Search

Sunday, November 3, 2024

তরুন প্রজস্ম এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব


বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৫ বয়সী কিশোর-কিশোরী এবং তরুন-তরুনীর সংখ্যা  তিন কোটির ঘরে, যা জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। ছাত্র-জনতার জুলাই ‘২৪ বিপ্লবের মাধ্যদিয়ে এরা আমাদের সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করছে। অকুতোভয় আন্দোলনকারীরা বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে; হুমকি-ধামকি, ভয়-ভীতি, নির্যাতন-গুম তাদেরকে লক্ষ্যথেকে বিচ্যুত করতে পরেনি। পকেটে নাম-ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম লেখা কাগজ নিয়ে রাস্তায় নেমেছে - এদের  অনেকে ঘরে ফিরে আসেনি। তদের সংকল্প এবং আত্নত্যাগ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলন শেখ হাসিনার রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। 

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনটি দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন, গনতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র গঠনের ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। দিবস তিনটি হলো ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫, ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯০ এবং ৫ই আগষ্ট ২০২৪। ৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য  আমরা প্রবীনরা যেভাবে উপলব্ধি করতে পরি, আজকের তরুন প্রজন্মের জন্য তা সহজ নয়। তাদের জন্ম ২০০০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে এবং ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর দূর অতীতের কথা।  আশার কথা আমাদের কিশোর এবং তরুনেরা অনেক তথ্য, উপাত্ত নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচারের চেষ্টা করে।  তা না হলে মুজিবময় পাঠ্যপুস্তক, শপথ বাক্য আর আওয়ামী লীগ সরকারের মুজিব বন্দনার বিপরীতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠত না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রতিনিয়ত তারুন্যে সংস্পর্শে আসতে হয়।  তাদের সচেতনতা, চিন্তার গভীরতা এবং নতুন কিছু গড়ার আকাক্ষা প্রতিনিয়ত চমকিত করে।  এদের মাঝেই বেঁচে থাকবে আমাদের ইতিহাস, অর্জন এবং গৌরব। তাদের কথা বিবেচনায় ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এর অপরিহার্যতা নিয়ে আমার আজকের উপস্থাপনা।  আমার আশা এ লোখাটি তরুনদের ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব নিয়ে আরও জানার আগ্রহ তৈরি করবে এবং তাদের মাঝে এই বিপ্লবের ভাবাদর্শ জীবিত থাকবে। 

৭ই নভেম্বরের পটভূমি রচিত হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে।  ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই ক্রান্তিকালে ২৬শে মার্চ বিহ্বল জাতী মেজর জিয়াউর রহমানের চট্রগ্রাম রেডিও ষ্টেশন থেকে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনায় সম্বিত খুজে পায়।  অথচ ফ্যাসিন্ট শেখ হাসিনার সরকার যেকোনো ছুতায় জিয়াউর রহমানের মর্যাদাহানিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি, চক্ষু লজ্জারও ধার ধারেনি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আদালতের রায়ের আড়ালে মেজর জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে।

অথচ ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ ও কর্নেল ওসমানী পীড়াপীড়ি করেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আদায় করতে পারেননি। সে সময়কার যে কেউ এক বাক্যে স্বীকার করবেন তারা জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছেন এবং সেটাই তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা  স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে প্রথম কে কখন পাঠ করেছে, তার বিতর্কে যদি না-ও যাই, আমাদের মানতে হবে জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের ঘোষণার ব্যাপক প্রভাব ছিল। এটা কেবল আহ্বান নয়, ইতোমধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দেওয়া বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তার ঘোষণা। জনগণ নিশ্চিত হয় প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনায়। আর জিয়াউর রহমান ২৫ থেকে ২৬ মাঝরাতে বিদ্রোহ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার ও সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার না করলে ভাষণ দেওয়ার জন্য রেডিও স্টেশন থাকত না।

জিয়াউর রহমানের এই ভাষণের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। একজন অপরিচিত সামরিক কর্মকর্তা থেকে তিনি হয়ে ওঠেন সবার পরিচিত ও সম্মানিত। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে ঈর্ষণীয়। ঠিক একই কারণে এবং কাছাকাছি পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের জিয়ার ভাষণ দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনে।

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সরকার এমন কী করেছিল যে স্বাধীতার চার বছরের মাথায় দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়? স্বল্প পরিসরে স্বাধীনতা-উত্তর ৭২ থেকে ৭৫ সালের আওয়ামী দুঃশাসন বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য কাজ। এর কদর্যতা ব্যাপক বিস্তৃত ও ভয়ংকর। শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলেও তিনি ছিলেন প্রথমত তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের রক্ষক এবং দলের প্রতিপালক ও প্রশ্রয়দাতা। তিনি জনগণের বন্ধু হতে পারেননি অথবা হতে চাননি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে খাদ্যশস্য ও আর্থিক সাহায্য এসেছিল, ৭২ থেকে ৭৫ সালের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশের অসহায়-অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ আত্মসাৎ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় চোরাকারবারি, কালোবাজারি ও মজুতকারীতে দেশ ছেয়ে যায়। চালের সংকট এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে দুবেলা ভাত খাওয়া বিলাসিতায় পরিণত হয়। ’৭২ থেকে ৭৪ সালের খরা ও বন্যা আমলে নিলেও আমাদের দুবেলা খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল, তবু ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে সারা দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মারা যায় এক লাখের বেশি মানুষ। যারা এখনও ওই দুর্ভিক্ষের জন্য শেখ মুজিবের ব্যর্থতা মানতে চান না, তাদের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের গবেষণা পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। তিনি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে উপসংহার টেনেছেন যথেষ্ট খাদ্য সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।

দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে তিনবার মাঠে নামান। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে অপরাধীদের ধরলেও আওয়ামী নেতা এবং সর্বোপরি শেখ মুজিবের সুপারিশে চিহ্নিত অপরাধীরাও ছাড়া পেয়ে যায়। খুনের মামলার আসামিরাও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতো। পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার বদলে তিনি তৈরি করেন লাল বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর মতো মিলিশিয়া বাহিনী, যাদের কাজ ছিল প্রতিবাদী, সমালোচক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও গুম-খুনের মাধ্যমে নিস্তব্ধ করা। রক্ষীবাহিনী ছিল মুজিব বাহিনীর উত্তরসূরি এবং তৈরি করা হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দাদের তত্ত্বাবধানে। বিতর্কিত মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তৈরি করা হয়, যা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডের বাইরে ছিল।

মুজিব বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করা। রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা ভারতের দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে সাভারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেজর রেড্ডি নামক একজন ভারতীয়র তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ পেত। ভারত বাংলাদেশে বারবার একই ভুল করেছে, দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা আমলে না নিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। রক্ষীবাহিনী ছিল জনমনে আতঙ্কের প্রতীক এবং সেনাবাহিনীর অসন্তোষের কারণ। রক্ষীবাহিনীর অপকর্ম এত ব্যাপক হয়েছিল যে তাদের দায়মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে আইন পাস করেন। ৩৪ বছর পর শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা একই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন র‌্যাব দিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মতো গৌরবজনক ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তাও শপথ ভঙ্গ করে শেখ হাসিনার জনবিরোধী কাজে শরিক হয়েছিলেন।

ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বোত সাহায্য করেছে, এটি অনস্বীকার্য। ১২ হজারের মতো ভারতীয় সেনাসদস্য আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ মূলত ভারতের খাদ্য সহায়তায় বেঁচে ছিল। এ সত্ত্বেও ভারতের অভিপ্রায় ও আচরণ দেখে প্রবাসী সরকার ও মুক্তি বাহিনীর মাঝে অস্বস্তি শুরু হয় ১৯৭১ সাল থেকেই, যা দূর হওয়ার বদলে আরও ঘনীভূত হয়। তখন মওলানা ভাসানী এক বিখ্যাত উক্তি বলেছিলেন, ‘পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়’। ১৬ ডিসেম্বর পকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী ও প্রবাসী সরকারকে দূরে রাখা হয়। আত্মসমর্পণকারি পাকিস্তানি বাহিনীর সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যায়। কিছু লুটতরাজেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তিকে জনগণ সন্দেহের চোখে দেখে। এই চুক্তির একটি ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গোলোযোগে ভারতকে হস্তক্ষেপের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সর্বোপরি শেখ মুজিবের দুঃশাসন যত দীর্ঘায়িত হতে থাকে, জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ তত দানা বাঁধতে থাকে।

শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এবং চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। জনগণকে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখানো শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেন। সব সমালোচনা ঝেড়ে ফেলে পুরোদস্তুর ফ্যাসিস্ট শাসক বনে যান। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এরপর বুলেট ছাড়া আপনাকে সরানোর কোনো উপায় থাকল না।’

মুজিব শাসনের ব্যর্থতা এতটা প্রকট হতে থাকে যে দেশের মানুষের স্বাধীনতার আনন্দ ফিকে হতে হতে বিলীন হয়ে যায়। অভাব, দুঃশাসন, দুর্নীতি, অরাজকতা ও জুলুমে জর্জরিত জনগণ মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। এমন পটভূমিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় ক্ষুব্ধ মেজর শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে। শেখ মুজিবকে হত্যা ছিল একটি coup d’état (ক্যু দেঁতা), যার কাছাকাছি পরিশব্দ অভ্যুত্থান। এর অর্থ হঠাৎ বল প্রয়োগের মাধ্যমে একটি ছোট গোষ্ঠী দ্বারা কোনো সরকারপ্রধানকে উৎখাত করা। বিপ্লব হয় তখন, যখন আপামর জনসাধারণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ধরনে পরিবর্তন আনে। যেমন ছাত্র-জনতার জুলাই ২০২৪ আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন একটা সফল বিপ্লব। একইভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা দেশকে অরাজকতার হাত থেকে উদ্ধার করা সফল বিপ্লব।

শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশে একটা অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান থাকলেও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজররা খন্দকার মোশতাকের হাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করে। সব বাহিনীর প্রধানরা খন্দকার মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করেন, সংসদ বলবৎ থাকে এবং নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। নতুন মন্ত্রীদের অধিকাংশই শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেও বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক ও মেজর রশীদ সব সিদ্ধান্ত দিতেন। বঙ্গভবন পাহারায় ফারুকের ট্যাংক বাহিনী নিয়োজিত থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আগস্টের শেষে জাতীয় চার নেতাকে কারান্তরীণ করা হয়। 

সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করা হয়। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ বীর উত্তমের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। সফিউল্লাহ কোনো দিনই যোগ্য অথবা বলিষ্ঠ সেনাপ্রধান ছিলেন না। জিয়াউর রহমানের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও শুধু শেখ মুজিবের আনুগত্যের কারণে এবং জেনারেল ওসমানীর প্রিয়ভাজন হওয়ায় সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান হন। একটি বিতর্কিত পদায়ন হয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে দিল্লিতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে তিন জন সিনিয়র অফিসার ডিঙিয়ে উপ-সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয় এবং মেজর জেনারেলে উন্নীত করা হয়। মাত্র এক বছর আগেই সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তাকে এভাবেই প্রশিক্ষণে থাকা আবস্থায় কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলে পদোন্নতি দেন। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের সঙ্গে এরশাদের সক্ষ্য এবং তাদের প্রতি আসকারা সেনাবাহিনীতে সর্বজনবিদিত।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ বীর উত্তমের পদপদবি অপরিবর্তিত থাকে। সফিউল্লাহ ও খালেদ মোশারফের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যোগাযোগ সর্বাধিক ছিল। সফিউল্লাহর পরবর্তীতে সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন লালন করছিলেন খালেদ মোশাররফ। শেখ মুজিব জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে খালেদ মোশাররফ মনক্ষুণ্ন ছিলেন।

সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জিয়াউর রহমানের মতো যোগ্য অফিসার সে মুহূর্তে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু তার যোগ্যতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও জনপ্রিয়তা অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের উদ্বেগের বিষয় ছিল। এ দুটি বিষয় মাথায় রেখে সেনাপ্রধানের ওপর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদ তৈরি করা হয় এবং মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তারও ওপরে জেনারেল ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হয়। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা সীমিত করে দেওয়া হয়। প্রকারান্তরে অভ্যুত্থানে জড়িত ওসমানী ও খলিলুর রহমান গং সামরিক বাহিনী পরিচালনা করতে থাকে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার জিয়াউর রহমানের সম্মানহানি এবং তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে এতটাই মনোযোগী ছিল যে অনেক সত্য ঘটনা জনগণের কাছে অজানা থেকে গেছে। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক সম্পর্কে খালেদ মোশাররফের ভাগ্নে এবং তার ছত্রচ্ছায়ায় ঢাকা সেনানিবাসে দম্ভের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। তার চেয়েও ভয়ংকর কথা হলো, ১৯৭৩ সালে তিনি অভ্যুত্থানচেষ্টা করে ব্যর্থ হন, যা সেনাবাহিনী জ্ঞাত ছিল। তবু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং মিসর থেকে উপহার পাওয়া নতুন ৩২টি ট্যাংক তার হাতেই ন্যাস্ত করা হয়। মেজর ফারুকের ট্যাংক বাহিনী সরাসরি সেনাপ্রধানের কমান্ডে ছিল। অপরদিকে অভ্যুত্থানে মেজর ফারুকের প্রধান সহযোগী মেজর রশীদ সম্পর্কে ফারুকের ভায়রা ভাই। প্রশিক্ষণ শেষে তার পোস্টিং নিয়মিতভাবে যশোরে হয়েছিল। কিন্তু ফারুক খালেদ মোশাররফকে ধরে রশীদের পোস্টিং বাতিল করে ঢাকায় রাখার বন্দোবস্ত করেন। 

শেখ মুজিব নিহত হওয়ার ঘটনা জনগণ একরকম মেনে নেয়। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ছাড়া আর কেউ প্রতিবাদ অথবা প্রতিরোধ করতে বের হননি। মজলুমের ওপর জুলুমবাজ রক্ষীবাহিনী, লাল বাহিনী, যুবলীগ, ছাত্রলীগ–এদের কাউকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি, ভোজবাজির মতো উধাও হয়েছিল। অথচ তখনো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। অত্যাচারী-জালেমদের হম্বীতম্বী সব সময়  অসহায়, দুর্বল মানুষের সঙ্গে হয়। শক্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলে পলায়নপরতা তাদের একমাত্র গত্যন্তর। গত ৫ আগস্ট আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন গণপলায়ন দুবারই হয়েছে, শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উৎপাটিত হওয়ার পর। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর অবস্থা এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে পরবর্তী দিনগুলোতে ১৪৪ ধারা জারি করারও প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়নি। উল্টো জনগণের মাঝে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। এক দিনের ব্যবধানে চাল কেজিপ্রতি ৭ টাকা থেকে ৪ টাকায় নেমে আসে। অধিকাংশ চোরাকারবারি, মজুতদার ও অপরাধীরা গা ঢাকা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীতে চলতে থাকে চাপা অস্বস্তি।

জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একমাত্র ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম প্রকাশ্যে খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ এবং অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের বঙ্গভবনে অবস্থানের বিরোধিতা করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে সোচ্চার ছিলেন। শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন এবং তার অধীনে মেজর রশীদের অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়া তার জন্য গ্লানিকর ছিল। শাফায়াত জামিল বেশ কয়েকবার জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের বঙ্গভবন থেকে সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করেন। জিয়াউর রহমান এ বিষয়ে তাড়াহুড়োর পক্ষপাতী ছিলেন না। উপরন্তু জিয়াউর রহমানের ওপর দুটি পদ তৈরি করে তাকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে অবশিষ্ট শৃঙ্খলা ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এখানে মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনীতে কেউই চেইন অব কমান্ডের বাইরে নয়, স্বয়ং সেনাপ্রধানসহ। সেনাপ্রধানকেও দেশের গঠন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী হয় রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আদেশ মানতে হয়। স্বউদ্যোগে কোনো কিছু করার স্বাধীনতা থাকে না। খন্দকার মোশতাকের সময়কালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ খলিলুর রহমানের নির্দেশ মেনে চলতে হতো। জিয়ারউর রহমান শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে নিজেকে জড়াবেন না বুঝতে পেরে শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফের মতামত জানার চেষ্টা করেন। খালেদ মোশাররফ তার সম্মতি জানিয়ে দেন।

২ অথবা ৩ নভেম্বর মাঝরাতে শাফায়াত জামিল তার অধীনে পদাতিক বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন। প্রথমেই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার ঘরে অন্তরীণ করা হয়। রেডিও-টিভি স্টেশন দখল করা হয়, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিছিন্ন করা হয়। বঙ্গভবন পাহারায় নিয়োজিত ইউনিটকে সেনানিবাসে ফেরত আনা হয়। এরপর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহের নিয়ন্ত্রণ নেন। রাষ্ট্রপতি ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য সারা দিন যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার সশব্দে বঙ্গভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকে। খালেদ মোশাররফ মেজরদের সেনানিবাসে ফেরত আসার নির্দেশ দেন। সারা দিনের উত্তপ্ত বাদানুবাদ শেষে মেজর মহিউদ্দিন ছাড়া বাকি ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় পরিবারসহ থাইল্যান্ডে চলে যায়। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করা হয়। 

৪ নভেম্বর সকালে একটি মর্মান্তিক খবর খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল জানতে পারেন; ২ বা ৩ নভেম্বর ভোর রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও মেজর রশীদের অনুমতিক্রমে চার নেতাকে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল উভয়ে খন্দকার মোশতাক ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু ততক্ষণে মেজররা থাইল্যান্ড পৌঁছে গেছে। পরে জানা যায়, অভ্যুত্থানে জড়িতরা আগেই ঠিক করে রেখেছিল সেনাবাহিনী থেকে পাল্টা অভ্যুত্থান হলে স্বংক্রীয়ভাবে চার নেতাকে হত্যা করা হবে। তাদের ভয় ছিল চার নেতার যেকোনো একজনের আহ্বানে ভারত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বেলা বাড়তে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে তার দাবি নিয়ে উপস্থিত হন। জিয়াউর রহমানের পরিবর্তে নিজে সেনাপ্রধান হতে অভিপ্রায় প্রকাশ করেন এবং খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখে মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানান। আলোচনা সারা দিন ধরে চলতে থাকে। এর মাঝে শাফায়াত জামিল টের পাওয়া শুরু করেন জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ রেখে খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান হওয়ার চেষ্টা সাধারণ সিপাহীরা ভলো চোখে দেখেছে না এবং তাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। শাফায়াত জামিল অধৈর্য হয়ে সেনানিবাস থেকে বঙ্গভবনে গমন করেন এবং মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে সশস্ত্র প্রবেশ করেন। ভীত খন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি দেন এবং সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। খন্দকার মোশতাক পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিপরিষদের মিটিং থেকেই চার মন্ত্রীকে আটক করা হয়। ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি সংসদ ভেঙে দেন।

এত কিছুর পরও খালেদ মোশারফ ও শাফায়াত জামিল তাদের অভ্যুত্থান টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে যে আলোচনা আসে, তা তাদের জন্য অসম্মানজনক। তারা দুজনেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা অনুচিত। রক্তপাত এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা তাদের মাঝে দেখা যায়। তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পারিপার্শ্বিক কারণগুলো আলোচনা করা উচিত, তাদের ব্যক্তিত্বে কালিমা লেপন না করে।

৩ নভেম্বর থেকে রেডিও-টিভিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল না। সেনানিবাস ও বঙ্গভবনে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সাধারণ জনগণ এমনকি সেনাবাহিনী অন্ধকারে ছিল। অনিশ্চয়তা ও ভারতীয় আগ্রাসনের ভীতির মাঝে জনতার দিন কাটছিল। তার ওপর সেনাবাহিনীর মধ্যে ধারণা তৈরি হয় খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি এবং তিনি ভারতের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বাসিত করবেন। এমন ধারণা তৈরি হওয়ার কারণ হিসেবে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ব্যাপক প্রচারণাকে দায়ী করা হয়। কাকতালীয় অথবা নিয়তির পরিহাস হলেও এ সময় কিছু ঘটনা ঘটে, যা খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য নিয়ে সিপাহী-জনতার মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়। কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ সিপাহীদের নজরে পড়ে। তার ওপর ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের একটি মিছিল বের হয় শেখ মুজিব ও চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে। মিছিলটি পলাশী থেকে শুরু হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেষ হয়। তারা এই দাবিতে পরের দিন হরতাল ডাকে। এ মিছিলের সম্মুখে ছিলেন খালেদ মোশাররফের মা ও বড় ভাই রাশেদ মোশাররফ, তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। এমন নাজুক অবস্থায় আওয়ামী লীগের মিছিল ও নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফের পরিবারের সদস্য, এই ছবি ৫ নভেম্বর প্রতিটা পত্রিকার প্রথম পাতায় খালেদ মোশাররফের র‌্যাংক পরিধানের ছবির নিচে ছাপা হয়েছিল। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যরা যদি পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর দাবিতে মিছিল করে, তাহলে জনমনে কী ধারণা তৈরি হবে?

আরেকটি ঘটনা ঘটে সেনানিবাসের প্রধান প্রবেশপথে। ৪ নভেম্বর ভারতীয় দুতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা এসে উপস্থিত হন এবং খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে চান। খালেদ মোশারফ সেনানিবাসে অনুপস্থিত থাকায় ব্রিগেডিয়ার ভোরা খালেদ মোশারফের জন্য একটি উপহার বাক্স রেখে যান। এমনিতেই সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তার ওপর এসব ঘটনা সিপাহী-জনতার মনে সন্দেহ ঘনীভূত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটা সময়ের আলোচনা করছি, যখন জনগণ ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে এবং ভারতবিদ্বেষ স্মরণকলের মধ্যে তীব্র।

খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল দুজনেই সেনাবাহিনীতে তাদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে ছিলেন। শাফায়াত জামিলের ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ বিগ্রেডের মাত্র তিনটি ইউনিট তাদের সমর্থন করছিল। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল পরস্পরের মাঝে অবিশ্বাস দেখা দেয়। শাফায়াত জামিলকে না জানিয়ে খালেদ মোশাররফ ১০ম বেঙ্গলকে রংপুর থেকে ঢাকা আনেন এবং নিয়তির টানে আরও দুজন খালেদ মোশাররফের আস্থাভাজন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম ঢাকায় এসে তার পাশে অবস্থান নেন।

জিয়াউর রহমান গৃহ-অন্তরীণ হওয়ার পর থেকে সেনানিবাসে গোপনে সিপাহীদের মাঝে বিদ্রোহ তৈরিতে উদ্যোগী হন জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। জিয়াউর রহমান গৃহঅন্তরীণ অবস্থায় তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হয়েছিলেন। তিনি উদ্ধারে সাহায্য চেয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাহের তার নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং নিজ অভিলাষ পূর্ণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পান। আবু তাহের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার এক পা অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বেসামরিক পদে যোগ দিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি গণচীনের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখতেন। তার আদর্শের সঙ্গে জাসদের মিল দেখতে পান। তাহের জাসদের উগ্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। তিনি জাসদের সশস্ত্র ইউনিট গণবাহিনীর প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ’৭২ থেকে ৭৫ সালে শেখ মুজিবের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে পরাক্রমশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল জাসদ। জাসদের অসংখ্য তরুণ নেতা-কর্মী রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের হাতে নিহত হন অথবা কারাগারে নির্যাতিত হন। তবু উগ্রবাদিতা এবং অসহিষ্ণু হিংসাত্মক আচরণের কারণে জাসদ জনসমর্থনে পিছিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জাসদ ও সর্বহারা পার্টিকে মেধা এবং তারুণ্যের অপচয় বলে মতামত দিয়েছেন।

আবু তাহের সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে গণবাহিনীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যেখানে শুধু সৈনিক নিয়োগ হবে এবং সুবেদার পর্যন্ত সর্বোচ্চ পদ থাকবে। নিয়মিত সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে তারা দেশের বিভিন্ন কাজে অংশ নিবে। রাশিয়া এবং চীনের বিপ্লবের পটভূমি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী চিন্তাধারা সে সময় অনেক দেশে উদ্ভব হয়, সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হুজুগ দেখা দেয়। দুঃখজনক ভাবে এসব স্বপ্নবিলাসের সাথে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক থাকায় অধিকাংশই ব্যর্থ হয় এবং মাঝখানে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশেও তাহেরের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে এবং ফলশ্রুতিতে জাসদ বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যায়। আবু তাহেরের পরিবার এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী তাকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। বিশেষ করে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তার পক্ষে জনগণের সহানুভূতি গড়ে তোলা সহজ। এর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়উর রহমানকে খলনায়কের ভূমিকায় দেখানো হয়। আওয়ামী লীগ সবসময় একাজে উৎসাহ দিয়েছে। অথচ জিয়াউর রহমান সিপাহীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং তার ফলে সিপাহীদের মর্যাদা এবং জীবনমানের উন্নয়ন হয়। ৭ই নভেম্বরের ছুটিও সিপাহীদের দাবি ছিল যা ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাতিল করা পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আবু তাহের সেনা বাহিনীতে যে অসন্তোষের বীজ বুনেছিলেন। তার রেশ ধরে ৭৫ থেকে ৭৭ তিন বছর সামরিক বাহিনীতে অসংখ্য সিপাহি এবং অফিসারের রক্ত ঝরেছে। তাহেরের বিপ্লবী সিপাহীরা ৭ই নভেম্বর খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং কর্নেল এ টি এম হায়দারকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে ভাতৃহত্যার সূচনা হয়। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। 

৩রা নভেম্বর খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল বিদ্রোহ করলে আবু তাহের তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান। এমনকি জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতামত উপেক্ষা করে জিয়াউর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক কষেন। তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঢাকা সেনানিবাসে ৪ঠা নভেম্বর থেকে ১২ দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ শুরু করে। সিপাহীদের ন্যায্য কিছু দাবির সাথে সুকৌশলে তার সমাজতান্ত্রীক দাবি ঢুকিয়ে দেন। সাথে রং চড়িয়ে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের আওয়ামী লীগ এবং ভারত প্রীতির গুজব ছড়ানো হয়। সিপাহিরা উত্তেজিত হতে থাকে। তারা প্রথম থেকেই জিয়াউর রহমানের আটক এবং পদত্যাগ ভালোভাবে নেয়নি। ৬/৭ ই নভেম্বর মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপাহীরা ফাঁকা গুলি করে বিদ্রোহ জানান দেয়। এর পর ঘটনা দ্রুত ঘটতে শুরু করে। ৪৬ ব্রিগেডের যে তিনটি পদাতিক ইউনিট খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল তরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মেজর মহিউদ্দিন (১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত-দেশে থেকে যাওয়া একমাত্র অফিসার) এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হক তাদের অনুগত কিছু সৈনিক সহ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করে তাদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন। অনেকে প্রচার করেন তাহেরের সৈনিকরা জিয়াউর রহমনকে উদ্ধার করে–যা সত্য নয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিদ্রোহ অনুঘটন হিসাবে কাজ করলেও, জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন এই দুই জন সেনা কর্মকর্তা। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে অবস্থানকালে এই রেজিমেন্ট এবং চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসার, নন কমিশন্ড অফিসার এবং সিপাহীরা জিয়াকে আগলে রাখে। এখানে উল্লেখ্য ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানে ফারুকের ট্যাংক ইউনিটের সাথে রশীদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ করেছিল। এবং চতুর্থ বেঙ্গল শাফায়াত জমিলের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। ৭ই নভেম্বর তারা সকলে জিয়ার চারিদিকে প্রতিরক্ষা তৈরি করে।


সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিজের অবস্থান সংহত করার পর জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে অবস্থানরত সকল সিনিয়র অফিসারদের তার কাছে হাজির করার আদেশ দেন। সৈনিকরা নিজ উদ্যোগে সেনানিবাসের সকল অফিসারকে খুঁজে জিয়ার সামনে হাজির করে। এদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী বীর উত্তম। তিনি সেসময় যশোর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং ৬ই নভেম্বর ঢাকার মিটিংয়ে যোগ দিতে এসেছিলেন। এ সকল অফিসার এবং অনুগত সৈনিকরা জিয়ার চারিদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে এবং তাকে সুরক্ষিত রাখে উচ্ছৃঙ্খল সিপাহি এবং সেনানিবাসে অনুপ্রবেশকারী তাহেরের সন্ত্রাসীদের থেকে।

জিয়াউর রহমান খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি শাফায়াত জামিলের সাথে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন এবং তাকে নিশ্চিন্তে সেনানিবাসে ফেরার আহ্বান জানান। শাফায়াত জামিলের বিপ্লবের মাত্রা এবং ব্যাপকতা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তিনি জিয়াউর রহমানের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। যখন উপলব্ধি করেন তার পদাতিক বাহিনী বঙ্গভবন অরক্ষিত রেখে পালিয়ে গেছে এবং বিপ্লবী সিপাহিরা বঙ্গভবনে প্রবেশের চেষ্টা করছে তখন তিনি দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন এবং শেষপর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় আশ্রয় নেন। মির শওকত আলী কর্নেল আমিনুল হককে পাঠিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করান। দুঃখজনক পরিণতি হয় খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের। তারা বঙ্গভবন ছেড়ে শেরেবাংলা নগরে অবস্থানরত রংপুর থেকে আগত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাওনিতে আশ্রয় নেন। এটা তাদের অনুগত বাহিনী হওয়ায় তারা সেখানে নিরাপদ বোধ করেছিলেন। এ ইউনিটের কমান্ডে তখন ছিলেন মেজর নওয়াজিশ। তিনি জিয়াউর রহমানকে ফোন করে খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের উপস্থিতির কথা জানান। জিয়াউর রহমান তাদের সর্বত নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংঘের সিপাহীরা এসে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের উত্তেজিত করে তুলে এবং এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করে। 

তাহের ৭ই নভেম্বর ভোর রাতে সেনানিবাসে এসে জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে আহ্বান করেন এবং সাথে করে নিয়ে যেতে চান। তাহেরের অভিসন্ধি উপলব্ধি করে এবং জিয়াউর রহমানের প্রাণহানির আশঙ্কায় উপস্থিত সেনাকর্মকর্তারা জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে বাধা দেন এবং রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তাহেরের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাহের বিফল হয়ে ফেরত যান। তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল জেষ্ঠ্য অফিসার পরবর্তীতে সর্বসম্মতভাবে মত দিয়েছেন তাহেরের সাথে জিয়াউর রহমানের সেনানিবাস থেকে বের না হওয়া সঠিক ছিল, এর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। জিয়াউর রহমান তাহেরের আয়ত্তে চলে গেলে তাকে জিম্মি করে নিজের মতন ভাষণ আদায় করে নিতেন এবং জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় সওয়ার হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিতেন। এমন ধারণা অবাস্তব শোনালেও সমাজতন্ত্রীরা যেকোনো উপায়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনকে বৈধ মনে করে। উপরন্তু তাহের উগ্রপন্থি রাজনীতিতে ইতোমধ্যে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমান হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাহের তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন অফিসার হত্যায় সিপাহীদের উৎসাহ দিয়ে যার ফলাফল ছিল মর্মান্তিক।

১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় জনতা যেমন সম্বিত ফিরে পেয়েছিল তেমনি ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জিয়ার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার ভাষণ শুনে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, চলমান অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তিপায়। একজন জনপ্রিয়, দৃঢ়চেতা মুক্তিযোদ্ধার দেশ শাসনের দায়িত্ব নেওয়ায় জনগণের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়। সাধারণ সিপাহীরা ট্রাক নিয়ে, ট্যাংক নিয়ে জনতার সাথে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে ৭ই নভেম্বর সকালেই সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আসে। এর পর জনতা সামরিক ট্রাক এবং ট্যাংকের উপর উঠে আনন্দ করতে থাকে। এই আনন্দ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার আনন্দ- মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার আনন্দ-অপশক্তি প্রতিরোধের আনন্দ। এ আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল রাজপথে। এই সফল বিপ্লব সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়েছিল যার ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী, যা আমরা আজও অনুভব করি। 


৭ই নভেম্বর না হলে বাংলাদেশ উদার গণতন্ত্র এবং সুশাসনের ধারায় ফিরত না। অভাব, দারিদ্র, দুর্নীতি এবং অরাজকতায় জর্জরিত হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করে আমাদের তরুণদের ৫ই আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হবে। কাজ মাত্র শুরু। হাজার শহীদের রক্ত বৃথা যাবে যদি আমরা সফল হতে না পারি। আমরা সবাই বিপ্লব সফল করতে বদ্ধপরিকর।


  • লেখক: প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান, মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব

জাতীয়তাবাদের আরাধ্য অবয়বের নাম ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’




কখনো কখনো বহমান সময় ব্যক্তিকে নির্মাণ করে, আবার কখনো ব্যক্তিই তৈরি করে ইতিহাস। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম যেমন সময়ের নির্মাণ, তেমনি শহীদ জিয়া তৈরি করে গেছেন ইতিহাস। আজকের বাংলাদেশ সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মাত্র, যেখানে সময়ের সাথে গড়ে উঠেছে ব্যক্তির এক অনস্বীকার্য মিথোজীবীতা।

সেনাবাহিনীর একজন মেজর যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে নিঃশঙ্ক চিত্তে নিজের এবং পরিবারের জীবনকে বিপদাপন্ন করে ঘোষণা করেন, “উই রিভোল্ট” তখন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ। যখন একজন দেশপ্রেমিক মহান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখন স্বাধীনতা ও ব্যক্তি হয়ে ওঠেন একে অপরের পরিপূরক। কালের স্রোতে, সময়ের প্রবহমানতায় যিনি তাঁর সত্তাকে বিলীন করে দেন জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে, তখন তিনি হয়ে ওঠেন জাতিসত্তার এক মূর্ত প্রতীক। জাতির সেই আরাধ্য অবয়বের নাম ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’।

মেজর জিয়াকে নিয়ে সম্পূর্ণ পাঠ এখনো হয়ে ওঠেনি কিংবা বলা যায়- প্রচারবিমুখ বীরমুক্তিযোদ্ধা জিয়ার পাঠোদ্ধার দুরূহ এবং অনতিক্রম্য তার ভাবনার পরিধি। তবুও যেটুকু আমরা জেনে যায় পরম্পরায়, আমরা এমন একজন সামরিক কর্মকর্তাকে দেখি। যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকেও ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারক এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে উঠেন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বাহক।

১৯৭২ সালের এপ্রিলে জেনারেল এমেজি ওসমানীর পদত্যাগের পর সেনাবাহিনীর প্রচলিত মান ও প্রথা ভেঙ্গে সর্বোচ্চ পেশাদারি, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, বিচক্ষণ, সামরিক নেতৃত্বের সকল গুণাবলিতে মহিমান্বিত, প্রশ্নাতীত দেশপ্রেমিক ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে বঞ্চিত করে, ব্রিগেডিয়ার কে এম শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান মনোনীত করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে রাজনীতিকরণ প্রথা চালু করেন। সেই বেদনা জারিত করে শতসহস্র সৈনিক ও অফিসারের হৃদয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমান রাজনৈতিক নেতা থেকে ক্রমশ হয়ে ওঠেন স্বৈরশাসক, যার বিপরীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা কর্মকর্তা হতে উত্তীর্ণ হন এক মহান নেতায়। যেন বহমান সময় এই বীরমুক্তিযোদ্ধাকে জায়গা করে দিতে উদ্ধত হয়। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না বরং এটি ছিল ঘটনার পরম্পরা ও পরিণতি। এই পরিণতি হলো একটি তিমির রাত্রির বিনাশ ঘটিয়ে একটি সদ্যোজাত রাষ্ট্রের জীবনে আরেকটি সম্ভাবনাময় ঊষার উন্মেষ।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর বিপ্লবের পর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রতিবিপ্লবের সূচনা হয়, তার ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ কারান্তরীণ হন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৩ নভেম্বর শুধু জিয়াউর রহমান কারান্তরীণ হননি, শৃঙ্খলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব।

৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাক বদলের উপাখ্যান। কেননা ৩ নভেম্বর যেমন ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরনের দিন। তেমনি ৭ নভেম্বর ছিল শৃঙ্খল মুক্তির এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এই মহান দিনে আধুনিক ও জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের জনক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তির ভেতর দিয়ে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। আর এই মুক্তির নেপথ্য কারিগর ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের অন্তর্গত স্পৃহা ও বীর সেনানীদের এক অভূতপূর্ব মিথস্ক্রিয়া। যার দরুন ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেদীপ্যমান হয়ে আছে সিপাহি-জনতার বিপ্লব নামে।

সূচনাতেই বলেছি, ইতিহাস হলো এক পরম্পরা। সেই পরম্পরায় ৭ নভেম্বর যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমানের শুরু করে যাওয়া কর্মযজ্ঞের পরম্পরা হলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যদিও এই পরম্পরায় যতি চিহ্ন ছিলেন জেনারেল এরশাদ, সেমিকোলন ছিল পলাতক স্বৈরাচারী হাসিনা। তবুও গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রবল সংঘবদ্ধ প্রয়াস ১৯৯১ সালে ম্যান্ডেট দেয় আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। বেগম খালেদা জিয়া দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যান ৭ নভেম্বরের স্পৃহার এক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ।

সময়ের প্রবহমানতায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ার প্রবাহ করেছে বাঁক বদল। বাংলাদেশের রাজনীতি ঘোর অমানিশায় আবর্তিত হয়েছে ১/১১-এর ভেতর দিয়ে। 

তবুও গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্খা নির্বাপিত হয়নি কখনো। কারান্তরীণ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তির মশাল তুলে দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি সেনা সন্তান তারেক রহমানের কাছে। একদা নির্যাতিত ও কারান্তরীণ পরবর্তীতে নির্বাসিত তারেক রহমান নিজেকে উৎসর্গ করেছেন জনগণ, দেশ ও গণতন্ত্রের মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছে স্বৈরাচারী হাসিনা। কিন্ত তারেক রহমানের যাত্রা চলমান। বন্ধুর পথে তিমির রাত্রিতে যে যাত্রা তিনি চলমান রেখেছেন, সেই যাত্রার কোন যতিচিহ্ন নেই। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার যে বিপ্লবী স্পৃহা ধারণ করেছিলেন তাঁর প্রয়াত পিতা, যা লালন করেছেন তাঁর বর্ষীয়ান মাতা, সেই অদম্য স্পৃহা লেলিহান অগ্নিশিখা হয়ে দেদীপ্যমান হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক বাংলাদেশে। যে বাংলা দুর্ভেদ্য, অজেয় ও অদৃষ্টপূর্ব।


  • ▪️ লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অবঃ); সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।


Thursday, October 17, 2024

তারেক রহমানের রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

 

গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিণত হয়েছেন দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেশ এখন তাঁর দিকেই তাকিয়ে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি যে ক্ষমতায় আসবে, তা সবাই বুঝতে পারছে। তারেক রহমান হবেন রাষ্ট্র নায়ক। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিএনপি এখন রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে রয়েছে। মানুষের মাথার উপর ছায়া হয়ে রয়েছে। আর এই ছায়ার উৎস হচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হতে পারে। তাঁর বক্তব্যগুলো নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে, কলাম লেখা হচ্ছে। মানুষ অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তাঁর প্রত্যেকটি কথায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির প্রচার স¤পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেছেন, তারেক রহমানের নির্দেশনায় ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ আমরা সবাই মানুষের পাশে থাকার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর মাধ্যমে বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তন এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে। তারেক রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বে, বিএনপি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিএনপির নেতাকর্মীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, মানুষকে অভয় দিচ্ছেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে যাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের মনের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপরেখা মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাচ্ছেন। বিএনপির যেকোনো কর্মসূচি শেষে এখন রাস্তাঘাট, সমাবেশের স্থল পরিষ্কার করা হয়। এই পরিবর্তনের কারিগর তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। এখন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেনেন, বিএনপির প্রত্যাশা রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। তারেক রহমানের উক্তিটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি ¯পষ্ট সংকল্প ব্যক্ত করে, যেখানে তিনি জনগণের প্রত্যাশা ও ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হচ্ছে, একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। এ কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম চলমান, তা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রয়াস নয়, বরং একটি জাতীয় দায়িত্ব। এই দৃঢ় অবস্থান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের জন্য তাঁর অঙ্গীকারকে প্রমাণ করে। তারেক রহমানের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, দলের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সততার জোরালো আহ্বান। তিনি ¯পষ্ট করেছেন, যদি কেউ বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থান দলের শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার প্রতীক। ইতিমধ্যেই বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মী শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে, বিএনপি শুধু রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়, বরং জনগণের আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে চায়। এই প্রক্রিয়ায়, তিনি একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং বৈষম্যহীন ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, যা আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও উদ্বেগজনক। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশনা সমগ্র জাতির জন্য একটি শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে উঠেছে। তিনি সবসময় বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে সাহস ও মানসিকতা বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন, যা সংগ্রামের এই সময়ে একান্ত প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর যে হামলা, মামলা এবং শারীরিক নির্যাতন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তারেক রহমানের সাহসিকতা নেতাকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন এবং তাঁর নেতৃত্বে দলটি কেবল রাজনৈতিক লড়াই নয়, বরং মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য একটি সংগ্রামী অবস্থান গ্রহণ করছে। সংকটময় সময়ে, তারেক রহমানের নেতৃত্ব জাতির জন্য আশার প্রদীপ হয়ে রয়েছে, যা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি বলেছেন, স্বৈরাচারের দোসররা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাঁর এই বক্তব্য বাস্তবসম্মত। কারণ, ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এ প্রেক্ষিতে, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি যে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে, তা সাধুবাদযোগ্য।

শুধু কথায় নয়, কাজেও তারেক রহমান প্রমাণ করেছেন, তিনি একজন প্রকৃত নেতা। তিনি যে পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরছেন, সেগুলো বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক। তার ফ্যামিলি কার্ডের ধারণা, রপ্তানিমুখী কৃষির উন্নয়ন এবং জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর। তারেক রহমান যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের বিরুদ্ধে করা কার্টুন শেয়ার করেন, তখন তিনি যে সমালোচনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন, তার নজির। একজন নেতা হিসাবে, তিনি নিজের প্রতি উঁচু মানসিকতা বজায় রাখছেন এবং সমালোচনাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই সহিষ্ণু মনোভাব বাংলাদেশের জনগণ ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করছে। জনগণ যখন দেখে, তাদের নেতা সমালোচনা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভয় পান না, তখন তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সংহতি সৃষ্টি হয়।

অনেকেই বলেন, একটি দেশ একবারই স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতা বেহাত হয়ে যাওয়ার পরে সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য গণবিপ্লবের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এসেছে, তা কি দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়? অবশ্যই দ্বিতীয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মানুষ এখন নতুন এক রাজনীতির স্বাদ পাচ্ছে। তারা ভোটাধিকার ফিরে পেতে চাচ্ছে। স্বৈরাচার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের একটিতেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়নি। মানুষ এখন ভোট দিতে চায়, সেই ভোটের মাধ্যমে মানুষ ক্ষমতায় আনবে তাদের সরকার, যারা দেশের মানুষের কথা বলবে। তাদের এই আশার প্রতীক তারেক রহমান। মানুষ যেমন আশা করে, সে হয়তো পুরোপুরি জানে না। কিন্তু মানুষ যা চায়, তা তারেক রহমান জানেন। তিনি কতদূর ভেবেছেন, তা হয়ত আমরা ভাবতে পারছি না। তিনি শুধু তাঁর দলের নেতাকর্মীকে বলেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন নতুন উদ্দীপনা। সারাদেশে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়ে মানুষের আস্থা ধরে রেখেছেন। তিনি যে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলছেন, সেই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরছেন।


আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সফল্য আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই সরকার ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হবে বাংলাদেশ, এটা অনুভব করেছেন তারেক রহমান। এই সরকার ব্যর্থ হলে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান ঘটবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তারেক রহমান বলেছেন, ধর্ম যার যার নিরাপত্তা পাবার অধিকার সবার। স্বাধীন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর এই চিন্তা সার্বজনীন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকার মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা কাজ করছেন। এমনভাবে তিনি কাজগুলো করেছেন, যা দলের অনেক নেতাকর্মীও জানে না।

তারেক রহমানের রাষ্ট্রচিন্তা অতুলনীয়। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, জাতীয় সরকার গঠন, এক ব্যক্তির দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া আমাদের দেশের জন্য নতুন ভাবনা। এই ভাবনা নিয়ে তিনি নিরন্তর কাজ করছেন। মানুষের কাছে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার চিন্তা তিনিই করছেন। তিনি একটি বিখ্যাত শ্লোগান দিয়েছিলেন, ‘টেইক ব্যাক বাংলাদেশ’, যা জনগণকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কবল থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। ফলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠছেন তিনি, যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং সমৃদ্ধির পথ সুরক্ষিত থাকবে।


লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা





১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান কর্তৃক জাতির সামনে উপস্থাপিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা —

১. জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন।

২. সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্রসত্ত্বা (Rainbow-Nation) ও 'জাতীয় সমন্বয় কমিশন ('National Reconciliation commission') গঠন।

৩. অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন।

8. আইনসভা, মন্ত্রীসভা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা।

৫.  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা অনুর্ধ্ব পরপর দুই মেয়াদ নির্ধারন।

৬. বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন।

৭. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন।

৮. নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধন।

৯. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরনে সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করন।

১০. বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন ও সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন।

১১. গণমুখী ও জনকল্যাণমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন।

১২. মিডিয়া কমিশন গঠন করে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।

১৩. দূর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ।

১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।

১৫. আত্মত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন।

১৬. ধর্মীয় স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ও কার্যকর নিশ্চয়তা প্রদান।

১৭. মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির আলোকে শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত করা।

১৮. প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং নবায়নযোগ্য ও মিশ্র জ্বালানী ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ খাত আধুনিকায়ন।

১৯. জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন।

২০. প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধিকতর আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা।

২১. প্রশাসন ও সেবা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলি স্বশাসিত ও ক্ষমতাবান করা।

২২. শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান। 

২৩. কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বেকার ভাতা প্রবর্তন।

২৪. নারীর মর্যাদা সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।

২৫. চাহিদা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।

২৬. "সবার জন্য স্বাস্থ্য" এবং "সার্বজনীন চিকিৎসা"ব্যবস্থা

কার্যকর করা। প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ পল্লী স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা করা এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত করা।

২৭. কৃষকের উৎপাদন ও বিপণন সুরক্ষা দিয়ে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

২৮. সড়ক, রেল, নৌ পথের আধুনিকায়ন ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

২৯. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ এবং নদী শাসন ও খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩০. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তির উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৩১. যুগোপযোগী, পরিকল্পিত, পরিবেশ বান্ধব আবাসন এবং নগরায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। 

বিচার বিভাগে দুর্নীতির দানব - পরিত্রাণের পথ শহীদ জিয়ার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’

 


১৯৭৮ সালে অধ্যাদেশ বলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিচারপতি অপসারণে গঠন করেছিলেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’। দূরদর্শী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এ সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করতে সংবিধানের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে কৌশলে অচল করে রাখে। দেড় দশকের মাফিয়াতন্ত্রে বিচার বিভাগকে পদানত রাখতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অচল করে রাখে এই কাউন্সিল। এ জন্য বন্দুকটিও রাখে আদালতের ঘাড়েই। হাসিনার দলীয় আনুগত্য স্বীকার করা বিচারাঙ্গনকে দুর্নীতির দানবে পরিণত হয়। সেই দানবকে বশে রাখার কোনো হাতিয়ারই অবশিষ্ট রাখা হয়নি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ বিচার বিভাগ সংস্কারের অনিবার্যতায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রণীত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’।


এ কাউন্সিল পুনঃজীবীতকরণের মধ্যেই বিশ্লেষকরা খুঁজছেন বিচার বিভাগকে দুর্নীতির রাহুমুক্তকরণের পথরেখা। জাতির এই সন্ধিক্ষণে তারা এখন বিচার বিভাগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানকে স্মরণ করছেন অকুণ্ঠভাবে। একইসঙ্গে ঘৃণাভরে স্মরণ করছে সদ্য উৎখাত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কথিত ‘বিচার-ব্যবস্থা’কে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে বাতিল করে দেয়া হয়। ২০১৭ সালে এ আদেশ দেন শেখ হাসিনার অনুগত তৎকালীন বিচারপতিগণ। এ রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্য আপিলও করেন শেখ হাসিনা। ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ মঞ্চস্থ করার জন্য হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগে। এতে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ‘নন-ফাংশানাল’ হয়ে পড়ে। পরে ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে সরকারপক্ষ। এতে গত ৭ বছর ধরে দেশে বিচারপতিদের অপসারণ করার মতো কোনো আইনি পদ্ধতিই বহাল নেই।


বিদ্যমান পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে গত ১৫ আগস্ট রিটকারী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আবেদন করেন। আদালতে তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে রয়েছে। এটির শুনানি হওয়া প্রয়োজন। পরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগীয় বেঞ্চ শুনানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০ অক্টোবর শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়।


এর আগে গতবছর ২৩ নভেম্বর বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ শুনানি ৬ জন বিচারপতি গ্রহণ করতে পারবেন সিদ্ধান্ত দেন তৎকালীন আপিল বিভাগ। তবে রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য একাধিকবার কার্যতালিকায় এলেও শুনানিতে আগ্রহ দেখায়নি শেখ হাসিনার সরকার।


২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়। সরকারপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চায়।


এর আগে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)র নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। ওই বছর ৮ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়। এতে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন দশ সিনিয়র আইনজীবী। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অন্যদের মধ্যে অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম. কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মতামত দেন।


এর আগে ২০১৬ সালের ৫মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ‘ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ’ বলে রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে এমপিগণ ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে এমপিদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে এমপিদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।


হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর ৫ নভেম্বর রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

১৯৭৫সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার। ১৯৭৮ সালে তিনি এক সামরিক ফরমানে গঠন করেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে এই ক্ষমতা দেন। তার সময়ই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়।


সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারে বহাল থাকে। ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে। এতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা চলে যায় জাতীয় সংসদের হাতে। ওই বছর ৫ নভেম্বর ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ১০ আইনজীবীর পক্ষে রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।


যে প্রক্রিয়ায় বিচারপতি অপসারণ করে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ : কি প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতিকে অপসারণ করে-জানতে চাইলে রিটকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, কানো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে প্রধান বিচারপতিকে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করতে বলবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে। শুনানি নেবে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে কমিশন। এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবেন যে, অভিযোগটি সঠিক কি না। পরে প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। সর্বশেষ ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার আমলে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে অভিশংসন করেছিলো। এসএম শাহিদুর রহমান সুপ্রিমকোর্ট বারের নেতৃত্বে ছিলেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে বারের তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালের এপ্রিলে তাকে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। তার নিয়োগের বিরোধিতা করেন সুপ্রিমকোর্ট বারের আওয়ামীলীগপন্থি আইনজীবীরা। তার নিয়োগের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে আ’লীগ। বিচার বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এ সময় সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তিনি এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ তখন এসএম শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে জামিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনেন। অভিযোগ তদন্তে গঠিত হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খন্দকার মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে কাউন্সিল অভিযোগ তদন্ত করে। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি কাউন্সিল প্রতিবেদন জমা দেয়। কাউন্সিলের সুপারিশ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তিনি রিট করেন। হাইকোর্ট তার অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে সৈয়দ জে.আর. মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পরবর্তীতে আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির প্যানেল ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি শাহিদুর রহমানের অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। এভাবেই ইতি ঘটে বিচারপতি এসএম শাহিদুর রহমানের ‘বিচারপতি’ পরিচয়।


স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতিসত্তা বিনির্মাণে শহীদ জিয়ার ঐতিহাসিক অবদান

প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান



শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রাম, গর্ব-অহঙ্কার আর স্বাধীকার আন্দোলনের মাস মার্চ। এই মাসেই সূচনা হয় আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের। যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের ৭ কোটি মানুষের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। পৃথিবীর বুকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি নতুন ভূখন্ড স্বীকৃতি পায় প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নামে।


স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানের বিষয়ে বিষদ আলোচনার আগে স্বল্প পরিসরে হলেও তার ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি করাচি একাডেমি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচিতে ডি. জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারী একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দু’বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন।


১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।


তিনি বলেন — This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, here by declared that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.


দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন।


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির মধ্যদিয়ে তিনি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপিঠে আসীন করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের উপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন।


একটি রাজনৈতিক সরকার যেখানে সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিল তখন জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে আসা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক স্বাধীনতার অন্যতম মূলস্তম্ভ বহুদলীয় গণতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়ে মুক্ত গনতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান এ কারণেই সবার থেকে আলাদা ছিলেন।


জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, সততা ও ন্যায় পরায়ণতা দিয়ে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিকালে অসামন্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে দেশ গঠনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃতজ্ঞজাতি আজও তার আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সততার মাপকাঠিতে তিনি আজও অনন্য ও অদ্বিতীয়। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েই দেশের চলমান অবনতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেন। শক্তহাতে চুরি, ডাকাতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসে।


স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ—অফ—স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশারফ এর নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে । তারপর গোটা জাতি আবার আতংকিত হয়ে পড়ে তৎ পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান কে বন্দি করলে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেইনি এবং জনগণ আবারো দুঃশাসনের আশঙ্কা করেন তাই সিপাহী এবং জনতা মিলে বন্দীদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে দেশের দায়িত্বভার তুলে দেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ—প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।


জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল অবস্থানের প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন “ I will make politics difficult for the politicians”.


১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ—সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।


লেখক:

প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান

মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব

দেশ-মাতৃকার কল্যাণে আজন্ম ছুটে চলা এক উত্তাল নদীর নাম বিএনপি

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান



একটি নতুন সময়, একটি নতুন দেশ, একটি নতুন প্রজন্মের সামনে বিএনপিকে নিয়ে যখন লিখছি তখন আমি নিজেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের কথা ও কর্মের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। তেমনই আমিও ফিরে এসেছি আমার পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নতুন করে। দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার এই আনন্দ সীমাহীন গৌরবের। যদিও আমার এই লড়াই-সংগ্রাম এদেশের কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘ দেড় দশকের নিপীড়ন-নিষ্পেষণের সামনে কোনোভাবেই উল্লেখযোগ্য নয়।


দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যে নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গেছে তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। গণমানুষের কণ্ঠস্বর বিএনপি এদেশের সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েছে। বছরের পর বছর অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছে এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী বুকের সবটুকু ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা দিয়ে আগলে রেখেছে প্রাণপ্রিয় দলকে। তাইতো দ্বিতীয় স্বাধীনতার এই সূচনা পর্বে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে নি:সন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাদ ভিন্ন রকমের।


৭৫ সালের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক শুন্যতা পূরণে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সেনা ছাউনিতে সৃষ্টি হয়েছিলো আজকের বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অথচ পৃথিবীর ইতিহাস বলে সেনা ছাউনি থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সময়ের শুন্যতা পূরণে সৃষ্টি হয় তেমনি শুন্যতা কেটে গেলে তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া গণমানুষের আস্থার ঠিকানা এই দলটি।


এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, ‘বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনা নায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে । এ ধরণের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই।’


১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সব সময়ই ছিলো বীরোচিত। যা তাকে তার পেশাগত পরিমন্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে থাকে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব প্রদান করেন।


মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।


১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সকল কিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।


১৯ দফা ছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিক-নির্দেশনাবলী। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো যে দিক সমাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সকল উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষতা মুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিলো তার সেই ১৯ দফায়।


বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।


শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবাহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে।


এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসাবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।"


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নি:শেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কূটকৌশল চলে। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপোসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ঢেউ এসে আঘাত হানে বিএনপিকে।


বিএনপিকে ধ্বংস ও নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায় দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে আটক রেখেছিল বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিলো এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটি হয়নি।

বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরো পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।


তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ঐ দু:সময়ে বহু দূর থেকে দলকে সংগঠিত করার কাজ করছেন অত্যন্ত মনোযোগ, ধীশক্তি ও দক্ষতা সহকারে। তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ সমাজকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারুণ্যের শক্তি যে অপরিহার্য- এই উপলব্ধিই তাকে চালিত করেছিল তরুণ সমাজকে সংগঠিত করতে। তৃণমূলে একটি রাজনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে সেই দলের জনপ্রিয়তা। তিনি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।


তারেক রহমান ৩১ দফার আদলে দলকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে। এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা আজ ডানা মেলেছে সেখানে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম, বিদেশী প্রভু শক্তির প্রতি যে উদ্ধত তর্জনী সে তো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরই ছড়িয়ে দেওয়া রাজনৈতিক দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাব।


প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গণমানুষের প্রিয় দল বিএনপির প্রতি অফুরন্ত শুভ কামনা।


লেখক: অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মহাসচিব ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) ও সদস্য মিডিয়া সেল, বিএনপি।

Monday, July 29, 2024

১৯৫২ থেকে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক



বর্ষীয়ান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী বদরুদ্দীন উমর রাজনীতি ও গবেষণায় সম্পৃক্ত রয়েছেন ৫৩ বছর ধরে। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে শতাধিক বই রয়েছে তার। দেশের চলমান ছাত্র আন্দোলন ও এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন 


চলমান ছাত্র আন্দোলন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।


উন্নয়নের কথা বলে অপকীর্তি ঠেকানো যায় না। মানুষের প্রতি জুলুমের বিষয়টিই শেষ পর্যন্ত সামনে এসেছে। বর্তমান আন্দোলনকে বুঝতে হলে অতীতে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানগুলো বুঝতে হবে। এ অঞ্চলে মোট পাঁচটি অভ্যুত্থান হয়েছে। শুরুর অভ্যুত্থানটি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। 


বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ও বৃহৎ গণ-অভ্যুত্থান আমরা দেখছি। এ গণ-অভ্যুত্থানের প্রকৃত চরিত্র, কারণ এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে— এটি বোঝার জন্য এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সেদিকে তাকাতে হবে। সেটি ছাড়া এ গণ-অভ্যুত্থানকে বোঝার উপায় নেই। এখানে একটি কথা বলা দরকার, অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ অঞ্চলে ১৯৫২ সালে আমরা প্রথম গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম। দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম ১৯৬৯ সালে। তৃতীয়টি ছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে। নব্বইয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে চতুর্থ গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম।


এই প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫২ সালের ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন সরাসরি হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের শুরুর দিকের এ সময়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো গঠিত হয়। দেখা যায়, বায়ান্নর আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকার পতন হয়। শুধু যে সরকারের পতন হয়েছিল তা-ই নয়; মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল তাতে সামরিক সরকার টিকে থাকলেও আইয়ুব খানের সরকার উচ্ছেদ হয়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৭১ সালে জানুয়ারি কিংবা এর আগেই ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে সরকার তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর সক্ষম ছিল না। তখন প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী সরাসরি রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর যুদ্ধ আরম্ভ হয়; সেই যুদ্ধের ফলে সরকার নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রই উচ্ছেদ হয়েছিল। এতই শক্তিশালী ছিল তখনকার অভ্যুত্থান এবং জনগণের আন্দোলন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এ আন্দোলন কিন্তু দেশব্যাপী বিশাল আন্দোলন ছিল না। সে সময় আমি লিখেছিলাম—এটি একটি নাগরিক অভ্যুত্থান। কারণ গ্রামাঞ্চলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন ছিল ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরকেন্দ্রিক। সেই নাগরিক বুর্জোয়ার অভ্যুত্থানের ফলে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দেখা গেছে, আগের চারটি অভ্যুত্থানের পরই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালের গণ-অভ্যুত্থান পরিণতি লাভ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রই উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। 


বর্তমানে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, এর ফলে চারদিকে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে এ সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এ গণ-অভ্যুত্থান যত ব্যাপক হয়েছে এর আগে কোনো অভ্যুত্থান এত ব্যাপক কখনো হয়নি। ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে তো বটেই সমগ্র গ্রামাঞ্চলে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কোটা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে সরকার ছাত্রদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করেছে এতে এ আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ যে যার পক্ষ থেকে এ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। এ কথা বলা দরকার, ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে তা আর কোটার আন্দোলন হিসেবে দেখলেই চলবে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রলীগ যে তাণ্ডব, নির্যাতন এবং নানাভাবে জুলুম চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভ ছিল। এ ক্ষোভের একটি ভূমিকাও ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে পড়েছে। এটিকে শুধু কোটা আন্দোলন, শুধু চাকরির আন্দোলন হিসেবেই দেখলে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া ছিল কোটা আন্দোলনে। সরকারি আক্রমণের কারণে এই কোটা আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একটি অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং ব্যাপকভাবে সারা দেশে অভ্যুত্থান হয়েছে। 


শুধু ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের কারণে জনগণ এ অভ্যুত্থানে নেমেছে এমন নয়। সারা দেশে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। সরকার জনগণের মতপ্রকাশের ওপর, বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। সংবাদপত্রগুলোয় সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যায় না। এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। তাদের ধারণা, এ সরকার যত দিন থাকবে তত দিন পর্যন্ত ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, দেশের টাকা পাচার, সরকারের প্রজেক্ট থেকে টাকা চুরি, এসব বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কাজেই অভ্যুত্থান এখন হয়েছে। 


এ অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এত দিনেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। এখন পর্যন্ত তারা কারফিউ দিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ ও সীমিত রাখার মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায়, তারা এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কোটা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের তারা নতুন করে ধরপাকড় করছে। তাদের জোরপূর্বক গ্রেফতার করে তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এর পরিণতি যে কি দাঁড়াবে! নতুনভাবে চারদিকে আন্দোলন শুরু হয় কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়। চারদিকে সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। এটা যে শুধু দেশেই হচ্ছে তা নয়। সারা দুনিয়ায়; শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বুদ্ধিজীবীরা, লেখকরা এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং এ হত্যাকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ঢাকায় ১৪টি দেশের কূটনৈতিক মিশন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বরাতে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু আসলে কত লোক যে মারা গেছে তার কোনো হিসাব নেই। হতে পারে শুধু হাসপাতালের তথ্য দিয়ে হিসাব করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের তো হাসপাতালে আনা হয়নি। কত লোক মারা গেছে তার হিসাব আসলে নেই। এই যে বেহিসেব হত্যাকাণ্ড, এর বিরুদ্ধে জনগণ চারদিকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ কথা বলা যায় না যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে আছে এতে নতুনভাবে আবার একটা আন্দোলন; আরেকটা ধাক্কা আসার সম্ভাবনা পুরোপুরিই রয়েছে। এ ধাক্কায় সরকারের অবস্থা কী হবে সেটি ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।

 



আপনি ঊনসত্তর সালের গণ-অভ্যুত্থান দেখেছেন। এর সঙ্গে এবারের আন্দোলনকে কীভাবে তুলনা করবেন?


ঊনসত্তর সালের আন্দোলনের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের সাদৃশ্য রয়েছে। সেটি হলো, আইয়ুব খান ১০ বছর পাকিস্তান শাসন করেছিল। ১০ বছর পর ‘‌ডিকেড অব ডেভেলপমেন্ট’ বলে চারদিকে খুব উৎসব শুরু হয়েছিল। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে এবং এ সরকারের পরিবর্তন চেয়েছে। দেখা গেল, উন্নয়নের কথা বললেও আইয়ুব খানের আমলে যে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। উপরন্তু উন্নয়ন সত্ত্বেও শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ একটি পর্যায়ে এসেছিল। সেখানে উন্নয়নের কথা মানুষ চিন্তা করেনি, বরং তাদের ওপর কত নির্যাতন হয়েছে সেটি চিন্তা করেছে। কারণ আইয়ুব খানের উন্নয়ন জণগণের কাজে আসেনি। এ উন্নয়নের ফলে শাসক শ্রেণীর লোকজনই সুবিধা পেয়েছিল। বর্তমান সরকারও গলা ফাটিয়ে উন্নয়নের কথাই বলে যাচ্ছে। দেখা যাবে যে বড় বড় এ প্রকল্পে আইয়ুব খানের আমলে যা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। এ রকম বড় প্রকল্পগুলোয় আইয়ুব খানের আমলে সে রকমভাবে চুরি হয়নি। এখন বড় বড় প্রকল্প মানে বড় বড় চুরি। লাখ লাখ কোটি টাকা এসব প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে। এর থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন, সরকারি আমলা ও সুবিধাভোগী লোকজন হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এভাবে লুটপাট করে তারা যে অবস্থা তৈরি করেছে দেশে তাতে উন্নয়নের ফল জনগণের কাছে পৌঁছেনি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে মানুষের আয়-মজুরি সেভাবে বাড়েনি। কাজেই তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মানুষ আগে যে তিনবেলা খেত, তারা এখন দুই বেলা-এক বেলা খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে। মাছ-মাংস যেভাবে খেত সেভাবে এখন আর পারছে না। খাবার জিনিসও কমে গেছে। 


একের পর এক সরকারি কর্তাব্যক্তির হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির রিপোর্টের প্রভাবও জনগণের মধ্যে পড়েছে। বড় বড় অবকাঠামো সাধারণ মানুষের কতটুকু উপকারে এসেছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্যে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে দেশের মানুষ পিছিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুব খান যেমন উন্নয়নের কথা বলে পার পায়নি; বর্তমান এ সরকারও উন্নয়নের কথা বলে পার পাবে বলে মনে হয় না।  


সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?


আওয়ামী লীগ এখন বেকায়দায় পড়ে দোষ কার ঘাড়ে চাপাবে এটি ভেবে অস্থির আছে। এক্ষেত্রে তো তারা বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কিছু দেখে না। তারা বাংলাদেশের জনগণকে দেখে না। জনগণ যে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এ চিন্তা তাদের নেই। এ চিন্তা করার ক্ষমতাও তাদের নেই। কিন্তু এ কথা বলে পার পাওয়ার উপায় তাদের নেই। এজন্যই তারা বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছে। এটি ঠিক যে বিএনপি-জামায়াত এ আন্দোলনে কিছুটা অংশগ্রহণ করেছে। এতে দোষের কিছু নেই। এমন একটি অভ্যুত্থান-আন্দোলন হলে জামায়াত বা বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে? আমরা মনে করি, এ দল দুটির যতটা অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল ততটা অংশগ্রহণ তারা মোটেই করেনি। নিজেদের দেউলিয়াপনার কারণে বিএনপি ও জামায়াত সেভাবে নামেনি। নামা দরকার ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সেই ক্ষমতা নেই। এখন আওয়ামী লীগ যে তাদের দোষারোপ করছে, এতে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো বিএনপি-জামায়াতেরই লাভ হচ্ছে। যে কাজ তারা করেনি সেই কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জামায়াত ও বিএনপিকে তারা গৌরবান্বিতই করছে। এর ফলে তাদের শক্তিই বাড়াচ্ছে। এটি আওয়ামী লীগের চরম মূর্খতা ও দেউলিয়াপনার কারণ। ওবায়দুল কাদের তাদের আওয়ামী লীগ নেতাদের রাস্তায় নামার যে ডাক দিয়েছিলেন সেটি অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা তার ডাকে সাড়া দেননি। কেউই রাস্তায় নামেননি। এ কথা তিনিই বিবৃতি দিয়ে বলেছেন। এদিকে অংশগ্রহণ করেনি বলে ঢাকার কিছু কিছু ওয়ার্ডের কমিটি বাদ করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের লোকজন নিজেরাই দলের পক্ষে দাঁড়ায়নি। সরকারের পক্ষে আছে শুধু পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আর্মি। 


আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় না নামার পেছনে কারণ কী হতে পারে?


তারা নামেনি এজন্য যে ওপরের সারির নেতারা অবস্থা না বুঝলেও নিচের সারির কর্মীরা অবস্থা বুঝতে পারছেন। সাধারণ কর্মী ও নিচের স্তরের কর্মীরা আওয়ামী লীগের দুর্বলতা কোথায় তা ধরতে পারছেন। সেজন্য আওয়ামী লীগ নেতারা যে নীতি অনুসরণ করছেন এটিতে যাওয়ার তাদের কোনো উৎসাহ নেই। তারা দেখছেন যে এটি করলে জনগণ তাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। সব জায়গায় তারা মার খাওয়ার ভয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতে তাদের কী হবে বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে সাধারণ কর্মীরা ভয় করছেন তাদের ওপর বিপদ নেমে আসবে। 


চলমান আন্দোলন নিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?


দেখা যাচ্ছে যে এ আন্দোলনে ভারত একেবারে চুপচাপ আছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ আন্দোলনে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু ভারত সরকার একেবারে চুপ করে আছে। তার কারণ বর্তমান ক্ষমতাশীল দল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তবে পশ্চিমারা নানাভাবে সমালোচনা করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এমনকি ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও সে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করেছেন।


বণিক বার্তা/ সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর

জুলাই ২৯, ২০২৪। 

Tuesday, July 2, 2024

রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, কেরানিও শতকোটি টাকার মালিক!



স্বাস্থ্যখাত

রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। এখন চারদিকে শুধুই দুর্নীতির খবর। কোটি টাকা না, শত কোটি, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন তারা তা নিয়ে খুব বেশি অনুসন্ধানের কথা শোনা যায় না। আগে যেখানে এক কোটি টাকার কথা শুনলেও অনেকে চমকে উঠছেন, এখন সেখানে হাজার কোটি টাকার খবরেও কেউ অনুসন্ধান করছে না। সর্বশেষ নজরে এলো হোমিও প্যাথি ডাক্তার ডা. দিলিপ রায়ের দুর্নীতির খবর। কিভাবে তিনি এত টাকার মালিক হলেন সেটার অনুসন্ধান জরুরী। 


সাবেক এক মন্ত্রীর প্রশ্রয়ে স্বাস্থ্যখাতে ঠিকাদার মিঠুর উত্থান হয়েছে। দেশের বাইরে তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি এবং অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নিউজ করতে গিয়ে হুমকিতে পড়তে হয়েছে সাংবাদিকদেরও। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীরও অনেক কর্মকর্তা তাকে প্রটেকশন দিয়েছেন। এরপর এলো ড্রাইভার মালেকের শত শত কোটি টাকার সম্পদের কথা। সাবেক একজন মহাপরিচালকের ড্রাইভার হিসেবে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটাসহ সব সেক্টরেই তার হাত ছিল। একজন ড্রাইভার কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন। এর পর এলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (পরিচালক) এডুকেশনে বিভাগে কেরানি আফজালের কাহিনী। কানাডায় তার বাড়ি আছে। কেরানি কিভাবে এত বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হলেন সেটাও এখনো অজানা। 


দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘এসব দুর্নীতিবাজদের মূল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান হল সচিবালয়। সচিবালয় থেকে এগুলো বন্ধ করা না গেলে এদের কখনই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’ ঠিক তাই হচ্ছে। স্বাস্থ্যের মতো সব জায়গায় দুর্নীতির বিশাল নেটওয়ার্ক। সবাই মিলেই গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। যে দুর্নীতির ভাগ পায় সবাই। ফলে এখন মন্ত্রণালয়ও কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। গত নির্বাচনের আগে আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুই শতাধিক ব্যক্তির দুর্নীতির তালিকা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে তারা এখন আরও বেশি বেপরোয়া। 


দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার জহিরুল হক বলেন, ‘আমরা নিজেরাও অনুসন্ধান করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি কারোর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় খবর এলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। কাউকে ছাড় দেবো না।’


অথচ স্বাস্থ্য খাতে যাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া কথা সেই চিকিৎসকরাই বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন হাসপাতালে অনেক শিক্ষকের পদ শূন্য। ছাত্ররা সুশিক্ষা থেকে বঞ্জিত হচ্ছে। শিক্ষকদের পদোন্নতি হচ্ছে না। মেধাবীরাও আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। একজন চিকিৎসকের চাকরি নেওয়ার পর অধ্যাপক হতে আর চাকরির বয়স থাকে না। দলবাজ না হলে পদোন্নতিও হয় না। পুরো স্বাস্থ্য খাতে যেন অশনি সংকেত। চিকিৎসকরাও কাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন। জুনিয়রদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন অনেকে। ফলে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে দুর্নীতি দেখার কেউ নেই। সুযোগ সুবিধা না পেলে কেন তারা এই পেশায় থাকবেন? ফলে সামনের দিনে চিকিৎসা সেক্টরে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে।


বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, ‘আসলে দুর্নীতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে। যারা দুর্নীতি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। অনেক বড় কর্মকর্তাও এর সঙ্গেও জড়িত। সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে না আনা গেলে বা পেছনে যারা আছে তাদের খুঁজে বের করে জবাবদিহিতায় আনতে না পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।’  


সর্বশেষ দুর্নীতির তথ্য সামনে এসে ডা. দিলীপ কুমার রায়ের। পনের বছরের ব্যবধানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায়। রাজনীতির জাদুর ছোঁয়ায় তিনি হোমিও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক থেকে হয়েছেন বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথী বোর্ডের চেয়ারম্যানও। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত দিলীপ কুমার রায় টানা পাঁচ মেয়াদে ১৫ বছর ধরে হোমিও বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখেও গড়েছেন রেকর্ড।


বোর্ডে দুর্নীতি হালাল করতে নীতিকে পাল্টে অনিয়মকেও তার ব্যক্তিগত নিয়মে পরিণত করেছেন। চা-পোষা হোমিও চিকিৎসক সেই দিলীপ কুমার এখন রাজনীতিতে বড় নেতা, স্বর্ণ, ডায়মন্ড, ইটভাটা, খাদ্য ও ওষুধের এক্সেসরিজের ব্যবসায়ীও। ফরিদপুরের বোয়ালমারী এলাকার ধোপা পরিবারের সন্তান দিলীপ কুমার এখন প্রতিষ্ঠিত এক স্বর্ণ ও হিরা ব্যবসায়ীর নাম। কারখানা গড়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন খাদ্য, ওষুধ ও ওষুধের এক্সেসরিজ খাতেও। অথচ ৮০-এর দশকে হোমিওপ্যাথী মেডিকেল কলেজে ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। পাশাপাশি হাঁটতেন রাজনৈতিক এক নেতার অনুসারী হয়ে। এরপর দিলীপ কুমারের উত্থান যত না আকাশচুম্বী ততই রহস্যে ঘেরা।


অথচ ২০১৫ সালের ৩০ জুন ডা. দিলীপ কুমার রায়কে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধান করেন দুদকের উপ-পরিচালক এসএম মফিদুল ইসলাম। তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দিলীপ কুমার রায়কে অব্যাহতি দেয় কমিশন।


ইত্তেফাক/ জুন ১০, ২০২৪

Monday, July 1, 2024

তিস্তা মহাপরিকল্পনার ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং করণীয়

মো:নিজাম উদ্দিন 



এক.
তিস্তার ভিক্টিম কারা?
উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলার দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকার সাথে গভীর ভাবে যুক্ত তিস্তা নদী।হিমালয় থেকে সিকিম এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে ডুকেছে।তিস্তার পানি যেন উত্তরাঞ্চলের প্রাণ। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী তিস্তার উজানে ভারতের গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মার্ণ করে পানি আটকে দেয়!ফলে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ হারায় তিস্তা!সেচ মৌসুমে তিস্তায় পানির অভাবে কৃত্রিম মরু করণ চলে আর বর্ষায় অস্বাভাবিক বন্যা, সময়ে অসময়ে বন্যাই এখন তিস্তা পাড়ের মানুষের নিয়তি। তিস্তার স্বাভাবিক যে পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। ফলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনের এক অভিশাপ এখন তিস্তা। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা ।যার জন্য একমাত্র দায়ী আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। 

২০১১ সালে মনমোহন সিংহ সরকার বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির কাছাকাছি চলে গেলেও সেই চুক্তিটি আজও হয়নি।বলা হয় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাধার কথা!এক যুগ পেড়িয়ে গেছে।যা দেওয়ার সব দেওয়াও হয়েছে শুধু বাংলাদেশ তার তিস্তার পানির ন্যা্য্য হিস্যা পায়নি!পাচ্ছে না।ফলে তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষ পানি সংকটের ভিক্টিম।

দুই.
তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী?
প্রতিবেশীর সাথে পানিবণ্টন চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়।যার নাম তিস্তা মহাপরিকল্পনা।অর্থাৎ ভারতের সাথে বাংলাদেশের তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি হলে কিন্তু এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা করার প্রয়োজনই পড়তো না। এই তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে কেন্দ্র করেই এখন ভা র ত, চীন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তুলপাড় চলছে!খুব সহজ করে বললে তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প । তিস্তা নদীর খনন, নদী শাসন,গভীরতা বাড়ানো,প্রস্থ কমানো,নৌ বন্দর নির্মাণ,তিস্তাকে কেন্দ্র করে উজানে সেচ মৌসুমে পানির জন্য বৃহৎ জলাধার নির্মাণ এবং নদীর দুই পাড়ে সেটেলাইট সিটি নির্মাণ।তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রায় ১৭১ বর্গ কিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব এবং নদীর গভীরতা বাড়বে পাঁচ থেকে দশ মিটার পর্যন্ত।  তিস্তা মহাপরিকল্পনা যা চীন করতে যাচ্ছে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে রংপুর বিভাগের তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। কিন্তু প্রকল্পটি নিয়ে এখন ব্যাপক রাজনীতি হচ্ছে। জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির খুব মুখ রোচক গল্প হয়েছে এখন এই তিস্তা। গল্প এখানেই থেমে নেই। চলুন, আরেকটু আগাই!

তিন.
তিস্তায় ভারতের রাজনীতিটা কী?
২০২২ সালে চীনা রাষ্ট্রদূত তিস্তা মহাপরিকল্পনাটি স্বশরীরে পরিদর্শন করতে গেলে ভারতও আড়মোড়া দিয়ে জাগে। চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে একটি পরিক্ষা নিরীক্ষা চালায় এবং একটি রিপোর্ট তৈরি করে। এখন ভারত বলছে এই প্রকল্পে তারাও সহযোগীতা করতে আগ্রহী।অথচ জীবিত তিস্তাকে মেরে ফেলার জন্য দায়ী তারাই।সংবাদ বেরুচ্ছে -China, India in tug of war over Teesta project in Bangladesh. অর্থাৎ তিস্তা নিয়ে চীন -ভারতের টানাটানি! চীন একশো কোটি ডলার ব্যয়ের এই মহাপরিকল্পনার প্রাথমিক সমীক্ষা করেছে। বাংলাদেশ চীনের কাছে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও সাহায্যেও চেয়েছে। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চীন বলেছিল দ্রুত কাজ শুরু হবে কিন্তু ভারতের বাঁধায় সব আটকে আছে। সরকারও ভা র তকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে না।কারণ ক্ষমতার রাজনীতি! কারণ এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি!পানি এখন ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে! বিশেষজ্ঞরা বলছেন -তিস্তার সমাধান না হলে বাংলাদেশ যেন ভারতের সাথে ট্রানজিটের বিষয়টি পুনঃ বিবেচনা করে! 

ভারত কেন চীনের তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিরোধিতা করছে? এর তুমুল বিশ্লেষণ হচ্ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা চীনের এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নীতি।এই প্রকল্পে চীনের আগ্রহের কারণ তাদের মেগা প্রজেক্ট বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। যা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে যুক্ত করছে।বাংলাদেশ -চীন-ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত এই অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে চীন তাদের ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে যুক্ত করতে চায়।চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়।তিস্তা মহাপরিকল্পনা তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভকেই প্রমোট করে যা কোনো ভাবেই ভা র ত করতে দিতে চায়না। 

চার.
তিস্তায় চীনের রাজনীতিটা কী?
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের যুক্ত হওয়ার মানে হচ্ছে চীনের অবস্থান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত স্পর্শ কাতর জায়গা শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের খুব কাছাকাছি চলে আসা।শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স  রাজ্য গুলোর সাথে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভা র ত চায়না তার এমন একটি স্পর্শ কাতর জায়গার কাছাকাছি চলে আসুক চীন! তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন যুক্ত হওয়া মানে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির সাথে তার বন্ধন দৃঢ় হওয়া। তিস্তা মহাপরিকল্পনা যেহেতু ভারতের তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তি না করার ফলে হচ্ছে তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন যুক্ত থাকলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী চীনপন্থী কমিউনিটি গড়ে উঠতে পারে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা চীনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে ভা রত বিরোধিতা আরো চরম পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ভারত এই কাজটা হতে দিতে চায় না। ফলে সে নিজেই তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ায় প্রস্তাব নিয়ে আসছে।অর্থাৎ চীনের প্রস্তাব নিজের স্বার্থে ভা র ত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ,নাগরিক সমাজের এখন উচিত ভা র তের ভন্ডামির মুখোশটা খুলে দেওয়া, প্রশ্ন তোলা যে-ভাই তুমি আমার তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিটা আগে করে দাও,তিস্তা মহাপরিকল্পনা করতে হবে না! 

পাঁচ.
তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের করণীয়? 
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতের যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব হাস্যকর।বিষয়টা এমন- একটা নদীকে মেরে পুকুর বানিয়ে দেওয়ার মতো,কাউকে খুন করে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো!জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকলে আজ তিস্তা  মহাপরিকল্পনাকে চীন ভারতের সামনে একটা বড় বার্গেনিং টুল হিসাবে ব্যবহার করতে পারতো,দু দেশের কাছ থেকেই বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারতো।কিন্তু এইটা এখন সম্ভব কী?কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের যে যে রাজনীতি তাই ভূরাজনীতি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক ভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যাবে। কারণ এই মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়া চীন ভারত উভয়ের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
 
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই আগামী দিনের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা মাথায় রেখে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনকে যুক্ত করা উচিৎ। বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন টেকানোর এটা একটা অগ্রীম কৌশল হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কি তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে সে পথে হাঁটবে?

লেখক: মো:নিজাম উদ্দিন 
সহ-সভাপতি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ