— কামরুল হাসান দর্পণ
এক।
যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, কারচুপিবিহীন ও প্রশ্নহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল, সে লক্ষ্য যে আজও পূরণ হয়নি, তা বিগত দশ বছরে সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সব ধরনের নির্বাচনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ভোট কেন্দ্র দখল, কারচুপি, জালভোট এমনকি ভোটের আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের যে কোনো নির্বাচন এলেই সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়া মানে সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সিটি মেয়র, পৌর মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার গ্যারান্টি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের যে ভিড় লক্ষ্য করা যায়, ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের তার ছিঁটেফোটাও দেখা যায় না। বৃহত্তম বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ভোটের দিন তাদের কোনো পাত্তা থাকে না। অনেক সময় দিনে দুপুরেই বর্জন করে চলে আসে। দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দেন। দেখা যায়, এ ঘোষণায় তারা অটল থাকতে পারেন না। আবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, আমরা দেখাতে চাই ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, নির্বাচনকে বিতর্কিত করার জন্য বৃহত্তম বিরোধী দলটি অংশগ্রহণ করে মাঝপথে সরে যায়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দল ও বৃহত্তম বিরোধী দলটির মধ্যে একধরনের বাগযুদ্ধ চলছে। এই বাকবিতন্ডা হলেও তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না। ফলে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভোট দিতে যায় না। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সমর্থকরাও অনেক সময় ভোট দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তারা বিলক্ষণ জানেন, আমাদের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত এবং তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন রয়েছে। কাজেই কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার দরকার কি!
দুই।
দেশের সচেতন মহল থেকে শুরু করে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত সব ধরনের নির্বাচনে অসন্তুষ্ট তা তারা বিভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে এবং পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখে পরামর্শ দিয়েছেন। এতে ক্ষমতাসীন দলের যে কিছু যায় আসে না, তা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার কোনো উদ্যোগ না নেয়া থেকেই বোঝা যায়। নির্বাচনে কিছু ভোটার এনে নামকাওয়াস্তে লোক দেখানো ভোটের দৃশ্য দেখানোর মধ্যেই সে সন্তুষ্ট। কে কি বলল, তার আমলে নিচ্ছে না। তার মধ্যে এ প্রবণতা বিদ্যমান, ভোট তো হচ্ছে, মানুষ ভোট দিতে না এলে তার কি করার আছে? সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনও একই বক্তব্য দেয়। তার কথা, ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের আনার দায়িত্ব তার নয়। তবে সে এটা ভুলে থাকতে চায়, অতীতে দেশের ভোটের চিত্র কেমন ছিল। সেসব ভোটের কোথাও কোথাও অনিয়ম হলেও সেগুলোতে যে বিপুল ভোটারের উপস্থিতি ছিল, তা মনে করতে চায় না। মনে করতে গেলে তার ব্যর্থতা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের দেশে ভোট কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি স্বাধীনতার পর থেকেই হয়ে আসছে। এর বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোরালো আন্দোলন মূলত গড়ে উঠে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। একদিকে স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে হটানো, অন্যদিকে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলন চলতে থাকে। বৃহৎ বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সাথে সমবিভ্যহারে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও এসব আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। মানুষের ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ নিশ্চিত করার স্লােগান নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন করে। আন্দোলনে বহু রক্ত ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, কার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? যেহেতু সব বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে স্বৈরাচারের পতন ঘটে, তাই তাদের মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত পোষণ করে। এই সরকারের প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করবেন। সবাই এই সরকার গঠনের বিষয়ে একমত হয়। এতে সংবিধানে সংশোধনীও আনতে হয়। পরবর্তীতে এটা একটা অটো সিস্টেম হয়ে দাঁড়ায়। যে দল ক্ষমতাসীন তাকে কর্মরত প্রধান বিচারপতির হাতে ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হতো। যদিও যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে তার অনুগত লোকজন যাতে তত্ত¡াবধায়ক সরকারে আসে এমন কূটকৌশল অবলম্বন করত। যাই হোক, স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিল বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি, যা তখন কেউ যেমন কল্পনা করতে পারেনি, তেমনি বিএনপি এবং তার সমর্থকদেরও ভাবনায় ছিল না। দলটি অনেকটা বিরোধী দলে বসার প্রস্তুতি নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, সে ক্ষমতায় যাচ্ছে। সে সময় শুনেছি, দলটির অনেক বড় বড় নেতা মন্ত্রী হওয়ার জন্য আগেভাগেই স্যূট-কোট বানাতে দিয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের পর দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, জয়ী হয়েছে বিএনপি। এটা আওয়ামী লীগের মাথায় বাজ পড়ার মতোই ছিল। দলটির নেতারা দাবী করে বসেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সুষ্ঠুতার কাছে তাদের এ দাবী ধোপে টিকেনি এবং এক পর্যায়ে তারা নির্বাচনটি মেনে নেন। এভাবে ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। একইভাবে ২০০১ সালে আসে বিএনপি। গোল বাঁধে ২০০৭ সালে যখন বিএনপি তার দলীয় অনুগত লোকজন নিয়ে তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠন করে। এ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে আওয়ামী লীগ ও তার জোট বেঁকে বসে এবং আন্দোলন-সংগ্রাম করে। কোনো ফয়সালা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেন নামক এক ভিন্ন ধরনের সরকার গঠিত হয়। নামে তত্তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও নেপথ্যে তার নিয়ন্ত্রণ থাকে সামরিক বাহিনীর হাতে। এ সময় দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। মূল দল থেকে বের হয়ে দুই দলে সংস্কারপন্থী নামক একদল লোকজনের উদ্ভব ঘটে। তাদের মাধ্যমে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মূলাও দেয়া হয়। তবে দুই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীর কাছে তারা ‘কুসংস্কারপন্থী’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। তারা দুই নেত্রীকে বাদ দেয়ার যে মিশন নিয়ে নেমেছিলেন, তাতে সফল হতে পারেননি। এ নিয়ে রাজনীতিতে নানা নাটকীয় ঘটনা শুরু হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাস থাকার কথা থাকলেও তা দুই বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়। বহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে আর্মি ব্যাকড তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার জোট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
তিন।
আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় দলটিকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। দলটির মনে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে নির্বাচিত তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোটের অধীনে। যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অনির্বিচিত সরকার এবং তা অগণতান্ত্রিক। সারাবিশ্বে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন হয়। পার্শ্ববর্তী ভারত, যক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন হয় এবং বিরোধী দলগুলো তাতে অংশগ্রহণ করে। এতে গণতন্ত্র বিকশিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এবং মানুষও গণতন্ত্র মনস্ক হয়ে উঠে। সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে তুলে দেবে। এর বিরোধিতা করে তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল চরম বিরোধিতা ও আন্দোলন শুরু করে। বিষয়টি উচ্চ আদালতে যায় এবং সরকারও এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। বিরোধী দলসহ দেশের বিশিষ্টজনদের কমিটির কাছে মতামত ব্যক্ত করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। দেখা গেছে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। এর মধ্যে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে রায় দেয় এবং পরবর্তী একটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দেন। সরকারও তা কালবিলম্ব না করে তা লুফে নেয়। আদালতের রায় মানতে হবে এ যুক্তিতে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়। যদিও আদালতের পরবর্তী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার আদালতের মত আমলে নেয়া হয়নি। প্রধান বিরোধী দল ও তার জোট অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেও সরকারকে টলাতে পারেনি। সরকার অনড় অবস্থানে থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন এবং ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেলে। নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটসহ অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করেনি। ক্ষমতাসীন দল তার মহাজোট নিয়েই নির্বাচন করে। ফলে নির্বাচনের আগেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন দলের ১৫২ জন এমপি বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে যান। অন্যদিকে নির্বাচনের দিন ব্যাপক সহিংসতার কারণে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ভোটার শূন্য হয়ে পড়ে। এ নির্বাচনকে তখন বিশ্লেষকরা দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন এবং ভোটারশূন্য নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিরোধী দলগুলোর দাবী ছিল এ নির্বাচনে শতকরা ৫ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। আর নির্বাচন কমিশনের দাবী শতকরা ৪০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। তবে যে কজনই ভোট দিয়ে থাকুক না কেন, ক্ষমতাসীন দল তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। দলটির বড় যুক্তি ছিল, সংবিধান অনুযায়ী তারা নির্বাচন করেছে এবং এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাতে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। দেশে-বিদেশে নির্বাচনটি তুমুল বিতর্কিত হলেও ক্ষমতাসীন দল প্রতিবেশী একটি দেশের সহায়তায় বিদেশীদের বোঝাতে সক্ষম হয়, সংবিধান অনুযায়ী এ নির্বাচন করা ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প ছিল না। তার এ যুক্তি বিদেশীরা মেনে নেয়। বিতর্কিত এ নির্বাচনের পর সরকারের রোষানলে পড়ে আন্দোলনরত বৃহৎ বিরোধী দল ও তার জোটের নেতা-কর্মীরা লাখ লাখ মামলায় জড়িয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল রাজনীতির মাঠে তার প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করে নিস্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া দূরে থাক সাধারণ মানববন্ধন করতেও দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে বিএনপি নেত্রীকেও দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে যেতে হয় এবং সরকারের বদান্যতায় জেল থেকে মুক্ত হলেও তিনি এখন ঘরবন্দী হয়ে রয়েছেন। ২০০৯ সালের পর থেকে এবং ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনসহ এ পর্যন্ত যেসব নির্বাচন হয়েছে দেখা গেছে, সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলের জয়জয়কার। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনটিতো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়েও কৌশলগত দিক থেকে অভাবনীয় ছিল। নির্বাচনের আগের দিন রাতেই প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট বক্স ভর্তি করে নির্বাচন করা হয় বলে বিরোধী দল থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন। এ নির্বাচনকে অভিহিত করা হয়, ‘রাতের ভোট’ হিসেবে। গত এক দশক ধরে বিরোধী দল বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও উল্লেখ করার মতো তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার প্রতিদ্ব›দ্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দল থেকে নমিনেশন পাওয়া এবং না পাওয়া বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে। এতে কখনো নমিনেশন পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হয়, কখনো বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়। গত এক দশক ধরে এ ধরনের নির্বাচনের ফলে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে এখন এ ধারণা, ভোট দিয়ে লাভ নেই। কারণ, তাতে তাদের ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। বিশিষ্টজনরা গণতন্ত্রের জন্য এ পরিস্থিতিকে ভীতিকর ও বিরাজনীতিকরণ হিসেবে অভিহিত করছেন। অন্যদিকে, এ ধরনের নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে এবং বিরোধীদল জনবিচ্ছিন্ন, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বলে যুক্তি দিচ্ছে।
চার।
দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ভেঙ্গে পড়েছে, তাতে একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। যেভাবে নির্বাচন হয়, তাকে তারা মানতে না পারলেও তাদের কিছু করার নেই। কারণ, তাদের ভোট দেয়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি সরকার ও নির্বাচন কমিশন সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষ নির্বাচনবিমুখ এবং আগ্রহহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে গণতন্ত্র ও রাজনীতি বলে কিছু থাকবে না। তারা তাকিদ বোধ করছেন, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি এবং গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য তারা পুরনো ফর্মূলা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’কেই উপযুক্ত মনে করছেন। এ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পরামর্শও দিচ্ছেন। গত রোববার সুসাশনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষ ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় দেশের গণতন্ত্র ক্ষতি হচ্ছে। গণতন্ত্র ‘কাল্পনিক’ রূপ লাভ করায় উগ্রবাদীদের উত্থান ঘটতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে নাগরিকদের ভোটকেন্দ্রমুখী করতে হবে। একইসঙ্গে তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ‘বিরাজনীতিকরণ কমিশন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, আগে দেখতাম সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করে বিরাজনীতিকরণ করেন, এখন বেসামরিক সরকারও ইসির সহায়তায় রাষ্ট্রকে বিরাজনীতিকরণ করেছে। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোটও নতুন করে নির্দলীয় তাদারকি তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছে। তাদের এসব বক্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দেশের সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠানের জন্য দলীয় সরকার উপযুক্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ধরনের সরকারের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব এবং মানুষ উৎসবমুখর হয়ে ভোট দিতে যায়, তা একাধিকবার প্রমানিত হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয় না, তাও প্রমানিত। এতে যেমন ভোটাররা ভোটাধিকার হারিয়েছে, তেমনি গণতন্ত্রও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, অন্তত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনির্বাচিত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
লেখক সাংবাদিক।
- কার্টসি — ইনকিলাব/ডিসেম্বর ৬, ২০২০