Search

Tuesday, June 15, 2021

রাজাকার পুনর্বাসনের আদি কথা

—   ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

 


সোশ্যাল , ইলেকট্রিনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এই প্রশ্নটা সামনে আসে যে কে বা কারা বা কার নির্দেশে এবং কার আমলে প্রথম স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও দালালদেরকে পুনর্বাসন শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তাদের সুশীল সমাজসহ চেতনাজীবীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও দালালদেরকে পুনর্বাসিত করার জন্য অভিযুক্ত করে থাকে। এই অভিযোগ কতটা সত্য, জানুন। 

‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইয়ের লেখক আওয়ামী বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ-জামান ও শাহরিয়ার কবির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী বাঙালিদের তালিকা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত এই বইটি একটি দালিলিক প্রমাণ গ্রন্থ। এই বইতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা আছে যে শেখ মুজিবের আমলেই রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী দালালদের পুনর্বাসন শুরু হয়। এই রাজাকার ও দালাল পুনর্বাসন ব্যাপক ছিলো এবং রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীরা এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান পায় যে শেখ মুজিবর রহমানের আমলেই প্রায় সব চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকারের পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়ে যায়। 

লেঃ কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনের কথা আপনেদের সবার জানা আছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর উপপ্রধান এবং রাজকার বাহীনি প্রধান রিক্রুটিং অফিসার ছিলেন। এই লেঃ কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা বিরোধী সব থেকে বড় রাজাকার ও দালাল ছিল। ৭২ সালের জানুয়ারিতেই পাকিস্তানের প্রতি অনুগত এই ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদে নিযুক্তি দেন শেখ মুজিবুর রহমান। লেঃ কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনকে এই পদে দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত জামিল তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সাফায়েত জামিল এই পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও দালালকে স্যালুট করেন নাই। সেই অপরাধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত জামিলের কোর্ট মার্শাল হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

এই খানেই শেষ নয়। 

বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সোমবার,  ডিসেম্বর, ১৬, ২০১৩, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ‘আমি বিজয় দেখিনি’ শীর্ষক লেখায় আরো অনেক রাজাকারদের কথা তুলে ধরেছিলেন যাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার পুনর্বাসিত করেছিল। 

তিনি লেখেন — 

স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় অদৃশ্য শক্তির আশীর্বাদে অলৌকিক সব ঘটনা ঘটতে লাগল। বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে শত্রু আর মিত্রে কোনো বিভক্তিই থাকল না। ক্যাপ্টেন হাকিম একজন গোলন্দাজ অফিসার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৭ ব্রিগেডের ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে কর্মরত থেকে যুদ্ধের ন'মাস হবিগঞ্জের নোয়াপাড়া অবস্থানে গোলন্দাজ অফিসার হিসেবে যুদ্ধরত থেকেছেন মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে। শত শত মানুষ হত্যা করেছেন তিনি তার নিক্ষিপ্ত গোলায়। স্বাধীনতার পর তিনি শুধু চাকরিই ফেরত পেলেন না, তিনি দায়িত্ব পেলেন মিলিটারি পুলিশ বিভাগের প্রধান হিসেবে। একইভাবে চাকরি ফেরত পেলেন লেফটেন্যান্ট মোদাব্বের ও লেফটেন্যান্ট আল ফরিদ। এরা দুজনই পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ জায়গাটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন পরবর্তীতে।

সেনাবাহিনীর সদর দফতরে চাকরি পেলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম রহমান। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ১ নং সামরিক আদালতের প্রধান কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়। আরও চাকরি পেলেন কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে। আরও যারা চাকরি পেলেন তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম, বেসামরিক গোয়েন্দা দফতরের প্রধান সাফদার, রাজাকার বাহিনী প্রধান রহিম এবং আরও অনেকে। এরা সবাই শুধু চাকরিই ফেরত পেলেন না, পেলেন রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ দফতর। 

— শেষ। 

সূত্র —  https://bit.ly/2TXzbSG 

কাজেই মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষক, স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেডফোর্সের কমান্ডার শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে এসব হীন প্রোপাগান্ডা বন্ধ করুন। আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। সত্যকে মেনে নিন। 



  • লেখক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাস্ট্র।  

রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার প্রভাব

------------------------------------

মোহাম্মদ আবুল হাসান

------------------------------------


১৯৪৪ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফ্রাংকফ্রুর্ট স্কুল চিন্তক অ্যাডর্নো এবং হকহেইমার ‘ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট’ নামক পুস্তকে আধুনিকতাকে গণপ্রতারণা হিসাবে চিহ্নিত করার পর চিন্তারাজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্য দেখা দেয়। ধর্মীয় মহা-আখ্যানগুলোর পাশাপাশি পুঁজিবাদ, মার্কসবাদ, উদারনৈতিকতাবাদ, উপযোগবাদসহ চিরায়ত প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত থাকেনি উত্তর-কাঠামোবাদীরা, খোদ ইউরোপীয় সাদা সভ্যতাসহ পুরো আধুনিকতাকে বিতর্কিত করে তুলেছে আধুনিকতার এ অধিপাঠ। শিল্পবিপ্লব যদি আধুনিকতার ভিত্তিভূমি হয়, তবে তথ্যপ্রযুক্তি হলো উত্তর-আধুনিকতার উর্বর জমিন। সিগমন্ড ফ্রয়েডের আনকনশাসে চিন্তাজগতের সীমাহীন স্বাধীনতার কারণে মনের কথার সন্ধানে লিপ্ত হয়েছে মানুষ। সন্দেহের বাতাবর্তে পরাবাস্তববাদী প্রভাব শিল্প, সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সত্যের সুলুক সন্ধানে ব্যাপৃত হয়। অধুনা তথ্যপ্রযুক্তি এ আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে রাজনীতিকে নিয়ত বিচলিত ও বিভ্রান্ত করে চলেছে।

জাঁক দেরিদা তার ডিকনস্ট্রাকশনে কোনো কিছুর সুনির্দিষ্ট অর্থবোধকতাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘কোনো টেক্সট লেখা হলে তা নিজে একটা মিনিং ধারণ করার পাশাপাশি একটা বিপরীত মিনিংও ধারণ করে।’ কোনো লেখক লেখার মাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশ করতে চাইলে তার মনে হয়, আমি যা কিছুই বুঝাতে চাই না কেন; পাঠক তার নিজের মতো করেই বুঝে নেবে। তাই লিখে কোনো কিছু প্রকাশের চেষ্টা নিরর্থক। লেখক ও পাঠকের রক্তপাতহীন বোঝাপড়ার সংঘাতে সীমাহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের ঔদ্ধত্য পাঠককে নিরীহ থাকতে দেয় না। লেখককে তার অধিপতি মানতে নারাজ সে। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফেসবুক ও টুইটারে লাইক, কমেন্টস ও শেয়ার স্বল্প পরিশ্রমে রাতারাতি তাকে তারকাখ্যাতির আত্মঅহমিকায় ভোগাচ্ছে। এমন আত্মঅহমিকায় সিক্ত রাজনীতিবিদ বুঝে না বুঝে, নিজ পরিধির বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের নীতিগত সিদ্ধান্তসহ নানাবিধ কর্মের চ্যালেঞ্জ করছেন। এহেন সাহসী কর্মে স্বদলীয় বৈরি শক্তির প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির এমন প্রকাশ্য বচসা নিজদলীয় ঐক্যে ভয়াবহ ফাটল ধরাচ্ছে।

জার্মান তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন তার ‘The work of art in the age of mechanical reproduction-1936’ নামক প্রবন্ধে বলেন, ‘যথাযথ শিল্প নিজেকে শুধু প্রকাশই করে না, গোপনও করে।’ বিপরীত লিঙ্গের কৌতূহল হেতু ইসলামের পর্দা প্রথা নারীর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বগুলোর ঐশ্বরিক ইলিউশন ও শৈল্পিক সৌন্দর্য প্রযুক্তির অতিব্যবহারে হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় নেতাদের প্রতি কর্মীদের আগ্রহে ভাটা পড়ছে। উপরন্তু নেতাদের বিশেষ গুণগুলোর দোষ-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে পরিকল্পিত অপপ্রচার তাকে বিতর্কিত করে তুলছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নিজদলীয় এমন অপরাজনীতি দলের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বিনষ্ট করছে। উত্তর-আধুনিকতা High art I Low art-এর ধারণাকে খারিজ করে দেয়। তর্কের খাতিরে রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমকে high art এবং কায়িক শ্রমকে low art ধরে নিলে কায়িক শ্রম নিয়ত দেখা গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেওয়া হয় পর্দার অন্তরালে। রাজনীতিতে যাদের কম দেখা যায় বা আদৌ দেখা যায় না, দলীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হয়তো সেই বেশি করছে। দলীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামকে জানিয়েই কাজগুলো করছে সে, যা টেকনিক্যাল কারণে সর্বসাধারণে জানানো হয়তো সম্ভবপর নয়। পক্ষান্তরে নিয়মিত সদম্ভে বিচরণ করা কোনো কর্মী হয়তো স্বল্প লোভে বিপক্ষ শক্তির এজেন্ট হিসাবে কাজ করছেন। নানা শ্রম ও উপাদানের সুসন্বিত রূপে নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেও নেতাকর্মীদের প্রায় অসন্তুষ্ট হয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কের ঝড় তুলতে দেখা যায়। একদল অপর দলকে গাধাভিত্তিক শ্রমিক ও এসি রুমের বাসিন্দা বা আয়েশি নেতা হিসাবে কটাক্ষ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টিপ্পনি কাটতেও কসুর করেন না। দলের পক্ষ থেকে গোপনীয়তার স্বার্থে যথোপযুক্ত প্রমাণসহ নেতৃত্ব নির্বাচনের যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরাও হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। কথা-কর্ম ও প্রকাশে সরাসরি এমন বৈরিতা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সাধিত হয়েছে, আগের দিনে তা ছিল কল্পনাতীত।

ফরাসি পণ্ডিত মিশেল ফুকোর বায়োপলিটিক্সের ধারণায় জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্ক বিচারে ক্ষমতা জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয় আর জ্ঞান ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, পুঁজিবাদী করপোরেট সংস্থা ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ফরমাইশি বুদ্ধিজীবি তৈরি করে থাকে। এমন বুদ্ধিজীবীদের বয়ান ও কর্মপরিকল্পনার সন্দেহ মিশ্রিত অনুপরীক্ষণ দলের অভ্যন্তরে অবিরত চলতে থাকে। গৃহীত সিদ্ধান্তের সফলতা-ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণে বুদ্ধিভিত্তিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। উত্তর-আধুনিক টেক্সট যেমন ব্যাখ্যা তৈরির কারখানা, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কোনো দৃশ্যপটও অসীম ব্যাখ্যা তৈরি করছে। কেউ কারাগারে গেলে ইচ্ছা করেই কারাগারে গিয়েছেন, আবার মুক্তি পেলে সরকারের যোগসাজশে মুক্তি পেয়েছেন। মামলা হলে ইচ্ছা করেই মামলা নিয়েছেন, আর মামলায় নাম না থাকলে তাকে সরকারের এজেন্ট বলছেন খোদ নিজদলের লোকজন। বিরোধীদলীয় মিটিং-মিছিলকে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় ও পুলিশকে উৎকোচ প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে স্বদলীয় বিপক্ষশক্তি। মিটিং-মিছিলকারীরা আবার নিজেদের সুসংহত শক্তি হিসাবে দলীয় ফোরামে জানান দিচ্ছেন। একই ঘটনাকে সরকার দলীয় বিপক্ষ শক্তি হাইকমান্ডকে অবহিত করছেন স্থানীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা নেতাদের বিতর্কিত করার লক্ষ্য নিয়ে। পাড়া-মহল্লায় সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’দলের দু’জন নেতার মিলিত ছবি স্ব-স্ব দলীয় বিপক্ষশক্তি ফেসবুক-টুইটারে ভাইরাল করছেন অভিযোগের সুরে। এমন নানা তৎপরতা ও অপতৎপরতায় রাজনীতির প্রকৃত অবস্থা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে দেয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল স্মিট তার ‘The concept of political-1926’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘Sense of enmity’ থেকে রাজনীতির উৎপত্তি, যা দুটো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি নিজ দলেও আছড়ে পড়ছে। রাজনৈতিক উঁচু মহলের গাণিতিক সমীকরণ ও যোগ-বিয়োগের খেলায় বড় নেতার অবস্থানচ্যুতির কারণে তার অনুসারী নির্দোষ ও কঠোর পরিশ্রমীদের প্রায়ই অন্যায়ের শিকার হতে দেখা যায়। ঐতিহাসিক বা পদ্ধতিগত প্রেক্ষাপটে স্ব-ইচ্ছায় বা মনের অজান্তেই উপদলে নাম লেখানো কর্মীটি নিয়তিকে মেনে না নিয়ে উত্তেজনায় ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপক্ষ বড় কোনো শক্তির অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছেন। অধিকন্তু রনজিত গুহের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সাবলটার্ন স্টাডিজের নিুবর্গের ইতিহাস চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনুসংগ্রামের নায়করা নিজেদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখতে চান। নেতৃত্ব নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকায় সবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশ স্পর্শ করছে। উপরন্তু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে দলে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বগুলোর শৈল্পিক ‘অঁরা’ ১/১১ সরকার অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা সরকারি নির্যাতনে পিষ্ট প্রত্যেক নেতাকর্মী নিজেকে অনুসংগ্রামের নায়ক ভাবছেন; কিন্তু পুরোনো প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব তা মানতে নারাজ। পক্ষান্তরে প্রায় এক যুগ ক্ষমতায় থাকা সরকারি দলে কালো টাকার দৌরাত্ম্যে গড়ে উঠেছে এক নতুন শ্রেণি। এ জায়মান শ্রেণি সরকারি দলের অপেক্ষাকৃত সৎ ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। এ যেন অহিংস, সহিংস ও রক্তপাতহীন যুদ্ধে সবাই সবার টার্গেট। তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত দ্বার যেমন নেতাকর্মীদের মাঝে অফুরান যোগসূত্র স্থাপন করেছে, ঠিক তেমনি শুধু লবিংয়ের জোরে নেতা বানানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক লেনদেনে নেতৃত্ব নির্বাচনের অভিযোগ আসছে প্রকটভাবে। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দোলাচলে রাজনীতিকে আর সুতায় বাঁধা যাচ্ছে না।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কোণঠাসা করে রাখার কারণে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি বিরোধীরা পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পক্ষান্তরে পুলিশ ও প্রশাসননির্ভর সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও শুধু অর্থনৈতিক চাহিদা ও ক্ষমতা চর্চায় ব্যাপৃত হয়েছেন। ফলে নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ও রাজনৈতিক চর্চার অভাব হেতু বোঝাপড়া দিনকে দিন কমছে। ঐক্যের পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে উঠছে পার্থক্যনির্ভর। চিন্তার নৈরাজ্য, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণে রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ প্রভাব চিরায়ত রাজনীতির শৈল্পিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। নোয়াম চমস্কি যেমন করে বলেন, ‘সব মানুষই দার্শনিক, কারণ মানুষ এমন বাক্য বলতে পারে; যেটা আগে কখনো সে শোনেনি। আবার আগে অকথিত বাক্যের অর্থ যথাযথভাবে উদ্ধার করতে পারে সে।’ রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। অধিকন্তু উচ্চাভিলাষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার স্বভাবজাত। এহেন রাজনীতিবিদদের জন্য নিজেকে লাগামহীন করতে চমস্কির ভাষামালার চেয়ে জুতসই বয়ান আর কিই বা হতে পারে! তবে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ আবিষ্টতা তরুণ রাজনীতিকদের সবচেয়ে বেশি বেচাইন করে তুলছে। এর কারণ, যার কেবল দাঁত গজিয়েছে; সে সবকিছুই কামড়াতে চায়।



  • লেখক সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ।
         লেখাটি প্রথম দৈনিক যুগান্তরে সম্পাদকীয় পাতায়  প্রকাশিত              হয়েছে। লিঙ্ক https://bit.ly/3glfj4O

Sunday, June 13, 2021

‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ উপাচার্যগণ

 ---------------------------------------

—    গোলাম মোর্তোজা

----------------------------------------

লেখার বিষয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নিয়ে। শুরুতে একটু অন্য প্রসঙ্গ। কিংবদন্তি সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র একটি ঘটনা।

বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করা কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু মিলে ফয়েজ আহমেদ মেস করে থাকেন নারিন্দার ভুতের গলিতে।

পত্রিকা অফিসের কাজ শেষ হয় রাত দুইটা তিনটায়। কেউ টেবিলে নিউজ পেপার বিছিয়ে বাকি রাতটুকু পার করে দেন, কেউ বাসায় ফেরেন। ফয়েজ আহমদরা মেসে ফিরতেন। সে বছর বড় বন্যা হলো।

দিনের বেলা কিছু অংশ ছোট নৌকায় পার হয়ে অফিসে আসা যায়। কিন্তু অত রাতে নৌকা থাকে না। সবাই মেসে ফেরেন কোমর পর্যন্ত ভিজে। একমাত্র ব্যতিক্রম ফয়েজ আহমদ, তিনি ফেরেন না ভিজে। ভিজে ফিরতে ফিরতে ইত্তেফাকের সহ-সম্পাদক মোহাম্মদউল্লাহর ঠান্ডা লেগে গেছে। সবার আলোচনার বিষয় ফয়েজ আহমেদের না ভেজার ‘রহস্য’। একদিন রাত দুইটায় মোহাম্মদউল্লাহ বন্ধু ফয়েজ আহম্মদকে বললেন, আজ তোর সঙ্গে ফিরব। দেখব না ভিজে তুই কি করে ফিরিস। ফয়েজ আহমদের কাজ শেষ হলো তিনটায়। দুই বন্ধু বের হলেন ইত্তেফাক অফিস থেকে। হাটখোলার ইত্তেফাক অফিসের কাছের হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির পাশের রেললাইন পার হলেই খ্রিষ্টানদের কবরস্থান। উল্টো দিকে বলধা গার্ডেন। পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে নারিন্দার দিকে। রাতে কবরস্থানে অনেকগুলো ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখা যায়। সারাদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে রাতে ঘোড়াগুলোকে ঘাস খাওয়ার জন্যে কবরস্থানে ছেড়ে দিয়ে যান কোচোয়ানরা। এমন একটি ঘোড়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছেন ফয়েজ আহমেদ, যেটায় চড়ে তিনি বন্যার পানি পার হয়ে মেসে পৌঁছান। সেরাতে এক ঘোড়া দুইজনকে নিতে গিয়ে বিদ্রোহ করে বসে। পেছন থেকে পড়ে যান মোহাম্মদউল্লাহ। ফয়েজ আহমেদ ঠিকই না ভিজে শেষরাতে মেসে ফেরেন।

সংবাদপত্র অফিসের রাত জেগে কাজ করার সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। রিপোর্টারদের মধ্যরাতে বাসায় ফিরতে হয় না।

তাতে কী, ইদানীং উপাচার্যদের মধ্যরাতে কাজের বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে। মধ্যরাত বা শেষ রাতে কাজ করে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।

কিছুদিন আগে বলেছিলেন তিনি দিনে ২০-২২ ঘণ্টা কাজ করেন। তার মানে ঘুমান মাত্র দুই ঘণ্টা। ১৪৪৭ দিনের মধ্যে ২৪০ দিন ক্যাম্পাসে উপস্থিত অর্থাৎ ১২০৭ দিন অনুপস্থিত উপাচার্য সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলেন যে তার কথা কেউ বিশ্বাস করেননি। ফলে বিদায় বেলা তিনি রাত সাড়ে তিনটায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছেন। তার অভিনব কর্মকাণ্ডের কথা বলে শেষ করা মুশকিল। তিনি হঠাৎ হঠাৎ সকালের ফ্লাইটে গিয়ে বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে আসেন। এমন এক দিন হঠাৎ করে ক্যাম্পাসের বাংলোতে গেছেন। শিক্ষক কর্মচারীরা এসেছেন দাবি নিয়ে। বাংলোর সামনে তারা অবস্থান নিয়েছেন। পরের দিনের পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে ঢাকায় ফিরলেন উপাচার্য কলিমউল্লাহ’।

তিনি ইতিমধ্যে একটি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন। প্রস্তাব পেলে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করবেন বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। শিক্ষক নিয়োগসহ আরও কিছু গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। নিজের মাকে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করেছেন। ইউজিসি তদন্তে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। মন্ত্রণালয় নির্বিকার। তিনি নির্বিঘ্নে দায়িত্ব শেষ করছেন।

র‍্যাঙ্কিং বিষয়ক আলোচনায় আসার আগে আরও কয়েকজন উপাচার্যের সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক।

মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক সোবহানের বাসভবনের সামনে চাকরির দাবিতে অবস্থান নিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তিনি তাদের চাকরি দেবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। মেয়াদ শেষের একদিন আগে তিনি শুধু তাদেরকেই নয়, আরও শতাধিকজনকে চাকরি দিলেন। এখানেও মধ্যরাত মানে সারারাত জেগে চাকরির কাগজপত্র ঠিক করলেন। সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ উঠল অর্থ মানে টাকা মানে ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছেন।

উপাচার্য এমন কর্ম করতে পারেন তা অনুধাবন করে প্রতিবাদকারী শিক্ষকরা রেজিস্ট্রার ভবনে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। উপাচার্যের মেয়ের জামাই তালা ভেঙে কাগজপত্র বের করে আনলেন। উপাচার্যের এই মেয়ের জামাই ও মেয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। উপাচার্য নিয়ম পরিবর্তন করে তাদের শিক্ষক বানিয়েছেন। মজার বিষয়, উপাচার্যের মেয়ের জামাই তালা ভেঙে কাগজপত্রও সরিয়েছেন মধ্যরাতে। এখন জানা যাচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণি ও এক বিষয়ে ফেল করা ছাত্রকেও তিনি শিক্ষক বানিয়ে গেছেন।

আরেকজন উপাচার্য  চাকরির যোগ্যতা কমিয়ে নিজের ছেলেকে শিক্ষক বানিয়েছেন। এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাশাপাশি নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। আরেক উপাচার্য নিজে একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। ছেলের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে কোটি টাকা দিয়ে আরও একটি গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আরেকজন উপাচার্য স্বামী-সন্তানকে দিয়ে নির্মাণ কাজের কমিশন ভাগ বাটোয়ারা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমের সংবাদ ও ছাত্রনেতাদের টেলিফোন সংলাপ অনুযায়ী তিনি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের এক-দেড় কোটি টাকা চাঁদার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। উপাচার্য অভিযোগ করেছেন, ছাত্র নেতারা তার কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। উপাচার্যের বাসভবনে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে তার মিটিংটিও হয়েছিল বেশ রাতে। গণমাধ্যমে তেমন সংবাদই প্রকাশিত হয়েছিল।

উপাচার্যের অভিযোগের ভিত্তিতে ছাত্র নেতাদের পদ বাতিল হয়েছে। উপাচার্য টিকে আছেন দাপটের সঙ্গে। বিদায় বেলায় তিনিও রাবি উপাচার্যকে অনুসরণ করে শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগে তৎপর হয়ে উঠেছেন। দরকার নেই, তারপরও অনলাইনে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপাচার্য।

আরেক উপাচার্যের কাছে শিক্ষার্থীরা দাবি নিয়ে গেলে তিনি সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতা-ক্যাডারদের ডেকে পেটানোর ব্যবস্থা করেন। নিজ শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বলে বিষোদগার করেন। ১০ টাকার চা-সিঙ্গারা-সমুচা তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য।

সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রসঙ্গে ফিরি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউএস বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে। এবছরের তালিকায় সেরা ৮০০’র মধ্যে নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ৮০০-১০০০ এর মধ্যে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট। ২০১২ ও ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ ও ৭০১ নম্বরে। অর্থাৎ ২০২১ সালে এসে মানের অবনতি হয়েছে। অথচ ২০২১ সালের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার ৩৫৫,৩৭৩ ও ৪৫৪ নম্বরে স্থান করে নিয়েছে পাকিস্তানের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়।

এমনিতেই বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বাজেট কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবছরের বাজেট ৮৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। গবেষণা বাজেট ৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে যা গত বছরের চেয়ে কম। এর মধ্যে আবার বড় অংশ ব্যয় হবে ঢাবির ৫৬টি গবেষণাগারের উন্নয়ন ও সরঞ্জাম কেনায়। প্রকৃত গবেষণার বাজেট নিতান্তই কম। ঢাবির মোট বাজেটের ৭০ শতাংশের উপরে ব্যয় হবে বেতন-ভাতা খাতে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এর চেয়ে করুণ। এর বাইরে শিক্ষকরা পাঠদান বা গবেষণার চেয়ে অতিমাত্রায় সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতি ও সেরা তালিকায় না থাকার ক্ষেত্রে এগুলো নিশ্চয় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু প্রধানতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকনিক চরিত্র উপাচার্য। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। বর্তমানে বা বিগত কিছু বছর ধরে উপাচার্য হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের কয়েকজনের কিছু কর্মকাণ্ড উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ করার বাইরে থেকে গেছে আরও এমন অনেক ঘটনা। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, উপাচার্য হয়ে যারা অনৈতিকতা ও আর্থিক দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন, সেইসব উপাচার্যরা পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে দু’একজনের বিরুদ্ধে। তাদের অপসারণ করা হয়নি। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আন্দোলনকেও ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয়নি। ইউজিসি তদন্ত করে দুর্নীতি, অনৈতিকতার প্রমাণ পেয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এমন সব উপাচার্যদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আমরা হা-হুতাশ করছি, কেন পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের নাম নেই! দুর্নীতির অভিযুক্তদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে, দুর্নীতির তালিকায় স্থান পাওয়া যেতে পারে, সেরা বা শ্রেষ্ঠের তালিকায় নয়।

আমরা অনেক সূচকে আশপাশের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলি। যা অসত্যও নয়। কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নে আমরা যে ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে পড়ছি, তা আড়াল করা সুযোগ নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন নির্মাণ করেছি। শিক্ষকের মান উন্নয়ন করিনি।

ভবন-রাস্তা-সেতু-ফ্লাইওভার-মেট্রোরেল-টানেল উন্নয়নের জন্যে অপরিহার্য। কিন্তু এগুলো মূল উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের সহায়ক। মূল উন্নয়ন মানবসম্পদ উন্নয়ন। সেদিকে আমাদের মনোযোগ নেই, তাই শুধু নয়—মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছি। ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে দেখব, যেখানে যে খালি জায়গা ছিল সেখানে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে, শিক্ষার্থীদের বাসস্থান,খাদ্য-জীবনমান তথা শিক্ষা উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। করোনাকালেও নেই। আমরা মূল উন্নয়ন বাদ দিয়ে যা উন্নয়নের সহায়ক তার পেছনে সময় ব্যয় করছি। ফলশ্রুতিতে আইকনিক চরিত্র উপাচার্যরা এখন অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেন, অনৈতিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ক্রমশ দৃশ্যমান আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবনতি।

লেখক সাংবাদিক।   



 — দি ডেইলি স্টার

Sunday, June 6, 2021

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও একজন জিয়াউর রহমান

 -------------------------------------------------------------------------

— ড. খন্দকার মারুফ হোসেন

--------------------------------------------------------------------------



মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ও আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়- তাঁর ৪০তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে। অপারেশন সার্চলাইটের পরে ২৫ মার্চ গভীর রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হন। মেজর জিয়াউর রহমানই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি একটি ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘We Revolt’, ‘আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করছি’। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরীসহ বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈন্যদের নিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি কর্নেল জানজুয়াকে গ্রেফতার করেন এবং নিজ হাতে তাকে পরাজিত করে বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে অস্ত্রাগার বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের জন্য খুলে দেয়া হয়। পরে তার নেতৃত্বে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা সারা দেশে এবং বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। পরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালীন কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি তার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বহির্নোঙরে থাকা একটি জাপানি জাহাজের রেডিওতে শোনায় যা পরবর্তীতে রেডিও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সংগৃহীত হয় এবং সারা বিশ্ব তা শুনতে পায়। এ ছাড়া আগরতলা থেকে মনিটরকৃত এ ঘোষণা ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত কিছু রেফারেন্স নিম্নে তুলে ধরা হলো —

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দিল্লিতে দেয়া এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় বলেছিলেন, ‘জনাব রাষ্ট্রপতি, আপনার অবস্থান ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের ৭৯ ও ৮০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘এভাবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সাড়ে ৭-৮টা বাজে। এমন সময় ইথারে ভেসে এলো মেজর জিয়ার জলদগম্ভীর কণ্ঠ। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন।’

তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক সচিব হোসেন তরফদার তার ‘মূলধারা ৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮-ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।’

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি নিউজ লেটারে প্রকাশিত খবর। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্যের একাংশে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পরই স্বাধীনতার দামামা শুরু হয়েছিল, তার আগে নয়। তিনি নিজেও, যতদূর আমি জানি, এখনো স্বাধীনতার দাবি করেননি’।

ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০২ সালের ১৩ মার্চ তারিখে ‘দি নিউ ন্যাশন’ পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি বা কারো হাতে কোনো লিখিত দলিল হস্তান্তর করেননি।’

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তার ‘স্বাধীনতা-৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভূঁইয়া ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস’ শীর্ষক বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘বেতার কেন্দ্র থেকে যারা মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তার প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।’

ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ‘রেডিও সেটে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে ‘স্বাধীন বাংলা রেডিও’র ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হয়েছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিন দিশেহারা, হতভম্ব ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।’

ভারতের সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তার ‘হিস্টরি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ‘মেজর জিয়া ও তার বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ওই দিন সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন।’


বিখ্যাত লেখক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছিলেন ‘২৭ মার্চ শনিবার রাত ৮টায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায় মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন- ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভেতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়।’

এ ছাড়া এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকার বীর উত্তমসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বইয়েও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে কেবলমাত্র জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের সময় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দান করেন।

মেজর জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে ১ নম্বর ও পরবর্তীতে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর দৃশ্যত বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। বাংলাদেশের জনগণ হয়ে পড়ে দিশেহারা। ঠিক সে সময়ে সিপাহি-জনতা বিপ্লব ঘটিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি বা ক্ষমতা দখল করেননি। ১৯৭৮ সালে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ৭২-৭৫ এর দুঃশাসনের কালিমা থেকে দেশকে মুক্ত করেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি স্বাধীনতার প্রধান চেতনা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে। মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ শুনতে হয়। জোরপূর্বক বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয় ৭২-৭৫ এ।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। তিনিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সন্নিবেশিত করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার স্থানে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং সব ধর্মের সমান অধিকার প্রবর্তন করেন। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি নারী উন্নয়নের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও মহান স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রবর্তন শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য শিশুপার্ক, শিশু একাডেমি, নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার তিনিই। দেশ যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে উন্নতির শিখরে যাচ্ছে, ঠিক তখনই জিয়াউর রহমানকে দেশী বিদেশী চক্রান্তে শাহাদত বরণ করতে হয়।



শহীদ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শহীদ জিয়ার আদর্শ ও দর্শনকে বুকে ধারণ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা দলকে সুসংগঠিত করেছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সফল হয়েছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেছে। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে শহীদ জিয়ার গড়া দল বিএনপি। যতবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, ততবারই বিএনপি জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাক্সক্ষা গণতন্ত্র বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দেশ আজ স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট ও নব্য বাকশালীদের দখলে। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার শূন্যের কোঠায়। দেশ আজ দুর্নীতি, দুঃশাসন, অপশাসন, গুম-খুন, অপহরণ ও মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে অরাজকতা হয়েছে তা নজিরবিহীন। বিরোধী মতের মুখ বন্ধ করতে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মী মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় জর্জরিত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে বর্তমান বাকশালী, স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লক্ষ্য পূরণ হবে।

  • লেখক বিএনপি নেতা ও অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা 


রণাঙ্গনের জিয়া থেকে রাষ্ট্রনায়ক জিয়া: বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শনের সুরতহাল

-----------------------------------------------------------------                           

—  অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান  

----------------------------------------------------------------


অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, অতি আবেগের কারণে আমাদের জাতি ইতিহাসমনষ্ক নয়। চরিত্র বিনির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই। আবেগের ভেলায় ভেসে 'প্রশংসাকে পূজায় এবং সমালোচনাকে কুৎসায়' পরিণত করার মধ্যে দিয়ে কল্পকাহিনী তৈরি করি। এর কারণ হলো, গোড়ায় গলদ। সোনাভানের পুঁথির বয়ান: 'লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার, গণিয়া দেখিলো মর্দ চল্লিশ হাজার।' 

বাঙালির মন মায়াজালে আবদ্ধ। এরা প্রভু কীর্তনে কিংবা ভিন্নমত দমনে ভেদাভেদ করে না; হোক রাষ্ট্রীয় কিংবা বিশ্বজগতের মালিক; অতি দুর্বল ভিন্নমত পোষণকারী কিংবা স্বয়ং ইবলিশ শয়তান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাঝি-মাল্লা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী- সবাই এই কর্মযজ্ঞে মিলে-মিশে একাকার। আহমেদ ছফার ভাষায়, "এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক প্রোপাগান্ডা লিটারেচারের সংগে পুঁথিসাহিত্যের একটি সমধর্মিতা আবিষ্কার করা খুব দুরুহ কর্ম নয় (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)। সংগত কারণে আমার পক্ষে এই জাতির  ইতিহাস চর্চার পরিচিত মসৃণ পথের বিপরীতে গিয়ে হঠাৎ করে ইতিহাসমনষ্ক হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। এই অক্ষমতা মাথায় রেখেই যা কিছু দলিল-দস্তাবেজ দ্বারা সমর্থিত, অথচ কম আলোচিত কিংবা উপেক্ষিত এমন কয়েকটি বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে রণাঙ্গণের জিয়া ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রবর্তনে রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান-এর সাফল্য মূল্যায়নের চেষ্টা করবো। 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে বীরত্বগাঁথা ও রাজনীতিবিদ হিসেবে চরিত্র বিনির্মাণ করতে হলে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা ও থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ ও স্বরূপ, পঁচাত্তরের পরের দিশেহারা রাজনীতির প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান ও এর সঠিক উপলব্ধি ও সবিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিলো, এই কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। রাজনৈতিক বিভাজন তখনও ছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ফেরত এসে যুদ্ধে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়হীনতার ছিলো। অন্যদিকে থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব ছিলো প্রায় দৃশ্যমান। (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০০৭ পৃ: ১৫)।  

ধীরে ধীরে দৃষ্টিভঙ্গিগত এই ভিন্নতা রাজনৈতিক মোড় নেয়, জন্ম ও বিকাশ লাভ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রিয় দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি গঠনে বলতে গেলে জিয়াউর রহমান এককভাবেই কৃতিত্বের দাবিদার। সাধারণত এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের মাঠে, গোলটেবিল আলোচনায় কিংবা ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সৃষ্টি হয়। সেই বিবেচনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি'র জন্ম এবং জনপ্রিয়তা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক দল গঠন ও প্রতিষ্ঠা লাভের বিবেচনায় ইতিহাসের বিরল ঘটনা। এর পেছনে যে বিষয়গুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তা মূলতঃ ব্যক্তি জিয়া'র ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। 

পেশাদারিত্ব তাঁর চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান একটি দিক। সৈনিক জিয়া'র ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন 'আলফা কোম্পানির' কমান্ডার হিসেবে 'খেমকারান' রণাঙ্গনের বেদীয়ান-এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পেশাদারিত্বের কৃতিত্ব হিসেবে তাঁর কোম্পানির সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে মেজর জিয়া ঢাকায় পোস্টিংয়ের সুবাদে দেশে ফিরে এলেন।  ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পার না হতেই পরিস্থিতি বিষ্ফোরোন্মুখ হয়ে উঠতে লাগলো। শুরু হয় ২৫ মার্চের কালো রাত। বেগম খালেদা জিয়া ও দুই শিশু সন্তানকে চট্টগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেই মেজর জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।  

শ্বাসরুদ্ধকর এই অবস্থার অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে; লাখো মা-বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মেজর জিয়ার সংগে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ না নিলেও বেগম জিয়া দুই অবুঝ শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে বুকে আগলে রেখে আত্মগোপন ও বন্দিদশায় যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ও আতংকে দিন অতিবাহিত করেছেন এবং সন্তানদের রক্ষা করেছেন তাঁর মূল্য রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধার তুলনায় কেনো অংশে কম নয়।

মুক্তিযুদ্ধে জিয়া'র ভূমিকা নিয়ে তাঁর কঠোর সমালোচকরাও নিন্দার কোনো আলামত বা উপকরণ খুঁজে পাননি। জিয়া'র স্বাধীনতার ঘোষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি  উজ্জীবীত ও উদ্দীপ্ত হয়ে তাঁদের লেখায় জিয়া'র প্রশংসা করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (আমার একাত্তর), ভারতীয় কূটনীতিক জে. এন. দীক্ষিত, ট্রেভর ফিসলক ও ডেভিড লুডেন (মাহফুজউল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ, এডর্ন পাবলিকেশন; ২০১৬)। জিয়াই হলেন বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তিযুাদ্ধা রণাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যার ছবি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম মিউজিয়ামে অমর কীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা আছে।

এর ব্যতিক্রমও আছে। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থে (রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, ১৯৭৪, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা) স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং জিয়া'র অবদানের তেমন কোনো উল্লেখ নেই। এতে অবাক হবারও তেমন কিছু নেই। কারণে চরিত্র বিনির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই। 

অতি সম্প্রতি বাংলা ইনসাইডার  অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সৈয়দ বোরহান কবীরের 'জিয়ার' ওপর  একটি লেখা আমার নজরে এসেছে। লেখাটা পড়ে একই রকম অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম হল। তিনি লিখেছেন,"উগ্রবাম ও উগ্র ডানকে  তিনি (জিয়া) ক্ষমতার ঘাটে জল খাইয়েছিল। ফলে তার উগ্রবাদী একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাযায় বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ (সৈয়দ বোরহান কবীর, জিয়ার রাজনীতির পাপ ও পরিণতি, বাংলা ইনসাইডার, ২৯ মে,২০২১) । দৃষ্টিগোচর হলে সাধারনত তার লেখা পড়ি। তিনি অনলাইন পোর্টালটির প্রধান সম্পাদক ও 'পরিপ্রেক্ষিত' এর নির্বাহী পরিচালক ।একটি  দায়িত্বশীল পদে আছেন, ভালো লিখেন। আমরা পাঠকরা এই ধরনের লেখকদের প্রবন্ধ পাঠ করে দোষারোপের সস্তা কুতর্কের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হয়ে ইতিহাসের সঠিক পাঠ গ্রহণ করতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকি। সৈয়দ বোরহান কবীরের সঙ্গে আমি একমত যে, প্রশংসাকে পূজায় পর্যবসিত করা আকাঙ্ক্ষিত, তাই পরিত্যাজ্য। বিভিন্ন গ্রন্থ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত  তথ্যেরভিত্তিতে জেনেছি জিয়ার জানাযায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মনিষীদের অন্যতম প্রধান অন্য দুজন হলেন মহাত্মা গান্ধী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গণমাধ্যম সূত্রেই আমরা অবগত হয়েছি, তাদের শেষকৃত্যে ধারণাতীত সংখ্যক  মানুষের জমায়েত হয়েছিল। জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের  পরিচয় কি ব্যক্তিগতভাবে আমি জানিনা। তবে ভারতবর্ষের জনগণ তথা  বাঙালির মনস্তত্ত্বের বিচারে বলা যায়, জীবিত অবস্থায় যত বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কই থাকুক না কেন, মৃত ব্যক্তির জন্য চোখে আবেগের অশ্রু বিসর্জন দেয়া আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। তাই আমজনতার মত আমার বিশ্বাস,  জিয়ার জানাযা কিংবা গান্ধীজী ও কবিগুরুর  শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীরা  মৃত ব্যক্তিদের কল্যাণ কামনার জন্য সমবেত হয়েছিলেন।  কিন্তু সৈয়দ বোরহান কবিরের দাবি জিয়ার ক্ষেত্রে এদের অধিকাংশই  হলেন জিয়ার মাধ্যমে সুবিধাভোগী উগ্র বামপন্থী ও উগ্র ডানপন্থীদের সমাবেশ।  জানাযায় তারা জিয়ার পরজাগতিক কল্যাণ কামনার জন্য অংশগ্রহণ করেননি, বরং সমবেত হয়েছেন পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম  করার নীলনকশা বাস্তবায়নে অংশ হিসেবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাধারণত সুবিধাবাদীরা কায়েমি স্বার্থ হাসিল করার জন্য রাজা বাদশাদের জীবদ্দশায় প্রাসাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে, তাদের জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে শামিল হয় না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর  বঙ্গবন্ধুর চারপাশে ঘুরঘুর করা সুবিধাবাদী মানুষগুলো কিভাবে কেটে পড়েছিল গোটা জাতি তা লক্ষ্য করেছে। ৩২ নাম্বার বাড়িতে ৩২ ঘণ্টা তার ক্ষত বিক্ষত দেহ পড়েছিল। সুবিধাভোগীরা জানাজায় অংশগ্রহণ করা দূরে থাক , নেতার লাশটি পর্যন্ত  দেখতে যায়নি।  বরং তারা কি করেছে সৈয়দ বোরহানসহ গোটা জাতি অবগত আছেন।জনাব বোরহান, আমার ধারণা জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে যারা যায়, তারা দুধের মাছি নন, দুঃখের সাথী। তাই জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের উগ্রপন্থি কিংবা বিশেষ কোন পন্থী হিসেবে  মূল্যায়ন করা কতটা অনুমাননির্ভর আর কতটা যুক্তিনির্ভর তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। হতে পারে  জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ব্যক্তির অংশগ্রহণ ছিল মঙ্গল কামনার জন্য  নয়, কেবলই আনুষ্ঠানিকতা পালন মাত্র। তাই জিয়ার জানাযায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ  মানুষের অভিপ্রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য স্বজ্ঞাপ্রসূত নয় (counterintuitive) বলেই প্রতীয়মান হয়।  যাইহোক, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক জনাব  বোরহানের এই দাবির যথার্থতা মূল্যায়ন এর উপযুক্ত ব্যক্তি আমি নই, ইতিহাসমনস্ক গবেষকরা এই দাবির যথার্থতা হয়তো একদিন মূল্যায়ন করবেন। সেদিন আমজনতা পাঠকের মত  সৈয়দ বোরহান নিজেই হয়তো  ইতিহাস মনস্ক কোন লেখকের উক্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখা কোন প্রবন্ধ পাঠ করে অনুধাবন করবেন যে, 'জিয়া-সমালোচনাকে'  তিনি  কিভাবে 'কুৎসায়' পরিণত করেছেন। হয়তো কোন একদিন  তিনি নিজেই তার রচিত এই প্রবন্ধের পরিমার্জিত বয়ান জনপ্রিয় কোন একটি দৈনিকে ছাপবেন। অন্য পাঠকদের মত আমিও সেদিন আশা করি বিভ্রান্তি মুক্ত হব।]

যাই হোক, প্রসংগে ফেরা যাক। পরাজিত হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যা তাঁকে অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। তিনি হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাননি। ১৯৭৪ সালে তাঁর নিজের লেখা 'একটি জাতির জন্ম' প্রবন্ধে এর আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসারদের আনুগত্য ছিলো প্রশ্নাতীত। অবশ্য গুটিকয়েক দালাল ছাড়া আমাদের ওরা দাবিয়ে রাখত, অবহেলা করত, অসম্মান করত। দক্ষ ও যোগ্য বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের ভাগ্যে জুটত না কোনো স্বীকৃতি বা পারিতোষিক। জুটত শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা ... ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগনাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মধ্যেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল ..." (রহমান, মেজর জেনারেল জিয়াউর (১৯৭৪), 'একটি জাতির জন্ম', বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যা, ২৬ মার্চ ১৯৭৪, ঢাকা)।

অন্তরে পুষে রাখা স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৬ মার্চ তাঁর রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার আব্দুর রশিদ জাঞ্জুয়াকে প্রতিহত করেন। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যের রাতে জিয়া চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামীলীগ নেতাদের জানাতে বলেন যে, ইস্ট বেঙ্গলের অষ্টম ব্যটেলিয়ান বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করবে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়া যে তাঁর সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, সেটা তাঁর সহকর্মীরা সমর্থন করেন এবং পরে ২৭ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-৪৬)। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়া'র রণকৌশল প্রয়োগের বিষয়টি খুব একটা বাধামুক্ত ছিলো না। চিহ্নিত শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা জিয়াসহ রণাঙ্গনের অনেক যোদ্ধার উৎসাহ উদ্দীপনাকে স্তীমিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। পদ ও বয়সের কারণে তাঁর নিযুক্তি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিলো। কিন্তু তিনি সবার সংগে মানিয়ে নিতে পারেননি। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান তাঁর শুভ দৃষ্টিবঞ্চিত ছিলেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে  জিয়াউর রহমানের অধীনে যুদ্ধ করা কর্মকর্তাদের উপর। বীরত্বসূচক পদক বিতরণের সময় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পদকবঞ্চিত হন জিয়া'র অধীনে যুদ্ধ করা অধিকাংশ কর্মকর্তা। পক্ষান্তরে অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করেই এম এ জি ওসমানী'র সংগে সু-সম্পর্ক থাকায় 'খয়রাতি বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত হন (কর্নেল শাফায়াত জামিল, ২০০৯, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ- ৫৪)। 

প্রসংগত উল্লেখ্য, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে 'জেড ফোর্স' নামক বিগ্রেড তৈরি করা হয়েছে। জুন ৭১-এ তৈরি এই 'জেড ফোর্স'ই হলো সর্বপ্রথম ব্রিগেড। পরে কে এম সফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফ তাঁদের অধীনে আরও দু'টি ব্রিগেড তৈরি করার জন্য এম এ জি ওসমানী'র ওপর চাপ  অব্যাহত রাখেন। আরও দু'টি ব্রিগেড তৈরি করার মতো নিয়মিত সেনা তখন না থাকলেও এম এ জি ওসমানী'র সংগে সু-সম্পর্ক থাকায় তিনি ৩০ আগস্ট সফিউল্লাহর অধীনে 'এস ফোর্স' এবং ২৪ সেপ্টেম্বর খালেদ মোশাররফের অধীনে 'কে ফোর্স' নামে আলাদা দু'টি ব্রিগেড তৈরি করেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ- ৪৮)।  

রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জিয়াকেও ১৯৭২ সালে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। এটি সন্দেহাতীতভাবেই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক ঘটে তখনই, যখন দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে জিয়া ও সফিউল্লাহ একই ব্যাচে কমিশন পেলেও ক্রম অনুযায়ী জিয়া'র নাম উপরে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সফিউল্লাহকে ৩ বছরের জন্য সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ নিয়োগ করা হয়। বৈষম্যের বঞ্চনার দহন এখানেই শেষ নয়।  সফিউল্লাহকে প্রথম তিন বছরের মেয়াদ শেষে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো তিন বছর মেয়াদে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় (নূরুল ইসলাম চৌধুরী, '১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে', ভোরের কাগজ, ১৫, ১৬ ও ১৭ আগস্ট, ১৯৯৪)।

ইতিহাসের এই বিবরণ পাঠে একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয়: কর্মজীবনের শুরু থেকেই রণাঙ্গনে ভূমিকা রাখার জন্য পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পুরষ্কারে ভূষিত জিয়াউর রহমানের সংগে এম এ জি ওসমানী'র এই শীতল সম্পর্কের কারণ কী? কেনই বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রচলিত জ্যেষ্ঠতার নিয়ম লঙ্ঘন কওে, মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় অবদান রাখার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত বীর উত্তম জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার পদবঞ্চিত করা হলো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার যথাযথ ব্যক্তিরা হলেন ইতিহাসের গবেষকগণ। সেই কারণে আমি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে অতি সাধারণীকরণের ঝুঁকি অনুভব করে, তা থেকে বিরত থাকাই সংগত মনে করছি। 

পেশাদার একজন সামরিক কর্মকর্তার যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে শীর্ষ পদে যাওয়ার বিষয়টি তাঁর অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এটি মোহ বা লোভের বিষয় নয়। অধিকার বঞ্চিত হয়েও প্রতিশোধের পথ বেছে না নিয়ে তিনি বছরের পর বছর (অন্তত সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে সফিউল্লাহ'র ৩+৩=৬ বছর মেয়াদে) ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা (ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্যু পাল্টা ক্যু-তে বিশেষভাবে খ্যাত একটি বাহিনী)।  লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ঐ সময়ে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠিয়ে দিতে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়। পেশার প্রতি একনিষ্ঠ জিয়া বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার প্রস্তাব বিনয়ের সংগে প্রত্যাখ্যান করেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত খুরশিদ উদ্দিন আহম্মেদ-এর সহায়তায় দেশ থেকে বিতাড়িত হবার দুর্ভাগ্যবরণ করা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন (হামিদ, লে. কর্নেল (অব.) এম এ (২০১৩), তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ- ১২-১৩)।

১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পেছনে জিয়াউর রহমানকে অনেকেই অনুমান-নির্ভর মূল্যায়ন করে থাকেন। দু'টি ঘটনা উল্লেখ করে বলা যায়, পটপরিবর্তনের কর্মকান্ডে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিলো না মর্মে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

(১) প্রথম ঘটনাটি হলো, ঢাকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পরে ঐ বিষয়ে অবহিত করার পরও জিয়া'র মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার কোনো ধরনের লক্ষণ কিংবা আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি বরং অতি সংক্ষেপে বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষেই তিনি মত প্রকাশ করেন (কর্নেল শাফায়াত জামিল (২০০৯), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ- ১০৩)।

(২) দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হবার পর। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, সাফায়াত জামিল জিয়া'র কক্ষে বসে আছেন। এমন সময় সদ্য পদোন্নতি পাওয়া এবং সরকারি আদেশে দিল্লিতে অবস্থানরত মেজর জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানের কক্ষে প্রবেশ করেন। এরশাদকে দেখে জিয়াউর রহমান রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বলেন,'আপনি অনুমতি ছাড়া কেন দেশে ফিরে এসেছেন?' জবাবে এরশাদ বলেন, 'আমার স্ত্রীর জন্য গৃহভৃত্য নিতে এসেছি। ততোধিক রেগে গিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, 'আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এ ধরনের লাগামহীন আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্র প্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে' (কর্নেল শাফায়াত জামিল (২০০৯), পৃ- ১২০-১২১)'। একইসংগে তিনি এরশাদকে বঙ্গভবনে যেতে নিষেধ করেন এবং পরের ফ্লাইটেই দিল্লি যেতে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ অমান্য করে ঐ রাতে এরশাদ বঙ্গভবনে যান এবং অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সংগে বৈঠক করেন (প্রাগুপ্ত)। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খোন্দকার মোশতাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশংকাজনকভাবে সংকুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই আদেশে বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সংগে জড়িত কারও বিচার করা যাবে না (মহিউদ্দিন আহমদ, ২০১৭, পৃ-৬৪)। অধিকন্তু কর্নেল সাফায়াত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী, তার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও খোন্দকার মোশতাক অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডে জড়িত মেজর রশীদ, ফারুক ও ডালিমকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন (সাফায়াত জামিল, ২০০৯, পৃ-৭)। এই ঘটনা প্রমাণ করে, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকান্ডের সংগে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অভ্যুত্থানকারীরা ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে সংঘটিত করলো? অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো তৎকালীন সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হওয়া নেতিবাচক মনস্তত্ত্ব। স্পষ্ট ভাষায় বললে, তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রতি অবহেলা ও ভারতীয় আধিপত্যের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য তারা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ১৯৭৪ সালে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করার বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটা দানব সৃষ্টি করতে চাই না' (মাসক্যারেনহাস, অ্যান্থনি, ২০০২), বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, A Legacy of Blood-এর ভাষান্তর, অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃ-৩৮-৩৯)। এর বিপরীতে তিনি রক্ষীবাহিনী নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেন; প্রথমে পুলিশের এটি সহায়ক বাহিনী হলেও পরে এই বাহিনীকে ক্ষমতা দেয়া হয়, যা দিয়ে তারা যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারতো এবং অনেকেই মনে করেন তাদের ব্যবহার করা হতো আওয়ামী লীগের সমালোচকদের বিরুদ্ধে (প্রাগুক্ত)। এর সংগে যুক্ত হয় বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যা ব্যপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের আস্থাভাজন তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ এ ধরনের পদক্ষেপ সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে বিধায় তাঁকে অবহিত করার তাগিদ বোধ করেন। এ ব্যাপারে ভোরের কাগজের (তৎকালীন) সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সফিউল্লাহ বলেছেন,

স্যার, 'সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। হঠাৎ করে এক পার্টিতে কেন যাচ্ছেন?' তিনি বললেন, 'সফিউল্লাহ, তুমি বুঝবে না ... আমার ওপর বিশ্বাস রাখো' ( ভোরের কাগজ, ১৫ ও ১৬ আগস্ট, ১৯৯৩)। 

সফিউল্লাহ এক্ষেত্রে আরও মন্তব্য করেন, 'মনে হয় এসব কিছুর পরও যদি রক্ষিবাহিনী সামনে না আসতো, সেনাবাহিনী সেগুলো মেনে নিতো (প্রাগুক্ত)। সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব অগ্রহণযোগ্য ছিলো মর্মে মন্তব্য করেছিলো আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত মিত্র বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। তাদের মূল্যায়নে বলা হয়- 'আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর জন্ম ও ভিত্তি তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার মতো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে... পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনীর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে তেমন বৈরীসুলভ দৃষ্টি গ্রহণ করা খুবই ক্ষতিকর হবে (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭৯, 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আমাদের পার্টির ভূমিকা ও করণীয়', কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গৃহীত, পৃ-১৪-১৫)'।

১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী ও আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের নিজস্ব বয়ানের (জনগণ এ বিষয়ের উপর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্টই অবগত হয়েছেন) পাশাপাশি উপরোল্লিখিত ঘটনাবলী বিশ্লেষণের আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ৭৫-এর পট পরিবর্তনের সংগে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁকে দায়ী করা বক্তব্য কিংবা লেখনি ভ্রান্ত অনুমাননির্ভর, অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

৩) ৭৫-এর নভেম্বরে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ ছিলো একটি সময়ের দাবি। সংকট, সন্দেহ, পারস্পরিক দোষারোপ, ক্যু ও পাল্টা ক্যু-এর অগ্নিঝরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিপাহী-জনতা অবরুদ্ধ জিয়াকে মুক্ত করে কীভাবে দেশ পরিচালনা গুরুদায়িত্ব প্রদান করেছেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন দেশবাসী অবগত আছেন। এই ইতিবাচক ঘটনাকে যথাযথ মর্যাদা দানের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বরকে 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করা হয়।

জিয়া'র দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কী হবে, এর একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গেছে। জিয়া প্রতিশোধ পরায়ন ছিলেন না। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও শত্রু চিহ্নিত করে নির্মূল করার পথে না হেঁটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে জিয়া সর্বস্তরের জ্ঞানী-গুনী মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছেন, যা পর্যায়ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।

১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট এই দল গঠন করা হয়। সাধারণত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে এ দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ এটি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের মস্তিষ্কজাত রাজনৈতিক মতাদর্শ। সংগত কারণে অনেকের মধ্যে সংসয় ছিলো, এটি কি রাজনৈতিক দল নাকি একটি 'প্রবণতা'। কিন্তু সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে এই দলটি জনগণের সমর্থন আদায় করে প্রভাবশালী দল হিসেবেই স্থায়িত্ব অর্জন করেনি বরং জিয়া পরবর্তী সময়ে তিনবার গ্রহণযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে দেশ শাসন করেছে। 

এই দলের গ্রহণযোগ্যতা তথা জনপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি কারণ হলো- ১) জাতীয়তাবাদী দলের দার্শনিক ভিত্তি, ২) জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ৩) কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। 

বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় 'বাঙালি' হিসেবে ধার্য করা হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এই ধারণায় পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন। নাগরিক হিসেবে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কী তা স্পষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে 'বাঙালি' পরিভাষাটি ব্যবহার করি, তাহলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকগণ (যেমন-আদিবাসীগণ) জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। এটি আমাদের জাতিসত্বার একটি খন্ডিত পরিচয় তুলে ধরে। জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সকল নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে 'বাঙালির' স্থলে 'বাংলাদেশী' পরিভাষা ব্যবহার করা প্রস্তাব করেন। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের তাত্ত্বিক বিচ্যুতি দূর করার লক্ষ্যে কালক্ষেপণ না করে তিনি ফরমান জারি করে একে আইনি কাঠামোর মধ্যে স্থিত করেন। এর পক্ষে তার যুক্তি হলো-

'বিশেষ করে ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, এ বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটেছে। 'রেজিয়াল' বা জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা এ প্রসংগে সর্বপ্রথমেই এসে যায়। আরব ও জার্মান জাতীয়তাবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।...এর পর আসে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্লোগান এই ধ্যান-ধারনা থেকেই উৎসারিত। এ কারণেই আওয়ামী লীগাররা বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে এখনো বিভোর রয়েছে। আবার মুসলিম লীগ, আইডিএল এবং জামায়াতিরা বলে থাকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা।...সত্য করে বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে শোষণ ও শাসন চালানো হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে 'পলিটিক্স অব এক্সপ্লয়টেশন' পাকিস্তানকে এক রাখতে পারলো না। প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করেও রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে একটি নতুন জাতীয়তাবাদ।... তাই আমরা বলি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ।... বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয় তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। ...প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতির একটি স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্নই হলো [সেই জাতির] দর্শন। এই দর্শন দিয়েই [চর্চার মাধ্যমেই] বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়িত করতে হবে' ('বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ', জিয়াউর রহমান, www.bnpbangladesh.org)।  

জিয়াউর রহমানের মতে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সার্বজনীন ও অবৈষম্যমূলক। এটি কেবল ধারণাগত বিষয় নয় বরং দেশপ্রেমের চেতনাস্নাত একটি প্রণোদনা; যা সকল নাগরিককে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সমান গুরুত্বের সংগে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৮১ সালে মার্কাস ফ্রান্ডাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জিয়াউর রহমানের বক্তব্যে তা-ই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন,

"এটা আমাদের দেশ, আমাদের ভূমি, ... এখন সুযোগ এসেছে ... চাষাবাদ করি এবং এর উৎপাদনশীলতা বাড়াই, শিল্প গড়ে তুলি এবং মর্যfদার সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। ... আমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজেদের শক্তিতে ... কোনো বিদেশীবাদ নয় (Franda, Marcus (1981) Ziaur Rahman and Bangladeshi Nationalism, Economic and political weakly, Vol. XVI, No-10-11-12, 1981; quoted in Hossain) p-63।

জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দেশব্যাপী বুদ্ধিজীবী সমাজে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ এই রাষ্ট্র দর্শনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে প্রান্তিক আদিবাসীরাও গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাই সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের স্বীকৃতি পায়, জিম্মি থাকে না আহমদ শরীফের ডায়েরি, ভাব-বুব্দুদ, পৃ-৬৪)। তবে তিনি জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করেননি। তাঁর মতে এর ফলে পূর্ণ নাগরিক হিসেবে মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার ক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণ বৈষম্যের শিকার হবেন (প্রাগুক্ত)।

আমার মতে, দু'টি কারণে আহমদ শরীফের শেষের মন্তব্যটি পূনঃবিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, জিয়া প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী দলের নীতিমালা অনুযায়ী জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রতি আস্থা রেখে দলের সমর্থক, কর্মী, কিংবা নেতৃত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের জন্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বরং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত এই দল অমুসলিম বাংলাদেশী নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের আইনগত ভিত্তি রচনা করেছেন। যার রূপকার জিয়াউর রহমান নিজেই। দ্বিতীয়ত,'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ আবার প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। জিয়া সাংবিধানিকভাবে দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেননি। যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদারনৈতিক চেতনা দ্বারা সুরক্ষিত। জিয়াউর রহমান সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযুক্ত করার মাধ্যমে মূলতঃ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন অমুসলিম নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় সমুন্নত রেখেছেন, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার প্রতি আন্তরিক সমর্থনের নিদর্শন হিসেবে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করেছেন।

তাঁর এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও নির্মোহ অকপট ভাবনার অতুলনীয় পন্ডিত আহমদ ছফা'র একটি উক্তিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছফা বলেন 'ইসলামের সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের সংগে যোগহীন রাজনীতির কোনো ভবিষ্যত এ দেশে নেই (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)'। নিরোধ বরণ চৌধুরী ১৯৬৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় পাঁচ পর্বে মুদ্রিত 'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' নামক প্রবন্ধে এ ধরনের একটি সমন্বয় ধর্মী অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রদর্শনের উন্মেষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সংগত কারণে বলা যায়, এই জাতির জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে আওয়ামী লীগের 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনার তুলনায় জিয়া'র রাষ্ট্রদর্শন 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রায়োগিক। এ প্রসংগে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-

আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির নিষ্পত্তি হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ওই ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেদন একাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতার সংগে কতোটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তরের স্মৃতি নিয়ে বসে থেকে তো জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা, যুদ্ধ-উত্তর সময়ের প্রয়োজনে সমঝোতা ও ঐক্যের রাজনীতি এবং জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বৃহত্তর নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার সংগে তাল মেলাতে পারেনি। ঐক্যের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিটিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। এর ফলে জাসদের মতো একটি রাজনৈতিক প্রবণতার জন্ম হয়। বাহাত্তরে প্রয়োজন ছিলো নতুন রাজনীতি, নতুন কৌশল। একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে 'জয় বাংলা' স্লোগান তার কার্যকারিতা সম্পন্ন করেছিলো। আওয়ামী লীগ এরপর পুরনো মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মনে করতে শুরু করে, মুসলিম লীগের বিরোধিতা মানেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেশদ্রোহ। একাত্তরের পর আওয়ামী লীগও বিরোধীদের সমালোচনার মধ্যে সবসময় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে থাকে। সরকার-বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহ একাকার করে ফেলে। এখান থেকেই শুরু রাজনৈতিক সংকটের। এর ধারাবাহিকতা চলছে আজও (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-১৩৪-১৩৫)।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয়তার পেছনে অন্য কারণ হলো- জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। এই ভাবমূর্তি তৈরির পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যতীক্রমহীনভাবে সদগুণাবলীর চর্চা। এ বিষয়ে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটি শেষ করতে চাই। কাফি খান ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর প্রেস সচিব। যিনি এক সময় 'ভয়েস অব আমেরিকার' সংবাদ পাঠক ছিলেন। খুব কাছ থেকে তিনি জিয়াউর রহমানকে দেখেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী,

'আত্মীয় স্বজনদের কেউ কোনো তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তাঁর বাসায় আসার সাহস পায়নি। তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একমাত্র দেখা যেত রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে গেলে সফরসংগী হিসেবে। তা-ও সব সফরে নয়।... তিন-চার হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন (সৈয়দ আবদাল আহমেদ-এর নেওয়া কাফি খানের সাক্ষাৎকার, www.bnpbangladesh.org)।

একই ধরনের মূল্যায়ন করেছেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তনি বলেন 'রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর মতো স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিমুক্ত এতো কঠোর রাষ্ট্রনায়ক আমি আগে কখনও দেখিনি (ভাসানীমঞ্চ, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন)'।

এই দলের গ্রহণযোগ্যতার পেছনে তৃতীয় কারণ হলো- কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। বিষয়টি যথাযথভাবে ব্যাখ্যার জন্য বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। যা একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনার দাবি রাখে (এ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনার কাজ এগিয়ে চলেছে)। 

যে কথা বলে শেষ করতে চাই, তাহলো- জিয়া'র জাতীয়তাবাদী দর্শনের মর্মকথা হলো, কেবল ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের মতাদর্শের সঠিক উপলব্ধি ও এর বাস্তবায়ন। এই লক্ষ্য অর্জনে জিয়া'র উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভূমিকা রাখবে, তাতে সন্দেহ নেই। 

প্রয়োজন জিয়া'র গুণাবলীতে অনুপ্রাণিত ও আলোকিত নেতা-কর্মী ও সমর্থক। গ্রিক দার্শনিক ও মানবজাতির একজন শিক্ষক হিসেবে খ্যাত মনীষী অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, নৈতিকভাবে আলোকিত সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য প্রয়োজন সদগুণচর্চা, যা নৈতিকভাবে অনুকরণযোগ্য নেতৃস্থানীয় পূর্বসূরীদের অনুসরণ করে করতে হয়। যেমন- সততা, মহত্ব, সাহস, বন্ধুত্ব ইত্যাদি সদগুণচর্চার ক্ষেত্রে সেসব আলোকিত পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতে হবে, যারা শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ চর্চায় অটল ছিলেন। ইতিহাস ও সাহিত্য এই উদাহরণ সৃষ্টিকারী আলোকিত মানুষদের কর্মকাণ্ড ধারণ করে; সংগতকারণেই সদগুণচর্চার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাস ও সাহিত্য নির্ভরশীলতা রয়েছে। ইতিহাস ও সাহিত্য মানবজাতির সাংস্কৃতিক স্মৃতির আধার (Store House of Cultural Memory)। তাই এই জাতির ইতিহাস মনষ্ক হওয়া অতি জরুরি। তাহলেই কেবল অনুকরণযোগ্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী রাজনৈতিক অভিভাবকের সঠিক সন্ধান পাওয়া যাবে। পেলেই চলবে না, প্রয়োজন সবাই সেই অনুযায়ী জীবন আচরণে অভ্যস্ত হওয়া। দল-মত নির্বিশেষে সকলের জন্যই আত্মজিজ্ঞাসার এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সময় এসেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা সামগ্রিকভাবে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে চাইলে সবাইকে এই আত্মজিজ্ঞাসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে এবং এক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শন উপলব্ধি, চর্চা ও বাস্তবায়নের সংগে যেসব নেতা-কর্মী ও সমর্থক জড়িত, তাদের জন্য আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব কিছু নয়, কারণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রবক্তা জিয়াউর রহমান স্বয়ং এক্ষেত্রে অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

  • লেখক শিক্ষক দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

‘ছাত্র রাজনীতিকে আমি সহশিক্ষা বলব’

-------------------------------------- 
আবিদ হাসান/বাংলাট্রিবিউন
 -------------------------------------- 
ইকবাল হোসেন শ্যামল
সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল

দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা, ক্যাম্পাসে ভিন্নমতের চর্চা ও ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রমের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের কী ভূমিকা ছিল? ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ছাত্র সংগঠনগুলো জোরালো ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার যখন স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়েছে বা দেখাতে চেয়েছে, অগণতান্ত্রিকভাবে জনমতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছাত্র সংগঠনগুলো ওই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ১/১১-এ ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও ছাত্র সংগঠনগুলো কথা বলছে। 

 বাংলা ট্রিবিউন: আগামীর ৫০ বছর কেমন আশা করেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের যে মূল আকাঙ্ক্ষা তথা গণতন্ত্র- তা আমরা পাইনি। গণতন্ত্রের যে মূল উপকরণ-জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, জনগণের ভোটাধিকার, সেই অধিকার এই সরকার খর্ব করেছে। ৫০ বছরেও আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পাইনি। জনগণের মৌলিক অধিকার প্রত্যক্ষ ভোট, তা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা আশা করি, দেশের জনগণের ভোটের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করবো, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবো। 

বাংলা ট্রিবিউন: ক্যাম্পাসে রাজনীতির সংস্কৃতির পরিবর্তন আসছে কি? কী পরিবর্তন দেখছেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: ছাত্র রাজনীতিকে আমি সহশিক্ষা বলব। আমি মনে করি শুধু ক্লাসরুমে শিক্ষকের লেকচারে শিক্ষাটা সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। ছাত্র রাজনীতিকে আমি সামাজিক কার্যক্রম বলতে চাই। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান যতটা আশা করি তার সিংহভাগই অনুপস্থিত। ক্যাম্পাস মুক্তচিন্তার জায়গা হবে, স্বাধীনভাবে আমি আমার মত প্রকাশ করবো। বর্তমানে ক্যাম্পাসে সেই পরিবেশ নেই। রাজনীতি সংস্কৃতির পরিবর্তন আসেনি। আশির দশকেও ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে সহাবস্থানের রাজনীতি করেছিল। কিন্তু বর্তমানে ভিন্নমতের কোনও সংগঠনকে আমরা লালন করতে পারি না, ধারণ করতে পারি না। 

বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কেমন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটা 'খয়ের খা' প্রশাসন। এই প্রশাসন সরকারের অনুগত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনের কাছ থেকে নিরপেক্ষ আচরণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। আমাদের সুন্দর ক্যাম্পাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই আস্থা রাখতে হবে। সেই আস্থার জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেই। রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ
বিনির্মাণ করতে পারছে না। 



বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দিলো, এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি কোন দিকে? ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তির জন্যই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। শত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্দেশ্যের অনেকটাই পূরণ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই রচিত। তবে বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমরা হতাশ। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেক নিচে। রাজনৈতিক প্রভাব আছে বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও নামছে। যখন সকল মতের জন্য ক্যাম্পাস হবে তখন শিক্ষার পরিবেশেরও উন্নতি হবে। 

বাংলা ট্রিবিউন : এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সহাবস্থান আছে? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাড়া সকল সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপরই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম খুবই সীমিত। ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্বাচন দীর্ঘদিন হচ্ছে না। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যদের কার্যক্রমগুলোকে সীমিত করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে সহাবস্থান আছে। এটাকে সহাবস্থান বলা যাবে না। কারণ প্রতিনিয়তই তারা আমাদের ওপর হামলা করছে। আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। 

বাংলা ট্রিবিউন : হলগুলোতে ক্ষমতাসীনদের একক আধিপত্য রয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ, এ বিষয়ে কী বলবেন? 
 ইকবাল হোসেন শ্যামল : এর সঙ্গে আমিও একমত। ভিন্নমতের কাউকেই স্থান দেওয়া হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের বাইরে গেলে কাউকেই হলে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাংলা ট্রিবিউন : ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ভিন্নমত গ্রহণের প্রবণতা আছে? ইকবাল হোসেন শ্যামল: ভিন্নমত থাকবেই। আমরা ভিন্নমতকে সম্মান করি। আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। বর্তমানে কিছু কিছু সংগঠনের মধ্যে ভিন্নমত গ্রহণের প্রবণতা কমেছে। তারা অন্য মত কিছুতেই সহ্য করছে না। এটা আশঙ্কার জায়গা। এটা অবশ্যই শিক্ষার পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।


Wednesday, June 2, 2021

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর অর্থনীতি

------------------------------------------

—  ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

------------------------------------------

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম

একমূখী রাষ্ট্রীয়করণ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ভারসাম্যপূর্ণ বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেন।

জিয়াউর রহমান সরকার সমাজতান্ত্রিক মেরুকরণকৃত একমুখী নীতি কৌশল থেকে সরে এসে অর্থনীতি, শিল্পনীতিতে  গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতিপদ্ধতির মাঝামাঝি একটা মধ্যপন্থী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে। এসময় গুরুত্বপূর্ন প্রায়  সকল নাগরিক সেবাকে সরকারি খাতে রেখেই বেসরকারি শিল্প বিকাশের পথে হাঁটা হয়। 

দ্রুত দেশের আর্থ-সামাজিকউন্নয়নের জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় করেছেন তিনটি উৎপাদন মূখী অর্থনৈতিক ধারা। এক — কৃষির সবুজ বিপ্লব। দুই — গণশিক্ষা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযান। তিন — শিল্প উৎপাদন। এসময় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দুটি শ্রমবাজার তৈরি হয় বাংলাদেশে। এক — তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার। দুই —  মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমবাজার। এর বাইরেও আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ  উদ্যোগ ছিল যা হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা। তিনটি অর্থনৈতিক ধারা এবং দুটি শ্রম বাজার পরবর্তিকালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু বংলাদেশ একটি বাজারমুখি রাষ্ট্র এবং যার সূচনা জিয়াউর রহমানের শাসনকালেই, তাই অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, মূলত এই সময়কালে সূচিত পরিবর্তন গুলোর ভিত্তিতেই পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ ও গতিপথ আবর্তিত হয়েছে।  বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তিনটি অর্থনৈতিক স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি, প্রবাসী শ্রমবাজার এবং তৈরি পোশাক শিল্প। এই তিনটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এই সময়েই সূচিত হয়েছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালে ক্ষুধার তাড়নায় নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত স্রোতের মত নগরে বিশেষ করে ঢাকায় ছুটেছেন,যাঁদের অনেকেই পরে গ্রামে ফিরে যাননি। অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষিতে সেচের সমস্যা ও অযান্ত্রিক শ্রমের প্রাচুর্য ছিল বলে সেখানে কৃষির কাজে অধিকতর সংখ্যায় শ্রমিক নিয়োজিত ছিল, ফলে বাংলদেশের গ্রামে গ্রামে ছদ্মবেকারত্বের প্রাচুর্যছিল। শ্রমঘনীভবনের দুর্ভিক্ষকালীন ধারা এবং আগে থেকেই বিরাজমান কৃষির ছদ্মবেকারত্ব —  এই দুটি ধারা জিয়াউর রহমানের আমলে শ্রমবাজারে রূপান্তর ঘটে। এসময় গণচীন পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন সহায়তায় তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ নতুন এক শ্রমবাজারের পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমের আরেকটি নতুন বাজার গড়ে উঠে। পাশাপাশি অলস ভাতার পরিবর্তে কাজের বিনিময়ে অলস শ্রমকে উৎপাদনমুখী কাজে জড়িত করায়, খাল খনন করে সেচের সুবিধা তৈরির ফলে কৃষিতে ও সবুজবিল্পব আসে। ফলে দেশে প্রায়োগিক পূঁজি ও মানবপূঁজি উভয়ের বহুবিধবিকাশ শুরু হয়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত বিকশের পথ ও তৈরিহয়।

ফলস্বরূপ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের মাঝের ও শেষ এই দুটি অর্থবছরে (১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮০-৮১) বাংলাদেশ সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও আব্দুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  বাংলাদেশের মাথাপিছু স্থূল দেশজ উৎপাদন গড়ে ৪.৫২% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, যা নব্বই দশকের আগের সময়ে গড় হিসেবে সর্বোচ্চ।















ছক —  জিয়াউর রহমান ও আবদুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার। তথ্যসূত্র —  বিশ্বব্যাংক।   

বিবিধ কারণে জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শুরুর সময়কাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত অবকাঠামোগত পুরোপুরি পুনর্ঘটিত হতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ,  ১৯৭৫ সালের বাকশাল ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ সার্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন জনিত বড় বড় দুর্ভাগ্যজনক অস্থিরতাগুলো বাংলাদেশের অর্থনিতিকে ভুগিয়েছে। দেশে সার্বিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

বহুমুখী বাস্তবধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ। এ সময়ে খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে, গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে একধরনের গণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক  কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। এমনকি কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল জিয়া সরকারের। জিয়াউর রহমান সরাসরিই কৃষি সমবায় এবং সমবায় বাঁধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মসূচী দৃষ্টিতে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তৃণমূলে গণভিত্তিক উৎপাদন ও শাসনব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এসবের পাশাপাশি মৌলিক সেবা খাতকে সরকারি আয়ত্বে রেখে পশ্চিম ইউরোপীয় ধারার এক ধরণের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতের উৎসাহিত করা হয়েছে, এই বিকাশ সাধনে ব্যাংক ঋণ কর্মসুচীও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষিতে খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, বেতার-টিভির সম্প্রসারণ, টিভির রঙিন সম্প্রচার, জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা, চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

নিন্মে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য দিক গুলোর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে। 

স্থিতিশীলতা — 

১। গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন। 

২। তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৩।রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান চরম বিশৃঙ্খল দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।‍ সশস্ত্র বাহিনীতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।  সামরিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সম্পন্ন হয়েছিলেন। 

৪। বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ প্রতিষ্ঠা। 

কৃষি — 

পানির পাম্প চালিয়ে কৃষকদের উৎসাহ
দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
১। আবাদী জমি তিন গুণ করার উদ্যোগ নিয়ে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন ছিল এই সময়ের একটা বড় উদ্যোগ।

২। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানির পর্যায়ে উন্নীতকরণের উদ্যোগ।

৩। দারিদ্র্য বিমোচনে ড. আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডলকে এগিয়ে নেয়া। 

৪। কাজের বিনিময়ে খাদ্য/কাবিখা, কাজের বিনিময়ে নগদ মজুরীর মত মেধাবী ধারনা দিয়ে সারফেইসে স্বাদু পানির রিজার্ভ বৃদ্ধি করে আবাদী জমি বাড়াতে খাল খননকে একটি সফল কৃষি বিপ্লবে রূপ দেয়া।  

শিল্প — 


১। নতুন ধারার বেসরকারি শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ। কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি। টেলিফোন শিল্প সংস্থার বিকাশ করে দেশে টেলিফোন সেট উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে পাকশি কাগজ কলে দৈনিক ৩০ টন করে কাগজ উৎপাদন শুরু হয়, যা দেশে পাটখড়ি থেকে কাগজ উৎপাদনের প্রথম উদাহরণ।

২। যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।

৩। তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মত নব ধারার বেসরকারি খাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।

৪। জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানির দ্বার উন্মোচন।

৫। ১৯৭৬ সালে প্রথম ৬০০০ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাঠানোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু। হয়

৬। শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।

৭। ১৯৭৯ তে বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানীযোগ্য তৈরি পোশাক শিল্প (বস্ত্র শিল্প) প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টসের যাত্রা। এর আগে ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৩০ জন কর্মী-উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়দক্ষিণ কোরিয়াতে ট্রেনিং পাঠানো হয়।আশির দশকের শেষ দিকের একটি জরীপে দেখা যায়, এই ১৩০ জন্যের অধিকাংশেরই নিজস্ব তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা ছিল। তবে অভিযোগ আছে, শিল্প ঋণ প্রণোদনা পাওয়া একটা ক্ষুদ্র অংশ ঋণ খেলাপি হয়েছেন এবং শিল্প ঋণের খেলাপি সংস্কৃতি তৈরি করেছেন, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে  পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অপধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।  

৮। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণকার্যক্রম শুরু করে (অধ্যাদেশ পাশহয় ১৯৮৩ সালে)।

৯। ১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হয়, ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

শিক্ষা — 

১। গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দানেরউদ্যোগ।

২। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়তৈরি।

৩। আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ইংরেজী, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা। 

৪। শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা, শিশু মনোবিকাশে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের শিশু পার্ক নির্মাণ করা হয়। 

৫। টেক্সটাইলকলেজপ্রতিষ্ঠাযাবর্তমানেবাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)। 

৬। সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সরকারি কর্ম কমিশন সংস্কার করে বিসিএস এ ১৪ টি বিশেষায়িত ক্যাডার সার্ভিস চালু করেন যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

স্বাস্থ্য — 

১। ২৭, ৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।

২। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

৩। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ এর পুনঃ সূচনা। (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (স্যাটো) কলেরা গবেষণা পরীক্ষাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার (সিআরএল) খুব দ্রুত ডায়রিয়া রোগ গবেষণায় একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও ফান্ড জনিত কারণে উল্লেখযোগ্য এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে কলেরা গবেষণা গবেষণাগার (সিআরএল) কে আইসিডিডিআর’বি নামে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসময় বক্ষব্যাধী/টিবি হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালের পরিসর বড় করা হয়,হার্টফাউন্ডেশান, ক্যান্সার হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। জাতীয় শিশু টিকাদান কর্মসূচী চালু করেন।   

৪। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রণয়ন। বাংলাদেশের জরূরী ভিত্ততে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া নিয়ে মার্কিন তারবার্তায় (জানুয়ারী ১৯ ১৯৭৬, সিআইএ টেলিগ্রাম নাম্বার ০৩২৫/০৯৫০Z) সিনেটর ম্যাক গভার্নের সাথে আলাপের প্রসঙ্গে বলা হয় যে- “তারা (জিয়া) এটি বুঝতে পারছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আটকাতে না পারলে অন্য সেক্টর গুলোতেও তারা সফল হবেনা। তিনি (জিয়া) আরো জানিয়েছেন যে তারা তাদের সেরা এবং সবচেয়ে কার্যক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন সাত্তার’কে জনসংখ্যা বিষয়ক কার্যক্রমের সচিব নিযুক্ত করেছেন এবং আশা করছেন যে এটা ফলপ্রসু হবে। তারা আরো বেশী সংখ্যক এবং বেশী দক্ষ লোকবল নিয়োগ করবে এবং আরো বেশী সংখ্যক নারীকে এটার সাথে জড়িত করবে।”   

জিয়াউর রহমান সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম বড় একটা কারণ সেসময়ের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যে বিশেষ কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতার জেরে অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক দুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার তিনটি মূল দিক ছিল। এক —  একচেটিয়া সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের সাম্যাবস্থা তৈরি। দুই —  মুসলিম বিশ্বের কাছ থেক স্বীকৃতি আদায় করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক শ্রমবাজার তৈরি হয়। তিন— চীনের সাথে সুস্পম্পর্ক স্থাপন যার মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্য বিভাগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ নামে দু’টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়।  

জিয়াউর রহমান প্রাচ্যের পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তার পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্ক গুলোতে সমাজতান্ত্রিক বাঁকজনিত কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৈত্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা এই আমলে রচিত হয়, এক্ষেত্রে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সত্তরদশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহের অবরোধের প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন তৎকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানীতেল প্রাপ্তির দাবী করেন যা বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পু্নর্গঠনের কাজ অনেকটা ত্বরান্বিত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়।

প্রাথমিকভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশি ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তার উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। তাই গঙ্গার পানি চুক্তি বিষয়ে জাতিসংঘে যাবার প্রেক্ষিতে কিছুটা টেনশন তৈরি হলেও জিয়াউর রহমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।‍

জিয়াউর রহমানের কর্মসুচী গুলোর একটা ভিন্ন মাত্রা হচ্ছে, এখানে অলস ভাতা এবং অলস সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দকে কর্ম নির্ভর বা উৎপাদনমুখী করা হয়েছে (কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাল কাটার বিনিময়ে মজুরি, উপবৃত্তি)। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ভাতা ও বরাদ্দের কৌশলে উৎপাদনের সম্পর্ক স্থাপনা করা হয়েছে। এতে যুদ্ধ পরবর্তি দেশের কর্মচাঞ্চল্য ফরে এসেছে। অভ্যন্তীণ উৎপাদন কৌশলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য মূখী পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগীতার ফ্রেইমোয়ার্ক তৈরি করে জিয়াউর রহমান দেশের অর্থনীতি সংহতকরণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।


  • লেখক ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা। 'বাংলাদেশঃ অর্থনীতির ৫০ বছর' এবং 'চতুর্থ
    শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ' গ্রন্থের লেখক। পরিবেশ, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন।