Search

Thursday, October 17, 2024

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতিসত্তা বিনির্মাণে শহীদ জিয়ার ঐতিহাসিক অবদান

প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান



শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রাম, গর্ব-অহঙ্কার আর স্বাধীকার আন্দোলনের মাস মার্চ। এই মাসেই সূচনা হয় আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের। যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের ৭ কোটি মানুষের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। পৃথিবীর বুকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি নতুন ভূখন্ড স্বীকৃতি পায় প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নামে।


স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানের বিষয়ে বিষদ আলোচনার আগে স্বল্প পরিসরে হলেও তার ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি করাচি একাডেমি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচিতে ডি. জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারী একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দু’বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন।


১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।


তিনি বলেন — This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, here by declared that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.


দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন।


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির মধ্যদিয়ে তিনি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপিঠে আসীন করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের উপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন।


একটি রাজনৈতিক সরকার যেখানে সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিল তখন জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে আসা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক স্বাধীনতার অন্যতম মূলস্তম্ভ বহুদলীয় গণতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়ে মুক্ত গনতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান এ কারণেই সবার থেকে আলাদা ছিলেন।


জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, সততা ও ন্যায় পরায়ণতা দিয়ে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিকালে অসামন্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে দেশ গঠনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃতজ্ঞজাতি আজও তার আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সততার মাপকাঠিতে তিনি আজও অনন্য ও অদ্বিতীয়। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েই দেশের চলমান অবনতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেন। শক্তহাতে চুরি, ডাকাতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসে।


স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ—অফ—স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশারফ এর নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে । তারপর গোটা জাতি আবার আতংকিত হয়ে পড়ে তৎ পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান কে বন্দি করলে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেইনি এবং জনগণ আবারো দুঃশাসনের আশঙ্কা করেন তাই সিপাহী এবং জনতা মিলে বন্দীদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে দেশের দায়িত্বভার তুলে দেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ—প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।


জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল অবস্থানের প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন “ I will make politics difficult for the politicians”.


১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ—সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।


লেখক:

প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান

মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব

দেশ-মাতৃকার কল্যাণে আজন্ম ছুটে চলা এক উত্তাল নদীর নাম বিএনপি

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান



একটি নতুন সময়, একটি নতুন দেশ, একটি নতুন প্রজন্মের সামনে বিএনপিকে নিয়ে যখন লিখছি তখন আমি নিজেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের কথা ও কর্মের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। তেমনই আমিও ফিরে এসেছি আমার পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নতুন করে। দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার এই আনন্দ সীমাহীন গৌরবের। যদিও আমার এই লড়াই-সংগ্রাম এদেশের কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘ দেড় দশকের নিপীড়ন-নিষ্পেষণের সামনে কোনোভাবেই উল্লেখযোগ্য নয়।


দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যে নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গেছে তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। গণমানুষের কণ্ঠস্বর বিএনপি এদেশের সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েছে। বছরের পর বছর অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছে এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী বুকের সবটুকু ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা দিয়ে আগলে রেখেছে প্রাণপ্রিয় দলকে। তাইতো দ্বিতীয় স্বাধীনতার এই সূচনা পর্বে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে নি:সন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাদ ভিন্ন রকমের।


৭৫ সালের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক শুন্যতা পূরণে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সেনা ছাউনিতে সৃষ্টি হয়েছিলো আজকের বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অথচ পৃথিবীর ইতিহাস বলে সেনা ছাউনি থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সময়ের শুন্যতা পূরণে সৃষ্টি হয় তেমনি শুন্যতা কেটে গেলে তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া গণমানুষের আস্থার ঠিকানা এই দলটি।


এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, ‘বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনা নায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে । এ ধরণের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই।’


১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সব সময়ই ছিলো বীরোচিত। যা তাকে তার পেশাগত পরিমন্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব প্রদান করেন।


মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।


১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সকল কিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।


১৯ দফা ছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিক-নির্দেশনাবলী। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো যে দিক সমাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সকল উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষতা মুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিলো তার সেই ১৯ দফায়।


বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।


শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবাহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে।


এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসাবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।"


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নি:শেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কূটকৌশল চলে। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপোসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ঢেউ এসে আঘাত হানে বিএনপিকে।


বিএনপিকে ধ্বংস ও নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায় দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে আটক রেখেছিল বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিলো এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটি হয়নি।

বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরো পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।


তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ঐ দু:সময়ে বহু দূর থেকে দলকে সংগঠিত করার কাজ করছেন অত্যন্ত মনোযোগ, ধীশক্তি ও দক্ষতা সহকারে। তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ সমাজকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারুণ্যের শক্তি যে অপরিহার্য- এই উপলব্ধিই তাকে চালিত করেছিল তরুণ সমাজকে সংগঠিত করতে। তৃণমূলে একটি রাজনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে সেই দলের জনপ্রিয়তা। তিনি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।


তারেক রহমান ৩১ দফার আদলে দলকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে। এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা আজ ডানা মেলেছে সেখানে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম, বিদেশী প্রভু শক্তির প্রতি যে উদ্ধত তর্জনী সে তো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরই ছড়িয়ে দেওয়া রাজনৈতিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাব।


প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণমানুষের প্রিয় দল বিএনপির প্রতি অফুরন্ত শুভ কামনা।


লেখক: অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মহাসচিব ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) ও সদস্য মিডিয়া সেল, বিএনপি।

Monday, July 29, 2024

১৯৫২ থেকে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক



বর্ষীয়ান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী বদরুদ্দীন উমর রাজনীতি ও গবেষণায় সম্পৃক্ত রয়েছেন ৫৩ বছর ধরে। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে শতাধিক বই রয়েছে তার। দেশের চলমান ছাত্র আন্দোলন ও এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন 


চলমান ছাত্র আন্দোলন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।


উন্নয়নের কথা বলে অপকীর্তি ঠেকানো যায় না। মানুষের প্রতি জুলুমের বিষয়টিই শেষ পর্যন্ত সামনে এসেছে। বর্তমান আন্দোলনকে বুঝতে হলে অতীতে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানগুলো বুঝতে হবে। এ অঞ্চলে মোট পাঁচটি অভ্যুত্থান হয়েছে। শুরুর অভ্যুত্থানটি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। 


বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ও বৃহৎ গণ-অভ্যুত্থান আমরা দেখছি। এ গণ-অভ্যুত্থানের প্রকৃত চরিত্র, কারণ এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে— এটি বোঝার জন্য এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সেদিকে তাকাতে হবে। সেটি ছাড়া এ গণ-অভ্যুত্থানকে বোঝার উপায় নেই। এখানে একটি কথা বলা দরকার, অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ অঞ্চলে ১৯৫২ সালে আমরা প্রথম গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম। দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম ১৯৬৯ সালে। তৃতীয়টি ছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে। নব্বইয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে চতুর্থ গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম।


এই প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫২ সালের ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন সরাসরি হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের শুরুর দিকের এ সময়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো গঠিত হয়। দেখা যায়, বায়ান্নর আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকার পতন হয়। শুধু যে সরকারের পতন হয়েছিল তা-ই নয়; মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল তাতে সামরিক সরকার টিকে থাকলেও আইয়ুব খানের সরকার উচ্ছেদ হয়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৭১ সালে জানুয়ারি কিংবা এর আগেই ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে সরকার তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর সক্ষম ছিল না। তখন প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী সরাসরি রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর যুদ্ধ আরম্ভ হয়; সেই যুদ্ধের ফলে সরকার নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রই উচ্ছেদ হয়েছিল। এতই শক্তিশালী ছিল তখনকার অভ্যুত্থান এবং জনগণের আন্দোলন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এ আন্দোলন কিন্তু দেশব্যাপী বিশাল আন্দোলন ছিল না। সে সময় আমি লিখেছিলাম—এটি একটি নাগরিক অভ্যুত্থান। কারণ গ্রামাঞ্চলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন ছিল ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরকেন্দ্রিক। সেই নাগরিক বুর্জোয়ার অভ্যুত্থানের ফলে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দেখা গেছে, আগের চারটি অভ্যুত্থানের পরই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালের গণ-অভ্যুত্থান পরিণতি লাভ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রই উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। 


বর্তমানে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, এর ফলে চারদিকে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে এ সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এ গণ-অভ্যুত্থান যত ব্যাপক হয়েছে এর আগে কোনো অভ্যুত্থান এত ব্যাপক কখনো হয়নি। ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে তো বটেই সমগ্র গ্রামাঞ্চলে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কোটা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে সরকার ছাত্রদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করেছে এতে এ আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ যে যার পক্ষ থেকে এ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। এ কথা বলা দরকার, ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে তা আর কোটার আন্দোলন হিসেবে দেখলেই চলবে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রলীগ যে তাণ্ডব, নির্যাতন এবং নানাভাবে জুলুম চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভ ছিল। এ ক্ষোভের একটি ভূমিকাও ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে পড়েছে। এটিকে শুধু কোটা আন্দোলন, শুধু চাকরির আন্দোলন হিসেবেই দেখলে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া ছিল কোটা আন্দোলনে। সরকারি আক্রমণের কারণে এই কোটা আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একটি অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং ব্যাপকভাবে সারা দেশে অভ্যুত্থান হয়েছে। 


শুধু ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের কারণে জনগণ এ অভ্যুত্থানে নেমেছে এমন নয়। সারা দেশে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। সরকার জনগণের মতপ্রকাশের ওপর, বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। সংবাদপত্রগুলোয় সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যায় না। এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। তাদের ধারণা, এ সরকার যত দিন থাকবে তত দিন পর্যন্ত ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, দেশের টাকা পাচার, সরকারের প্রজেক্ট থেকে টাকা চুরি, এসব বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কাজেই অভ্যুত্থান এখন হয়েছে। 


এ অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এত দিনেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। এখন পর্যন্ত তারা কারফিউ দিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ ও সীমিত রাখার মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায়, তারা এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কোটা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের তারা নতুন করে ধরপাকড় করছে। তাদের জোরপূর্বক গ্রেফতার করে তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এর পরিণতি যে কি দাঁড়াবে! নতুনভাবে চারদিকে আন্দোলন শুরু হয় কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়। চারদিকে সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। এটা যে শুধু দেশেই হচ্ছে তা নয়। সারা দুনিয়ায়; শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বুদ্ধিজীবীরা, লেখকরা এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং এ হত্যাকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ঢাকায় ১৪টি দেশের কূটনৈতিক মিশন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বরাতে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু আসলে কত লোক যে মারা গেছে তার কোনো হিসাব নেই। হতে পারে শুধু হাসপাতালের তথ্য দিয়ে হিসাব করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের তো হাসপাতালে আনা হয়নি। কত লোক মারা গেছে তার হিসাব আসলে নেই। এই যে বেহিসেব হত্যাকাণ্ড, এর বিরুদ্ধে জনগণ চারদিকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ কথা বলা যায় না যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে আছে এতে নতুনভাবে আবার একটা আন্দোলন; আরেকটা ধাক্কা আসার সম্ভাবনা পুরোপুরিই রয়েছে। এ ধাক্কায় সরকারের অবস্থা কী হবে সেটি ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।

 



আপনি ঊনসত্তর সালের গণ-অভ্যুত্থান দেখেছেন। এর সঙ্গে এবারের আন্দোলনকে কীভাবে তুলনা করবেন?


ঊনসত্তর সালের আন্দোলনের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের সাদৃশ্য রয়েছে। সেটি হলো, আইয়ুব খান ১০ বছর পাকিস্তান শাসন করেছিল। ১০ বছর পর ‘‌ডিকেড অব ডেভেলপমেন্ট’ বলে চারদিকে খুব উৎসব শুরু হয়েছিল। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে এবং এ সরকারের পরিবর্তন চেয়েছে। দেখা গেল, উন্নয়নের কথা বললেও আইয়ুব খানের আমলে যে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। উপরন্তু উন্নয়ন সত্ত্বেও শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ একটি পর্যায়ে এসেছিল। সেখানে উন্নয়নের কথা মানুষ চিন্তা করেনি, বরং তাদের ওপর কত নির্যাতন হয়েছে সেটি চিন্তা করেছে। কারণ আইয়ুব খানের উন্নয়ন জণগণের কাজে আসেনি। এ উন্নয়নের ফলে শাসক শ্রেণীর লোকজনই সুবিধা পেয়েছিল। বর্তমান সরকারও গলা ফাটিয়ে উন্নয়নের কথাই বলে যাচ্ছে। দেখা যাবে যে বড় বড় এ প্রকল্পে আইয়ুব খানের আমলে যা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। এ রকম বড় প্রকল্পগুলোয় আইয়ুব খানের আমলে সে রকমভাবে চুরি হয়নি। এখন বড় বড় প্রকল্প মানে বড় বড় চুরি। লাখ লাখ কোটি টাকা এসব প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে। এর থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন, সরকারি আমলা ও সুবিধাভোগী লোকজন হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এভাবে লুটপাট করে তারা যে অবস্থা তৈরি করেছে দেশে তাতে উন্নয়নের ফল জনগণের কাছে পৌঁছেনি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে মানুষের আয়-মজুরি সেভাবে বাড়েনি। কাজেই তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মানুষ আগে যে তিনবেলা খেত, তারা এখন দুই বেলা-এক বেলা খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে। মাছ-মাংস যেভাবে খেত সেভাবে এখন আর পারছে না। খাবার জিনিসও কমে গেছে। 


একের পর এক সরকারি কর্তাব্যক্তির হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির রিপোর্টের প্রভাবও জনগণের মধ্যে পড়েছে। বড় বড় অবকাঠামো সাধারণ মানুষের কতটুকু উপকারে এসেছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্যে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে দেশের মানুষ পিছিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুব খান যেমন উন্নয়নের কথা বলে পার পায়নি; বর্তমান এ সরকারও উন্নয়নের কথা বলে পার পাবে বলে মনে হয় না।  


সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?


আওয়ামী লীগ এখন বেকায়দায় পড়ে দোষ কার ঘাড়ে চাপাবে এটি ভেবে অস্থির আছে। এক্ষেত্রে তো তারা বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কিছু দেখে না। তারা বাংলাদেশের জনগণকে দেখে না। জনগণ যে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এ চিন্তা তাদের নেই। এ চিন্তা করার ক্ষমতাও তাদের নেই। কিন্তু এ কথা বলে পার পাওয়ার উপায় তাদের নেই। এজন্যই তারা বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছে। এটি ঠিক যে বিএনপি-জামায়াত এ আন্দোলনে কিছুটা অংশগ্রহণ করেছে। এতে দোষের কিছু নেই। এমন একটি অভ্যুত্থান-আন্দোলন হলে জামায়াত বা বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে? আমরা মনে করি, এ দল দুটির যতটা অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল ততটা অংশগ্রহণ তারা মোটেই করেনি। নিজেদের দেউলিয়াপনার কারণে বিএনপি ও জামায়াত সেভাবে নামেনি। নামা দরকার ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সেই ক্ষমতা নেই। এখন আওয়ামী লীগ যে তাদের দোষারোপ করছে, এতে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো বিএনপি-জামায়াতেরই লাভ হচ্ছে। যে কাজ তারা করেনি সেই কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জামায়াত ও বিএনপিকে তারা গৌরবান্বিতই করছে। এর ফলে তাদের শক্তিই বাড়াচ্ছে। এটি আওয়ামী লীগের চরম মূর্খতা ও দেউলিয়াপনার কারণ। ওবায়দুল কাদের তাদের আওয়ামী লীগ নেতাদের রাস্তায় নামার যে ডাক দিয়েছিলেন সেটি অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা তার ডাকে সাড়া দেননি। কেউই রাস্তায় নামেননি। এ কথা তিনিই বিবৃতি দিয়ে বলেছেন। এদিকে অংশগ্রহণ করেনি বলে ঢাকার কিছু কিছু ওয়ার্ডের কমিটি বাদ করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের লোকজন নিজেরাই দলের পক্ষে দাঁড়ায়নি। সরকারের পক্ষে আছে শুধু পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আর্মি। 


আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় না নামার পেছনে কারণ কী হতে পারে?


তারা নামেনি এজন্য যে ওপরের সারির নেতারা অবস্থা না বুঝলেও নিচের সারির কর্মীরা অবস্থা বুঝতে পারছেন। সাধারণ কর্মী ও নিচের স্তরের কর্মীরা আওয়ামী লীগের দুর্বলতা কোথায় তা ধরতে পারছেন। সেজন্য আওয়ামী লীগ নেতারা যে নীতি অনুসরণ করছেন এটিতে যাওয়ার তাদের কোনো উৎসাহ নেই। তারা দেখছেন যে এটি করলে জনগণ তাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। সব জায়গায় তারা মার খাওয়ার ভয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতে তাদের কী হবে বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে সাধারণ কর্মীরা ভয় করছেন তাদের ওপর বিপদ নেমে আসবে। 


চলমান আন্দোলন নিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?


দেখা যাচ্ছে যে এ আন্দোলনে ভারত একেবারে চুপচাপ আছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ আন্দোলনে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু ভারত সরকার একেবারে চুপ করে আছে। তার কারণ বর্তমান ক্ষমতাশীল দল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তবে পশ্চিমারা নানাভাবে সমালোচনা করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এমনকি ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও সে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করেছেন।


বণিক বার্তা/ সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর

জুলাই ২৯, ২০২৪। 

Tuesday, July 2, 2024

রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, কেরানিও শতকোটি টাকার মালিক!



স্বাস্থ্যখাত

রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। এখন চারদিকে শুধুই দুর্নীতির খবর। কোটি টাকা না, শত কোটি, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন তারা তা নিয়ে খুব বেশি অনুসন্ধানের কথা শোনা যায় না। আগে যেখানে এক কোটি টাকার কথা শুনলেও অনেকে চমকে উঠছেন, এখন সেখানে হাজার কোটি টাকার খবরেও কেউ অনুসন্ধান করছে না। সর্বশেষ নজরে এলো হোমিও প্যাথি ডাক্তার ডা. দিলিপ রায়ের দুর্নীতির খবর। কিভাবে তিনি এত টাকার মালিক হলেন সেটার অনুসন্ধান জরুরী। 


সাবেক এক মন্ত্রীর প্রশ্রয়ে স্বাস্থ্যখাতে ঠিকাদার মিঠুর উত্থান হয়েছে। দেশের বাইরে তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি এবং অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নিউজ করতে গিয়ে হুমকিতে পড়তে হয়েছে সাংবাদিকদেরও। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীরও অনেক কর্মকর্তা তাকে প্রটেকশন দিয়েছেন। এরপর এলো ড্রাইভার মালেকের শত শত কোটি টাকার সম্পদের কথা। সাবেক একজন মহাপরিচালকের ড্রাইভার হিসেবে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটাসহ সব সেক্টরেই তার হাত ছিল। একজন ড্রাইভার কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন। এর পর এলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (পরিচালক) এডুকেশনে বিভাগে কেরানি আফজালের কাহিনী। কানাডায় তার বাড়ি আছে। কেরানি কিভাবে এত বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হলেন সেটাও এখনো অজানা। 


দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘এসব দুর্নীতিবাজদের মূল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান হল সচিবালয়। সচিবালয় থেকে এগুলো বন্ধ করা না গেলে এদের কখনই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’ ঠিক তাই হচ্ছে। স্বাস্থ্যের মতো সব জায়গায় দুর্নীতির বিশাল নেটওয়ার্ক। সবাই মিলেই গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। যে দুর্নীতির ভাগ পায় সবাই। ফলে এখন মন্ত্রণালয়ও কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। গত নির্বাচনের আগে আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুই শতাধিক ব্যক্তির দুর্নীতির তালিকা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে তারা এখন আরও বেশি বেপরোয়া। 


দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার জহিরুল হক বলেন, ‘আমরা নিজেরাও অনুসন্ধান করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি কারোর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় খবর এলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। কাউকে ছাড় দেবো না।’


অথচ স্বাস্থ্য খাতে যাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া কথা সেই চিকিৎসকরাই বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন হাসপাতালে অনেক শিক্ষকের পদ শূন্য। ছাত্ররা সুশিক্ষা থেকে বঞ্জিত হচ্ছে। শিক্ষকদের পদোন্নতি হচ্ছে না। মেধাবীরাও আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। একজন চিকিৎসকের চাকরি নেওয়ার পর অধ্যাপক হতে আর চাকরির বয়স থাকে না। দলবাজ না হলে পদোন্নতিও হয় না। পুরো স্বাস্থ্য খাতে যেন অশনি সংকেত। চিকিৎসকরাও কাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন। জুনিয়রদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন অনেকে। ফলে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে দুর্নীতি দেখার কেউ নেই। সুযোগ সুবিধা না পেলে কেন তারা এই পেশায় থাকবেন? ফলে সামনের দিনে চিকিৎসা সেক্টরে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে।


বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, ‘আসলে দুর্নীতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে। যারা দুর্নীতি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। অনেক বড় কর্মকর্তাও এর সঙ্গেও জড়িত। সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে না আনা গেলে বা পেছনে যারা আছে তাদের খুঁজে বের করে জবাবদিহিতায় আনতে না পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।’  


সর্বশেষ দুর্নীতির তথ্য সামনে এসে ডা. দিলীপ কুমার রায়ের। পনের বছরের ব্যবধানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায়। রাজনীতির জাদুর ছোঁয়ায় তিনি হোমিও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক থেকে হয়েছেন বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথী বোর্ডের চেয়ারম্যানও। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত দিলীপ কুমার রায় টানা পাঁচ মেয়াদে ১৫ বছর ধরে হোমিও বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখেও গড়েছেন রেকর্ড।


বোর্ডে দুর্নীতি হালাল করতে নীতিকে পাল্টে অনিয়মকেও তার ব্যক্তিগত নিয়মে পরিণত করেছেন। চা-পোষা হোমিও চিকিৎসক সেই দিলীপ কুমার এখন রাজনীতিতে বড় নেতা, স্বর্ণ, ডায়মন্ড, ইটভাটা, খাদ্য ও ওষুধের এক্সেসরিজের ব্যবসায়ীও। ফরিদপুরের বোয়ালমারী এলাকার ধোপা পরিবারের সন্তান দিলীপ কুমার এখন প্রতিষ্ঠিত এক স্বর্ণ ও হিরা ব্যবসায়ীর নাম। কারখানা গড়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন খাদ্য, ওষুধ ও ওষুধের এক্সেসরিজ খাতেও। অথচ ৮০-এর দশকে হোমিওপ্যাথী মেডিকেল কলেজে ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। পাশাপাশি হাঁটতেন রাজনৈতিক এক নেতার অনুসারী হয়ে। এরপর দিলীপ কুমারের উত্থান যত না আকাশচুম্বী ততই রহস্যে ঘেরা।


অথচ ২০১৫ সালের ৩০ জুন ডা. দিলীপ কুমার রায়কে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধান করেন দুদকের উপ-পরিচালক এসএম মফিদুল ইসলাম। তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দিলীপ কুমার রায়কে অব্যাহতি দেয় কমিশন।


ইত্তেফাক/ জুন ১০, ২০২৪

Monday, July 1, 2024

তিস্তা মহাপরিকল্পনার ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং করণীয়

মো:নিজাম উদ্দিন 



এক.
তিস্তার ভিক্টিম কারা?
উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলার দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকার সাথে গভীর ভাবে যুক্ত তিস্তা নদী।হিমালয় থেকে সিকিম এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে ডুকেছে।তিস্তার পানি যেন উত্তরাঞ্চলের প্রাণ। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী তিস্তার উজানে ভারতের গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মার্ণ করে পানি আটকে দেয়!ফলে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ হারায় তিস্তা!সেচ মৌসুমে তিস্তায় পানির অভাবে কৃত্রিম মরু করণ চলে আর বর্ষায় অস্বাভাবিক বন্যা, সময়ে অসময়ে বন্যাই এখন তিস্তা পাড়ের মানুষের নিয়তি। তিস্তার স্বাভাবিক যে পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। ফলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনের এক অভিশাপ এখন তিস্তা। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা ।যার জন্য একমাত্র দায়ী আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। 

২০১১ সালে মনমোহন সিংহ সরকার বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির কাছাকাছি চলে গেলেও সেই চুক্তিটি আজও হয়নি।বলা হয় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাধার কথা!এক যুগ পেড়িয়ে গেছে।যা দেওয়ার সব দেওয়াও হয়েছে শুধু বাংলাদেশ তার তিস্তার পানির ন্যা্য্য হিস্যা পায়নি!পাচ্ছে না।ফলে তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষ পানি সংকটের ভিক্টিম।

দুই.
তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী?
প্রতিবেশীর সাথে পানিবণ্টন চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়।যার নাম তিস্তা মহাপরিকল্পনা।অর্থাৎ ভারতের সাথে বাংলাদেশের তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি হলে কিন্তু এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা করার প্রয়োজনই পড়তো না। এই তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে কেন্দ্র করেই এখন ভা র ত, চীন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তুলপাড় চলছে!খুব সহজ করে বললে তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প । তিস্তা নদীর খনন, নদী শাসন,গভীরতা বাড়ানো,প্রস্থ কমানো,নৌ বন্দর নির্মাণ,তিস্তাকে কেন্দ্র করে উজানে সেচ মৌসুমে পানির জন্য বৃহৎ জলাধার নির্মাণ এবং নদীর দুই পাড়ে সেটেলাইট সিটি নির্মাণ।তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রায় ১৭১ বর্গ কিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব এবং নদীর গভীরতা বাড়বে পাঁচ থেকে দশ মিটার পর্যন্ত।  তিস্তা মহাপরিকল্পনা যা চীন করতে যাচ্ছে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে রংপুর বিভাগের তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। কিন্তু প্রকল্পটি নিয়ে এখন ব্যাপক রাজনীতি হচ্ছে। জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির খুব মুখ রোচক গল্প হয়েছে এখন এই তিস্তা। গল্প এখানেই থেমে নেই। চলুন, আরেকটু আগাই!

তিন.
তিস্তায় ভারতের রাজনীতিটা কী?
২০২২ সালে চীনা রাষ্ট্রদূত তিস্তা মহাপরিকল্পনাটি স্বশরীরে পরিদর্শন করতে গেলে ভারতও আড়মোড়া দিয়ে জাগে। চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে একটি পরিক্ষা নিরীক্ষা চালায় এবং একটি রিপোর্ট তৈরি করে। এখন ভারত বলছে এই প্রকল্পে তারাও সহযোগীতা করতে আগ্রহী।অথচ জীবিত তিস্তাকে মেরে ফেলার জন্য দায়ী তারাই।সংবাদ বেরুচ্ছে -China, India in tug of war over Teesta project in Bangladesh. অর্থাৎ তিস্তা নিয়ে চীন -ভারতের টানাটানি! চীন একশো কোটি ডলার ব্যয়ের এই মহাপরিকল্পনার প্রাথমিক সমীক্ষা করেছে। বাংলাদেশ চীনের কাছে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও সাহায্যেও চেয়েছে। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চীন বলেছিল দ্রুত কাজ শুরু হবে কিন্তু ভারতের বাঁধায় সব আটকে আছে। সরকারও ভা র তকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে না।কারণ ক্ষমতার রাজনীতি! কারণ এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি!পানি এখন ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে! বিশেষজ্ঞরা বলছেন -তিস্তার সমাধান না হলে বাংলাদেশ যেন ভারতের সাথে ট্রানজিটের বিষয়টি পুনঃ বিবেচনা করে! 

ভারত কেন চীনের তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিরোধিতা করছে? এর তুমুল বিশ্লেষণ হচ্ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা চীনের এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নীতি।এই প্রকল্পে চীনের আগ্রহের কারণ তাদের মেগা প্রজেক্ট বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। যা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে যুক্ত করছে।বাংলাদেশ -চীন-ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত এই অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে চীন তাদের ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে যুক্ত করতে চায়।চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়।তিস্তা মহাপরিকল্পনা তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভকেই প্রমোট করে যা কোনো ভাবেই ভা র ত করতে দিতে চায়না। 

চার.
তিস্তায় চীনের রাজনীতিটা কী?
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের যুক্ত হওয়ার মানে হচ্ছে চীনের অবস্থান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত স্পর্শ কাতর জায়গা শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের খুব কাছাকাছি চলে আসা।শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স  রাজ্য গুলোর সাথে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভা র ত চায়না তার এমন একটি স্পর্শ কাতর জায়গার কাছাকাছি চলে আসুক চীন! তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন যুক্ত হওয়া মানে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির সাথে তার বন্ধন দৃঢ় হওয়া। তিস্তা মহাপরিকল্পনা যেহেতু ভারতের তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তি না করার ফলে হচ্ছে তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন যুক্ত থাকলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী চীনপন্থী কমিউনিটি গড়ে উঠতে পারে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা চীনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে ভা রত বিরোধিতা আরো চরম পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ভারত এই কাজটা হতে দিতে চায় না। ফলে সে নিজেই তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ায় প্রস্তাব নিয়ে আসছে।অর্থাৎ চীনের প্রস্তাব নিজের স্বার্থে ভা র ত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ,নাগরিক সমাজের এখন উচিত ভা র তের ভন্ডামির মুখোশটা খুলে দেওয়া, প্রশ্ন তোলা যে-ভাই তুমি আমার তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিটা আগে করে দাও,তিস্তা মহাপরিকল্পনা করতে হবে না! 

পাঁচ.
তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের করণীয়? 
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতের যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব হাস্যকর।বিষয়টা এমন- একটা নদীকে মেরে পুকুর বানিয়ে দেওয়ার মতো,কাউকে খুন করে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো!জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকলে আজ তিস্তা  মহাপরিকল্পনাকে চীন ভারতের সামনে একটা বড় বার্গেনিং টুল হিসাবে ব্যবহার করতে পারতো,দু দেশের কাছ থেকেই বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারতো।কিন্তু এইটা এখন সম্ভব কী?কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের যে যে রাজনীতি তাই ভূরাজনীতি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক ভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যাবে। কারণ এই মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়া চীন ভারত উভয়ের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
 
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই আগামী দিনের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা মাথায় রেখে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনকে যুক্ত করা উচিৎ। বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন টেকানোর এটা একটা অগ্রীম কৌশল হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কি তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে সে পথে হাঁটবে?

লেখক: মো:নিজাম উদ্দিন 
সহ-সভাপতি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ

Friday, June 21, 2024

লুটপাটকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন



বাংলাদেশি বাবাদের দুর্নীতি, লুটপাট আর পাচার করা টাকায় কতো যে সন্তান বিদেশে রাজকীয় জীবনযাপন করে আর বেগমপড়ায় কতো যে বেগমরা থাকেন সেই তালিকা কখনো আমরা পাবো না।

বেগমদের সাহেবরা তো ধনীই, উপরন্তু বিদেশে তাঁরা ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়েছেন বিনিয়োগকারী কোটায়। খরচ বেশি নয়; মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার অর্থাৎ এক কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই কানাডা আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে। বেগমদেরও এই পরিমাণ টাকা দিতে হয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন প্রবাসে নিরাপদ ঘর।

তবে বেগম পাড়ার সাহেবরা কিন্তু বছরের বেশির ভাগটা নিজের দেশেই কাটান। তারা সেখানেটাকা বানাবার মেশিন চালু রাখেন। যখন প্রয়োজন বা বিপদে পড়েন শুধু তখন তারা বেগমপাড়ায় যান।

আফসোস কয়েক বছর পেরিয়ে গেল, পদ্মা-যমুনায় অনেক জল গড়ালো, কানাডায় সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর ভাইসহ অনেকে এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেন, আদালত নির্দেশও দিল-কিন্তু জানা গেল না সেই সাহেবদের পরিচয়।

যারা বৈধভাবে বিদেশে সম্পদ করেছেন তাদের বিষয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু যারা অবৈধভাবে সম্পদ করেছেন তাদের বিষয়ে আপত্তি আছে।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন একবার বলেছেন, বিদেশে টাকা পাচারের সত্যতা মিলেছে।তবে রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্যএসেছে, সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর টাকা পাচারের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাই কোর্ট বেঞ্চ দুদকের কৌঁসুলি মো. খুরশীদ আলম খানকে আদালতে বলেন, “বিদেশে এত লোক টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারা টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের নামও পাননি! উই ওয়ান্ট টু সি দুদক কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আপনারা অন্ততপক্ষে এটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাকা আসবে কি আসবে না, সেটা পরে দেখা যাবে।”

আফসোস কোনও কিছুতেই কিছু হয়নি। বরং সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়।

মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দুবাইয়েও একদল বাংলাদেশি বিপুল সম্পদের মালিক। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর-কোথায় তাদের সম্পদ নেই?

আমি বেশ কয়েকবার লিখেছিলাম এমন যদি করা যায় যে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য থেকে শুরু করেসব জনপ্রতিনিধি এবং সচিব থেকে শুরু করে সব সরকারি কর্মকর্তাদের একটাই পাসপোর্ট হতে হবে। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনও দেশের পাসপোর্ট তাদের থাকতে পারবে না। দেশের বাইরে তাদের কোন বাড়ি এবং সম্পদ থাকবে না। তারা নিজেরা এবং তাদের সন্তানদের সবার আগে দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাবেন। গণপরিবহনে চড়বেন। পাবলিক স্কুলে সন্তানদের পড়াবেন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া সরকারি সব সেবা নিতে বাধ্য থাকবেন। এগুলো করা গেলে হয়তো বাংলাদেশটা বদলে যাবে।

আসলে আমরা কপাল পোড়া জনগণ! ভেবে দেখেন, আমাদের জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-আমলাদের প্রায় সবাই কথায় কথায় দেশের মঙ্গলের কথা বলেন। দেশ সেবা করছেন দাবি করেন। অথচ নিজেরা সরকারি হাসপাতালে যান না। সরকারি স্কুলে সন্তানদের পড়ান না।গড়ে তোলেন বেগমপাড়া। টাকা পাচার করেন বিদেশে।
জানি লিখে খুব একটা লাভ নেই। কারণ এই দেশ থেকে যারা বিদেশে টাকা পাচার করে, যারা বেগমপাড়ায় কিংবা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করে তারা তো কেউ সাধারণ জনগন নন, কৃষক নন। তারা তো সব বড় মানুষ, অনেক ক্ষেত্রে তারাই তো নীতি নির্ধারক!

এর আগে লিখেছিলাম, আপনার বাবার আয়টা হালাল তো? আপনার আত্মীয় যাকে নিয়ে এতো গর্ব করছেন, তিনি সৎভাবে আয় করেন তো?

মনে রাখবেন আইজিপি, সচিব থেকে শুরু করে যতো বড় কর্মকর্তাই তিনি হন না কেন এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বেতন স্কেল ৭৮ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়াসহ সব মিলিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা তিনি পেতে পারেন। এই যুগে সব খরচ সামলে এই টাকা দিয়ে তিনি কীভাবে এতো সম্পদের মালিক হন, কী করে তাঁর এতো গাড়ি-বাড়ি থাকে, কী করে তিনি আপনাকে বিদেশে বাদামী স্কুলে পড়ানোর টাকা দেন? আপনার সেই প্রশ্ন তোলা উচিত।

শুধু সরকারি চাকরিজীবী নন, আপনার বাবা বা স্বজন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, বিচারক, সাংবাদিক, শিক্ষক, উপাচার্য, প্রক্টর, প্রকৌশলী, বেসরকারি চাকরিজীবী কিংবা যাই হোন না কেন আপনি যদি গাড়ি-বাড়ি থেকে শুরু করে অঢেল সম্পদ দেখেন এবং যখন যা চান তাই পেয়ে থাকেন, কিন্তু আপনাদের জমিদারি না থাকে তাহলে তাঁর সম্পদের উৎস নিয়ে সন্দেহ করুন, প্রশ্ন তুলুন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা সামাজিক আন্দোলন জরুরী।

আসলে একটা ভয়াবহ সমাজব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি আমরা। এইতো ২০-৩০ বছর আগেও যে লোকটা দুর্নীতি করতো, তার দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকাতো।

আর আজকে যে কোনোভাবে টাকা আয় করলে বা গাড়ি-বাড়ি বা সম্পদ থাকলেই আমরা তাদের তোয়াজ করি‌। মসজিদ কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে নানা পদ-পদবীতে বসাই‌। নানাভাবে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চাই। অথচ এই নোংরা কিটগুলোর আশ্রয় হওয়া উচিত ছিল জেলখানায়।

কথাগুলো বলছি, কারণ এই বাংলাদেশ সংকটটা যতোটা না অর্থনৈতিক তার চেয়েও বেশি মানবিক মূল্যবোধের। সত্যিকারের সব সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শ্রদ্ধা জানাই। সব দপ্তরেই এমন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাদের জন্য শ্রদ্ধা।

তবে বাস্তবতা হলো একদল লোক দুর্নীতি-লুটপাট করে টাকা পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আরেকদল মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেও কোনওমতে টিকে থাকতে পারছেন না।

ভয়াবহ এই দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা দরকার। এই দেশের প্রতিটা বড় বাড়ি, ফ্ল্যাট, দামি গাড়ির মালিকের সম্পদের উৎস সন্ধান করা উচিত। বিদেশে কাদের কাদের সম্পদ আছে-এগুলো অনুসন্ধান করা জরুরী। আশায় থাকি যদি কোনদিন এই রাষ্ট্রের হুশ ফেরে!

আর যতদিন সেটা না হয় সামাজিকভাবে আমরা যেন এই দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি। অন্তত প্রশ্ন তুলি। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে এই লুটপাটকারি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তুলতেই হবে।


শরিফুল হাসান : কলামিস্ট ও অভিবাসনবিশেষজ্ঞ

জুন ২১, ২০২৪ 

link - https://rajneete.com/opinion/vneu08c6r0

Friday, June 14, 2024

তিনি আমাদের ধ্রুব তাঁরা


স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর পরিবার সংকট ও সম্ভবনা যেন একই সুত্রে গাঁথা, তার যৌক্তিক কারণ কি হতে পারে?

স্বাধীনতা’র ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল পরিচয়, প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার জেড-ফোর্স, রণাঙ্গনে প্রথম ৫শো বর্গ মাইল ভূখন্ড স্বাধীন করাসহ বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত হওয়া এত কিছু অর্জন যার তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের বিশ্ব দরবারে জাতিস্বত্বা “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” হিসেবে পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা তার রাজনৈতিক দর্শন।

তলাবিহীন ঝুড়ি ও রাষ্ট্রের বদনাম গুছিয়ে মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে আধুনিক স্ব-নির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলেছেন ১৯ দফা কর্মসূচী’র মাধ্যমে।

আর “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ও “১৯ দফা’র” লক্ষ্য উদ্দেশ্য-কে হাজার বছর টেনে নিয়ে যাবার জন্য প্লাটফর্ম হিসেবে রেখে গিয়েছেন “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি”।

তার রাজনৈতিক ও আর্দশিক উত্তরসূরী আমরা কোটি কোটি জনতা। রক্তের ও রাজনৈতিক এবং আর্দশিক উত্তরসূরী “যিনি আমাদের ধ্রুব তাঁরা” তিনি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তারেক রহমান-এর যোগ্যতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে, বিনা ভোটে অবৈধ ভাবে দখলদার সরকার বাংলাদেশের স্বার্থ-কে বিকিয়ে দিয়ে নানান ধরনের পথ অবলম্বন করে চলেছেন শুধু মাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকা ও দীর্ঘস্হায়ী করার উদ্দেশ্য।

বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশ-দরদী তারেক রহমান তাঁর দল বিএনপি আগামী’র বাংলাদেশ-কে “কল্যাণ রাষ্ট্র” বি-নির্মাণে নেতৃত্বের উপযোগী সুশৃঙ্খল ব্যবস্থায় সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সুদূর লন্ডন থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

দেশ-নায়ক তারেক রহমান-এর এই প্রচেষ্টা-কে ইতিবাচক দৃষ্টি’তে দেখছেন যেসমস্ত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, নাগরিক সমাজ প্রতিনিধি, সকল স্তরের নেতাকর্মী সমর্থক ও সাধারণ নাগরিক।

তাদের সাথে সরকার প্রতারণার আশ্রয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে আজ্ঞাবহ গোষ্ঠী-কে দিয়ে বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী শক্তি-কে মানসিক ও কাঠামোগত ভাবে দূর্বল করতে এবং সমাজে বিভ্রান্ত তৈরি করতে এই পরিস্থিতিতে দুদকের এক মামলায় বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও উনার সহধর্মিণী প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার জুবাইদা রহমান-কে সাজা দিয়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আদালতের এই আদেশ।

দলের সকল স্তরের নেতাকর্মী সমর্থক বিশ্বাস করেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর একনিষ্ঠ লক্ষ্য স্থির রেখেই ধৈর্যের সাথে সবকিছু মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন।

তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সবার চোখের সামনে ঝলঝল করছে। অনেকটা সুদূর প্রসারী চিন্তা থেকে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকর করতে তিনি দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব থাকা অবস্থায় বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৫ সাল ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন শুরু করেন।

বাংলাদেশে গতানুগতিক ধারার আন্দোলনের বাহিরে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে, শান্তিপূর্ণ গণ-সমাবেশের মাধ্যমে গণ আন্দোলন তৈরি করা যায় তার দৃষ্টান্ত ইতিমধ্যে তিনি স্হাপন করেন বিভাগীয় গণ-সমাবেশ সফল করার মধ্যে দিয়ে।

তখনকার গণমাধ্যমে বিএনপি’র তৃণমূল সম্মেলন নিয়ে শিরোনামসহ সকল সংবাদ গুলো জলন্ত স্বাক্ষী।

আর ২০১৮ সাল ৮ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অন্যায় ভাবে দুদকে’র করা মামলায় আদালতের আদেশে প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মাতা বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া-কে কারাগারে নিয়ে যাবার পর থেকে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দ্বায়িত্ব নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপের বিষয়ে কেউ নেতিবাচক প্রশ্ন কিংবা মন্তব্য করেননি।

সেজন্যই আওয়ামী দখলদার অবৈধ সরকারের নেতৃবৃন্দ দেশ-নায়ক তারেক রহমান-এর যোগ্যতাকে হিংসা করেন ও সবসময় একধরনের আতংকে ভোগে, স্বপ্ন দেখেন এই বুঝি তারেক রহমান এলেন…।

দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে ছোট্ট এই লেখায় একমাত্র অনুভূতি বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশদরদী তারেক রহমান ইনশাআল্লাহ সফল হবেন। হতেই তো হবে? “তিনি আমাদের ধ্রুব তাঁরা” বাংলাদেশের ভাগ্যে, বিএনপি’র ভাগ্যে আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর উত্তরসূরীদের ভাগ্য যে একই সুত্রে গাঁথা।


লেখক:- শায়রুল কবির খান

সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

সদস্য, বিএনপি চেয়ারপার্সন প্রেস উইং ও বিএনপি মিডিয়া সেল।



Wednesday, May 29, 2024

এই নতজানু বাংলাদেশ শহীদ জিয়ার নয়

প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান 


বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অগ্রসরমান পৃথিবীর এক অনন্য বিস্ময়ের নাম বাংলাদেশ। যার সূচনা হয়েছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাড়ে ৭ কোটি বাংলাদেশির বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে তার আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয়েছিলো। সেদিন স্বাধীনতার মহান ঘোষক জেনারেল জিয়া পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন সেই বিদ্রোহই বিপ্লবের পথকে শাণিত করে। উন্মোচিত করে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ গালিচায় মোড়ানো সার্বভৌম ভূখন্ড। 


শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি করাচি একাডেমি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচিতে ডি. জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দু'বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। 


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত, নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা ও মানুষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি শুরু করলে জিয়া দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধে পরাজিত হলে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও সেদিন দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। স্ত্রী- সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে পারে জানা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার জন্য নিজ নামে জেড ফোর্স গঠন করেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। 


দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শেখ মুজিবের সরকার জিয়াউর রহমানকে 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত করে। 


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যু‘র মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। 


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির মধ্যদিয়ে তিনি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপীঠে আসীন করে। 


জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। 


জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরপরই উন্নয়ন অভিযাত্রায় সূচনা হয়। এতো অল্প সময়ে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন খুব সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে সম্ভব হয়নি। নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কিছু উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরা হলো- 


১) ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের উপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন। 


২) তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের কুশীলব কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব রক্ষা ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অগ্রনায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। 


৩) সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল-পিআইবি প্রতিষ্ঠা করেন। 


৪) ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পুরস্কার চালু অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চলচ্চিত্রে প্রেসিডেন্ট পুরস্কারের সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ বছরই তিনি জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ এবং এর সাথে স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ বিভাগে যুক্ত করেন। 


৫) ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে তিনি প্রবর্তন করেন একুশে পদক। 


৬) গুণী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে ১৯৭৭ সালে তিনি চালু করেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'স্বাধীনতা পদক' প্রবর্তন করেন। 


৭) শিল্প-সংস্কৃতিতে শিশুদের মেধা মননের বিকাশের লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই পুরোনো হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিম পাশে তিনি শিশু একাডেমির নতুন ভবন উদ্বোধন করেন। 


৮) ১৯৭৮ সালে তিনি কলেরা (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতাল, দক্ষ নার্স তৈরির লক্ষ্যে ৫ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে ঢাকার মহাখালীতে নার্সিং কলেজ এবং ১৯৮১ সালের ৩ এপ্রিল তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় নিপসম, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও ইপিআই প্রতিষ্ঠিত হয়। 


৯) তিনি ৫০ শয্যার ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, পিজি হাসপাতালের সি-ব্লক, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটসহ চিকিৎসকদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিএমএ ভবন-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। 


১০) বাংলাদেশি জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির উন্নয়নে বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮' জারি করেন। 


১১) ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যশোরের উলশী-যদুনাথপুর খাল খননের মাধ্যমে খাল খনন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। 


১২) ১৯৭৭ সালের ২২ মে জিয়াউর রহমান আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশের ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদ ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। 


১৩) ১৯৭৯ সালের ৯ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৭) প্রদান করেন। জিয়ার আগ্রহেই ১৯৮১ সালের মার্চ-এপ্রিলে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। 


১৪) ১৯৭৮ সালে ৪টি বিভাগীয় শহরে ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। 


১৫) শিশুদের বিনোদনের জন্য ১৯৭৯ সালে রাজধানীর শাহবাগে তিনি প্রতিষ্ঠান করেন জাতীয় শিশু পার্ক। শিশুর স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য শ্যামলীতে একটি শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। 


১৬) ১৯৭৬ সালে শিশুদের সাংস্কৃতিক বিকাশ তরান্বিত করতে পুনরায় রিয়েলিটি টেলিভিশন প্রতিযোগিতা 'নতুন কুড়ি' চালু করেন। 


১৭) ১৯৮০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। 


১৮) দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন তিনি।


১৯) দেশে সকল ধর্মের মানুষের স্বীয় ধর্ম পালনের সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। 


২০) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। 


২১) পল্লী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং প্রথম বছরেই ২৭ হাজার লোককে পল্লী চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। 


২২) ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। 


২৩) ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বরেণ্য ব্যক্তিদের একটি বহর নিয়ে তার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে গভীর সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে হিযবুল বাহার। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি ধারণা সৃষ্টি হয়। 


২৪) তিনি বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। 


২৫) বিদ্যুতের আলো সারাদেশে পৌঁছে দিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। 


২৬) তিনি জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। 


২৭) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা করেন। 


২৮) ১৯৮০ সালের ২৬ ডিসেম্বর জিয়া বাংলাদেশি কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকায় ফরেন অ্যাফেয়ার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। 


২৯) ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পরিচিতি ও ভাবমুর্তি বৃদ্ধি করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। 


৩০) নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৮ সালে প্রথম মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই চাকুরির ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু করেন। 


৩১) বাংলাদেশে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূত ও মহিলা অডিটর জেনারেল নিয়োগ করেন। 


৩২) মহিলা পুলিশ, আনসার ভিডিপি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। কর্মজীবী মহিলাদের সুবিধার্থে তিনিই প্রথম কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ করেন। 


৩৩) জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত করেন। 


৩৪) ১৯৮০ সালে তিনি যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৭৮ সালে কুয়েতে ৬০৭৮ জন শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে বিদেশে মানবসম্পদ পাঠানোর সূচনা করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। 


৩৫) মুজিব আমলের মৃতপ্রায় কলকারখানাগুলো তিনি বেসরকারিকরণের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবীত করেন। 


৩৬) ১৯৭৭ সালে পোশাক কারখানা তৈরির মাধ্যমে তিনি দেশে তৈরি পোশাকখাতের সূচনা করেন। 


৩৭) ১৯৮১ সালে ঢাকায় জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। 


৩৮) প্রেসিডেন্ট জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ কর। 


৩৯) উপজাতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে রাঙামাটিতে 'উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট এবং নেত্রকোনার বিরিশিরিতে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। 


শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখন্ড দিয়েছিলেন। জাতি হিসেবে তিনি গড়ে দিয়েছিলেন আত্মমর্যাদার ভীত। যা তার স্বল্প সময়ের শাসনকালে বিশ্বব্যাপী প্রসংশিত ও অনুকরণীয় হয়। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এখন আমরা একটি উল্টো বাংলাদেশকে দেখছি। যে বাংলাদেশে নেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন। শৌর্য-বীর্য আর সমৃদ্ধির বাংলাদেশের পরিবর্তে এখন আমরা এক নতজানু, ভঙ্গুর ও ক্ষয়িষ্ণু বাংলাদেশকে দেখছি। পরাধীনতার এই বাংলাদেশ আমার না। এটি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া সেই বাংলাদেশ নয়। 


লেখক: প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান  

মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাব।

Tuesday, April 23, 2024

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি

 

মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট-২০২৩

২০২৩ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে এ কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সোমবার, এপ্রিল ২২, ২০২৪  এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিধিবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, স্বেচ্ছাচারমূলক আটক-গ্রেপ্তার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় গুরুতর সমস্যা, রাজনৈতিক বন্দি, মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অযৌক্তিক বিধিনিষেধ এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার পরিবর্তনের সুযোগ না থাকাসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় শাস্তির বদলে দায়মুক্তিরও তথ্যও পাওয়া গেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা বা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের সরকার কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার বা সরকারি সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিধিবহির্ভূত নানা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে খবর রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে মোট কতজন নিহত হয়েছে, সরকার সেই সংখ্যা প্রকাশ করেনি, আবার ঘটনাগুলো তদন্তে স্বচ্ছ পদক্ষেপও নেয়নি।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিগত বছরের তুলনায় কমেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আটজনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালে মৃত্যু হওয়ার কথা বলেছে।

অন্যদিকে আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন একই সময়ে ১২ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার খবর দিয়েছে। রিপোর্টে ২৬ মার্চ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে গুম ও অপহরণের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বলেও প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে।

তারা বলেছে, বাংলাদেশে স্বাধীন আন্দোলনে বাধা দেয়া হয়। আছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সরকার পরিবর্তনে নাগরিকদের অক্ষমতা। রাজনৈতিক অংশগ্রহণে গুরুতর ও অযৌক্তিক বাধা। বাংলাদেশে সরকারে আছে মারাত্মক দুর্নীতি। দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোর ওপর আছে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ অথবা হয়রানি। সরকারের তরফ থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নিষ্ঠুর নির্যাতন, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ ও শাস্তি দেয়া হয়। আছে জীবনের প্রতি হুমকি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর সমস্যা, রাজনৈতিক বন্দি ও আটক। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি এমন অজুহাতে মিথ্যা অভিযোগসহ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে ওই বছরে বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা পুনঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই বছরও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসনকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতে দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে বাংলাদেশের হাসপাতালে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে ২০০৮ সালের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাকে ১০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে তাকে জেলখানা থেকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালে সেখান থেকে তাকে স্থানান্তর করে গৃহবন্দি করা হয়। রাজনৈতিক বন্দি ও আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও দেশের ভিতরকার আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার তথ্যপ্রমাণে ঘাটতি আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক ছক সাজানো হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রসিকিউটররা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করেছেন। এই রিপোর্টে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংবিধান সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়ার সদস্যসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু সরকার এই অধিকারে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ করেছে। এক্ষত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারের হয়রানি অথবা প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্র মিডিয়ার সদস্যরা ও ব্লগাররা নিজেরাই সেন্সর করেছেন। এতে তুলে ধরা হয়েছে সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র, বিচারের ক্ষেত্রে হয়রানি, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তারসহ নানা রকম নিষ্পেষণের কথা। উল্লেখ্য, প্রতি বছর সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সময় গত রাতে এই রিপোর্ট প্রকাশ হয়। তাতে বাংলাদেশ অধ্যায়ে আরও বলা হয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মিডিয়ার স্বাধীনতায় মারাত্মক বিধিনিষেধ আছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অথবা সহিংসতার হুমকি। সাংবাদিকদের অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয় অথবা বিচার করা হয়। সেন্সরশিপ করা হয়। ইন্টারনেট স্বাধীনতায় আছে মারাত্মক বিধিনিষেধ। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অথবা স্বাধীন সমাবেশের ক্ষেত্রেও আছে বড় রকমের হস্তক্ষেপ। আছে সংগঠন, অর্থায়ন ও বেসরকারি এবং নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আছে নিবর্তনমূলক আইন। মুক্তভাবে চলাচলে আছে বিধিনিষেধ। রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্যাতনের বিষয়ে ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা বা নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সদস্যদের শনাক্তে বা শাস্তি দিতে সরকার বিশ্বাসযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না। 

এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসব যুদ্ধাপরাধ ও নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে তার বিচার করার জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। সেই আদালত শাস্তি দিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে মৃত্যুদণ্ড। অনেক পর্যবেক্ষক এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দেখেন। কারণ, আদালত বিশেষত বাছাই করে অভিযুক্ত করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের। এতে খেয়ালখুশিমতো ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ বেআইনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার তদন্ত নিজেরাই করেছে। তারা এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছে যেখানে তাদের শারীরিক মারাত্মক প্রহারে মানুষ আহত হয়েছে অথবা মারা গেছেন। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে কতজন মানুষ মারা গেছেন তার মোট কোনো সংখ্যা সরকার প্রকাশ করেনি। এমনকি এসব ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তও করেনি। এই তদন্ত যারা করেছেন তাদের স্বাধীনতা ও পেশাগত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। 

রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা বছরেই আইন প্রয়োগকারীরা তল্লাশি বা রেইড দিয়েছে কথিত সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকাণ্ড, মাদক ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে। কোনো কোনো ঘেরাওয়ের কালে, গ্রেপ্তারকালে সন্দেজজনক কিছু মৃত্যু ঘটেছে। একই ঘটনা ঘটেছে অন্য আইন প্রয়োগকারীদের অপারেশনেও। রিপোর্টে আরও বলা হয়, আগের বছরের তুলনায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে যায় গত বছর। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও শালিশ কেন্দ্র রিপোর্ট করেছে যে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ড, অথবা হেফাজতে থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে দুজন আইন প্রয়োগকারী এজেন্সির গুলিতে নিহত হয়েছেন। তিনজন নিহত হয়েছেন নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়ার আগে বা হেফাজতে নেয়ার পর শারীরিক নির্যাতনে। ২৬শে মার্চ সুলতানা জেসমিন র‌্যাবের হেফাজতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন আটক অবস্থায়। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা এটাকে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে মাথার ক্ষতের কথা তুলে ধরেছে। র‌্যাবের ইউনিটের কমান্ড কর্মকর্তারা মিডিয়াকে বলেছেন, জেসমিন আর্থিক প্রতারণায় জড়িত থাকার জন্য তাকে তুলে নেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা আছে। 

ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করে চাকরিপ্রত্যাশিতদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি একটি রিপোর্ট জমা দেয় আগস্টে। কিন্তু সেই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। অক্টোবরে হাই কোর্টের দু’জন বিচারক বলেন, এই রিপোর্ট অস্পষ্ট। গ্রেপ্তার ও আটকের বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা নেই এতে। এমন মন্তব্যের সময়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। ১৮ই মার্চ সাদা পোশাকে র‌্যাব কর্মকর্তারা এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। এতে আহত হন একজন। ওই রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ এবং মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হচ্ছে গুম এবং অপহরণ অব্যাহত আছে। অভিযোগ আছে এসব করছে নিরাপত্তা সার্ভিসের লোকজন। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ের মধ্যে একটি স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন রিপোর্ট করেছে যে, এ সময়ে ৩২ জনকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে, তদন্তে বা শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে সীমিত উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো রিপোর্ট করেছে যে, জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন যারা তারা বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী। গুমের অভিযোগের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কোনো রকম অভিযোগ ছাড়া কিছু মানুষকে ছেড়ে দিয়েছে। গ্রেপ্তার করেছে অন্যদের। ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৩ কান্ট্রি রিপোর্টে’ উল্লেখ করেছে যে, জোরপূর্বক গুম, গোপন জেলখানার ব্যবহার, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও নির্যাতন সহ মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে নিরাপত্তা বিষয়ক এজেন্সিগুলো। বছরজুড়ে জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে দিতে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অপহরণে জড়িত তাদের বিচারের। ভিকটিমের পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাক র‌্যালি করেছে। বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলেছে, তাদের কোনো সদস্য আইনগতভাবে, প্রশাসনিক, বিচারিক কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। মায়ের ডাক ও স্থানীয় মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকারকে হয়রানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন জোরপূর্বক ও অনিচ্ছায় গুমের শিকার বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিষয়ক জাতিসংঘের চেয়ার-র‌্যাপোর্টিউর সহ জাতিসংঘের র‌্যাপোর্টিউররা। মার্চে সরকার জানায়, তারা ২৮ জন জোরপূর্বক নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয় দেখছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের কাছে জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের সংখ্যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপনের জন্য নাগরিক সমাজের সংগঠনের সমালোচনা করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ দেশে ফেরার একটি ট্রাভেল পাস নিশ্চিত করেন জুনে। তিনি বাংলাদেশ থেকে জোরপূর্বক গুম করার পর বৈধ কাগজ ছাড়া অবস্থানের কারণে ভারতে আট বছর আটকে আছেন। ২০১৫ সালে তাকে ঢাকার বাসা থেকে তুলে নেয় হয়। ভারত সীমান্তের কাছে তাকে ছেড়ে দেয়ার আগে দুই মাস নিখোঁজ ছিলেন। 

প্রতিবেদনে মিডিয়ার স্বাধীনতা অংশে বলা হয়, আইনে ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্যকে সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিরুদ্ধে কথা বলাকে সরকার বিধিনিষেধ দিয়েছে বলেই মনে হয়। সাংবিধানিক কোনো পরিষদের সমালোচনাকে আইনে ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধ, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার  বিরুদ্ধে প্রাপাগাণ্ডা ছড়ানোর কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে। সরকারের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সারাবছরই সরকার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আইনমন্ত্রী রিপোর্ট করেছেন যে, সারাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কমপক্ষে ৭০০০ মামলা মুলতবি আছে। আগস্টে সরকার ঘোষণা দেয়, তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইনে পরিণত করবে। পার্লামেন্ট এই আইন পাস করেছে সেপ্টেম্বর মাসে। আইন ও সালিস কেন্দ্র রিপোর্ট করেছে যে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১১৯টি ঘটনায় সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়েছে। আরেকটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বলেছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর ৩০৯টি হামলা বা হয়রানির ঘটনা ঘটছে। আহত হয়েছেন ১৩৮ জন সাংবাদিক। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট ও সুনাম নষ্ট করার জন্য প্রিন্ট, অনলাইন এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের অভিযোগে প্রথম আলোর সম্পাদক ও একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মার্চে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আওয়ামী লীগ পন্থি একজন আইনজীবি। এ অভিযোগে সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে আটক করে পুলিশ। এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। এই আইনকে সংশোধন বা বাতিলের দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের সংগঠন, সম্পাদক পরিষদ ও রাজনৈতিক দলগুলো।  জুনে জামালপুরে একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সাংবাদিক গোলাম রাব্বানি নাদিমকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ আটক করে আরও কয়েকজনকে।