Search

Tuesday, February 5, 2019

গায়েবি মামলা — গাড়ি পোড়ানোর আসামি দৃষ্টিহীন কেরামত আলী!


সুপ্রিম কোর্টের বর্ধিত ভবনের সামনের লনের গাছতলায় বসে হাঁপাচ্ছিলেন ৭০ বছরের কেরামত আলী। বসেছিলেন কুঁজো হয়ে, লাঠিতে ভর করে। একটু পর পর কাঁপছিলেন। গাঢ় কালো রঙের চশমা পরা শ্মশ্রুমণ্ডিত কেরামত চোখে দেখেন না। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতেও পারেন না। বয়সের ভারে শরীরও ভেঙেছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে।  কুঁচকে গেছে শরীরের চামড়া। কথা বলে জানা গেল, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ১০ নম্বর খেরুয়াজানি ইউনিয়নের বন্ধ গোয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা কেরামতের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে। আগাম জামিন নিতে গতকাল সোমবার তিনিসহ হাইকোর্টে এসেছিলেন এ মামলায় নাম থাকা স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকরা। বৃদ্ধ কেরামত জানান, তিনি বিএনপির সমর্থক হলেও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। ঘর থেকে বের হওয়ার মতো সামর্থ্যও তার নেই। মামলায় তার নাম আসায় বিস্মিত অন্যরাও।

কেরামত ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর মুক্তাগাছা থানায় বিএনপির ৪০ নেতাকর্মীর নামে একটি মামলা (নম্বর- ২৪) হয়। এ মামলায় কেরামতকে ৩৮ নম্বর আসামি করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, গত ২২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তাগাছা পৌরসভার আলাউদ্দিন কেন্দ্রীয় পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে নৌকা সমর্থক একজনের মোটসাইকেলে আগুন দিয়েছেন কেরামত ও অন্য আসামিরা। এছাড়া তারা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এলাকায় আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। তারা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ (৩) ধারাসহ দণ্ডবিধির ১৪৩, ১৪৭, ১৪৮ ও ৪২৭ ধারায় অপরাধ করেছেন।

গতকাল সুপ্রিম কোর্টে স্বজনদের কথা জানতে চাইলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন কেরামত আলী। পরে জানান, দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। দুই দশকের বেশি সময় আগে ১৮ বছরের শরীফুল ইসলাম কিডনিজনিত জটিলতায় মারা যায়। কয়েক বছর পর শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট ছেলে ফরিদুলও মারা যায়। চার বছর আগে তাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন স্ত্রী আসিয়া খাতুনও। সেই থেকেই তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ। পুত্র-স্ত্রী শোকে কাতর কেরামতকে এখন দেখার কেউ নেই। দরিদ্র দুই ভাই গিয়াসউদ্দিন ও আবদুল মজিদ অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দুই ভাইকে নিজের শেষ সম্বল গ্রামের বাড়ির পাঁচ শতক জমি দান করে দিয়েছেন কেরামত।  বিনিময়ে তাকে তিনবেলা খাবার ও পরনের কাপড় দেওয়া হয়। চোখে ছানি পড়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই একপ্রকার অন্ধের জীবনযাপন করছেন কেরামত। সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হলেও সেই চোখের আলো পুরোপুরি ফেরেনি। দুই হাত দূরের জিনিসও দেখতে পান না। এখন লাঠি ও অন্যের সাহায্যই ভরসা কেরামতের। তিনি জানান, মামলার কারণে গ্রেপ্তার ও হয়রানির ভয়ে নির্বাচনের আগে একমাস তাকে আত্মীয়ের বাড়িসহ এখানে-সেখানে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।

কেরামত আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাবারে দুনিয়াতে আমার কেউ নাই। আমারে দেখার কেউ নাই। আমি রাজনীতি বুঝি না, রাজনীতি করিও না। কিন্তু আমারে ক্যান এই মামলায় জড়াইলো জানি না। আমি ন্যায়বিচার চাই।’ তার সঙ্গে আসা দূর সম্পর্কের ভাতিজা সাইফুল আজিজ (তিনিও একই মামলার আসামি) বলেন, ‘নির্বাচনের আগে করা গায়েবি মামলায় এই বৃদ্ধ লোকটাকেও আসামি করা হয়েছে। এই বয়সে অসমর্থ শরীর নিয়ে তিনি নাকি মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছেন, মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘উনার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। এই বয়সে একজন বৃদ্ধ লোককে এভাবে হয়রানি করতে দেখে আমাদের নিজেদের খারাপ লাগছে।  আজ (গতকাল) আগাম জামিন পেলেও এই মামলার হয়রানি থেকে সহসাই তিনি রেহাই পাবেন এমন মনে হচ্ছে না। কেননা জামিনের মেয়াদ শেষে আবারও তাকে আদালতে আসতে হবে।’

এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুক্তাগাছা থানার এসআই (উপপরিদর্শক) মো. রফিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেরামত আলী অসুস্থ চোখে দেখেন না এ বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না। তদন্তে যাচাই-বাছাই হচ্ছে। তদন্ত শেষে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
  • দেশ রুপান্তর/ ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

গায়েবি মামলা — স্ট্রেচারে করে এলেন হাইকোর্টে


উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে দেখা গেল এক ব্যক্তি শুয়ে আছেন। দুই হাত ও দুই পায়ে ব্যান্ডেজ। বাম পায়ের তিনটি আঙুল কাটা। কিছুদিন   আগে জোড়া লেগেছে দেখলে বোঝা যায়। এমনই এক দৃশ্য দেখা গেল হাইকোর্টের এ্যানেক্স ভবনের সামনের খোলা জায়গায়। নাশকতার মামলায় আগাম জামিনের জন্য এসেছিলেন কৃষক তছিরউদ্দিন মণ্ডল। বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ওমেদপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি।

আর্থিক সংকটের কারণে একটি বাসের পাশাপাশি দুটি সিট ভাড়া নিয়ে শুয়ে ঢাকায় আসেন। একইভাবে ফিরেও গেছেন। হাইকোর্টে উচ্চ আদালতে তছিরউদ্দিন মণ্ডলসহ শৈলকূপার ২৩৬ জনের চার সপ্তাহের আগাম জামিন হয়েছে গতকাল। বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ১৩টি পৃথক জামিন আবেদনে তাদের এ আগাম জামিন দেন। এ সময়ের পরে তাদের ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় তছিরকে গাবতলী টার্মিনাল থেকে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হয় উচ্চ আদালতে। স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয় এ্যানেক্স ভবনের দো’তলায়। গত বছরের ১৫ই ডিসেম্বর ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানায় ৭০ জনকে আসামি করে একটি গায়েবি মামলা দেয়া হয়। এই মামলার আসামি তছিরউদ্দিন মণ্ডলও। 

তছিরউদ্দিনসহ অন্য জামিন আবেদনকারীদের আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, মামলাগুলো গায়েবি। সরকারদলীয় লোকজনই এদের মেরেছে, নির্যাতন করেছে ও কুপিয়েছে। আবার তারাই মামলা করেছে। হাইকোর্ট ১৩টি পৃথক আবেদনে ২৩৬ জনকে আগাম জামিন দিয়েছে। 

তছিরউদ্দিন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মামলার পর থেকে রয়েছেন বাড়ির বাইরে। থাকছেন এক আত্মীয়ের বাসায়। তার দুই সন্তান। বড় ছেলে কলেজে পড়ে। ছোট ছেলের বয়স দুই বছর। অভাবের সংসার। টাকার অভাবে নিজের সামান্য জমিটুকুও বন্ধক দিয়েছেন। এগুলো দিয়ে টেনে টুনে চলছে সংসার। অর্থের অভাবে ছেলের পড়ালেখাও বন্ধের উপক্রম। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছেন না তছিরউদ্দিন। 

গতকাল এ্যানেক্স ভবনের দো’তলায় তছির মানবজমিনকে বলেন, আমি দিন আনি দিন খাই। আমি কোনো রাজনীতিও করি না। নির্বাচনের পরে উমেদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান সাব্দার হোসেন মোল্লা গ্রুপের লোকজন আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। পরে নাশকতার মামলায় আমাকে আসামিও করেছে। তিনি জানান, কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় তিনি ১৩ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করলেও গত দেড় মাসে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আমি চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারছি না। খুব অসহায় জীবন যাপন করছি। 

জানা যায়, নির্বাচনের দুইদিন পর তছিরউদ্দিনের নিজ গ্রাম কৃষ্ণপুরে মারামারি হয়। এ সময় গুরুতর আহত হন তিনি। তার এক পা ও এক হাতের হাড় অনেকটাই ভেঙে গেছে। গত একমাস ধরে বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ঘটনার পর স্থানীয় হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তছিরউদ্দিন। 

একাদশ জাতীয় নির্বাচন চলাকালীন সময় শৈলকূপা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলায় ৩১১ জনকে আসামি করা হয়। রোববার রাত ১০টায় ঝিনাইদহ থেকে উচ্চ আদালতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারা। সকাল ৭টায় নামেন গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে। সকালের নাস্তা শেষে বাসে করে উচ্চ আদালতে আসেন সবাই। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অনেকেই রাজি হন নি। আবার কেউ কথা বললেও নিজের নাম জানান নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের মধ্যে একজন বলেন, মামলার কারণে দেড় মাস বাড়ির বাইরে। নাম বললে তো আর বাড়ি যাইতে পারুম না। এমনেই বাড়ি ছাড়া, পরিবার ছাড়া। আমার নামে কেন মামলা দিছে সেটাই জানি না। জীবনে কোনোদিন কোর্টের বারান্দায় আসা লাগেনি। ৫৫ বছরের তোফাজ্জল পেশায় কৃষক। তাকেও একই নাশকতার মামলায় আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় বিএলকে বাজারে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আগুন দেয়ার কথিত ঘটনা ঘটে রাত আড়াইটায়। তখন তোফাজ্জল ছিলেন ঘটনাস্থল থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে তার কদমতলা গ্রামের বাড়িতে। 

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একজন বলেন, নির্বাচনের সময় তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। সবাই যখন মামলার বিষয়ে আমাকে বললো। আমি কারো কথা বিশ্বাস করি নাই। কারণ আমি একজন কৃষক। সারাদিন আমি থাকি মাঠে ঘাটে। আমি তো আর রাজনীতি করি না। তাই ভাবছি আমার নামে মামলা হবে কেন। পরে পুরো বিষয় জানার পর দেড় মাস ধরে বাড়ির বাইরে রয়েছি। কিভাবে যে দিন কাটাচ্ছি একমাত্র আল্লাহই জানে। আমার দুটি সন্তান। তারা স্কুলে পড়ে। পরিবারের অভাব অনটনের কারণে তাদের লেখাপড়া এখন বন্ধ হওয়ার পথে। আমার বউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে এখন সংসার চালাচ্ছে। 

মামলার বিষয়ে শৈলকূপা থানার পরিদর্শক আইয়ুবুর রহমান বলেন, নির্বাচনের আগে-পড়ে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। সবগুলোরই তদন্ত চলছে। ঘটনার সময় না থেকেও এই মামলায় অনেকে আসামি হয়েছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তথ্য প্রমাণের উপরে সবার নামে মামলা হয়েছে। আর মামলার তো তদন্ত চলছে। যদি এর মধ্যে কেউ নির্দোষ হয় তাকে তাকে অবশ্যই বাদ দেয়া হবে। 
  • মানবজমিন/  ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিশ্বের অর্ধেক গরিব বাংলাদেশসহ পাঁচ দেশে

  • বিশ্বের অর্ধেক গরিব থাকে পাঁচটি দেশে 
  • এসব দেশের একটি বাংলাদেশ
  • বাংলাদেশে ৩ শতাংশ গরিব লোকের বাস


পাঁচটি দেশেই বিশ্বের অর্ধেক গরিব লোক বাস করে। এই দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বাকি দেশগুলো হলো ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) যাঁদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তাঁদের হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে এখন দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম আয় করেন এমন দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৭৩ কোটি ৬০ লাখ। তাঁরা হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচিত। এর মধ্যে উল্লেখিত পাঁচটি দেশেই বাস করে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ গরিব লোক। এই হিসাব ২০১৫ সালের ভিত্তিতে তৈরি করা। তখনকার হিসাবে ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি—২৪ শতাংশ গরিব লোক থাকে। এ ছাড়া নাইজেরিয়ায় ১২ শতাংশ, কঙ্গোতে ৭ শতাংশ, ইথিওপিয়ায় ৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৩ শতাংশ গরিব লোকের বাস।

বিশ্বব্যাংক ২০১৮ সালে এসে ওই পাঁচটি দেশে কত গরিব লোক বাস করে, সেই হিসাবও দিয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী, এরা গরিব। এ ছাড়া ভারতে ৯ কোটি ৬৬ লাখ, নাইজেরিয়ায় ৯ কোটি ৯২ লাখ, কঙ্গোয় ৬ কোটি ৭ লাখ এবং ইথিওপিয়ায় ২ কোটি ১৯ লাখ গরিব মানুষ বাস করে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য নির্মূল বা জিরো পভার্টির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মানে হলো সারা বিশ্বের দারিদ্র্য হার ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিশ্বের অর্ধেক গরিব লোকের বসবাস করা পাঁচটি দেশ গরিবি হটানোর যুদ্ধে কতটা জয়ী হবে, এর একটি প্রক্ষেপণও দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালে জিরো পভার্টির যুগেও নাইজেরিয়ায় ৯ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ গরিব থাকবে। অর্থাৎ গরিবি হটানোর যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না দেশটি। এরপরের স্থানেই থাকবে কঙ্গো। সেখানে ৭ কোটি ১৫ লাখ গরিব মানুষ থেকে যাবে। এ ছাড়া ইথিওপিয়ায়ও দেড় কোটি গরিব মানুষ বাস করবে। এ ছাড়া ভারতে ৩৫ লাখ এবং বাংলাদেশে ৮ লাখ ৩০ হাজার গরিব মানুষ গরিব থাকবে ২০৩০ সালে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স বলেছে, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম। গত বুধবার একই প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে।

  • প্রথম আলো/০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Sunday, February 3, 2019

বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে পারলেই গণতন্ত্রের মুক্তি মিলবে — খুলনায় বিএনপি নেতারা

‘জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ : অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় খুলনায়  বিএনপি নেতারা।


বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ভোট ছিল না, সম্পূর্ণ ভোট ডাকাতি হয়েছে। তার নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকার গণতন্ত্রকে নিপীড়ন করেছে। নির্বাচনে তাদের বিজয় উল্লাস পাশবিক শক্তির উল্লাস। নির্বাচনী মাঠে তাদের সামান্যতম মানবিক মূল্যবোধ ছিল না। যারা জয় লাভ করেছে, তারা কেউ জনগণের প্রতিনিধি নয়। রাজনীতি যদি সত্য হয়- ভবিষ্যতে তারা মহা ভোট দখলের জন্য মহা বিপর্যয়ে পড়বে। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপির হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই বলে দাবি করেছেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান। কারণ এ নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, ধ্বংস হয়েছে নাগরিকদের ভোট দেয়ার অধিকার। নাগরিকরা হারিয়েছে রাষ্ট্রের মালিকানা। সমস্ত রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতির মাধ্যমে দেশের ও গণতন্ত্রের সর্বনাশ করেছে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে গণনিপীড়ন করেছে। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য এই সরকারকেই মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে বলে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি। 

খুলনায় ‘জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ : অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শাহজাহান এ কথা বলেন। 

শনিবার, ফেব্রুয়ারি ০২, খুলনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিক আলহাজ লিয়াকত আলী মিলনায়তনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি খুলনা বিভাগের ব্যানারে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে একাদশ সংসদ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেবার কারণে শাসক দলের রোষানলে পড়ে ক্ষতির শিকার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশের প্রতিটি বিভাগে সাংগঠনিক সফর ও সভা করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। সাত বিভাগীয় সদরের জন্য পৃথক পৃথকভাবে গঠিত হয় সাতটি কমিটি। খুলনা বিভাগীয় সভার মাধ্যমে এ কার্যক্রমের সূচনা হলো। 

খুলনার এ সভায় জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে খুলনা বিভাগের নেতৃবৃন্দ, বিভাগের ১০ জেলা ও এক মহানগর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ, বিভাগের ৩৬ টি আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। তবে শুরুতেই নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার দলীয় ক্যাডার ও পুলিশী নির্যাতনের শিকার বিএনপির দুই মহিলা ও এক পুরুষ কর্মী বক্তব্য রাখেন। তাদের ওপর চালানো নির্মমতার অশ্রুসজল বর্ণনা দিতে গিয়ে মিলনায়তনে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। 

বিএনপি নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এ দেশে যদি প্রথম কেউ সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে তবে সেই দলটি হলো আওয়ামী লীগ। এরা কখনোই জনগণের ওপর আস্থাশীল নয় বলেই যে কোন উপায়ে ক্ষমতা দখলে রাখতে চায়। ’৭৩ এর নির্বাচনের পর তারা একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। যা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। নিপীড়িত নির্যাতিত তৃণমূলের কর্মীদের পাশে থেকে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 

মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অনেকেই মনে করেছিলেন ’১৪ সালের নির্বাচনে না যেয়ে বিএনপি ভুল করেছিল। কিন্তু এবারের ভোটের মধ্য দিয়ে সেই ভুল ভেঙেছে। প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী দল এবং তাদের অধীনে কোন অবাধ সুষ্ঠু ভোট হতে পারে না। 

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন,  দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, দলের জন্য তার ত্যাগের তুলনায় আমাদের ত্যাগ কিছুই নয়। তিনি মুক্তি পেলেই গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরে আসবে। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সভাপতিত্বে এবং সহ সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জয়ন্ত কুমার কুন্ডুর পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান, উপদেষ্টা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক সোহরাবউদ্দিন, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক প্রফেসর ড, ওবায়দুল ইসলাম, যশোর-১ আসনের প্রার্থী মফিকুল হাসান তৃপ্তি, বাগেরহাট-১ আসনের প্রার্থী শেখ মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় তথ্য বিষয়ক সম্পাদক ও খুলনা-৪ আসনের প্রার্থী আজিজুল বারী হেলাল, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কুষ্টিয়া-২ আসনের প্রার্থী আহসান হাবিব লিংকন, এনপিপির চেয়ারম্যান ও নড়াইল-২ আসনের প্রার্থী ড. ফরিদউদ্দিন ফরহাদ, খুলনা জেলা বিএনপি সভাপতি এ্যাড. এস এম শফিকুল আলম মনা, খুলনা-৩ আসনের প্রার্থী আলহাজ রকিবুল ইসলাম বকুল, যশোর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, মাগুরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক মো. আক্তারুজ্জামান, কেন্দ্রীয় সহ তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুল, নড়াইল বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, ঝিনাইদহ-৪ আসনের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, কুষ্টিয়া-৩ আসনের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকার, ঝিনাইদহ-২ আসনের প্রার্থী এ্যাড. এম এ মজিদ, বাগেরহাট জেলা বিএনপি সভাপতি এম এ সালাম, সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সভাপতি রহমতউল্লাহ পলাশ, মেহেরপুর-২ আসনের প্রার্থী জাভেদ মাসুদ মিল্টন, যশোর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. সাবেরুল হক সাবু, মেহেরপুর-১ আসনের প্রার্থী মাসুদ অরুন, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের প্রার্থী শরীফুজ্জামান শরীফ। হামলা ও নির্যাতনের শিকার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়ন বিএনপি নেতা রুহুল আমিন বিশ্বাস, খুলনা জেলা মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড. সেতারা সুলতানা এবং দৌলতপুর থানা বিএনপি নেত্রী সাথী বেগম তাদের ওপর চালানো নির্যাতনের মর্মন্তুদ বিবরণ দেন।  
  • দিনকাল/ ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রশূন্য — রুহুল কবির রিজভী


রোববার, ফেব্রুয়ারি ০৩, রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, একদলীয় শাসন নিরাপদ করতেই খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়া হাজার হাজার ‘মিথ্যা’ মামলায় বিএনপির লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে জড়ানো হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রশূন্য। গণতন্ত্রহীনতায় বাংলাদেশের জনগণ এখন রাষ্ট্র-দাসত্ব করছে।

সংবাদ সম্মেলনের পূর্ণপাঠ নিচে দেওয়া হল -

সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আস্সালামু আলাইকুম। সবাইকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।

মানুষ অজানাকে জানার জন্য প্রয়োজন হয়েছে চিন্তার স্বাধীনতার। ‘দুর্গম পর্বত চুড়া, অন্ধকার অরণ্যানী, দূরবিস্তৃত মরুভূমি, বরফে মোড়া মেরুপ্রদেশ, গভীর সাগরতল, সীমাহীন আকাশ’-কোন কিছু সম্পর্কেই সে অজানা থাকতে চায় না। পৃথিবীতে দর্শন, রাষ্ট্রদর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সমাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বিশ^মনিষীদের চিন্তা, নিজের মত এবং অন্যের মতের সাথে বিতর্ক সবকিছু মিলিয়ে চিন্তার স্বাধীনতা মানবসমাজকে অগ্রগতির পথে নিয়ে গেছে। চিন্তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয় নাগরিক স্বাধীনতা। আর নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর।

বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রশুণ্য। গণতন্ত্রহীনতায় বাংলাদেশের জনগণ এখন রাষ্ট্রদাসত্ব করছে। রাষ্ট্র এখন এক ব্যক্তি ও এক দলের কব্জায়। একদলীয় শাসনে রাষ্ট্র জনগণকে দাসে পরিণত করে। গণতন্ত্রক মৃত্যু যন্ত্রণায় ধুকতে ধুকতে শেষ নি:শ^াস ত্যাগ করে। বর্তমানেও সেই দশা বিরাজমান। এক ব্যক্তির একদলীয় শাসন নিরাপদ করতেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকানো হয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় বিএনপি’র লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীকে জড়ানো হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

গায়েবী মামলায় এমন মানুষদের জড়ানো হয়েছে যা শুধু অদ্ভুতই নয়, এটি নিষ্ঠুর তামাশা। কবরে শায়িত লাশ, পক্ষঘাতগ্রস্ত রোগী, হজ¦ব্রত পালনরত ব্যক্তি, বহুদিন ধরে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে নজীরবিহীনভাবে মামলার আসামী করা হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী তারা মিয়া, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে শামসুল হক যিনি মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে অচল এবং তিনি কানেও শোনেন না; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্গাচাষী মিলন মিয়া, ঢাকার আতর বিক্রেতা হাতকাটা ইউসুফসহ এধরণের অসংখ্য হতদরিদ্র ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদেরকে। এরা নাকি রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী। যে রাষ্ট্র এতো বিবেকহীন, মনুষ্যত্বহীন ও নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু কেবলমাত্র সেই রাষ্ট্রেই উল্লিখিত ব্যক্তিদের অপরাধী বানানো হয়। সুতরাং সেই রাষ্ট্র পরিচালকদের অর্থাৎ অবৈধ সরকারের পতনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা ন্যায়সঙ্গত। 

সাংবাদিকবৃন্দ, 
জনগণকে ফাঁকি দিয়ে ভুয়া ভোটের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার জন্যই গায়েবী মামলায় বিএনপি’র লাখ লাখ নেতাকর্মীদের জড়িয়ে উল্লিখিত হতদরিদ্র দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষদেরকেও মামলা দিতে দ্বিধা করেনি। এদের কারো কারো নামে দশ থেকে বারোটি মামলা। ক্ষমতাসীনরা ভোগ লালসায় অস্থির হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে গিয়ে তালবেতাল হয়ে অমানবিকতার পথ অবলম্বন করেছে। এরা মানবিক বিবেচনাগুলো পদদলিত করছে। সেইজন্য ক্ষমতা-আধিপত্যের রঙিন সম্প্রসারণে মেতে উঠেছে। 

গতকাল গণভবনে নির্বাচন পরবর্তী ‘২৯শে ডিসেম্বর রাতের ভোটের’ প্রধানমন্ত্রীর চা-চক্রে শেখ হাসিনার সদাহাস্য চেহারা ও সরকারের আনুকুল্য পাওয়া উৎফুল্ল উচ্ছিষ্ট রাজনীতিবিদ চেহারা দেখে মনে হয়েছিল তারা আনন্দে মাতোয়ারা। মহাভোট ডাকাতির পর অনুশোচনাহীন সরকারের চা-চক্রের এই আনন্দায়োজন দেখে একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়লো, সেটি হলো- Pleasure without conscience' মানে বিবেকহীন আনন্দ। এই আনন্দ একটি সামাজিক পাপ। গোটা জাতির সাথে নির্লজ্জ মহাতামাশার নির্বাচনের পর উল্লসিত সরকারের চা-চক্রের আয়োজন বিবেকহীন আনন্দেরই সমতুল্য। জনগণের সাথে প্রতারণাকারী সরকারের জয়ল্লোসের চা-চক্রে দেশের গণতন্ত্রমণা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণরত কোন রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করেনি। যারা জনগণের ভোট লুট করেছে তাদের সাথে গণতন্ত্রপ্রেমী কোন ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী কেউই সেই লুটের আনন্দের পাপে অংশগ্রহণ করেনি। এটাই জনগণের বিজয়। 

সুহৃদ সাংবাদিকবৃন্দ,
মহাভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর ভুয়া ভোটের সরকারের অনুগত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচনের ঘোষনা দিয়েছে। দুর্দশাগ্রস্ত গণতন্ত্রে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটুকু সুষ্ঠূ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে এ নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। যেখানে বিশ^বিদ্যালয়ের ‘ষ্ট্যান্ডার্ড’ বিচার করা হচ্ছে, জ্ঞানান্বেষণ বা সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে নয়, বরং চা-সমুচা ও আলুর চপ এর মুল্যে। পৃথিবীর দেশে-দেশে বিশ^বিদ্যালয়ের সার্বজনীন সজ্ঞায় ‘Freedom of learning’ এবং ‘Freedom of research' এর প্রত্যয় বিধৃত। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে To communicate the truth' অর্থাৎ সত্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। এটিই হচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়ের মূল ‘Academic tone'। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষাব্রতীদেরকে এই শিক্ষা স্বর থেকে দুরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। শেখার স্বাধীনতা, গবেষণার স্বাধীনতার মাধ্যমে সত্যের সন্ধান কখনোই নিশ্চিত হবে না, যদি সেখানে সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতার স্থান না থাকে। মুক্তকন্ঠে বিতর্কের স্বাধীনতা না থাকে। ক্যাম্পাসগুলো একদলীয় দু:শাসনের প্রবল প্রতাপের অংশীদার বলেই এখন শিক্ষার উৎকর্ষতার চেয়ে চা-সিঙ্গারা-চপ-এর উৎকর্ষতার বাণী শুনতে পাওয়া যায়। সুতরাং ডাকসু নির্বাচনে সব ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে ডাকসু নির্বাচন হবে মহাভোট ডাকাতির নির্বাচনের ধারাবাহিকতার আরেকটি সংযোজন। 
    
বন্ধুরা,
বিএনপি’র অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার খালেদ মাহবুব শ্যামল এর মাতা শামসুন্নাহার বেগম গত ৩০ জানুয়ারী রাত ১২-৩০টায় রাজধানীর তেজগাঁওস্থ ইমপালস্ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শামসুন্নাহার বেগম এর মৃত্যুতে আমি গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যবর্গ, গুণগ্রাহী ও শুভান্যুধ্যায়ীদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা। এই বয়স্কা নারীও জুলুমের শিকার হয়েছেন। তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার খালেদ মাহবুব শ্যামল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় এবং তার বৃদ্ধা মাতার সাথেও দুর্ব্যবহার করা হয়। এই আক্রমণে শ্যামলের মা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শোকে-বেদনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৩০ জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন। তার এই মৃত্যু হয়েছে আওয়ামী দুস্কৃতিকারীদের জন্যই। এই অমানবিক নির্মমতার প্রতিবাদ করার ভাষা আমার জানা নেই। সৃষ্টিকর্তাই এদের বিচার করবেন। 
ধন্যবাদ সবাইকে। আল্লাহ হাফেজ।

পোস্ট মর্টেম : জাতীয় নির্বাচন ২০১৮

তৈমূর আলম খন্দকার

গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের ছদ্মাবরণে যে ঘটনা ঘটে গেল, যাকে শেখ হাসিনা সরকারের মহা বিজয় বলতে দেশের গোটা বুদ্ধিজীবী সমাজ, যারা সরকারের অধীনে বড় বড় চেয়ারে অধিষ্ঠিত আছেন তারা তো বটেই, বরং দেশী-বিদেশী অভিনন্দনবার্তা সব মিলিয়ে ইতিহাসের পাতায় কোথায় অবস্থান নেবে তা এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বহুবার বলা হয়েছে, গায়েবি মামলা বিরোধী দলকে নির্যাতন নিষ্পেষণ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকার তাদের কথামতো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যার জন্য সরকারপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ জনসভায় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ/প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উপকারীর উপকার স্বীকার করতে হয় বিধায় প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়ে কোনো ভুল করেছেন তা বলতে চাই না। তবে গায়েবি মোকদ্দমা প্রধানমন্ত্রীকে ইতিহাসের পাতায় কোথায় স্থান করে দেবে তিনি হয়তো এখনো উপলব্ধি করেননি। উপলব্ধি না করার কারণ এও হতে পারে যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের গ্রিন সিগন্যাল থেকেই গায়েবি মোকদ্দমার উৎপত্তি, যার কারণে এত সমালোচনার পরও সরকার বা কোনো মহল বা সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবী গায়েবি মামলার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন না।

গায়েবি মোকদ্দমা কী? জাতীয় পত্রিকায় ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদ থেকেই গায়েবি মামলার আকার, রঙ, প্রকার প্রভৃতি চিত্রায়িত করা যাবে। সংবাদটির নিজস্ব রূপ, পঙ্গু তারা মিয়া, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দেয়া হয়েছিল, তাকে নিয়ে জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ২৩ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। পুলিশের করা ওই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, গত ২৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের দু’দিন আগে বিকেল ৪টার পর সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর বাজারে চাপাতি, হকিস্টিক ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মামলায় ৫২ জনকে আসামি করে পুলিশ। তারা মিয়া সেই ৫২ জনের একজন। তবে জামিনের সময় শেষ হয়ে গেলে তারা মিয়াকে সুনামগঞ্জের নি¤œ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

জানা গেছে, ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন, নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না ডান হাত দিয়ে। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। এটি তার জন্মগত সমস্যা। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাঁকানো। খুব কষ্ট করে বাম হাত দিয়ে খেতে হয়। ছবির ওই মানুষটির ডান হাত অচল, বাম হাতও প্রায় অচল। সুনামগঞ্জের অধিবাসী তারা মিয়া চাপাতি, হকিস্টিক ও রড হাতে নিয়ে আক্রমণ করেছেন পুলিশের ওপর। ভিক্ষা করে জীবনযাপন করা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছে। যার সামান্য বোধ শক্তি রয়েছে এই সংবাদ পাঠ করার পর তার মনে নিশ্চয়ই গায়েবি মামলা সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাবে। আর যিনি একটি একতরফা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে গায়েবি মামলার সমর্থক তার কথা ভিন্ন। কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষের কোনো কারণেই এ গায়েবি মামলা সমর্থন করার কথা নয়। যদিও গায়েব থেকে সৃষ্ট এই গায়েবি মামলাই বিরোধী দলের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

যদিও পদোন্নতির ভাগ্যাকাশ অনেকের জন্যই খুলে গেছে। অথচ বাম জোটের মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পথে। তারা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত এ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গত ২৮ জানুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোটের ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির নির্বাচন গণশুনানির অভিজ্ঞতা নাগরিক সমাজের ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। পৃথিবীর ২০০টি দেশের মধ্যে ৫০টি দেশে গণতন্ত্র আছে। বাকিগুলোতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মিছিলে ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে থাকা অবস্থায় নিহত হন। কেউ বলতে পারবে না কোন নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ ভয় এবং লোভ ব্যবহার করে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। তিনি এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, আওয়ামী লীগের অতি বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘৃণ্য ও কলঙ্কজনক পন্থায়। বাংলাদেশ অন্ধকার পথে প্রবেশ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। অধ্যাপক আকাশ বাম জোটকে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’ আন্দোলন গড়ে তোলায় আহ্বান জানান। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে পূর্বপরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্বাচনে অতি বিজয় অর্জন করেছে। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ জাতীয় পত্রিকা)

এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবে আওয়ামী লীগকে জেতানো হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর সম্মানের প্রতি আঘাত করা হয়েছে। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন, তারা কেউ আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী নয়। এতে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারির জাতীয় পত্রিকা)

নির্বাচনে মহা বিজয় সম্পর্কে ২৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজয়ের কারণ হিসেবে ১৪টি এবং বিএনপি জোটের তথা ঐক্যফ্রন্টের হারের সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কে সাতটি ব্যর্থতার কারণ হিসেবে নির্ধারণ করে মন্তব্য করেছেন, সেহেতু বিএনপির পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানো দরকার। নতুবা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অখণ্ডিতভাবেই থেকে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই রাজনৈতিক দলের ধর্ম হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা না থাকলে ‘রাজনীতি’ থাকে না। নির্বাচনে হেরে যাওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন তার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়া জনগণের মধ্যে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার করবে, অন্য দিকে কর্মীদের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বিএনপির ওপরে শেখ হাসিনা সরকার যে স্টিম রোলার চালিয়েছে, তা তিনি জেনেও সাফাই গাওয়ার জন্যই ২৫ জানুয়ারি জনসভায় নির্বাচনের মহাজয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়ের ব্যাখ্যা করেছেন, যা তার নিজস্ব আঙ্গিকেই তিনি করেছেন, যা সুনির্দিষ্টভাবে খণ্ডানোর দায়িত্ব বিএনপির রয়েছে বলে মনে করি। প্রবাদ রয়েছে, ‘চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না’।

এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডানোর বিষয়ে বিএনপি পিছিয়ে থাকলে পরিস্থিতি বিএনপিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেবে। ফলে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। স্মরণ করা দরকার, কে কি করে তা নিয়ে অন্যকে ফাঁকি দেয়া যায়, কিন্তু নিজেকে কি ফাঁকি দেয়া সম্ভব? ঘটে যাওয়া ‘নির্বাচন’ নামক প্রহসন সম্পর্কে ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে, বিদেশীদের চোখে ধুলো দেয়া যাবে, কিন্তু তারা কি তাদের নিজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন যারা ভূমিধস বিজয় অর্জনের কারিগর হিসেবে ব্যবহার হয়েছেন? জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যাদের স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন লালিত-পালিত তাদের বিবেক কি জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করেনি? জাতির বিবেক কি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যাবে? কারো কারো পদোন্নতি, বিলাসবহুল জীবনধারণ ও আকাশচুম্বী উন্নতির কামনা-বাসনার কাছে কি জাতি হেরে যাবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহিতার কি কোনো প্রয়োজন নেই? (ক্রমশ)

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন) 
  • সুত্র- নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৯ 

রিজার্ভ চুরি — ৩৬ মাসেও উত্তর নেই অনেক প্রশ্নের!

রিজার্ভ চুরির ৩৬ মাস পর অবশেষে মামলা করল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় ভোর ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এ মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির ৩৬ মাস পার হলেও আজও কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। অথচ অর্থ উদ্ধার ও তদন্তের নামে ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ঘণ্টায় প্রায় ৪০০ ডলার ব্যয়ে ১ হাজার ৪০০ ঘণ্টা তদন্ত করেছে ফায়ার আই নামক একটি সফটওয়্যার কোম্পানি। রাকেশ আস্তান নামের একজন ভারতীয় নাগরিক এ তদন্তে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এ ব্যয়বহুল তদন্তের ফলাফল কি তা জানে না দেশের জনগণ।

জানা গেছে, সুরক্ষিত সুইফট সিস্টেমের সাথে আরটিজিএস নামের একটি সফটওয়্যার সংযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কেউ অতিউৎসাহী ছিলেন। আরটিজিএস সংযোগের পরেই রিজার্ভ চুরি হয়। কারা অতিউৎসাহী ছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। আবার ফিলিপাইনের দৈনিক পত্রিকা ইনকোয়েরার’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়। চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখায় ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে অর্থের বড় অংশ চলে যায় দেশটির ক্যাসিনোতে (জুয়ার আসরে)।

আবার ক্যাসিনোতেও সেই অর্থ ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ আরো ২০ দিন। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারকে সময়মতো অবহিত করলে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব ছিল কি না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে এ অর্থের বেশির ভাগই ফেরত আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু কেন সরকারকে জানানো হলো না, কারা বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরকে ঘটনাটি না জানাতে পরামর্শ দিয়েছিল তা জানা যায়নি। এদিকে ঘটনা জানার পর পরই তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে ফিলিপাইনে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওই প্রতিনিধিদল কোনো সরকারি আদেশ (জিও) ছাড়া কিভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সেখান থেকে আসার পর এ সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন কেন দেয়নি এ প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো উত্তর পায়নি রিজার্ভ চুরির ওপর তদন্তে নিয়োজিত সিআইডি কর্মকর্তারাও। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, সিআইডি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে ড. আতিউর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন। তবে তিনি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি বলে এক সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, চুরি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক অবহিত হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ ঘটনা অবহিত হওয়ার পরও অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংকিং সিস্টেমে ছিল দুই দিন ( ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি)। এর পর এক টানা বিশ দিন ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে এই অর্থ ঘোরাফেরা করে। সরকারকে যথাসময় জানানো হলে অর্থ উদ্ধার কিভাবে সম্ভব হতো, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যখন চুরি যাওয়া অর্থ ব্যাংকে ছিল তখন সরকারকে জানালে এবং সাথে সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার চাপ প্রয়োগ করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা টাকা উত্তোলন বন্ধ করা যেতো। এরপর জুয়ার আসরে যাওয়ার পরেও সরকারকে অবহিত করা হলেও টাকা উদ্ধার করা সম্ভব ছিল। যেমন, সরকার টু সরকার পর্যায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতো। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা উদ্ধারের জন্য ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেয়া যেত।

কিন্তু এতগুলো সম্ভাবনা থাকার পরও কেন বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো সরকারকে অর্থ উদ্ধারে অবহিত করল নাÑ এ দায় নিয়ে চাপের মুখে তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। আরো দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম ও নাজনীন সুলতানাকে অপসারণ করা হয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া পদত্যাগপত্রে ড. আতিউর রহমান লিখেছেন, ‘চুরি হওয়ার ঘটনা পরবর্তী কার্য দিবসেই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে অবহিত করি এবং অর্থ পুনরুদ্ধার, জড়িত পক্ষগুলো শনাক্ত করার এবং অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার বিষয়গুলোর দিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই।’

তার পদত্যাগপত্রের ভাষা দেখে বোঝা যায়, তিনি বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পরই বিএফআইইউকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু বিএফআইইউ কেন সরকারকে অবহিত করল না এটাই এখন বড় রহস্য।

প্রসঙ্গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে মার্চের শুরুতে। ১৫ মার্চ এ ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশে ওই মামলার তদন্ত ভার পেয়ে দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে কাজ শুরু করে সিআইডি। একটি অংশ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত দেশীয় সূত্রগুলো নিয়ে তদন্ত করতে থাকে। আরেকটি অংশ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদেশী সূত্রগুলো নিয়ে কাজ করে। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করা ২ কোটি ডলার আগেই ফেরত পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের বড় অংশই এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি। এ অর্থ থেকে এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া গেছে মাত্র দেড় কোটি ডলার। এ অর্থ ফেরত পেতেই তিন বছর পর মামলা করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।

অবশেষে মামলা : রিজার্ভ চুরির ঘটনায় প্রধান আসামি করা হয় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংককে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ফিলিপাইনের মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ, দুটি ক্যাসিনো এবং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় আরসিবিসি ব্যাংকসহ ৬টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ ব্যক্তির নাম আছে বলে জানা গেছে। এতে চুরি হওয়া অর্থসহ মামলা পরিচালনার সমুদয় ব্যয় এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা আইনি প্রতিষ্ঠান কোজেন ও’কোনর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মামলাটি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক বনাম রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন শিরোনামে করা এ মামলা নথিভুক্তির নম্বর ১৯-০০৯৮৩।

নথিতে যা আছে : মামলায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিউ ইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার অজ্ঞাত হ্যাকাররা হাতিয়ে নেয়। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির মধ্যে ফিলিপাইনে যায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় যায় ২ কোটি ডলার। শ্রীলঙ্কা থেকে ২ কোটি ডলার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

৮ কোটি ১০ লাখ ডলার গেছে আরসিবিসিতে। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এতে জড়িত রয়েছে। তারা মানিলন্ডারিংয়ের বিধিবিধান পরিপালন না করে ওই সব অর্থ ছাড় করার মাধ্যমে পাচার করতে সহায়তা করেছে। নথিতে আরো বলা হয়, ব্যাংকটির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তা এ অর্থ চুরির জন্য কয়েক বছর ধরে ‘বড় ধরনের’ ‘জটিল ষড়যন্ত্র’ করেন। অজ্ঞাত উত্তর কোরীয় হ্যাকাররা এ চুরিতে সহায়তা করেছে। অর্থ চুরির পর তা ফিলিপাইনের আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে মানিএক্সচেঞ্জ হয়ে বেশির ভাগ অর্থ ফিলিপাইনের ক্যাসিনোর মাধ্যমে পাচার করে দেয়া হয়।
  • সুত্র - নয়াদিগন্ত / ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
  • https://goo.gl/ndTLqv

আন্তর্জাতিকভাবেই সমাধান পেতে হবে

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন
x
স্বাধীন দেশে যদি প্রশাসন জনগণের না হয়, তাহলে দেশ তো পরাধীন আমলের মতোই থেকে যায়। জনজীবনে অন্যায়-অবিচার বাসা বাঁধার মূল কারণ আমাদের প্রশাসনে স্বাধীনতার মূল্যবোধের অভাব। দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধনে আমরা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে থাকি।

দুর্নীতির সুযোগ বহাল রাখার জন্যই ভোট ডাকাতির ব্যাপারে প্রশাসনের সব স্তরের সহযোগিতা পাওয়া সহজ হয়েছে। জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের শাসনতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। সরকারকে বিভ্রান্ত করার জন্যও লোকের কোনো অভাব নেই।

প্রকাশ্যে নির্বাচনে ডাকাতির পর স্বাধীন জাতি হিসেবে অহঙ্কার করার মতো আমাদের আর কতটা কী অবশিষ্ট আছে তাই নিয়ে ভাবছি। আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে- জাতীয়ভাবে, দলীয়ভাবে নয়। নির্বাচনে কোনো দলেরই জয়-পরাজয় হয়নি।

জাতির অসহায়ত্বকেই দেখানো হয়েছে বিশ্বের কাছে। এভাবে ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে শুধু জনগণের শাসনতান্ত্রিক মৌলিক অধিকারই হরণ করা হয়নি। জনগণ কিছু নয়। তাদের ভোটও কিছু নয়। এর নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়।

৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়লাভ করা সমকালীন পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে প্রায় অচিন্তনীয়। আর অতিলোভীদের দোষ এটাই। কতটা হজম করা যাবে সেটাই বুঝতে চায় না। ভোট ডাকাতির সাক্ষ্য-প্রমাণ তারা নিজেরাই রেখে দিয়েছে।

পুলিশি মামলা দিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে বিচারব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে ফেলা হয়েছে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতাটিও কম লজ্জাকর নয়। এটি সত্য যে, টেলিভিশন টকশোতে আমি বহুবার নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক শক্ত কথা বলেছি। এজন্য অনেকেই বলেছেন, আপনি বিপদে পড়বেন।

আমি তো সংঘাত-সংঘর্ষের বিরুদ্ধে বলেছি। যুক্তির বাইরে কিছু বলিনি। কোনো দলের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য রাখিনি। দেখা গেল নির্বাচনের আগে আমাকে জেলে পাঠানো হল একটি খোঁড়া অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে।

যে পরিপ্রেক্ষিতেই হোক, আর প্রশ্নটি যতই অশোভন হোক, ৭১ টিভির টকশোতে যে মহিলাটিকে আমি চরিত্রহীন বলতে চেয়েছি তাতে তার মানহানি হলে তিনি মামলা করতে পারেন। তিনি কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননি।

শব্দটির ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে মনে করে পরদিন ফোন করে আমি তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি। ৭১ টেলিভিশনকেও আমি লিখিতভাবে জানিয়েছি। তারা আমার চিঠির বিষয়বস্তু সম্প্রচারও করেছে। তারপর প্রকাশ্যে আর কী করার থাকতে পারে?

আশ্চর্য হলাম যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই এক প্রেস কনফারেন্সে সবাইকে বললেন আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে। তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন। মহিলাটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কী সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না।

সাধারণ মানহানির বিষয়টি এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার হয়ে গেল! মানহানির মামলা যে তৃতীয় পক্ষের কেউ করতে পারে না তা-ও চিন্তা করতে হয়নি। হবেই বা কেন? আইনকানুন তো নেই। আসলে সমগ্র বিষয়টি ছিল সাজানো। সরকারি আইনজীবীদেরও তো আমার জামিনে বাধা দেয়ার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।

‘পবিত্র চরিত্রের’ অধিকারী আওয়ামী লীগের কিছু অতিউৎসাহী সমর্থকও নেমে পড়লেন এ অভিযোগ নিয়ে যে, মহিলাটিকে চরিত্রহীন বলে আমি সমগ্র নারী জাতির অবমাননা করেছি। তাদের দাবি, আমাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। সরকারের কাছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করতেও বিশেষ উৎসাহ দেখা গেছে। বিষয়টির ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা বুঝে ওঠার আগেই সন্ধ্যায় ডিবির লোকজন তৃতীয় পক্ষের এক মানহানির মামলায় আমাকে গ্রেফতার করে। সরকারের ডিটেকটিভ শাখার ব্যস্ততা দেখানোরই বা যুক্তি কোথায়? আমার নিরাপত্তা নিয়ে একদল পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে দেখলাম।

তাদের ধারণা আওয়ামী লীগ ‘কর্মীরা’ আমাকে আক্রমণ করতে পারে! রংপুরে কোর্ট চত্বরে তা-ই হল। এ হল আমাদের দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মী!

আওয়ামী লীগের মহিলা কর্মীরা উপরের নির্দেশমতে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয় না, তবুও একটি-দুটি নয়, ২২টি মানহানির মামলা করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলে বিচারব্যবস্থায় নিশ্চয়ই এরকম মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করতে দিত না।

আশার কথা যে, দু-একজন ম্যাজিস্ট্রেট এ ধরনের মামলা গ্রহণ না করার সাহস দেখিয়েছেন। মামলা হয় না, তবুও মামলা দেয়া হল, মামলা নেয়াও হল এবং আইনত জামিনযোগ্য মামলা হলেও জামিন হল না। আমাকে তাই তিন মাসেরও বেশি জেলে থাকতে হল।

মোটকথা, নির্বাচনের সময় আমাকে বাইরে থাকতে দেয়া হবে না। সবার জানা আছে, আমি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছি। দলীয় রাজনীতি করি না বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। তবে আমি ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে ছিলাম।

আমার বিরুদ্ধে শুধু মামলা করার নির্দেশই দেয়া হয়নি। শুনেছি, আমার যাতে ‘অসুবিধা’ হয় সেই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সুযোগ পেয়ে অন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন মহিলা সাংবাদিক আমাকে চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ বলে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না।

ভালো কথা, তাহলে তাদের যুক্তিতে নিশ্চয়ই তিনি সব রাজনীতিবিদকে চরিত্রহীন বলেছেন। তাতে কিন্তু কোনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদের মানহানি হয়নি! প্রধানমন্ত্রী মানহানির কোনো মামলাও করতে বলেননি!

আমার কোনো দল নেই। তাই সরকারদলীয় মামলা-হামলার মোকাবেলায় বিশেষভাবে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অন্য আইনজীবীদের সঙ্গে মিলে আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দেশে-বিদেশে অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন। আমি তাদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।

যাই হোক, অসুবিধা সৃষ্টির ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে আমাকে জেলে নিয়ে দু’দিন সাধারণ আসামিদের সঙ্গে রাখা হল। আমাকে ডিভিশন দেয়া হল না। কিন্তু আসামিদের মধ্যে যে সুন্দর মন ও মানবিক গুণাবলীর পরিচয় পেলাম তাতে মুগ্ধ ও অবাক হয়েছি।

কীভাবে আমার থাকাটা কিছুটা হলেও সহনীয় করা যায় তার জন্য তারা অস্থির হয়ে পড়লেন। জেলের বিভিন্ন স্থান থেকে আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কিছুটা উঁচুমানের খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী আনা হতে থাকল।

অর্থাৎ জেলের অনেকেই জানতে ও বুঝতে পারেন আমাকে অসুবিধায় রাখা হয়েছে। যারা সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, তাদের কাউকেই আমি চিনতাম না। তাদের ব্যবহারে আমার কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়।

যারা জেলে আছে তাদের বেশিরভাগই সত্যিকার কোনো ভয়াবহ মামলার আসামি নয়। দেখেই বোঝা গেছে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতির গন্ধ খোঁজা হয়েছে, না হয় ড্রাগস সম্পর্কিত মামলা হয়েছে। আসলে চাইলেই মামলা করা যায়। অপরাধ তো প্রমাণ করার দায় নেই। বিচার ত্বরান্বিত করার কোনো আগ্রহও নেই।

জামিন না দিয়েই জেলে আটক রাখা যাচ্ছে মাসের পর মাস। এসব আসামির অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ব দেখে আমিও কষ্ট কম অনুভব করিনি। অনেকের কোর্ট-আদালতে ছোটাছুটি করার কোনো লোকও নেই। এমনও কিছু আসামি আছে যাদের আত্মীয়স্বজনরা কেউ জানে না তারা কোথায় আছে।

শাসনতন্ত্রে বলা আছে, একজন আসামি আইনজীবীর সাহায্য নিতে পারবে। কিন্তু একবার জেলে ঢোকাতে পারলে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগই দেয়া হয় না। কোনো আইনজীবী যোগাযোগ করলে তবেই সে তার সাহায্য নিতে পারে। শাসনতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্পর্কে পুলিশ ও জেল কর্তৃপক্ষকে অধিকতর সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু করবে কারা? রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো নেই।

বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছে, জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি যেন তাদের আইনগত সাহায্য করি। কতটুকু তাদের জন্য করতে পারব জানি না। জেলে পুরলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যারা অন্যায়কারী তাদের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু বিনা জামিনে, বিনা বিচারে পুলিশ দিয়ে জেলে পাঠানোর রাজনীতি তো নির্যাতন। পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার। একটি সুন্দর দেশ গড়তে উদার মনের নেতৃত্ব ও সুন্দর মনের মানুষের প্রয়োজন। আমি আশান্বিত হলাম এটা দেখে যে, তরুণদের মধ্যে এখনও সুন্দর মন মরে যায়নি। জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও যথেষ্ট সম্মান ও সহযোগিতা পেয়েছি। নিজের দেশে এটাই তো আশা করি। যারা মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য তাদের অবশ্যই মর্যাদা দিতে হবে।

আমার এ লেখাটির মূল লক্ষ্য একটি সাধারণ মানহানির মামলা নিয়ে আমার প্রতি যে নোংরা আচরণ করা হয়েছে সেটা নয়। দেশব্যাপী রাজনীতিতে পুলিশি মামলার যে ছড়াছড়ি, তার বিপজ্জনক দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

জনগণের ওপর মামলা-হামলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা পুলিশের দায়িত্ব নয়। ফরমায়েশি পুলিশি মামলার ভয়ে সারা দেশের মানুষ ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে আছে। পুলিশ তো হবে জনগণের বন্ধু। রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা।

পুলিশে এখন অনেক ভদ্র, শিক্ষিত লোক যোগ দিয়েছে। তাদের দিয়ে রাজনীতি করাতে গিয়ে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অর্থাৎ একটি যোগ্য, সৎ পুলিশ বাহিনী যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য সে প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে না।

কমপক্ষে জেলের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ বন্দি রাজনৈতিক মামলার শিকার। একেকজনের বিরুদ্ধে ২৫-৩০টি করে মামলা দেয়া হয়েছে। মামলার সত্যতা কোনো বিষয় নয়, জামিনে মুক্তি পাওয়াকে অসম্ভব করতে পারলেই হল।

গুরুতর মামলা হলে তো একটিই যথেষ্ট। এসব বিষয় নিয়ে ভাববার লোক দুর্লভ। কারাগারগুলোতে ঠাঁই নেই। অথচ বেশিরভাগ বন্দিকে ছেড়ে দেয়ার, জামিন দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের প্রতি চরম অন্যায় করা হচ্ছে।

অবশেষে হাইকোর্টের নির্দেশে আমাকে ডিভিশন দেয়া হল। আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেনের ল’চেম্বারে আমি তার জুনিয়র ছিলাম। তিনি কোর্টে আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘মানিক মিয়ার ছেলেকে জেলে ডিভিশন পেতে হাইকোর্টে আসতে হয়!’

মানিক মিয়ার ছেলে ছাড়া আমার নিজেরও তো কিছু অর্জন আছে। আমি বঙ্গবন্ধুর সময় সংসদ সদস্য ছিলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ছিলাম। নিজে একজন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলাম। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছি। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রেস কমিশনের রিপোর্ট তৈরিতে আমি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলাম।

স্বাধীন দেশে মানুষের সাহস জোগায় বিচারব্যবস্থা। এজন্য জনগণ শাসনতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে বিচার বিভাগের ওপর। এর অর্থ জনগণের অধিকার ও শাসনতন্ত্রসম্মত শাসনের ব্যাপারে জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা না রেখে আস্থা রেখেছে বিচার বিভাগের ওপর।

বিচার প্রক্রিয়ায় ভয়ভীতির স্থান থাকতে পারে না। মানুষের অধিকার নিশ্চিত না হলে স্বাধীনতা অর্থহীন। বর্তমানে মানুষ তাই বড় অসহায়। জামিনের আবেদনের ভিড়ে সুপ্রিমকোর্টে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সুপ্রিমকোর্ট এখন জামিনের আবেদন নিয়ে মহাব্যস্ত। সুপ্রিমকোর্টের অস্তিত্ব ও সাহস না থাকলে দেশের বিচারব্যবস্থা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ত।

আমরা নিশ্চয়ই একটি সুস্থ, সভ্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালানোর যোগ্যতা রাখি। সেই শিক্ষাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আমাদের শিখিয়ে গেছেন।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বাঙালিদের উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বেই তদানীন্তন পাকিস্তানে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়াসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই তখন জাতি গঠনে নীতি-আদর্শ ও সততার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মুখেই শুনতে হয়েছে, তারা কল্পনাও করতে পারেননি যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এত নির্লজ্জভাবে ভোট ডাকাতি হবে। তারা ছোটাছুটি করতে থাকলেন সাক্ষীগোপাল নির্বাচন কমিশন অফিসে।

এমনকি তারা জনগণের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রক্ষা করেননি। ভেবেছিলেন জনগণ তো সরকারের বিপক্ষে, তাই জনগণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীকেই ভোট দেবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপির মতো একটি বড় দল রাজনৈতিক দল হতে পারছে না। শুধু নির্বাচনের আশায় ব্যস্ত থাকার কারণে। এখন তো নির্বাচনও গেল।

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম শেষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ অবস্থায় বৈরুত থেকে আব্বার কাছে লেখা এক পত্রে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, আমরা যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য লড়াই করছি তারা ব্যর্থ থেকে গেলাম।

পরবর্তী সময়ে যে রাজনীতি দেখা দেবে তা হবে ভয়াবহ নৈরাজ্যিক চরিত্রের। শহীদ সাহেব এ বক্তব্য যখন রাখেন তখন দেশে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। পরবর্তী সময়ে কী ধরনের ভয়াবহ হিংসা-বিদ্বেষ দেশে চলেছে তা তো সবাই দেখেছি।

মনে হচ্ছে ১৮ কোটি লোকের এ দেশে এত শিক্ষিত, যোগ্য ও সৎ লোক থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখাতে পারছি না যে, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের কোনো গঠনমূলক ভূমিকা আছে বা আমরা জাতির কোনো উপকারে আসছি।

আপস ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে সচেষ্ট ছিলাম। কোনো সমঝোতা নয়, আমলা সাহেবদের ভোট ডাকাতির ষড়যন্ত্রই সহজ পথ মনে করা হল। এ হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই আমাদের মতো কিছু লোককে হয়তো বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। বোবা হয়ে থাকাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

নির্বাচনে কারচুপি এত বিশালভাবে হয়েছে যে, সংশ্লিষ্টরাই তার প্রমাণ রেখে গেছে। আমলাদের বুদ্ধিতে এটা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু তারা সমাধান দিতে পারবে না। ভোট কারচুপি হয়েছে জাতির বিরুদ্ধে।

তাই সংকটের সমাধানও হতে হবে জাতীয়ভাবে, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়। ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা সর্বজনীন মানবাধিকার লঙ্ঘন। কোনো স্বাধীন জাতি ভোটাধিকারহীন হয়ে থাকতে পারে না। আমরাও থাকব না। পুলিশি মামলা-হামলার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। জনগণের ভোটের শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাই নিরাপদ, সহনশীল রাজনীতির পথ।

—  লেখক আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। 

খেলাপি ঋণে নাজুক দশা জনতা ব্যাংকের

এক বছরে বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণ

সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু

বেশ নাজুক অবস্থায় চলে গেছে জনতা ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি মুনাফা করেছে। কিন্তু এখন লোকসান গুনছে জনতা ব্যাংক। খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ব্যাংকটির ভিত এখন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রার সূচনার পর এখনই সবচেয়ে বাজে সময় পার করছে ব্যাংকটি। ফলে এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গত বছর (২০১৮) ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ফলে এক বছরেই জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এই ঋণের পুরোটাই আবার দুইটি গ্রুপের কাছে। যাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই ঋণ প্রদান করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকটির এমন উদ্বেগজনক খবরে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার সরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি’র অগ্রগতিবিষয়ক এক আলোচনা সভায় জনতা ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংকটিকে দ্রুত তার খেলাপি ঋণ আদায়ের যাবতীয় কার্যকর ও আইনি পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

জানা গেছে, কর্ম সম্পাদন চুক্তি অনুযায়ী জনতা ব্যাংকের জন্য চলতি অর্থবছরে বেশ কয়েকটি টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, কৃষি ঋণ বিতরণ, এসএমই ঋণ বিতরণ, অন্যান্য বিনিয়োগ, পরিচালন মুনাফা অর্জন, লোকসানি শাখার সংখ্যা হ্রাস, রিট মামলা নিষ্পত্তি, অর্থঋণ ও অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তি, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি, শাখাগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ইত্যাদি।

ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সূচকে জনতা ব্যাংক টার্গেট পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে চলতি বছরের জন্য আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর’২০১৮) আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা। টার্গেট অনুযায়ী এ সময়ে আদায় করার কথা ছিল ২৫০ কোটি টাকা। একইভাবে অবলোপনকৃত (ডেট রিট অফ) ঋণ থেকে আদায় করার টার্গেট ছিল ১৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে ছয় মাসে আদায় হওয়ার কথা ছিল ৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে জনতা ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের মোট ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণের মধ্যে দুইটি গ্রুপের কাছেই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই দুইটি গ্রুপ হলো- ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও অ্যাননটেক্স। অ্যাননটেক্সের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় পুরোটাই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল নিজেই নিয়েছেন। অ্যাননটেক্স তার কোম্পানির নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুললেও টাকা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করেছে। গ্রাহককে তা পরিশোধের কথা থাকলেও তারা তা পরিশোধ করেনি। এসব দায়ের বিপরীতে ফোর্সড ঋণ তৈরি করেছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এই গ্রুপটি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।

অন্য দিকে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ বিভিন্ন সরকারি তহবিল ও জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চামড়ার ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে সরকার থেকে নগদ রফতানি সুবিধা নিয়েছে, পক্ষান্তরে রফতানি করেও দেশে টাকা ফেরত আনেনি। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ক্রিসেন্টের পাদুকা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে ৭৫ ভাগ ছাড়ে তারা জুতা বিক্রি করছে বলে জানা গেছে।

এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রয়েছেন দুই ভাই। একজন এম এ কাদের এবং অন্যজন এম এ আজিজ। কাদের জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধানও। সম্প্রতি মুদ্রা পাচার আইনে এম এ কাদেরকে এনবিআরের দায়ের করা মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জনতা ব্যাংকও এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করার সবেমাত্র আইনি আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের এই বিশাল অঙ্কের অর্থ শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় জনতা ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত এমডি ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। তাদের সময়েই এসব অর্থায়ন হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়।

ব্যাংক খাতের যে শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপি রয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশই জনতা ব্যাংকের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে খেলাপিদের এই তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির মধ্যে জনতা ব্যাংকের গ্রাহকেরা হলো কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম, রেমিক্স ফুটওয়্যার, রুবাইয়া ভেজিটেবল ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্ট, চৌধুরী নিটওয়্যার, আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস, মুন্নু ফেব্রিকস, সিক্স সিজন অ্যাপার্টমেন্ট, রহমান স্পিনিং মিলস, ওয়ান ডেনিম মিলস, হিন্দোল ওয়ালী ট্রেডিং, গ্লোবাল মেটাল কমপ্লেক্স, অ্যাপেক্স নিট কম্পোজিট, আলী পেপার মিলস, ড্রেজ বাংলা লিমিটেড, গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ডায়িং, রেপকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও ফাইবার শাইন লিমিটেড।

জনতা ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৯৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ২৫১ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৪৬২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। যা ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু এ বছর ব্যাংকের অবস্থা অনেক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংকটিকে আগের অবস্থায় নিতে হলে এখনই ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালানো, ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করা এবং খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করার পাশাপাশি সৃষ্ট খেলাপি ঋণের পেছনে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
  • সুত্র - নয়াদিগন্ত / ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
  • https://goo.gl/wmWsg6

Saturday, February 2, 2019

মামলাগুলো গায়েবি, মানুষগুলো নয়

আলী রীয়াজ


ঘাটাইলের আজিজ মুনশিকে আমি চিনি না, আপনাদের অধিকাংশও চেনেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি বিখ্যাত হতে চাননি, তাঁর নাম পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই খবর তিনি পেয়েছেন কি না, জানি না। সম্ভবত পাননি। রাজধানী ঢাকায় তিনি আগে এসেছিলেন কি না, তা নিয়েও আমার মনে সংশয় আছে। কিন্তু সম্প্রতি তাঁকে আসতে হয়েছে। সেই সূত্রে আমি-আপনি তাঁর নাম জানতে পেরেছি। আমরা জানতে পেরেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুর গ্রামের বর্গাচাষি মিলন মিয়ার নাম। জানতে পেরেছি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে প্রায় অচল মানুষ, কানেও শোনেন না এমন একজন শামসুল হকের কথা। তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার কোনো গ্রামে। আপনাদের মতো আমিও এখন স্বস্তি বোধ করছি যে সুনামগঞ্জের অধিবাসী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তারা মিয়ার শেষ পর্যন্ত জামিন হয়েছে, ছয় সপ্তাহের জামিন। আতর বিক্রেতা ‘হাতকাটা’ ইউসুফের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, সেই খবর আমি জানি না। ১১টি মামলার আসামি মোহাম্মদপুরের ‘হাতকাটা’ ইউসুফের জামিনের ব্যবস্থা কে করবেন, তাঁর পরিবার তা পেরেছে কি না, সে খবর আমি কোথাও খুঁজে পাইনি, সম্ভবত ওই পরিবার আর তাঁর নিকটজনেরা ছাড়া আর কেউ জানার প্রয়োজন বোধ করছেন না।


এই যে এসব মানুষের কথা বললাম, তাঁরা সবাই রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী, ৩০ ডিসেম্বরের ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, সংসদে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আসন নিয়েছেন, তাঁদের প্রতিপক্ষ। আইনের ভাষায় যদি বলি তাহলে তাঁদের সরকারের প্রতিপক্ষ না বলে অন্য কিছু বলার উপায় নেই। কেননা, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো যেনতেন মামলা নয়। তাঁরা নাগরিকের ভোট দেওয়ার কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছেন, সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত থেকেছেন। ভিন্ন ভিন্নভাবে এসব কথা আছে পুলিশের করা মামলায়। সংবাদপত্রের ভাষায় এগুলো হচ্ছে ‘গায়েবি’ মামলা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘গায়েবি মামলা বলতে কোনো কিছু আমাদের অভিধানে নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ তাহলে কি আমাদের এমন অদ্ভুত অভিযোগ সত্য বলে মনে করতে হবে যে, ডান হাত অস্বাভাবিক চিকন, কোনো চেতনা নেই, বাঁ হাতেও সমস্যা, কোনো কাজ করতে পারেন না, সেই তারা মিয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী? মানতে হবে যে তিনি রামদা, হকিস্টিক ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছেন—এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য?

মামলাগুলো ‘গায়েবি’; কিন্তু মানুষগুলো বাস্তবের, রক্ত–মাংসের মানুষ। তাঁদের অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কেউ কেউ চলতে পারেন না, চাষাবাদের কাজে যাঁদের দিন কাটে, যাঁরা জানেন না তাঁদের অপরাধ কী। কিন্তু এখন তাঁদের আসতে হয়েছে এবং হচ্ছে রাজধানীর হাইকোর্টে। তাঁদের চাওয়া একটাই, ‘জামিন’। এমন মানুষের সংখ্যা কত? গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেড় মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ১৮২টি ‘গায়েবি’ মামলা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। এসব মামলায় ৮৮ হাজার জনের নাম উল্লেখ আছে। আর আসামি করা হয়েছে পৌনে তিন লাখ ব্যক্তিকে। এই হিসাব তো নভেম্বরের আগের, তারপর নির্বাচন হয়েছে।

সরকার, ক্ষমতাসীন দল, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন একটি ‘আন্তর্জাতিক মানের’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছে। বারবার বলা হচ্ছে যে এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দেখে বলাই যায় শান্তিপূর্ণই ছিল নির্বাচন। কিন্তু তা–ই যদি হবে, তবে এই যে লাখ লাখ মানুষ অভিযুক্ত, এই যে হাজারে হাজারে মানুষ আদালতের দরজায় মাথা কুটে মরছেন, তাঁরা কারা? তাঁদের অপরাধ কী? অন্য যেকোনো সময়ে আমরা বলতে পারতাম যে এই সব মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা ভুলে যাবেন না, ভবিষ্যতে তাঁরা এর রায় দেবেন। এখন যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখানে এই সব ক্ষোভ–বিক্ষোভের তোয়াক্কা করার দরকার নেই।

হাইকোর্টের বাইরে যেমন জামিনপ্রত্যাশীদের ভিড়, তেমনি কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজনের ভিড়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আটক হয়েছেন ‘রাজনৈতিক’ কারণে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে জানতে পারি এক জননীর কথা; হেনা, সন্তানের নাম হাবিব। ‘(হাবিব) নভেম্বর মাসে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে আসছিল। মুড়ি কিনতে বাসা থেকে বের হলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর খুঁজে পাইনি।’ হেনা জানান, নির্বাচনের আগে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে ঘটে যাওয়া পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় হাবিবকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হাবিব জামালপুরেই থাকেন। তাঁর মা হেনা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। বাড়িতে থাকে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসছিল। পুলিশ শুধু শুধু মামলা দিয়েছে।’ তিনি জানান, গ্রেপ্তারের পর তিন মাস ধরে কেরানীগঞ্জ কারাগারেই আছেন হাবিব, (মানবজমিন, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯)।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুর গ্রামের বর্গাচাষি মিলন মিয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে নাশকতার মামলা। আগাম জামিন নিতে ঢাকা এসেছেন তিনি। প্রথম আলো। 



পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায় আবিদ উল্লাহর কথা। আবিদ উল্লাহ বলেন, ‘আমার ভাইকে মামলা দেওয়ার বয়সই হয়নি। সে এখনো অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে আটক করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ছোট ভাইয়ের জামিন নিয়েও প্রতিদিন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন কত নেতার কাছে ঘুরি। কোনো কাজ হয় না। একটা অবুঝ ছেলে, সে মামলার কী বোঝে। উকিল ধরছি, এখনো জামিন কবে পাইব জানি না।’ কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ আটক আছেন। এই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে নির্বাচনের অব্যবহিত আগের মাসগুলোতে। গত কয়েক বছরে আটক বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কথা তো আমরা প্রায় বিস্মৃতই হয়েছি। মানুষ গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৮ সাল থেকে আমরা গায়েবি মামলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।

এসব গায়েবি মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের অনেকেই এসব জামিনের ব্যবস্থা করতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলো তো বাতিল হচ্ছে না। সেগুলোর হাজিরা চলবে ভবিষ্যতে। কত দিন? কেউ জানে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা অব্যাহত আছে, নিয়মিতভাবেই তাঁদের হাজিরা দিতে হয় বলেই জানি। শুধু তা–ই নয়, সম্প্রতি পোশাকশ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করলে আটক করা হয়েছে অনেককে, তাঁদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার উপায় কোথায়? এ নিয়ে কথা বললেই ষড়যন্ত্রের গল্প শোনানো হবে। শুধু তা–ই নয়, ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই সব দেখে সবকিছুকেই ‘গায়েবি’ বলেই মনে হয়।

এই যে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য একটাই—সবাইকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া যে তাঁদের কী পরিণতি হতে পারে। রাজনীতি না করলেও এই যদি অবস্থা হয়, তবে রাজনীতি করলে কী হবে, সেটা অনুমানের ব্যবস্থা করা। সাধারণ মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখা। এর একটা শ্রেণিবিভাজনও আছে। শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন না, কেননা তাঁদের পরিচিত কাউকে তো এমন অবস্থায় পড়তে দেখছেন না। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বাড়ল কি না, তাঁদের চাকরি থাকল কি না, ঘাটাইলের আজিজ মুনশির কী হলো, তা নিয়ে বাংলাদেশের নতুন মধ্যবিত্তের উদ্বেগের কিছু নেই। কেননা, শ্রেণিগতভাবে এটা তাঁদের জানাই আছে যে প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ তাঁদের পাতেই আসবে। তাঁদের সম্ভবত করার আরও অনেক কিছুই আছে। সংবাদপত্রের পাতায় এসব খবর বড়জোর কতগুলো সংখ্যামাত্র।

রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীনেরা যে এই মানুষদের কথা ভাবছে না, তা দরিদ্র, সাধারণ মানুষ জানে। আদালতের কাছে ‘জামিনের’ জন্য এসেছেন, আসছেন, আসবেন—কিন্তু সেখানে বিচার পাবেন, এমন আশা তাঁদের নেই। সে কারণে আজিজ মুনশি বলেছেন, ‘দোয়ার দরখাস্ত রাখলাম। এক বিন্দু অপরাধ করি নাই। ওপরের উনি সব দেখছেন।’ (প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯)।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

সূত্র — প্রথম আলো/ শনিবার, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৯।