——— অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান
লেখাটি যখন লিখছি তখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেবল রাজধানী ঢাকা নয় সারাদেশেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। ইতোমধ্যে, ২০২৩ সালেই সরকারি তথ্য মতেই ১১৪ জন মানুষ মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার। বাস্তব সংখ্যা অনেক বেশি। আজই খবর ছড়িয়ে পড়েছে শেখ ফজলে নূর তাপস সপরিবার রয়েছেন ১৭ দিনের বিদেশ ভ্রমণে। অন্যদিকে অবৈধ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক রয়েছেন বিদেশ সফরে। ২০১৯ সালেও ডেঙ্গু সঙ্কটের সময় তিনি বিদেশ চলে গিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দিন যতো যাচ্ছে ততোই এর বাহক এডিস মশা তার চরিত্র বদলাচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি কামড়ানোর সময়ও বাড়িয়েছে। এখন এ মশা রাতের বেলাতেও কামড়াচ্ছে। এর ফলে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তিতে বসবাসের কথা ভাবছে তখন নাগরিক নানা বঞ্চনার পাশপাশি যোগ হয়েছে ডেঙ্গু আক্রমণ। এতে নাগরিকদের স্বস্তির সেই স্বপ্ন এখন দু:স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সেইসঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীর মেয়রদের অবহেলা ও দায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতায় ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ বিস্তার। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, মেয়ররা সারা বছর মশা নিমূলে কোনো কাজ করেন না। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন রাজধানী ঢাকার দুই মেয়র। এর মধ্যে আবার উত্তরের চেয়ে দক্ষিণের মেয়রের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ বেশি। তিনি চেয়ারে বসার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এই ধরণের রুটিন কাজগুলোয় অনেকটা ভাটা পড়ে। অথচ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম মশা নিধন। এ খাতে বিপুল বাজেট থাকলেও সে তুলনায় যৎসামান কাজই চোখে পড়ে সারা বছর।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, সারা বছর চুপচাপ থাকা মেয়ররা এখন দৌড়ঝাপ করছেন। অথচ তাদের রুটিন কাজ চালিয়ে গেলে এখন বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ প্রকোপ দেখতে হতো না।
পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং সারা বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০০।
এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও কয়েক গুণ খারাপ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য প্রজননস্থলের সংখ্যা সর্বোচ্চ। এ বছর এখন পর্যন্ত ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে পুরো আগস্ট মাসটিতে এই ভয়াবহতা আরো উর্ধমুখী থাকবে।
এখন পর্যন্ত ল্যাবরোটোরিতে গবেষণার যে ফলাফল দেখা গেছে তাতে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের এই শঙ্কার যায়গাটি যদি সত্যি হয় তাহলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে তা ভাবতেও গা শিউরে উঠছে।
এবার বর্ষা শুরুর আগে থেকেই এডিস মশাবাহিত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। চলতি বছর গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ৯ হাজার ৮৭১ জন। গত মঙ্গলবার দেশে ৬৭৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা এ বছরের সর্বোচ্চ।
মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন এবং জুন মাসে ৫৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চলমান দূর্নীতি ও নগর ব্যবস্থাপনায় থাকা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বহীনতায় গত ছয় মাসে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে পঞ্চাশ জনের বেশি সাধারন মানুষ, যাদের মধ্যে নিস্পাপ শিশুও রয়েছে। শুধুমাত্র জুন মাসেই মারা গেছে ৩৪ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী।
এ বছর এডিস মশা শনাক্তে চালানো জরিপে ঢাকায় মশার যে উপস্থিতি দেখা গেছে, তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় সামনে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। সম্প্রতি এক জরিপে ঢাকার ১১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৭টিতে ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে দূর্নীতির পরিধি বাড়াতে ‘ড্রোন ব্যবহার করে’ মশা নিয়ন্ত্রনের প্রচলন করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন যা চট্টগ্রামেও অনুসরন করা হয়েছে। সাধারন মানুষের অর্থ ব্যয় করে উচ্চাভিলাসী প্রকল্প গ্রহন করে দুর্নীতির নতুন ক্ষেত্র বের করছে সরকারের সুবিধাভোগীরা।
তার বিপরীতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করছে প্রতিনিয়ত। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ১ শতাংশেরও কম। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে এমনকি প্রতিবেশী দেশেও এ খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
মশা নিয়ন্ত্রণে গত ৬ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ব্যয় করেছে প্রায় ৩৮৭ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তরের মেয়র সম্প্রতি স্বীকার করেছেন রাজধানীর মশা নিধনে এতদিন যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটি ভুল ছিল। জনগণের টাকা লুট করার পরে ‘পদ্ধতিকে দোষারোপ’ করে আওয়ামী সুবিধাপুষ্ট মেয়ররা কোনভাবেই মানুষের প্রাণহানির দায় এড়াতে পারেনা। ডেঙ্গুতে প্রাণহানি কমানো এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোগী দ্রুত শনাক্ত জরুরি। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার কথা বললেও নেয়া হচ্ছে না তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ। নাগরিকের করের টাকায় চলা স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়, সিটি কর্পোরেশনে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে অভিগম্যতা অনেকটাই কম।
ডেঙ্গুর এই মহামারী পরিস্থিতিতে যেখানে র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে দ্রুত সনাক্ত করা প্রয়োজন, তার বিপরীতে হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেঙ্গু পরীক্ষার নামে কয়েক ধাপে অর্থ দিতে হচ্ছে সাধারন নাগরিকদের। যেটা অতি অমানবিক। আওয়ামীপপন্থি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লুটপাটের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে সারা দেশের সকল সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য বলছে, রবিবার ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৩ জন। এ নিয়ে এ মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণকারীর সংখ্যা ৭৬ জন। এছাড়া রবিবার একদিনে আরও ৮৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৭৪ জন আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩১৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩২৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঢাকার ৫৩ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ২০৮০ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ১১৭৩ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮৪৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৯ হাজার ৬৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪ হাজার ১৭৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ হাজার ৫১৪ জন। ঢাকায় ৭ হাজার ৫২৫ এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৯৮৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু।
ঈদুল আযহার লম্বা ছুটির পর ৯ জুলাই রবিবার থেকে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরো বেড়ে গেলো। বিশেষ করে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে খ্যাত এলাকাগুলোর বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এ চরম উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতায় সময় পার করছেন অভিবাবকরা।
লুটপাট আর অর্থ পাচারের মহোৎসবের দেশে স্বাস্থ্য খাতের এমন পঙ্গু দশার বিষয়টি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। স্বয়ং মন্ত্রী যেখানে লুটপাটের প্রধান সেখানে সরকারের আমলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতারাতো বেপরোয়া হবেই। তাইতো জনগণের টাকার সিংহভাগ এ খাতে বরাদ্দ রেখেও দিন দিন তলানীতে গিয়ে ঠেকছে স্বাস্থ্য সেবা। আর জবাবদিহিহীন ঢাকার সিটি মেয়রদের ক্ষেত্রেতো বিষয়টি আরো খোলামেলা।
জনগণের ভোটকে পাশ কাটিয়ে চেয়ারে বসা মেয়ররা যে জনগণের ভালোমন্দের বিষয়টি ভাবে না এর চেয়ে বড় প্রমান আর কি হতে পারে। তাইতো সময় এসেছে এইসব তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। জনগণের করের টাকায় চলা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বজ্ঞানহীন শীর্ষ পদধারীরা কখনো নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করবে না। কেননা তাদের অনুপ্রেরণার যিনি বাতিঘর তার ডিকশনারীতে ‘লজ্জা’ কিংবা ‘দায় স্বীকার’ নামক কোনো শব্দ নেই।
————————————