Search

Saturday, September 11, 2021

'বেগম খালেদা জিয়া', মানচিত্রে মিশে থাকা নাম — ড. মোর্শেদ হাসান খান


মাদার অব ডেমোক্রেসি 














দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায়ে তখন। চারিদিকে ধ্বংস আর ধ্বংসাবশেষ। প্রলয়ঙ্করী এমনই এক সময়ে ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদার দম্পতির কোলজুড়ে নতুন ভোরের দীপ্তি নিয়ে আগমন করেন খালেদা খানম পুতুল। সময়ের পরিক্রমায় বাবা-মায়ের আদরের সেই পুতুলই বর্তমান বংলাদেশের গণতন্ত্রের সমার্থক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই থেকে দিনাজপুরের এক অরাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে খালেদা খানমের বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের সঙ্গে যুগপৎ পথচলার শুরু। দিনে দিনে বাংলার আপামর জনতার আশা-আকাঙ্খার প্রতীক, সুখ-দুঃখের সারথি বনেছেন। মানুষ তাকে ভালবেসে দেশনেত্রী উপাধিতে ভূষিত করেছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করেন নি। তাই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আপসহীনতার প্রতীক। গণতন্ত্রের জন্য তার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম তাকে ভূষিত করেছে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ খেতাবে। তবে তার এই দেশনেত্রী বা মাদার অব ডেমোক্রেসি হয়ে উঠার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রথম লগ্ন থেকেই বেগম খালেদা জিয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথচলার শুরু। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে অভিভাবকহীন দিশেহারা জাতির জন্য যখন আলোকবর্তিকা হয়ে জিয়াউর রহমানের অভ্যুদয় ঘটলো তখন থেকেই বেগম জিয়ার সংগ্রামী জীবনের সূচনা। দেশমাতৃকার টানে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ‘I Revolt’ বলে বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পরিবার-পরিজন রেখে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তার দুই শিশুপুত্র নিয়ে সেই অনিশ্চিত ও ঘোরতর অমানিশার মাঝে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে সেখান থেকে বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের সাথে যোগাযোগ করে দুই সন্তানসহ লঞ্চযোগে ১৬ মে ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান। তবে তিনি বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারেন নি। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ের চেষ্টাকালে পাক বাহিনী তার সন্ধান পেয়ে যায় এবং দোসরা জুলাই এস কে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি সামরিক হেফাজতে বন্দিজীবন কাটান। 

পাক বাহিনীর দীর্ঘ জুলুম, নির্যাতন ও অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের পর জিয়া সামরিক শৃঙ্খলা মেনে ব্যারাকে ফিরে যান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে থাকেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের ঘটনাবহুল পরিক্রমার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া জনতার জিয়ায় পরিণত হন। ঐতিহাসিক সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়া শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনকালে বেগম খালেদা জিয়া সবসময়ই পাদপ্রদীপের পেছনে ছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করে একজন আপাদমস্তক গৃহবধূ হিসেবে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশে সফর করেছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও স্বামী জিয়ার দূরদর্শীতা, বিচক্ষণতা, নেতৃত্বদানের বলিষ্ঠতা বেগম জিয়ার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তাই তো ১৯৮১ সালের ৩০শে মে কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর বুলেটের আঘাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর তার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সফলতার সাথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলছেন বাংলার এই অবিসংবাদিত কিংবদন্তী। 

১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে কতিপয় বেপথু সেনাসদস্যের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদাতবরণ করলে তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি-তে আন্তঃকলহ প্রকট হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল সর্বজনে গ্রহণযোগ্য একজন নেতা, যিনি শহীদ জিয়ার দেখানো পথে তার প্রবর্তিত আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলকে পরিচালিত করতে পারবেন। নিভৃতচারী বেগম খালেদা জিয়াই ছিলেন সেই আইকনিক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিএনপি নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। সেই থেকে তার বিপ্লব ও সংগ্রামের সূচনা। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব আলন করেন। অতঃপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপি’র চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন এবং এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। 

১৯৮৩ সাল থেকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথে জনতার কাতারে নেমে এসে নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহ এরশাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। নব্বই দশকের সেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অনেকেই সমঝে চলার নীতি গ্রহণ করলেও বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কোন আপস করেন নি। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করলো। একাধিকবার তিনি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের রোষাণলে পড়েন। তাকে মোট চারবার- ১৯৮৩ সালের ২৮শে নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩রা মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর- আটক করা হয়। ১৯৮৭ সালে হোটেল পূর্বাণী থেকে আটক করে আরো কয়েকজন নেতাসহ তাকে মতিঝিল থানায় নেয়া হয়। তবে সে সময় পুলিশ তাকে জেলে পাঠায় নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু তিনি দমে যান নি। সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য তিনি সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বারবার দীপ্তি ছড়িয়েছেন। অতঃপর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ৯০ এর ছাত্রজনতার প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। জনগণের মুক্তির জন্য আপসহীন সংগ্রামী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের রায়ে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালের ১৯শে মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিএনপি আরো দুইবার বিজয়লাভ করে। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। 

গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রাম আজোবধি অব্যহত রয়েছে। স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের মতই আধিপত্যবাদি ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি বারবার তার উপর খড়গহস্ত হয়েছে। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়েও তাকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনীতি থেকে তাকে মাইনাস করে দেয়ার এক নীলনকশা প্রস্তুত করেছিল এক-এগারোর অবৈধ সরকার। নানারূপ হুমকি-ধমকি, প্রলোভন দেখিয়েও তাকে দেশছাড়া করা সম্ভব হয় নি। এদেশের মানুষের সাথেই তিনি নিজের ভাগ্যকে মিলিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে প্রবীণ অবস্থায় এসেও অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি থাকতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি হার মানেন নি; আধিপত্যবাদি শক্তির আগুনসদৃশ লালচোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গণতন্ত্রের, জাতীয় ঐক্যের, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। ২০১৭ সালে বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘এদেশের গতি প্রকৃতির সাথে আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে।’ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবরণের আগের দিন তিনি এক বার্তায় বলেন, ‘কম বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। দেশেরর জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় একটি সন্তান হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান দূরদেশে চিকিৎসাধীন। আমার স্বজনহীন জীবনে দেশবাসীই আমার স্বজন। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো দেশবাসীকে ছেড়ে যাবো না।’ প্রকৃত অর্থেই তিনি এ দেশের দেশপ্রেমিক আপামর জনতার আস্থা ও বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। ১৯৯১ সালে আধিপত্যবাদি শক্তির দোসরদের বিপরীতে সগর্বে মাথা উঁচু করে বেগম খালেদা জিয়া উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ওদের হাতে গোলামীর জিঞ্জির; আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা।’ এই ভয়ডরহীন আত্মমর্যাদাবোধই তাকে রাজনীতির উচ্চাসনে আসীন করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গেঁথে দেয়া বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে একটি সার্বভৌম মর্যাদাসম্পন্ন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গরার যে প্রত্যয় তার মাঝে রয়েছে, তা আর কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে মেলা ভার। ভুরি ভুরি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, গালগল্পের ভীড়ে বেগম জিয়ার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’- এই একটি বাক্যই দেশ ও জনগণের প্রতি তার প্রতিশ্রুতির বর্ণনা দিতে যথেষ্ঠ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি এই আহবান জানিয়েছিলেন, যা আজোও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। 

বিপ্লবী বেগম জিয়া বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের পাশে থাকার পুরস্কারস্বরূপ তিন তিনবার এদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই তাকে নির্বাচিত করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্চাসনে আসীন হয়েও তিনি জনগণের পাশেই ছিলেন। দেশ গড়ার লক্ষ্যে, ভাগ্যবিড়ম্বিত আপামর জনতার ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিজেকে ব্রত রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক ও রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনি বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে অমর করে রাখা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসমূহকে সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যে প্রভূত কাজ করেছেন। তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; দুই শিশুপুত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার রয়েছে প্রবল আবেগ। তিনি ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষা ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতীসৌধ নির্মাণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। ২০০১ সালে সরকার গঠন করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধন ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা গ্রহণে সরাসরি সরকারকে সম্পৃক্ত করার নিমিত্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা রেদোয়ান আহমদ এ মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে খুঁজে বের করে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পদক ‘বীর প্রতীক’ হস্তান্তর করা হয়। তিনি পাকিস্তানে অসম্মানিত অবস্থায় পড়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাববশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের ২৪শে জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করেন। অতঃপর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশের মাটিতে সমাহিত করা হয়। এর আগে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে খালেদা জিয়া এক জনসভায় ঘোষণা করেন, শিগগিরই মতিউরের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নামে খুলনায় একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তি সরকারের আমলে এসে সেটি পরিবর্তন করে দেয়া হয়! দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে এরকম আরো স্থাপনাসমূহের নামকরণ করেন। 

তিন দফায় সরকার গঠন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেগুলো এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ এসবের মধ্যে অন্যতম। খালেদা জিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনায় ৬০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করেন, যাতে বিরোধীদলীয় সাংসদদেরকে গুরুত্ব সহকারে অবস্থান দেয়া হয়। 

শিক্ষাখাতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন এবং মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা তার সরকারের অন্যতম অবদান। তার সরকারের আমলেই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন তার সরকারের আমলেই গৃহীত হয়। তিনি জিয়াউর রহমানের অর্থনীতির অনুসরণ করে প্রাইভেটাইজেশনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। ব্যক্তিগত আয়কর প্রদানের হার ৫৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসেন। ব্যবসায় সহজ করার লক্ষ্যে ২৭ ধরণের শুল্ক হ্রাস করে ৭ ধরণের আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা করেন। দেশের ভূ-ভাগের খনিজ সম্পদকে কাজে লাগাতে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা খনি ও মধ্যপাড়ার শ্বেত পাথরের খনি থেকে উত্তোলন কার্যক্রমের সূচনা তার সরকারের আমলেই করা হয়। এছাড়াও ভোলা, বঙ্গোপসাগর ও দিনাজপুরে তার শাসনকালে নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। 

বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে নারীদের আত্মনির্ভরশীল রূপে গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আত্ম-কর্মসংস্থান কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সহজ শর্তে ঋণসেবা সহায়তায় তিনি আনসার-ভিডিপি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাস্থ্যখাতে সমস্যা ও সংকট নিরসনে তার সরকারসমূহের কার্যক্রম সুবিদিত। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ থে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং জেলা কমপ্লেক্সকে ১০০ থেকে ২৫০ এবং ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের জন্য তার সরকার সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। 

বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন খাতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার সময়েই সেলুলার ফোন ও আইএসডি ফোনের সূচনা হয়; অন্তত তিন লক্ষ টেলিফোন সংযোগ চালু করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ৩৩০টি উপজেলাকে বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসে। উপকুলীয় এলাকাগুলোতে এক হাজারেরও বেশি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করেন। ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রবল গুরুত্ব দেয়। তার সরকারের আমলে এদেশে অসংখ্য মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও অন্যান্য উপাসনালয় নির্মাণে সরকারি তহবিল থেকে অনুদান প্রদান করা হয়। ঢাকার আশকোনায় হজ্ব যাত্রীদের সুবিধার্থে একটি স্থায়ী হাজী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও তাবলীগ জামাতের বৃহৎ সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে অতিরিক্ত ৩০০ একর জমির বন্দোবস্ত করে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। 

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় সংগ্রাম ও রাষ্ট্র গঠনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা এই মহিয়সী নারীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় যখন, তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৮৪ সালে তখন আমরা আমার সিভিল সার্জন বাবার কর্মস্থল পিরোজপুরে ছিলাম। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে তখন তিনি বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করছিলেন। এমনি এক সফরে তিনি পিরোজপুরে আসেন এবং সাবেক মন্ত্রী আফজাল সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন। আফজাল সাহেবের বাসার ঠিক বিপরীতে ছিল আমাদের বাসা। তিনি যখন বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন আমি তার সাদা করোলা গাড়িটির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি বললেন, ‘এই ছেলে, সরো।’ কথার স্বর না থামতেই তিনি মায়াবি কণ্ঠে বললেন, ‘কি নাম তোমার? কোন ক্লাসে পড়ো?’ আমি কোন ভয় না পেয়ে উত্তর দিলাম। এরপর তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সে-ই ছিল আমার প্রথম কথোপকথন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই জীবন্ত কিংবদন্তী মাদার অব ডেমোক্রেসি খ্যাত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন ৭৬ বছর বয়স্কা একজন নারী। কিন্তু বরাবরের মতই এই বয়সে এসেও তাকে নানারূপ জুলুম, অবিচারের শিকার হতে হচ্ছে। শাসকশ্রেণী আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঔজ্জ্বল্য রুখতে অসংখ্য চেষ্টা করেছে; এখনো করছে। কিন্তু যে নামের অর্থই ঔজ্জ্বল্য, তার আবির্ভাবকে কি চিরতরে রুদ্ধ করা যায়! যায় নি। তিনি বারবার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। যে ‘বাংলাদেশবাদ’ জিয়া এই জাতিকে দিয়ে গিয়েছেন, সেই দর্শনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে তিনি আগুয়ান হয়েছেন; জীবনের ঘোরতর সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় থেকেও জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। জাতিও তার উপরে আস্থা রেখেছে অদ্যাবধি। এ ধারা অব্যহত থাকবেই।

— লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহসম্পাদক, বিএনপি ও সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


অন্ধকারের সমাপ্তি বেগম জিয়ার হাতেই

— শওকত মাহমুদ 

‘কোনও ইতিহাস স্বত্বের ইতিহাস নহে, তাহা সত্যের ইতিহাস। যে মহান সত্য নানা আঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়া পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে’ —  রবীন্দ্রনাথ


এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন সত্যটি আঘাত-সংঘাতে পূর্ণ হয়ে উঠছে? ফ্যাসিবাদের চলমানতা, না গণতন্ত্রের পুনরুন্মেষ? জালিমের রোষাগ্নি, না মজলুমের উত্থান? কোনটা চলবে আর কোনটা ঘটবে? মনে হতে পারে, দেহে-মনে ফ্যাসিবাদ মেখে বসে আছে যে স্বৈরাচার, তার বুঝি অবসান নেই। বিধ্বস্ত গণতন্ত্রের ভাগাড়ে বাংলাদেশ যেন পচতেই থাকবে। এক নেতার এক কন্যার মালিকানার যে গড়াপেটা ইতিহাস, তা এমন এক দ্ব্যর্থ উপসংহারে একমত যে যত গর্জে তত বর্ষে না। বজ্রপাত সাময়িক। তা দেখে জনমত ঠাহর করা ভুল। প্রকৃত জনমত হচ্ছে ভোরের শিশিরের মতো, নীরবে-নিঃশব্দে প্রতি বর্গইঞ্চি মাটি ও তৃণমূলকে ছেয়ে ফেলে। সত্যের উপলব্ধি সেখানেই। ইতিহাসের চালচলন নিয়ত সত্যাভিমুখী। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা, ৭ নভেম্বরের জাতীয় বিপ্লবে সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উচ্চ নিনাদ, এক বলিষ্ঠ ও আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে শহীদ জিয়ার সুকীর্তির সম্ভার এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার তা বিকশিত করার সফল অভিযাত্রা—সর্বোপরি স্বৈরাচারবিরোধী আপসহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক নতুন বিএনপি নির্মাণ ইতিহাসেরই এক সোনালি অধ্যায়। এই সত্যকে উপড়ে ফেলার দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

ইতিহাসের নির্দেশ হচ্ছে, অন্যায়-অনিয়ম ও পরনিন্দা আর খুনাখুনির মধ্য দিয়ে জালিম সরকারের যে প্রলম্বিত অবৈধ শাসন, তার ইতি আসন্ন। দিন বদলাবেই এবং তা হবে ইতিহাসের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্র খালেদা জিয়ার হাত ধরেই। এই সত্যটাই সুবহে সাদিকের মতো দৃশ্যমান। কেন এবং কিভাবে? পতনের গল্পটা কোত্থেকে উঠবে? এর আখ্যান-ব্যাখ্যানই বা কী? মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে দণ্ড দেওয়া থেকে? নাকি সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন থেকে? ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ক্রান্তিলগ্নে এখন বাংলাদেশ। এর প্রতিটি জনপদই গণতন্ত্রের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায়, সভ্যতা ও আইনের শাসনের অসহনীয় তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে উঠেছে এবং সেই গণবিস্ফোরণ ঘটবে বেগম জিয়ার ঈমানি নেতৃত্বে এবং জিয়াসন্তান অসম্ভব জনপ্রিয় তরুণ নেতা আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের সেনাপতিত্বে। এই সত্যটাই আঘাতে-সংঘাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সহ্যের অতীত রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিপীড়নের কঠিন ঝঞ্ঝায় শুধু প্রত্যয়-নিষ্ঠার ওপর ভর করে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য, সভ্যতার এক নতুন জাগরণের জন্য বেগম জিয়া সর্বাত্মক বিজয় ছিনিয়ে আনবেনই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, একমাত্র বেগম জিয়ারই সক্ষমতা আছে এবং তা দুইবার করে ইতিপূর্বে তিনি দেখিয়েছেনও।

ইতিহাসের এই আলোকিত সত্যকে কে অস্বীকার করবেন যে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে বিরাজমান। সবচেয়ে বেশি আসনে নির্বাচিত হওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশবাসীর অকুণ্ঠ জনসমর্থন আর সুতীব্র সহানুভূতি তাঁকে ঘিরে আছেই। রাস্তায় নামলেই লাখো মানুষের ঢল। তরুণরা তাঁর গাড়ি ঘিরে রাখে লৌহবেষ্টনীর মতো। রাজনীতির শুরুই হয়েছে এরশাদের স্বৈরশাসনকে ‘মানি না’—এই বজ  উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ এবং স্বৈরাচারী এরশাদের অশুভ আঁতাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নৈরাজ্য-নীতিহীনতার ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। তা থেকে বাঁচানোর একমাত্র উজ্জ্বল বাতিঘর খালেদা জিয়া। বুকভরা সাহসে লড়াইটা জনগণের পক্ষে একাই করেন। নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখা থেকে আজ পর্যন্ত সেই সৎ, নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি তিনি ধরে রেখেছেন। কেউ বলতে পারবেন না, তিনি বাংলাদেশের কোনো অবৈধ শাসনকে ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’ অথবা ‘আমার আন্দোলনের ফসল’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এরশাদ এবং মঈনউদ্দীন-ফখরুদ্দীনের স্বৈরতন্ত্রকে বেগম জিয়া অনমনীয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদায় করেছেন। বর্তমান দুনিয়ায় এমন কোনো রাজনৈতিক নেতার কৃতিত্ব আছে দুটি সামরিক শাসন হটানোর? ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্রকে খুন করেছিল। বেগম জিয়া তা ফিরিয়ে আনলেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা অনিবার্য প্রধানমন্ত্রী—এমন ধারণায় ইতিহাসকে যখন সাব্যস্ত করা হচ্ছিল, অলক্ষ্যেই সেই শিশিরভেজা সত্যটি দৃশ্যমান হলো। নাহ! আন্দোলনের সাচ্চা নেত্রী বেগম জিয়াই প্রধানমন্ত্রী, তাঁর হাতে গড়া নতুন বিএনপিই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। বেগম জিয়ার গণতন্ত্রবোধ পরিমাপে একটি দৃষ্টান্ত অবশ্য উল্লেখ্য। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন হওয়ার বিধান ছিল ওয়ার্ড কমিশনারদের ভোটে। এতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জেতে। কিন্তু তিনি মেয়র পদকে জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার বিধান করলেন। আর সংবিধানের প্রতি আনুগত্য? তিন জোটের রূপরেখা অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার যুগপৎ আন্দোলন ছিল নব্বইয়ের দশকে একটি অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সংসদ থেকে আগেই পদত্যাগ করে ওই সব দল বেগম জিয়াকে এই বিপদে ফেলতে চেয়েছিল যে তিনি ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেন সংসদে এসংক্রান্ত বিল পাস করাতে না পারেন। তিনি যেন কোনো সংবিধানসম্মত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না পারেন। পর্দার অন্তরালে ওই অশুভ আঁতাত সামরিক অভ্যুত্থানের প্ররোচনাই দিচ্ছিল। এটা হতো বেগম জিয়ার সারা জীবনের জন্য কলঙ্ক। কিন্তু বেগম জিয়া শুধু সংবিধান সংশোধনের নিমিত্তে ১৯৯৬-তে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দিলেন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে এই চক্রান্ত নস্যাৎ করলেন। জেনারেল নাসিমের ক্যু হয়েও হতে পারল না। রাজনীতির নীতিনৈতিকতা খালেদা জিয়া জীবনজুড়ে মেনে চলেছেন। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যাননি। ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০১৪ তার উদাহরণ। এবারের লড়াই তাঁর চূড়ান্ত লড়াই। হাসিনা সরকারের অধীনে ভোট নয়। আজ প্রমাণ হয়েছে, ২০১৪-তে ভোটে না গিয়ে তিনি কত বড় প্রজ্ঞা ও নৈতিক ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়েছেন। গোটা বিশ্ব আজ একমত, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন মানে ৩০০ আসনে স্বদলীয় প্রার্থীর অর্ধেকের বেশি বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া।

শুধুই কি গণতন্ত্রের সংগ্রামের জন্য খালেদা জিয়া চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন? তাঁর দেশ পরিচালনাকালে আইনের শাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বত্র প্রশংসিত। ঢাকা থেকে সব মহাসড়ক দিয়ে বাইরে গেলে দুই পাশে আজ যে শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পস্থাপনার সম্ভার, তা তাঁর আমলেই। ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপকতার দরুন দশ গ্রাম মিলে সাপ্তাহিক হাটের বদলে প্রত্যেক গ্রামে আজ বাজার বসে, টাকা দিয়ে লেনদেন হয়। নারীরা ক্ষুদ্রঋণে স্বাবলম্বী—এটা তাঁর সাফল্য। খাদ্যে, মাছে স্বয়ম্ভরতা, নারীশিক্ষার বিপ্লব, রপ্তানির সমৃদ্ধি, সবচেয়ে বড় কথা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৭০ হাজার কোটি টাকার মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬.৭-এ পৌঁছার অবিশ্বাস্য কাহিনির নির্মাতা বেগম জিয়াই। আজকের স্বৈরাচারের মতো গণতন্ত্র হত্যা করে উন্নয়নের যজ্ঞে তিনি মাতেননি। এই উন্নয়ন হচ্ছে দুর্নীতিতাড়িত। খালেদা জিয়া গণতন্ত্র অর্থাৎ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন করেছেন। লোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায় যা হচ্ছে freedom oriented development বা অধিকারভিত্তিক সমৃদ্ধি।

প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী—যে পদেই থাকুন বা না থাকুন, বেগম জিয়া রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে সর্বদাই। তাঁর গণতান্ত্রিক ঔদার্যকে উপহাস করা হোক, তাঁকে নিয়ে গিবত, কটুকাটব্য যতই বর্ষিত হোক, তাঁকে ঘরছাড়া করা হোক বা বাড়ি ও অফিসে অন্তরিন রাখা হোক, তাঁর ওপর মরিচের গুঁড়া স্প্রে করা হোক, তাঁর গাড়িতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করুক, তাঁর পথের দুপাশে উদ্বেলিত জনতাকে পুলিশ পেটাতে থাকুক, বেগম জিয়া আছেন অবিচল। মামলার তারিখ যত দ্রুতই দেওয়া হোক, তিনি হাসিমুখে আদালতে যান, ঠায় বসে থাকেন। তাঁকে জনসভা করতে দেওয়া হয় না, সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করতে বাধা দেওয়া হয়। কেননা তাঁর কথায় মানুষ উদ্বোধিত হয়।

বিশেষ করে ২০০৭ থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর কেটেছে বাংলাদেশ ও তার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়। সাধারণ মানুষ, দলের নেতাকর্মীর জন্য তাঁর সহানুভূতি ফুরায় না। অপার তাঁর নিজস্ব মনোবেদনা। পারিবারিকভাবে নিঃসঙ্গ। এক-এগারোর সময় জেলে ছিলেন, মৃত্যুশয্যায় মাকে দেখতে পারেননি। দুই ছেলেকে জেলে নির্যাতন করা হচ্ছে। তারেক রহমানকে মেরে ফেলতে চাইছিল এক-এগারোর বর্বরকুল। কী বিভীষিকার দিনগুলো ছিল তখন! রাজনীতি থেকে বিয়োগ করার জন্য কী চাপ, বিদেশে জোর করে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু বেগম জিয়া বেগম জিয়াই। দেশ ছেড়ে, দেশের জনগণকে ছেড়ে তিনি বিদেশে গেলেনই না। তারেক রহমান মুক্তি পেয়ে যেদিন পিজি হাসপাতালে, কী অঝোর কান্নায় জড়িয়ে ধরে ছিলেন সন্তানকে! মানুষ দেশনেত্রীর সেই কান্নায় কেঁদেছিল। আজ তারেক রহমান মিথ্যা মামলায় মামলায় দুর্বিষহ অবস্থায় বিদেশে। দুর্নীতির খলনায়ক বানানোর হাজারো অপচেষ্টা বিফলে গেছে। তিনি দেশে আসতে পারেন না। আরাফাত রহমান কোকো ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু লাশ হয়ে। সরকারের নির্যাতনে কষ্টে কষ্টে ওই প্রাণবন্ত তরুণটি মরে গেল। জানাজার নামাজে লাখ লাখ মুসল্লি অশ্রুভেজা চোখে তাতে অংশ নিল। ২০০৮-এর নির্বাচনের সময় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের একাংশে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘মানুষ হিসেবে আমি ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলাম না। ব্যর্থতার গ্লানিও আমাকে অনেক সময় স্পর্শ করেছে; কিন্তু যে সীমাহীন কুৎসা এবং অপপ্রচারের শিকার আমাকে হতে হচ্ছে, সেটা কি আমার প্রাপ্য? আপনারা দেখেছেন, অপপ্রচারের পথ ধরেই আমাকে আপনাদের কাছ থেকে মাইনাস করার, বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা হয়েছে। এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আমাকে বিনা অপরাধে ছয় মাস গৃহবন্দি ও এক বছর নির্জন কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে, আমি আমার মায়ের মৃত্যুর সময়ও তাঁর পাশে থাকতে পারিনি। গুরুতর অসুস্থ সন্তানদেরও দেখতে দেয়া হয়নি। তার পরও যত দিন বাঁচি, আপনাদের মাঝেই থাকব। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশই আমার একমাত্র ও শেষ ঠিকানা।’

অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ক্রসফায়ারে নিহত ও গুমে নিখোঁজ স্বজনরা এবং নানা নির্যাতনে ক্লিষ্ট মানুষরা যখন বেগম জিয়ার সান্নিধ্যে যান, তখন তিনি এমনভাবে সান্ত্ব্তনা দেন, যেন তাঁর কোনো নিজস্ব বেদনা নেই। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে যান এই মহিলার অসম্ভব মনের জোর দেখে। জীবনভর সংগ্রামই করে চলেছেন, তবু মাথা নোয়াবার নয়। মহান স্বাধীনতার ঘোষকের স্ত্রী, হানাদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী ও যুদ্ধ সূচনাকারীর সহধর্মিণী হিসেবে পরিবারসহ বন্দি ছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপ্রধানের স্ত্রী হিসেবে সংসারে নিভৃতে ছিলেন। জিয়া যেমনিভাবে দরখাস্ত করে ক্ষমতার মঞ্চে আসেননি, তেমনি খালেদা জিয়াও বিএনপির চেয়ারপারসন স্বেচ্ছায় হননি। দল ও জনগণের অনুরোধে ওই দায়িত্ব নিয়ে কী সংগ্রামী জীবনকেই না যাপন করছেন! সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমত তাঁর প্রতি আছে। নইলে এমন রাজনৈতিক নেতা কে আছেন, যাঁর প্রতি নির্যাতনের কুঠারাঘাত প্রতিনিয়ত বর্ষিত হয়। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে বিএনপি আজ সুবিশাল দল।

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুছে দিতে কতই না হিংস্র প্রয়াস চলছে! কিন্তু রাজনীতি করার, দেশটাকে বাঁচানোর, জাতিকে গণতন্ত্র দেওয়ার ইচ্ছাটা কখনো তাঁর মনে মরেনি, মরবেও না। ৩৫ বছরের রাজনীতিতে তিন নম্বর স্বৈরশাসনকে গণজাগরণের মধ্য দিয়ে বিদায় দিতে তিনি দৃঢ়সংকল্প। তাঁর চূড়ান্ত বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

বেগম জিয়ার মতো অসামান্য রাজনৈতিক নেত্রীর পক্ষেই মানুষকে এমন সভ্য স্বপ্ন দেখানো সম্ভব, যখন তিনি বলেন, ‘শরতের আকাশে সাতটি রঙের বিচিত্র প্রভাব নিয়ে রংধনু যেভাবে মনোরম সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটায়, আমরা চাই সকল মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন ও পরিপুষ্ট করতে, যে সংস্কৃতি বাংলাদেশকে একটি রংধনু জাতিতে (rainbow nation) পরিণত করবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ও ভবিষ্যত্মুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপি। এ জন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছতে বিএনপি সচেষ্ট হবে (ভিশন-২০৩০)।’ সেদিন দূরে নয়, মেগাদুর্নীতি, লোমহর্ষক গুম-খুন, অবিশ্বাস্য ভোট চুরি ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতার ঘটনাগুলো উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে। বেগম জিয়ার ধৈর্যে আমরাও ধৈর্যশীল। ফারসি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘দের আয়েদ দুরস্ত আয়েদ’। যা দেরিতে আসে, সাজানো-গোছানোই আসে। এক দশকের অন্ধকারের সমাপ্তি বেগম জিয়ার হাতেই।

  • লেখক ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি এবং সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিএফইউজে । লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত। 


Saturday, September 4, 2021

প্রেসিডেন্ট জিয়া: আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার

—  ড. মোর্শেদ হাসান খান

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম
এমন একজন মানুষ সম্পর্কে কিছু লিখছি যিনি আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তবে বেঁচে না থেকেও তিনি আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন তাঁর কৃতিত্ব ও কর্মের মাধ্যমে। তিনি হলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান শুধু একটি নাম নয়, তিনি একটি ইতিহাস। জীবিত অবস্থায়ও তিনি যেমন এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় ধন্য ছিলেন, শত ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার সত্ত্বেও শাহাদাতবরণের চার দশক পরও তিনি এদেশের মানুষের মনিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে আসীন হয়ে আছেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের এক অবিসংবাদিত নেতা। জাতির চরম ক্রান্তিকালে যাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলো স্বাধীনতার ঘোষণা। অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে যিনি মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যাঁর নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গড়ে ওঠেছিল প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’। একজন সংগঠক ও রণাঙ্গণের অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যিনি অর্জন করেছেন জীবিত যোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ ‘বীর উত্তম’ খেতাব। 

বাবা-মায়ের আদরের সন্তান বগুড়ার ‘কমল’ জাতির প্রিয় জিয়াউর রহমান একজন সফল সেনানায়ক ছিলেন। ইতিহাসে হাতেগোনা যে কয়জন সামরিক অফিসার দেশের জন্য দু-দুটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে লড়াই করার গৌরব অর্জন করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁদের একজন। তিনি ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালে মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং এর অন্যতম সংগঠক হিসেবে পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর দিশেহারা জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন তখনকার সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ‘I Revolt’ বলে বিদ্রোহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর চট্টগ্রামে স্থাপিত অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেন। দেশকে স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ২৭ ও ২৮ মার্চ তাঁর এ ঘোষণা বেতারকেন্দ্র থেকে বারবার প্রচারিত হয়। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে মুক্তিপাগল দেশবাসী আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল এবং অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। তারপর দীর্ঘ ২৬৬ দিনের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণের রক্ত ও ৩ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালির গর্ব এ মহান মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে ‘জেড ফোর্স’- এর প্রধান হিসেবে দুঃসাহসী সেনানায়কের একটা আলাদা পরিচয় অর্জন করেন। যোদ্ধা ও একজন সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি 

হিসেবে জিয়াউর রহমান ‘বীর উত্তম’ খেতাব লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জিয়ার অনন্য অবদান কেবল বংলাদেশের সরকার ও জনগণেরই স্বীকৃতি পায়নি এজন্য বহির্বিশ্বে ও তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারত সফরে গেলে তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নীলম সঞ্জীব রেড্ডি বলেছিলেন:

Your position is already assured in the annals of the history of your country as a brave fighter who was the first to declare the independence of Bangladesh. Since you took over the reins of government in your country, you have earned wide respect both in Bangladesh and abroad as a leader dedicated to the progress of your country and the wellbeing of your people.১ 

শুধু সঞ্জীব রেড্ডি নয়, জিয়ার ঘোষণার গুরুত্বের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে ভারতীয় প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ জে এন দীক্ষিত, ট্রেভর ফিসলক, ডেভিড লুডেন প্রমুখ বিশ^খ্যাত পণ্ডিতদের রচনাতেও।

একজন সেনানায়ক হিসেবে জিয়া যেমন সফল ছিলেন, তেমনি একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও। তিনি ছিলেন স্বনির্ভর ও আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। স্বাধীনতা বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের এ স্বাধীনতা। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার এই তিনটি মূল্যবোধকে সামনে রেখেই হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। যেখানে জনগণই হবে সকল ক্ষমতার মূল উৎস। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তদানিন্তন সরকার জাতির এ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি ইত্যাদির ফলে দেশে এক চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্য সংকটের ফলে ১৯৭৪ সালে দেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে নিপতিত হয়। এ দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেন। অর্থনৈতিক দৈন্য-দশায় নিপতিত বাংলাদেশ আখ্যা লাভ করে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকদের উপর দমন-নিপীড়নের ফলে জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। জাতির এ চরম দুর্দিনে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে ‘বাকশাল’ নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। জাতির বহুল প্রত্যাশিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল চেতনা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমাধি রচনা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নানা ঘটনার প্রবাহের মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে আসার সুযোগ লাভ করেন। তাঁর সময়োচিত দায়িত্বভার গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা পায়। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পরিচালিত সরকারে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালনসহ পরিশেষে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার লাভ করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম স্বেচ্ছায় জিয়াউর রহমানের কাছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। এভাবেই সেনানায়ক থেকে জিয়া একজন রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রতি দেশের জনগণের আস্থা ও সমর্থন আছে কী নাÑ তা যাচাইয়ের জন্য জিয়াউর রহমান দেশে একটি গণভোটের আয়োজন করেন। ১৯৭৭ সালের ৩ মে সেই ভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং জনগণ বিপুল ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রতি সমর্থন ও আস্থা প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এ নির্বাচনে দশ জন প্রার্থী অংশ নেয়। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিয়াউর রহমান বিপুল ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশকেএকদলীয় স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন জিয়াউর রহমানের এক অসামান্য অবদান। তাঁর উদ্যোগে ১৯৭৬ সালে জারিকৃত ‘রাজনৈতিক-দলবিধি আদেশ’ এর আওতায় প্রথমে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলসহ ২১টি রাজনৈতিক দল সরকারি নিবন্ধন লাভ করে। পরে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মুজিব সরকারের আমলে সংবাদপত্রের উপর আরোপিত বিধি-নিষেধ জিয়াউর রহমানের সময় প্রত্যাহার করে এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশের জন্য তিনি নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সাংবাদিকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) জিয়াউর রহমানেরই চিন্তার ফসল। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রণীত আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন।১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক সমাজের মিলনকেন্দ্র ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটিও জিয়ার অবদান।

‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রবর্তনের মাধ্যমে জাতিকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের ও মতের নানা জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। তাদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরণএকে অপরের থেকে ভিন্ন। তাই জিয়াউর রহমান মনে করতেন যে, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখ-ের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান।

জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ও স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তিনি উৎপাদনমুখী রাজনীতির প্রবর্তন করেন। ১৯৭৭ সালের ২২ মে জিয়াউর রহমান তাঁর বিখ্যাত ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ঘোষিত জিয়ার এ ১৯ দফা কর্মসূচিকে বাংলাদেশের জন্য ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা মুক্তির সনদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। এ জন্য কৃষিখাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর যশোরের উলশী-যদুনাথপুর খাল খননের মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক খাল খনন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের কৃষিভিত্তিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সেচ সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশব্যাপী ১৪০০০ খাল খনন করা হয়। জিয়ার সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা ও পদক্ষেপের ফলে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। জিয়ার উদ্যোগে গঠিত স্বনির্ভর সমিতির তত্ত্বাবধানে গ্রামীণ জনপদে দারিদ্র্য বিমোচনের 

লক্ষ্যে নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এ ব্যাপারে জিয়ার প্রবর্তিত গ্রাম সরকারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপন অভিযান চালু করেন।মুজিব সরকারের আমলে সরকারিকরণের ফলে মৃতপ্রায় কলকারখানাগুলো বেসরকারিকরণের মাধ্যমে শিল্পখাতকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করেন। জিয়ার সাহসী উদ্যোগের ফলে তাঁর শাসনামলে দেশে প্রায় ৩৫০০ নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প। ১৯৭৭ সালে ‘দেশ গার্মেন্টস’প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জিয়া তৈরি পোশাক শিল্প খাতের সূচনা করেন। শিল্পউৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়।

শিক্ষা খাতের উন্নয়ন ও বিকাশেও শহীদ জিয়ার বিশেষ অবদান রয়েছে। জিয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের ২১ নং ধারায় বাংলাদেশে একটি ‘গণমুখী ও জীবননির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম’ চালুর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল। উৎপাদনমূখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর শহীদ জিয়া ঢাকায় একটি “জাতীয়শিক্ষা ওয়ার্কশপ” আয়োজন করেন। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত সারাদেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষাকর্মী এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন। একটি সময়োপযোগী অন্তর্বর্তী শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৭৮ সালে প্রফেসর মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে একটি জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেন। জিয়া সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারে জোর দেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা পরিষদ’ গঠন করেন। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেন। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার উপরও গুরুত্ব প্রদান করা হয়। জিয়ার সময়েই ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়। নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া ‘গণশিক্ষা কর্মসূচি’ প্রবর্তন করেন। শিক্ষার প্রসারে গ্রন্থাগারকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৮০-৮১ অর্থ বছরে ‘থানা পাবলিক লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম স্থাপন’ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণকল্পে জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। শহীদ জিয়া জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (NITRO) প্রতিষ্ঠা করেন। 

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাখাতেও জিয়া মূল্যবান অবদান রাখেন। তিনি পল্লী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং প্রথম বছরেই ২৭০০০ জনকে পল্লী চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ১৯৭৮ সালে কলেরা হাসপাতাল (আইসিডিডিআরবি), দক্ষ নার্স তৈরির লক্ষ্যে ৫ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে মহাখালীতে নার্সিং কলেজ এবং ১৯৮১ সালের ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়ই নিপসম, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও ইপিআই প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫০ শয্যার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, পিজি হাসপাতালের সি-ব্লক, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ চিকিৎসকদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিএমএ ভবন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। জিয়া জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ এবং এর সাথে স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ বিভাগকে যুক্ত করেন। 

জনসংখ্যার অর্ধেক নারী সমাজকে উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে জিয়া নানাবিধ পদক্ষেপ হাতে নেন। নারীর উন্নয়ন, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে প্রথম নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম চাকুরি ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য শতকরা ১০ ভাগ কোটা নির্ধারণ করেন। মহিলা পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। কর্মজীবী মহিলাদের সুবিধার্থে তিনিই প্রথম ‘কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল’ নির্মাণ করেন। জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৫ থেকে ৫০ এ উন্নীত করেন। ১৯৮০ সালে যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। জিয়াই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূত ও মহিলা অডিটর জেনারেল নিয়োগ করেন।বেকারযুব সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জিয়া ‘যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কেবল দেশে কর্মসংস্থান নয় বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। বিশ^বাজারে শ্রমশক্তি রফতানিতে বাংলাদেশের আজকের যে সাফল্য তার দ্বার উদ্ঘাটনের কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট জিয়ার। ১৯৭৮ সালে কুয়েতে ৬০৮৭ জন শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে বিদেশে মানবসম্পদ পাঠানোর সূচনা করেন।

শিশুর সুপ্ত মেধা বিকশিত করার সুবর্ণ সুযোগ করে দিতে ১৯৭৬ সালে শহীদ জিয়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৫ জুলাই ১৯৭৭ সালে পুরনো হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিম পাশ্বের তিনি শিশু একাডেমির নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। শিশুদের বিনোদনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে শাহবাগে জাতীয় শিশুপার্ক স্থাপন করেন। শিশুর স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য ঢাকার শ্যামলীতে তিনি শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে শিশুদের সাংস্কৃতিক প্রতিভা বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে বিটিভিতে ‘নতুন কুঁড়ি’ নামক প্রতিযোগিতা চালু করেন।

সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে প্রেসিডেন্ট জিয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশী জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি। এর উন্নয়নে তিনি ‘বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮’ প্রণয়ন করেন। চলচিত্র শিল্পের বিকাশের জন্য জিয়া ফিল্ম ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন। ১৯৭৯ সালের ৯ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৭) চালু করেন। জিয়ার আগ্রহেই ১৯৮১ সালের মার্চ-এপ্রিলে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। উপজাতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটিতে ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ (বর্তমান নাম ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’) এবং নেত্রকোণার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ‘উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে জিয়া ঢাকায় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। ১৯৭৮ সালে ৪ টি বিভাগীয় শহরে ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করেন।

বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন যাত্রা শুরু করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৩১ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সভায় জিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এবং দেশটি নিজের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে’। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে বিভিন্ন দেশের সাথে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করেন। জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে তাঁকে মধ্যস্থতার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ মুসিলম বিশ্বের বৃহৎ সংগঠন ওআইসিতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে এবং তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করে। জিয়া পেশাদার কূটনীতিবিদ সৃষ্টিতেও অবদান রাখেন। ১৯৮০ সালের ২৬ ডিসেম্বর জিয়া বাংলাদেশী কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকায় ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠার ধারণার উদ্ভাবন করেন। এ জন্য তাঁকে সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়। 

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৭ সালে শহীদ জিয়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রবর্তন করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৫২ সালের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য জিয়াউর রহমান ‘একুশে পদক’ নামক আরেকটি পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এটি রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তি। সেনা ছাউনির আবেষ্টনীতে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হলেও তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই গণমানুষের নেতা। জিয়াউর রহমান যে জনগণের কতটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন এবং জনগণ যে তাঁকে কতটা কাছে টেনে নিয়েছিল তার বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে লরেন্স জায়রিং এর লেখায়। 

‘A people’s President’ সাব হেডিং-এ লরেন্স জায়রিং তার গ্রন্থে লিখেছেন:   

Zia ingratiated himself with the peasant masses. They received his primary attention and whenever his schedule permitted, he helicoptered around the country, dropping out of the sky often unannounced to view peasant conditions, first hand and to discuss the methods and the resources available to raise them from their poverty. ২ 

জীবনের শাসনামলের মতো তাঁর জীবনরেখাও দীর্ঘ ছিল না। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ পরিচালনায় বাংলাদেশ যখন ক্রমশ স্বনির্ভরতার পথে ধাবিত হচ্ছিল তখনই একটি কুচক্রি মহল বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোর রাতে একদল বিবেকবর্জিত বিপথগামী সেনা সদস্য চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের এ ঘটনায় গোটা জাতি শোকবিহ্বল হয়ে পড়ে। জিয়ার শাহাদাতের ১৫ দিনের মাথায় ১৯৮১সালের ১৫ জুন বহুল প্রচলিত ‘News Week’ পত্রিকায় নিবন্ধকার  Fred Brunning এবং James Pringle যৌথভাবে সদ্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। যার একাংশে লেখা ছিল: 

Black bordered pictures of the slain man were pinned to rickshaws peasants fasted to express their grief. And nearly 2 million mourners jammed the streets of Dhaka to mourn Ziaur Rahman, president of Bangladesh and symbol of impoverished nation's struggle for self respect. For many Rahman's assassination by army dissidents dashed hopes for the future. Now progress will stop, the country will go down, said Tazul Islam, 50 a railway clerk. there are no more good leaders. ৩

জিয়ার শাহাদাতের পর এরকমই ছিলো বাংলাদেশের বাস্তবতা। জিয়াউর রহমানের হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত কুচক্রীদের ধারণা ছিল তাঁর শাহাদাতের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে জিয়ার আদর্শেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শের ঝা-া হাতে তুলে নেন, তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যান। বাংলাদেশের মানুষও পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে আপন করে নেন। জনমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনে বেগম খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশকে সেবা ও সুশাসন উপহার দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে জিয়া ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে জিয়ার ঐতিহাসিক অবদানকে মুছে ফেলার সর্বগ্রাসী অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্যও অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছ। জিয়া পরিবারকে রাজনীতিতে থেকে বিযুক্ত করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের অংশ হিসেবে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে আপোসহীন নেত্রী হিসেবে সুপরিচিত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। চক্রান্ত করে জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র এবং যোগ্য উত্তরসূরী দেশনায়ক তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইতিহাসের শক্তি অবিনশ্বর। ষড়যন্ত্র করে ইতিহাসের গতিপথকে সাময়িক সময়ের জন্য ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা যায়, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ইতিহাসের সত্য উদ্ভাসিত হবেই। জিয়ার অবদানকে খাটো করার যত অপচেষ্টাই করা হোক না কেনো, তিনি অমর হয়ে আছেন স্বমহিমায় এবং ভবিষ্যতেও জ্যোতির্ময় হয়ে থাকবেন এ দেশের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

ড. মোর্শেদ হাসান খান
— লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহসম্পাদক, বিএনপি ও সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।  

সূত্র —  

১। Z, M Shamsul Haq, Bangladesh in international Politics, Dhaka 1993, P.96

২। Lawrence Ziring, Bangladesh : from Mujib to Ershad : An Interpretive Study, p. 146 3 

৩। News Week, 15 June 1981

বিএনপি এক সামাজিক শক্তি, প্রতিটি পরিবারে তৈরি হয়েছে শুভাকাঙ্ক্ষী

—  শওকত মাহমুদ 



শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর সমাধিসৌধ থেকে সামান্য দূরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আজ বিএনপির পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার বটমূলে জিয়াউর রহমানের দল ঘোষণার পর আজকের তারিখটি হতে পারে বিএনপির নয়া অভিযাত্রার, নব উদ্বোধনের।

‘নানান মানুষ নানান পথ, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’ স্লোগান তুলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি-এর জাতীয় সম্মেলনকে জাতীয় সম্মিলনীতে বিকশিত করার ‘রংধনু’ প্রয়াস, এ উপলক্ষে তৃণমূল পর্যায় থেকে সাংগঠনিক সজীবতা এবং আয়োজনের প্রাণচাঞ্চল্য যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, নেতাদের বিশ্বাস—বাংলাদেশের সমকালীন লোক-চিন্তায় ও রাজনৈতিক অববাহিকায় এ অনুষ্ঠান সম্ভাবনার তরতাজা পলি ছড়াবে। বিএনপির রাজনীতিকে নেতির নেত্রে পরখ করেন না, এমন অভিজন সমাজের ধারণা হলো, এক-এগারোর পর থেকে রাষ্ট্র যেমন গণতন্ত্রে ও সার্বভৌমত্বে বিপন্ন হয়েছে, উপর্যুপরি দুই আমলের নিগ্রহে বিএনপি ততোধিক বিদীর্ণ। ১৬ বছর পর বিরোধী দলে থেকে এ কাউন্সিলকে সফল করা গেলে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে। এর পৌঁছ রাষ্ট্র-রাজনীতিতেও বিস্তৃত হবে, ‘তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে’।


মাদার অব ডেমোক্রেসি
বেগম খালেদা জিয়া
ইতোমধ্যে বেগম খালেদা জিয়া আবারও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেবে, দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে একজন রাজনৈতিক নেতার শীর্ষ জনপ্রিয়তা, তিনবারের কাউন্সিলে দলের প্রধান হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকা, দলকে বার বার ভোটে বিজয়ী করা এবং সর্বদা সর্বোচ্চ ভোটে সবচেয়ে বেশি আসনে নিজের নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড নজিরবিহীন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি রাজপথের আপসহীন আন্দোলনে দলকে গড়ে তুলেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্র তিনি ফিরিয়ে এনেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন তাঁর হাতে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলের বিপর্যয়েও বেগম জিয়ার প্রাপ্ত ভোট বরাবরের মতো উচ্চতায় ছিল। অনেকেরই চোখে পড়েনি, আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষে বিপর্যস্ত রাষ্ট্রকে সুঠাম করার অভিপ্রায়ে নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে জাতীয় ঐক্যের ডাক  দিয়েছিলেন। ২০০৮-এর নির্বাচনের ফল বিএনপির জন্য অপমানজনক হয়েছে বটে, কিন্তু দেশ বাঁচানোর জ্বলন্ত আবেগে সরকারকে তিনি সহযোগিতার অঙ্গীকার দিয়ে রেখেছেন। যা ২০০১-এর ভোটের পর বিরোধী দল করেনি। এ জন্য বোধ করি সরকার-নিন্দার বদলে এই জাতীয় কাউন্সিলের স্লোগানে নানান পথে নানান মানুষের জাতীয় ঐক্যই মূলমন্ত্র। থিম সংটাও তাই বলে, ‘বন্ধু-সাথিরা এক মোহনায়/ মিশেছি সবাই এসে লাখো শহীদের রক্তে/ রাঙানো পবিত্র এই দেশে।’ সম্মেলনের পোস্টারে মাঝখানে সূর্য রেখে চারদিকে সাত রঙের রংধনুর অবস্থান, জমিনজুড়ে সৌভাগ্যের হলুদ রং, ওয়েবসাইট উদ্বোধন নতুন উপলব্ধিরই আবাহন। পার্লামেন্টে না যাওয়া, আপাত দুর্বল বিরোধী দল বিএনপির জন্য এই শোডাউন বড় একটি ঘটনা। বেশ কয়েক দিন ধরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানসহ বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনে মনে হয়েছে, পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলকে তাঁরা শুধু আইনি বাধ্যবাধকতার কাউন্সিল মনে করেন না। তার পরও আইন মেনে কাউন্সিল ও গঠনতন্ত্রের সংশোধনীর ক্ষেত্রে তাঁরা যত্নবান। বরং জাতীয় সমস্যাকে জাতীয় ঐক্যে মোকাবিলার জন্য বিএনপির আদর্শিক পুনরুজ্জীবন, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দলকে সুবিন্যস্ত করার অগ্রাধিকারকেই তাঁরা এ মুহূর্তের কর্তব্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল উল্টো পথে হেঁটেছে। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখা যায়নি। 

এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কীভাবে নতুন করে সাজবে? কাউন্সিলের আম অর্থই হচ্ছে পুনর্বিন্যাস। স্থানীয় পর্যায়ের ৭৫ শতাংশে সফল সম্মেলন হয়েছে। বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপির নতুন সদস্য হয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। কম কথা নয়। 

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হালে প্রায় ঘোষণার মতোই বলেছেন, ‘৮ ডিসেম্বরের পর জনগণ নতুন বিএনপি দেখতে পাবে।’ সময়ের দাবিও অবশ্য নতুন পরিচ্ছন্ন বিএনপি। অন্তত এক-এগারোর বিরোধী চেতনায় দুর্নীতিবাজ বলে যাদের কুনাম আছে, তাদের অপরাধও যেন এ অজুহাতে মুছে না যায়। দলের ভেতর-বাইরে এমন উপলব্ধি প্রবল। বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তাঁদের অনুভূতির মূল্যায়ন চান। দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা চেইন অব কমান্ড থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় না থাকলে বিএনপি সব সময় অপেক্ষমাণ রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু দলটি যে পারফর্ম করতে পারে, আগের উদাহরণ সামনে এনে নতুন করে সাজিয়ে বিএনপিকে তা-ই দেখাতে হবে। সবার প্রত্যাশা, নতুন রক্তের সংযোগ-সাধন ঘটুক। প্রয়াত জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান, তরুণ রাজনীতিক তারেক রহমানের আশু দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। নির্যাতনে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে বহুদিন। সম্প্রতি লন্ডনে তারেক রহমান এক সাক্ষাতে আমাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির মানদণ্ডে একজন রাজনীতিবিদের যে সীমারেখা, তা আমি কখনো অতিক্রম করিনি।’ বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল যদি বিএনপির নবযাত্রার সূচনা করে, তারেক রহমান হতে পারেন ভবিষ্যতের কান্ডারি। সময় হলেই ফিরবেন তিনি এবং বীরোচিত সংবর্ধনায়। এ প্রত্যাশা বহু মানুষের।

আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার বটমূলে সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলের ঘোষণাপত্র তিনি পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ দাঁড়াবে নিজের পায়ে, চলবে আত্মশক্তিতে।’ স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন এবং দল ও রাষ্ট্র গঠনের সুবিশাল যজ্ঞ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তনসহ রাজনৈতিক সংস্কার দেশকে নতুন পরিচিতি, নতুন স্বয়ম্ভরতা দিয়েছিল। বিশ্ব ও দেশবাসীর সামনে থেকে তীব্র দেশপ্রেমে ও আত্মিক সততায় তিনি তাঁর পূর্ব সময়কে পৃথক করতে পেরেছিলেন। ‘The Final test of a leader is that he leaves behind him in other men the conviction and the will to carry on’ — বিলেতি রাজনীতির এই পর্যবেক্ষণ জিয়ার জন্য বেশি প্রযোজ্য। আজকের বিএনপির জন্য জিয়ার দেশপ্রেম, সততা ও নিঃস্বার্থের আদর্শ, দলের ঘোষণাপত্রের চেতনা এবং বেগম জিয়ার উদার গণতন্ত্র হতে পারে নবযাত্রার মূল ভিত্তি। অভিজন সমাজের মতে, ৩১ বছরের যাত্রায় বিএনপি কিন্তু আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এক সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে এখন বিএনপির সদস্য, সমর্থক বা শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি হয়েছে।

—  লেখক ভাইসচেয়ারম্যান, বিএনপি। সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিএফইউজে। লেখাটি ২০০৯ সালে রচিত। 

Thursday, August 12, 2021

কোকো ভাই ——— লুনা রুশদী


মা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আরাফাত রহমান কোকো

সময়টা ১৯৮৮ অথবা ৮৯ সাল হবে। কোকো ভাই যখন মেলবোর্ন এসেছিল লেখাপড়ার জন্য, বেগম খালেদা জিয়া তখন বিরোধী দলের নেত্রী। এরশাদ ক্ষমতায়। তখনও বোধহয় পল কিটিং অস্ট্রেলিয়ার প্রাইম মিনিস্টার হন নাই। সে বছর বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিলো। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য আমরা অস্ট্রেলিয়ায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানের মহড়ায় তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। 

সেই স্মরণীয় দিনে মোনাশ ইউনিভার্সিটির একটি হলরুমে আমাদের মহড়া চলছিলো। সিঁড়িতে উঠে একটা টানা বারান্দা পার হয়ে যেতে হতো সেই হল রুমে। এখান থেকে গানবাজনার শব্দ শোনা যেত, মানুষের কথাবার্তা, হাসাহাসিও। আমি সিঁড়িতে উঠতে উঠতে দেখলাম উপরে রেলিংয়ের উপরে একজন তরুণ বসে আছেন। তাকে ঘিরে ফয়সল ভাই, মিকি ভাই, বাবু ভাই আরো অনেকে বসা। রেলিংয়ে বসা লোকটিই ছিলেন কোকো ভাই। কালো রঙের একটা লেদার জ্যাকেট গায়ে ছিল আর নীল জিন্স।

আমাদের একটা গ্রুপ ছিল, প্রতি মহড়ার পরেই আমরা একসাথে ঘুরতাম। কোকো ভাই, ফয়সল ভাই আর আরো কয়েকজন একটা বাসা শেয়ার করে থাকতেন। এই বিষয়টি নিয়ে ফয়সল ভাই বেশ গর্বিত ছিল, মনে আছে। আমাকে একবার সে বলেছিল, ‘কোকোকে আমি প্রথম দেখছিলাম টিভিতে!’ বলার সময় উনার গলা খুশীতে কাঁপছিল।  প্রথম যখন ওই বাসায় উঠেছে, কোকো ভাই নাকি মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাতেন। এটি ছিলো ওনার বড় গুণ। আমার সারাজীবনের স্বভাব সবচেয়ে অপ্রিয় প্রশ্ন করা। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি জিয়াউর রহমানের ছেলে?’ মানে আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল ছোটবেলায় টিভির খবরে দেখা জিয়াউর রহমানের মুখ, একটা কোদাল হাতে, গেঞ্জি পরা ছবি ছিল না উনার? তারপরে যেবার আশুফুপুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম কুমিল্লায়, আমার তখন বোধহয় পাঁচ-ছয় বছর বয়স। আমিসহ সবার চোখে অসুখ হয়েছিলো সে বছর। ওই চোখ নিয়েই ফুফু একদিন কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখন খবর  পেলাম জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খবরটা শুনে কেমন অস্থির লাগছিল।

তাই কোকো ভাইকে করা আমার প্রশ্নটা যতই বেমানান হোক, এইটা আসলে একটা অস্বাভাবিকভাবেই করেছিলাম। উনি হাসা শুরু করেছিলেন। তারপরে বলল, ‘হুম, লোকে তো সেইরকমই সন্দেহ করে’। তারপরে স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতে আমার সাথে ঠাট্টা করল, গণ্ডার ডাকল। কারণ উনার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার এতদিন পরে এই প্রশ্ন আমার মনে আসছে। অনুষ্ঠানের দিন কোকো ভাই মঞ্চে উঠে কিছুক্ষণ কথা বলছিল। কী বলছিল মনে নাই, তবে মঞ্চে উনারে দেখতে অন্যরকম লাগছিল, এমনিতে আমাদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় উনাকে কোকো ভাই ছাড়া আর কিছু মনে হত না, মজার মজার কথা বলত, সবাইকে হাসাত, দাঁত উঁচু ছিল কিন্তু চোখ অনেক সুন্দর থাকায় উঁচু দাঁত খেয়াল করতাম না।

মঞ্চে তাকে একটু একটু জিয়াউর রহমানের মতন লাগছিল। ওইরকম সানগ্লাস ছিল উনার। মঞ্চে কি সানগ্লাস পরা ছিল? না বোধহয়। ও রকম হলে তো হাসি আসত নিশ্চয়ই। তবে প্রথমেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলছিল মনে আছে। এটা মনে আছে কারণ, উনি নেমে আসার পরে অনেক মহিলারা উনাকে বলছিল উনি নাকি ঠিক উনার আব্বার মতন করে বক্তৃতা শুরু করেছেন, এতে সবাই খুশি হয়েছিল। কোকো ভাই লাজুক লাজুক হাসতে হাসতে সবার প্রশংসা শুনতেছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল।

কোকো ভাই পার্টটাইম চাকরি করত হান্টিংডেল-এর পিৎজাহাটে। আমাদের বাসার খুব কাছে। মাঝে মাঝে বাসায় আসত। পিৎজাহাটের লাল টিশার্ট আর কালো টুপিতে উনারে দেখা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমাদের। গরমের দিনে উনার ডিউটি শেষে বাসায় আসলে মাঝে মাঝে সবাই একসাথে মুভি দেখতাম। মাঝেমাঝে বেশ কয়েকজন মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম। দৌড়াতে না পারলে বলত, ‘কীরে দুর্বল লাগে? সাগু খাবি?’ ভালো ড্রাইভ করত। উনি খুব স্বাভাবিক থাকত সবসময়, যে কোনো জায়গাতেই কমফোর্টেবল মনে হত। নার্ভাস ছিল না আবার অ্যারোগেন্টও না। তাই যে কোনো গ্রুপ সিচুয়েশনে উনি চুপচাপ থাকলেও লিডারশিপ উনার কাছেই আসত। আর উনিও এভাবে চালিয়ে নিত যে সহজে তা বুঝা যেত না। মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ‘তোরা এত ইনোসেন্ট ক্যান?’ উনার বলার ভঙ্গিতে মনে হত ইনোসেন্ট হওয়াটা বেশ দোষের একটা কাজ।

এরপর বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসলেন। তখন বুঝি নাই, এখন মনে হয় সেইটা বিশাল ঘটনা ছিল আসলে। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার দশ বছর পরে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসল। কোকোভাইও নিশ্চয়ই এই পরিবর্তন টের পেয়েছিল। অথচ উনার চলাফেরায় বা আমাদের সাথে মেলামেশায় সেইরকম কিছু বুঝতে পারা যায় নাই। আমরা তখনও আগের মতনই ব্যাডমিন্টন খেলতাম, মুভি দেখতাম, বিচে বেড়াতে যেতাম। শুধু বাংলাদেশীদের মধ্যে তার খাতির বেড়ে গিয়েছিল। অনেক দাওয়াত পেত। আর সেইসময় মেলবোর্নে বাংলাদেশি কমিউনিটি এত বড় ছিল না। সবাই প্রায় সবাইকে চিনত। দেখা যেত আমাদের দাওয়াতগুলো কমন পড়ছে। দাওয়াতেও আমরাই আড্ডা দিতাম। আর কোকো ভাইয়ের জনপ্রিয়তা নিয়ে তাকে ক্ষেপাতাম। ততদিনে তিনি পিৎজাহাটের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, প্লেন চালানোর লেসন নিতে শুরু করছিল। মাঝে মাঝে যখন ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম, তিনি গিয়ে একদম অপরিচিত সাদা লোকেদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলায় কথা বলতে থাকতেন, ওরা কিছুই না বুঝে হাসত, এমনটা যে কতবার করছে! একবার মনে আছে, খেলার ব্রেকে বাইরের পাবলিক ফোন বুথ থেকে ফোন করছিল। আমিও সাথে আসছিলাম। পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। কাকে যেন বলছিল তার এক বন্ধুর কথা। যে কোনো একটা ব্যবসায়ের বিষয়ে দেখা করতে চায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে। কোকোভাই বলেছিল ‘আম্মাকে বলবেন, আমার বন্ধু বলে কোনো স্পেশাল ফেভার করার দরকার নাই।’ আমার মজা লাগছিল দেখতে। একটা মানুষরে দুই রকম দেখছিলাম। সেই সময়টা মনে আছে, আমরা মোনাশের স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন সেন্টারের সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, আর তিনি তখনও ফোনবুথে, কত মানুষজন আসছিল-যাচ্ছিল, কেউ উনারে চিনে না।

দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় যখন বিদায় নিতে আসল কোকো ভাই, আমি জানতাম তাকে বিদায় দেয়া অন্য বন্ধুদেরকে বিদায় দেয়ার মতন না। দেশে গেলে তিনি তো আর কোকোভাই থাকবেন না, আরাফাত রহমান কোকো হয়ে যাবেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাদের সাথে কি আর বন্ধুত্ব হয়? পেপারে খবর পড়তে হয় তাদের নিয়ে। যেমন আজকে পড়ছি তার মারা যাওয়ার খবর। এই মানুষটাকে শুধু এমন একজন মানুষ হিসেবেই চিনতাম তো আমি, তার জন্য ব্যক্তিগত শোকের স্পেস আছে কীনা কে জানে।

  • লেখিকা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি, অসওয়াইড ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানিং এ কর্মরত। 
     


রাজনীতির অঙ্ক ওল্টানো একজন ক্রীড়াপ্রেমী — মোস্তফা মামুন


আরাফাত রহমান কোকো
আগস্ট ১২, ১৯৬৯ — জানুয়ারি ২৫, ২০১৫

আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা খুব মনে রাখার মতো কিছু ছিল না। ক্রিকেট বোর্ড অফিসে নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি অমুক’। হাত মিলিয়েছিলেন কিন্তু তাতে এমন কোনো আন্তরিকতার ছাপ নেই। হতাশ হওয়ার মতো ব্যাপার। আমাদের দেশে রাজনীতিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান কিন্তু তাদের অনেক দোষ থাকলেও প্রকাশ্যে তারা ভীষণ আন্তরিক। সেদিন বুঝলাম, রাজনীতিক এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। রাজনীতিকদের মনে যাই থাকুক, মুখে থাকে হাসি। সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সেরকম নয়। তারা দেখানোর জন্যও কাউকে খুব পাত্তা দিতে রাজি নন। এরপর আর তার কাছ ঘেঁষার প্রশ্ন নেই। যথাসাধ্য দূরত্ব রক্ষা করেই চলেছি।

কয়েক মাস পর অস্ট্রেলিয়া সফর। ডেভ হোয়াটমোরের বাংলাদেশ দলের সঙ্গে সেই সফরে গিয়ে শুনলাম আরাফাত রহমানও এসেছেন। নিজে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছেন বলে সেই জায়গাটা নিয়ে বাড়তি আগ্রহও আছে। ডারউইন বা কেয়ার্নসে একদিন মাঠেও এলেন। সঙ্গীদের নিয়ে ছবি-টবি তুললেন। এটাও অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। আমাদের কর্তারা বিদেশে গেলে ব্যক্তিগত অ্যালবামের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির চেষ্টা করে থাকেন। ম্যাচ শেষে প্রেসবক্সে লিখছি, এই সময় তার একজন সঙ্গী এসে জানালেন, ‘কোকো ভাই আজ রাতে দলের জন্য একটা ডিনার দিচ্ছেন। তিনি চান, সাংবাদিকরাও সেখানে থাকুন। আপনাদের সবার আমন্ত্রণ।’

অস্ট্রেলিয়া পত্রিকার সাংবাদিকদের জন্য খুব সুবিধাজনক একটা জায়গা। খেলাটা বাংলাদেশ সময় দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায় বলে লেখার অনেক সময়। সুযোগ থাকে লেখা শেষ করে দাওয়াত রক্ষার। আমরা প্রেসবক্সে আলোচনা করে ঠিক করে ফেললাম, যেহেতু দাওয়াত দিয়েছেন তাই যাওয়া উচিত। আর তাছাড়া খেলোয়াড়দেরও একসঙ্গে পাওয়া যাবে। পরদিনের স্টোরির জন্যও রাতের খাবার আদর্শ জায়গা।

যেতে আমাদের দেরি হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধ ঘণ্টা পর। আর গিয়ে যা দেখলাম তাতে চমকে উঠলাম। প্রথম পরিচয়ে উন্নাসিক মনে হওয়া, ক্ষমতাবানসুলভ অহমিকা দেখানো মানুষটা তখনও না খেয়ে বসে আছেন। আমরা যেতেই উঠে এগিয়ে এলেন। সবার সঙ্গে এমনভাবে হাত মেলালেন যেন আমরা না যাওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠান পূর্ণতা পাচ্ছিল না। আর তাতে দূরত্বের দেয়ালটা ভেঙ্গে গেল যেন। ঢাকায় যা হয়নি সেই দূর অস্ট্রেলিয়ায় সেটা হলো। তার সঙ্গে বেশ লম্বা সময়ের আড্ডা। সেখানে পারিবারিক পরিচয়ের আবহ ছেড়ে যে কোকো বেরিয়ে এলেন তার চোখে ক্রিকেট নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন। আর চোখে ঝলমল করা সেই স্বপ্নে তাকে আর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল শুধুই একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠক। রাজনীতি বা ক্ষমতার শক্তি নয়, ক্রিকেট ভালোবাসাই তার একমাত্র শক্তি।

এটা ঠিক যে রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদেই তিনি ক্রিকেট বোর্ডে এসেছিলেন। কিন্তু সেটা কে আসে না! এখনও যে বা যারা ক্রিকেট বোর্ডে আছেন তাদের পরিচয়ও তো রাজনৈতিক। কিংবা ব্যবসায়ী। কাজেই সেই জায়গা দিয়ে বিবেচনা করলে প্রায় সবাইকে বাদ দিতে হয়। বিবেচনার পরিবর্তিত মানদণ্ড তাই তিনি কীভাবে এসেছেন সেটা বড় কথা নয়, এসে কী করলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জায়গাটাতে আরাফাত রহমান অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি পদে মনোনয়ন দিতে পারত। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত চর্চা করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন। হননি। দায়িত্ব পালন করেছেন ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে, সেটা বোর্ডেরই অধীন একটা কমিটি। পরে অনেকের কাছে অনেক কথা শুনেছি বটে কিন্তু সেই সময় মাঠে-ঘাটে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেও তার বলয়ের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপের কথা শুনিনি। এমন কিছু দেখিনি যাতে মনে হয়, তিনি শক্তি খাটানোর চেষ্টা করছেন। বরং দেখা গেছে, দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে অন্য অনেক লোভনীয় জায়গা বাদ দিয়ে তিনি ডেভেলপমেন্ট কমিটির মতো একটা প্রায় থ্যাংকসলেস কমিটিকে বেছে নিয়েছেন। আর তাতে হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যতের ক্রিকেটার তৈরির দারুণ একটা পথ তৈরি করেছেন। অস্বীকারের উপায় নেই, আজকের সাকিব-মুশফিকরা সেই দূরদর্শী হাই পারফরম্যান্সেরই ফল। মোটের উপর পরের কয়েক বছরের সাপ্লাই লাইনটা তৈরিই হয়েছিল এই কমিটির মাধ্যমে। কমিটির প্রধান হিসাবে মূল কৃতিত্বটা তারই পাওনা।

কেউ কেউ তবু বলবেন, ঐ তো হলো! প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলেই তো...। তাদের জন্য একটা উত্তর আছে। বোর্ডে যারা ক্ষমতার জোরে আসেন তাদের মধ্যে কতজন পাওয়া যাবে যারা মাঠে ক্রিকেট খেলেছেন! হ্যাঁ, তিনি ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেছেন। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট আর এমন কী ক্রিকেট! এই প্রশ্নও আসবে জানি। কিন্তু মা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলাটা তো একইসঙ্গে পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মানসিকতারও প্রকাশ। ১৯৯১-৯২ সালে খেলেছেন ক্রিকেট, যখন রাজ্যপাঠ পুরো তার পরিবার এবং দলের দখলে। এসবই প্রমান করে, অন্য ক্ষেত্রে যত কথা বা আলোচনাই থাক খেলার মাঠের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল পুরনো। ভালোবাসাটা ছিল খাঁটি।

বুঝতে পারি এখন যারা তার কীর্তিকে স্মরণীয় করতে এই বই প্রকাশের চেষ্টা করছেন তাদের খুব ঝামেলা হচ্ছে। লেখা দিতেও সম্ভবত চেনা অনেকেই রাজি হচ্ছেন না। কিন্তু আবার দেখবেন, সময় বদলে গেলে এরাই তার নামে ঢোল বাজাতে বাজাতে ফাটিয়ে ফেলবেন। আরাফাত রহমান বা রাজনৈতিক পরিবারের মানুষের এই একটা সমস্যা তারা না চাইলেও অনেক অঙ্কের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি তো ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গে নিজেদের মানুষদের বেশি বড় করার চেষ্টাও তাদের অর্জন প্রশ্নের মুখে ফেলে। অথচ কী জানেন আরাফাত রহমানের মোটেও সেটা প্রাপ্য নয়। তিনি তো আমাদের খেলার জগতে রাজনৈতিক হিসাব ভেঙ্গে দেয়ার নায়ক। কীভাবে?

কাছের মানুষদের তথ্য অনুযায়ী তিনি ছিলেন আবাহনীর সমর্থক। আবাহনীর প্র্যাকটিস দেখতে ধানমণ্ডি ছুটে যেতেন বলে জানা গেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। সেই আবাহনী, যার প্রতিষ্ঠাতার নাম শেখ কামাল। যে ক্লাবের সঙ্গে তার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে সেই ক্লাবকে নিজের ক্লাব করতে একটুও অসুবিধা হয়নি। খেলা তার কাছে এত বড় ছিল যে রাজনীতির অঙ্ক পাত্তাই পায়নি।

তাই যদি হয় তাহলে তো হাইপারফরম্যান্স-ডেভেলপমেন্ট কমিটি এসবের চেয়েও এটা বড় ব্যাপার। খেলায় রাজনৈতিক বিভক্তি আর শক্তি ব্যবহারের কালো ছায়ার বিপরীতে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বিভেদমুক্তি আর ভালোবাসার সৌন্দর্য নিয়ে।

 

  • লেখক উপ সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি,  ২০১৬-২০১৯ । বর্তমানে তিনি দৈনিক দেশরূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।   

 


Monday, July 26, 2021

বাংলাদেশের ভবিতব্য ও তারেক রহমান

 ---------------------------------------------------
শামা ওবায়েদ
---------------------------------------------------



বাংলাদেশের মানুষ এক দুঃসহ সময়ের মধ্যে বসবাস করছে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণের মাত্রা দিনে-দিনে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের মৃত্যুতে ভার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত লকডাউন--- যেখানে জীবিকা আর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মানুষের নাভিশ্বাস সংগ্রাম। রাষ্ট্রজুড়ে বর্তমান আওয়ামী লীগের বিনা নির্বাচিত সরকারের দুর্গতিসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা।

এই রকম পরিস্থিতির মধ্যে দেশের প্রধানতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, সাবেক তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক-এগারোর মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। অথচ একইসময়ে করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই মামলাগুলো নেই। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা বঞ্চিত করছে সরকার। অথচ, এক-এগারোর সময় বেগম খালেদা জিয়াই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিকিৎসার জন্য সোচ্চার ছিলেন।

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, নেতৃত্বদানকারী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রধান, সাবেক নির্বাচিত তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতি, সেক্টর ও ফোর্সেস কমান্ডারের সম্মানিতা স্ত্রী, বেগম খালেদা জিয়া গুলশানের ফিরোজায় ব্যক্তিগত ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের সমন্বিত বোর্ডের অধীনে আছেন। তার মুক্তিকে যেমন বাধাগ্রস্ত করে রাখা হয়েছে, তেমনি মানুষের স্বাভাবিক জীবনকেও আটকে রেখেছে সরকার।

সব মানুষের মনে ক্ষোভ, জীবনবঞ্চনার হাহাকার। চরিত্রহীন একটি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশ পরিচালনায় রয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে ‘খারাপ সরকার’টি।

‘নিখোঁজ গণতন্ত্র’ এ অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখছেন, ‘২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো একটি হেজিমনিক ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ান শাসনব্যবস্থা বা আধিপত্যশীল নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদী শাসন।’

একইভাই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ‘বাৎসরিক রিপোর্ট: বাংলাদেশ ২০২০’ তেও বাক স্বাধীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ নানা বিষয়ে এই দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সামনে এসেছে। আর ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। সর্বশেষ ৮ জুলাই প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনেও এসেছে নারী ও শিশু নির্যাতন, গণমাধ্যমের উপর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের চাপ প্রয়োগসহ নানা বিষয়।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ইতিহাসের বর্বরতম সরকারের চিত্র। প্রতিষ্ঠানের একটি তথ্য বলছে, ‘২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত অপহরণের শিকার হওয়া ৩১০ জনের মধ্যে মাত্র ৩৩ জন ফিরে এসেছেন।

ফিরে আসাদের সংখ্যা নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের পার্থক্য থাকলেও যারা ফিরে আসেন, তারা যেন স্বাভাবিক থাকতে পারেন না। একটা ভীতি, একটা ভীরু পরিবেশ বজায় থাকে চারপাশে। সংবাদপত্রে দেখি, তারা কেউ কথা বলতে চান না।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার বিপরীতে দলান্ধ, দুর্নীতিগ্রস্থ রাখার মধ্য দিয়ে এই ভীরু পরিবেশ স্থায়ী রাখার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মূল্যবোধ, মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ।

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ভীতি সারাদেশে ছড়িয়ে স্বৈরশাসনের সবরকম প্রতিবাদ রুখে দেওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। আর এই ভীতির সাম্রাজ্যে একমাত্র হুমকি তারেক রহমান-- যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আসন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে মানুষ।

সুদূর লন্ডনে বসে করোনাভাইরাসের শুরু থেকেই দেশের মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন তারেক রহমান। তার নেতৃত্বাধীন বিএনপির নেতাকর্মীরা সারাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিপন্ন মানুষকে তার নেতৃত্ব, নির্দেশনায় দেওয়া হয়েছে ত্রাণ, খাবার, নিত্যপণ্য। পুরো দল সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করে দেশের মানুষের সঙ্গে লড়াই করেছেন। আর এই বেঁচে থাকার কঠিন সময়েও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে আহত হয়েছেন অনেক সহকর্মী। নিমর্মভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন ত্রাণ কার্যক্রম। তবুও, মানুষের পাশেই আছে বিএনপি। তারেক রহমানের আবারও নির্দেশনা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।

পলিমাটির এই দেশের সাধারণ মানুষমাত্রেই জানেন আসন্ন ভবিষ্যতের নির্মাণ শুরু হবে তারেক রহমানের হাত ধরে। তারা জানেন যে খাল কেটে, বস্ত্র রপ্তানি করে, সার্ক গঠন করার মতো অগণিত উদ্যোগ ও নেতৃত্ব বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী করে তোলার অবিচ্ছেদ্য রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের ছেলেও সেই সাধারণ মানুষের মায়ামমতায় আশ্রিত। বহু দূরে বসে স্বদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বাংলাদেশে একদিকে ঝকঝকে উন্নতির ফানুস, আড়ালে লুটপাট আর জোর-জুলুম--এমন পরিস্থিতিকে আরও শাণিত করতে, রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদি সংঘের অন্যায়, অবাধ অপশাসনের যাত্রা আরও অব্যাহত রাখতেই; এই বিক্ষুব্ধ মানুষের, জনমানুষের নেতা তারেক রহমানকে টার্গেট করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বাংলাদেশবিরোধী শক্তি তার রাজনৈতিক জীবনের উন্মেষের সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এসেছে, রাজনীতিতে থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন মেজর জিয়াউর রহমান ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে, আবার যখন বাংলাদেশকে হারিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র প্রায় ঘনিয়ে এসেছিলো-- সিপাহী-জনতার সমন্বিত প্রতিরোধের মুখে তাদের বিজয়ী করেন জিয়াউর রহমানই। এরপর তাকে শহীদ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আবারও হারানোর চক্রান্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে নেতৃত্বে এসেছেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দেশের মধ্যাহ্নে নিয়ে এসে নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। অবিচল আপোষহীনতার মূর্ত প্রতীক বেগম খালেদা জিয়ার সেই সংগ্রামের পথ ধরেই বাংলাদেশকে জেতাবেন তারেক রহমান।

দেশে ভোট নেই, মানুষের অধিকার নেই, নারীর নিরাপত্তা নেই, প্রত্যেক মানুষকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে রেখে ‘ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রের’ পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চক্রান্তকে কেবলমাত্র তার নেতৃত্বই নস্যাৎ করতে পারে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ’ করে রাখার যে চক্রান্ত অব্যাহত আছে, তার শুরুটা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে টার্গেট করা হয়েছে।

এক-এগারোর সময় নির্যাতন করে তাকে মেরে ফেলার অপচেষ্টাও হয়েছে। ওই সময় আমার বাবা, বিএনপির সাবেক মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমান ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই সময় টিভিতে সংবাদ দেখে বলেছিলেন-- ‘মা দেশনেত্রী; দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাবা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, তাদের সন্তানের সাথে এভাবে আচরণ করছে, এইটা ফেস করতে হবে, ভাবিনি। তার বাবা তো দেশ স্বাধীন করেছেন।’

বাংলাদেশের জন আকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল ও দলের সর্বস্তরে এখন অটুট ঐক্য। কেবল জাতীয়তাবাদী আদর্শবাদীরাই নয়, তিনি নতুন প্রজন্মেরও প্রত্যাশার প্রতীক। যিনি তারুণ্যকে ভাস্বর করে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ভাবী রাষ্ট্রপ্রধান। এইসব দেশপ্রেমের নৈকট্য আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারে না-- যাদের হাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ হয়, যাদের হাতে বিনাবিচারে বিনাকারণে মানুষ গুম হয় আর যারা উন্নয়নের আড়ালে দেশবিক্রি করে দেয়। পৃথিবী বহুবার স্বৈরশাসনের অবসান দেখেছে। জনগণ ক্ষিপ্ত, জীবন বিপন্ন। এই ব্যর্থতায় ক্ষমতাহারানোর ভয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছে শাসনকক্ষ। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে যে ষড়যন্ত্রমূলক অপ্রচারণা চলছে, সেগুলো একছকে বাঁধা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও এই ‘সংঘবদ্ধ ছকে’ই মঞ্চায়িত হয়েছে বাংলাদেশকে ব্যর্থ করে দেওয়ার সব ষড়যন্ত্র। আর বারবারই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি তা পরাজিত করেছে।

— লেখক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক 

বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংস্কারক শহিদ জিয়া

 

-----------------------------------------

ওয়াসিম ইফতেখার 

-----------------------------------------



'নারীরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী' — তাঁদেরকে কর্মহীন রেখে দারিদ্র বিমোচন ও সমৃদ্ধি অসম্ভব। নারীর সক্ষমতাকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদেরকে দেশ বিনির্মাণের হাতিয়ারে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম উপলব্দি করে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করেন  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীদেরকে উন্নয়ন উৎপাদনে সম্পৃক্ত করাই আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। আর এইভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ও ভবিষ্যতমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে  শহীদ জিয়া হয়ে ওঠেন ‘আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি’। 

ঐতিহাসিকভাবে রক্ষণশীল বাংলাদেশে নারীরা সাধারণত ঘরেই অবস্থান করতেন এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদেরকে সম্পৃক্ত করার কোন উদ্যোগই ছিলনা। নারীদের সচেতন করে তাঁদেরকে ঘর থেকে বের করে পড়ালেখায় ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেই কাজটি করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। সেই লক্ষ্যে তিনি আইন প্রণয়ন  ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আর এভাবেই বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সংস্কারক শহীদ জিয়া। 

পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদশাহীর আমলে শহীদ জিয়া প্রণীতসব যুগান্তকারী উদ্যোগের মতো নারীউন্নয়নের কর্মসূচিও থেমে যায়। বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে জিয়া প্রণীত 

নারীউন্নয়ন কর্মসূচিকে বৈপ্লবিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যান।  

দেশের উন্নতিতে নারীদের গুরুত্ব তুলে ধরতে শহীদ জিয়ার উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। 

তিনি বলেন  — 

“দুটি সবল হাত থাকলে একটা কাজ যত সহজে করা যায়, একহাত সে কাজ অসম্ভব হতে পারে। পুরুষ এবং মহিলা সমাজের দুটি হাতের মতন। দেশকে মনের মত গড়তে হলে দু’টি হাতেরই দরকার এবং দুটোকেই সবল হতে হবে।” 

সূত্র —  দৈনিক দেশ/ জানুয়ারি ৩০, ১৯৮১। 



নারীদের চাকুরীর ব্যবস্থা করতে শহীদ জিয়া বিশেষ পদক্ষেপ নেন। যেমন —   নারীদের জন্যে সরকারি চাকরিতে শতকরা ১০ ভাগ পদ নির্ধারিত করে নির্দেশ জারি করেন। শিক্ষকতাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে যতদিন না মহিলাদের কোটা পূরণ হয় ততদিন কেবল মেয়েদেরই নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। ফলে মেয়েদের কোটা পূরণ হতে বেশি সময় লাগেনি।

১৯৭৮ সালে প্রথম  মহিলা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং মহিলা মন্ত্রী নিয়োগ করেন।

প্রথম মহিলা কর্মজীবী হোস্টেল নির্মানের ব্যবস্থা করেন । অনেক কর্মজীবী মহিলারা এতে উপকৃত হয়েছেন এবং চাকরিকালে তাঁদের বাসস্থানের সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়।

তিনি নারী সমাজকে স্বনির্ভর করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতেন যে মেয়েরা নিজেরা যদি উপার্জনক্ষম হয়, তাহলে সেই পরিবারের সকলের কাছে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যাবে এবং নারীদের উপর অযথা হয়রানি ও অত্যাচার কমে যাবে।

তিনি বুঝতেন মেয়েরা শিক্ষিত হলে সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও শিক্ষিত হবে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস এবং সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি মেয়েদের গ্রামপ্রতিরক্ষা দলেও অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর সময়েই গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীতে ৩৫ লাখ মহিলা সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়া বিশ্বাস করতেন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাঁদেরকে এগিয়ে নিতে হবে।

আনসার, পুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ দেন জিয়া। 

তিনি অনুধাবন করেছিলেন ক্রমবর্ধমান অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রনে ও নারীর ক্ষমতায়নে প্রশাসনের মূলধারাতে নারীদের অংশ গ্রহণ সমাজকে এগিয়ে দেবে। 

বর্তমানে সেনাবাহিনীতে নারীরা যোগ দিচ্ছেন। শুধু ডাক্তার বা নার্স হিসাবে নয়, সরাসরি যোদ্ধা হিসাবে, গোলন্দাজ বা কমিউনিকেশন ইউনিটে অফিসার হচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু ১৯৮০ সালেই জিয়াই নিয়ে ছিলেন। উনি খুব স্পষ্ট ভাষাতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন —  ‘ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর জন্য মেয়েদের প্রস্তুত হতে হবে।’ 

প্রতিটি জনসভাতেই তিনি মেয়েদেরকে শিক্ষিত হতে বলতেন। তাঁদেরকে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতেন যেন তারা স্বাবলম্বী হয়, কোন না কোন কাজ করে যেন তারা সংসারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে সেইসব পরামর্শ দিতেন।

তাঁর ভাষাতে — 

“আপনারা জেগে উঠুন; আপনারা আমাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনারা  সক্রিয়ভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করুন, আপনাদের স্বামীদেরকেও বাধ্য করুন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য।” 

পরিবার পরিকল্পনার কথা এই দেশে এক সময় ভাবাই যেতো না। অথচ জিয়া আগামীর সমস্যা সবাইকে বুঝিয়ে এই দেশে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প হাতে নেন। মিশরের গ্রান্ড ইমামকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন দেশে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেন নাজায়েজ নয়, তা বিস্তারিত বুঝিয়ে ছিলেন অতি রক্ষণশীলদের।

চট্টগ্রামের মত রক্ষণশীল এলাকাতেও তিনি এমনি ভাবেই কথা বলতেন এবং মেয়েরাও তাঁর কথাতে প্রাণ পেতো, উল্লসিত হতো, তিনি যে মেয়ের মনের কথাগুলিই বলতেন তা বোঝা যেতো মেয়েদের উল্লাস মুখর আর আন্তরিক হাততালির ধ্বনি থেকে।

মহিলাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস তিনি জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পুরুষ ও মহিলা সব্বাইকে দেশের উন্নয়নের কাজে শরিক করতে। 

তাঁর কথায় — 

“সেই জন্য আমাদের পার্টিতে মহিলা অঙ্গ দল, যুব মহিলা অঙ্গ দল আছে এবং জাতীয়তাবাদের যে চেতনা রয়েছে,আমাদের যে আদর্শ রয়েছে তাতে আমরা সকলকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। আমাদের ধর্মও বলে যে কাজের বেলাতে পুরুষ ও মহিলা সব সমান।”

মেয়েদেরকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাতে সম্পর্কে সচেতন হতে তিনি সব জনসভাতেই সর্বদা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলতেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা একই সূত্রে গাঁথা। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে স্বাস্থ্য থাকবে না। তাঁর আগে আর কোন নেতা মহিলাদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে কোন সক্রিয় মনোভাব বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে অগুনতি মহিলা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে জিয়ার আরো একটি কাজ আমাদের জানা থাকা খুব প্রয়োজন। বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তাঁর সময় থেকেই মেয়েদের আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হয়। 

—  লেখক ব্লগার, ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ও গবেষক   

তথ্য সুত্র ও কৃতজ্ঞতা —  

বিচিত্রা, দৈনিক ইত্তেফাক  

এস আব্দুল হাকিম, সাবেক মহা পরিচালক, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা