, ভোটকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে শোডাউন করায় সৃষ্ট নিরাপত্তা-ঝুঁকি। এই নিরাপত্তা-ঝুঁকি অনেক ভোটারকে নিরুৎসাহিত করেছিলো ভোটকেন্দ্রে যেতে। তাদের ভয় ছিলো ভোটকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা তাদের হয়রানি করতে পারে। এমনকী, ভোট দিতে বাধাও দিতে পারে। এই ধরনের ভয় বেশিরভাগ বিরোধীদলের প্রার্থীর সমর্থকদের নিরুৎসাহিত করেছিলো ভোটকেন্দ্রে যেতে।

ভোটের খরার চতুর্থ কারণ — ভোট প্রদানে বাধা। আমি অভিযোগ পেয়েছি, অনেক স্থানে ভোটকেন্দ্রের সামনে প্রকৃত ভোটারদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিলো। কোথাও কোথাও ভোট প্রদানে বাধা দিতে শোডাউনকারীরা কৃত্রিম লাইন তৈরি করেছিলো। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থক হিসেবে পরিচিত ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এই ধরনের হয়রানির সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ভোটার তা দেখে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুত্সাহিত হন।

আমি ভোটারদের কাছ থেকে আরও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। অনেকের মতে তারা নির্দ্বিধায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ভোটকেন্দ্রে অবাঞ্ছিত ‘সহায়তাকারী’রা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করছিলো বা তারাই ভোটারদের পক্ষে ভোট দিয়ে দিচ্ছিলো। কিছু ভোটারকে বলা হয়েছিলো, ইভিএমে ভোট দিলে তারা কাকে ভোট দিচ্ছে তা গোপন থাকবে না। তাই তারা কাকে ভোট দিচ্ছে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বেশ কয়েকজন ভোটার অভিযোগ করেছিলেন, তাদের পরিচয় আপলোড করতে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরই তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

সামগ্রিকভাবে, এটি স্পষ্ট যে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ছিলো ‘নিয়ন্ত্রিত’, যদিও অতীতের তুলনায় নিয়ন্ত্রণের ধরন ছিলো ভিন্ন। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন এবং কম ভোট পড়া যেনো এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত, ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে যে উদ্বেগ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা ছিলো সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হয়নি, বরং সেগুলো আরও প্রকট হয়েছে।

এই উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে নির্বাচনই ক্ষমতা রদবদলের একমাত্র বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ পথ। যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা এক অশুভ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারি, যার দায় নিতে ক্ষমতাসীনদেরকে এবং মাসুল গুনতে হবে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন - সুশাসনের জন্য নাগরিক
  • কার্টসি - ডেইলি স্টার/ ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০ 

বিদেশীরা নিয়ে যাচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা


বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীরা প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন? এ নিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষা রয়েছে। ২০১৭ সালে করা সেই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দেশে বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি বিদেশী নাগরিক কর্মরত রয়েছেন। প্রতি বছর এসব বিদেশী দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার (৫ বিলিয়ন ডলার)। বর্তমান ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হারে যার পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা।

তবে ২০১৮ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, আমাদের দেশে এখন বিপুলসংখ্যক বিদেশী কাজ করছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেশের কাজে লাগছে না। আমরা নিজেরাই দক্ষতা অর্জন করতে পারলে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরো গতিশীল করবে।

তিনি আরো বলেছিলেন, দেশের বৃহৎ চারটি শিল্পখাতে মধ্যম এবং নির্বাহী পর্যায়ে দক্ষ জনবলের অভাবে বিদেশীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আর এ কারণে দেশ থেকে প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানোর পাশাপাশি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দেশেই দক্ষ জনবল তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

অন্য দিকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ২০১৩ সালের ২১ মে ‘ফিফটিন নেশসন সেন্ডিং হাইয়েস্ট রেমিট্যান্স টু ইন্ডিয়া’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অর্থাৎ ভারতের রেমিট্যান্স পাঠানোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে (২০১৩ সাল) বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ভারতীয় বসবাস করছে। এসব ভারতীয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩৭১ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশে প্রেরণ করছে। আগামী কয়েক বছর অর্থ প্রেরণের পরিমাণ আরো বাড়বে। এসব ভারতীয় অধিকাংশ তৈরী পোশাক খাত, এনজিও ও বস্ত্রখাতে কাজ করছে।

বিবিসির উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলা ট্রিবিউন ২০১৮ সালের ২০ মে এক তথ্যে জানায়, প্রতি বছর এ দেশ থেকে ভারতে ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে চলে যাচ্ছে। মূলত ‘দক্ষ’ জনশক্তির অভাবে এ দেশে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় কাজ করছে। শুধু ভারতীয় নয়, এখানে শ্রীলঙ্কানও কাজ করছে। পাশাপাশি কিছু রয়েছে পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের অধিবাসী।

এ দিকে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীরা বছরে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করছে।

বেতন-ভাতার নামে এই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশে বিদেশীদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। গত বুধবার টিআইবির ধানমন্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি।

সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীর প্রাক্কলিত ন্যূনতম সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। ন্যূনতম এই সংখ্যার হিসাবে দেশ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায় এবং তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়।

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এ দেশে বসবাসরত বিদেশীদের অধিকাংশই কাজ করছে তৈরী পোশাক খাতে। বাদবাকিরা চামড়া শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল ও বিদেশী কয়েকটি সংস্থায় কর্মরত। এসব বিদেশীর অধিকাংশ ট্রাভেল ভিসায় এখানে এসে অবৈধভাবে কাজ করছে। তবে সব বিদেশী এখানে কাজ করার প্রধান কারণ হচ্ছে- তারা যেসব কাজ করছে তা করার জন্য স্থানীয়ভাবে দক্ষ লোক পাওয়া যায় না।

ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই দেশের উদ্যোক্তরা বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট খাতে দক্ষ লোক এনে এখানে নিয়োগ দিচ্ছেন। আর এতে করে দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এখন এ প্রবণতা ঠেকানোর জন্য দেশে দক্ষ লোক তৈরি করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটির নামকরণ করা হয়েছে ‘স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি)।

প্রকল্পটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এডিএফ ঋণ, সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের (এসডিসি) অনুদান এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০২০ মেয়াদে দক্ষতা উন্নয়নে পাঁচ লাখ দুই হাজার লোককে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ছিল। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থীকে সংশ্লিষ্ট শিল্প সংগঠনের আওতাভুক্ত শিল্প/প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করা হবে। তবে এই প্রকল্প থেকে এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক লোক প্রশিক্ষণ নিয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি।

  • কার্টসি- নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০ 

দুরবস্থায় ব্যাংকিং খাত

আশরাফুল ইসলাম

পুঁজিবাজারে দুরবস্থায় পড়েছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আগে যেখানে মোট বাজার মূলধনের ৪০ ভাগের ওপরে দখলে ছিল এ খাতের, এখন সেটা কমতে কমতে ২০ ভাগের নিচে নেমে গেছে।

শুধু তা-ই নয়, অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে আট ব্যাংকের শেয়ার। ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার জন্য এ খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব দেখা দেয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক, এনন টেক্স, ক্রিসেন্টের মতো বড় বড় ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা যখন বিনিয়োগকারীরা জানতে পারেন, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ঘটনা যখন ঘটে, খেলাপি ঋণ যখন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, তখন শঙ্কিত হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগ করে মূলধন হারানোর আতঙ্ক থেকে এ খাতের ওপর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যাংকের শেয়ার মূল্যের ওপর।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) গত বৃহস্পতিবারের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য যখন ১০ টাকা, সেখানে আটটি ব্যাংকের শেয়ার মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমে গেছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক রয়েছে। আর ওই দিন ২২টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টিরই অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, কোনো কোম্পানির ওপর যখন বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারী যখন বুঝতে পারেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তার বিনিয়োগ তুলতে পারবেন না, তখন ওই কোম্পানিতে আর শেয়ারে বিনিয়োগ করেন না।

এতে ওই কোম্পানির মূল্য কমে যায়। ব্যাংকিং খাতে শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়া এটাই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি জানান, দেশের পুঁজিবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৪০ ভাগের ওপরে দখলে ছিল ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার। এখন তা কমতে কমতে ২০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার জন্য নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ঘন ঘন নীতিমালা শিথিল করা। ২০১৫ সালে ঋণপুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়। এর বাইরেও ওই সময়ে অনেক ব্যাংকেরই ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়।

এতে রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমে গেলেও আবার ঋণখেলাপিরা এ সুযোগ নিয়ে নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। কিন্তু নবায়ন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা নতুন করে খেলাপি হয়। এভাবেই গত কয়েক বছর যাবৎ ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়ায় ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক ভালো ঋণগ্রহীতা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের শুরুতেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে সুদের হারেও ছাড় দেয়া হয়।

এ সুবিধার আওতায় ১০ বছর মেয়াদি ঋণ নবায়নের সুযোগ নিতে ঋণ পরিশোধ অনেকাংশেই বন্ধ করে দেন বড় বড় ঋণগ্রহীতারা। এর পরেও গত সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকায়। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাবে তা প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। সবমিলে ব্যাংকের নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। ব্যাংকাররা মনে করেন, সামনে এ আয়ের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর আয় আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুঁজিবজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর।

ব্যাংক খাতের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওতার কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়া। গত কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংকিং খাতে যে দুর্নীতি, ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, আর এসব সংবাদ শুনতে শুনতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। হলমার্ক ঘটনার দাগ মুছতে না মুছতেই বিসমিল্লাহর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে। এর কিছু দিন পড়েই বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে।

বেসিক ব্যাংকের রেশ কাটতে না কাটতেই এননটেক্স, ক্রিসেন্ট লেদারের ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। এর বাইরে প্রতিনিয়তই ব্যাংকের কোনো না কোনো ঘটনা বিনিয়োগকারীরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না কিছু কিছু ব্যাংক। এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না।

এসব কারণে গত কয়েক বছর যাবৎ, অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এ কারণেই গত কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী লভ্যাংশ দিতে পারছে না। বেশির ভাগ ব্যাংকের এমন অবস্থার কারণে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ব্যাংক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার। এরই সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের ওপর।

তিনি মনে করেন, এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন ধরে রাখতে পারবে না বলে তিনি আশঙ্কা করেন। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর সার্বিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করেই সব ব্যাংকের জন্যই অভিন্ন পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা করা হয়। আর এ ৪০০ কোটি টাকার মূলধন করতে গিয়ে দুর্বল ব্যাংক কোম্পানিগুলো শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ও ইকুইটি ধরে রাখতে পারছে না।

তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পরিশোধিত মূলধনের পরিবর্তে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মূলধন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুপারভিশন ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাহলে বর্তমান অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

  • কার্টসি - নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০ 

Thursday, February 6, 2020

ঢাকা সিটি নির্বাচনে অর্জন-বিসর্জন

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

প্রচারণার উৎসব এবং বিরোধী দল ও ভোটারের উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ঢাকায় যে ইভিএম মাধ্যমের ইলেকশনটা হয়ে গেল, তার মাধ্যমে কী পেলাম আমরা? কেমন হলো এই নির্বাচনটি? শুধু বিজয়ী বা পরাজিতদের দৃষ্টিতে নয়, ভোটারের দৃষ্টিতে কেমন ছিল সে নির্বাচন? ভোটারদের সঙ্গে কথা বলার, তাদের মনোভাব জানার সুযোগ নিশ্চয়ই কমবেশি সবারই হয়েছে। তার কিছুটা এসেছে সংবাদমাধ্যমেও। 

প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক। দেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর কয়েকটি শিরোনাম ছিল গোপন বুথে ঢুকে পড়লেন আ.লীগের এজেন্ট, ‘৫ মিনিটে কার্জন হল এলাকা না ছাড়লে খবর আছে’, আ.লীগের ভোটারও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, ১৫-১৭% জনসমর্থন নিয়ে মেয়র, ‘নেই’ আর ‘নেই’-এর নির্বাচন, ইভিএমেও নিজের পছন্দে ভোট দিতে পারলেন না অনেকে, ঢাকার দুই সিটিতে নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ, ‘দ্যাখেন না মিডিয়া আছে, ফিতা খোলেন’, জোর করে অন্য প্রতীকে ভোটের অভিযোগ, আঙুলের ছাপ মেলেনি সিইসির, পরিচয়পত্র দিয়ে ভোট দিলেন, বাটন চেপে ভোটটি দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি, ভোটার না থাক ভোট তো আছে!, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দিল ছাত্রলীগ। 

আরও কয়েকটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল এই রকম ইভিএম আমাকে চিহ্নিত করতে পারেনি : জাফরুল্লাহ চৌধুরী (যুগান্তর), ভোটের মাঠে এক পক্ষ ছাড়া অন্য পক্ষকে দেখা যায়নি : ইসি মাহবুব (যুগান্তর), ইভিএমেও ভোট ‘ছিনতাই’! (বিডিনিউজ ২৪ ডটকম), ঢাকায় ভোটার খরার ভোটে নৌকার জয় (বিডিনিউজ ২৪ ডটকম), ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ভোটারকে মারধর (মানবজমিন), উত্তরায় বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ও এজেন্টকে মারধর (মানবজমিন), আধঘণ্টায় একটি ভোটও পড়েনি সিইসির কেন্দ্রে (মানবজমিন), ভেতরে কৃত্রিম লাইন, ফিরে যাচ্ছেন ভোটাররা (মানবজমিন), নিরাপত্তাহীনতায় কাউন্সিলর প্রার্থীই ভোট দেননি (মানবজমিন), ভোট দিলেন ড. কামাল; লেখা উঠল আবার চেষ্টা করুন (যমুনা টিভি), ইভিএমে যত বিপত্তি (বাংলাদেশ প্রতিদিন), AL People Press EVM (Nwe Age), 3 journos beaten up (The Daily Star), Snapshots of election day: As we saw it (The Daily Star), ভোটে জনগণের অনীহা দেখে যে প্রশ্ন জেগেছে ইসি মাহবুবের মনে (দেশ রূপান্তর)।
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

এই সংবাদ শিরোনামগুলো কী নির্দেশ করে? নির্বাচন কমিশন, সরকার বা আওয়ামী লীগের দাবি করা অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সাক্ষ্য দেয় এই রিপোর্টগুলো? প্রথম আলোর ‘ঢাকার দুই সিটিতে নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ’ শিরোনামের রিপোর্টে লিখেছে, ১. ভোটার যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলো। কাপড় দিয়ে ঘেরা গোপনকক্ষে ভোট সম্পন্ন করতে গেলেন। এ সময় কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন, তা উঁকি দিয়ে প্রত্যক্ষ করছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা। ২. ভোটার গোপনকক্ষে গিয়ে দেখলেন, সেখানে থাকা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তার ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। ৩. ভোটার গোপনকক্ষে প্রবেশ করার পর কোন মার্কায় ভোট দিতে হবে, তা বলে দিচ্ছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। বেশির ভাগ ভোটকক্ষের দৃশ্য ছিল এমনই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে’ ভোট গ্রহণ হয়েছে। ভোটকক্ষ, কেন্দ্রের ভেতরে এবং কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় নৌকার ব্যাজধারীদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে গোপন ভোট আর গোপন থাকেনি। পত্রিকাটি আরও লেখে, প্রথম আলোর ৬৬ জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী দিনভর ঘুরেছেন। তারা ৪২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন। এর মধ্যে সকালে ১২৫টি কেন্দ্রের কিছু কিছু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট দেখা গেছে। তবে বেলা ১টার পর তাদের আর পাওয়া যায়নি। 

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। পত্রিকাটির সাংবাদিকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন ২০৭টি কেন্দ্র। তার মধ্যে মাত্র তিনটি কেন্দ্রের সামনে তারা দেখা পেয়েছেন বিএনপি প্রার্থীর সহায়তাকারীর। আর ধানের শীষের এজেন্ট পেয়েছেন মাত্র ২০টি কেন্দ্রে। কেন্দ্রের সামনে শুধু নৌকা সমর্থকদের জটলা, নৌকার ব্যাজ পরিহিত কর্মীদের দিয়ে কৃত্রিম লাইন বানিয়ে রাখা, ভেতরে শুধু নৌকার এজেন্ট, বুথে ঢুকে ভোটারদের সাহায্য করার নামে নৌকা ও আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলকে ভোট দিতে বাধ্য করা বা নিজেরাই বাটন টিপে দিয়ে দেওয়াসহ সব অপকর্মের চিত্র দুটো পত্রিকার পর্যবেক্ষণেই ছিল অভিন্ন।

এত কিছু করেও এই নির্বাচনে ভোটারের আকাল ছিল লক্ষণীয়। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট ও ঢাকা উত্তরে আতিকুল ইসলাম ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট পেয়ে মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন। তাদের বিপরীতে দক্ষিণে বিএনপির ইশরাক হোসেন পেয়েছেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট ও উত্তরে তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, মোট ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ভোটারের মধ্যে দক্ষিণে মাত্র ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটিতে একদিনেই ভোট হয়েছিল। তাতে ব্যালট পেপারে গড়ে ভোট পড়েছিল ৪৩ শতাংশ। তখন ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৭ শতাংশ; দক্ষিণ সিটিতে ৪৮ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের উপনির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোট পড়ে। এসব পরিসংখ্যানই ইসি ঘোষিত। যার ওপর মানুষের আস্থা নেই মোটেই। অনেকেই মেনে করেন প্রদত্ত ভোটের হার ইসি নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে নির্ধারণ করেন। সে সন্দেহ ঘনীভূত করেছে এবার ফল ঘোষণায় অতিরিক্ত বিলম্ব। 

ইভিএমে আধা ঘণ্টায় ফল ঘোষণা করা যাবে বলে ইসি এত দিন ধরে প্রচার করলেও ঢাকা দক্ষিণের ফল ঘোষণা করতে মধ্যরাত গড়িয়ে যায়, উত্তরের ক্ষেত্রে সময় লাগে আরও বেশি। এর কোনোটিতেই কাগুজে ব্যালটের চেয়ে কম সময়ে ফল ঘোষণা করতে পারেনি ইসি। এ সময় নিয়ে প্রদত্ত ভোটের হিসাবে জালিয়াতি করেছে ইসি, এমন অভিযোগ অনেকেরই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডক্টর কামাল বলেছেন, এই নির্বাচনে মানুষের রায় ৫-৭ শতাংশ, বাকিটা জালভোট। এত জালিয়াতির পরও ঢাকার দুই অংশের মেয়র যে কথিত জনরায় নিয়ে মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন, তা যথেষ্ট কি না সে প্রশ্নও উঠেছে ইতিমধ্যেই। ইসি ঘোষিত হিসেবেই আতিকুল ইসলাম মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিচ্ছেন। অর্থাৎ এই নগরীর ৮৫ শতাংশ ভোটার ভোট দেননি তাদের।

কিন্তু প্রচারে এত উৎসব ভাব এনে, প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট বাড়িয়েও মাত্র ১৪ ও ১৭ শতাংশ ভোটের মালিক কেন আওয়ামী লীগ? অনেকেই বলে থাকেন আওয়ামী লীগের নিজস্ব একটা কোর ভোটার গ্রুপ আছে। তা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেই কোর ভোটার গেল কোথায়? তারাও কি নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে? নাকি আওয়ামী লীগের সেই কথিত কোর ভোটারের সংখ্যাটাই ১৪-১৭ শতাংশে নেমে এসেছে? এই নির্বাচনের পর সংবাদমাধ্যমে যতটা না আলোচনা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ভোট জালিয়াতির নানা কৌশল নির্বাচন কমিশনের দায় নিয়ে, তার চেয়ে বেশি আলোচনা দেখা গেছে মানুষ কেন ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছে তা নিয়ে। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো বিবিসি বাংলাও প্রকাশ করেছে তাদের অনুসন্ধানের সারমর্ম। তাদের চিহ্নিত পাঁচটি কারণ ছিল অনীহা, অনাস্থা, অনিয়মের আশঙ্কা, পরিবহন সংকট ও ছুটির ফাঁদ। বিবিসির দেওয়া পাঁচ কারণের মধ্যে প্রথম তিনটিই যে প্রধান, সে বিষয়ে বোধ করি কারও দ্বিমত নেই। এ সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তাতে মানুষের মনে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভোট দিয়ে কোনো লাভ নেই, ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। 

সরকার যা চাইবে ইসি তাই করবে। সুতরাং ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে লাভ নেই। এর মধ্যেও যারা সরকারের ও তাদের অনুগত ইসির অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক, তাদের একটা অংশ শেষ পর্যন্ত বিরত থেকেছে আওয়ামী লীগের কর্মীদের দখলে থাকা কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো ভোট দিতে না পারার শঙ্কা থেকে। আবার কেউ তাদের হাতে হেনস্তা হওয়ার ভয়েও বিরত থেকেছেন কেন্দ্রে যাওয়া থেকে। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি যদি ভোটকেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারতেন, তবে হয়তো ঘটনা অন্য রকমও হতে পারত। একতরফাভাবে বুথে ঢুকে বাটন টেপার সুযোগ পেত না আওয়ামী লীগ। সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ধানের শীষের ভোটাররা দল বেঁধে যেত কেন্দ্রে। সে জোয়ার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ত ইসি বা সরকারের পক্ষে। কিন্তু এটা তো সবারই জানা যে, বিএনপি গত চৌদ্দ বছর ধরে নানা নির্যাতন সহ্য করে টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ঘরছাড়া, মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত নেতাকর্মীদের অনেকে ঘরে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নতুন করে সংঘর্ষে না জড়ানোর শর্তে। তারা কোন ভরসায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়াবেন? মেয়র নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, ক্ষমতায় সেই আওয়ামী লীগ, তাদের সেই দাপট থাকবে অপরিবর্তিত। তাদের পুলিশ-প্রশাসনের সেই পুরনো চেহারা বহাল থাকবে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় কর্মীদের জন্য কেন্দ্রে এজেন্ট হয়ে টিকে থাকাটা যে কতটা কঠিন, এটা যারা বোঝেন না, তারাই বিএনপিকে গালমন্দ করে বলেন, কেন্দ্রে এজেন্ট রাখতে পারল না কেন বিএনপি। তবে সরকারের এই নিপীড়নমূলক কৌশলকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, বিএনপি সেটা বের করাটাই হলো রাজনীতি। আওয়ামী লীগ কোনো সুবোধ পলিটিক্যাল পার্টি নয় যে, তারা রাজনৈতিক ন্যায্যতা দেখাবে আর সে সুযোগে বিএনপি সরল রাজনীতি করে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবে। বিএনপিকেই ভাবতে হবে, আওয়ামী লীগের এসব কূটকৌশল ও নিপীড়ন উপেক্ষা করে দাঁড়াতে পারে, তেমন কর্মীবাহিনী কীভাবে তৈরি করবে।

  • লেখক, চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রুপান্তর/ ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২০ 

ঢাকার দুই সিটিতে নিয়ন্ত্রিত ভোটের নতুন রূপ

গোপন ভোটকক্ষে ভোটারের পেছনে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। ইভিএমে ‘নির্দিষ্ট’ প্রার্থীর প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। গতকাল বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ কেন্দ্রে। ছবি: জাহিদুল করিম













১. ভোটার যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলো। কাপড় দিয়ে ঘেরা গোপন কক্ষে ভোট সম্পন্ন করতে গেলেন। এ সময় কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন, তা উঁকি দিয়ে প্রত্যক্ষ করছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা। ২. ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে দেখলেন, সেখানে থাকা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তাঁর ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। ৩. ভোটার গোপন কক্ষে প্রবেশ করার পর কোন মার্কায় ভোট দিতে হবে, তা বলে দিচ্ছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। বেশির ভাগ ভোটকক্ষের দৃশ্য ছিল এমনই।

গতকাল শনিবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে’ ভোট গ্রহণ হয়েছে। ভোটকক্ষ, কেন্দ্রের ভেতরে এবং কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় নৌকার ব্যাজধারীদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে গোপন ভোট আর গোপন থাকেনি।

বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপিসহ অন্য দলের মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট আসেননি। কোথাও কোথাও এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

তবে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোটে বড় কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। দুই সিটিতে ভোটকেন্দ্র ছিল ২ হাজার ৪৬৮টি। কোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মারমুখী ভূমিকায় খুব একটা দেখা যায়নি। তবে কোথাও কোথাও ভোটার ও কর্তব্যরত সাংবাদিকদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দুই সিটির সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলে। যন্ত্রের সঙ্গে অনভ্যস্ততার কারণে কীভাবে ভোট দিতে হবে, তা ভোটারদের বুঝিয়ে দিতে দেখা যায় ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টদের। আঙুলের ছাপ মেলাতেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক দফা চেষ্টা করতে হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম থাকায় কোথাও লম্বা সারি দেখা যায়নি।

প্রথম আলোর ৬৬ জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী দিনভর ঘুরেছেন। তাঁরা ৪২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন। এর মধ্যে সকালে ১২৫টি কেন্দ্রের কিছু কিছু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট দেখা গেছে। তবে বেলা একটার পর তাঁদের আর পাওয়া যায়নি।

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন: সংঘাত নেই, ভোট স্থগিত হয়নি। তবে গোপন ভোটকক্ষে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের তৎপরতা।

ভোট গ্রহণ শেষে রাতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলন করে দলের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গত এক শ বছরের যেকোনো নির্বাচনকে যদি পর্যবেক্ষণে আনা যায়, তাহলে এ রকম অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন আর কখনো দেখা গিয়েছে কি না, এটা আমার সাংবাদিক বন্ধুরাই ভালো বলতে পারবেন।’ তিনি বলেন, বিএনপির কোনো এজেন্টকে মারধর করে বের করে দেওয়ার কোনো ঘটনা নেই। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে কোনো কোনো কেন্দ্রে তাদের এজেন্টরা আসেননি।

তবে বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন,কেন্দ্রগুলোয় নৌকার ব্যাজ পরে বহিরাগতরা অবস্থান নিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। তাঁর অভিযোগ, বিএনপির এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি এবং ঢুকতে পারলেও মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ১ শতাংশ ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও এর চেয়ে বেশি ভোট তাঁরা দিয়েছেন।

যেভাবে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করা হয়

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিন স্তরের তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। প্রথমে কেন্দ্রের বাইরে নৌকা ও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন টেবিল পেতে ভোটার স্লিপ দেন। একে ঘিরে তৈরি করা হয় জটলা। স্লিপ দেওয়ার টেবিল থেকে শুরু করে কেন্দ্রের গেট পর্যন্ত ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ভোটার তথ্য কেন্দ্রের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এক বা একাধিক ব্যক্তি তাঁদের কেন্দ্রের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ধানের শীষ বা বিএনপি–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীদের দেখা মিলেছে কমই।

কিছু কেন্দ্রের ভেতর সরকারি দলের কর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। পুলিশের সঙ্গে খোশগল্পে মশগুল ছিলেন তাঁরা। এঁদের কেউ কেউ ভোটারকে সঙ্গে করে নিয়ে বুথ পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
আশ্রাফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আরেকজন। ২. ছবি তুলছে, পেছন থেকে কেউ একজন বলার পর ঘুরে তাকান তিনি। ৩. এরপরই কালো কাপড় দিয়ে তৈরি গোপন কক্ষে মাথা নিচু করে ফেলেন তিনি। কামরাঙ্গীরচর চর, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম


বুথ বা ভোটকক্ষের চিত্র আরও খারাপ। সব কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। এর বাইরে নৌকার ব্যাজধারী আরও তিন–চারজন করে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাঁদের এক বা দুজন সার্বক্ষণিক কাপড় ঘেরা গোপন কক্ষের আশপাশে তৎপর ছিলেন।

পুলিশের বাইরে কেন্দ্রগুলোতে আনসার সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। এর মধ্যে কিছু স্থায়ী আর কিছু ভোটের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্থায়ী সদস্যদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন। বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

ভোটারদের অভিজ্ঞতা

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বেলা একটার দিকে ভোট দিতে ঢোকেন এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পরে বুথ থেকে বের হয়েই চিৎকার শুরু করেন তিনি। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর নিজে ভোট দিতে পারেননি। তিনি গোপন কক্ষে যাওয়ার আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বাটন চাপ দিয়ে তাঁর ভোট দিয়ে দিয়েছেন।

সংসদ ভবনের উল্টো দিকে রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ে স্কুলে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার কথা জানান দুজন ভোটার। তাঁদের অভিযোগ, সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর বাটন চাপ দেওয়ার সময় এক অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এসে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দেন। তাঁরা নিজের ভোট দিতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে বেরিয়ে আসেন।

তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে একই ধরনের ঘটনায় লাঞ্ছিত হন একজন ভোটার। তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীর পক্ষে সভাও করেছি। কিন্তু তাঁদের ভোট দিতে গিয়ে পারিনি। বুথের ভেতরে এক যুবক জোর করে আমার ভোট দিয়ে দেন। প্রতিবাদ করলে বলপ্রয়োগ করে বের করে দেওয়া হয়।’

সকাল ১০টার দিকে কার্জন হল কেন্দ্রে ভোট দেন এক ব্যক্তি। ভোট দিয়ে বের হওয়ার পর বাইরে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। ওই ব্যক্তি ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন বলতেই তাঁকে মারধর শুরু করেন। তাঁরা তাঁকে মারতে মারতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের দিকে নিয়ে যান।

আগেও নিয়ন্ত্রিত ছিল

এর আগে ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম–৮ আসনের উপনির্বাচনে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। ইভিএম পদ্ধতির ওই নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।

আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতা–কর্মীদের দাঁড়াতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে নেতা–কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। এর আগে গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা ভোটের দিন ঠিকভাবে এজেন্ট দিতে পারেনি। দলটির অভিযোগ, মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তার-ভয়ভীতির কারণে তারা নির্বাচনে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি।


  • কার্টসি- প্রথম আলো/ ফেব্রুয়ারি ২, ২০২০