আলফাজ আনাম
ক্ষমতাসীনেরা জানেন, অধিকার হরণের রাজনীতির বিপরীতে একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন তাদেরকে কী ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। এ কারণে নির্বাচনব্যবস্থাও তারা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে ফেলেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার নিজ থেকেই নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল একই পথে হেঁটেছে। আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকার একই ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে জার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের মানদণ্ড কি আমাদের জার্মানদের কাছ থেকে শিখতে হবে? হিটলারের দেশ থেকে? আমরা আসলে কার কাছ থেকে গণতন্ত্র শিখব তা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জার্মানদের কাছ থেকে আমরা গণতন্ত্র শিখব না মিসরের কাছ থেকে শিখব তা আলোচনার বিষয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের পর জার্মানির রাজনীতিতে নাজি পার্টি শুধু নিষিদ্ধ হয়নি, ইউরোপে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ও চর্চায় ছেদ পড়েনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও আমরা দুনিয়ার বহু দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী একদলীয় শাসনের রূপ দেখেছি; কিন্তু জার্মানি, জাপান বা ইতালিতে এমন অবস্থা দেখা যায়নি। ১৯৪৯ সালের পর থেকে জার্মানিতে গণতন্ত্রের বিকাশ, নাগরিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। বেশি উন্নয়ন কিংবা কম গণতন্ত্রের প্রয়োজন সেখানে হয়নি। আবার বিরোধী দলবিহীন ভোটের চিত্র ছিল না। হিটলারের দেশ হয়েও সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে ও হচ্ছে। হিটলারের মতো শাসকের আর আবির্ভাব ঘটেনি। নতুন কোনো হিটলার জার্মানি শাসন করবে, জার্মানরা অন্তত তা কল্পনাও করে না।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জার্মানির গবেষণা প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেছেন। নির্বাচনের আগে ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, এমন প্রশ্ন তুলেছেন। জার্মানির এ প্রতিষ্ঠানটি মূলত ৯টি বিষয়কে সামনে রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমীক্ষার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সরকার ও স্বৈরশাসনের একটি সূচক নির্ধারণ করেছে। এই বিষয়গুলো ছিল রাষ্ট্র পরিচালনাব্যবস্থা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়িত্ব, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, ক্ষমতার একক ব্যবহার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকার। প্রতিষ্ঠানটির সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ১২৯টি দেশের মধ্যে ৫৮টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালে তাদের আগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ৭৪টি দেশে গণতান্ত্রিক এবং ৫৫টি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে।
১২৯টি দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে যে সূচক এই সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে। একই অবস্থানে আছে রাশিয়া। দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বেশ মিল আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে রাশিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধী প্রার্থী অ্যালেক্সি নাভালনিকে নির্বাচনের বাইরে রেখেই আরো এক মেয়াদের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। নির্বাচনের ফলাফলেও ছিল না অবাক করার মতো কোনো কিছু। ধারণা মতোই পুতিন জিতেছেন বড় ব্যবধানে। রাশিয়ায় যে পুতিনের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে, সেটি অনেকটাই নিশ্চিত।
১৯৯৯ সালের আগস্টে তিনি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। চার মাস পর ডিসেম্বরে ইয়েলৎসিনের পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে রাশিয়া ফেডারেশনে যে পুতিন যুগের সূচনা হয়, তা চলছে এখনো। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট পদে থেকেই ২০০০ সালের নির্বাচনে জেতেন। পুনর্নির্বাচিত হন ২০০৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে। রাশিয়ার সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া যায় না। তাই নিজে প্রার্থী হতে না পারায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে পুতিন তার পছন্দের রাজনীতিক দিমিত্র মেদভেদেভকে প্রার্থী করেন। মেদভেদেভের সরকারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন নিজে। মূলত এ সময়টিতেও পুতিনই রাশিয়াকে শাসন করেছেন বলে মনে করা হয়।
২০১২ সালের নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়। আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন পুতিন। ২০১৭ সালে শেষ হয় তার তৃতীয় মেয়াদ। এবারের নির্বাচনে জিতে শুরু হতে যাচ্ছে চতুর্থ মেয়াদের পুতিন যুগ, যা চলবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। বর্তমান নিয়মে ২০২৪ সালের নির্বাচনে (পরপর তিনবার) প্রার্থী হতে পারবেন না পুতিন। তবে রাশিয়ার রাজনীতিতে তার যে অবস্থান, তাতে এই মেয়াদের মধ্যেই সংবিধান থেকে মেয়াদের এই সীমাবদ্ধতাসংক্রান্ত ধারাটি তুলে দিলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। পুতিনের ক্ষমতা স্থায়ী করতে রাশিয়ার সংবিধান পরিবর্তিত হতে পারে অথবা সংবিধান ঠিক রেখে অন্য কোনো বিকল্প কৌশলে তার শাসন দীর্ঘায়িত করার ব্যবস্থা হতে পারে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে ক্রমেই নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন সাবেক এই কেজিবি এজেন্ট। সেই সাথে ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগও আছে। সমালোচকেরা বলছেন, দেশটিতে মুক্ত গণতন্ত্র শুধু নয়, পুতিন যুগ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্নভাবে বিরোধীদের রাজনীতির মূল অঙ্গন থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। যার বড় উদাহরণ অ্যালেক্সি নাভালনি। রাশিয়ায় পুতিনবিরোধীদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা নাভালনি। দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানদণ্ডে বাংলাদেশ কেন রাশিয়ার সাথে অবস্থান করছে। আমরা যদি জার্মানির প্রতিষ্ঠানটির মানদণ্ডের বিষয়গুলো দেখি, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা রাশিয়া থেকে খুব ভিন্ন কিছু নয়। জার্মানি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যেসব দেশের ওপর সমীক্ষা চালায়, সেসব দেশের মধ্যে পাঁচটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডা। এ পাঁচটি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই গণতন্ত্রকে ক্ষুণœ করা হচ্ছিল। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় এই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ১০ বছর আগে ২০০৮ সালে। যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা বিজয়ী হয় তা নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকারের সাথে ক্ষমতাসীনদের বোঝাপড়ার বিষয়টি গোপন কোনো বিষয় নয়; যেখানে প্রতিবেশী দেশের বিশেষ ভূমিকা ছিল। দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার নিজের লেখা বইয়ে এর বিবরণ তুলে ধরেছেন। এই নির্বাচনের পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক। যেখানে ১৫৩ জন সংসদ সদস্যকে কোনো ভোটে অংশ নিতে হয়নি। এ নির্বাচনের সাথে কেবল মিসরের সামরিক স্বৈরাচার আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির নির্বাচনের তুলনা করা যেতে পারে। পুতিনের টার্গেট যেখানে ২০১৪ সাল, সেখানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের টার্গেট কিন্তু ২০৪১ সাল পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার চাবিকাঠির রহস্য কেবল পুতিন বলতে পারেন। আর তার কৌশলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা কিংবা আইনের শাসন কোন অবস্থায় আছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে প্রমাণ হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়ে প্রেস ক্লাবের আঙিনা কিংবা পল্টনের পার্টি অফিসের সামনেও স্থান হচ্ছে না। দেশের প্রধান বিরোধী দল সভা-সমাবেশের জন্য বারবার অনুনয় করে অনুমতি পাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের পালিত বিরোধী দল সাড়ম্বরে সভা-সমাবেশ করছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সামরিক স্বৈরাচার হিসেবে জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও আন্দোলন করেছিল। এই এরশাদ দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে উচ্ছেদ করে ২৪ এপ্রিল ১৯৮২-তে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরশাদের জন্য হয়তো সুখের বিষয় তিনি যখন ঢাকায় সমাবেশ করছেন, তখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা দুই নেত্রীর একজনকে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্বৈরশাসক হিসেবে তুলে ধরেছে। এরশাদের জন্য এর চেয়ে আনন্দের কী হতে পারে?
আজকে ক্ষমতাসীন দলের দেউলিয়াত্ব কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, একদিকে হিটলারের দেশ বলে জার্মানির সমালোচনা করা হচ্ছে; এর দুই দিন পর জার্মান রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনীতিকেরা সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে আইনমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন। সেখানে তারা দাবি করেছেন, এ আইনের অন্তত তিনটি ধারা জনগণের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াও বাংলাদেশে বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা আইনের শাসন কোন পর্যায়ে আছে, তা দেশের মানুষ যেমন জানে, তেমনি বিদেশীরাও জানে।
নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে যখন কোনো সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তখন টিকে থাকার জন্য যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেন। সেখানে রাজনৈতিক অধিকার, আইনের শাসন বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীনেরা জানেন, অধিকার হরণের রাজনীতির বিপরীতে একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন তাদেরকে কী ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। এ কারণে নির্বাচনব্যবস্থাও তারা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে ফেলেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার নিজ থেকেই নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল একই পথে হেঁটেছে। আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকার একই ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ দেশটি স্বাধীন করেছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। একটি নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়াকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। সে দেশের মানুষ এখন ভোটের অধিকার হারিয়ে ফেলছে। যে দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছাড়া জনপ্রতিনিধির নাম জানতে পারছে। আরো দুর্ভাগ্য, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সে দলটি, যে দলটি স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বৈরশাসনের এই তকমা ক্ষমতাসীনদের কারণে জাতি হিসেবে এ দেশের মানুষের জন্য লজ্জার।
- নয়াদিগন্ত/২৮ মার্চ ২০১৮